বারবাড়িতে
সেকালের নয়ম অনুসারে একটা বয়েস পর্যন্ত ছেলেরা থাকতেম অন্দরে ধরা, তারপর একদিন চাকর এসে দাসীর হাত থেকে আমাদের চার্জ বুঝে নিতো । কাপড় জুতো জামা বাসন-কোসনের মতো করে আমাদের তোষাখানায় নামিয়ে নিয়ে ধরতো ; সেখান থেকে ক্রমে দপ্তরখানা হয়ে হাতেখড়ির দিনে ঠাকুরঘর, শেষে বইঠকখানার দিকে আস্তে আস্তে প্রমোশন পাওয়া নিয়ম ছিল । রামলাল যতোদিন আমার চার্জ বুঝে নেয়নি ততদিন আমি ছিলেম তিন তলায় উত্তরের ঘরে ! সেইকালে একবার একটা সূর্যগ্রহণ লাগলো— থালায় জল দেখে সুর্য দেখে পূন্য কাজ করে ফেলেছিলেম সেদিন । মনে পড়ে সেই প্রথম একলা ছাতে বার হয়ে আকাশ দেখলেম— নীল পরিষ্কার আকাশ । তারই গায়ে সারি সারি নারকেল গাছ, পুবদিক জুড়ে মস্ত একটা বটগাছ, তারই একটা পুকুর— আমাদের দক্ষিনের বাগানের এই টুকুই চোখে পড়ল সেই দিন।
এই দক্ষিনের বাগান ছিলো বারবাড়ির সামিল— বাবুদের চলাফেরার স্থান । এখন যেমন ছেলেপিলে দাসী চাকর রাস্তার লোক এবং অন্দরের মেয়েরা পর্যন্ত এই বাগান মাড়িয়ে চলাফেরা করে, সেকালে সেটি হবার জো ছিলো না ! বাবামশায়ের শখের বাগান ছিলো এটা— এখানে পোষা সারস পোষা ময়ূর— তারা কেউ হাঁটুজলে পুকুরে নেমে মাছ শিকার করতো, কেউ পেখম ছড়িয়ে ঘাসের উপর চলাফেরা করতো তিন চারটে উড়ে মালীতে মিলে এখানে সব শখের গাছ আর খাঁচার পাখিদের তদবির করে বেড়াতো, একটি পাতা কি ফুল ছেঁড়ার হুকুম ছিলোনা কারু ! এই বাগানে একটা মস্ত গাছ-ঘর—সেখানে দেশ-বিদেশের দামী গাছ ধরা থাকতো ! পদ্মফুলের মতো করে গড়া একটা ফোয়ারা-তার জলে লাল মাছ, সব আফ্রিকা দেশ থেকে আনানো, নীল পদ্মপাতার তলায় খেলে বেড়াতো ! বাড়িখানা একতলা দোতলা তিনতলা পর্যন্ত, পাখিতে গাছেতে ফুলদানিতে ভর্তি ছিলো তখন । মনে পড়ে দোতলায় দক্ষিণের বারান্দার পূবদিকে একটা মস্ত গামলায় লাল মাছ ঠাসা থাকে, তারই পাশে দুটো সাদা খরগোশ, জাল-ঘেরা মস্ত খাঁচার মধ্যে সব ছোটো ছোটো পোষা পাখির ঝাঁক, দেওয়ালে একটা হরিণের শিঙের উপর বসে লালঝুঁটি মস্ত কাকাতুয়া, শিকলি-বাঁধা চীন দেশের একটা কুকুর, নাম তার কামিনী— পাউডার এসেন্সের গন্ধে কুকুরটার গা সর্বদা ভুরভুর করে । তখন বেশ একটু বড়ো হয়েছি, কিন্তু বৈঠকখানার বারান্দায় ফস্ করে যাবার সাধ্য নেই, সাহসও নেই ! এখন যেমন ছেলেমেয়েরা ‘বাবা’ বলে বৈঠকখানায় এসে হাজির হয় তখন সেটা হবার জো ছিল না । বাবামশায় যখন আহারের পর ও-বাড়িতে কাছারি করতে গেছেন সেই ফাঁকে একএক দিন বৈঠকখানায় গিয়ে পড়তেম । ‘টুনি’ বলে একটা ফিরিঙ্গী ছেলেও এই সময়টাতে পাখি চুরি করতে এদিকটাতে আসতো । পাখিগুলোকে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিয়ে, জালে করে ধরে নেওয়া খেলা ছিল তার ! টুনিসাহেব একবার একটা দামী পাখি উড়িয়ে দিয়ে পালায় । দোষটা আমার ঘাড়ে পড়ে । কিন্তু সেবারে আমি টুনির বিদ্যে ফাঁস করে দিয়ে রক্ষে পেয়ে যাই । আর একদিন— সে তখন গরমির সময়— দক্ষিন বারান্দাটা ভিজে খসখসের পরদায় অন্ধকার আর ঠাণ্ডা হয়ে আছে ; গামলা ভর্তি জলে পদ্মপাতার নীচে লাল মাছগুলোর খেলা দেখতে দেখতে মাথায় একটা দুর্বুদ্ধি জোগালো । যেমন লালমাছ, তেমনি লাল জলেই খেলে বেড়ালে শোভা পায় ! কোথা থেকে খানিক লাল রঙ এনে জলে ণ্ডলে দিতে দেরি হলো না, জলটা লালে লাল হয়ে উঠলো কিন্তু মিনিট কতকের মধ্যেই গোটা দুই মাছ মরে ভেসে উঠলো দেখেই বারান্দা ছেড়ে চোঁ চোঁ দৌড়— একদম ছোটোপিশির ঘরে ! মাছ মারার দায় থেকে কেমন করে, কি ভাবে যে রেহাই পেয়েছিলাম তা মনে নেই, কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত আর দোতলায় নামতে সাহস হয়নি ।
