টুং-সোন্নাটা-ঘুম
সুরেশ্বর ছেড়ে বৃষ্টি আরম্ভ হল। এতদিন রোদে কাঠ ফাটছিল। সকালে যখন হাঁসের দল যাত্রা করে বার হল তখন আকাশ বেশ পরিষ্কার, কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের রাস্তা ধরে যতই তারা উত্তর-মুখে এগিয়ে চলল, ততই মেঘ আর কুয়াশা আর সঙ্গে-সঙ্গে বৃষ্টি দেখা দিলে! হাঁসের ডানায় পাহাড়ের হাওয়া লেগেছে, তারা মেঘ কাটিয়ে হু হু করে চলেছে; মাটির পাখিদের সঙ্গে রঙতামাশা করে বকতে-বকতে চলবার আর সময় নেই, তারা কেবলি টানা সুরে ডেকে চলেছে – “কোথায়, হেথায়, কোথায়, হেথায়।”
হাঁসের দলের সাড়া পেয়ে ব্রহ্মপুত্রের দুপারের কুঁকড়ো ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে জানান দিতে শুরু করলে। পুব-পারের কুঁকড়ো হাঁকলে – “সাতনল চন্দনপুর, কোমিল্লা, আগরতলার রাজবাড়ি, টিপারা, হীলটিপারা!” পশ্চিমপারের কুঁকড়ো হাঁকলে – “ভেংচার চর”, পশ্চিমে হাঁকলে – “চর ভিন-দোর।”
হাঁসেরা তেজে চলেছে, এবার ছোট-ছোট গ্রাম, নদীর আর নাম শোনা যাচ্ছে না, বড়-বড় জায়গার কুঁকড়ো হাঁকছে – “পাবনা, রামপুরবোয়ালিয়া, বোগরা, রাজসাহি, দিনাজপুর, রংপুর, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি!” পুবের কুঁকড়ো অমনি ডেকে বললে – “খাসিয়া-পাহাড়, গারো-পাহাড়, জৈঁতিয়া-পর্বত, কামরূপ।”
বুনো-হাঁসের দল পাহাড়-পর্বত অনেক দেখেছে, শিলিগুড়ি থেকে হিমালয় ডিঙিয়ে মানস-সরোবরে চট করে গিয়ে পড়া গেলেও তারা শিলিগুড়ি থেকে ডাইনে ফিরে, ফুলচাড়ি, হাড়গিলের চর, ধুবড়ি, শিলং, গৌহাটি, দিব্রুগড়, কামরূপ হয়ে যাবার মতলব করলে, কেননা, দার্জিলিঙ হয়ে যাওয়া মানে ঝড়-ঝাপটা, বরফের উপর দিয়ে যাওয়া, আর কামরূপের পথে গেলে ব্রহ্মপুত্র-নদের দুধারে নগরে গ্রামে চরে জিরিয়ে যাওয়া চলে।
রিদয় কিন্তু বেঁকে বসল, এত কাছে এসে দার্জিলিঙ যদি দেখা না হল তো হল কি? খোঁড়া-হাঁসের যদিও পায়ে বাত তবু রিদয়ের কথাতেই সে সায় দিয়ে বসল! ঠিক এই সময় শিলিগুড়ি থেকে ছোট রেল বাঁশি দিয়ে পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করলে, রিদয় আকাশের উপর থেকে দেখলে, যেন শাদা-কালো একটি গুটিপোকা এঁকে-বেঁকে পাহাড়ের গা বেয়ে চলেছে – হাসে চড়া রিদয়ের অভ্যেস, রেল এত ঢিমে চলছে দেখে ভেবেছিল, গুগলীর মতো কত বছরই লাগবে ওটার দার্জিলিঙ পৌঁছতে!
রিদয় চকাকে শুধোলে, “ওটা কতদিনে দার্জিলিঙ পৌঁছবে?”
চকা উত্তর দিলে – “এই সকাল আটটায় ছাড়ল, বেলা তিনটে-চারটেতে পৌঁছে যাবে!”
“আর আমরা কতক্ষণে সেখানে যেতে পারি” – রিদয় শুধোলে।
চকা উত্তর করলে – “যদি রাস্তায় কুয়াশা, হিম না পাই, তবে বড় জোর এক-ঘণ্টায় ‘ঘুম-লেকে’ গিয়ে নামতে পারি, সেখান থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে সিঞ্চল, কালিম্পং, লিবং, সন্দকফু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে কার্সিয়াং, টুং-সোনাদা হয়ে আবার ঘুমেতে নেমে একটু জল খেয়ে একচোট ঘুমিয়ে নিয়ে বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ দার্জিলিঙ-ক্যালকাটা রোডের ধারে আলুবাড়ির গুম্ফাটার কাছটায় তোমায় নামিয়ে দিতে পারি। আমরা তিব্বতের হাঁস, তার ওদিকে যাবার যো নেই – গেলেই গোরারা গুলি চালাবে!”
এত সহজে দার্জিলিঙ দেখা যাবে জেনে খোঁড়া-হাঁস পর্যন্ত নেচে উঠল। চকা তখন বললে – “এতবড় দল নিয়ে তো পাহাড়ে চলা দায়, ছোট রেলের মতো আমাদেরও ছোট করে ফেলা যাক। বড়-দলটা নিয়ে আন্দামানি কামরূপে হাড়গিলে চরে গিয়ে অপেক্ষা করুক; আর আমি, খোঁড়া, হংপাল, কাটচাল, নানকৌড়ি, চল দার্জিলিঙ দেখে আসি।” শিলিগুড়ি থেকে হাঁসের দল দুই ভাগ হয়ে চলল, ঠিক সেই সময় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নামল। কাঠ-ফাটা রোদের পরে নতুন বৃষ্টি পেয়ে মাটি ভিজে উঠেছে, পাতা গজিয়ে উঠেছে, বনের পাখিরা আনন্দে উলু-উলু দিয়ে কেবলি বলতে লেগেছে, বৃষ্টির গানঃ
বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর
বাজছে বাদল গামুর-গুমুর
ডাল-চাল আর মক্কা-মসুর
ফোঁটায়-ফোঁটায় নামে –
আকাশ থেকে নামে –
জলের সাথে নামে –
ঘরে ঘরে নামে –
টাপুর-টুপুর গামুর-গুমুর
গামুর-গুমুর টাপুর-টুপুর।
‘তিষ্টা’ নদীর কাছে এসে হাঁসেরা শুনলে নদীর দুপারে সবাই বলছেঃ
মেঘ লেগেছে কালা-ধলা
বইছে বাতাস জলা-জলা
বরফ-গলা পাগল-ঝোরা
শুকনা ধুয়ে আসে
তিষ্টা নদীর পাশে –
ঝাপুর-ঝুপুর ছাপুর-ছুপুর
ছাপুর-ছুপুর ঝাপুর-ঝুপুর।
নতুন জল-বাতাস পেয়ে পৃথিবী জুড়ে সবাই রোল তুলেছে, আকাশের হাঁসেরাই বা চুপ করে থাকে কেমন করে, তারা পাহাড়ের গাঁয়ে সিঁড়ির মতো ধাপে-ধাপে আলু, পেঁয়াজ, শাক-সবজী ক্ষেতগুলোর ধার দিয়ে ডাকতে-ডাকতে চলল – “রসা-জমি ধসে পড় না, বসে থেক না, ফসল ধরাও। নতুন বীজে ফল ধরাও!”
পাগলা-ঝোরার কাছ বরাবর এসে একখানা প্রকাণ্ড মেঘ হাঁসেদের সঙ্গ নিয়ে উত্তরমুখে চলল। কলকাতার এক বাবু পাহাড়ে রাস্তায় রবারের জুতো রবারের ওয়াটারপ্রুফ পরে বিষ্টির ভয়ে নাকে-কানে গলাবন্ধ জড়িয়ে মোটা এক চুরুট টানতে-টানতে ছাতা খুলে হাঁফাতে-হাঁফাতে চড়াই ভেঙে তাড়াতাড়ি বাড়ি-মুখো হয়েছেন দেখে হাঁসেরা রঙ্গ জুড়লেঃ
জল চাও না, চাও কিন্তু খাসা পাউরুটি
হয় না তো সিটি!
জলের ভয়ে তাড়াতাড়ি খুললে কেন ছাতা!
জল না হলে গাছে-গাছে ফলে পেঁপে আতা?
জল না পেলে কোথায় আলু পটোল চা!
হত নাকো রবার গাছ কিসে ঢাকতে পা?
বিষ্টি নইলে ছিষ্টি নষ্ট, সেটা মনে রেখ –
মেঘ দেখলে নাক তোলো তো উপোস করে থেক!
সকালে পাবে না ফল, রাতে জ্বলবে আঁত
না পাবে নদীতে মাছ ক্ষেতেতে ফসল –
ফোঁটা-ফোঁটা ঝরবে তখন তোমার চোখের জল।
বাবু একবার ছাতার মধ্যে থেকে আকাশে চেয়ে দেখলেন, রিদয় টুপ করে তার নাকের উপর একখানা শিল ফেলে হাততালি দিতে-দিতে হাঁসের পিঠে চড়ে চলল। মেঘখানা শিল বর্ষাতে-বর্ষাতে হাঁসের দলের পিছনে পিছনে আসছে, আর হাঁসেরা সারি দিয়ে আগে-আগে যেন মেঘখানাকে টেনে নিয়ে চলেছে – আকাশ দিয়ে পুষ্পকরথের মতো। তিন দরিয়ার অনেক উপরে দুই পাহাড়ের দেয়াল যেন কেল্লার বুরুজের মতো সোজা আকাশ ঠেলে উঠেছে একেবারে মেঘের কাছে, তারি গায়ে পাগলা-ঝোরা ঝরনা শাদা পৈতের মতো পাহাড়ের গা বেয়ে গাছ-পালার মধ্যে দিয়ে ঝুলে পড়েছে – এই পাহাড়ের দেওয়াল ডিঙিয়ে হাঁসেরা কা কার্সিয়ং-এর মুখে চলল – পাংখাবাড়ি থেকে কার্সিয়ং দুধারে ঝরনা আর চা বাগান সবজীক্ষেত থাকে-থাকে পাহাড়ের গায়ে বস্তি, সাহেবদের কুঠি, কার্সিয়ং শহরটা যেন আর এক ঝরনার মতো দেখা যাচ্ছে – পাহাড়ি গোলাপ গেঁদা গাছ-আগাছায় কুঁড়ি ধরেছে।
বাঁ ধারে দূরে কালো-কালো পাহাড়ের শিখরে বরফের পাহাড় যেন দুধের ফেনার মতো উথলে পড়েছে। একদল বাঙালী বৌ ছেলেপুলে নিয়ে কার্সিয়ং-এর ইস্টিশনের উপরের রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছে – গিন্নি সবে অসুখ থেকে উঠেছেন, তিনি ছাতি মাথায় দাণ্ডি চেপে চলেছেন, কর্তা লাঠি ধরে সঙ্গে, পিছনে চার মেয়ে, ছোট বড় তিন ছেলে, এক বৌ, দুই জামাই, একপাল নাতিপুতি হাসি-খুশি লুটোপুটি করে চলেছে! কেউ পাহাড় থেকে ফুল তুলছে, কেউ রাস্তা থেকে নুড়ি কুড়োচ্ছে, একটা ছেলের হাতে প্রজাপতির কুড়োজাল দেখে রিদয় চেঁচিয়ে বলল – “ধর না, ধর না, যক্ হবে।”
হাঁসেরা বলে চলল – “ফুল যত চাও তোল, গোলাপ ফুটল বলে, গাঁদা ওই ফুটেছে, চেরি ফুলে রঙ ধরেছে, আমরা এনেছি, নাও কলাই-শুটি নাও, ফুলকপি নাও, আপেল নাও, নাসপাতি যত পার নাও খাও দাও থোও, প্রজাপতি ধরা ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও!”
দেখতে-দেখতে মেঘে কার্সিয়ং ঢেকে গেল, ছেলে-বুড়ো ঘর-বাড়ি বাজার-ইস্টিশান মায় ছোট রেল গিদা পাহাড় ডাউন হিল সব কুয়াশায় চাপা পড়ল, দূরে সিঞ্চল মেঘের উপরে মাথা তুলে দেখা দিল! এইবার রিদয়ের শীত আরম্ভ হল। খোঁড়া-হাঁস ডানা ছড়িয়ে উড়ে চলেছে পালকের মধ্যে ঢোকবার যো নেই, জলে শীতে থরথর করে বেচারা কাঁপতে লাগল, খোঁড়াও বাঙলাদেশের মানুষ, পাহাড়ের শীতে তারও ডানার পালকগুলো কাঁটা দিয়ে উঠল, সে ডাক দিলে – “শীত-শীত হংপাল শীতে গেল।”
চকা হাঁকলে – “নেমে পড় কার্সিয়ং!”
হাঁসেরা অমনি মেঘের মধ্যে দিয়ে নামতে শুরু করলে। রিদয় দেখল, মেঘের মধ্যেটায় খোলা আকাশের চেয়ে কম ঠাণ্ডা, যেন পাতলা তুলোর বালাপোষ গায়ে দিয়েছে। হাঁসেরা নামতে-নামতে একটা বাড়ির ছাতে এসে বসল। বাড়ির বাইরে কেউ নেই, কুয়াশার ভয়ে সবাই ঘরে কাঁচ বন্ধ করে বসেছে, বাইরে কেবল গালফুলো একটুখানি একটা পাহাড়ি ছোঁড়া আগুন জ্বেলে কচি ছেলের একজোড়া পশমের মোজা তাতিয়ে নিচ্ছে আর সেই সঙ্গে নিজের হাত-পাগুলোও একটু সেঁকে নিচ্ছে, এমন সময় ঘর থেকে বাড়ির গিন্নী ডাক দিলেন – “টুকনী!”
ছেলেটা অমনি তাড়াতাড়ি হাতের মোজা জোড়া মাটিতে ফেলে দৌড় দিলে, চকা অমনি ছোঁ দিয়ে মোজাটা নিয়ে রিদয়কে দিয়ে বললে – “পড়ে ফেল উলের জামা।” রিদয় মোজাটা মাথায় গলিয়ে ছেঁড়া মোজার তিনটে ছেঁদা দিয়ে হাত আর মাথা বার করে ফিট হয়ে যেন সোয়েটার পরে দাঁড়াল।
হাঁসের দল তাকে পিঠে নিয়ে আকাশে উঠল – টুকনী ছোঁড়াটা নিচে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল – ‘আরে-আরে হাঁস মোজা লেকে ভাগা!”
রিদয় শুনলে গিন্নি চেঁচাচ্ছেন – “হাঁসে কখনও মোজা নেয়? নিশ্চয় মোজাটা পুড়িয়ে রেখে মিছে কথা বলছে! ফের ঝুটবাত বোলতা!”
টুকনীর মোজা-পোড়ানোর মামলার শেষ কি হল দেখবার আর সময় হল না! মেঘ তখন মুষলধারায় জল ঢালতে আরম্ভ করেছে, হাঁসেরা তাড়াতাড়ি মেঘ ছাড়িয়ে উঠতে লাগল আর বন-জঙ্গলকে ডেকে বলতে লাগল – “কত জল আর চাই বল, তেষ্টা যে মেটে না দেখি, মেটে না দেখি!” কিন্তু দেখতে দেখতে আকাশ নীল মেঘে ছেয়ে গেল, সূর্য কোথায় কোনদিকে তার ঠিক নেই, হাঁসেদের ডানার উপরে বিষ্টি ক্রমাগত চাবুকের মত পড়ছে, ডানার পালক ভিজে তাদের বুকের পালকে পর্যন্ত জল সেঁধিয়েছে, পাহাড়-পর্বত চড়াই-নাবাই গাছ-পালা ঘন কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেছে – দু’হাত আগে নজর চলে না। পাখিদের গান থেমে গেছে। হাঁসরা চলেছে ধীরে-ধীরে পথ খুঁজে-খুঁজে; রিদয় শীতে কাঁপছে আর ভাবছে, চুরি করার এই শাস্তি।
এই মেঘ আর কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চকা-নিকোবর যখন তাদের কটিকে নিয়ে সিঞ্চল পাহাড়ের সিঙে একটা ঝাউতলায় এসে বসল, তখন যেন রিদয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! পাহাড়ের চুড়োয় কেবল সোনালী ঘাসের বন আর এক-একটা ছাতার মতো প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পাথর বরফ-জল বয়ে চলেছে, পাতায়-পাতায় টিপটিপ করে বিষ্টি লাগছে কিন্তু শীত হলেও হাওয়া এখানে এমন পরিষ্কার যে রিদয় আনন্দে এদিকে-ওদিকে ছুটে বেড়াতে লাগল! বুনো-টেঁপারি- সোনালী-পাতা রুপোলী পাতা সোনা-ঘাস তুলে-তুলে রিদয় বোঝা বাঁধছে দেখে চকা হেসে বললে – “এগুলো হবে কি?”
রিদয় অমনি বলে উঠল – “দেশে গিয়ে দেখাব!”
খোঁড়া-হাঁস ভয় পেয়ে বললে – “ওই সমস্ত বোঝা নিয়ে ওড়া আমার কর্ম নয়, তুমি তবে রেলে করে বাড়ি যাও!”
চকা রিদয়কে ডেকে বললে – “খুব-কাজের জিনিস ছাড়া একটি বাজে জিনিস সঙ্গে নেওয়া আমাদের নিয়ম নয়, পেট ভরে টেঁপারি খাও তাতে আপত্তি নেই, ঘাস দু’কানে গুঁজতে পার তার বেশি নয়!”
রিদয় দু’কানে দুটো ঘাস গুঁজে টেঁপারি খেয়ে বেড়াচ্ছে এমন সময় ভালুকের সঙ্গে দেখা! রিদয় ভালুক নাচ অনেক দেখেছে কিন্তু এত বড় এমন রোঁয়াওয়ালা মিস-কালো ভালুক সে কোনোদিন দেখেনি, ভালুক তাকে দেখে দু’পা তুলে থপ-থপ করে এগিয়ে এসে বললে – “এখানে মানুষ হয়ে কি করতে এসেছ? পালাও না হলে শীতে মরে যাবে, বড় খারাপ জায়গা। গোরাগুলো পর্যন্ত এখানে টিক্তে পারেনি, কত লোক যে এখানে ঠাণ্ডা আর রাতের বেলায় ভূতের ভয়ে কেঁপে মরেছে তার ঠিক নেই। এখানে এককালে গোরা-বারিক ছিল কাণ্ডেল জাঁদরেল সব এখানে থাকত, এখন আর কেউ নেই। কোথায় গেছে তাদের বাগ-বাগিচা বাজার শহর, কেবল দেখ চারদিকে আগুন জ্বালাবার চুলোগুলো পড়ে আছে, শীতে সব গোরা ভূত বেরিয়ে এই-সব ভাঙাচুলির ধারে বসে আগুন পোহায় আর মদ খায়, হুক্কা-হুয়া গান গায়।”
ঠিক এই সময়ে শেয়াল-ডাকের মতো গান শোনা গেল, আর মেম সঙ্গে একটা গোরা বোতল হাতে টলতে-টলতে আসছে দেখা গেল। ভালুককে দূর থেকে দেখেই গোরা যেমন বন্দুক উঁচিয়েছে, অমনি ভালুক চট করে গাছের তলায় অন্ধকারে কালোয়-কালো মিশিয়ে গেছে! রিদয়ের গায়ে টকটকে মোজা – মেম তাকে ভাবলে কার পোষা বাঁদর, সে অমনি “মাংকি-মাংকি” বলে রিদয়কে ধরতে ছুটল! রিদয় তাড়াতাড়ি যেমন পালাতে যাবে অমনি পাহাড় থেকে গড়াতে-গড়াতে একেবারে কার্ট রোডে মাল-বোঝাই ছোট রেলের ছাতে এসে চিৎপাত!
