শৃগাল
মেঘনার মোহনায় চর যে কখন কোথায় পড়ে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আজ যেখানে জল, কাল সেখানে দেখা গেল চড়া পড়ে বালি ধূ-ধূ করছে; কাল সেখানে দেখছি চরে উলু-ঘাস, বালু-হাঁস; বছর ফিরতে সেখানে দেখলেম চরও নেই, হাঁসও নেই – অগাধ জল থৈ থৈ করছে! এক রাতের মধ্যে হয়তো নদীর স্রোত ফিরে গেল – জলের জায়গায় উঠল বালি, বালির জায়গায় চলল জল।
বাগদী-চরে হাঁসেরা যখন উড়ে বসল, তখন চরের চারদিকে জল – ডাঙা থেকে না-সাঁতরে চরে আসা মুশকিল। অপার মেঘনার বুকে এক-টুকরো ময়লা গামছার মতো ভাসছিল চরটি, কিন্তু রাত হতেই জল ক্রমে সরতে লাগল, আর দেখতে-দেখতে সরু এক টুকরো চরা ডাঙা থেকে বাগদী-চর পর্যন্ত, একটি সাঁকোর মতো দেখা দিলে।
চাঁদপুরের জঙ্গলে বসে খেঁকশিয়ালী হাঁসের দলের উপরে নজর রেখেছিল; কিন্তু চকা-নিকোবরকে সে চেনে; এমনি বেছে-বেছে নিরাপদ জায়গায় চকা তার দল নিয়ে রাত কাটাত যে এ-পর্যন্ত তার দলের একটি হাঁস শিয়ালে ধরতে পারেনি। মেঘনার পুব-তীরের জঙ্গল ভেঙে রাতের বেলায় খেঁকশেয়ালী শিকারে বেরিয়েছে, এমন সময় জলের বুকে কুমীরের পিঠের মতো সরু সেই চরটির দিকে চোখ পড়ল। এক লাফ দিয়ে সে চর ডিঙিয়ে পায়ে-পায়ে অগ্রসর হল। খেঁকশিয়ালী প্রায় হাঁসের দলে এসে পড়েছে, এমন সময় ছপ করে একটা ডোবার জলে তার পা পড়ল; অমনি চকা চমকে উঠে ডাক দিলে – “কেও?” আর সব হাঁস ডানা ঝেড়ে উড়ে পড়তে আরম্ভ করলে; সেই অবসরে তীরের মতো ছুটে গিয়ে শেয়াল লুসাই-হাঁসের ডানা কামড়ে ধরে হিড়-হিড় করে সেটাকে ডাঙার দিকে নিয়ে চলল।
সব হাঁসের সঙ্গে ভয় পেয়ে খোঁড়া-হাঁসও ডানা ছড়িয়ে আকাশে উঠল; কেবল রিদয় হাঁসের ডানা থেকে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে চোখ রগড়ে চেয়ে দেখলে অন্ধকারে সে একা, আর দূরে একটা কুকুর হাঁস ধরে পালাচ্ছে। অমনি রিদয় হাঁসটা কেড়ে নিতে শেয়ালের সঙ্গে ছুটল। মাথার উপর থেকে খোঁড়া-হাঁস একবার ডাক দিলে – “দেখে চল!” কিন্তু রিদয় তখন হৈ হৈ করে ছুটেছে। রিদয়ের গলা পেয়ে লুসাই কতকটা সাহস পেলে, কিন্তু বুড়ো-আঙুলের মতো ছেলে কেমন করে তাকে শেয়ালের মুখ থেকে বাঁচাবে, এটা তার বুদ্ধিতে এল না। এত দুঃখেও লুসাই-এর হাসি এল। সে প্যাঁক-প্যাঁক করে হাসতে-হাসতে চলল।
মাথার উপরে খোঁড়া-হাঁস রিদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে; তার ভয় – পাছে রিদয় খানায়-ডোবায় পড়ে হাত-পা ভাঙে। কিন্তু যক্ হয়ে অবধি খুব অন্ধকার রাতেও যকের মতো রিদয় দেখতে পাচ্ছে। খানা-খন্দ লাফিয়ে দিনের বেলার মতো রিদয় সহজে ছুটছে আর চেঁচাচ্ছে – “ছেড়ে দে বলছি, না হলে এক ইট মেরে পা খোঁড়া করে দেব!” কে তার কথা শোনে? শেয়াল এক লাফে চড়া ছেড়ে পারে উঠে দৌড়ে চলল। রিদয়ও চলেছে হাঁকতে-হাঁকতে – “মড়াখেকো-কুকুর কোথাকার। ছাড় বলছি, না হলে মজা দেখাব।”
চাঁদপুরের খেঁকশেয়াল যার নাম, আসামের জঙ্গলের হেন পাখি নেই যে তাকে জানে না। সে শহরে গিয়ে কতবার মুরগি, হাঁস ধরে এনেছে তাকে ‘মড়াখেকো-কুকুর’ বলে এমন সাহস কার? শেয়াল একটু থেমে যেমন ঘাড় ফিরিয়ে দেখেছে, অমনি রিদয় গিয়ে তার ল্যাজ চেপে পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিলে। মানুষটি বুড়ো-আংলা, তার কিলটিই কত বড়ই বা? শেয়ালের পিঠে যেন একটা বেদানা-বিচি পড়ল! কিন্তু মানুষের মতো গলার সুর শুনে শেয়াল সত্যি ভয় পেলে; সে ল্যাজ তুলে বনের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে চলল; আর রিদয় তার ল্যাজ ধরে টিকটিকির মতো ঝুলতে-ঝুলতে চলল – উলু-ঘাসের মধ্যে দিয়ে গা-ঘেঁষড়ে। কাঁকড়ার মতো ল্যাজে কি কামড়ে রয়েছে, সেটা দেখবার শেয়ালের অবসর ছিল না। সে একবারে নিজের গর্তের কাছে এসে দাঁড়িয়ে, মুখ থেকে হাঁসটা নামিয়ে সেটার বুকে পা দিয়ে দাঁড়াল, তখন তার চোখ পড়ল ল্যাজে গাঁথা বুড়ো আংলার দিকে! এই টিকটিকির মতো ছেলেটা – ইনি চাঁদপুরী শেয়ালকে জব্দ করবেন, ভেবে শেয়াল ফ্যাক করে মুখ ভেংচে হেসে বলল - “এইবার তোমার মনিবকে খবর দাওগে চাঁদপুরের শেয়াল হাঁস খেয়েছে।”
ছুঁচোলো-মুখ, নাটা-চোখ দেখে এতক্ষণে রিদয় বুঝলে এটা শেয়াল। কিন্তু শেয়াল তাকে ভেংচেছে, এর শোধ সে দেবেই দেবে! রিদয় আরো শক্ত করে ল্যাজ চেপে, দুই পায়ে একটা গাছ আঁকড়ে, যেমন শেয়াল হাঁ করে হাঁসটার গলা কাটতে গেছে অমনি পিছনে এক টান দিয়ে, হাঁস থেকে শেয়ালকে দু’হাত তফাতে টেনে নিয়েছে! আর সেই ফাঁকে লুসাই হাঁসও ভাঙা ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে উড়ে পালিয়েছে।
“হাঁস যাক, আজ তোকে খাব!” – বলে খেঁকশেয়ালী দাঁত-খিঁচিয়ে রিদয়কে ধরবার জন্যে কেবলি নিজের ল্যাজটার সঙ্গে ঘুরতে লাগল। রিদয়ও ল্যাজ আঁকড়ে চরকি বাজির মতো শেয়ালের সঙ্গে ঘুরতে থাকল, আর বলতে লাগল – “ধর দেখি মড়াখেকো-কুকুর!”