মনে আছে আর একবার মিস্ত্রী হবার শখ করে বিপদে পড়েছিলেম । বাবামশায়ের মনের মতো করে চীনে মিস্ত্রীরা চমৎকার একটা পাখির ঘর গড়ছে— জাল দিয়ে ঘেরা একটা যেন মন্দির তৈরি হচ্ছে, দেখছি বসে বসে । রোজই দেখি, আর মিস্ত্রীর মতো হাতুড়ি পেরেক অস্ত্রশস্ত্র চালাবার জন্য হাত নিস্পিস্ করে । একদিন, তখন কারিগর সবাই টিফিন করতে গেছে, সেই ফাঁকে একটা বাটালি আর হাতুড়ি নিয়ে মেরেছি দু’তিন কোপ ! ফস্ করে বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের ডগায় বাটালির এক ঘা ! খাঁচার গায়ে দু’চার ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়লো । রক্তটা মুছে নেবার সময় নেই— তাড়াতাড়ি বাগান থেকে খানিক ধুলো-বালি দিয়ে যতই রক্ত থামাতে চলি ততই বেশি করে রক্ত ছোটে ! তখন দোষ স্বীকার করে ধরা পড়া ছাড়া উপায় রইল না । সেবারে কিন্তু আমার বদলে মিস্ত্রী ধমক খেলে— যন্ত্রপাতি সাবধানে রাখার হুকুম হলো তার উপর ! কারিগর হতে গিয়ে প্রথমে যে ঘা খেয়েছিলেম তারে দাগটা এখনো আমার আঙ্গুলের ডগা থেকে মেলায় নি । ছেলেবেলায় আঙ্গুলের যে মামলায় পার পেয়ে গিয়েছিলেম, তারই শাস্তি বোধ হয় এই বয়সে লম্বা আঙ্গুল এঁকে হচ্ছে সাধারনের দরবারে ।
আর একটা শাস্তির দাগ এখনো আছে লেগে আমার ঠোঁটে । গুড়গুড়িতে তামাক খাবার ইচ্ছে হলো— হঠাৎ কোথা থেকে একটা গাড় জোগাড় করে তারই ভিতর খানিক জল ভরে টানতে লেগে গেলেম । ভুড় ভুড় শব্দটা ঠিক হচ্ছে, এমন সময় কি জানি পায়ের শব্দে চমকে যেমন পালাতে যাওয়া, অমনি শখের হুঁকোটার উপর উলটে পড়া ! সেবারে নীলমাধব ডাক্তার এসে তবে নিস্তার পাই— অনেক বরফ আর ধমকের পরে । দেখেছি যখন দুষ্টুমির শাস্তি নিজের শরীরে কিছু-না কিছু আপনা হতেই পড়েছে, তখন গুরুজনদের কাছ থেকে উপরি আরো দু’চার ঘা বড়ো একটা আসতো না । যখন দুষ্টুমি করেও অক্ষত শরীরে আছি তখনই বেচত খেতে হতো, নয় তো ধমক, নয় তো অন্দরে কারাবাস । এই শেষের শাস্তিটাই আমার কাছে ছিল ভয়ের— কুইনাইন খাওয়ার চেয়ে বিষম লাগতো !
অন্দরে বন্দী অবস্হায় যে ক’দিন আমার খাকতে হতো, সে’কদিন ছোটোপিশির ঘরই ছিলো আমার নিশ্বাস ফেলবার একটিমাত্র জায়গা। ‘বিষবৃক্ষ’, বইখানিতে সূর্যমুখীর ঘরের বর্ণনা পড়ি আর মনে আসে ছোটোপিশির ঘর । তেমনি সব ছবি, দেশী পেন্টারের হাতের । ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ যে লোহার সিন্দুকটা, সেটাও ছিলো । কৃষ্ণনগরের কারিগরের গড়া গোষ্ঠলীলার চমৎকার একটি কাচ-ঢাকা দৃশ্য, তাও ছিলো । উলে বোনা পাখির ছবি, বাড়ির ছবি । মস্ত একখানা খাট— মশারিটা তার ঝালরের মতো করে বাঁধা । শকুন্তলার ছবি, মদনভস্মের ছবি, উমার তপস্যার ছবি, কৃষ্ণলীলার ছবি দিয়ে ঘরের দেয়াল ভর্তি । এক একটা ছবির দিকে চেয়ে-চেয়েই দিন কেটে যেতো । এই ঘরে জয়পুরী কারিগরের আঁকা ছবি থেকে আরম্ভ করে, অয়েল পেনটিং ও কালীঘাটের পট পর্যন্ত সবই ছিলো ; তার উপরেও, এক আলমারি খেলনা । কালো কাচের প্রমাণ সই একটা বেড়াল, শাদা কাচের একটা কুকুর, ঠুনকো একটা ময়ুর, রঙিন ফুলদানি কত রকমের ! সে যেন একটা ঠুনকো রাজত্বে গিয়ে পড়তেম ! এ ছাড়া একটা আলমারি, তাতে সেকালের বাংলা-সাহিত্যের যা-কিছু ভালো বই সবই রয়েছে । এই ঘরের মাঝে ছোটোপিশি বসে বসে সারাদিন পুঁতি-গাঁথা আর সেলাই নিয়েই থাকেন । বাবামশায় ছোটোপিশিকে সাহেব-বাড়ি থেকে সেলাইয়ের বই, রেশম, কত কি, এনে দিতেন আর তিনি বই দেখে নতুন নতুন সেলাইয়ের নমুনা দিয়ে কতো কি কাজ করতেন তার ঠিক নেই । ছোটোপিশি এক জোড়া ছোট্ট বালা পুঁতি গেঁথে গেঁথে গড়েছিলেন- সোনালি পুঁতির উপরে ফিরোজার ফুল বসানো ছোট্ট বালা দু’গাছি, সোনার বালার চেয়েও ঢের সুন্দর দেখতে ।
বিকেলে ছোটোপিশি পায়রা খাওয়াতে বসতেন । ঘরের পাশেই খোলা ছাত ; সেখানে কাঠের খোপে, বাঁশের খোপে, পোষা থাকতো লক্কা, সিরাজী, মুক্ষি কতো কী নামের আর চেহারার পায়রা । খাওয়ার সময় ডানায় আর পালকে ছোটোপিশিকে ঘিরে ফেলত পায়রাগুলো । সে যেন সত্যিসত্যিই একটা পাখির রাজত্ব দেখতেম— উঁচু পাঁচিল-ঘেরা, ছাতে ধরা । বাবামশায়েরও পাখির শখ ছিলো ,কিন্তু তাঁর শখ দামী দামী খাঁচার পাখির, ময়ূর সারস হাঁস এইসবেরই । পায়রার শখ ছিলো ছোটোপিশির । হাটে হাটে লোক যেত পায়রা কিনতে। বাবামশায় তাঁকে দুটো বিলিতী পায়রা এক সময়ে এনে দেন, ছোটোপিশি সে দুটোকে ঘুঘু বলে স্হির করেন, কিছুতেই পুষভে রাজী হন না । অনেক বই খুলেও বাবামশায় যখন প্রমাণ করতে পারলেন না যে পাখি দুটো ঘুঘু নয়, তখন অগত্যা সে দুটো রটলেজ সাহেবের ওখানে ফেরত গেলো ! এরই কিছুদিন পরে একটা লোক ছোটোপিশিকে একজোড়া পায়রা বেচে গেলো— পাখিদুটোকে দেখতে ঠিক শাদা লাক্কা, কিন্তু লেজের পালক তাদের ময়ূর পুচ্ছের মতো রঙিন । এবার ছোটোপিশি ঠকলেন— বাবামশায় এসেই ধরে দিলেন পায়রার পালকে ময়ূরপুচ্ছ সুতো দিয়ে সেলাই করা । একটা তুমুল হাসির হর্রা উঠেছিলো সেদিন তিনতলার ছাতে, তাতে আমরাও যোগ দিয়েছিলেম ।