রেলটা ঝরনা থেকে ফোঁস-ফোঁস করে খানিক জল ইঞ্জিনে ভরে নিয়ে ঘুম জোড়াবাংলার দিকে চলল ভক-ভক করে বকতে-বকতে। এদিকে ভালুকের কাছে খবর পেয়ে হাঁসেরা উড়েছে ঠিক রেলের সঙ্গে সঙ্গে – তারা দেখছে, রিদয় মালগাড়ির উপরটায় যেন একটি লাল নিশেনের মতো লটপট করছে। ঘুম বস্তিতে এসে রেল থামল। হাঁসেরা অমনি হাঁক দিলে – “ঘুম লেক যাও তো নেমে পড়!” কিন্তু তখন গাড়ির ঝাঁকানিতে রিদয়ের ঘুম এসেছে, সে হাত নেড়ে জানালে – “দার্জিলিঙ যাব!” এই সময় গাড়ির মধ্য থেকে একপাল ছেলে চেঁচিয়ে উঠল – “টুং সোনাদা ঘুম!” রিদয় চমকে উঠে দেখলে গাড়ি ছেড়েছে।
ঘুমের পরেই ‘বাতাসীয়া’ লাইন খুলেছে – এক-একটা পাহাড় কেটে সেগুলো কেল্লার বুরুজের মতো পাথরের টালি দিয়ে পাহাড়ি মিস্ত্রি সব গেঁথে তুলেছে। রিদয়ের মনে হল, ঠিক যেন কেল্লার মধ্যে ঢুকেছি! ঠিক সেই সময় হাঁসের দল ডাক দিল – “বাতাসীয়া বাতাস-জোর, ধরে বস্!” কিন্তু গুছিয়ে বসবার আগেই রিদয় বাতাসে লাল ছাতার মতো উড়ে একেবারে পথের মাঝে এসে বসল। সোঁ-সোঁ করে বাঁশি দিয়ে রেল দারজিলিঙের দিকে বেরিয়ে গেল।
পাহাড়ের মোড়টা সুনসান, লোক নেই, দূর থেকে একটা মোষের গাড়ি আসছে। রিদয় আস্তে-আস্তে সেই মোষের গাড়ি ধরে ঝুলতে-ঝুলতে দার্জিলিঙের বাজারে হাজির। হাঁসেরা মাথার উপর ডাক দিয়ে গেল – “আলুবাড়ি গুম্ফা মনে রেখ, সেখানে আমরা রইব।” রিদয় আলুবাড়ি-আলুবাড়ি নাম মুখস্থ করতে-করতে বাজার দেখতে চলল। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে – অন্ধকারে রিদয় ভিড়ের মধ্যে মিশে চলেছে। বাজারের ওধারে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়ে বরফের উপর সন্ধ্যার আলো যেন সোনার মতো ঝলক দিয়ে উঠল। তারপর গোলাপী, গোলাপী থেকে বেগুনী হয়ে আবার যে শাদা সেই শাদা বরফ দেখা দিলে। সেই সময় চৌরাস্তায় গোরার বাদ্যি শুরু হল, আর দলে-দলে লোক সেই দিকে ছুটল। রাস্তার দুধারে জুতো, খাবার, বাসন, গহনার দোকান – এখানে-ওখানে ভুটিয়া লামারা মড়ার মাথার খুলি নিয়ে ঘণ্টা-ডমরু বাজিয়ে নন্দি-ভৃঙ্গির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ের রাস্তা কখনো রিদয় ভাঙেনি, দু-এক চড়াই উঠে বেচারা হাঁপিয়ে পড়ল; কোথায় বসে জিরোব ভাবছে এমন সময় একটা খেলনার দোকানে নজর পড়ল, সেখানে লাল উলের মোজা পরানো ঠিক তারি মতো অনেকগুলো পুতুল সার্শির গায়ে কাগজের বাক্সোতে দাঁড় করানো রয়েছে! রিদয় চুপি-চুপি দোকানে ঢুকে একটা খালি বাক্স দেখে তারি মধ্যে শুয়ে রইল।
সার্শিমোড়া দোকানের মধ্যে বেশ গরম, এক খোট্টা বাবু বসে বিড়ি টানছেন আর একটা ভুটিয়া মেয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানের মধ্যে ফুটবল পোস্টকার্ড নানা পুতুল লজঞ্চুস মার্বেল এমনি সব সাজানো, দরজার উপরটায় একটা বিভীষণের মুখোশ হাঁ করে চোখ পাকিয়ে চেয়ে রয়েছে! রিদয় মুখোশটার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে এমন সময় এক বাবু দোকানে ঢুকেই বলে উঠলেন – “ওহে মার্কণ্ড, ছোট-খাটো দুটো পুতুল দাও দেখি, টুনু আর সুরূপার জন্যে!”
মার্কণ্ড তাড়াতাড়ি রিদয় যে-বাক্সে ছিল সেই বাক্সে আর একটা বিবি পুতুল দিয়ে কাগজে মুড়ে বাবুর হাতে দিলে। বাবু সেটাকে আলখাল্লার পকেটে ফেলে চুরুট ধরিয়ে পাহাড়ে রাস্তায় ঠক-ঠক লাঠি ঠুকতে-ঠুকতে বাড়ি-মুখো হলেন। পকেটের মধ্যে গরম পেয়ে রিদয় বিবি-পুতুলটির পাশে ঘুমিয়ে পড়ল, আবার যখন চোখ মেলে চাইলে তখন দেখলে বাক্সর ডালাটা খুলে গেছে। একটা কাঁচ-মোড়া বারাণ্ডায় গোটাকতক তুলি, এক বাক্স রঙ, একটা গদি মোড়া চৌকি, তারি উপরে একটা কালো কুকুর বাক্স থেকে তাকে টানাটানি করে খেলবার চেষ্টা করছে! কুকুরটা যদি কামড়ে দেয় – ! রিদয় ভাবছে, এমন সময় ওঘর থেকে ডাক এল “টমা-টমা-টমাসে!” কুকুরটা দৌড়ে ওঘরে গেল, সেই ফাঁকে রিদয় বাক্স থেকে চোঁচা দৌড়।
বাড়ির বাইরে থেকে সার্শিতে মুখ লাগিয়ে দেখলে একটা লাল-কম্বল-পাতা খাটে ছেলে-মেয়ে একদল বসে তাদের বড় ভাইটির কাছে গল্প শুনছে, আর একটা ছোট ছেলে ভুটিয়াদের লাল কাপড় পরে যে গল্প বলছে তার গলা জড়িয়ে ডাকছে – “পাখম দাদা, পাখম দাদা!”
শীতের রাতে আগুন জ্বালা ঘরখানি – এই ছেলের দল, এই হাসি-খুশি গল্প দেখে রিদয়ের চোখে জল আসতে লাগল। তারও ঘর আছে তারও দাদা আছে, দিদি আছে অথচ সব থেকেও নেই! কোথায় রইল তাদের আমতলি, কোথায় সেই মাটির দেওয়াল দেওয়া ঘরগুলি! রিদয়ের প্রাণ চাইছে এই ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে খেলে, কিন্তু হায়, সে বুড়ো-আংলা যক্ হয়ে গেছে, আর কি মানুষের ঘরে তার স্থান হবে! বুড়ো-আংলা জানলার বাইরে শীতে বসে অঝোরে কাঁদতে লাগল। সেই সময় বাবু হুকুম দিলেন – “এ রবতেন, কাল আলুবাড়ি জানে হোগা, ডাণ্ডি রাখ যাও!”
রবতেন ডাণ্ডিখানা জানলার বাইরে বারাণ্ডায় রেখে চলে গেল। রিদয় সে-রাত ডাণ্ডির ছৈটার মধ্যে কাটিয়ে বাবুর সঙ্গে যেমন এসেছিল, তেমনি ডাণ্ডিতে লুকিয়ে রওনা হল। পুতুলের মধ্যে টুনুর পুতুলটাই পাওয়া গেল, সুরূপার পুতুলটা নিশ্চয়ই টমা মুখে করে কোথায় ফেলেছে বলে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান হল না! সুরূপা টমার পিঠে দুই থাবড়া বসিয়ে পাহাড়ের উপর পা ছড়িয়ে কাঁদতে লাগল।
আলুবাড়ি থেকে রিদয়কে পিঠে নিয়ে জলা-পাহাড় কাট-পাহাড় পেরিয়ে হাঁসেরা এমন মেঘ আর শিলা-বৃষ্টি পেলে যে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকেই এগোতে পারল না, তাড়াতাড়ি ঘুরে ঝুপ-ঝাপ ঘুম লেকে গিয়ে পড়ল। ভয়ঙ্কর শিল পড়েছে, লেকের জলের উপরে বরফের সর পড়ে গেছে, পাহাড়ের গা বরফে সাদা হয়ে গেছে, খোঁড়া-হাঁসের পায়ের বাত কট-কট করে উঠল। সে বললে – “কাজ নেই বাপু এখানে থেকে, ফিরে চল, আর একবার আসা যাবে।” কিন্তু চল বললেই চলা যায় না – পাহাড় দেশে মেঘ, ভালো হওয়ার গতিক বুঝে তবে চলাচল করতে হয়। কোনো রকমে পাঁপড়া নানাকৌড়ি ঘুম-রকে চড়ে আকাশের ভাবটা জেনে আসতে চলল; অমনি রিদয় বললে – “আমি যাব ঘুম-রকে।” খোঁড়া বললে – “আমিও।” অমনি সবাই একসঙ্গে “আমিও আমিও” বলতে বলতে উড়ে গিয়ে রকের উপরে বসল।
মানুষের বাড়িতে যেমন কোনো জায়গা রাঁধবার, কোনোটা বৈঠকখানা, কোনোটা বা শোবার জায়গা, হিমালয়েতেও তেমনি এক-একটা জায়গা এক-এক কাজের জন্য আছে। মানুষের বাড়িতে যেমন দালান থাকে বারাণ্ডা থাকে, রক থাকে, হিমালয়েতেও তাই। ঘুম-রকটা হল ঘুম দেবার স্থান, জলাপাহাড় হল জল খাবার কিম্বা জলো হাওয়া খাবার জায়গা, রংটং হল ধোবিখানা, কাপড় রঙাবার জায়গা, টুং হল ঘড়ির ঘর, এমনি সব নানা রকম নানা দালান চাতাল গুহা এক-এক কাজের জন্যে রয়েছে।
ঘুম-রকে দিনে বড় কেউ আসে না, দু’চার পথিক পাখি কি জানোয়ার কখনো-কখনো জিরোতে বসে, না হলে জায়গাটা সারাদিন ফাঁকা থাকে দেখে বুড়ো রামছাগল মাস্টার এখানে ছানা পড়াবার জন্যে একটা ইস্কুল খুলেছেন। পাখির-ছানা শেয়াল-ছানা শুয়োর-ছানা ভালুক-ছানারা ঘুম-রকে বড় বড় পাথরের বেঞ্চিতে কেউ পা ঝুলিয়ে কেউ বা বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে সারাদিন ঝিমোচ্ছে আর রামছাগল শিঙের খোঁচায় তাদের জাগিয়ে দিয়ে কেবলি পড়াচ্ছেন, ক, খ, গ, ঐ বো স্যে! একে ঘুম-রক তাতে আজ বড় বাদলা, শিঙের খোঁচা খেয়েও তারা চুনে-চুনে পড়ছে দেখে রামছাগলও কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমের যোগার করছেন এমন সময় রিদয়কে নিয়ে হাঁসেরা উপস্থিত। অচেনা লোক দেখে মাস্টারমশায় তাড়াতাড়ি গা ঝাড়া দিয়ে মস্ত ম্যাপ আঁকা প্রকাণ্ড কালো সেলেটখানায় শিং বুলিয়ে ছেলেদের জিয়োগ্রাফি লেকচার শুরু করলেনঃ
জলের জন্তুরা চোখ ফুটেই দেখে জল আকাশ, ডাঙার জীব তারা দেখে বন-জঙ্গল মাঠ, আর পাহাড়ের ছেলেমেয়ে তারা দেখে আকাশের উপরে বরফে ঢাকা হিমালয়ের ওই চুড়ো ক’টা। হিম-আলয় সন্ধি করে হয়েছে হিমালয়, অর্থাৎ কিনা হিমালয় মানে হিমের বাড়ি, পাহাড়ি ভাষায় বলে হিমালয়, সমস্কৃতোতে বলে হিমাচলম্, ইংরেজ তারা ভাল রকম উচ্চারণ করতেই পারে না, ‘র’ বলতে ‘ল’ বলে ফেলে – তারা হিমালয়কে বলে ইমালোইয়াস্! হিমালয়ের মতো উঁচু পর্বত আর জগতে নেই। সব দেশের সব পর্বত আমাদের এই হিমালয়ের চুড়োর কাছে হার মেনেছে।
ধলা চামড়া জানোয়ারেরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, আমাদের বলে কালো, কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় পাহাড় মোটে ষোল হাজার ফুট আর আমাদের এই বাড়ির চুড়োগুলো কত উঁচু তা জানো? এর চল্লিশটা শিখর হচ্ছে চব্বিশ হাজার ফিট করে এক-একটি। ঐ কাঞ্চনজঙ্ঘা যেটা সকালে-সন্ধ্যায় সোনা আর দিনে রাতে দেখায় রুপো, ওটা হচ্ছে আটাশ হাজার ফুট, ওরও আরও হাজার ফুট উপরে ধবলাগিরির সব উঁচু চুড়ো ঊনত্রিশ হাজার ফুট। এর পাশে ধলা চামড়াদের জেতো পাহাড় – ফুঃ, রাজহস্তীর পাশে খরগোস। মানুষের কথা দূরে থাক পাখিরাও এই হিমালয়ের চুড়োয় চড়তে পারে না, এখানে না ঘাস না গাছ! মেঘ পর্যন্ত ভয় পায় সেখানে উঠতে, শুধু ধপ-ধপ করছে আছোঁয়া শাদা বরফ।
এই হিমালয়ের চুড়ো থেকে বরফ গলে বারোটা মহানদী ছিষ্টি হয়ে পুব-পশ্চিমে দুই মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে, হত দেশ কত বনের মধ্যে দিয়ে তার ঠিক নেই। এ-সব নদীর ধারে কত নগর কত গ্রাম কত মাঠঘাট জমি-জমা রাজ্য পেতে কত রকমের মানুষেরা রয়েছে তা গোনা যায় না।
এই হিমের বাড়ির চুড়োটা থেকে ধাপে-ধাপে পৃথিবীর দিকে নেমে গেছে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পর্বত প্রমাণ সিঁড়ি, এক-এক ধাপে রকম-রকম গাছ-পালা-পশু পাখি! এ-রকে সে-রকে পাথরের কাজাল এমন চওড়া যে সেখানে কতককালের পুরোনো পাথরের মেঝেতে বড়-বড় গাছের বন হয়ে রয়েছে, ঝরনা দিয়ে বর্ষার জল বরফের জল সব গড়িয়ে চলেছে। কোনো রকের উপর দিয়ে মানুষেরা রেল চালিয়ে দিয়েছে, বড় বড় শহর বসিয়ে বাজার বসিয়ে রাজত্ব করেছে।
জীব-জন্তুর অগম্য স্থান ধবলাগিরি, সেখানে কেবলি বরফ। এই সিঁড়ির রক, যাতে আমরা বাস করছি, এরি সব উপরের রকে শুধু বরফ আর শেওলা, একমাত্র চমরী গাই পাহাড়ি ছাগল আর ভেড়া, তার পরের ধাপে মানুষ-সমান ঘাস আর দেবদারু বন, সেখানে শেয়াল ভালুক হেঁড়েল এরাই যেতে পারে, তার পরের রকে নানা ফুলের বাগান, সেখানে প্রজাপতি পাখি খরগোস কুকুর বেড়াল ভোঁদড় ভাম বাঁদর হনুমান এরাই থাকে, সবশেষের ধাপে বেতবন বাঁশবন অন্ধকার ঘন জঙ্গল, সেখানে হরিণ মোষ বাঘ সাপ ব্যাঙ্ তার পরে চাটালো জমি যার উপর দিয়ে সহস্রধারা নদী সব বয়ে চলেছে, এরি পরে অগাধ সমুদ্র, নীল জল, শেষ দেখা যায় না, এই সমুদ্রের ওপারে যে কি, তা কেউ জানে না!
চকা অমনি বলে উঠল – “আমি জানি। নীল সমুদ্রের মাঝে পাহাড় আছে, টাপু আছে, তার পরে পৃথিবীর শেষ বরফের দেশ, সেখানে ছ’মাস রাত্রি ছ’মাস দিন; সেখানে পেঙ্গু পাখিরা বরফের বাসায় ডিম পাড়ে, ধলা ভালুক আছে, ধলা শেয়াল সিন্ধুঘোটক আছে, সব সেখানে শাদা, কালো কিছু নেই, দিন রাত সমান আলো, ঘুটঘুটে আঁধার মোটেই নেই, আমি সেইখানে পাঁচবার গেছি!”
চকার কথায় রামছাগল শিং বেঁকিয়ে বললে – “এত বুড়ো হলেম এমনি আজগুবি কথা তো শুনিনি।”
রিদয় এবার এগিয়ে এসে বললে – “যে হিমালয়ের চুড়ো এখান থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বরফে ঢাকা, ঐ হিমের বাড়ি গড়া নিয়ে কি কাণ্ড হয়ে গেছে এককালে, তার খবর চকা তো জানে না, রামছাগলও জানে না, মানুষেরা ধ্যান করে ওই নিচের তলাকার বনে বসে! ওই ধবলাগিরির উপরের খবর যা শাস্তর লিখে গেছে – তাই বলছি, শোনো। বড় চমৎকার কথা।”
সবাই অমনি রিদয়কে ঘিরে বসল কথা শুনতে, মেঘলা দিনে ভিজে স্যাৎস্যাঁত করছে, ভালুকের গা ঘেঁষে ছাগল, ছাগলের গা ঘেঁষে হাঁস, হাঁসের গা ঘেঁষে শেয়াল।
রিদয় বসে গল্প শুরু করলেঃ
হিমালয় কেমন, তা শুনলে! হিমালয়ের উপরে কি নিচে কি সমুদ্রের এপারে কি ওপারে কি সবই তো শুনলে, কিন্তু এগুলো তৈরি করলে কে, তার খবর রাখ? প্রথমে সেইটে বলি শোনো – একদিন বিশ্বকর্মা গোলার মতো একতাল কাদা পাকিয়ে নতুন পৃথিবী গড়তে বসলেন। চন্দ্র সূর্য গড়া হয়েছে এইবার সসাগরা আমাদের এর ধরা তিনি গড়তে আরম্ভ করলেন। সেদিনটাও এমনি আঁধার-আঁধার ছিল। বিশ্বকর্মার আর কাজে মনই যাচ্ছে না, তিনি কাদা দিয়ে কেবলি পৃথিবীটার উপরে বুড়ো আঙুলের টিপ দিয়ে এদেশ-সেদেশ গড়ে চললেন, সব দেশ মিলিয়ে দেশ-বিদেশগুলোর চেহারাটা হল ঠিক যেন হাড্ডিসার – এখানে-ওখানে মাটি-ঝরা শির-বার-করা বাঁকা-চোরা টোল-খাওয়া দোমড়ানো চোপসানো গরু ঘাড় ঝুঁকিয়ে সমুদ্রের জল খাচ্ছে, আর ঠিক তারি সামনে একটা গরুড় পক্ষীর ছানা, সেও যেন গো-ডিম থেকে সবে বার হয়ে মাছ ধরবার জন্যে সমুদ্রের দিকে গলা বাড়িয়েছে।
বিশ্বকর্মার পাশে বিশ্বামিত্র বসে ছিলেন; তাঁর বিশ্বাস, বিশ্বকর্মার চেয়ে গড়ন-পিটন করতে তিনি পাকা। বিশ্বকর্মার সঙ্গে বাজি রেখে প্রায়ই বিশ্বামিত্র এটা-ওটা গড়তেন, প্রত্যেক বারে বাজিও হারতেন কিন্তু তবু তাঁর বিশ্বাস গেল না যে তিনি পাকা কারিগর! বিশ্বকর্মার ছিষ্টি মিষ্টি আতা খেয়ে বিশ্বামিত্র এক আতা গড়লেন, দেখতে বিশ্বকর্মার আতার চেয়েও ভালো, কিন্তু সমুদ্রের জল দিয়ে গড়বার কাদা ছানার দরুন বিশ্বামিত্রের আতা এমনি নোনা হয়ে গেল যে মুখে দেবার যো নেই! ডিম ফুটে পাখি বেরোচ্ছে বিশ্বকর্মা ছিষ্টি করলেন, পাখিদের মা-বাপ – তাদের ডিম, ডিমের মধ্যে বাচ্চা – বিশ্বামিত্র বললেন, ‘ও কি হল? এ কি আবার ছিষ্টি! আমি গাছে পাখি ফলাব।’ বিশ্বামিত্র অনেক মাথা ঘামিয়ে অনেক জাঁক করে স্থির করলেন – ডিমে তা দেওয়া চাই কিন্তু পাখি তা দিলে তো চলবে না – তিনি এমন নারকেল গাছ সুপুরি গাছ তাল গাছ ছিষ্টি করলেন যাতে দিন ভোর রোদ পায় কিন্তু বেশি রোদ পেলে ডিম একেবারে সিদ্ধ হয়ে যাবে, আবার রাতে হিম পেলেও দষ্ট হবে, জল পেলে পচে যাবে! সব ভেবে-চিন্তে বিশ্বামিত্র বড়-বড় পাখির পালকের মতো পাতা গাছের আগায় বেঁধে দিয়ে সেই পাতার গোড়ায় দশটা বারোটা কুড়িটা পঁচিশটা করে ছোট বড় নানা রকম ডিম ঝুলিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন পাখি বার হয়, কিছু পাছে কাগে চিলে ঠুকরে ডিমগুলো ভেঙে দেয় সেজন্য বিশ্বামিত্র ডিমের খোলাগুলো এমনি শক্ত করে বানিয়েছেন যে বাচ্চা পাখি সেই পুরু নারকোল মালা নারকোল ছোবড়া তালের খোলা সুপুরির ছাল ভেঙে বার হতেই পারলে না। কোনোটা রোদে পক্ক কোনোটা অর্ধপক্ক কোনোটা অপক্কই রয়ে গেল। ডিম হল, তার শাঁস জল হল, তা দেওয়া হল, সবই হল কিন্তু তা থেকে পাখি হল না!