বনের মধ্যে শেয়াল-মানুষে চরক-বাজি এমনতর কেউ কোনোদিন দেখেনি। প্যাঁচা, চামচিকে, এমনকি দিনের পাখিরাও তামাশা দেখতে বার হল। কিন্তু রিদয় দেখলে তামাশা ক্রমে শক্ত হয়ে উঠছে – সে নিজে শেয়ালের ল্যাজ ছাড়তে চাইলেও, শেয়াল তাকে সহজে ছাড়ে কি না সন্দেহ! খেঁকশিয়ালী পাকা শিকারী; তার গায়ের শক্তিও যেমন বুদ্ধিও তেমনি, সাহসও কম নয়। রিদয় বুঝলে ঘুরে-ঘুরে সে নিজে যেমনি হাঁপিয়ে পড়বে অমনি টুপ করে তাকে ধরবে শেয়াল! রিদয় একবার চারদিকে চেয়ে দেখল, হাতের কাছে কোনো বড় গাছ আছে কি না। কাছেই একটা সরু ঝাউ-গাছ বন ঠেলে আকাশে সোজা উঠেছে, ঘুরতে ঘুরতে রিদয় সেইদিকে এগিয়ে গেল, তারপর হঠাৎ একসময় শেয়ালের ল্যাজ ছেড়ে একেবারে ঝাউ-গাছটার আগ-ডালে উঠে পড়ল। শেয়াল তখনো নিজের ল্যাজ কামড়াতে বোঁ-বোঁ লাঠিমের মতো ঘুরছে। রিদয় গাছের উপর থেকে চেঁচিয়ে বললেঃ
তাকুড়-তাকুড় তাকা!
যাচ্ছে শেয়াল ঢাকা!
থাকে-থাকে-থাকে
হুক্কাহুয়া ডাকে!
চাঁদপুরের কাঁকড়া-বুড়ি
কামড়েছে তার নাকে!
শেয়াল দেখলে শিকার তাকে ঠকিয়ে পালাল! সে গাছের তলায় হাঁ করে বসে রিদয়ের দিকে চেয়ে বললে – “রইলুম এখানে বসে, কতক্ষণে নেমে আসিস দেখি। তোকে না খেয়ে নড়ছিনে!” এক-ঘণ্টা গেল, দু-ঘণ্টা গেল, শেয়াল আর নড়ে না। ঝাউ গাছের সরু ডালে পা ঝুলিয়ে শীতের রাতে জেগে বসে থাকা যে কি কষ্ট আজ রিদয় বুঝলে। শীতে তার হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে, চোখ ঢুলে পড়ছে, কিন্তু ঘুমোবার যো নেই – পড়ে যাবার ভয়ে। আর বনের মধ্যে অন্ধকারই বা কত! দু’হাত তফাতে নজর চলে না – মিশ কালো ঘুটঘুটে চারিদিক! মনে হল যেন গাছ-পালা সব শীতে কালো পাথরের মতো পাষাণ হয়ে গেছে! একটি পাখি ডাকছে না, একটি পাতা নড়ছে না – সব নিথর নিঝুম! রিদয়ের মনে হচ্ছে রাত যেন ফুরোতে চায় না! – রিদয় আর না ঘুমিয়ে থাকতে পারে না! এই সময় ভোরের কনকনে বাতাস বইল, আর দেখতে-দেখতে ভুসো-কালির মতো রাতের রঙ ক্রমে ফিকে হতে-হতে মিশি থেকে রাঙা, রাঙা থেকে রুপোলী, রুপোলী থেকে সোনালী হয়ে উঠল। তারপর বনের ওপারে সূর্য উঠলেন। বেলায় উঠত, কাজেই সূর্যকে চিরকাল রিদয় দেখে এসেছে কাঁচা সোনার মতো হলুদ বর্ণ; সূর্য যে ক্ষেপা মোষের চোখের মতো এমন লাল টকটকে, তা তার জ্ঞান ছিল না; তার ঠিক মনে হল কে যেন রাত্তিরের কাণ্ডকারখানা শুনে রেগে তার দিকে চাচ্ছেন!
