হাওয়া বদলঃ
হাওয়া বদলের অন্তর্গত টুকরো রচনাবলী অবনীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে কার্সিয়াং যাওয়ার পথে ও কার্সিয়াংয়ে বসে লেখা।
শিয়ালদহঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
সহরতলিঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
পদ্মাঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
জলপাইগুড়িঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
শিলিগুড়িঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
সুকনাঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
তিস্তাঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
পাহাড়তলিঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
পর্বতঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
পাহাড়িয়াঃ গদ্যছন্দ
বিচিত্রা, শ্রাবণ ১৩৩৪
পাহাড়িয়া রংমহলঃ গদ্যছন্দ
বিচিত্রা, ভাদ্র ১৩৩৪
পাহাড়িয়াঃ তিণদরিয়া
বিচিত্রা, আশ্বিন ১৩৩৪
পাহাড়িয়াঃ মেঘমণ্ডল
বিচিত্রা, কার্তিক ১৩৩৪
হাটবারঃ
বেণু, আশ্বিন ১৩৩৪
আতসবাজিঃ গদ্যছন্দ
উত্তরা, কার্তিক ১৩৩৪
হাওয়া বদলের অন্তর্গত টুকরো রচনাবলী অবনীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে কার্সিয়াং যাওয়ার পথে ও কার্সিয়াংয়ে বসে লেখা।
শিয়ালদহঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
সহরতলিঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
পদ্মাঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
জলপাইগুড়িঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
শিলিগুড়িঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
সুকনাঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
তিস্তাঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
পাহাড়তলিঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
পর্বতঃ
মানসী ও মর্ম্মবাণী বৈশাখ ১৩৩৪
পাহাড়িয়াঃ গদ্যছন্দ
বিচিত্রা, শ্রাবণ ১৩৩৪
পাহাড়িয়া রংমহলঃ গদ্যছন্দ
বিচিত্রা, ভাদ্র ১৩৩৪
পাহাড়িয়াঃ তিণদরিয়া
বিচিত্রা, আশ্বিন ১৩৩৪
পাহাড়িয়াঃ মেঘমণ্ডল
বিচিত্রা, কার্তিক ১৩৩৪
হাটবারঃ
বেণু, আশ্বিন ১৩৩৪
আতসবাজিঃ গদ্যছন্দ
উত্তরা, কার্তিক ১৩৩৪
হাওয়া বদল: শব্দচিত্র
আমার সকালে ঘুম ভাঙে না দেখে আমি নিজে থেকে একটা প্রহরী ঘড়ি (Alarm Clock) কিনে মাথার শিয়রে রেখেছিলেম, ঘড়ি রোজই ঠিক সূর্যোদয়ে চেঁচিয়ে ঘুম ভাঙায়, ঠিক যেভাবে নেতা ঘুম ভাঙাতে চলে ঘুমন্ত জাতির! তেমন করে জেগে দেখি সকাল ভালো লাগে না, কাজ ভালো লাগে না, মাথা ধরে। জাগার পরে, ঘুম যেন আরো বেশি করে জড়িয়ে আসে দেহে মনে! এমনি ভাবে জেগে আমার কোনো ফল হল না, শরীর মন দুইই খারাপ হয়ে উঠল দেখে প্রহরী ঘড়িকে ঘরে পাহাড়া দিতে রেখে আমি পাহাড়ে গিয়ে বাসা নিলেম। সেখানে জাগরণ একটি অজানা পাখির ডাকে মধুর হয়ে এল রাত্রিশেষে, তেমন করে জেগে আনন্দে ভরল প্রাণ, স্ফূর্তি পেল দেহ, ফিরে পেলেম অনেক দিনের হারানো স্বচ্ছন্দতা।
শিয়ালদহ
ই.বি.এস. আর বড়ো ইংরিজি অক্ষরে লেখা — সাদায় কালোয়, এলামাটি আর চক্লেট রং-দেওয়া দেয়ালে, খোঁচা খোঁচা কাঠের বেড়া তারি মাঝখানটাতে নুড়ি আর পাথুরে কয়লার সরু পথ দুটো সরু ইস্পাতের টানা-বাঁধনে বাঁধা। এরি মাঝে দাঁড়িয়ে একটা ইঞ্জিন হঠাৎ সিটি দিয়ে দূরের আকাশকে মাথকে টিনের ছাতগুলোকে ডাক দিলে। সারি সারি গাড়িগুলো চম্কে উঠে যেন দেখতে চলল ব্যাপার কি- সহরতলির দিকে।
E.B.S.R.