এতেও বিশ্বামিত্রের চৈতন্য হল না। বিশ্বকর্মাকে গোরূপা পৃথিবী গড়তে দেখে তাঁরও গড়বার সাধ হল। তখন বিশ্বকর্মা গোরূপা পৃথিবীর বাঁটের মতো এই ভারতবর্ষটি অতি যত্ন করে গড়েছেন, সব তখনো গড়া হয়নি কিন্তু এতেই মনে হচ্ছে এই দেশটি হবে চমৎকার, একেবারে কামধেনুর বাঁটের মতো দেশটি – যা চাই যত চাই এখানে পাওয়া যাবে। বিশ্বামিত্র তাড়াতাড়ি একটু কাদা নিয়ে বসলেন, ‘দাদা তুমি খানিক এই দেশটা গড়, আমিও খানিক গড়ি – দেখা যাক কার ভালো হয়।’ বিশ্বকর্মা ভারতবর্ষের আদড়াটা প্রায় শেষ করেছিলেন কাজেই বিশ্বামিত্র খারাপ করে দিলেও দেশটা একেবারে মাটি হয়ে যাবে না জেনে দেশটার উপরে বিশ্বামিত্রকে গড়া পেটা করতে দিতে বিশ্বকর্মা আপত্তি করলেন না। তাঁকে সমস্ত উত্তর দিকটা গড়তে ছেড়ে দিয়ে নিজে বাঙলাদেশটা গড়তে বসে গেলেন। বাঙলাদেশটা সুন্দর করে নদী গ্রাম ধানক্ষেত সুন্দর বন আম কাঁঠালের বাগান খড়ের চাল দেওয়া ছোট-ছোট কুঁড়ে ঘর দিয়ে চমৎকার করে সাজিয়ে তুলতে বিশ্বকর্মার বেশি দেরি লাগল না, বুড়ো আঙুলের দু’চার টিপ দিয়ে মাঠগুলো আর আঙুলের দাগ দিয়ে নদী-নালা বানিয়ে তিনি কাজ শেষ করে বসে বিশ্বামিত্রের দিকে চাইলেন। বিশ্বামিত্র অমনি বলে উঠলেন – “আমার কাজ অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে, দেখবে এস।”
বিশ্বকর্মার ছিষ্টি বাঙলাদেশ দেখে বিশ্বামিত্র এবারে নিন্দা করতে পারলেন না, চমৎকার! সুজলা সুফলা বীজ ছড়ালেই ফসল, কোথাও উঁচু-নিচু এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়-পর্বত নেই বললেই হয়, যতদূর চোখ চলে সবুজ ক্ষেত আর জলা। বিশ্বামিত্র দাড়ি নেড়ে বললেন – ‘হ্যাঁ, এবারের ছিষ্টিটা হয়েছে মন্দ নয়, কিন্তু আমার দেশটা আরো ভালো হয়েছে দেখসে’ বলে বিশ্বামিত্র বিশ্বকর্মাকে উত্তর-ভারতবর্ষটা কেমন হয়েছে দেখতে বললেন।
বিশ্বকর্মার আদড়া উল্টে-পাল্টে বিশ্বামিত্র গড়েছেন। পাঞ্জাবে টেনেছেন পাঁচটা নদীর খাত কিন্তু সেখানকার জমিতে সার মাটি না-দিয়ে তিনি দিয়েছেন বালি আর কাঁকর, ধানও হবে না, চালও হবে না, মানুষগুলো কেবল যেন জল খেয়েই থাকবে। তারপর পাহাড় অঞ্চলে দুজনে উপস্থিত – বিশ্বকর্মা বিশ্বামিত্রের কীর্তি দেখে অবাক! সেখানে যা পেরেছেন পাথর সবগুলো জড়ো করে এক হিমালয় পাহাড়ের ছিষ্টি করে বসেছেন বিশ্বামিত্র। তাঁর চিরকাল মাথায় আছে সূর্যের তাপ – গাছপালা মানুষ গরু সব জিনিসের পক্ষে ভালো, কাজেই তাঁর ছিষ্টি-করা পাহাড়দেশ তিনি যতটা পারেন সূর্যের কাছে ঠেলে তুলেছেন আর সেই সব পাথরের গায়ে এখানে-ওখানে দু-চার মুটো মাটি ছড়িয়ে দু-একটা ঘাসের চাপড়া লাগিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসেছেন।
বিশ্বামিত্র একগাল হেসে যেমন বলেছেন, ‘কেমন দাদা, ভালো হয়নি?’ অমনি ঝুপ-ঝুপ করে এক পশলা বৃষ্টি নামল আর পাহাড়ের সব মাটি ঘাস ধুয়ে গিয়ে খালি পাথর আর নুড়ি বেরিয়ে পড়ল। এদিকে পাহাড়ের এখানে-ওখানে উপরে-নিচে এত বিষ্টির জল জমা হল যে তাতে সারা পৃথিবীর নদীতে জল দেওয়া চলে!
বিশ্বকর্মা বলে উঠলেন – ‘করেছ কি, সব উল্টো-পালটা! যেখানে মাটি চাই, সেখানে দিয়েছ কাঁকর, যেখানে জল দরকার সেখানে দিয়েছ বালি, আর যেখানে জল মোটেই দরকার নেই সেখানে জমা করেছ রাজ্যের জলাশয়, তোমার মতলব তো কিছু বোঝা গেল না!’
বিশ্বামিত্র দাড়ি মোচড়াতে-মোচড়াতে বললেন – ‘শীতে যাতে লোক কষ্ট না পায় তাই দেশটা যতটা পারি সূর্যের কাছে এনে দিয়েছি, এতে দোষটা হল কি!’
বিশ্বকর্মা বললেন –‘উঁচু জমিতে দিনে যেমন গরম, রাতে তেমনি ঠাণ্ডা, এটা তো তোমার মনে রাখা উচিত ছিল, এত উঁচুতে তো কিছু গাছপালা গজানো শক্ত, গরমে জ্বলে যাবে বরফে সব জমে যাবে। এত পরিশ্রম তোমার সব মাটি হল, দেখছি!’
বিশ্বামিত্র মাথা চুলকে বললেন – ‘আমি সব এখানকার উপযুক্ত মানুষ ছিষ্টি করে দিই। তারা দেখবে এই পাহাড়কে ভূস্বর্গ করে তুলবে!’
বিশ্বকর্মা বললেন – ‘আর তোমার ছিষ্টি করে কাজ নেই, মানুষ গড়তে শেষে বাঁদর গড়ে বসবে!’
‘কোনো ভয় নেই, এবার আমি খুব সাবধানে গড়ছি। দেখ এবারে ঠিক হবে’ – বলে বিশ্বামিত্র একরাশ প্রজাপতির ডানা গড়ে রেখে বিশ্বকর্মাকে ডেকে বললেন – ‘দেখসে মজা!’
বিশ্বকর্মা ভেবেই পান না, এত ডানা নিয়ে বিশ্বামিত্র কি করবেন! তিনি শুধোলেন, - ‘এগুলো কি হবে ভাই?’
বিশ্বামিত্র খানিক কপালে আঙুল বুলিয়ে চিন্তা করে বললেন – ‘পাহাড়দের সব ডানা দিয়ে দিতে চাই, তারা যেখানে খুশি – শীতের সময় গরমদেশে, গরমের সময় শীতদেশে, উড়ে-উড়ে বিচরণ করতে পারবে, তা হলে এখানে যারা বাস করবে তাদের আর কোনো অসুবিধে হবে না।’
বিশ্বকর্মা ভয় পেয়ে বলে উঠলেন – ‘সর্বনাশ, পাহাড় যেখানে-সেখানে উড়ে বসতে আরম্ভ করলে যে-সব দেশে পাহাড়-পর্বত গিয়ে পড়বে, সেসব দেশের দশা কি হবে? লোকগুলো-সুদ্ধ সারা-দেশ যে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যাবে!’
বিশ্বামিত্র বলে উঠলেন – ‘তা কেন! লোকেরা সব ধন-দৌলত খাবার-দাবার নিয়ে পাহাড়ে চড়ে বসবে, তা হলেই কোনো গোল নেই?’
বিশ্বকর্মা বললেন – ‘সবাই পাহাড় চড়ে ঘুরে বেড়ালে আমার জমিতে হাল দেয় কে, রাজত্বই বা করে কে ঘর-বাড়িই বা বেঁধে থাকে কে!!’
‘তা আমি কি জানি’ – বলে বিশ্বামিত্র হিমালয়ের ডানা দিতে যান, এমন সময়ে বিশ্বকর্মা তাঁর হাত চেপে ধরে বললেন – ‘আগে হিমালয়ের বাচ্চা এই ছোট-খাটো মন্দর পর্বতটাকে ডানা দিয়ে দেখ, কি কাণ্ড হয়, পরে বড়টাকে নিয়ে পরীক্ষা কর।’
বিশ্বামিত্র মন্দর পর্বতে ডানা দিয়ে যেমন ছেড়ে দেওয়া, সে অমনি উড়তে-উড়তে বাঙলাদেশের দক্ষিণধারে যে-সব দেশ গড়া হয়েছিল সেইখানে উড়ে বসল! যেমন বসা অমনি সারাদেশ রসাতলে তলিয়ে গেল; মাটি যেখানে ছিল সেখানে একটা উপসাগর হয়ে গেছে দেখা গেল। মানুষ যারা ছিল তাদের চিহ্ন রইল না, কেবল মাছগুলো জলে কিল-বিল করতে লাগল, আর মন্দর পর্বতটা সমুদ্র তোলপাড় করে এমনি সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলে যে, জল-প্লাবনে বিশ্বকর্মার ছিষ্টি মাটি ধুয়ে যাবার যোগাড়!
বিশ্বকর্মা তাড়াতাড়ি সমুদ্রের ধারে-ধারে বালির বাঁধ দিয়ে জল ঠেকিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন – আমার হাতের কাজে তোমায় আর হাত দিতে দিচ্ছি নে। এই পৃথিবীর উত্তর শিয়র আর দক্ষিণ শিয়রে কিছু নেই, কিছু সৃষ্টি করতে হয় সেই দু’জায়গায় করগে। যে ভুলগুলো করেছ সেগুলো আমাকে শুধরে নিতে দাও এখন।’ বিশ্বামিত্রের হাত থেকে বিশ্বকর্মা গড়বার যন্তর-তন্তর কেড়ে নিয়ে পাহাড়ে যত জল জমা হয়েছিল, সমস্ত নালা কেটে ঝরনা দিয়ে সমুদ্রের দিকে বইয়ে দিলেন। বিশ্বকর্মার ছিষ্টিতে কিছু বাজে থাকবার যো নেই, নষ্ট হবার যো নেই – পাহাড়ের জল সমুদ্রে পড়ে, সেখান থেকে সূর্যের তাপে মেঘ হয়ে আকাশ দিয়ে দেশ-বিদেশে বিষ্টি দিয়ে ক্ষেতে-ক্ষেতে ফসল গজাতে চলল!
বিশ্বকর্মা ইন্দ্রকে বললেন – ‘বাজ দিয়ে মন্দর পর্বতের ডানা কেটে দাও!’ ডানা কাটা গেল, মন্দর সমুদ্রেই ডুবে রইল আর তার ডানার কুঁচিগুলো এখানে-ওখানে সমুদ্রের মাঝে টাপুর মতো ভাসতে লাগল। বিশ্বকর্মা সেগুলোর উপরে মাটি ছড়িয়ে দিলেন, বসতি বসিয়ে দিলেন। তারপর বিশ্বামিত্র যত ডানা গড়ে রেখেছিলেন সেগুলো দিয়ে বিশ্বকর্মা প্রজাপতি ভোমরা মৌমাছি সব গড়ে ছেড়ে দিলেন। তারা দেশ-বিদেশ থেকে ফুলের রেণু ফুলের মধু এনে পাহাড়ে-পাহাড়ে বাগান বসাতে শুরু করে দিলে। দেখতে-দেখতে পাথরের গায়ে সব ফুল গজাল ফল ফলল। সব ঠিক করে বিশ্বকর্মা প্রকাণ্ড দুটো ডানা দিয়ে দক্ষ প্রজাপতি ছিষ্টি করে হাত-পা ধুয়ে ভাত খেতে গেলেন, শাস্তরের ছিষ্টত্তত্ব তো এই হল, তারপর দক্ষ প্রজাপতির কথা পুরাণে লিখেছে যেমন, বলি, শোনো –
বিধির মানস সূত দক্ষমুনি মজবুত
প্রসূতি তাহার ধর্ম-জায়া।
তার গর্ভে সতীনাম অশেষ মঙ্গলধাম
জনম লভিল মহামায়া।
নারদ ঘটক হয়ে নানামতে বলে কয়ে
শিবেরে বিবাহ দিল সতী।
নারদ তো ঘটকালি নিয়ে সরে পড়লেন, এদিকে শিব ষাঁড়ে চড়ে ভুটিয়ার দলের সঙ্গে ডমরু বাজিয়ে জটায় সাপ জড়িয়ে হাড়মালা গলায় ঝুলিয়ে নাচতে-নাচতে হাজির।
দক্ষ প্রজাপতি বরের চেহারা দেখেই চটে লাল –
শিবের বিকট সাজ
দেখি দক্ষ ঋষিরাজ
বামদেবে হৈল বাম-মতি।
সেই থেকে জামাই শ্বশুরের মুখ দেখেন না। দক্ষ প্রজাপতিও শিবনিন্দে না করে জল খান না। এই সময়ে দক্ষ শিবহীন যজ্ঞ করলেন; সব দেবতা নেমতন্ন পেলেন। সতীর বোনেরা গয়না-গাটি পরে পালকি চড়ে শিবের বাড়ির সামনে দিয়ে ঝমর-ঝমর করতে-করতে বাপের বাড়ি মাছের মুড়ো খেতে চলল দেখে সতীর চোখে জল এল। দুঃখী বলে বাবা তাঁদের নেমতন্ন পাঠাননি!
সতী বোনেদের পালকির কাছে গিয়ে দিদির গলা ধরে কেঁদে-কেঁদে বললেনঃ
অশ্বিনীদিদি! আমাদের দুখিনী দেখিয়া পিতে
অবজ্ঞা করিয়া যজ্ঞে আজ্ঞা না করিলেন যেতে,
নিজ বাপ নহে অন্য শুনে হৃদে এই ক্ষুণ্ণ
আমা ভিন্ন নেমতন্ন করেছেন এই ত্রিজগতে।
অশ্বিনীদিদি আঁচলে সতীর চোখের জল মুছিয়ে বললেন – ‘তুই চল না। বাপের বাড়ি যাবি তার আবার নেমতন্ন কিসের? আয় আমার এই পালকিতে।’
সতী ঘাড় নেড়ে বললেন – ‘না ভাই – তিনি রাগ করবেন!’
‘তবে তুই তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পরে আয়’ বলে সতীর দিদিরা –
চতুর্দোলে সবে চড়ি চলিলেন হরষে
হেথায় শঙ্করী ধেয়ে করপুটে দণ্ডাইয়ে
চরণে প্রণতি হয়ে কহিলেন গিরিশে
আমি বাপের বাড়ি যাব।
শিব বললেন –
সতী তুমি যেতে চাচ্ছ বটে,
পাঠাইতে না হয় ইচ্ছে দক্ষের নিকটে।
আমাদের শ্বশুর জামায়ে কেমন ভাব শোনো –
আমাদের ভাব কেমন জামাই শ্বশুরে, যেমন দেবতা আর অসুরে,
যেমন রাবণ আর রামে, যেমন কংস আর শ্যামে,
যেমন স্রোতে আর বাঁধে, যেমন রাহু আর চাঁদে,
যেমন জল আর আগুনে, যেমন তেল আর বেগুনে,
যেমন পক্ষী আর সাতনলা, যেমন আদা আর কাঁচকলা,
যেমন ঋষি আর জপে, যেমন নেউল আর সাপে,
যেমন ব্যাঘ্র আর নরে, যেমন গোমস্তা আর চোরে,
যেমন কাক আর পেচক, যেমন ভীম আর কীচক।
‘দক্ষ যখন অমান্য করে বারণ করেছেন নিমন্ত্রণ, কেমন করে সেখানে তোমার যাওয়া হয়!’
সতী কিন্তু শোনেন না শিবের কথা, তিনি সেজেগুজে নন্দীকে সঙ্গে নিয়ে মহাদেবের ষাঁড়ে চড়ে বাপের বাড়ি চললেন দুঃখিনী বেশে। কুবের দেখে বাক্স ভরা এ-কালের সে-কালের গহনা এনে বললে – ‘মা, এমন বেশে কি যেতে আছে! বাপের বাড়িতে লোকে বলবে কি – ওমা, একখানা গয়নাও দেয়নি জামাই! সতী কুবেরের দেওয়া গহনা পরে সাজলেন, কিন্তু দক্ষ প্রজাপতির কন্যা এমন সুন্দরী যে সোনা হীরে তাঁর সোনার অঙ্গের আলোর কাছে টিম-টিম করতে লাগল। ‘দূর ছাই’ বলে সতী সেগুলো ফেলে দিয়ে পাহাড়ি ফুলের সাজে সেজে বার হলেন। ত্রিলোক সতীর চমৎকার বেশ দেখে ধন্য-ধন্য করতে-করতে সঙ্গে চলল।
এদিকে ছোট মেয়ে সতী এল না, কাজের বাড়ি শূন্য ঠেকছে, সতীর মা কেবলি আঁচলে চোখ মুচছেন এমন সময় দাসীরা এসে প্রসূতিকে খবর দিলে – ‘ও মা তোর সতী এলো ঐ!’ এই শুনে –
রাণী উন্মাদিনী-প্রায়
কৈ সতী বলিয়া অতি বেগে তথা ধায়।
অম্বিকারে দৃষ্টি করি বাহিরেতে এসে
আয় মা বলে লইয়া কোলে
নয়ন জলে ভাসে!
