অসমাপিকা
উড়ো ভাষায় এসে গেলো হাতে-খড়ির খবরটা আমার কানে । কিন্তু রামলাল রেখেছিলো পাক্কা খবর ঠিক কখন, কোন তারিখে, কোন মাসে হবে হাতে-খড়িটা । কেননা এই শুভ কাজে তার কিছু পাওনা ছিলো । কাজেই সে ঠিক সময় বুঝে, রাত ন’টার আগেই আমাকে খাঁচার মধ্যে বন্ধ করে বললে, ‘ঘুমিয়ে নাও, সকালে হাতে-খড়ি, ভোরে ওঠা চাই ।’ দু’কানের মধ্যে দুটো কথা— ‘ভোরে ওঠা’, ‘হাতে-খড়ি’— থেকে থেকে মশার মতো বাঁশি বাজিয়ে চললো । অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসতে দেরি করে দিয়ে, ঠিক ভোরে আমাকে একটু ঘুমোতে দিয়ে পালাল দুটো কথা । পাছে হাতে-খড়ির শুভ-লগ্নটা উতরে যায়, রামলালের চেয়েও সজাগ ছিলো আমাদের ঠাকুরঘরের বামুন ! সে ঠিক আজকের একজন স্টেশন মাস্টারের মতো দিলে ফার্স্ট বেল । রামলালও বলে উঠল--চলো, আর দেরি নেই ।’
পাছে দেরি হয়ে পড়ে, সেজন্যে পা চালিয়ে চললো রামলাল । একতলায় তোষাখানা থেকে নানা গলি-ঘুঁজি সিঁড়ি উঠোন পেরিয়ে চলতে চলতে দেখছি কাঠের গরাদে-আঁটা একটা জানলা— জানলার ওপারে অন্ধকার ঘরের মধ্যে কালো একটা মূর্তি একটা মোটা জালা থেকে কি তুলছে । লোকের শব্দ পেয়ে সে মূর্তিটা গোল দুটো চোখ নিয়ে আমার দিকে দেখতে থাকলো । এর অনেক কাল পরে জেনেছিলেম এ-লোকটা আমাদের কালীভান্ডারী— রোজ এর হাতের রুটিই খাওয়ায় রামলাল । কালী লোকটা ছিলো ভালো, কিন্তু চেহারা ছিলো ভীষণ । আলিবাবার গল্পের তেলের কূপো আর ডাকাতের কথা পড়ি আর মনেপড়ে এখনো কালীর সেদিনের চোখ, গরাদে-আঁটা ঘর আর মেটে জালা । ভাঁড়ার ঘর পেরিয়ে এক ছোটো উঠোন— জলে ধোওয়া, লাল টালি বিছানো । সেখান খেকে ছাতের-ঘরের ঠাকুর-ঘরের উত্তর দেওয়াল দেখা যায়, কিন্তু সেখানে পৌঁছতে সহজে পারিনি । উঠোনের উত্তর-ধারে চার-পাঁচটা সিড়ি উঠে একটা ঘর-জোড়া মেটে সিঁড়ি সোজা দোতলায় উঠেছে । এই সিঁড়ির গায়েই পাল্কি নামবার ঘর । সেটা ছাড়িয়ে একটা সরু গলি— একধারে দেওয়াল, অন্যধারে কাঠের বেড়া । গলিটা পেরিরে এলেম একটা ছাত আর সরু একটা বারান্দা । তারই একপাশে সারি সারি মাটির উনুন গাঁথা আছে– দুধ জ্বাল দেবার, লুচি ভাজবার স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র চুল্লি । এই সরু বারান্দা, সরু গলির শেষে, চার-পাঁচ ধাপ সিঁড়ি— অন্ধকার আর ঘোরতর ঘর্ঘর শব্দ পরিপূর্ণ একটা ছোটো ঘরে নেমে গেছে । ঘরের মেঝেটা থরথর করে পায়ের তলায় কাঁপছে টের পেলেম । সেখানে দেখলেম একটা দাসী, হাত দু’খানা তার মোটা মোটা— গোল দুখানা পাথর একটার উপর আর একটা রেখে, একটা হাতল ধরে ক্রমাগত ঘুরিয় চলেছে— পাশে তার স্তূপাকার করা সোনামূগ । এই ডাল দিয়ে যে রুটি খাই তা কি তখন জানি ? সে-ঘরটা পেরিয়ে আর একটা উঠোনের চক-মিলানো বারান্দা । সেখানে পৌঁছে একটা চেনা লোক— অমৃত দাসী— সে একটা শিল আর নোড়ায় ঘষা-ঘষি করে শব্দ তুলছে ঘটর- ঘটর ! এক মুঠো কি সে শিলের উপরে ছেড়ে দিয়ে খানিক নোড়া ঘযে দিলে ঘটাঘট, অমনি হয়ে গেল লাল রঙের একটা পদার্থ । অমনি হলুদ, সবুজ, শাদা, কত কী রঙ বাটছে বসে বসে সে-কে জানে তখন সেগুলো দিয়ে কালিয়া, পোলাও, মাছের ঝোল, ডাল, অম্বল রঙ করা হয় ভাত খাবার বেলায় । এখান থেকে টালি-খসা ফোকলা একটা মেটে সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে ঠাকুর-ঘরের ঠিক দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেম । রামলাল ফস্ করে চঢিজুতোটা পা থেকে খুলে নিয়ে বললে— ‘যাও।’