তারপর গাছের ফাঁকে ফাঁকে সকালের আলো উঁকি মারতে লাগল – বনের গাছ-পালা, জীব জন্তু রাতের আড়ালে আবডালে অন্ধকারে বসে কি কাণ্ড করেছে, তারি খোঁজ নিতে লাগল। বনের তলাকার চোরকাঁটা শেয়াল-কাঁটা, বাটি-কুটি, কাঁটা-খোঁচা, যা-কিছু সব যেন আলোর ধ্মকে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। ক্রমে মেঘে-মেঘে আলো পড়ল – রঙ ধরল; গাছের পাতা, ঘাসের শিষ, ফোটা-ফুলের পাপড়ি তার উপরে শিশিরের ফোঁটা – সবই আলোতে ঝলক দিতে লাগল! যেন সবাই সিঁদুর পরে সাটিনের কাপড়ে সেজেছে! ক্রমে চারিদিক আলোতে আলময় হয়ে উঠল; অন্ধকারের ভয় দেখতে-দেখতে কোথায় পালাল; আর অমনি কত পাখি, কত জীব-জন্তুই না বনে ছুটোছুটি আরম্ভ করল! লাল টুপি মাথায় কাঠঠোকরা ঠকাস-ঠকাস গাছের ডালে ঘা দিতে বসে গেল, কাঠবেরালি অমন খোপ ছেড়ে গাছের তলায় বসে কুটুস-কুটুস বাদাম ছাড়াতে লেগে গেল; গাং-শালিক, গো-শালিক, ছাতারে, গাছের তলায় নেমে শুকনো পাতা উল্টে-উল্টে কিড়িং-ফড়িং ধরে ধরে বেড়াতে লাগল; আগ ডালে বসে শ্যামা-দোয়েল শিস দিতে আরম্ভ করলে। রিদয়ের মনে হল সূর্য যেন সব পশু-পাখি কীট-পতঙ্গদের জাগিয়ে দিয়ে অভয় দিতে থাকলেন – রাত পালিয়েছে, তোরা ঘর ছেড়ে বার হ, আমি এসেছি, ভয় নেই!
রিদয় শুনলে মেঘনার চরে হাঁসেরা ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি লাগিয়েছে, দল একত্র হচ্ছে। চকা-নিকোবর হাঁকলে – “মানস-সরোবর! ধৌলাগিরি আও আও আও!” তারপর রিদয় দেখলে তার মাথার উপর দিয়ে নিকোবরের পুরো দল উড়ে চলল – খোঁড়া-হাঁসটি সুদ্ধ! রিদয় তাদের একবার ডাক দিলে, কিন্তু এত উপর দিয়ে হাঁসেরা চলেছে যে তার ডাক শুনলে কিনা বোঝা গেল না – উড়তে উড়তে আকাশে মিলিয়ে গেল। রিদয় স্থির করলে হাঁসেরা নিশ্চয়ই দেখেছে শেয়ালে তাকে খেয়েছে। সে হতাশ হয়ে আকাশে চেয়ে রইল। কিন্তু এত দুঃখেও সকালের আলো আর বাতাস, সে যেখানটিতে বসে আছে সেই ডালটি সোনার রঙে রাঙিয়ে ঝাউ পাতার মধ্যে দিয়ে চুপিচুপি তাকে এসে বলতে থাকল – “ভয় কি? দিন হয়েছে – সূর্য উঠেছেন; আমরা থাকতে কিসের ভয়!” ঠিক সে সময় কমলালেবুর রঙের সাজ পরে হলুদবর্ণ যে সূর্য আমতলির মাঠে রোজ-রোজ রিদয়কে দেখা দিতেন, তিনি চাঁদপুরের জঙ্গলের উপরে দেখা দিলেন।
বেলা প্রায় এক প্রহর। রিদয় গাছের উপরে, শেয়াল নিচে বসে আছে, হাঁসের দলেরও কোনো খবর নেই, যে-যার খাবার সন্ধানে বেরিয়ে গেছে। ঠিক যখন বেলা ন’টা, তখন দেখা গেল, বনের মধ্য দিয়ে একটিমাত্র হাঁস যেন উড়তেই পারছে না, এই ভাবে আস্তে-আস্তে চলেছে। খেঁকশেয়ালী অমনি কান খাড়া করে হাঁসের দিকে নাক উঠিয়ে পায়ে-পায়ে এগিয়ে চলল। হাঁসটা শেয়ালকে দেখেও দেখলে না, তার নাকের সামনে দিয়েই উড়ে চলল। হাঁসটাকে ধরবার জন্য শেয়াল একবার ঝম্প দিলে, হাঁস অমনি ফিক করে হেসে, উড়ে গিয়ে চড়ায় বসল। এর পরেই আর-এক হাঁস ঠিক তেমনি করে আরো-একটু মাটির কাছ দিয়ে উড়ে চলল; শেয়ালটা লাফ দিলে; তার কানের রোয়া গুলো হাঁসের পায়ে ঠেকল, কিন্তু ধরতে পারলে না – হাওয়ার মতো হাঁস উড়তে উড়তে চড়ার দিকে চলে গেল। একটু পরে আর এক হাঁস – এটা যেন উড়তেই পারছে না – একেবারে মাটির কাছ দিয়ে ঝাউ-গাছের গা-ঘেঁষে উড়ে চলল। এবারে প্রাণপণে শেয়াল ঝম্প দিলে। ধরেছে, এমন সময় হাঁস সোঁ-করে তার দাঁতে পালক বুলিয়ে দিয়ে একেবারে মুখের মধ্যে থেকে পালিয়ে গেল। এবার যে এল, সে এমনি বেকায়দায় লটপট করে উড়ে আসছে যে খেকশেয়াল ভাবলে – একে তো আগে ধরেছি! কিন্তু বারবার তিনবার ঠকে শেয়াল বিরক্ত হয়ে উঠেছে, সে হাঁসের দিক থেকে মুখটা ফিরিয়ে গোঁ হয়ে রইল। যে-পথে আগের তিনটে হাঁস গেছে, এটাও সেই পথ ধরে ঝাউ-তলায় এসে শেয়ালের এত কাছ দিয়ে চলল যে শেয়াল আর স্থির থাকতে না পেরে দিয়েছে লাফ এমন জোরে যে তার ল্যাজটা ঠেকল হাঁসের পিঠে। কিন্তু হাঁসও পাকা; সে সাঁ-করে শেয়ালের পেটের নীচে দিয়ে গলে তার ঝাঁটার মতো ল্যাজে ডানার এক থাপ্পড় বসিয়ে হাসতে-হাসতে চম্পট দিলে। শেয়ালের আর দম নেবার সময় হল না, ঝপ-ঝপ করে আরো গোটা-পাঁচেক হাঁস নাকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল, একটাকেও সে ধরতে পারলে না – লাফানি-ঝাঁপানি সার হল! এবারে পর-পর আবার পাঁচটা হাঁস একে-একে শেয়ালকে লোভ দেখিয়ে সজোরে তার পিঠে ডানার বাতাস দিয়ে হোঃ-হোঃ করে হাসতে-হাসতে একেবারে তার রগ ঘেঁষে চলে গেল; কিন্তু শেয়াল না-রাম না-গঙ্গা – চুপ করে বসে রইল। সে বুঝেছে চকা-নিকোবরের দল কাল রাতে হাঁস নিয়ে যাওয়ার শোধ তুলতে মস্করা লাগিয়েছে।