ঠাকুরপুজো, কথকতা, সেলাই আর পায়রা— এই নিয়েই থাকতেন ছোটোপিশি । একবার তাঁর তিনতলার এই ছাতটাতে, বাড়িসুদ্ধ সবার ফোটো নিতে এক মেম এসে উপস্হিত হলো । আমাদেরও ফোটো নেবার কথা, সকাল থেকে সাজগোজের ধুমধাম পড়ে গেলো । সেইদিন প্রথম জানলেম আমার একটা হালকা নীল মখমলের কোট প্যান্ট আছে । ভারি আনন্দ হলো, কিন্তু গায়ে চড়াবামাত্রই কোট-প্যান্ট বুঝিয়ে দিলো যে আমার মাপে তাদের কাটা হয়নি । এই অদ্ভুত সাজ পরে আমার চেহারাটা কারু কারু অ্যালবামে এখনো আছে— রোদের ঝাঁজ লেগে চোখ দুটো পিটপিট করছে, কাপড়টা ছেড়ে ফেলতে পারলে বাঁচি এই ভাব ।
ফোটো তোলা আর বাড়ির প্ল্যান আঁকার কাজ জানতেন বাবামশায় । ড্রইং করার নানা সাজ-সরজাম, কম্পাস-পেনসিল কত রকমের দেখতেম তাঁর ঘরে । বাবামশায় কাছারির কাজে গেলে তাঁর ঘরে ঢুকে সেগুলো নেড়ে-চেড়ে নিতেম । ঠিক সেই সময়, ফারসি পড়ানোর মুন্সি এসে জুটতেন । কথায় কথায় তিনি আলে বে, পে, তে, জিম— এমনি ফারসি অক্ষর আমাদের শোনাতে বসতেন । মুন্সির দু’একটা বয়েৎ এখনো মনে আছে— ‘গুলেস্তাঁমে যাকে হরিয়েক গুলকো দেখা, না তেরি সেরঙ্গ, না তেরি সে বূ হ্যায়’ । আর একটা বয়েৎ ছিল সেটা ভুলে গেছি, কেবল ধ্বনিটা মনে আছে । —কবুতর্ বা কবুতর্ বাক্ বাবাজ ! সেকালে ফারসি পড়িয়ে হলে কানে শরের কলম আর লুঙ্গি না হলে চলতো না, মাথাও ঢাকা চাই ! ঠিক মনে পড়ে না কেমন সাজটা ছিলো মুন্সির ।
ডাক্তারবাবুর আসবার সময় ছিলো সকাল ন’টা । অসুখ থাক বা না থাক, কতকটা সময় বাইরে বসে গুজব করে অন্যত্র রোগী দেখতেন গিয়ে রোজই । সেখানেও হয়তো এমনি একটা বাঁধা টাইম ছিলো ডাক্তারের জন্যে পান জল তামাক ইত্যাদি নিয়ে ! আর এক ডাক্তার সাহেব ছিলো বরাদ্দ— তার নাম কেলি— সে রোজ আসতো না, কিন্তু যখন আসতো তখনই জানতেম বাড়িতে একটা শক্ত রোগ ঢুকেছে । তখন দেখতুম আমাদের নীলমাধব বাবুর মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠেছে, আর ইংরিজি কথাটার মাঝেমাঝে থেকে থেকে ‘ওর নাম কি’ কথটা অজস্র ব্যবহার করছেন তিনি ; যথা— ‘আই থিংক— ওর নাম কি— ডিজিটিলিস্ অ্যান্ড কোয়নাইন ওর নাম কি— ইফ ইউ প্রেফার আই সে ডক্টার কেলি, ইত্যাদি ।‘
সাহেব ছাড়া হয়ে নীলমাধব বাবু— তাঁকে ডাক্তারই মনে হতো না, মনে হতো, একেবারে ঘরের মানুষ আর মজার মানুষটি বাঘমুখো ছড়ি হাতে, গলায় চাদর বুকে মোটা সোনার চেন, ডাক্তারবাবু ভালোমানুষের মতো এসে একখানা বেতের চৌকিতে বসতেন । চৌকিখানা আসত তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই আর সরেও যেত তাঁর সঙ্গেই । আমার প্রায়ই অসুখ ছিল না, কাজেই ডাক্তারের লাঠিটার বাঘমুখ কেমন করে কাত হয়ে চাইছে সেইটেই দেখতে পেতেম । ছোটো ছোটো লাল মানিকের চোখ দুটো বাঘের— ইচ্ছে হতো খুঁটে নিই, কিন্তু ভয় হতো— মা আছেন কাছেই দাঁড়িয়ে ডাক্তারের । এখনকার কালে কত ওষুধেরই নাম লেখে একটু অসুখেই, তখন সাতদিন জ্বর চলল তো দালচিনির আরক দেওয়া মিকশ্চার আসতো— বেশ লাগতো খেতে, আর খেলেই জ্বর পালাতো । তিনদিন পর্যন্ত ওষুধ লেখাই হতো না কোনো– হয় সাবুদানা, নয় এলাচদানা, বড়োজোর কিটিং –এর বন্বন্ । তিনদিনের পরেও যদি উঠে না দাঁড়াতেম তবে আসতো ডাক্তারখানা থেকে রেড মিক্শ্চার । গলদা চিংড়ির ঘি বলে সেটাকে সমস্তটা খাইয়ে দিতে কষ্ট পেতে হতো মা কে ।