করকরে টিনের মস্ত মস্ত তালি-দেওয়া পাহাড়-প্রমাণ ঢালু ছাত, শুকনো পেঁয়াজের খোলার মতো রুখো আকাশ থেকে হিম আর বৃষ্টি ঝ'রে ঝ'রে টিনের গায়ে লঙ্কা বাটার ঝাল রঙ ধরিয়েছে। সেই ছাদের তলায় সারি সারি ঢাকা-দেওয়া ঘ্র পরদেশে নিয়ে চলে পাত্রের পুত্র সদাগর পুত্র কোটালের পুত্র কত পিতামাতা পুত্রকলত্র পোঁটলা পুঁটলি লোকলস্কর মালপত্র। গরুর গাড়িগুলো সারি সারি পথের ধারে দাঁড়িয়ে ঘাড় তুলে চেয়ে থাকে অবাক হয়ে বসে মায়ের গলার সোনার হারখানা [দেখে] আর দুয়োরানীর পুত্র জালনা দিয়ে একটি রোগা হাত বাড়িয়ে তাকে বলে, পয়সা পয়সা পান বিড়ি সিগারেট!
সহরতলি
সাবানের কারখানা, সুরকি মিল, তেল কল, সোজা সোজা চিম্নি— এর মাঝে দাঁড়িয়ে, ডাইনে হেলে বাঁয়ে হেলে, ক'টা নারকেল গাছ— কোনো একটার আড়াইখানার বেশি পাতা নেই, তাও আবার আধ-শুকনো! কতকালের বে-মেরামৎ কে জানে কার বাগানবাড়ি। সে-কালের বাড়িতে একালের টালি-ছাতের তালি-দেওয়া গেরোস্তো বাড়ি, মস্ত লম্বা দীঘি— খানিকটা ভর্তি আস্তাকুড়ের আবর্জনায়, খানিকটাতে পড়েছে সবুজ পানা, তারি একটু ফাঁকে থিতোনো জলে পড়েছে পেঁয়াজের খোলার মতো অপরিষ্কার লাল আলোর টান্-টোন্ বিকেল বেলায়!
পদ্মা
লোহার ঝাঝরের ঝনৎকার, তারি তলায় পদ্মার নিথ্র জল রাত্রির সমান নীল স্তব্ধ। কূল নেই কিনারা নেই, ঘাট আঘাট আরম্ভ শেষ কিছু পাইনে, শুধু পাই দেখা দূর থেকে একখানি নৌকোর মাঝ দরিয়াতে— সে ঘুমে ভারি লঙ্গর নামিয়ে স্থির হয়েছে!
জলপাইগুড়ি
দুধারে মাঠ বলে উঠেছে রাত কাটল— রেলগাড়ি হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটেছে ইস্টিসেনের ঘড়ি কি বলে তাই দেখতে।
শিলিগুড়ি
সারি সারি সবুজ গুল্-বোনা সতরঞ্চি, তারি উপরে একটা মস্ত কাছিমের খোলা, টিনের তৈরি। রাতের হিমে ভিজে উঠে সেটা টিহি (T.E)— শব্দ করছে— সবুজ নিশেনের ইসারা পেয়ে বাচ্ছা ইঞ্জিন চলল মানুষ-বোঝাই ছোট ছোট বাক্সো নিয়ে হিমালয় টপকাতে। প্ল্যাটফর্মে টেবিলে- ধরা চায়ের কেট্লি— সে গলা তুলে চেয়ে দেখছে কান্ড ইস্টিম ইঞ্জিনের!