অনেকক্ষণ আর হাঁসেদের দেখা নেই, শেয়াল ভাবছে তারা গেছে, এমন সময় চকা-নিকোবর দেখা দিলেন। তার সেই পাকা পালক, ছিনে গলা দেখেই শেয়াল তাকে চিনে নিলে। একটা ডানা বেঁকিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এক-কাৎ হয়ে সে উড়ে এল – একেবারে যেন চলতেই পারে না, এই ভাবে। শেয়াল এবারে লাফ দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত হাঁসটাকে তাড়িয়ে গেল; কিন্তু হাঁস যেন ধরা দিয়েও দিলে না; সোজা গিয়ে চরে বসে প্যাঁক-প্যাঁক করে হেসে উঠল। শেয়াল একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে জঙ্গলের দিকে ফিরে দেখলে – এবারে চমৎকার ধবধবে মোটা-সোটা রাজহাঁস তার দিকে উড়ে আসছে। বনের অন্ধকারে তার শাদা ডানা-দু’খানা যেন রুপোর মতো ঝক-ঝক করছে। এবারে শেয়ালের নোলা সকসক করে উঠল। সে এমন লাফ দিলে যে ঝাউ-গাছের পাতাগুলো তার গায়ে খোঁচা মারলে, কিন্তু রাজহাঁস ধরা পড়ল না – সোজা ঝাউ-গাছ ঘুরে চড়ায় গিয়ে উঠল।
এর পর আর হাঁসের সাড়া-শব্দ নেই; সব চুপচাপ। শেয়াল ঝাউ-গাছের দিকে চেয়ে দেখলে, ছেলেটাও সেখান থেকে সরে পড়েছে! শেয়াল ফ্যাল-ফ্যাল করে চারিদিকে চাইছে এমন সময় চড়ার দিক থেকে একে-একে হাঁস সব আগেকার মতো তাকে লোভ দেখিয়ে উড়ে চলল। কিন্তু শেয়ালের তখন মাথার ঠিক নেই; সে পাগলের মত কেবল ঝাঁপাঝাঁপি লাফালাফি করতে থাকল আর কেবলি হাঁস তার নাকের সামনে দিয়ে যেতে থাকল – এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, দশ, পনেরো, কুড়ি, বাইশ! শেয়াল তাদের একটি পালক পর্যন্ত ছিঁড়ে নিতে পারলে না। শেয়াল এমন নাকাল কখনো হয়নি। চাঁদপুরের শেয়াল সে, কতবার গুলির মুখ থেকে মুরগি হাঁস শিকার করেছে তার ঠিক নেই; শেয়ালের রাজা বললেই হয়; কিন্তু এই শীতকালে হাঁস শিকার করতে আজ তার ঘাম ছুটে গেল! সারাদিন ধরে মোটা-সোটা চিক-চিকে হাঁস দলে-দলে তার নাকের উপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে, অথচ একটাকেও সে ধরে খিদে মেটাতে পারছে না! সব চেয়ে তার লজ্জা – মানুষটাও তাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে! আর তার দুর্দশার কথা সেই পোষা রাজহাঁসটাও জেনে গেল! দেশে-দেশে নিশ্চয়ই তারা চাঁদপুরের খেঁকশেয়ালের কীর্তি কাহিনী রাষ্ট্র করে দেবেই-দেবে।
ভোরে এই শেয়ালের গা চিকচিকে, ল্যাজ মোটা, রোঁয়াগুলো কেমন যেন সাটিনের মতো খয়েরি-কালো-শাদা ঝক-ঝক করছিল; কিন্তু বিকেলে তার পেটের চামড়া ঝুলে পড়েছে, গা ধুলো-ঘামে কাদা হয়ে গেছে, চোখ ঝিমিয়ে পড়েছে, জিভ চার-আঙুল বেরিয়ে পড়ে মুখে গোটানাল ভাঙছে। তাকে দেখে কে বলবে সকালের সেই দুরন্ত শেয়াল! সারাদিন ধরে কেবলি দেখছে যেন চোখের সামনে হাঁস ঘুরছে। সে গাছের তলায় সূর্যের আলো দেখে ভাবছে হাঁস; প্রজাপতি উড়লে হাঁস বলে লাফিয়ে ধরতে যাচ্ছে! যতক্ষণ দিনের আলো রইল চকা-নিকোবরের দল কিছু দয়া-মায়া না করে শেয়ালকে হয়রান করেই চলল। শেয়ালের তখন আর নড়বার শক্তি নেই, সে কেবল মাটির উপরে হাঁসের ছায়াগুলো থাবা দিয়ে-দিয়ে আঁচড়াতে থাকল। হাঁসেরা যখন দেখলে শেয়ালটা মড়ার মতো শুকনো পাতার উপরে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লেগেছে, তখন তারা – “কেমন! কেমন! হাঁস ধরবে!” বলতে-বলতে চাঁদপুরের জঙ্গল ছেড়ে নালমুড়ির চরের দিকে চলে গেল।
মেঘনার মোহনায় চর যে কখন কোথায় পড়ে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আজ যেখানে জল, কাল সেখানে দেখা গেল চড়া পড়ে বালি ধূ-ধূ করছে; কাল সেখানে দেখছি চরে উলু-ঘাস, বালু-হাঁস; বছর ফিরতে সেখানে দেখলেম চরও নেই, হাঁসও নেই – অগাধ জল থৈ থৈ করছে! এক রাতের মধ্যে হয়তো নদীর স্রোত ফিরে গেল – জলের জায়গায় উঠল বালি, বালির জায়গায় চলল জল।