এখন নানা রকম সৌখিন ওষুধ বেড়িয়েছে, তখন মাত্র একটিই ছিলো সৌখিন ওষুধ, যেটা খাওয়া চলতো অসুখ না থাকলেও । এই জিনিসটি দেখতে ছিলো ঠিক যেন মানিকে গড়া একটি একটি রুহিতনের টেক্কা । নামটাও তার মজার— জুজুবস্ । এখন বাজারে সে জুজুবস্ পাওয়া যায়না, তার বদলে ডাক্তার খানায় রাখে যষ্টি মধুর জুজুবস্— খেতে অত্যন্ত বিস্বাদ । অসুখ হলে তখন ডাক্তারের বিশেষ ফরমাসে আসতো একটিন বিস্কুট আর দমদম মিছরি । এখনকার বিস্কুটগুলো দেখতে, হয় টাটকা, নয় টিকিট । তখন ছিলো তারা সব কোনোটা ফুলের মতো, কেউ নক্ষত্রের মতো, কতক পাখির মতো । দমদম মিছরি গুলো যেন সোনার থেকে নিঙরে নেওয়া, রসে ঢালাই করা মোটা স্ক্রু একটা –একটা ।
ডাক্তারের পরই— টনটনে চটি পায়ে, সভ্যভব্য চন্দ্র কবিরাজ— তিনি তোষাখানা থেকে দপ্তরখানা হয়ে, লাল রঙের বগলী থেকে চটি বিলি করে করে উঠে আসতেন তেতলায় আমাদের কাছে । নাড়ি টিপে বেড়ানোই ছিলো তার একমাত্র কাজ, কিন্তু নিত্য-কাজ । বুড়ো কবিরাজ আমার মাকে মা বলে যে কেন ডাকে তার কারণ খুঁজে পেতাম না । আর একটি-দুটি লোক আসতো উপরের ঘরে, তাদের একজন গোবিন্দ পান্ডা, আর একজন রাজকিষ্ট মিস্ত্রী । পান্ডা আসতো কামানো মাথায় নামাবলি জড়িয়ে, কর্পূরের মালা, জগন্নাথের প্রসাদ নিয়ে । দাসীদের সঙ্গে আমরাও ঘিরে বসতেম তাকে । প্রথমটা সে মেঝেতে খড়ি পেতে গুনে দিত দাসীদের মধ্যে কার কপালে ক্ষেত্তরে যাওয়া আছে, না আছে । তার পর প্রসাদ বিতরন করে সে শ্রীক্ষেত্রের গল্প করতে থাকতো পট দেখিয়ে । সেই পট, নামাবলি, কর্পূরের মালা সব ক’টার রঙ মিলে শ্রীক্ষেত্রের সমুদ্র বালি পাথর ইত্যাদির একটা রঙ ধরেছিলো মনটা ।
অল্প কয় বছর হলো যখন পুরী দেখলেম প্রথম, তখন সেই সব রঙগুলোকেই আবার দেখতে পেলেম, যেন অনেক কাল আগে দেখা রঙ । নৌকো, পালকি, মন্দির, বালি, কাপড়— সমস্ত জিনিস শাদা, হলুদ, কালো ও নীল— চারটি বহুকালের চেনা রঙের ছোপ ধরিয়ে রেখেছে !
আর একজন সাহেব আসতো, তার নাম রুবারীও । জাতে পর্তুগীজ ফিরিঙ্গী-মিশকালো। বড়োদিনের দিন সে একটা কেক নিয়ে হাজির হতো । তাকে দেখলেই শুধোতেম— ‘সাহেব আজ তোমাদের কী?’ সাহেব অমনি নাচতে নাচতে উত্তর দিতো ‘আজ আমাদের কিস্মিস্ ।’ সাহেবের নাচন দেখে আমরা তাকে ঘিরে খুব একচোট নেচে নিতেম ।
নতুন কিছু পাখি কিম্বা নিলেমে গাছ কেনার দরকার হলে, বৈকুণ্ঠবাবুর ডাক পড়তো । দেখতে বেঁটে-খাটো মানুষটি মাথায় টাক, রাজ্যের পাখি, গাছ আর নিলেমের জিনিসের সংগ্রহ করতে ওস্তাদ ছিলেন ইনি । তখন স্যার রিচার্ড টেম্পল ছোটোলাট— ভারি তাঁর গাছের বাতিক । বৈকুণ্ঠবাবুর নিলেমের ছোটোলাটের ডাকের উপর ডাক চড়িয়ে, অনেক টাকার একটা গাছ আমাদের গাছ-ঘরে এনে হাজির করলেন । ছোটোলাট খবর পেলেন— গাছ চলে গেছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-বাড়িতে । সঙ্গে সঙ্গে লাটের চাপরাশি পত্র নিয়ে হাজির—ছোটোলাট বাগান দেখতে ইচ্ছে করেছেন। উপায় কি, সাজ-সাজ রব পড়ে গেলো । আমার মখমলের কোট-প্যান্ট আবার সিন্দুক থেকে বার হলো । সেজেগুজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলেম— ঘোড়ায় চড়ে ছোটোলাট এলেন । খানিক বাগানে ঘুরে একপাত্র চা খেয়ে বিদায় হলেন । বৈকুণ্ঠবাবুর ডেকে-আনা গাছটাও চলে গেলো জোড়াসাঁকো থেকে বেলভেডিয়ার পার্কে । বৈকুণ্ঠবাবুর বাসা ছিলো পাথুরেঘাটায়, সেখান থেকে নিত্য হাজিরি দেওয়া চাই এখানে । একবার ঘোর বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ডুবে এক কোমর জল দাঁড়িয়ে যায় । বৈকুণ্ঠবাবু গলির মোড়ে আটকা— অন্যের যেখানে হাঁটু-জল বৈকুণ্ঠবাবুর সেখানে ডুব-জল— এতো ছোটো ছিলেন তিনি ।
কাজেই একখানা ছোট্ট নৌকা পুকুর থেকে টেনে তুলে তবে তাকে চাকরেরা উদ্ধার করে আনে । ছোটো মানুষটি, কিন্তু ফন্দি ঘুরতো অনেকরকম তার মাথায় । কতো রকমই যে ব্যবসার মতলব করতেন তিনি তার ঠিক নেই । একবার বড়ো জ্যাঠামশায় একবাক্স নিব কিনে আনতে বৈকুণ্ঠবাবুকে হুকুম করেন । তিনি নিলেম থেকে একটা গরুর গাড়ি বোঝাই নিব কিনে হাজির ! আর একবার একগাড়ি বিলিতি এসেন্স এনে হাজির । বাবামশায়ের জন্য । দেখে সবাই অবাক, হাসির ধুম পড়ে গেল । এই ছোট্ট মানুষটিকে প্রকান্ড স্বপ্ন ছাড়া ছোট্টখাটো স্বপ্ন দেখতে কখনো দেখলেম না শেষ পর্যন্ত । বিচিত্র চরিত্রের সব মানুষের দেখা পেলেম তিনতলা থেকে ছাড়া পেয়েই।