সতী মায়ের কাছে বসে একটু দুধ সন্দেশ খেয়ে সভা দেখতে চললেন। ইন্দ্র-চন্দ্র সব বসেছেন, বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠ সব বসেছেন দক্ষ প্রজাপতিকে ঘিরে, আর কালোয়াত সব গান-বাজনা করছে –
ধির্ কুট্ কুট্ তানা তাদিম তা, তা দিয়ানা ঝেন্না ঝেন্না
নাদেরে দানি তাদেরে দানি, ওদেরে তানা দেরে তানা
তাদিম তারয়ে তারয়ে দানি।
দেতারে তারে দানি ধেতেন দেতেন নারে দানি।
বেশ গান-বাজনা চলেছে – এমন সময়ে সভাতে সতীকে আসতে দেখেই দক্ষ শিব-নিন্দে শুরু করলেন। দক্ষ প্রজাপতিঃ
কেবল এ গ্রহ আনি নারুদ ঘটালে,
কনিষ্ঠা কন্যাটা আমি দিলাম জলে ফেলেঃ
বস্ত্রবিনা বাঘছাল করে পরিধান,
দেবের মধ্যে দুঃখী নাই শিবের সমান।
ভূত সঙ্গে শ্মশানে-মশানে করে বাস,
মাথার খুলি বাবাজীর জল খাবার গেলাস!
যায় বলদে বসে গলদেশে মালাগুলো সব অস্থি,
সিদ্ধি ঘোঁটার সদাই ঘটা বুদ্ধি সেটার নাস্তিঃ
অদ্ভুত সঙ্গেতে ভূত গলায় সাপের পৈতে,
তারে আনিলে ডেকে হাসিবে লোকে – তাই হবে কি সইতে!
পাগলে সম্ভাষা করা কোন প্রয়োজন,
সাগরে ফেলেছি কন্যা বলে বুঝাই মন।
দক্ষের শিব-নিন্দা শুনি সতী আর সইতে পারলেন না।
পতি-নিন্দা শুনি সতী জীবনে নৈরাশ,
ঘন-ঘন চক্ষে ধারা সঘনে নিশ্বাস;
পিতারে কুপিতা হইয়া অঙ্গ অবসান,
ধরা শয্যা করি ‘তারা’ ত্যেজিলেন প্রাণ!
সতী শিব-নিন্দা শুনে প্রাণত্যাগ করলেন, চারদিকে হাহাকার উঠল। সতীর সাতাশ বোন আকাশের তারা সব কাঁদতে লাগল, নন্দী কাঁদতে লাগল, ভৃঙ্গী কাঁদতে লাগল, দেবতারা কাঁদতে লাগলেন, মানুষেরা কাঁদতে লাগল –
ফিরে চাও মা বাঁচাও পরাণী,
ধূলাতে পতিত কেন পতিত-পাবনী;
দুটি নয়ন-তারা মুদিয়া তারা –
অধরা কেন ধরাসনে!
নন্দী গিয়ে কৈলাসে মহাদেবকে খবর দিলে – ‘মা আর নেই।’ তখন শিব ক্রোধে হুঙ্কার ছাড়লেন, অমনি শিবদাস সব দক্ষযজ্ঞ নাশ করতে আগুয়ান হল। মহাদেব যুদ্ধে চললেন, পৃথিবী কাঁপতে থাকল, মেঘ সব গর্জন করে উঠল, আকাশে বিদ্যুৎ বাজ ছুটোছুটি করতে থাকল কড়মড় করে, শিব ত্রিশূল হাতে সাজলেন –
মহারুদ্র রূপে মহাদেব সাজে,
ভবম্বম ভবম্বম সিঙ্গা ঘোর বাজে;
ফণাফণ ফণাফণ ফণী ফন্ন গাজে
মহারুদ্র রূপে মহাদেব সাজে;
ধকধ্বক ধকধ্বক জ্বলে বহ্নি ভালে,
ববম্বম ববম্বম মহাশব্দ গালে;
ধিয়াতা ধিয়াতা ধিয়া ভূত নাচে
উলঙ্গী উলঙ্গে পিশাচী পিশাচে।
চলে ভৈরবা ভৈরবী নন্দী ভৃঙ্গী
মহাকাল বেতাল তাল ত্রিশৃঙ্গী,
চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে
চলে শাঁখিনী পেতিনী মুক্ত কেশে।
ভূত-প্রেত নিয়ে শিব এসে উপস্থিত। ভয়ে কারু মুখে কথা নেই, মহাদেব হুকুম দিলেন ভূতিয়া ফৌজকে – যজ্ঞনাশ কর। অমনি –
রুদ্রদূত ধায় ভূত নন্দী ভৃঙ্গী সঙ্গিয়া
ঘোরবেশে মুক্ত কেশ যুদ্ধ রঙ্গ রঙ্গিয়া,
যক্ষ রক্ষ লক্ষ লক্ষ অট্ট অট্ট হাসিছে
যজ্ঞগেহ ভাঙ্গি কেহ হব্যগব্য খাইছে,
প্রেতভাগ সানুরাগ ঝম্প ঝম্প ঝাঁপিছে,
ঘোররোল গণ্ডগোল চৌদ্দলোক কাঁপিছে।
ভূত ভাগ পায় লাগ লাথি কিল মারিছে
বিপ্র সর্ব দেখি খর্ব ভোজ্য বস্ত্র সারিছে
ভার্গবের সৌষ্ঠবের দাড়ি গোঁফ ছিণ্ডিল
পূষণের ভূষণে দন্ত পাঁতি পড়িল,
ছাড়ি মন্ত্র ফেলি তন্ত্র মুক্ত কেশ ধায় রে,
হায় হায় প্রাণ যায় পাপ দক্ষ দায় রে!
নৈবিদ্যির থালা ফেলে বিশ্বামিত্র দৌড় – বশিষ্ঠ চম্পট, সবার দাড়ি গোঁফ ছিঁড়ে কিলিয়ে দাঁত ভেঙে ভূতেরা লম্ফ ঝম্প করতে লাগল –
মৌনী তুণ্ড হেঁট মুণ্ড দক্ষ মৃত্যু জানিছে।
মৈল দক্ষ, ভূত যক্ষ সিংহনাদ ছাড়িছে।
দক্ষ-নিপাত দেখে সতীর মা কেঁদে শিবকে বললেন –
সতীর জননী আমি, শাশুড়ী তোমার,
তথাপি বিধবা দশা হইল আমার?
প্রসূতির বাক্যে শিব সলজ্জ হইল
রাজ্যসহ দক্ষরাজে বাঁচাইয়া দিল।
ধড়ে মুণ্ড নাহি দক্ষ দেখিতে না পায়,
উঠে পড়ে ফিরে ঘুরে কবন্ধের প্রায় –
কন্দ-কাটা দক্ষের দুর্গতি দেখে ভূতেরা সব হাসতে লাগল, তখন শিবের কাছে ছিল পাহাড়ি একটা রামছাগল দড়ি দিয়ে হাড়-কাঠে বাঁধা। তিনি সেইটে নন্দীকে দেখিয়ে দিলেন। নন্দী তার মুড়োটা কেটে দক্ষের কাঁধে জুড়ে দিয়ে দক্ষ প্রজাপতির ডানা দুটো কেটে নিয়ে চলে গেল, শিব সতীদেহ নিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে কৈলাসে গেলেন! এর পরে আরও কথা আছে, কিন্তু এখানেই দক্ষযজ্ঞ শেষ – হরি হরি বল সবে পালা হৈল সায় – বলে রিদয় চুপ করলে।
রামছাগল ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকালে, খানিক চেয়ে থেকে বললে – “ফুঃ, এমন আজগুবি কথা তো কখনো শুনিনি। বুড়ো হয়ে শিং ক্ষয়ে গেল, এমন কথা তো কোনোদিন শুনলেম না যে প্রজাপতির মাথা হয় রামছাগলের মতো আর পাহাড়গুলোর গজায় ডানা!”
রামছাগল ছেলেদের বললেনঃ
ওসব বাজে কথায় বিশ্বাস করো না, বড় হয়ে মধুর সন্ধানে পেটের দায়ে তোমরা জানি দেশ-বিদেশে যাবে, এমন অনেক বাজে গল্পও তোমাদের এই দেশের পাহাড়-পর্বত নদ-নদীর নামে শুনতে পাবে। কেউ বলবে তোমার দেশ মন্দ, কেউ বলবে মন্দ নয়, কিন্তু মনে রেখ এই হিমালয়ের জলে বাতাসে তোমরা মানুষ, ভগবান তোমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো, সব চেয়ে উঁচু, সবচেয়ে চমৎকার বাড়ি দিয়েছেন। এই কথাটি সর্বদা মনে রেখ, কোনোদিন ভুলো না যে পৃথিবীর সেরা হচ্ছে এই হিমালয়, আর সেইটে ভগবান দিয়েছেন তাঁর কালো ছেলেদের। এই পাথরের সিঁড়ি এতকালের পুরোনো যে তার ঠিক ঠিকানা নেই। আগে এটা, তারপর গাছ-পালা, জন্তু-জানোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। পাখির ছানাগুলো জন্মাবার আগে যেমন তাদের বাসা তৈরি হয়ে থাকে, মানুষদের, জানোয়ারদের জন্মাবার আগে তেমনি জগৎমাতা আর বিশ্বপিতা তাদের জন্য এই চমৎকার হিমালয় আর সমুদ্র পর্যন্ত গেছে যে পাঁচ ধাপ পাথরের সিঁড়ি, তা প্রস্তুত করিয়েছিলেন। জীব-জন্তুরা জন্মে যাতে আরামে থাকে, কষ্ট না পায় সেই জন্য চমৎকার করে পাথর দিয়ে দালান রক এমনি সব নানা ঘর নানা বাড়ি তাঁরা সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিলেন!
কিন্তু কত কালের এই বাড়ি, একে পরিষ্কার রাখা, মেরামতে রাখা, যারা জন্মাতে লাগল তাদের তো সাধ্য হল না, এককালের নতুন বাড়ি পাথরের সিঁড়ি সব ভেঙে ফেটে পড়তে লাগল বর্ষায় এখানে ওখানে সোঁতো লাগল, শেওলা গজাল, হাওয়াতে ধুলো-মাটি এসে ধাপগুলোতে জমা হতে থাকল, ঝড়ে ভূমিকম্পে বড় বড় পাথর খসে-খসে এখানে-ওখানে পড়ল, এখানটা ধ্বসে গেল, সেখানটা বসে গেল, ওটা ভেঙে পড়ল, সেটা বেঁকে রইল, এইভাবে কালে-কালে ধাপগুলোর উপরের তলার মাটি ধুয়ে নিচের তলায় নামতে লাগল; আর ধাপে- ধাপে সেখানে যেমন মাটি পেলে নানা জাতের গাছপালা বন-জঙ্গল দেখা দিলে। উপর-তলার মাটি ধুয়ে গেছে সেখানে অল্পসল্প চাষবাস চলেছে দেখ, খুব ছোট-ছোট ক্ষেত, ছোট গ্রাম। মাঝের ধাপে অনেকটা মাটি জমা হয়েছে। সেখানে দেখ দার্জিলিঙ শহর বাড়ি-ঘর বাজার চা-বাগান। কোম্পানীর বাগান সব বসে গেছে, উপর-তলার মতো অতটা ঠাণ্ডাও নয়, কাজেই সেখানে নানা গাছ ঝাউ বাদাম আখরোট পিচ পদম সব তেজ করেছে। নানা ফুলও সেখানে।
কিন্তু হিমালয়ের সব নিচের ধাপে যত কিছু ভালো মাটি এসে জমা হয়েছে জলে ধুয়ে একেবারে সমুদ্রের ধার পর্যন্ত, সেখানে ফুল-ফলের বাগান ক্ষেতের আর অন্ত নেই, মাটিতে সেখানে এত তেজ যে, যা দাও ফলবে, আর সেখানে শীতও বেশি নয় বরফও পড়ে না, সেখানে গাছ এক-একটা যেন একখানা গ্রাম জুড়ে রয়েছে, আর চারদিকে আম-কাঁঠালের বন!
পাহাড়ে বরফ পড়লে ইস্কুল বন্ধ করে আমি সেখানে চরতে যাই, নিজের চোখে দেখে এসেছি যা, তাই বলছি। ঋষিদের মতো চোখ বুজে ধ্যান করে গল্প বলবার জন্যে আমি ইস্কুল-মাস্টারি করতে আসিনি। ছাত্রগণ! চোখ দিয়ে দেখাই হল আসল দেখা, ঠিক দেখা আর চোখ বুজে ধ্যান করে দেখবার মানে খেয়াল দেখা বা স্বপন দেখা। খেয়ালীদের বিশ্বাস কর না, তা তাঁরা ঋষিই হন, কবিই হন। যা দুই চোখে দেখছি তাই সত্যি, তাছাড়া সব মিছা, সব কল্পনা, গল্পকথা, খেয়াল!
রামছাগল দাড়ি নেড়ে শিং বেঁকিয়ে কটমট করে তাদের দিকে তাকাচ্ছে দেখে সুবচনীর খোঁড়া-হাঁস হেলতে-দুলতে এগিয়ে এসে বললে – “ছাত্রগণ তোমাদের মাস্টার যা বললেন, ঠিক, চোখে না দেখলে কোনো জিনিসে বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু এই পাহাড় পর্বত কুয়াশায় যখন দেখা যায় না, তখন কি বলতে হবে কুয়াশার মধ্যে কিছু নেই? না বলতে হবে, সূর্য-চন্দ্র আকাশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ঠিক জিনিস সব সময়ে চোখে পড়ে না, সেইজন্য এই দুই চোখের উপরে নির্ভর করে থাকি বলে আমরা কোনোদিন মানুষের সমান হতে পারব না। মানুষের মধ্যে যাঁরা ঋষি, যাঁরা কবি, তাঁরা শুধু দুই চোখে দেখলেন না, তাঁরা ধ্যানের চোখে যা দেখতে পেয়েছেন সেইগুলো ধ্যান করে কেতাবে লিখেছেন, তা পড়লে তোমরা জানতে পারবে – এই হিমালয় প্রথমে সমুদ্রের তলায় ছিল। হঠাৎ একসময় পৃথিবীর মধ্যেকার তেজ মহাবেগে জল ঠেলে আকাশের দিকে ছুটে বার হল আর তাতেই হল সব পর্বত! যে সময়ে পাহাড় হয়েছিল সেই সময়ে কেউ দেখেনি কেমন করে কি হল, কিন্তু মানুষ ধ্যান করে অনুসন্ধান করে এই পাহাড়ের জন্ম যেন চোখে দেখে কেতাব লিখেছে।
“মাস্টার মহাশয়ের কথায় কি কেতাবগুলো অবিশ্বাস করবে!” বলে খোঁড়া একটি সমুদ্রের শাঁখ পাহাড়ের উপর থেকে তুলে নিয়ে রামছাগলকে দেখিয়ে বললে – “হিমালয় তো এককালে সমুদ্রের গর্ভে ছিল, এই শাঁখই তার পরমাণ!”
রামছাগল ঘাড় নেড়ে বললে – “ওকথা আমি বিশ্বাসই করিনে। নিশ্চয় কোনো পাখিতে এনে ওটাকে ফেলেছে।”
খোঁড়া বললে – “তা হয় না। সমুদ্রের একেবারে নিচে থাকে এই শামুক, পাখি সেখানে যেতে পারে না।”
রামছাগল তর্ক তুলল – “তবে মাছে খেয়েছে, সেই মাছ মরে ভেসে এসেছে সমুদ্রের ধারে, সেখানে পাখি তাকে খেয়ে শাঁকটা মুখে নিয়ে হিমালয়ে এনে ফেলেছে!”
খোঁড়া ঘাড় নেড়ে বললে – “তাও হয় না। সমুদ্রে যেখানে এই শাঁখ থাকত, সেখানে মাছ কেন, মানুষ পর্যন্ত যেতে পারা শক্ত!”
রামছাগল অমনি দাড়ি চুমড়ে বললে – “তবে মানুষ জানল কেমন করে এ-শাঁখ সমুদ্রের তলাকার, পাহাড়ের উপরকার নয়।”
সুবচনী পাছে তর্কে হেরে যায় রিদয় তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল – “জানো না, মানুষ ডুবুরি নামিয়ে মুক্তো তোলবার সময় এই সব শাঁখ কুড়িয়ে এনেছিল ঝুড়ি-ঝুড়ি!”
রামছাগল শিং নেড়ে বললে – “ঝুড়ি থেকে তারি গোটাকতক শাঁক হয়তো মাটিতে পরে গিয়েছিল।” হঠাৎ সুবচনী বললে – “তা নয়” – সুবচনী আরও কি বলতে যাচ্ছে অমনি রামছাগল রেগে বললে – “তা যদি নয় তো নিশ্চয় আগে শাঁখের সব ডানা ছিল, উড়ে এসেছে হাঁসেদের মতো এই পাহাড়ে।”
রিদয় অমনি বলে উঠল – “শাঁখের যদি ডানা থাকতে পারে তবে পাহাড়গুলোরও ডানা ছিল একথাই বা কেন বিশ্বাস করবে না?”
সুবচনী অমনি বলে উঠল – “আর প্রজাপতির মাথায় রামছাগলের মুখই বা না হবে কেন, তা বল!”
ভালুকে-শেয়ালে হাঁসে-ছাগলে তর্ক বেধে গেল, দেশের জানোয়ার সেই তর্কে যোগ দিয়ে চেঁচামেচি হট্টগোল বাধিয়ে দিলে।
শিকরা বহরী বাসা বাজ তুরমতি
কাহা কুহী লগড় ঝগড় জোড়াথুতি
ঠেটি ভেটি ভাটা হরিতাল গুড়গুড়
নানাজাতি কাক পেঁচা বাবুই বাদুর।
সবাই মিলে তর্ক লাগিয়েছে – “যাও-যাও হুঁদি খাও!” এমন সময় গণ্ডগোল শুনে পাহাড়ের গুহা থেকে বুড়ো লামা-ছাগল বেরিয়ে এলেন –
অতি দীর্ঘকক্ষ লোম পড়ে ঊরু পর
নাভি ঢাকে দাড়ি গোঁফে বিশদ চামর।
ববম-বম ববম-বম বলতে-বলতে লামাকে আসতে দেখে সবাই তটস্থ, ভালোমানুষ হয়ে বসল। লামা বললেন – “তোমরা সব কি বৃথা তর্ক করছ? দেখ কি ভয়ানক ব্যাপার, কোথায় তোমরা পড়া পড়বে, না, হাতা-হাতি বাধিয়েছ ভায়ে-ভায়ে – ”
অভেদ হইল ভেদ এ বড় বিরোধ
কি জানি কাহারে আজি কার হয় ক্রোধ!
ভ্রান্তজীব অন্ত না বুঝিয়ে কর দ্বন্দ্ব,
কারো কিছু ঠিক নাই কেবল কহে মন্দ;
উভয়ের মন তোরে মন্ত্রণা আমি কই,
তর্কে নাহি মেলে কিছু গণ্ডগোল বই;
শুন বাক্য গুরুবাক্য করেছে প্রামাণ্য;
একে পঞ্চ পঞ্চে এক, নাহি কিছু অন্য!
লামা ছাগল লেকচার শেষ করলেন অমনি বোকা ছাগলের দল জাতীয় সঙ্গীত শুরু করে দিলে –
জটজালিনী ক্ষুরশালিনী,
শিংঅধারিনী গো –
ঘনঘোষিণি ঘাস-খাদিনি,
গৃহ-পোষিণি গো।
চ্যেঁ ভ্যেঁ প্যেঁ পোঁ।
সেই সময় ভূমিকম্পে পাহাড় টলমল করে উঠল, অমনি হাঁসেরা রিদয়কে নিয়ে আকাশে উড়ে পড়ল। সব জানোয়ার ভয়ে লেজ গুটিয়ে চুপ হয়ে রইল! লামা-ছাগল মাঝে দাঁড়িয়ে দুলতে থাকলেন আর বলতে থাকলেন, “এ কি দোলায় যে, এঁ কি ভয়ানক বিয়াপার!”
রামছাগল লামার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বললেন – “পর্বতটা পার্বতী-পাঠশালা-সমেত উড়বে না কি – এঃ!”