বাগদী-চরে হাঁসেরা যখন উড়ে বসল, তখন চরের চারদিকে জল – ডাঙা থেকে না-সাঁতরে চরে আসা মুশকিল। অপার মেঘনার বুকে এক-টুকরো ময়লা গামছার মতো ভাসছিল চরটি, কিন্তু রাত হতেই জল ক্রমে সরতে লাগল, আর দেখতে-দেখতে সরু এক টুকরো চরা ডাঙা থেকে বাগদী-চর পর্যন্ত, একটি সাঁকোর মতো দেখা দিলে।
চাঁদপুরের জঙ্গলে বসে খেঁকশিয়ালী হাঁসের দলের উপরে নজর রেখেছিল; কিন্তু চকা-নিকোবরকে সে চেনে; এমনি বেছে-বেছে নিরাপদ জায়গায় চকা তার দল নিয়ে রাত কাটাত যে এ-পর্যন্ত তার দলের একটি হাঁস শিয়ালে ধরতে পারেনি। মেঘনার পুব-তীরের জঙ্গল ভেঙে রাতের বেলায় খেঁকশেয়ালী শিকারে বেরিয়েছে, এমন সময় জলের বুকে কুমীরের পিঠের মতো সরু সেই চরটির দিকে চোখ পড়ল। এক লাফ দিয়ে সে চর ডিঙিয়ে পায়ে-পায়ে অগ্রসর হল। খেঁকশিয়ালী প্রায় হাঁসের দলে এসে পড়েছে, এমন সময় ছপ করে একটা ডোবার জলে তার পা পড়ল; অমনি চকা চমকে উঠে ডাক দিলে – “কেও?” আর সব হাঁস ডানা ঝেড়ে উড়ে পড়তে আরম্ভ করলে; সেই অবসরে তীরের মতো ছুটে গিয়ে শেয়াল লুসাই-হাঁসের ডানা কামড়ে ধরে হিড়-হিড় করে সেটাকে ডাঙার দিকে নিয়ে চলল।
সব হাঁসের সঙ্গে ভয় পেয়ে খোঁড়া-হাঁসও ডানা ছড়িয়ে আকাশে উঠল; কেবল রিদয় হাঁসের ডানা থেকে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে চোখ রগড়ে চেয়ে দেখলে অন্ধকারে সে একা, আর দূরে একটা কুকুর হাঁস ধরে পালাচ্ছে। অমনি রিদয় হাঁসটা কেড়ে নিতে শেয়ালের সঙ্গে ছুটল। মাথার উপর থেকে খোঁড়া-হাঁস একবার ডাক দিলে – “দেখে চল!” কিন্তু রিদয় তখন হৈ হৈ করে ছুটেছে। রিদয়ের গলা পেয়ে লুসাই কতকটা সাহস পেলে, কিন্তু বুড়ো-আঙুলের মতো ছেলে কেমন করে তাকে শেয়ালের মুখ থেকে বাঁচাবে, এটা তার বুদ্ধিতে এল না। এত দুঃখেও লুসাই-এর হাসি এল। সে প্যাঁক-প্যাঁক করে হাসতে-হাসতে চলল।
মাথার উপরে খোঁড়া-হাঁস রিদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে; তার ভয় – পাছে রিদয় খানায়-ডোবায় পড়ে হাত-পা ভাঙে। কিন্তু যক্ হয়ে অবধি খুব অন্ধকার রাতেও যকের মতো রিদয় দেখতে পাচ্ছে। খানা-খন্দ লাফিয়ে দিনের বেলার মতো রিদয় সহজে ছুটছে আর চেঁচাচ্ছে – “ছেড়ে দে বলছি, না হলে এক ইট মেরে পা খোঁড়া করে দেব!” কে তার কথা শোনে? শেয়াল এক লাফে চড়া ছেড়ে পারে উঠে দৌড়ে চলল। রিদয়ও চলেছে হাঁকতে-হাঁকতে – “মড়াখেকো-কুকুর কোথাকার। ছাড় বলছি, না হলে মজা দেখাব।”
চাঁদপুরের খেঁকশেয়াল যার নাম, আসামের জঙ্গলের হেন পাখি নেই যে তাকে জানে না। সে শহরে গিয়ে কতবার মুরগি, হাঁস ধরে এনেছে তাকে ‘মড়াখেকো-কুকুর’ বলে এমন সাহস কার? শেয়াল একটু থেমে যেমন ঘাড় ফিরিয়ে দেখেছে, অমনি রিদয় গিয়ে তার ল্যাজ চেপে পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিলে। মানুষটি বুড়ো-আংলা, তার কিলটিই কত বড়ই বা? শেয়ালের পিঠে যেন একটা বেদানা-বিচি পড়ল! কিন্তু মানুষের মতো গলার সুর শুনে শেয়াল সত্যি ভয় পেলে; সে ল্যাজ তুলে বনের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে চলল; আর রিদয় তার ল্যাজ ধরে টিকটিকির মতো ঝুলতে-ঝুলতে চলল – উলু-ঘাসের মধ্যে দিয়ে গা-ঘেঁষড়ে। কাঁকড়ার মতো ল্যাজে কি কামড়ে রয়েছে, সেটা দেখবার শেয়ালের অবসর ছিল না। সে একবারে নিজের গর্তের কাছে এসে দাঁড়িয়ে, মুখ থেকে হাঁসটা নামিয়ে সেটার বুকে পা দিয়ে দাঁড়াল, তখন তার চোখ পড়ল ল্যাজে গাঁথা বুড়ো আংলার দিকে! এই টিকটিকির মতো ছেলেটা – ইনি চাঁদপুরী শেয়ালকে জব্দ করবেন, ভেবে শেয়াল ফ্যাক করে মুখ ভেংচে হেসে বলল - “এইবার তোমার মনিবকে খবর দাওগে চাঁদপুরের শেয়াল হাঁস খেয়েছে।”
ছুঁচোলো-মুখ, নাটা-চোখ দেখে এতক্ষণে রিদয় বুঝলে এটা শেয়াল। কিন্তু শেয়াল তাকে ভেংচেছে, এর শোধ সে দেবেই দেবে! রিদয় আরো শক্ত করে ল্যাজ চেপে, দুই পায়ে একটা গাছ আঁকড়ে, যেমন শেয়াল হাঁ করে হাঁসটার গলা কাটতে গেছে অমনি পিছনে এক টান দিয়ে, হাঁস থেকে শেয়ালকে দু’হাত তফাতে টেনে নিয়েছে! আর সেই ফাঁকে লুসাই হাঁসও ভাঙা ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে উড়ে পালিয়েছে।
“হাঁস যাক, আজ তোকে খাব!” – বলে খেঁকশেয়ালী দাঁত-খিঁচিয়ে রিদয়কে ধরবার জন্যে কেবলি নিজের ল্যাজটার সঙ্গে ঘুরতে লাগল। রিদয়ও ল্যাজ আঁকড়ে চরকি বাজির মতো শেয়ালের সঙ্গে ঘুরতে থাকল, আর বলতে লাগল – “ধর দেখি মড়াখেকো-কুকুর!”