সেকালের নয়ম অনুসারে একটা বয়েস পর্যন্ত ছেলেরা থাকতেম অন্দরে ধরা, তারপর একদিন চাকর এসে দাসীর হাত থেকে আমাদের চার্জ বুঝে নিতো । কাপড় জুতো জামা বাসন-কোসনের মতো করে আমাদের তোষাখানায় নামিয়ে নিয়ে ধরতো ; সেখান থেকে ক্রমে দপ্তরখানা হয়ে হাতেখড়ির দিনে ঠাকুরঘর, শেষে বইঠকখানার দিকে আস্তে আস্তে প্রমোশন পাওয়া নিয়ম ছিল । রামলাল যতোদিন আমার চার্জ বুঝে নেয়নি ততদিন আমি ছিলেম তিন তলায় উত্তরের ঘরে ! সেইকালে একবার একটা সূর্যগ্রহণ লাগলো— থালায় জল দেখে সুর্য দেখে পূন্য কাজ করে ফেলেছিলেম সেদিন । মনে পড়ে সেই প্রথম একলা ছাতে বার হয়ে আকাশ দেখলেম— নীল পরিষ্কার আকাশ । তারই গায়ে সারি সারি নারকেল গাছ, পুবদিক জুড়ে মস্ত একটা বটগাছ, তারই একটা পুকুর— আমাদের দক্ষিনের বাগানের এই টুকুই চোখে পড়ল সেই দিন।
এই দক্ষিনের বাগান ছিলো বারবাড়ির সামিল— বাবুদের চলাফেরার স্থান । এখন যেমন ছেলেপিলে দাসী চাকর রাস্তার লোক এবং অন্দরের মেয়েরা পর্যন্ত এই বাগান মাড়িয়ে চলাফেরা করে, সেকালে সেটি হবার জো ছিলো না ! বাবামশায়ের শখের বাগান ছিলো এটা— এখানে পোষা সারস পোষা ময়ূর— তারা কেউ হাঁটুজলে পুকুরে নেমে মাছ শিকার করতো, কেউ পেখম ছড়িয়ে ঘাসের উপর চলাফেরা করতো তিন চারটে উড়ে মালীতে মিলে এখানে সব শখের গাছ আর খাঁচার পাখিদের তদবির করে বেড়াতো, একটি পাতা কি ফুল ছেঁড়ার হুকুম ছিলোনা কারু ! এই বাগানে একটা মস্ত গাছ-ঘর—সেখানে দেশ-বিদেশের দামী গাছ ধরা থাকতো ! পদ্মফুলের মতো করে গড়া একটা ফোয়ারা-তার জলে লাল মাছ, সব আফ্রিকা দেশ থেকে আনানো, নীল পদ্মপাতার তলায় খেলে বেড়াতো ! বাড়িখানা একতলা দোতলা তিনতলা পর্যন্ত, পাখিতে গাছেতে ফুলদানিতে ভর্তি ছিলো তখন । মনে পড়ে দোতলায় দক্ষিণের বারান্দার পূবদিকে একটা মস্ত গামলায় লাল মাছ ঠাসা থাকে, তারই পাশে দুটো সাদা খরগোশ, জাল-ঘেরা মস্ত খাঁচার মধ্যে সব ছোটো ছোটো পোষা পাখির ঝাঁক, দেওয়ালে একটা হরিণের শিঙের উপর বসে লালঝুঁটি মস্ত কাকাতুয়া, শিকলি-বাঁধা চীন দেশের একটা কুকুর, নাম তার কামিনী— পাউডার এসেন্সের গন্ধে কুকুরটার গা সর্বদা ভুরভুর করে । তখন বেশ একটু বড়ো হয়েছি, কিন্তু বৈঠকখানার বারান্দায় ফস্ করে যাবার সাধ্য নেই, সাহসও নেই ! এখন যেমন ছেলেমেয়েরা ‘বাবা’ বলে বৈঠকখানায় এসে হাজির হয় তখন সেটা হবার জো ছিল না । বাবামশায় যখন আহারের পর ও-বাড়িতে কাছারি করতে গেছেন সেই ফাঁকে একএক দিন বৈঠকখানায় গিয়ে পড়তেম । ‘টুনি’ বলে একটা ফিরিঙ্গী ছেলেও এই সময়টাতে পাখি চুরি করতে এদিকটাতে আসতো । পাখিগুলোকে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিয়ে, জালে করে ধরে নেওয়া খেলা ছিল তার ! টুনিসাহেব একবার একটা দামী পাখি উড়িয়ে দিয়ে পালায় । দোষটা আমার ঘাড়ে পড়ে । কিন্তু সেবারে আমি টুনির বিদ্যে ফাঁস করে দিয়ে রক্ষে পেয়ে যাই । আর একদিন— সে তখন গরমির সময়— দক্ষিন বারান্দাটা ভিজে খসখসের পরদায় অন্ধকার আর ঠাণ্ডা হয়ে আছে ; গামলা ভর্তি জলে পদ্মপাতার নীচে লাল মাছগুলোর খেলা দেখতে দেখতে মাথায় একটা দুর্বুদ্ধি জোগালো । যেমন লালমাছ, তেমনি লাল জলেই খেলে বেড়ালে শোভা পায় ! কোথা থেকে খানিক লাল রঙ এনে জলে ণ্ডলে দিতে দেরি হলো না, জলটা লালে লাল হয়ে উঠলো কিন্তু মিনিট কতকের মধ্যেই গোটা দুই মাছ মরে ভেসে উঠলো দেখেই বারান্দা ছেড়ে চোঁ চোঁ দৌড়— একদম ছোটোপিশির ঘরে ! মাছ মারার দায় থেকে কেমন করে, কি ভাবে যে রেহাই পেয়েছিলাম তা মনে নেই, কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত আর দোতলায় নামতে সাহস হয়নি ।