সুক্না
ইঞ্জিন সিটি দিয়ে দুরের একটা ঢালু ছাতকে বললে কত বড়ো পাহাড় দেখে নেব! দুর্জয় পাহাড়ের চূড়ো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে বললে— বাসরে তবে তো আমি নেই।
সুক্নার জঙ্গল
দিনদুপুরে নিশুতিরাতের কাজলঢালা গহন বন। বনের তলা রোদে ঝিক্ঝিক্, গাছের আগা চাঁদে চিক্মিক্। গাছ বেড়েছে রূপকথার রূপের লতা, ফুল ধরেছে সকালবেলার সন্ধ্যামণি।
বনপথ
তল-পাহাড়ের বনের ধারে কাঠ-বোঝাই বয়েল গাড়ি থামিয়েছে কাঠুরে— চলন্ত রেলগাড়িতে গলাবন্ধ আর অলস্টার পরা ছোট্ট রাজপুত্রটি ফাঁকে ফাঁকে চোখ দিয়ে মৃগয়া করে চলেছে তীরবেগে পক্ষী-রাজ ঘোড়া ছুটিয়ে।
তিস্তা
আকাশের নীল, পাহাড়ের গায়ে গড়িয়ে পড়েছে, পাহাড়ের নীল বালিয়াড়ির বুকের পথে বইছে কূলহারা সমুদ্রজলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে!
পাহাড়তলি
সকালের কুয়াশা হিমে মন্থর— মাঠ ছেড়ে সে যেতেই চায় না! বালির বুকে নদীর ধারা শীতে
মন্থর— চলতেই চায় না পাহারতলি ছেড়ে। গাড়ি ছুটেছে তো ছুটেইছে— থামতেই চায় না!
পর্বত
মন বলে দিন-দুপুর, বন বলে নিশুতি-রাত! বনের ফাঁকে ফাঁকে আকাশ বলে শরৎকাল, গাছের পাতায় পাতায় ঝিঁঝি বলে বর্ষা যায় নি বৃষ্টি থামে নি মেঘ লেগেছে দিকে দিকে!
তল-পাহাড়ের বনের ধারে তালাবন্ধ ভাঙ্গা ঘর। দাওয়ায় বসে একটা ভুলো কুকুর কান চুলকোচ্ছে। রেলগাড়ি সেখানে এসে কি ভেবে হটাৎ দাঁড়িয়ে গেল! গাড়ির মধ্যে গলাবন্ধ আর অলস্টার-মোড়া ছোট্ট রাজপুত্র একটা কমলালেবু টপ্ করে বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠল— বাগা মামা! ইঞ্জিন অম্নি বাঁশি বাজিয়ে দিলে, গাড়িও হেলতে দুলতে নাচতে নাচতে বনের দিকে এগোল। তালাবন্ধ বাড়ি ছুটে পালাল, বনের গাছ তারাও, ভুলো বসে বসে কান চুলকোতেই থাকল ঠিক যেখানকার সেখানে, নড়লও না! দেখা বন, সারি সারি গাছ সেখানে পাহাড়া দিচ্ছে, এরি পরেই রূপকথার বন। যাবার বেলায় সেখানের গাছগুলো স্ব ঘুরে ঘুরে দৌড়ে নামে তরাই ক্ষেতে। আসার বেলা গাছ সব দৌড়ে ওঠে চড়াই পথে! চাঁদের আলো পড়ে সেখানে গাছের শিয়রে, শিকড়ে এসে লাগে তাদের দিন-দুপুরের রোদ। সকালের কুঁড়িতে সেখানে সন্ধ্যামণি ফুল ফোটে, সেখান থেকে কাঠকুড়ুনি এক রানী সে দেখে বনের উপর দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট খেলার গাড়ি বাঁশি দিতে দিতে গিয়ে থাম্ল পাহাড়ের একটা মোড়ে।
গাড়ি থেকে উঁকি দিয়ে রাজপুত্র দেখেন, কাঠকুড়ুনি চলতে চলতে মিলিয়ে গেল বনের ছায়ায়!