বনের মধ্যে শেয়াল-মানুষে চরক-বাজি এমনতর কেউ কোনোদিন দেখেনি। প্যাঁচা, চামচিকে, এমনকি দিনের পাখিরাও তামাশা দেখতে বার হল। কিন্তু রিদয় দেখলে তামাশা ক্রমে শক্ত হয়ে উঠছে – সে নিজে শেয়ালের ল্যাজ ছাড়তে চাইলেও, শেয়াল তাকে সহজে ছাড়ে কি না সন্দেহ! খেঁকশিয়ালী পাকা শিকারী; তার গায়ের শক্তিও যেমন বুদ্ধিও তেমনি, সাহসও কম নয়। রিদয় বুঝলে ঘুরে-ঘুরে সে নিজে যেমনি হাঁপিয়ে পড়বে অমনি টুপ করে তাকে ধরবে শেয়াল! রিদয় একবার চারদিকে চেয়ে দেখল, হাতের কাছে কোনো বড় গাছ আছে কি না। কাছেই একটা সরু ঝাউ-গাছ বন ঠেলে আকাশে সোজা উঠেছে, ঘুরতে ঘুরতে রিদয় সেইদিকে এগিয়ে গেল, তারপর হঠাৎ একসময় শেয়ালের ল্যাজ ছেড়ে একেবারে ঝাউ-গাছটার আগ-ডালে উঠে পড়ল। শেয়াল তখনো নিজের ল্যাজ কামড়াতে বোঁ-বোঁ লাঠিমের মতো ঘুরছে। রিদয় গাছের উপর থেকে চেঁচিয়ে বললেঃ
তাকুড়-তাকুড় তাকা!
যাচ্ছে শেয়াল ঢাকা!
থাকে-থাকে-থাকে
হুক্কাহুয়া ডাকে!
চাঁদপুরের কাঁকড়া-বুড়ি
কামড়েছে তার নাকে!
শেয়াল দেখলে শিকার তাকে ঠকিয়ে পালাল! সে গাছের তলায় হাঁ করে বসে রিদয়ের দিকে চেয়ে বললে – “রইলুম এখানে বসে, কতক্ষণে নেমে আসিস দেখি। তোকে না খেয়ে নড়ছিনে!” এক-ঘণ্টা গেল, দু-ঘণ্টা গেল, শেয়াল আর নড়ে না। ঝাউ গাছের সরু ডালে পা ঝুলিয়ে শীতের রাতে জেগে বসে থাকা যে কি কষ্ট আজ রিদয় বুঝলে। শীতে তার হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে, চোখ ঢুলে পড়ছে, কিন্তু ঘুমোবার যো নেই – পড়ে যাবার ভয়ে। আর বনের মধ্যে অন্ধকারই বা কত! দু’হাত তফাতে নজর চলে না – মিশ কালো ঘুটঘুটে চারিদিক! মনে হল যেন গাছ-পালা সব শীতে কালো পাথরের মতো পাষাণ হয়ে গেছে! একটি পাখি ডাকছে না, একটি পাতা নড়ছে না – সব নিথর নিঝুম! রিদয়ের মনে হচ্ছে রাত যেন ফুরোতে চায় না! – রিদয় আর না ঘুমিয়ে থাকতে পারে না! এই সময় ভোরের কনকনে বাতাস বইল, আর দেখতে-দেখতে ভুসো-কালির মতো রাতের রঙ ক্রমে ফিকে হতে-হতে মিশি থেকে রাঙা, রাঙা থেকে রুপোলী, রুপোলী থেকে সোনালী হয়ে উঠল। তারপর বনের ওপারে সূর্য উঠলেন। বেলায় উঠত, কাজেই সূর্যকে চিরকাল রিদয় দেখে এসেছে কাঁচা সোনার মতো হলুদ বর্ণ; সূর্য যে ক্ষেপা মোষের চোখের মতো এমন লাল টকটকে, তা তার জ্ঞান ছিল না; তার ঠিক মনে হল কে যেন রাত্তিরের কাণ্ডকারখানা শুনে রেগে তার দিকে চাচ্ছেন!