সুরেশ্বর ছেড়ে বৃষ্টি আরম্ভ হল। এতদিন রোদে কাঠ ফাটছিল। সকালে যখন হাঁসের দল যাত্রা করে বার হল তখন আকাশ বেশ পরিষ্কার, কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের রাস্তা ধরে যতই তারা উত্তর-মুখে এগিয়ে চলল, ততই মেঘ আর কুয়াশা আর সঙ্গে-সঙ্গে বৃষ্টি দেখা দিলে! হাঁসের ডানায় পাহাড়ের হাওয়া লেগেছে, তারা মেঘ কাটিয়ে হু হু করে চলেছে; মাটির পাখিদের সঙ্গে রঙতামাশা করে বকতে-বকতে চলবার আর সময় নেই, তারা কেবলি টানা সুরে ডেকে চলেছে – “কোথায়, হেথায়, কোথায়, হেথায়।”
হাঁসের দলের সাড়া পেয়ে ব্রহ্মপুত্রের দুপারের কুঁকড়ো ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে জানান দিতে শুরু করলে। পুব-পারের কুঁকড়ো হাঁকলে – “সাতনল চন্দনপুর, কোমিল্লা, আগরতলার রাজবাড়ি, টিপারা, হীলটিপারা!” পশ্চিমপারের কুঁকড়ো হাঁকলে – “ভেংচার চর”, পশ্চিমে হাঁকলে – “চর ভিন-দোর।”
হাঁসেরা তেজে চলেছে, এবার ছোট-ছোট গ্রাম, নদীর আর নাম শোনা যাচ্ছে না, বড়-বড় জায়গার কুঁকড়ো হাঁকছে – “পাবনা, রামপুরবোয়ালিয়া, বোগরা, রাজসাহি, দিনাজপুর, রংপুর, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি!” পুবের কুঁকড়ো অমনি ডেকে বললে – “খাসিয়া-পাহাড়, গারো-পাহাড়, জৈঁতিয়া-পর্বত, কামরূপ।”
বুনো-হাঁসের দল পাহাড়-পর্বত অনেক দেখেছে, শিলিগুড়ি থেকে হিমালয় ডিঙিয়ে মানস-সরোবরে চট করে গিয়ে পড়া গেলেও তারা শিলিগুড়ি থেকে ডাইনে ফিরে, ফুলচাড়ি, হাড়গিলের চর, ধুবড়ি, শিলং, গৌহাটি, দিব্রুগড়, কামরূপ হয়ে যাবার মতলব করলে, কেননা, দার্জিলিঙ হয়ে যাওয়া মানে ঝড়-ঝাপটা, বরফের উপর দিয়ে যাওয়া, আর কামরূপের পথে গেলে ব্রহ্মপুত্র-নদের দুধারে নগরে গ্রামে চরে জিরিয়ে যাওয়া চলে।
রিদয় কিন্তু বেঁকে বসল, এত কাছে এসে দার্জিলিঙ যদি দেখা না হল তো হল কি? খোঁড়া-হাঁসের যদিও পায়ে বাত তবু রিদয়ের কথাতেই সে সায় দিয়ে বসল! ঠিক এই সময় শিলিগুড়ি থেকে ছোট রেল বাঁশি দিয়ে পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করলে, রিদয় আকাশের উপর থেকে দেখলে, যেন শাদা-কালো একটি গুটিপোকা এঁকে-বেঁকে পাহাড়ের গা বেয়ে চলেছে – হাসে চড়া রিদয়ের অভ্যেস, রেল এত ঢিমে চলছে দেখে ভেবেছিল, গুগলীর মতো কত বছরই লাগবে ওটার দার্জিলিঙ পৌঁছতে!
রিদয় চকাকে শুধোলে, “ওটা কতদিনে দার্জিলিঙ পৌঁছবে?”
চকা উত্তর দিলে – “এই সকাল আটটায় ছাড়ল, বেলা তিনটে-চারটেতে পৌঁছে যাবে!”
“আর আমরা কতক্ষণে সেখানে যেতে পারি” – রিদয় শুধোলে।
চকা উত্তর করলে – “যদি রাস্তায় কুয়াশা, হিম না পাই, তবে বড় জোর এক-ঘণ্টায় ‘ঘুম-লেকে’ গিয়ে নামতে পারি, সেখান থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে সিঞ্চল, কালিম্পং, লিবং, সন্দকফু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে কার্সিয়াং, টুং-সোনাদা হয়ে আবার ঘুমেতে নেমে একটু জল খেয়ে একচোট ঘুমিয়ে নিয়ে বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ দার্জিলিঙ-ক্যালকাটা রোডের ধারে আলুবাড়ির গুম্ফাটার কাছটায় তোমায় নামিয়ে দিতে পারি। আমরা তিব্বতের হাঁস, তার ওদিকে যাবার যো নেই – গেলেই গোরারা গুলি চালাবে!”
এত সহজে দার্জিলিঙ দেখা যাবে জেনে খোঁড়া-হাঁস পর্যন্ত নেচে উঠল। চকা তখন বললে – “এতবড় দল নিয়ে তো পাহাড়ে চলা দায়, ছোট রেলের মতো আমাদেরও ছোট করে ফেলা যাক। বড়-দলটা নিয়ে আন্দামানি কামরূপে হাড়গিলে চরে গিয়ে অপেক্ষা করুক; আর আমি, খোঁড়া, হংপাল, কাটচাল, নানকৌড়ি, চল দার্জিলিঙ দেখে আসি।” শিলিগুড়ি থেকে হাঁসের দল দুই ভাগ হয়ে চলল, ঠিক সেই সময় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নামল। কাঠ-ফাটা রোদের পরে নতুন বৃষ্টি পেয়ে মাটি ভিজে উঠেছে, পাতা গজিয়ে উঠেছে, বনের পাখিরা আনন্দে উলু-উলু দিয়ে কেবলি বলতে লেগেছে, বৃষ্টির গানঃ
বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর
বাজছে বাদল গামুর-গুমুর
ডাল-চাল আর মক্কা-মসুর
ফোঁটায়-ফোঁটায় নামে –
আকাশ থেকে নামে –
জলের সাথে নামে –
ঘরে ঘরে নামে –
টাপুর-টুপুর গামুর-গুমুর
গামুর-গুমুর টাপুর-টুপুর।
‘তিষ্টা’ নদীর কাছে এসে হাঁসেরা শুনলে নদীর দুপারে সবাই বলছেঃ
মেঘ লেগেছে কালা-ধলা
বইছে বাতাস জলা-জলা
বরফ-গলা পাগল-ঝোরা
শুকনা ধুয়ে আসে
তিষ্টা নদীর পাশে –
ঝাপুর-ঝুপুর ছাপুর-ছুপুর
ছাপুর-ছুপুর ঝাপুর-ঝুপুর।
নতুন জল-বাতাস পেয়ে পৃথিবী জুড়ে সবাই রোল তুলেছে, আকাশের হাঁসেরাই বা চুপ করে থাকে কেমন করে, তারা পাহাড়ের গাঁয়ে সিঁড়ির মতো ধাপে-ধাপে আলু, পেঁয়াজ, শাক-সবজী ক্ষেতগুলোর ধার দিয়ে ডাকতে-ডাকতে চলল – “রসা-জমি ধসে পড় না, বসে থেক না, ফসল ধরাও। নতুন বীজে ফল ধরাও!”
পাগলা-ঝোরার কাছ বরাবর এসে একখানা প্রকাণ্ড মেঘ হাঁসেদের সঙ্গ নিয়ে উত্তরমুখে চলল। কলকাতার এক বাবু পাহাড়ে রাস্তায় রবারের জুতো রবারের ওয়াটারপ্রুফ পরে বিষ্টির ভয়ে নাকে-কানে গলাবন্ধ জড়িয়ে মোটা এক চুরুট টানতে-টানতে ছাতা খুলে হাঁফাতে-হাঁফাতে চড়াই ভেঙে তাড়াতাড়ি বাড়ি-মুখো হয়েছেন দেখে হাঁসেরা রঙ্গ জুড়লেঃ
জল চাও না, চাও কিন্তু খাসা পাউরুটি
হয় না তো সিটি!
জলের ভয়ে তাড়াতাড়ি খুললে কেন ছাতা!
জল না হলে গাছে-গাছে ফলে পেঁপে আতা?
জল না পেলে কোথায় আলু পটোল চা!
হত নাকো রবার গাছ কিসে ঢাকতে পা?
বিষ্টি নইলে ছিষ্টি নষ্ট, সেটা মনে রেখ –
মেঘ দেখলে নাক তোলো তো উপোস করে থেক!
সকালে পাবে না ফল, রাতে জ্বলবে আঁত
না পাবে নদীতে মাছ ক্ষেতেতে ফসল –
ফোঁটা-ফোঁটা ঝরবে তখন তোমার চোখের জল।
বাবু একবার ছাতার মধ্যে থেকে আকাশে চেয়ে দেখলেন, রিদয় টুপ করে তার নাকের উপর একখানা শিল ফেলে হাততালি দিতে-দিতে হাঁসের পিঠে চড়ে চলল। মেঘখানা শিল বর্ষাতে-বর্ষাতে হাঁসের দলের পিছনে পিছনে আসছে, আর হাঁসেরা সারি দিয়ে আগে-আগে যেন মেঘখানাকে টেনে নিয়ে চলেছে – আকাশ দিয়ে পুষ্পকরথের মতো। তিন দরিয়ার অনেক উপরে দুই পাহাড়ের দেয়াল যেন কেল্লার বুরুজের মতো সোজা আকাশ ঠেলে উঠেছে একেবারে মেঘের কাছে, তারি গায়ে পাগলা-ঝোরা ঝরনা শাদা পৈতের মতো পাহাড়ের গা বেয়ে গাছ-পালার মধ্যে দিয়ে ঝুলে পড়েছে – এই পাহাড়ের দেওয়াল ডিঙিয়ে হাঁসেরা কা কার্সিয়ং-এর মুখে চলল – পাংখাবাড়ি থেকে কার্সিয়ং দুধারে ঝরনা আর চা বাগান সবজীক্ষেত থাকে-থাকে পাহাড়ের গায়ে বস্তি, সাহেবদের কুঠি, কার্সিয়ং শহরটা যেন আর এক ঝরনার মতো দেখা যাচ্ছে – পাহাড়ি গোলাপ গেঁদা গাছ-আগাছায় কুঁড়ি ধরেছে।
বাঁ ধারে দূরে কালো-কালো পাহাড়ের শিখরে বরফের পাহাড় যেন দুধের ফেনার মতো উথলে পড়েছে। একদল বাঙালী বৌ ছেলেপুলে নিয়ে কার্সিয়ং-এর ইস্টিশনের উপরের রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছে – গিন্নি সবে অসুখ থেকে উঠেছেন, তিনি ছাতি মাথায় দাণ্ডি চেপে চলেছেন, কর্তা লাঠি ধরে সঙ্গে, পিছনে চার মেয়ে, ছোট বড় তিন ছেলে, এক বৌ, দুই জামাই, একপাল নাতিপুতি হাসি-খুশি লুটোপুটি করে চলেছে! কেউ পাহাড় থেকে ফুল তুলছে, কেউ রাস্তা থেকে নুড়ি কুড়োচ্ছে, একটা ছেলের হাতে প্রজাপতির কুড়োজাল দেখে রিদয় চেঁচিয়ে বলল – “ধর না, ধর না, যক্ হবে।”
হাঁসেরা বলে চলল – “ফুল যত চাও তোল, গোলাপ ফুটল বলে, গাঁদা ওই ফুটেছে, চেরি ফুলে রঙ ধরেছে, আমরা এনেছি, নাও কলাই-শুটি নাও, ফুলকপি নাও, আপেল নাও, নাসপাতি যত পার নাও খাও দাও থোও, প্রজাপতি ধরা ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও!”
দেখতে-দেখতে মেঘে কার্সিয়ং ঢেকে গেল, ছেলে-বুড়ো ঘর-বাড়ি বাজার-ইস্টিশান মায় ছোট রেল গিদা পাহাড় ডাউন হিল সব কুয়াশায় চাপা পড়ল, দূরে সিঞ্চল মেঘের উপরে মাথা তুলে দেখা দিল! এইবার রিদয়ের শীত আরম্ভ হল। খোঁড়া-হাঁস ডানা ছড়িয়ে উড়ে চলেছে পালকের মধ্যে ঢোকবার যো নেই, জলে শীতে থরথর করে বেচারা কাঁপতে লাগল, খোঁড়াও বাঙলাদেশের মানুষ, পাহাড়ের শীতে তারও ডানার পালকগুলো কাঁটা দিয়ে উঠল, সে ডাক দিলে – “শীত-শীত হংপাল শীতে গেল।”
চকা হাঁকলে – “নেমে পড় কার্সিয়ং!”
হাঁসেরা অমনি মেঘের মধ্যে দিয়ে নামতে শুরু করলে। রিদয় দেখল, মেঘের মধ্যেটায় খোলা আকাশের চেয়ে কম ঠাণ্ডা, যেন পাতলা তুলোর বালাপোষ গায়ে দিয়েছে। হাঁসেরা নামতে-নামতে একটা বাড়ির ছাতে এসে বসল। বাড়ির বাইরে কেউ নেই, কুয়াশার ভয়ে সবাই ঘরে কাঁচ বন্ধ করে বসেছে, বাইরে কেবল গালফুলো একটুখানি একটা পাহাড়ি ছোঁড়া আগুন জ্বেলে কচি ছেলের একজোড়া পশমের মোজা তাতিয়ে নিচ্ছে আর সেই সঙ্গে নিজের হাত-পাগুলোও একটু সেঁকে নিচ্ছে, এমন সময় ঘর থেকে বাড়ির গিন্নী ডাক দিলেন – “টুকনী!”
ছেলেটা অমনি তাড়াতাড়ি হাতের মোজা জোড়া মাটিতে ফেলে দৌড় দিলে, চকা অমনি ছোঁ দিয়ে মোজাটা নিয়ে রিদয়কে দিয়ে বললে – “পড়ে ফেল উলের জামা।” রিদয় মোজাটা মাথায় গলিয়ে ছেঁড়া মোজার তিনটে ছেঁদা দিয়ে হাত আর মাথা বার করে ফিট হয়ে যেন সোয়েটার পরে দাঁড়াল।
হাঁসের দল তাকে পিঠে নিয়ে আকাশে উঠল – টুকনী ছোঁড়াটা নিচে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল – ‘আরে-আরে হাঁস মোজা লেকে ভাগা!”
রিদয় শুনলে গিন্নি চেঁচাচ্ছেন – “হাঁসে কখনও মোজা নেয়? নিশ্চয় মোজাটা পুড়িয়ে রেখে মিছে কথা বলছে! ফের ঝুটবাত বোলতা!”
টুকনীর মোজা-পোড়ানোর মামলার শেষ কি হল দেখবার আর সময় হল না! মেঘ তখন মুষলধারায় জল ঢালতে আরম্ভ করেছে, হাঁসেরা তাড়াতাড়ি মেঘ ছাড়িয়ে উঠতে লাগল আর বন-জঙ্গলকে ডেকে বলতে লাগল – “কত জল আর চাই বল, তেষ্টা যে মেটে না দেখি, মেটে না দেখি!” কিন্তু দেখতে দেখতে আকাশ নীল মেঘে ছেয়ে গেল, সূর্য কোথায় কোনদিকে তার ঠিক নেই, হাঁসেদের ডানার উপরে বিষ্টি ক্রমাগত চাবুকের মত পড়ছে, ডানার পালক ভিজে তাদের বুকের পালকে পর্যন্ত জল সেঁধিয়েছে, পাহাড়-পর্বত চড়াই-নাবাই গাছ-পালা ঘন কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেছে – দু’হাত আগে নজর চলে না। পাখিদের গান থেমে গেছে। হাঁসরা চলেছে ধীরে-ধীরে পথ খুঁজে-খুঁজে; রিদয় শীতে কাঁপছে আর ভাবছে, চুরি করার এই শাস্তি।
এই মেঘ আর কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চকা-নিকোবর যখন তাদের কটিকে নিয়ে সিঞ্চল পাহাড়ের সিঙে একটা ঝাউতলায় এসে বসল, তখন যেন রিদয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! পাহাড়ের চুড়োয় কেবল সোনালী ঘাসের বন আর এক-একটা ছাতার মতো প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পাথর বরফ-জল বয়ে চলেছে, পাতায়-পাতায় টিপটিপ করে বিষ্টি লাগছে কিন্তু শীত হলেও হাওয়া এখানে এমন পরিষ্কার যে রিদয় আনন্দে এদিকে-ওদিকে ছুটে বেড়াতে লাগল! বুনো-টেঁপারি- সোনালী-পাতা রুপোলী পাতা সোনা-ঘাস তুলে-তুলে রিদয় বোঝা বাঁধছে দেখে চকা হেসে বললে – “এগুলো হবে কি?”
রিদয় অমনি বলে উঠল – “দেশে গিয়ে দেখাব!”
খোঁড়া-হাঁস ভয় পেয়ে বললে – “ওই সমস্ত বোঝা নিয়ে ওড়া আমার কর্ম নয়, তুমি তবে রেলে করে বাড়ি যাও!”
চকা রিদয়কে ডেকে বললে – “খুব-কাজের জিনিস ছাড়া একটি বাজে জিনিস সঙ্গে নেওয়া আমাদের নিয়ম নয়, পেট ভরে টেঁপারি খাও তাতে আপত্তি নেই, ঘাস দু’কানে গুঁজতে পার তার বেশি নয়!”
রিদয় দু’কানে দুটো ঘাস গুঁজে টেঁপারি খেয়ে বেড়াচ্ছে এমন সময় ভালুকের সঙ্গে দেখা! রিদয় ভালুক নাচ অনেক দেখেছে কিন্তু এত বড় এমন রোঁয়াওয়ালা মিস-কালো ভালুক সে কোনোদিন দেখেনি, ভালুক তাকে দেখে দু’পা তুলে থপ-থপ করে এগিয়ে এসে বললে – “এখানে মানুষ হয়ে কি করতে এসেছ? পালাও না হলে শীতে মরে যাবে, বড় খারাপ জায়গা। গোরাগুলো পর্যন্ত এখানে টিক্তে পারেনি, কত লোক যে এখানে ঠাণ্ডা আর রাতের বেলায় ভূতের ভয়ে কেঁপে মরেছে তার ঠিক নেই। এখানে এককালে গোরা-বারিক ছিল কাণ্ডেল জাঁদরেল সব এখানে থাকত, এখন আর কেউ নেই। কোথায় গেছে তাদের বাগ-বাগিচা বাজার শহর, কেবল দেখ চারদিকে আগুন জ্বালাবার চুলোগুলো পড়ে আছে, শীতে সব গোরা ভূত বেরিয়ে এই-সব ভাঙাচুলির ধারে বসে আগুন পোহায় আর মদ খায়, হুক্কা-হুয়া গান গায়।”
ঠিক এই সময়ে শেয়াল-ডাকের মতো গান শোনা গেল, আর মেম সঙ্গে একটা গোরা বোতল হাতে টলতে-টলতে আসছে দেখা গেল। ভালুককে দূর থেকে দেখেই গোরা যেমন বন্দুক উঁচিয়েছে, অমনি ভালুক চট করে গাছের তলায় অন্ধকারে কালোয়-কালো মিশিয়ে গেছে! রিদয়ের গায়ে টকটকে মোজা – মেম তাকে ভাবলে কার পোষা বাঁদর, সে অমনি “মাংকি-মাংকি” বলে রিদয়কে ধরতে ছুটল! রিদয় তাড়াতাড়ি যেমন পালাতে যাবে অমনি পাহাড় থেকে গড়াতে-গড়াতে একেবারে কার্ট রোডে মাল-বোঝাই ছোট রেলের ছাতে এসে চিৎপাত!