পেটা লোহার সরু একখানা মই, তারি তলায় পেরেকে-গাঁথা একফালি সরু পথ। অতল খাতের ধারে পথটা পাছে পাহাড় থেকে পিছলে পড়ে তাই একটা মস্ত পাথর পিঠ দিয়ে তাকে ঠেসে ধরেছে। পাহাড়ের সঙ্গে এরি উপর দিয়ে রেল নির্ভয়ে দৌড়োয়, পাহাড়ি ঝাউ ইস্ ইস্ বলে আর ক্রমাগত সাম্লাতে চলে।
কাছে স্টেশন ঘর, কোথাও কিছু নেই। গাড়িগুলো সেখানে হটাৎ নিশেন হাতে একটা লোক দেখে চম্কে পিছন হটে গড় গড় করে খানিক নীচের পাহাড়ে গড়িয়ে প'ড়ে থেমে থাকে বনের মাঝে। শীতের কুয়াশা তল-পাহাড়ের ঢালু বেয়ে আস্তে আস্তে উঠে আসে— কি হল তাই দেখতে!
সুন্সান্ বনের তলা। সোনা রুপোর গাছে পাতায় পাতায় রোদ ঝিক্ঝিক্ করছে। রেলরাস্তার স্তূপাকার ঢেলা দেখাদেখি খানিক বালি আর আবোর মেখে যেন রোদ পোহাতে লেগেছে এমনি ভাব দেখাচ্ছে!
ইস্পাতে কাঁটা একটা 'দ' রোদ পোহাচ্ছে, পাহাড়ের গায়ে কাত হয়ে পড়ে আছে সেখানে গাড়িগুলোর ঝুঁটি ধরে টানে একটা ইঞ্জিন, পিঠে ধাক্কা মারে আর একটা, আর বলে— পড়বি নে চল্!
বনের মধ্যে সরু দুটো তারের ফাঁসি— পড়ে আছে তো পড়েই আছে। তার উপর দিয়ে ইঞ্জিনে আর গাড়িগুলোতে ওঠা-নামা খেলা দুবেলা চলছে!
খাঁচার মতো কয়েকটা কাঠের ঘর, কিন্তু তাকে ঘিরে বসেই আছে কতদিন তার ঠিক নেই— ফাঁসে কি পড়ে তাই দেখতে গাছের ছাওয়া, মেঘলা দিনের হাওয়া আসছে যাচ্ছে--
কিছুই দেখা যায় না, তার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে রেলগাড়ি হটাৎ একটা ঘরের মধ্যে এসে পড়ায় সেখানে দেয়ালের গায়ে বড়ো বড়ো করে লেখা— মহানদী। জল ঝরার শব্দ নেই। শুধু একটা পাহাড়ের মোড়ে গাঁথা চৌবাচ্ছা। বাচ্ছা ইঞ্জিন গাড়িগুলোকে একলা ফেলে দৌড়ে যায় সেদিকে জল খেয়ে নিতে!
অপরিচয় ঢেউ দিয়ে উঠেছে সামনে,— পরিচিত অতি- পরিচিত দুটো পাশাপাশি টানা ইস্পাতের লাইন ধরে যাত্রিবোঝাই গাড়ি ছুটেছে এরি দিকে, কিন্তু ছুটে ছুটে পথের শেষ পাচ্ছে না!