তারপর গাছের ফাঁকে ফাঁকে সকালের আলো উঁকি মারতে লাগল – বনের গাছ-পালা, জীব জন্তু রাতের আড়ালে আবডালে অন্ধকারে বসে কি কাণ্ড করেছে, তারি খোঁজ নিতে লাগল। বনের তলাকার চোরকাঁটা শেয়াল-কাঁটা, বাটি-কুটি, কাঁটা-খোঁচা, যা-কিছু সব যেন আলোর ধ্মকে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। ক্রমে মেঘে-মেঘে আলো পড়ল – রঙ ধরল; গাছের পাতা, ঘাসের শিষ, ফোটা-ফুলের পাপড়ি তার উপরে শিশিরের ফোঁটা – সবই আলোতে ঝলক দিতে লাগল! যেন সবাই সিঁদুর পরে সাটিনের কাপড়ে সেজেছে! ক্রমে চারিদিক আলোতে আলময় হয়ে উঠল; অন্ধকারের ভয় দেখতে-দেখতে কোথায় পালাল; আর অমনি কত পাখি, কত জীব-জন্তুই না বনে ছুটোছুটি আরম্ভ করল! লাল টুপি মাথায় কাঠঠোকরা ঠকাস-ঠকাস গাছের ডালে ঘা দিতে বসে গেল, কাঠবেরালি অমন খোপ ছেড়ে গাছের তলায় বসে কুটুস-কুটুস বাদাম ছাড়াতে লেগে গেল; গাং-শালিক, গো-শালিক, ছাতারে, গাছের তলায় নেমে শুকনো পাতা উল্টে-উল্টে কিড়িং-ফড়িং ধরে ধরে বেড়াতে লাগল; আগ ডালে বসে শ্যামা-দোয়েল শিস দিতে আরম্ভ করলে। রিদয়ের মনে হল সূর্য যেন সব পশু-পাখি কীট-পতঙ্গদের জাগিয়ে দিয়ে অভয় দিতে থাকলেন – রাত পালিয়েছে, তোরা ঘর ছেড়ে বার হ, আমি এসেছি, ভয় নেই!
রিদয় শুনলে মেঘনার চরে হাঁসেরা ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি লাগিয়েছে, দল একত্র হচ্ছে। চকা-নিকোবর হাঁকলে – “মানস-সরোবর! ধৌলাগিরি আও আও আও!” তারপর রিদয় দেখলে তার মাথার উপর দিয়ে নিকোবরের পুরো দল উড়ে চলল – খোঁড়া-হাঁসটি সুদ্ধ! রিদয় তাদের একবার ডাক দিলে, কিন্তু এত উপর দিয়ে হাঁসেরা চলেছে যে তার ডাক শুনলে কিনা বোঝা গেল না – উড়তে উড়তে আকাশে মিলিয়ে গেল। রিদয় স্থির করলে হাঁসেরা নিশ্চয়ই দেখেছে শেয়ালে তাকে খেয়েছে। সে হতাশ হয়ে আকাশে চেয়ে রইল। কিন্তু এত দুঃখেও সকালের আলো আর বাতাস, সে যেখানটিতে বসে আছে সেই ডালটি সোনার রঙে রাঙিয়ে ঝাউ পাতার মধ্যে দিয়ে চুপিচুপি তাকে এসে বলতে থাকল – “ভয় কি? দিন হয়েছে – সূর্য উঠেছেন; আমরা থাকতে কিসের ভয়!” ঠিক সে সময় কমলালেবুর রঙের সাজ পরে হলুদবর্ণ যে সূর্য আমতলির মাঠে রোজ-রোজ রিদয়কে দেখা দিতেন, তিনি চাঁদপুরের জঙ্গলের উপরে দেখা দিলেন।
বেলা প্রায় এক প্রহর। রিদয় গাছের উপরে, শেয়াল নিচে বসে আছে, হাঁসের দলেরও কোনো খবর নেই, যে-যার খাবার সন্ধানে বেরিয়ে গেছে। ঠিক যখন বেলা ন’টা, তখন দেখা গেল, বনের মধ্য দিয়ে একটিমাত্র হাঁস যেন উড়তেই পারছে না, এই ভাবে আস্তে-আস্তে চলেছে। খেঁকশেয়ালী অমনি কান খাড়া করে হাঁসের দিকে নাক উঠিয়ে পায়ে-পায়ে এগিয়ে চলল। হাঁসটা শেয়ালকে দেখেও দেখলে না, তার নাকের সামনে দিয়েই উড়ে চলল। হাঁসটাকে ধরবার জন্য শেয়াল একবার ঝম্প দিলে, হাঁস অমনি ফিক করে হেসে, উড়ে গিয়ে চড়ায় বসল। এর পরেই আর-এক হাঁস ঠিক তেমনি করে আরো-একটু মাটির কাছ দিয়ে উড়ে চলল; শেয়ালটা লাফ দিলে; তার কানের রোয়া গুলো হাঁসের পায়ে ঠেকল, কিন্তু ধরতে পারলে না – হাওয়ার মতো হাঁস উড়তে উড়তে চড়ার দিকে চলে গেল। একটু পরে আর এক হাঁস – এটা যেন উড়তেই পারছে না – একেবারে মাটির কাছ দিয়ে ঝাউ-গাছের গা-ঘেঁষে উড়ে চলল। এবারে প্রাণপণে শেয়াল ঝম্প দিলে। ধরেছে, এমন সময় হাঁস সোঁ-করে তার দাঁতে পালক বুলিয়ে দিয়ে একেবারে মুখের মধ্যে থেকে পালিয়ে গেল। এবার যে এল, সে এমনি বেকায়দায় লটপট করে উড়ে আসছে যে খেকশেয়াল ভাবলে – একে তো আগে ধরেছি! কিন্তু বারবার তিনবার ঠকে শেয়াল বিরক্ত হয়ে উঠেছে, সে হাঁসের দিক থেকে মুখটা ফিরিয়ে গোঁ হয়ে রইল। যে-পথে আগের তিনটে হাঁস গেছে, এটাও সেই পথ ধরে ঝাউ-তলায় এসে শেয়ালের এত কাছ দিয়ে চলল যে শেয়াল আর স্থির থাকতে না পেরে দিয়েছে লাফ এমন জোরে যে তার ল্যাজটা ঠেকল হাঁসের পিঠে। কিন্তু হাঁসও পাকা; সে সাঁ-করে শেয়ালের পেটের নীচে দিয়ে গলে তার ঝাঁটার মতো ল্যাজে ডানার এক