রেলটা ঝরনা থেকে ফোঁস-ফোঁস করে খানিক জল ইঞ্জিনে ভরে নিয়ে ঘুম জোড়াবাংলার দিকে চলল ভক-ভক করে বকতে-বকতে। এদিকে ভালুকের কাছে খবর পেয়ে হাঁসেরা উড়েছে ঠিক রেলের সঙ্গে সঙ্গে – তারা দেখছে, রিদয় মালগাড়ির উপরটায় যেন একটি লাল নিশেনের মতো লটপট করছে। ঘুম বস্তিতে এসে রেল থামল। হাঁসেরা অমনি হাঁক দিলে – “ঘুম লেক যাও তো নেমে পড়!” কিন্তু তখন গাড়ির ঝাঁকানিতে রিদয়ের ঘুম এসেছে, সে হাত নেড়ে জানালে – “দার্জিলিঙ যাব!” এই সময় গাড়ির মধ্য থেকে একপাল ছেলে চেঁচিয়ে উঠল – “টুং সোনাদা ঘুম!” রিদয় চমকে উঠে দেখলে গাড়ি ছেড়েছে।
ঘুমের পরেই ‘বাতাসীয়া’ লাইন খুলেছে – এক-একটা পাহাড় কেটে সেগুলো কেল্লার বুরুজের মতো পাথরের টালি দিয়ে পাহাড়ি মিস্ত্রি সব গেঁথে তুলেছে। রিদয়ের মনে হল, ঠিক যেন কেল্লার মধ্যে ঢুকেছি! ঠিক সেই সময় হাঁসের দল ডাক দিল – “বাতাসীয়া বাতাস-জোর, ধরে বস্!” কিন্তু গুছিয়ে বসবার আগেই রিদয় বাতাসে লাল ছাতার মতো উড়ে একেবারে পথের মাঝে এসে বসল। সোঁ-সোঁ করে বাঁশি দিয়ে রেল দারজিলিঙের দিকে বেরিয়ে গেল।
পাহাড়ের মোড়টা সুনসান, লোক নেই, দূর থেকে একটা মোষের গাড়ি আসছে। রিদয় আস্তে-আস্তে সেই মোষের গাড়ি ধরে ঝুলতে-ঝুলতে দার্জিলিঙের বাজারে হাজির। হাঁসেরা মাথার উপর ডাক দিয়ে গেল – “আলুবাড়ি গুম্ফা মনে রেখ, সেখানে আমরা রইব।” রিদয় আলুবাড়ি-আলুবাড়ি নাম মুখস্থ করতে-করতে বাজার দেখতে চলল। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে – অন্ধকারে রিদয় ভিড়ের মধ্যে মিশে চলেছে। বাজারের ওধারে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়ে বরফের উপর সন্ধ্যার আলো যেন সোনার মতো ঝলক দিয়ে উঠল। তারপর গোলাপী, গোলাপী থেকে বেগুনী হয়ে আবার যে শাদা সেই শাদা বরফ দেখা দিলে। সেই সময় চৌরাস্তায় গোরার বাদ্যি শুরু হল, আর দলে-দলে লোক সেই দিকে ছুটল। রাস্তার দুধারে জুতো, খাবার, বাসন, গহনার দোকান – এখানে-ওখানে ভুটিয়া লামারা মড়ার মাথার খুলি নিয়ে ঘণ্টা-ডমরু বাজিয়ে নন্দি-ভৃঙ্গির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ের রাস্তা কখনো রিদয় ভাঙেনি, দু-এক চড়াই উঠে বেচারা হাঁপিয়ে পড়ল; কোথায় বসে জিরোব ভাবছে এমন সময় একটা খেলনার দোকানে নজর পড়ল, সেখানে লাল উলের মোজা পরানো ঠিক তারি মতো অনেকগুলো পুতুল সার্শির গায়ে কাগজের বাক্সোতে দাঁড় করানো রয়েছে! রিদয় চুপি-চুপি দোকানে ঢুকে একটা খালি বাক্স দেখে তারি মধ্যে শুয়ে রইল।
সার্শিমোড়া দোকানের মধ্যে বেশ গরম, এক খোট্টা বাবু বসে বিড়ি টানছেন আর একটা ভুটিয়া মেয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানের মধ্যে ফুটবল পোস্টকার্ড নানা পুতুল লজঞ্চুস মার্বেল এমনি সব সাজানো, দরজার উপরটায় একটা বিভীষণের মুখোশ হাঁ করে চোখ পাকিয়ে চেয়ে রয়েছে! রিদয় মুখোশটার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে এমন সময় এক বাবু দোকানে ঢুকেই বলে উঠলেন – “ওহে মার্কণ্ড, ছোট-খাটো দুটো পুতুল দাও দেখি, টুনু আর সুরূপার জন্যে!”
মার্কণ্ড তাড়াতাড়ি রিদয় যে-বাক্সে ছিল সেই বাক্সে আর একটা বিবি পুতুল দিয়ে কাগজে মুড়ে বাবুর হাতে দিলে। বাবু সেটাকে আলখাল্লার পকেটে ফেলে চুরুট ধরিয়ে পাহাড়ে রাস্তায় ঠক-ঠক লাঠি ঠুকতে-ঠুকতে বাড়ি-মুখো হলেন। পকেটের মধ্যে গরম পেয়ে রিদয় বিবি-পুতুলটির পাশে ঘুমিয়ে পড়ল, আবার যখন চোখ মেলে চাইলে তখন দেখলে বাক্সর ডালাটা খুলে গেছে। একটা কাঁচ-মোড়া বারাণ্ডায় গোটাকতক তুলি, এক বাক্স রঙ, একটা গদি মোড়া চৌকি, তারি উপরে একটা কালো কুকুর বাক্স থেকে তাকে টানাটানি করে খেলবার চেষ্টা করছে! কুকুরটা যদি কামড়ে দেয় – ! রিদয় ভাবছে, এমন সময় ওঘর থেকে ডাক এল “টমা-টমা-টমাসে!” কুকুরটা দৌড়ে ওঘরে গেল, সেই ফাঁকে রিদয় বাক্স থেকে চোঁচা দৌড়।
বাড়ির বাইরে থেকে সার্শিতে মুখ লাগিয়ে দেখলে একটা লাল-কম্বল-পাতা খাটে ছেলে-মেয়ে একদল বসে তাদের বড় ভাইটির কাছে গল্প শুনছে, আর একটা ছোট ছেলে ভুটিয়াদের লাল কাপড় পরে যে গল্প বলছে তার গলা জড়িয়ে ডাকছে – “পাখম দাদা, পাখম দাদা!”
শীতের রাতে আগুন জ্বালা ঘরখানি – এই ছেলের দল, এই হাসি-খুশি গল্প দেখে রিদয়ের চোখে জল আসতে লাগল। তারও ঘর আছে তারও দাদা আছে, দিদি আছে অথচ সব থেকেও নেই! কোথায় রইল তাদের আমতলি, কোথায় সেই মাটির দেওয়াল দেওয়া ঘরগুলি! রিদয়ের প্রাণ চাইছে এই ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে খেলে, কিন্তু হায়, সে বুড়ো-আংলা যক্ হয়ে গেছে, আর কি মানুষের ঘরে তার স্থান হবে! বুড়ো-আংলা জানলার বাইরে শীতে বসে অঝোরে কাঁদতে লাগল। সেই সময় বাবু হুকুম দিলেন – “এ রবতেন, কাল আলুবাড়ি জানে হোগা, ডাণ্ডি রাখ যাও!”
রবতেন ডাণ্ডিখানা জানলার বাইরে বারাণ্ডায় রেখে চলে গেল। রিদয় সে-রাত ডাণ্ডির ছৈটার মধ্যে কাটিয়ে বাবুর সঙ্গে যেমন এসেছিল, তেমনি ডাণ্ডিতে লুকিয়ে রওনা হল। পুতুলের মধ্যে টুনুর পুতুলটাই পাওয়া গেল, সুরূপার পুতুলটা নিশ্চয়ই টমা মুখে করে কোথায় ফেলেছে বলে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান হল না! সুরূপা টমার পিঠে দুই থাবড়া বসিয়ে পাহাড়ের উপর পা ছড়িয়ে কাঁদতে লাগল।
আলুবাড়ি থেকে রিদয়কে পিঠে নিয়ে জলা-পাহাড় কাট-পাহাড় পেরিয়ে হাঁসেরা এমন মেঘ আর শিলা-বৃষ্টি পেলে যে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকেই এগোতে পারল না, তাড়াতাড়ি ঘুরে ঝুপ-ঝাপ ঘুম লেকে গিয়ে পড়ল। ভয়ঙ্কর শিল পড়েছে, লেকের জলের উপরে বরফের সর পড়ে গেছে, পাহাড়ের গা বরফে সাদা হয়ে গেছে, খোঁড়া-হাঁসের পায়ের বাত কট-কট করে উঠল। সে বললে – “কাজ নেই বাপু এখানে থেকে, ফিরে চল, আর একবার আসা যাবে।” কিন্তু চল বললেই চলা যায় না – পাহাড় দেশে মেঘ, ভালো হওয়ার গতিক বুঝে তবে চলাচল করতে হয়। কোনো রকমে পাঁপড়া নানাকৌড়ি ঘুম-রকে চড়ে আকাশের ভাবটা জেনে আসতে চলল; অমনি রিদয় বললে – “আমি যাব ঘুম-রকে।” খোঁড়া বললে – “আমিও।” অমনি সবাই একসঙ্গে “আমিও আমিও” বলতে বলতে উড়ে গিয়ে রকের উপরে বসল।
মানুষের বাড়িতে যেমন কোনো জায়গা রাঁধবার, কোনোটা বৈঠকখানা, কোনোটা বা শোবার জায়গা, হিমালয়েতেও তেমনি এক-একটা জায়গা এক-এক কাজের জন্য আছে। মানুষের বাড়িতে যেমন দালান থাকে বারাণ্ডা থাকে, রক থাকে, হিমালয়েতেও তাই। ঘুম-রকটা হল ঘুম দেবার স্থান, জলাপাহাড় হল জল খাবার কিম্বা জলো হাওয়া খাবার জায়গা, রংটং হল ধোবিখানা, কাপড় রঙাবার জায়গা, টুং হল ঘড়ির ঘর, এমনি সব নানা রকম নানা দালান চাতাল গুহা এক-এক কাজের জন্যে রয়েছে।
ঘুম-রকে দিনে বড় কেউ আসে না, দু’চার পথিক পাখি কি জানোয়ার কখনো-কখনো জিরোতে বসে, না হলে জায়গাটা সারাদিন ফাঁকা থাকে দেখে বুড়ো রামছাগল মাস্টার এখানে ছানা পড়াবার জন্যে একটা ইস্কুল খুলেছেন। পাখির-ছানা শেয়াল-ছানা শুয়োর-ছানা ভালুক-ছানারা ঘুম-রকে বড় বড় পাথরের বেঞ্চিতে কেউ পা ঝুলিয়ে কেউ বা বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে সারাদিন ঝিমোচ্ছে আর রামছাগল শিঙের খোঁচায় তাদের জাগিয়ে দিয়ে কেবলি পড়াচ্ছেন, ক, খ, গ, ঐ বো স্যে! একে ঘুম-রক তাতে আজ বড় বাদলা, শিঙের খোঁচা খেয়েও তারা চুনে-চুনে পড়ছে দেখে রামছাগলও কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমের যোগার করছেন এমন সময় রিদয়কে নিয়ে হাঁসেরা উপস্থিত। অচেনা লোক দেখে মাস্টারমশায় তাড়াতাড়ি গা ঝাড়া দিয়ে মস্ত ম্যাপ আঁকা প্রকাণ্ড কালো সেলেটখানায় শিং বুলিয়ে ছেলেদের জিয়োগ্রাফি লেকচার শুরু করলেনঃ
জলের জন্তুরা চোখ ফুটেই দেখে জল আকাশ, ডাঙার জীব তারা দেখে বন-জঙ্গল মাঠ, আর পাহাড়ের ছেলেমেয়ে তারা দেখে আকাশের উপরে বরফে ঢাকা হিমালয়ের ওই চুড়ো ক’টা। হিম-আলয় সন্ধি করে হয়েছে হিমালয়, অর্থাৎ কিনা হিমালয় মানে হিমের বাড়ি, পাহাড়ি ভাষায় বলে হিমালয়, সমস্কৃতোতে বলে হিমাচলম্, ইংরেজ তারা ভাল রকম উচ্চারণ করতেই পারে না, ‘র’ বলতে ‘ল’ বলে ফেলে – তারা হিমালয়কে বলে ইমালোইয়াস্! হিমালয়ের মতো উঁচু পর্বত আর জগতে নেই। সব দেশের সব পর্বত আমাদের এই হিমালয়ের চুড়োর কাছে হার মেনেছে।
ধলা চামড়া জানোয়ারেরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, আমাদের বলে কালো, কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় পাহাড় মোটে ষোল হাজার ফুট আর আমাদের এই বাড়ির চুড়োগুলো কত উঁচু তা জানো? এর চল্লিশটা শিখর হচ্ছে চব্বিশ হাজার ফিট করে এক-একটি। ঐ কাঞ্চনজঙ্ঘা যেটা সকালে-সন্ধ্যায় সোনা আর দিনে রাতে দেখায় রুপো, ওটা হচ্ছে আটাশ হাজার ফুট, ওরও আরও হাজার ফুট উপরে ধবলাগিরির সব উঁচু চুড়ো ঊনত্রিশ হাজার ফুট। এর পাশে ধলা চামড়াদের জেতো পাহাড় – ফুঃ, রাজহস্তীর পাশে খরগোস। মানুষের কথা দূরে থাক পাখিরাও এই হিমালয়ের চুড়োয় চড়তে পারে না, এখানে না ঘাস না গাছ! মেঘ পর্যন্ত ভয় পায় সেখানে উঠতে, শুধু ধপ-ধপ করছে আছোঁয়া শাদা বরফ।
এই হিমালয়ের চুড়ো থেকে বরফ গলে বারোটা মহানদী ছিষ্টি হয়ে পুব-পশ্চিমে দুই মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে, হত দেশ কত বনের মধ্যে দিয়ে তার ঠিক নেই। এ-সব নদীর ধারে কত নগর কত গ্রাম কত মাঠঘাট জমি-জমা রাজ্য পেতে কত রকমের মানুষেরা রয়েছে তা গোনা যায় না।
এই হিমের বাড়ির চুড়োটা থেকে ধাপে-ধাপে পৃথিবীর দিকে নেমে গেছে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পর্বত প্রমাণ সিঁড়ি, এক-এক ধাপে রকম-রকম গাছ-পালা-পশু পাখি! এ-রকে সে-রকে পাথরের কাজাল এমন চওড়া যে সেখানে কতককালের পুরোনো পাথরের মেঝেতে বড়-বড় গাছের বন হয়ে রয়েছে, ঝরনা দিয়ে বর্ষার জল বরফের জল সব গড়িয়ে চলেছে। কোনো রকের উপর দিয়ে মানুষেরা রেল চালিয়ে দিয়েছে, বড় বড় শহর বসিয়ে বাজার বসিয়ে রাজত্ব করেছে।
জীব-জন্তুর অগম্য স্থান ধবলাগিরি, সেখানে কেবলি বরফ। এই সিঁড়ির রক, যাতে আমরা বাস করছি, এরি সব উপরের রকে শুধু বরফ আর শেওলা, একমাত্র চমরী গাই পাহাড়ি ছাগল আর ভেড়া, তার পরের ধাপে মানুষ-সমান ঘাস আর দেবদারু বন, সেখানে শেয়াল ভালুক হেঁড়েল এরাই যেতে পারে, তার পরের রকে নানা ফুলের বাগান, সেখানে প্রজাপতি পাখি খরগোস কুকুর বেড়াল ভোঁদড় ভাম বাঁদর হনুমান এরাই থাকে, সবশেষের ধাপে বেতবন বাঁশবন অন্ধকার ঘন জঙ্গল, সেখানে হরিণ মোষ বাঘ সাপ ব্যাঙ্ তার পরে চাটালো জমি যার উপর দিয়ে সহস্রধারা নদী সব বয়ে চলেছে, এরি পরে অগাধ সমুদ্র, নীল জল, শেষ দেখা যায় না, এই সমুদ্রের ওপারে যে কি, তা কেউ জানে না!
চকা অমনি বলে উঠল – “আমি জানি। নীল সমুদ্রের মাঝে পাহাড় আছে, টাপু আছে, তার পরে পৃথিবীর শেষ বরফের দেশ, সেখানে ছ’মাস রাত্রি ছ’মাস দিন; সেখানে পেঙ্গু পাখিরা বরফের বাসায় ডিম পাড়ে, ধলা ভালুক আছে, ধলা শেয়াল সিন্ধুঘোটক আছে, সব সেখানে শাদা, কালো কিছু নেই, দিন রাত সমান আলো, ঘুটঘুটে আঁধার মোটেই নেই, আমি সেইখানে পাঁচবার গেছি!”
চকার কথায় রামছাগল শিং বেঁকিয়ে বললে – “এত বুড়ো হলেম এমনি আজগুবি কথা তো শুনিনি।”
রিদয় এবার এগিয়ে এসে বললে – “যে হিমালয়ের চুড়ো এখান থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বরফে ঢাকা, ঐ হিমের বাড়ি গড়া নিয়ে কি কাণ্ড হয়ে গেছে এককালে, তার খবর চকা তো জানে না, রামছাগলও জানে না, মানুষেরা ধ্যান করে ওই নিচের তলাকার বনে বসে! ওই ধবলাগিরির উপরের খবর যা শাস্তর লিখে গেছে – তাই বলছি, শোনো। বড় চমৎকার কথা।”
সবাই অমনি রিদয়কে ঘিরে বসল কথা শুনতে, মেঘলা দিনে ভিজে স্যাৎস্যাঁত করছে, ভালুকের গা ঘেঁষে ছাগল, ছাগলের গা ঘেঁষে হাঁস, হাঁসের গা ঘেঁষে শেয়াল।
রিদয় বসে গল্প শুরু করলেঃ
হিমালয় কেমন, তা শুনলে! হিমালয়ের উপরে কি নিচে কি সমুদ্রের এপারে কি ওপারে কি সবই তো শুনলে, কিন্তু এগুলো তৈরি করলে কে, তার খবর রাখ? প্রথমে সেইটে বলি শোনো – একদিন বিশ্বকর্মা গোলার মতো একতাল কাদা পাকিয়ে নতুন পৃথিবী গড়তে বসলেন। চন্দ্র সূর্য গড়া হয়েছে এইবার সসাগরা আমাদের এর ধরা তিনি গড়তে আরম্ভ করলেন। সেদিনটাও এমনি আঁধার-আঁধার ছিল। বিশ্বকর্মার আর কাজে মনই যাচ্ছে না, তিনি কাদা দিয়ে কেবলি পৃথিবীটার উপরে বুড়ো আঙুলের টিপ দিয়ে এদেশ-সেদেশ গড়ে চললেন, সব দেশ মিলিয়ে দেশ-বিদেশগুলোর চেহারাটা হল ঠিক যেন হাড্ডিসার – এখানে-ওখানে মাটি-ঝরা শির-বার-করা বাঁকা-চোরা টোল-খাওয়া দোমড়ানো চোপসানো গরু ঘাড় ঝুঁকিয়ে সমুদ্রের জল খাচ্ছে, আর ঠিক তারি সামনে একটা গরুড় পক্ষীর ছানা, সেও যেন গো-ডিম থেকে সবে বার হয়ে মাছ ধরবার জন্যে সমুদ্রের দিকে গলা বাড়িয়েছে।
বিশ্বকর্মার পাশে বিশ্বামিত্র বসে ছিলেন; তাঁর বিশ্বাস, বিশ্বকর্মার চেয়ে গড়ন-পিটন করতে তিনি পাকা। বিশ্বকর্মার সঙ্গে বাজি রেখে প্রায়ই বিশ্বামিত্র এটা-ওটা গড়তেন, প্রত্যেক বারে বাজিও হারতেন কিন্তু তবু তাঁর বিশ্বাস গেল না যে তিনি পাকা কারিগর! বিশ্বকর্মার ছিষ্টি মিষ্টি আতা খেয়ে বিশ্বামিত্র এক আতা গড়লেন, দেখতে বিশ্বকর্মার আতার চেয়েও ভালো, কিন্তু সমুদ্রের জল দিয়ে গড়বার কাদা ছানার দরুন বিশ্বামিত্রের আতা এমনি নোনা হয়ে গেল যে মুখে দেবার যো নেই! ডিম ফুটে পাখি বেরোচ্ছে বিশ্বকর্মা ছিষ্টি করলেন, পাখিদের মা-বাপ – তাদের ডিম, ডিমের মধ্যে বাচ্চা – বিশ্বামিত্র বললেন, ‘ও কি হল? এ কি আবার ছিষ্টি! আমি গাছে পাখি ফলাব।’ বিশ্বামিত্র অনেক মাথা ঘামিয়ে অনেক জাঁক করে স্থির করলেন – ডিমে তা দেওয়া চাই কিন্তু পাখি তা দিলে তো চলবে না – তিনি এমন নারকেল গাছ সুপুরি গাছ তাল গাছ ছিষ্টি করলেন যাতে দিন ভোর রোদ পায় কিন্তু বেশি রোদ পেলে ডিম একেবারে সিদ্ধ হয়ে যাবে, আবার রাতে হিম পেলেও দষ্ট হবে, জল পেলে পচে যাবে! সব ভেবে-চিন্তে বিশ্বামিত্র বড়-বড় পাখির পালকের মতো পাতা গাছের আগায় বেঁধে দিয়ে সেই পাতার গোড়ায় দশটা বারোটা কুড়িটা পঁচিশটা করে ছোট বড় নানা রকম ডিম ঝুলিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন পাখি বার হয়, কিছু পাছে কাগে চিলে ঠুকরে ডিমগুলো ভেঙে দেয় সেজন্য বিশ্বামিত্র ডিমের খোলাগুলো এমনি শক্ত করে বানিয়েছেন যে বাচ্চা পাখি সেই পুরু নারকোল মালা নারকোল ছোবড়া তালের খোলা সুপুরির ছাল ভেঙে বার হতেই পারলে না। কোনোটা রোদে পক্ক কোনোটা অর্ধপক্ক কোনোটা অপক্কই রয়ে গেল। ডিম হল, তার শাঁস জল হল, তা দেওয়া হল, সবই হল কিন্তু তা থেকে পাখি হল না!