মনে আছে আর একবার মিস্ত্রী হবার শখ করে বিপদে পড়েছিলেম । বাবামশায়ের মনের মতো করে চীনে মিস্ত্রীরা চমৎকার একটা পাখির ঘর গড়ছে— জাল দিয়ে ঘেরা একটা যেন মন্দির তৈরি হচ্ছে, দেখছি বসে বসে । রোজই দেখি, আর মিস্ত্রীর মতো হাতুড়ি পেরেক অস্ত্রশস্ত্র চালাবার জন্য হাত নিস্পিস্ করে । একদিন, তখন কারিগর সবাই টিফিন করতে গেছে, সেই ফাঁকে একটা বাটালি আর হাতুড়ি নিয়ে মেরেছি দু’তিন কোপ ! ফস্ করে বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের ডগায় বাটালির এক ঘা ! খাঁচার গায়ে দু’চার ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়লো । রক্তটা মুছে নেবার সময় নেই— তাড়াতাড়ি বাগান থেকে খানিক ধুলো-বালি দিয়ে যতই রক্ত থামাতে চলি ততই বেশি করে রক্ত ছোটে ! তখন দোষ স্বীকার করে ধরা পড়া ছাড়া উপায় রইল না । সেবারে কিন্তু আমার বদলে মিস্ত্রী ধমক খেলে— যন্ত্রপাতি সাবধানে রাখার হুকুম হলো তার উপর ! কারিগর হতে গিয়ে প্রথমে যে ঘা খেয়েছিলেম তারে দাগটা এখনো আমার আঙ্গুলের ডগা থেকে মেলায় নি । ছেলেবেলায় আঙ্গুলের যে মামলায় পার পেয়ে গিয়েছিলেম, তারই শাস্তি বোধ হয় এই বয়সে লম্বা আঙ্গুল এঁকে হচ্ছে সাধারনের দরবারে ।
আর একটা শাস্তির দাগ এখনো আছে লেগে আমার ঠোঁটে । গুড়গুড়িতে তামাক খাবার ইচ্ছে হলো— হঠাৎ কোথা থেকে একটা গাড় জোগাড় করে তারই ভিতর খানিক জল ভরে টানতে লেগে গেলেম । ভুড় ভুড় শব্দটা ঠিক হচ্ছে, এমন সময় কি জানি পায়ের শব্দে চমকে যেমন পালাতে যাওয়া, অমনি শখের হুঁকোটার উপর উলটে পড়া ! সেবারে নীলমাধব ডাক্তার এসে তবে নিস্তার পাই— অনেক বরফ আর ধমকের পরে । দেখেছি যখন দুষ্টুমির শাস্তি নিজের শরীরে কিছু-না কিছু আপনা হতেই পড়েছে, তখন গুরুজনদের কাছ থেকে উপরি আরো দু’চার ঘা বড়ো একটা আসতো না । যখন দুষ্টুমি করেও অক্ষত শরীরে আছি তখনই বেচত খেতে হতো, নয় তো ধমক, নয় তো অন্দরে কারাবাস । এই শেষের শাস্তিটাই আমার কাছে ছিল ভয়ের— কুইনাইন খাওয়ার চেয়ে বিষম লাগতো !
অন্দরে বন্দী অবস্হায় যে ক’দিন আমার খাকতে হতো, সে’কদিন ছোটোপিশির ঘরই ছিলো আমার নিশ্বাস ফেলবার একটিমাত্র জায়গা। ‘বিষবৃক্ষ’, বইখানিতে সূর্যমুখীর ঘরের বর্ণনা পড়ি আর মনে আসে ছোটোপিশির ঘর । তেমনি সব ছবি, দেশী পেন্টারের হাতের । ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ যে লোহার সিন্দুকটা, সেটাও ছিলো । কৃষ্ণনগরের কারিগরের গড়া গোষ্ঠলীলার চমৎকার একটি কাচ-ঢাকা দৃশ্য, তাও ছিলো । উলে বোনা পাখির ছবি, বাড়ির ছবি । মস্ত একখানা খাট— মশারিটা তার ঝালরের মতো করে বাঁধা । শকুন্তলার ছবি, মদনভস্মের ছবি, উমার তপস্যার ছবি, কৃষ্ণলীলার ছবি দিয়ে ঘরের দেয়াল ভর্তি । এক একটা ছবির দিকে চেয়ে-চেয়েই দিন কেটে যেতো । এই ঘরে জয়পুরী কারিগরের আঁকা ছবি থেকে আরম্ভ করে, অয়েল পেনটিং ও কালীঘাটের পট পর্যন্ত সবই ছিলো ; তার উপরেও, এক আলমারি খেলনা । কালো কাচের প্রমাণ সই একটা বেড়াল, শাদা কাচের একটা কুকুর, ঠুনকো একটা ময়ুর, রঙিন ফুলদানি কত রকমের ! সে যেন একটা ঠুনকো রাজত্বে গিয়ে পড়তেম ! এ ছাড়া একটা আলমারি, তাতে সেকালের বাংলা-সাহিত্যের যা-কিছু ভালো বই সবই রয়েছে । এই ঘরের মাঝে ছোটোপিশি বসে বসে সারাদিন পুঁতি-গাঁথা আর সেলাই নিয়েই থাকেন । বাবামশায় ছোটোপিশিকে সাহেব-বাড়ি থেকে সেলাইয়ের বই, রেশম, কত কি, এনে দিতেন আর তিনি বই দেখে নতুন নতুন সেলাইয়ের নমুনা দিয়ে কতো কি কাজ করতেন তার ঠিক নেই । ছোটোপিশি এক জোড়া ছোট্ট বালা পুঁতি গেঁথে গেঁথে গড়েছিলেন- সোনালি পুঁতির উপরে ফিরোজার ফুল বসানো ছোট্ট বালা দু’গাছি, সোনার বালার চেয়েও ঢের সুন্দর দেখতে ।
বিকেলে ছোটোপিশি পায়রা খাওয়াতে বসতেন । ঘরের পাশেই খোলা ছাত ; সেখানে কাঠের খোপে, বাঁশের খোপে, পোষা থাকতো লক্কা, সিরাজী, মুক্ষি কতো কী নামের আর চেহারার পায়রা । খাওয়ার সময় ডানায় আর পালকে ছোটোপিশিকে ঘিরে ফেলত পায়রাগুলো । সে যেন সত্যিসত্যিই একটা পাখির রাজত্ব দেখতেম— উঁচু পাঁচিল-ঘেরা, ছাতে ধরা । বাবামশায়েরও পাখির শখ ছিলো ,কিন্তু তাঁর শখ দামী দামী খাঁচার পাখির, ময়ূর সারস হাঁস এইসবেরই । পায়রার শখ ছিলো ছোটোপিশির । হাটে হাটে লোক যেত পায়রা কিনতে। বাবামশায় তাঁকে দুটো বিলিতী পায়রা এক সময়ে এনে দেন, ছোটোপিশি সে দুটোকে ঘুঘু বলে স্হির করেন, কিছুতেই পুষভে রাজী হন না । অনেক বই খুলেও বাবামশায় যখন প্রমাণ করতে পারলেন না যে পাখি দুটো ঘুঘু নয়, তখন অগত্যা সে দুটো রটলেজ সাহেবের ওখানে ফেরত গেলো ! এরই কিছুদিন পরে একটা লোক ছোটোপিশিকে একজোড়া পায়রা বেচে গেলো— পাখিদুটোকে দেখতে ঠিক শাদা লাক্কা, কিন্তু লেজের পালক তাদের ময়ূর পুচ্ছের মতো রঙিন । এবার ছোটোপিশি ঠকলেন— বাবামশায় এসেই ধরে দিলেন পায়রার পালকে ময়ূরপুচ্ছ সুতো দিয়ে সেলাই করা । একটা তুমুল হাসির হর্রা উঠেছিলো সেদিন তিনতলার ছাতে, তাতে আমরাও যোগ দিয়েছিলেম ।