থাপ্পড় বসিয়ে হাসতে-হাসতে চম্পট দিলে। শেয়ালের আর দম নেবার সময় হল না, ঝপ-ঝপ করে আরো গোটা-পাঁচেক হাঁস নাকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল, একটাকেও সে ধরতে পারলে না – লাফানি-ঝাঁপানি সার হল! এবারে পর-পর আবার পাঁচটা হাঁস একে-একে শেয়ালকে লোভ দেখিয়ে সজোরে তার পিঠে ডানার বাতাস দিয়ে হোঃ-হোঃ করে হাসতে-হাসতে একেবারে তার রগ ঘেঁষে চলে গেল; কিন্তু শেয়াল না-রাম না-গঙ্গা – চুপ করে বসে রইল। সে বুঝেছে চকা-নিকোবরের দল কাল রাতে হাঁস নিয়ে যাওয়ার শোধ তুলতে মস্করা লাগিয়েছে।
অনেকক্ষণ আর হাঁসেদের দেখা নেই, শেয়াল ভাবছে তারা গেছে, এমন সময় চকা-নিকোবর দেখা দিলেন। তার সেই পাকা পালক, ছিনে গলা দেখেই শেয়াল তাকে চিনে নিলে। একটা ডানা বেঁকিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এক-কাৎ হয়ে সে উড়ে এল – একেবারে যেন চলতেই পারে না, এই ভাবে। শেয়াল এবারে লাফ দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত হাঁসটাকে তাড়িয়ে গেল; কিন্তু হাঁস যেন ধরা দিয়েও দিলে না; সোজা গিয়ে চরে বসে প্যাঁক-প্যাঁক করে হেসে উঠল। শেয়াল একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে জঙ্গলের দিকে ফিরে দেখলে – এবারে চমৎকার ধবধবে মোটা-সোটা রাজহাঁস তার দিকে উড়ে আসছে। বনের অন্ধকারে তার শাদা ডানা-দু’খানা যেন রুপোর মতো ঝক-ঝক করছে। এবারে শেয়ালের নোলা সকসক করে উঠল। সে এমন লাফ দিলে যে ঝাউ-গাছের পাতাগুলো তার গায়ে খোঁচা মারলে, কিন্তু রাজহাঁস ধরা পড়ল না – সোজা ঝাউ-গাছ ঘুরে চড়ায় গিয়ে উঠল।
এর পর আর হাঁসের সাড়া-শব্দ নেই; সব চুপচাপ। শেয়াল ঝাউ-গাছের দিকে চেয়ে দেখলে, ছেলেটাও সেখান থেকে সরে পড়েছে! শেয়াল ফ্যাল-ফ্যাল করে চারিদিকে চাইছে এমন সময় চড়ার দিক থেকে একে-একে হাঁস সব আগেকার মতো তাকে লোভ দেখিয়ে উড়ে চলল। কিন্তু শেয়ালের তখন মাথার ঠিক নেই; সে পাগলের মত কেবল ঝাঁপাঝাঁপি লাফালাফি করতে থাকল আর কেবলি হাঁস তার নাকের সামনে দিয়ে যেতে থাকল – এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, দশ, পনেরো, কুড়ি, বাইশ! শেয়াল তাদের একটি পালক পর্যন্ত ছিঁড়ে নিতে পারলে না। শেয়াল এমন নাকাল কখনো হয়নি। চাঁদপুরের শেয়াল সে, কতবার গুলির মুখ থেকে মুরগি হাঁস শিকার করেছে তার ঠিক নেই; শেয়ালের রাজা বললেই হয়; কিন্তু এই শীতকালে হাঁস শিকার করতে আজ তার ঘাম ছুটে গেল! সারাদিন ধরে মোটা-সোটা চিক-চিকে হাঁস দলে-দলে তার নাকের উপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে, অথচ একটাকেও সে ধরে খিদে মেটাতে পারছে না! সব চেয়ে তার লজ্জা – মানুষটাও তাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে! আর তার দুর্দশার কথা সেই পোষা রাজহাঁসটাও জেনে গেল! দেশে-দেশে নিশ্চয়ই তারা চাঁদপুরের খেঁকশেয়ালের কীর্তি কাহিনী রাষ্ট্র করে দেবেই-দেবে।
ভোরে এই শেয়ালের গা চিকচিকে, ল্যাজ মোটা, রোঁয়াগুলো কেমন যেন সাটিনের মতো খয়েরি-কালো-শাদা ঝক-ঝক করছিল; কিন্তু বিকেলে তার পেটের চামড়া ঝুলে পড়েছে, গা ধুলো-ঘামে কাদা হয়ে গেছে, চোখ ঝিমিয়ে পড়েছে, জিভ চার-আঙুল বেরিয়ে পড়ে মুখে গোটানাল ভাঙছে। তাকে দেখে কে বলবে সকালের সেই দুরন্ত শেয়াল! সারাদিন ধরে কেবলি দেখছে যেন চোখের সামনে হাঁস ঘুরছে। সে গাছের তলায় সূর্যের আলো দেখে ভাবছে হাঁস; প্রজাপতি উড়লে হাঁস বলে লাফিয়ে ধরতে যাচ্ছে! যতক্ষণ দিনের আলো রইল চকা-নিকোবরের দল কিছু দয়া-মায়া না করে শেয়ালকে হয়রান করেই চলল। শেয়ালের তখন আর নড়বার শক্তি নেই, সে কেবল মাটির উপরে হাঁসের ছায়াগুলো থাবা দিয়ে-দিয়ে আঁচড়াতে থাকল। হাঁসেরা যখন দেখলে শেয়ালটা মড়ার মতো শুকনো পাতার উপরে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লেগেছে, তখন তারা – “কেমন! কেমন! হাঁস ধরবে!” বলতে-বলতে চাঁদপুরের জঙ্গল ছেড়ে নালমুড়ির চরের দিকে চলে গেল।