এতেও বিশ্বামিত্রের চৈতন্য হল না। বিশ্বকর্মাকে গোরূপা পৃথিবী গড়তে দেখে তাঁরও গড়বার সাধ হল। তখন বিশ্বকর্মা গোরূপা পৃথিবীর বাঁটের মতো এই ভারতবর্ষটি অতি যত্ন করে গড়েছেন, সব তখনো গড়া হয়নি কিন্তু এতেই মনে হচ্ছে এই দেশটি হবে চমৎকার, একেবারে কামধেনুর বাঁটের মতো দেশটি – যা চাই যত চাই এখানে পাওয়া যাবে। বিশ্বামিত্র তাড়াতাড়ি একটু কাদা নিয়ে বসলেন, ‘দাদা তুমি খানিক এই দেশটা গড়, আমিও খানিক গড়ি – দেখা যাক কার ভালো হয়।’ বিশ্বকর্মা ভারতবর্ষের আদড়াটা প্রায় শেষ করেছিলেন কাজেই বিশ্বামিত্র খারাপ করে দিলেও দেশটা একেবারে মাটি হয়ে যাবে না জেনে দেশটার উপরে বিশ্বামিত্রকে গড়া পেটা করতে দিতে বিশ্বকর্মা আপত্তি করলেন না। তাঁকে সমস্ত উত্তর দিকটা গড়তে ছেড়ে দিয়ে নিজে বাঙলাদেশটা গড়তে বসে গেলেন। বাঙলাদেশটা সুন্দর করে নদী গ্রাম ধানক্ষেত সুন্দর বন আম কাঁঠালের বাগান খড়ের চাল দেওয়া ছোট-ছোট কুঁড়ে ঘর দিয়ে চমৎকার করে সাজিয়ে তুলতে বিশ্বকর্মার বেশি দেরি লাগল না, বুড়ো আঙুলের দু’চার টিপ দিয়ে মাঠগুলো আর আঙুলের দাগ দিয়ে নদী-নালা বানিয়ে তিনি কাজ শেষ করে বসে বিশ্বামিত্রের দিকে চাইলেন। বিশ্বামিত্র অমনি বলে উঠলেন – “আমার কাজ অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে, দেখবে এস।”
বিশ্বকর্মার ছিষ্টি বাঙলাদেশ দেখে বিশ্বামিত্র এবারে নিন্দা করতে পারলেন না, চমৎকার! সুজলা সুফলা বীজ ছড়ালেই ফসল, কোথাও উঁচু-নিচু এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়-পর্বত নেই বললেই হয়, যতদূর চোখ চলে সবুজ ক্ষেত আর জলা। বিশ্বামিত্র দাড়ি নেড়ে বললেন – ‘হ্যাঁ, এবারের ছিষ্টিটা হয়েছে মন্দ নয়, কিন্তু আমার দেশটা আরো ভালো হয়েছে দেখসে’ বলে বিশ্বামিত্র বিশ্বকর্মাকে উত্তর-ভারতবর্ষটা কেমন হয়েছে দেখতে বললেন।
বিশ্বকর্মার আদড়া উল্টে-পাল্টে বিশ্বামিত্র গড়েছেন। পাঞ্জাবে টেনেছেন পাঁচটা নদীর খাত কিন্তু সেখানকার জমিতে সার মাটি না-দিয়ে তিনি দিয়েছেন বালি আর কাঁকর, ধানও হবে না, চালও হবে না, মানুষগুলো কেবল যেন জল খেয়েই থাকবে। তারপর পাহাড় অঞ্চলে দুজনে উপস্থিত – বিশ্বকর্মা বিশ্বামিত্রের কীর্তি দেখে অবাক! সেখানে যা পেরেছেন পাথর সবগুলো জড়ো করে এক হিমালয় পাহাড়ের ছিষ্টি করে বসেছেন বিশ্বামিত্র। তাঁর চিরকাল মাথায় আছে সূর্যের তাপ – গাছপালা মানুষ গরু সব জিনিসের পক্ষে ভালো, কাজেই তাঁর ছিষ্টি-করা পাহাড়দেশ তিনি যতটা পারেন সূর্যের কাছে ঠেলে তুলেছেন আর সেই সব পাথরের গায়ে এখানে-ওখানে দু-চার মুটো মাটি ছড়িয়ে দু-একটা ঘাসের চাপড়া লাগিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসেছেন।
বিশ্বামিত্র একগাল হেসে যেমন বলেছেন, ‘কেমন দাদা, ভালো হয়নি?’ অমনি ঝুপ-ঝুপ করে এক পশলা বৃষ্টি নামল আর পাহাড়ের সব মাটি ঘাস ধুয়ে গিয়ে খালি পাথর আর নুড়ি বেরিয়ে পড়ল। এদিকে পাহাড়ের এখানে-ওখানে উপরে-নিচে এত বিষ্টির জল জমা হল যে তাতে সারা পৃথিবীর নদীতে জল দেওয়া চলে!
বিশ্বকর্মা বলে উঠলেন – ‘করেছ কি, সব উল্টো-পালটা! যেখানে মাটি চাই, সেখানে দিয়েছ কাঁকর, যেখানে জল দরকার সেখানে দিয়েছ বালি, আর যেখানে জল মোটেই দরকার নেই সেখানে জমা করেছ রাজ্যের জলাশয়, তোমার মতলব তো কিছু বোঝা গেল না!’
বিশ্বামিত্র দাড়ি মোচড়াতে-মোচড়াতে বললেন – ‘শীতে যাতে লোক কষ্ট না পায় তাই দেশটা যতটা পারি সূর্যের কাছে এনে দিয়েছি, এতে দোষটা হল কি!’
বিশ্বকর্মা বললেন –‘উঁচু জমিতে দিনে যেমন গরম, রাতে তেমনি ঠাণ্ডা, এটা তো তোমার মনে রাখা উচিত ছিল, এত উঁচুতে তো কিছু গাছপালা গজানো শক্ত, গরমে জ্বলে যাবে বরফে সব জমে যাবে। এত পরিশ্রম তোমার সব মাটি হল, দেখছি!’
বিশ্বামিত্র মাথা চুলকে বললেন – ‘আমি সব এখানকার উপযুক্ত মানুষ ছিষ্টি করে দিই। তারা দেখবে এই পাহাড়কে ভূস্বর্গ করে তুলবে!’
বিশ্বকর্মা বললেন – ‘আর তোমার ছিষ্টি করে কাজ নেই, মানুষ গড়তে শেষে বাঁদর গড়ে বসবে!’
‘কোনো ভয় নেই, এবার আমি খুব সাবধানে গড়ছি। দেখ এবারে ঠিক হবে’ – বলে বিশ্বামিত্র একরাশ প্রজাপতির ডানা গড়ে রেখে বিশ্বকর্মাকে ডেকে বললেন – ‘দেখসে মজা!’
বিশ্বকর্মা ভেবেই পান না, এত ডানা নিয়ে বিশ্বামিত্র কি করবেন! তিনি শুধোলেন, - ‘এগুলো কি হবে ভাই?’
বিশ্বামিত্র খানিক কপালে আঙুল বুলিয়ে চিন্তা করে বললেন – ‘পাহাড়দের সব ডানা দিয়ে দিতে চাই, তারা যেখানে খুশি – শীতের সময় গরমদেশে, গরমের সময় শীতদেশে, উড়ে-উড়ে বিচরণ করতে পারবে, তা হলে এখানে যারা বাস করবে তাদের আর কোনো অসুবিধে হবে না।’
বিশ্বকর্মা ভয় পেয়ে বলে উঠলেন – ‘সর্বনাশ, পাহাড় যেখানে-সেখানে উড়ে বসতে আরম্ভ করলে যে-সব দেশে পাহাড়-পর্বত গিয়ে পড়বে, সেসব দেশের দশা কি হবে? লোকগুলো-সুদ্ধ সারা-দেশ যে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যাবে!’
বিশ্বামিত্র বলে উঠলেন – ‘তা কেন! লোকেরা সব ধন-দৌলত খাবার-দাবার নিয়ে পাহাড়ে চড়ে বসবে, তা হলেই কোনো গোল নেই?’
বিশ্বকর্মা বললেন – ‘সবাই পাহাড় চড়ে ঘুরে বেড়ালে আমার জমিতে হাল দেয় কে, রাজত্বই বা করে কে ঘর-বাড়িই বা বেঁধে থাকে কে!!’
‘তা আমি কি জানি’ – বলে বিশ্বামিত্র হিমালয়ের ডানা দিতে যান, এমন সময়ে বিশ্বকর্মা তাঁর হাত চেপে ধরে বললেন – ‘আগে হিমালয়ের বাচ্চা এই ছোট-খাটো মন্দর পর্বতটাকে ডানা দিয়ে দেখ, কি কাণ্ড হয়, পরে বড়টাকে নিয়ে পরীক্ষা কর।’
বিশ্বামিত্র মন্দর পর্বতে ডানা দিয়ে যেমন ছেড়ে দেওয়া, সে অমনি উড়তে-উড়তে বাঙলাদেশের দক্ষিণধারে যে-সব দেশ গড়া হয়েছিল সেইখানে উড়ে বসল! যেমন বসা অমনি সারাদেশ রসাতলে তলিয়ে গেল; মাটি যেখানে ছিল সেখানে একটা উপসাগর হয়ে গেছে দেখা গেল। মানুষ যারা ছিল তাদের চিহ্ন রইল না, কেবল মাছগুলো জলে কিল-বিল করতে লাগল, আর মন্দর পর্বতটা সমুদ্র তোলপাড় করে এমনি সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলে যে, জল-প্লাবনে বিশ্বকর্মার ছিষ্টি মাটি ধুয়ে যাবার যোগাড়!
বিশ্বকর্মা তাড়াতাড়ি সমুদ্রের ধারে-ধারে বালির বাঁধ দিয়ে জল ঠেকিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন – আমার হাতের কাজে তোমায় আর হাত দিতে দিচ্ছি নে। এই পৃথিবীর উত্তর শিয়র আর দক্ষিণ শিয়রে কিছু নেই, কিছু সৃষ্টি করতে হয় সেই দু’জায়গায় করগে। যে ভুলগুলো করেছ সেগুলো আমাকে শুধরে নিতে দাও এখন।’ বিশ্বামিত্রের হাত থেকে বিশ্বকর্মা গড়বার যন্তর-তন্তর কেড়ে নিয়ে পাহাড়ে যত জল জমা হয়েছিল, সমস্ত নালা কেটে ঝরনা দিয়ে সমুদ্রের দিকে বইয়ে দিলেন। বিশ্বকর্মার ছিষ্টিতে কিছু বাজে থাকবার যো নেই, নষ্ট হবার যো নেই – পাহাড়ের জল সমুদ্রে পড়ে, সেখান থেকে সূর্যের তাপে মেঘ হয়ে আকাশ দিয়ে দেশ-বিদেশে বিষ্টি দিয়ে ক্ষেতে-ক্ষেতে ফসল গজাতে চলল!
বিশ্বকর্মা ইন্দ্রকে বললেন – ‘বাজ দিয়ে মন্দর পর্বতের ডানা কেটে দাও!’ ডানা কাটা গেল, মন্দর সমুদ্রেই ডুবে রইল আর তার ডানার কুঁচিগুলো এখানে-ওখানে সমুদ্রের মাঝে টাপুর মতো ভাসতে লাগল। বিশ্বকর্মা সেগুলোর উপরে মাটি ছড়িয়ে দিলেন, বসতি বসিয়ে দিলেন। তারপর বিশ্বামিত্র যত ডানা গড়ে রেখেছিলেন সেগুলো দিয়ে বিশ্বকর্মা প্রজাপতি ভোমরা মৌমাছি সব গড়ে ছেড়ে দিলেন। তারা দেশ-বিদেশ থেকে ফুলের রেণু ফুলের মধু এনে পাহাড়ে-পাহাড়ে বাগান বসাতে শুরু করে দিলে। দেখতে-দেখতে পাথরের গায়ে সব ফুল গজাল ফল ফলল। সব ঠিক করে বিশ্বকর্মা প্রকাণ্ড দুটো ডানা দিয়ে দক্ষ প্রজাপতি ছিষ্টি করে হাত-পা ধুয়ে ভাত খেতে গেলেন, শাস্তরের ছিষ্টত্তত্ব তো এই হল, তারপর দক্ষ প্রজাপতির কথা পুরাণে লিখেছে যেমন, বলি, শোনো –
বিধির মানস সূত দক্ষমুনি মজবুত
প্রসূতি তাহার ধর্ম-জায়া।
তার গর্ভে সতীনাম অশেষ মঙ্গলধাম
জনম লভিল মহামায়া।
নারদ ঘটক হয়ে নানামতে বলে কয়ে
শিবেরে বিবাহ দিল সতী।
নারদ তো ঘটকালি নিয়ে সরে পড়লেন, এদিকে শিব ষাঁড়ে চড়ে ভুটিয়ার দলের সঙ্গে ডমরু বাজিয়ে জটায় সাপ জড়িয়ে হাড়মালা গলায় ঝুলিয়ে নাচতে-নাচতে হাজির।
দক্ষ প্রজাপতি বরের চেহারা দেখেই চটে লাল –
শিবের বিকট সাজ
দেখি দক্ষ ঋষিরাজ
বামদেবে হৈল বাম-মতি।
সেই থেকে জামাই শ্বশুরের মুখ দেখেন না। দক্ষ প্রজাপতিও শিবনিন্দে না করে জল খান না। এই সময়ে দক্ষ শিবহীন যজ্ঞ করলেন; সব দেবতা নেমতন্ন পেলেন। সতীর বোনেরা গয়না-গাটি পরে পালকি চড়ে শিবের বাড়ির সামনে দিয়ে ঝমর-ঝমর করতে-করতে বাপের বাড়ি মাছের মুড়ো খেতে চলল দেখে সতীর চোখে জল এল। দুঃখী বলে বাবা তাঁদের নেমতন্ন পাঠাননি!
সতী বোনেদের পালকির কাছে গিয়ে দিদির গলা ধরে কেঁদে-কেঁদে বললেনঃ
অশ্বিনীদিদি! আমাদের দুখিনী দেখিয়া পিতে
অবজ্ঞা করিয়া যজ্ঞে আজ্ঞা না করিলেন যেতে,
নিজ বাপ নহে অন্য শুনে হৃদে এই ক্ষুণ্ণ
আমা ভিন্ন নেমতন্ন করেছেন এই ত্রিজগতে।
অশ্বিনীদিদি আঁচলে সতীর চোখের জল মুছিয়ে বললেন – ‘তুই চল না। বাপের বাড়ি যাবি তার আবার নেমতন্ন কিসের? আয় আমার এই পালকিতে।’
সতী ঘাড় নেড়ে বললেন – ‘না ভাই – তিনি রাগ করবেন!’
‘তবে তুই তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পরে আয়’ বলে সতীর দিদিরা –
চতুর্দোলে সবে চড়ি চলিলেন হরষে
হেথায় শঙ্করী ধেয়ে করপুটে দণ্ডাইয়ে
চরণে প্রণতি হয়ে কহিলেন গিরিশে
আমি বাপের বাড়ি যাব।
শিব বললেন –
সতী তুমি যেতে চাচ্ছ বটে,
পাঠাইতে না হয় ইচ্ছে দক্ষের নিকটে।
আমাদের শ্বশুর জামায়ে কেমন ভাব শোনো –
আমাদের ভাব কেমন জামাই শ্বশুরে, যেমন দেবতা আর অসুরে,
যেমন রাবণ আর রামে, যেমন কংস আর শ্যামে,
যেমন স্রোতে আর বাঁধে, যেমন রাহু আর চাঁদে,
যেমন জল আর আগুনে, যেমন তেল আর বেগুনে,
যেমন পক্ষী আর সাতনলা, যেমন আদা আর কাঁচকলা,
যেমন ঋষি আর জপে, যেমন নেউল আর সাপে,
যেমন ব্যাঘ্র আর নরে, যেমন গোমস্তা আর চোরে,
যেমন কাক আর পেচক, যেমন ভীম আর কীচক।
‘দক্ষ যখন অমান্য করে বারণ করেছেন নিমন্ত্রণ, কেমন করে সেখানে তোমার যাওয়া হয়!’
সতী কিন্তু শোনেন না শিবের কথা, তিনি সেজেগুজে নন্দীকে সঙ্গে নিয়ে মহাদেবের ষাঁড়ে চড়ে বাপের বাড়ি চললেন দুঃখিনী বেশে। কুবের দেখে বাক্স ভরা এ-কালের সে-কালের গহনা এনে বললে – ‘মা, এমন বেশে কি যেতে আছে! বাপের বাড়িতে লোকে বলবে কি – ওমা, একখানা গয়নাও দেয়নি জামাই! সতী কুবেরের দেওয়া গহনা পরে সাজলেন, কিন্তু দক্ষ প্রজাপতির কন্যা এমন সুন্দরী যে সোনা হীরে তাঁর সোনার অঙ্গের আলোর কাছে টিম-টিম করতে লাগল। ‘দূর ছাই’ বলে সতী সেগুলো ফেলে দিয়ে পাহাড়ি ফুলের সাজে সেজে বার হলেন। ত্রিলোক সতীর চমৎকার বেশ দেখে ধন্য-ধন্য করতে-করতে সঙ্গে চলল।
এদিকে ছোট মেয়ে সতী এল না, কাজের বাড়ি শূন্য ঠেকছে, সতীর মা কেবলি আঁচলে চোখ মুচছেন এমন সময় দাসীরা এসে প্রসূতিকে খবর দিলে – ‘ও মা তোর সতী এলো ঐ!’ এই শুনে –
রাণী উন্মাদিনী-প্রায়
কৈ সতী বলিয়া অতি বেগে তথা ধায়।
অম্বিকারে দৃষ্টি করি বাহিরেতে এসে
আয় মা বলে লইয়া কোলে
নয়ন জলে ভাসে!