পাহাড়ের নীল চন্দন গড়িয়ে পড়েছে পাহারতলির বালিয়াড়ির বুকে, নীল আকাশের স্বপ্ন রেখা রচনা করে। এর সঙ্গে মিলেছে গত বর্ষার ভরা নদীর বুকের তলায় নীল সমুদ্রের যে স্বপ্ন লুকিয়ে ছিল তারই সজল নীল।
নিথর নীল জল রাত্রির সমান স্তব্ধ, কূল পায় না কিনারা পায় না, ঘাট আঘাট আরম্ভ শেষ কিছুই পায় না। কেবলি মাঝ-দরিয়া, কেবলি একলা মাঝি ঘুমে ভারি নৌকো ভাসিয়ে--
ভাদরের ভরা নদী নেই, পাহাড়তলায় বালিয়াড়ি, তারই বুক জুড়িয়ে শরতের আলোয় ঝিল্মিল্ স্রোতের তলাকার অতল-নীল ভাবনা!
প্রথম যুগের ফুল দোল— উত্তর পর্বতে তারি হিল্লোল— অপরাজিতার নিস্পন্দ নীল, মালতীফুলের হিমে-ঢালা নীল, গভীর জলে ছায়া-পদ্মের নীল!
আলো-করা শরতের মেঘ ছু'য়ে ছু'য়ে বকের পাঁতি উড়ে উড়ে যায় মাঠের ধারে ধারে, বাঁধে কুয়াশার তলায় শিশিরে-ভেজা শ্বেতপদ্মের ক্লি; তারা স্থির হয়ে থাকে ঘুমন্ত আর এক ঝাঁক পাখির মতো!
উত্তর পর্বতের মেঘ আর কুয়াশাতে নিরুত্তর দিক্, এরি বুকে পাষাণে-গড়া চারটি মিনার—আলিফ্ অক্ষরের মত সরল সুন্দর। এরি একটি মিনার সেই শুধু বলে মানুষের গলার সুরে সুরে—"লা-ইলাহ-ইল্লাল্লা" এরি প্রতিধ্বনি দেয় উত্তরের পর্বত-চূড়া একের পরে এক সকালে, সন্ধ্যায়, রাতে।
উত্তরে তুষার-পর্বতের নিশ্চল তরঙ্গ, দক্ষিণে পাহাড়তলায় যতদূর দেখা যায় কেবলি মেঘ আর কুয়াশার সমুদ্র, এরি মাঝখানে একটি কালো পাথর আর তাকে জড়িয়ে একটি বনলতা। পাথর সে কাঞ্চনশৃঙ্গের দিকে চেয়ে সকাল-সন্ধ্যা সোনার আল-মাখা মস্ত একটা স্বপ্ন দেখলে আর বনলতা সে পাহাড়-তলার দিকে চেয়ে মেঘ-সমুদ্রের তলাকার সবুজ বন আর ধানে-ভরা মাঠের স্বপ্ন দেখলে! এই দুই স্বপ্ন এক হয়ে একটি সোনার পাতার রূপ ধরে বেরিয়ে এল— গোপন একটি ঝরনার ধারে! উত্তর থেকে হিম-বাতাস কাঞ্চনশৃঙ্গের কথা তার কানে কানে বলে যায়, পাহাড়তলি থেকে মেঘ উঠে এসে তাকে সবুজ বনের খবর জানায়, সবুজ বৃন্তে বাঁধা সোনার পাতার মন পাথরের উপর থেকে উঁকি দেয় এদিকে অদিকে, ঝরনা সে দিনরাত শুনিয়ে চলে তাকে অকূল কালো জলের ডাক।
ঊষার আলো শীত-কাতর পাখির মতো প্রহরের প্র প্রহর চুপ করে সামনের পাহাড়ে বসে আছে, বরফের একটা চূড়া আকাশের ঠেস দিয়ে স্থির হয়ে হারানো সূর্যের ধ্যান করছে—একটা ঝরনার পাথর তরায়ের জঙ্গলে ছোট একটি নদীর দিকে ঝুকে রয়েছে, আর একটা পাতা-ঝরা শীতের গাছ দেখছে চুপ্টি করে— রঙিন প্রজাপতির মত একদল বাগানের কুলি চা-ক্ষেতে উড়ে বসেছে।