ঠাকুরপুজো, কথকতা, সেলাই আর পায়রা— এই নিয়েই থাকতেন ছোটোপিশি । একবার তাঁর তিনতলার এই ছাতটাতে, বাড়িসুদ্ধ সবার ফোটো নিতে এক মেম এসে উপস্হিত হলো । আমাদেরও ফোটো নেবার কথা, সকাল থেকে সাজগোজের ধুমধাম পড়ে গেলো । সেইদিন প্রথম জানলেম আমার একটা হালকা নীল মখমলের কোট প্যান্ট আছে । ভারি আনন্দ হলো, কিন্তু গায়ে চড়াবামাত্রই কোট-প্যান্ট বুঝিয়ে দিলো যে আমার মাপে তাদের কাটা হয়নি । এই অদ্ভুত সাজ পরে আমার চেহারাটা কারু কারু অ্যালবামে এখনো আছে— রোদের ঝাঁজ লেগে চোখ দুটো পিটপিট করছে, কাপড়টা ছেড়ে ফেলতে পারলে বাঁচি এই ভাব ।
ফোটো তোলা আর বাড়ির প্ল্যান আঁকার কাজ জানতেন বাবামশায় । ড্রইং করার নানা সাজ-সরজাম, কম্পাস-পেনসিল কত রকমের দেখতেম তাঁর ঘরে । বাবামশায় কাছারির কাজে গেলে তাঁর ঘরে ঢুকে সেগুলো নেড়ে-চেড়ে নিতেম । ঠিক সেই সময়, ফারসি পড়ানোর মুন্সি এসে জুটতেন । কথায় কথায় তিনি আলে বে, পে, তে, জিম— এমনি ফারসি অক্ষর আমাদের শোনাতে বসতেন । মুন্সির দু’একটা বয়েৎ এখনো মনে আছে— ‘গুলেস্তাঁমে যাকে হরিয়েক গুলকো দেখা, না তেরি সেরঙ্গ, না তেরি সে বূ হ্যায়’ । আর একটা বয়েৎ ছিল সেটা ভুলে গেছি, কেবল ধ্বনিটা মনে আছে । —কবুতর্ বা কবুতর্ বাক্ বাবাজ ! সেকালে ফারসি পড়িয়ে হলে কানে শরের কলম আর লুঙ্গি না হলে চলতো না, মাথাও ঢাকা চাই ! ঠিক মনে পড়ে না কেমন সাজটা ছিলো মুন্সির ।
ডাক্তারবাবুর আসবার সময় ছিলো সকাল ন’টা । অসুখ থাক বা না থাক, কতকটা সময় বাইরে বসে গুজব করে অন্যত্র রোগী দেখতেন গিয়ে রোজই । সেখানেও হয়তো এমনি একটা বাঁধা টাইম ছিলো ডাক্তারের জন্যে পান জল তামাক ইত্যাদি নিয়ে ! আর এক ডাক্তার সাহেব ছিলো বরাদ্দ— তার নাম কেলি— সে রোজ আসতো না, কিন্তু যখন আসতো তখনই জানতেম বাড়িতে একটা শক্ত রোগ ঢুকেছে । তখন দেখতুম আমাদের নীলমাধব বাবুর মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠেছে, আর ইংরিজি কথাটার মাঝেমাঝে থেকে থেকে ‘ওর নাম কি’ কথটা অজস্র ব্যবহার করছেন তিনি ; যথা— ‘আই থিংক— ওর নাম কি— ডিজিটিলিস্ অ্যান্ড কোয়নাইন ওর নাম কি— ইফ ইউ প্রেফার আই সে ডক্টার কেলি, ইত্যাদি ।‘
সাহেব ছাড়া হয়ে নীলমাধব বাবু— তাঁকে ডাক্তারই মনে হতো না, মনে হতো, একেবারে ঘরের মানুষ আর মজার মানুষটি বাঘমুখো ছড়ি হাতে, গলায় চাদর বুকে মোটা সোনার চেন, ডাক্তারবাবু ভালোমানুষের মতো এসে একখানা বেতের চৌকিতে বসতেন । চৌকিখানা আসত তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই আর সরেও যেত তাঁর সঙ্গেই । আমার প্রায়ই অসুখ ছিল না, কাজেই ডাক্তারের লাঠিটার বাঘমুখ কেমন করে কাত হয়ে চাইছে সেইটেই দেখতে পেতেম । ছোটো ছোটো লাল মানিকের চোখ দুটো বাঘের— ইচ্ছে হতো খুঁটে নিই, কিন্তু ভয় হতো— মা আছেন কাছেই দাঁড়িয়ে ডাক্তারের । এখনকার কালে কত ওষুধেরই নাম লেখে একটু অসুখেই, তখন সাতদিন জ্বর চলল তো দালচিনির আরক দেওয়া মিকশ্চার আসতো— বেশ লাগতো খেতে, আর খেলেই জ্বর পালাতো । তিনদিন পর্যন্ত ওষুধ লেখাই হতো না কোনো– হয় সাবুদানা, নয় এলাচদানা, বড়োজোর কিটিং –এর বন্বন্ । তিনদিনের পরেও যদি উঠে না দাঁড়াতেম তবে আসতো ডাক্তারখানা থেকে রেড মিক্শ্চার । গলদা চিংড়ির ঘি বলে সেটাকে সমস্তটা খাইয়ে দিতে কষ্ট পেতে হতো মা কে ।