সতী মায়ের কাছে বসে একটু দুধ সন্দেশ খেয়ে সভা দেখতে চললেন। ইন্দ্র-চন্দ্র সব বসেছেন, বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠ সব বসেছেন দক্ষ প্রজাপতিকে ঘিরে, আর কালোয়াত সব গান-বাজনা করছে –
ধির্ কুট্ কুট্ তানা তাদিম তা, তা দিয়ানা ঝেন্না ঝেন্না
নাদেরে দানি তাদেরে দানি, ওদেরে তানা দেরে তানা
তাদিম তারয়ে তারয়ে দানি।
দেতারে তারে দানি ধেতেন দেতেন নারে দানি।
বেশ গান-বাজনা চলেছে – এমন সময়ে সভাতে সতীকে আসতে দেখেই দক্ষ শিব-নিন্দে শুরু করলেন। দক্ষ প্রজাপতিঃ
কেবল এ গ্রহ আনি নারুদ ঘটালে,
কনিষ্ঠা কন্যাটা আমি দিলাম জলে ফেলেঃ
বস্ত্রবিনা বাঘছাল করে পরিধান,
দেবের মধ্যে দুঃখী নাই শিবের সমান।
ভূত সঙ্গে শ্মশানে-মশানে করে বাস,
মাথার খুলি বাবাজীর জল খাবার গেলাস!
যায় বলদে বসে গলদেশে মালাগুলো সব অস্থি,
সিদ্ধি ঘোঁটার সদাই ঘটা বুদ্ধি সেটার নাস্তিঃ
অদ্ভুত সঙ্গেতে ভূত গলায় সাপের পৈতে,
তারে আনিলে ডেকে হাসিবে লোকে – তাই হবে কি সইতে!
পাগলে সম্ভাষা করা কোন প্রয়োজন,
সাগরে ফেলেছি কন্যা বলে বুঝাই মন।
দক্ষের শিব-নিন্দা শুনি সতী আর সইতে পারলেন না।
পতি-নিন্দা শুনি সতী জীবনে নৈরাশ,
ঘন-ঘন চক্ষে ধারা সঘনে নিশ্বাস;
পিতারে কুপিতা হইয়া অঙ্গ অবসান,
ধরা শয্যা করি ‘তারা’ ত্যেজিলেন প্রাণ!
সতী শিব-নিন্দা শুনে প্রাণত্যাগ করলেন, চারদিকে হাহাকার উঠল। সতীর সাতাশ বোন আকাশের তারা সব কাঁদতে লাগল, নন্দী কাঁদতে লাগল, ভৃঙ্গী কাঁদতে লাগল, দেবতারা কাঁদতে লাগলেন, মানুষেরা কাঁদতে লাগল –
ফিরে চাও মা বাঁচাও পরাণী,
ধূলাতে পতিত কেন পতিত-পাবনী;
দুটি নয়ন-তারা মুদিয়া তারা –
অধরা কেন ধরাসনে!
নন্দী গিয়ে কৈলাসে মহাদেবকে খবর দিলে – ‘মা আর নেই।’ তখন শিব ক্রোধে হুঙ্কার ছাড়লেন, অমনি শিবদাস সব দক্ষযজ্ঞ নাশ করতে আগুয়ান হল। মহাদেব যুদ্ধে চললেন, পৃথিবী কাঁপতে থাকল, মেঘ সব গর্জন করে উঠল, আকাশে বিদ্যুৎ বাজ ছুটোছুটি করতে থাকল কড়মড় করে, শিব ত্রিশূল হাতে সাজলেন –
মহারুদ্র রূপে মহাদেব সাজে,
ভবম্বম ভবম্বম সিঙ্গা ঘোর বাজে;
ফণাফণ ফণাফণ ফণী ফন্ন গাজে
মহারুদ্র রূপে মহাদেব সাজে;
ধকধ্বক ধকধ্বক জ্বলে বহ্নি ভালে,
ববম্বম ববম্বম মহাশব্দ গালে;
ধিয়াতা ধিয়াতা ধিয়া ভূত নাচে
উলঙ্গী উলঙ্গে পিশাচী পিশাচে।
চলে ভৈরবা ভৈরবী নন্দী ভৃঙ্গী
মহাকাল বেতাল তাল ত্রিশৃঙ্গী,
চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে
চলে শাঁখিনী পেতিনী মুক্ত কেশে।
ভূত-প্রেত নিয়ে শিব এসে উপস্থিত। ভয়ে কারু মুখে কথা নেই, মহাদেব হুকুম দিলেন ভূতিয়া ফৌজকে – যজ্ঞনাশ কর। অমনি –
রুদ্রদূত ধায় ভূত নন্দী ভৃঙ্গী সঙ্গিয়া
ঘোরবেশে মুক্ত কেশ যুদ্ধ রঙ্গ রঙ্গিয়া,
যক্ষ রক্ষ লক্ষ লক্ষ অট্ট অট্ট হাসিছে
যজ্ঞগেহ ভাঙ্গি কেহ হব্যগব্য খাইছে,
প্রেতভাগ সানুরাগ ঝম্প ঝম্প ঝাঁপিছে,
ঘোররোল গণ্ডগোল চৌদ্দলোক কাঁপিছে।
ভূত ভাগ পায় লাগ লাথি কিল মারিছে
বিপ্র সর্ব দেখি খর্ব ভোজ্য বস্ত্র সারিছে
ভার্গবের সৌষ্ঠবের দাড়ি গোঁফ ছিণ্ডিল
পূষণের ভূষণে দন্ত পাঁতি পড়িল,
ছাড়ি মন্ত্র ফেলি তন্ত্র মুক্ত কেশ ধায় রে,
হায় হায় প্রাণ যায় পাপ দক্ষ দায় রে!
নৈবিদ্যির থালা ফেলে বিশ্বামিত্র দৌড় – বশিষ্ঠ চম্পট, সবার দাড়ি গোঁফ ছিঁড়ে কিলিয়ে দাঁত ভেঙে ভূতেরা লম্ফ ঝম্প করতে লাগল –
মৌনী তুণ্ড হেঁট মুণ্ড দক্ষ মৃত্যু জানিছে।
মৈল দক্ষ, ভূত যক্ষ সিংহনাদ ছাড়িছে।
দক্ষ-নিপাত দেখে সতীর মা কেঁদে শিবকে বললেন –
সতীর জননী আমি, শাশুড়ী তোমার,
তথাপি বিধবা দশা হইল আমার?
প্রসূতির বাক্যে শিব সলজ্জ হইল
রাজ্যসহ দক্ষরাজে বাঁচাইয়া দিল।
ধড়ে মুণ্ড নাহি দক্ষ দেখিতে না পায়,
উঠে পড়ে ফিরে ঘুরে কবন্ধের প্রায় –
কন্দ-কাটা দক্ষের দুর্গতি দেখে ভূতেরা সব হাসতে লাগল, তখন শিবের কাছে ছিল পাহাড়ি একটা রামছাগল দড়ি দিয়ে হাড়-কাঠে বাঁধা। তিনি সেইটে নন্দীকে দেখিয়ে দিলেন। নন্দী তার মুড়োটা কেটে দক্ষের কাঁধে জুড়ে দিয়ে দক্ষ প্রজাপতির ডানা দুটো কেটে নিয়ে চলে গেল, শিব সতীদেহ নিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে কৈলাসে গেলেন! এর পরে আরও কথা আছে, কিন্তু এখানেই দক্ষযজ্ঞ শেষ – হরি হরি বল সবে পালা হৈল সায় – বলে রিদয় চুপ করলে।
রামছাগল ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকালে, খানিক চেয়ে থেকে বললে – “ফুঃ, এমন আজগুবি কথা তো কখনো শুনিনি। বুড়ো হয়ে শিং ক্ষয়ে গেল, এমন কথা তো কোনোদিন শুনলেম না যে প্রজাপতির মাথা হয় রামছাগলের মতো আর পাহাড়গুলোর গজায় ডানা!”
রামছাগল ছেলেদের বললেনঃ
ওসব বাজে কথায় বিশ্বাস করো না, বড় হয়ে মধুর সন্ধানে পেটের দায়ে তোমরা জানি দেশ-বিদেশে যাবে, এমন অনেক বাজে গল্পও তোমাদের এই দেশের পাহাড়-পর্বত নদ-নদীর নামে শুনতে পাবে। কেউ বলবে তোমার দেশ মন্দ, কেউ বলবে মন্দ নয়, কিন্তু মনে রেখ এই হিমালয়ের জলে বাতাসে তোমরা মানুষ, ভগবান তোমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো, সব চেয়ে উঁচু, সবচেয়ে চমৎকার বাড়ি দিয়েছেন। এই কথাটি সর্বদা মনে রেখ, কোনোদিন ভুলো না যে পৃথিবীর সেরা হচ্ছে এই হিমালয়, আর সেইটে ভগবান দিয়েছেন তাঁর কালো ছেলেদের। এই পাথরের সিঁড়ি এতকালের পুরোনো যে তার ঠিক ঠিকানা নেই। আগে এটা, তারপর গাছ-পালা, জন্তু-জানোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। পাখির ছানাগুলো জন্মাবার আগে যেমন তাদের বাসা তৈরি হয়ে থাকে, মানুষদের, জানোয়ারদের জন্মাবার আগে তেমনি জগৎমাতা আর বিশ্বপিতা তাদের জন্য এই চমৎকার হিমালয় আর সমুদ্র পর্যন্ত গেছে যে পাঁচ ধাপ পাথরের সিঁড়ি, তা প্রস্তুত করিয়েছিলেন। জীব-জন্তুরা জন্মে যাতে আরামে থাকে, কষ্ট না পায় সেই জন্য চমৎকার করে পাথর দিয়ে দালান রক এমনি সব নানা ঘর নানা বাড়ি তাঁরা সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিলেন!
কিন্তু কত কালের এই বাড়ি, একে পরিষ্কার রাখা, মেরামতে রাখা, যারা জন্মাতে লাগল তাদের তো সাধ্য হল না, এককালের নতুন বাড়ি পাথরের সিঁড়ি সব ভেঙে ফেটে পড়তে লাগল বর্ষায় এখানে ওখানে সোঁতো লাগল, শেওলা গজাল, হাওয়াতে ধুলো-মাটি এসে ধাপগুলোতে জমা হতে থাকল, ঝড়ে ভূমিকম্পে বড় বড় পাথর খসে-খসে এখানে-ওখানে পড়ল, এখানটা ধ্বসে গেল, সেখানটা বসে গেল, ওটা ভেঙে পড়ল, সেটা বেঁকে রইল, এইভাবে কালে-কালে ধাপগুলোর উপরের তলার মাটি ধুয়ে নিচের তলায় নামতে লাগল; আর ধাপে- ধাপে সেখানে যেমন মাটি পেলে নানা জাতের গাছপালা বন-জঙ্গল দেখা দিলে। উপর-তলার মাটি ধুয়ে গেছে সেখানে অল্পসল্প চাষবাস চলেছে দেখ, খুব ছোট-ছোট ক্ষেত, ছোট গ্রাম। মাঝের ধাপে অনেকটা মাটি জমা হয়েছে। সেখানে দেখ দার্জিলিঙ শহর বাড়ি-ঘর বাজার চা-বাগান। কোম্পানীর বাগান সব বসে গেছে, উপর-তলার মতো অতটা ঠাণ্ডাও নয়, কাজেই সেখানে নানা গাছ ঝাউ বাদাম আখরোট পিচ পদম সব তেজ করেছে। নানা ফুলও সেখানে।
কিন্তু হিমালয়ের সব নিচের ধাপে যত কিছু ভালো মাটি এসে জমা হয়েছে জলে ধুয়ে একেবারে সমুদ্রের ধার পর্যন্ত, সেখানে ফুল-ফলের বাগান ক্ষেতের আর অন্ত নেই, মাটিতে সেখানে এত তেজ যে, যা দাও ফলবে, আর সেখানে শীতও বেশি নয় বরফও পড়ে না, সেখানে গাছ এক-একটা যেন একখানা গ্রাম জুড়ে রয়েছে, আর চারদিকে আম-কাঁঠালের বন!
পাহাড়ে বরফ পড়লে ইস্কুল বন্ধ করে আমি সেখানে চরতে যাই, নিজের চোখে দেখে এসেছি যা, তাই বলছি। ঋষিদের মতো চোখ বুজে ধ্যান করে গল্প বলবার জন্যে আমি ইস্কুল-মাস্টারি করতে আসিনি। ছাত্রগণ! চোখ দিয়ে দেখাই হল আসল দেখা, ঠিক দেখা আর চোখ বুজে ধ্যান করে দেখবার মানে খেয়াল দেখা বা স্বপন দেখা। খেয়ালীদের বিশ্বাস কর না, তা তাঁরা ঋষিই হন, কবিই হন। যা দুই চোখে দেখছি তাই সত্যি, তাছাড়া সব মিছা, সব কল্পনা, গল্পকথা, খেয়াল!
রামছাগল দাড়ি নেড়ে শিং বেঁকিয়ে কটমট করে তাদের দিকে তাকাচ্ছে দেখে সুবচনীর খোঁড়া-হাঁস হেলতে-দুলতে এগিয়ে এসে বললে – “ছাত্রগণ তোমাদের মাস্টার যা বললেন, ঠিক, চোখে না দেখলে কোনো জিনিসে বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু এই পাহাড় পর্বত কুয়াশায় যখন দেখা যায় না, তখন কি বলতে হবে কুয়াশার মধ্যে কিছু নেই? না বলতে হবে, সূর্য-চন্দ্র আকাশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ঠিক জিনিস সব সময়ে চোখে পড়ে না, সেইজন্য এই দুই চোখের উপরে নির্ভর করে থাকি বলে আমরা কোনোদিন মানুষের সমান হতে পারব না। মানুষের মধ্যে যাঁরা ঋষি, যাঁরা কবি, তাঁরা শুধু দুই চোখে দেখলেন না, তাঁরা ধ্যানের চোখে যা দেখতে পেয়েছেন সেইগুলো ধ্যান করে কেতাবে লিখেছেন, তা পড়লে তোমরা জানতে পারবে – এই হিমালয় প্রথমে সমুদ্রের তলায় ছিল। হঠাৎ একসময় পৃথিবীর মধ্যেকার তেজ মহাবেগে জল ঠেলে আকাশের দিকে ছুটে বার হল আর তাতেই হল সব পর্বত! যে সময়ে পাহাড় হয়েছিল সেই সময়ে কেউ দেখেনি কেমন করে কি হল, কিন্তু মানুষ ধ্যান করে অনুসন্ধান করে এই পাহাড়ের জন্ম যেন চোখে দেখে কেতাব লিখেছে।
“মাস্টার মহাশয়ের কথায় কি কেতাবগুলো অবিশ্বাস করবে!” বলে খোঁড়া একটি সমুদ্রের শাঁখ পাহাড়ের উপর থেকে তুলে নিয়ে রামছাগলকে দেখিয়ে বললে – “হিমালয় তো এককালে সমুদ্রের গর্ভে ছিল, এই শাঁখই তার পরমাণ!”
রামছাগল ঘাড় নেড়ে বললে – “ওকথা আমি বিশ্বাসই করিনে। নিশ্চয় কোনো পাখিতে এনে ওটাকে ফেলেছে।”
খোঁড়া বললে – “তা হয় না। সমুদ্রের একেবারে নিচে থাকে এই শামুক, পাখি সেখানে যেতে পারে না।”
রামছাগল তর্ক তুলল – “তবে মাছে খেয়েছে, সেই মাছ মরে ভেসে এসেছে সমুদ্রের ধারে, সেখানে পাখি তাকে খেয়ে শাঁকটা মুখে নিয়ে হিমালয়ে এনে ফেলেছে!”
খোঁড়া ঘাড় নেড়ে বললে – “তাও হয় না। সমুদ্রে যেখানে এই শাঁখ থাকত, সেখানে মাছ কেন, মানুষ পর্যন্ত যেতে পারা শক্ত!”
রামছাগল অমনি দাড়ি চুমড়ে বললে – “তবে মানুষ জানল কেমন করে এ-শাঁখ সমুদ্রের তলাকার, পাহাড়ের উপরকার নয়।”
সুবচনী পাছে তর্কে হেরে যায় রিদয় তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল – “জানো না, মানুষ ডুবুরি নামিয়ে মুক্তো তোলবার সময় এই সব শাঁখ কুড়িয়ে এনেছিল ঝুড়ি-ঝুড়ি!”
রামছাগল শিং নেড়ে বললে – “ঝুড়ি থেকে তারি গোটাকতক শাঁক হয়তো মাটিতে পরে গিয়েছিল।” হঠাৎ সুবচনী বললে – “তা নয়” – সুবচনী আরও কি বলতে যাচ্ছে অমনি রামছাগল রেগে বললে – “তা যদি নয় তো নিশ্চয় আগে শাঁখের সব ডানা ছিল, উড়ে এসেছে হাঁসেদের মতো এই পাহাড়ে।”
রিদয় অমনি বলে উঠল – “শাঁখের যদি ডানা থাকতে পারে তবে পাহাড়গুলোরও ডানা ছিল একথাই বা কেন বিশ্বাস করবে না?”
সুবচনী অমনি বলে উঠল – “আর প্রজাপতির মাথায় রামছাগলের মুখই বা না হবে কেন, তা বল!”
ভালুকে-শেয়ালে হাঁসে-ছাগলে তর্ক বেধে গেল, দেশের জানোয়ার সেই তর্কে যোগ দিয়ে চেঁচামেচি হট্টগোল বাধিয়ে দিলে।
শিকরা বহরী বাসা বাজ তুরমতি
কাহা কুহী লগড় ঝগড় জোড়াথুতি
ঠেটি ভেটি ভাটা হরিতাল গুড়গুড়
নানাজাতি কাক পেঁচা বাবুই বাদুর।
সবাই মিলে তর্ক লাগিয়েছে – “যাও-যাও হুঁদি খাও!” এমন সময় গণ্ডগোল শুনে পাহাড়ের গুহা থেকে বুড়ো লামা-ছাগল বেরিয়ে এলেন –
অতি দীর্ঘকক্ষ লোম পড়ে ঊরু পর
নাভি ঢাকে দাড়ি গোঁফে বিশদ চামর।
ববম-বম ববম-বম বলতে-বলতে লামাকে আসতে দেখে সবাই তটস্থ, ভালোমানুষ হয়ে বসল। লামা বললেন – “তোমরা সব কি বৃথা তর্ক করছ? দেখ কি ভয়ানক ব্যাপার, কোথায় তোমরা পড়া পড়বে, না, হাতা-হাতি বাধিয়েছ ভায়ে-ভায়ে – ”
অভেদ হইল ভেদ এ বড় বিরোধ
কি জানি কাহারে আজি কার হয় ক্রোধ!
ভ্রান্তজীব অন্ত না বুঝিয়ে কর দ্বন্দ্ব,
কারো কিছু ঠিক নাই কেবল কহে মন্দ;
উভয়ের মন তোরে মন্ত্রণা আমি কই,
তর্কে নাহি মেলে কিছু গণ্ডগোল বই;
শুন বাক্য গুরুবাক্য করেছে প্রামাণ্য;
একে পঞ্চ পঞ্চে এক, নাহি কিছু অন্য!
লামা ছাগল লেকচার শেষ করলেন অমনি বোকা ছাগলের দল জাতীয় সঙ্গীত শুরু করে দিলে –
জটজালিনী ক্ষুরশালিনী,
শিংঅধারিনী গো –
ঘনঘোষিণি ঘাস-খাদিনি,
গৃহ-পোষিণি গো।
চ্যেঁ ভ্যেঁ প্যেঁ পোঁ।
সেই সময় ভূমিকম্পে পাহাড় টলমল করে উঠল, অমনি হাঁসেরা রিদয়কে নিয়ে আকাশে উড়ে পড়ল। সব জানোয়ার ভয়ে লেজ গুটিয়ে চুপ হয়ে রইল! লামা-ছাগল মাঝে দাঁড়িয়ে দুলতে থাকলেন আর বলতে থাকলেন, “এ কি দোলায় যে, এঁ কি ভয়ানক বিয়াপার!”
রামছাগল লামার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বললেন – “পর্বতটা পার্বতী-পাঠশালা-সমেত উড়বে না কি – এঃ!”