এখন নানা রকম সৌখিন ওষুধ বেড়িয়েছে, তখন মাত্র একটিই ছিলো সৌখিন ওষুধ, যেটা খাওয়া চলতো অসুখ না থাকলেও । এই জিনিসটি দেখতে ছিলো ঠিক যেন মানিকে গড়া একটি একটি রুহিতনের টেক্কা । নামটাও তার মজার— জুজুবস্ । এখন বাজারে সে জুজুবস্ পাওয়া যায়না, তার বদলে ডাক্তার খানায় রাখে যষ্টি মধুর জুজুবস্— খেতে অত্যন্ত বিস্বাদ । অসুখ হলে তখন ডাক্তারের বিশেষ ফরমাসে আসতো একটিন বিস্কুট আর দমদম মিছরি । এখনকার বিস্কুটগুলো দেখতে, হয় টাটকা, নয় টিকিট । তখন ছিলো তারা সব কোনোটা ফুলের মতো, কেউ নক্ষত্রের মতো, কতক পাখির মতো । দমদম মিছরি গুলো যেন সোনার থেকে নিঙরে নেওয়া, রসে ঢালাই করা মোটা স্ক্রু একটা –একটা ।
ডাক্তারের পরই— টনটনে চটি পায়ে, সভ্যভব্য চন্দ্র কবিরাজ— তিনি তোষাখানা থেকে দপ্তরখানা হয়ে, লাল রঙের বগলী থেকে চটি বিলি করে করে উঠে আসতেন তেতলায় আমাদের কাছে । নাড়ি টিপে বেড়ানোই ছিলো তার একমাত্র কাজ, কিন্তু নিত্য-কাজ । বুড়ো কবিরাজ আমার মাকে মা বলে যে কেন ডাকে তার কারণ খুঁজে পেতাম না । আর একটি-দুটি লোক আসতো উপরের ঘরে, তাদের একজন গোবিন্দ পান্ডা, আর একজন রাজকিষ্ট মিস্ত্রী । পান্ডা আসতো কামানো মাথায় নামাবলি জড়িয়ে, কর্পূরের মালা, জগন্নাথের প্রসাদ নিয়ে । দাসীদের সঙ্গে আমরাও ঘিরে বসতেম তাকে । প্রথমটা সে মেঝেতে খড়ি পেতে গুনে দিত দাসীদের মধ্যে কার কপালে ক্ষেত্তরে যাওয়া আছে, না আছে । তার পর প্রসাদ বিতরন করে সে শ্রীক্ষেত্রের গল্প করতে থাকতো পট দেখিয়ে । সেই পট, নামাবলি, কর্পূরের মালা সব ক’টার রঙ মিলে শ্রীক্ষেত্রের সমুদ্র বালি পাথর ইত্যাদির একটা রঙ ধরেছিলো মনটা ।
অল্প কয় বছর হলো যখন পুরী দেখলেম প্রথম, তখন সেই সব রঙগুলোকেই আবার দেখতে পেলেম, যেন অনেক কাল আগে দেখা রঙ । নৌকো, পালকি, মন্দির, বালি, কাপড়— সমস্ত জিনিস শাদা, হলুদ, কালো ও নীল— চারটি বহুকালের চেনা রঙের ছোপ ধরিয়ে রেখেছে !
আর একজন সাহেব আসতো, তার নাম রুবারীও । জাতে পর্তুগীজ ফিরিঙ্গী-মিশকালো। বড়োদিনের দিন সে একটা কেক নিয়ে হাজির হতো । তাকে দেখলেই শুধোতেম— ‘সাহেব আজ তোমাদের কী?’ সাহেব অমনি নাচতে নাচতে উত্তর দিতো ‘আজ আমাদের কিস্মিস্ ।’ সাহেবের নাচন দেখে আমরা তাকে ঘিরে খুব একচোট নেচে নিতেম ।
নতুন কিছু পাখি কিম্বা নিলেমে গাছ কেনার দরকার হলে, বৈকুণ্ঠবাবুর ডাক পড়তো । দেখতে বেঁটে-খাটো মানুষটি মাথায় টাক, রাজ্যের পাখি, গাছ আর নিলেমের জিনিসের সংগ্রহ করতে ওস্তাদ ছিলেন ইনি । তখন স্যার রিচার্ড টেম্পল ছোটোলাট— ভারি তাঁর গাছের বাতিক । বৈকুণ্ঠবাবুর নিলেমের ছোটোলাটের ডাকের উপর ডাক চড়িয়ে, অনেক টাকার একটা গাছ আমাদের গাছ-ঘরে এনে হাজির করলেন । ছোটোলাট খবর পেলেন— গাছ চলে গেছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-বাড়িতে । সঙ্গে সঙ্গে লাটের চাপরাশি পত্র নিয়ে হাজির—ছোটোলাট বাগান দেখতে ইচ্ছে করেছেন। উপায় কি, সাজ-সাজ রব পড়ে গেলো । আমার মখমলের কোট-প্যান্ট আবার সিন্দুক থেকে বার হলো । সেজেগুজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলেম— ঘোড়ায় চড়ে ছোটোলাট এলেন । খানিক বাগানে ঘুরে একপাত্র চা খেয়ে বিদায় হলেন । বৈকুণ্ঠবাবুর ডেকে-আনা গাছটাও চলে গেলো জোড়াসাঁকো থেকে বেলভেডিয়ার পার্কে । বৈকুণ্ঠবাবুর বাসা ছিলো পাথুরেঘাটায়, সেখান থেকে নিত্য হাজিরি দেওয়া চাই এখানে । একবার ঘোর বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ডুবে এক কোমর জল দাঁড়িয়ে যায় । বৈকুণ্ঠবাবু গলির মোড়ে আটকা— অন্যের যেখানে হাঁটু-জল বৈকুণ্ঠবাবুর সেখানে ডুব-জল— এতো ছোটো ছিলেন তিনি ।
কাজেই একখানা ছোট্ট নৌকা পুকুর থেকে টেনে তুলে তবে তাকে চাকরেরা উদ্ধার করে আনে । ছোটো মানুষটি, কিন্তু ফন্দি ঘুরতো অনেকরকম তার মাথায় । কতো রকমই যে ব্যবসার মতলব করতেন তিনি তার ঠিক নেই । একবার বড়ো জ্যাঠামশায় একবাক্স নিব কিনে আনতে বৈকুণ্ঠবাবুকে হুকুম করেন । তিনি নিলেম থেকে একটা গরুর গাড়ি বোঝাই নিব কিনে হাজির ! আর একবার একগাড়ি বিলিতি এসেন্স এনে হাজির । বাবামশায়ের জন্য । দেখে সবাই অবাক, হাসির ধুম পড়ে গেল । এই ছোট্ট মানুষটিকে প্রকান্ড স্বপ্ন ছাড়া ছোট্টখাটো স্বপ্ন দেখতে কখনো দেখলেম না শেষ পর্যন্ত । বিচিত্র চরিত্রের সব মানুষের দেখা পেলেম তিনতলা থেকে ছাড়া পেয়েই।