ঠাকুরঘরের দেওয়ালে শাদা পঙ্খের প্রলেপ ; খাটলে খাটলে ছোটো ছোটো সারি সারি কুলুঙ্গি ; তারই একটাতে তেল-কালি-পড়া পিলসুজে পিদুম জলছে সকাল বেলায় । ঠিক তারই নিচে, দেওয়ালের গায়ে, প্রায় মুছে গেছে এমন একটা বসুধারার ছোপ । ঘরের মেঝেয় একটা শাদা চুন-মাখানো দেলকো, আর আমপাতা, ডাব আর সিঁদুর মাখানো একটা ঘট । পুজোর সামগ্রী নিয়ে তারই কাছে পুরুত বসে ; আর গায়ে নামাবলি জড়িয়ে হরিনামের মালা হাতে ছোটোপিশিমা । ধুপ-ধুনোর ধোঁয়ার গন্ধে ভরা ঘরের মধ্যেটায় কী আছে দেখবার আগেই আমার চোখ জ্বালা করভে থাকলো । তারপর কে যে সে মনে নেই, মেঝেতে একটা বড়ো ক লিখে দিলো । রামখড়ি হাতের মুঠোয় ধরে দাগা বুলোলেম— একবার, দু’বার, তিনবার । তার পরেই শাঁখ বাজলো । হাতে-খড়িও হয়ে গেলো ।
পুজোর ঘর থেকে একটা বাতাসা চিবোতে চিবোতে ফিরতে থাকলেম এবারে । একেবারে একতলায় যোগেশদাদার দপ্তরে এসে একতাড়া তালপাতা, কঞ্চির কলম ও মাটির নতুন দোয়াত নিতে হলো, বাড়ির বুড়ো আধবুড়ো ছোকরা করমচারী সবারই পায়ের ধুলো ও আশীর্বাদের সঙ্গে— এও মনে আছে । তারপর সদরে-অন্দরে সবাইকে দেখা দিয়ে কোথায় গেলেম, কি করলেম কিছুই মনে নেই । কিন্তু তার পরদিনই আবার সরস্বতী পুজোয় দোয়াত, কলম, বই, শেলেট রামলাল দিয়ে এল, তা মনে পড়ে কিন্তু । গুরুমশায় বলে সেদিনের একটা কেউ আমার মনের খোপে ধরা নেই হাতে-খড়ির সকালটার সঙ্গে ।
একটা অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো এই হাতে-খড়ি ব্যাপারটা । এরই মতো আরো কতকগুলো অসমাপ্ত, কতকটা বায়োস্কোপের টুকরো ছবির মতো, মনের কোণে রয়েছে জমা ।
খুব ছোটোবেলার একটা ঘটনার কথা । সেটা শুনে-পাওয়া সংগ্রহ মনের— মা বলতেন— আমাকে নিয়ে কাটোয়াতে যাচ্ছেন ছোটো পিশিমার শ্বশুরবাড়ি । পথে ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে পালকি চলছে ।সঙ্গের দাসী একগোছা ধানের শীষ ভেঙে মাকে দিয়েছে ; তারই একটা শীষ মা দিয়েছেন আমাকে খেলতে । মা চলেছেন অন্য মনে মাঠ-ঘাট দেখতে দেখতে, বন্ধ পাল্কির ফাঁকে চোখ দিয়ে । সেই ফাঁকে হাতের ধান-শীষ মুখের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আমার গলায় বেধে দম বন্ধ করে আর কি ! এমন সময়— এ-ঘটনা বারবার বলতেন মা, কিন্তু এ-ঘটনা কোনো কিছু স্মৃতি কি ছবির সঙ্গে জড়িয়ে দেখতে পেতো না মন । যেন মনের ঘুমন্ত অবস্হার ঘটনা এটা জন্মের পরের, কিন্তু মনের ছাপাখানা খোলার পূর্বের ঘটনা।
পুরনো বৈঠকখানা –বাড়িটা । অনেক অদলবদল জোড়া-তাড়া দিয়ে হয়েছে জোড়াসাঁকোর আমাদের এই বসত বাড়িটা । খাপছাড়া রকমের অলি, গলি, সিঁড়ি, চোর-কুঠরি, কুলুঙ্গি ইত্যাদিতে ভরা এই বাড়ি, খানিক সমাপ্ত খানিক অসমাপ্ত ছবিও ঘটনার ছাপ আপানা হতেই দিত তখন মনের উপর । অন্দর-বাড়ি থেকে রান্না-বাড়িতে যাবার একটা গলিপথ ; ছোটখাটো একটা উঠোনের পশ্চিম গায়ে, সরু দুটো মেটে সিঁড়ির মাথায়, দোতলার উপর ধরা এই গলিটার পশ্চিম দেওয়ালে পিদুম দেবার একটা কুলুঙ্গি । বাড়ির আর সব কুলুঙ্গি ক’টা ছিলো মেঝে ছেড়ে অনেক উপরে, ছোটো আমাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু এই কুলুঙ্গিটা— ঠিক একটি পূর্ণচন্দ্র যতো বড়ো দেখা যায় ততো বড়ো— আর সব কুলুঙ্গি থেকে স্বতন্ত্র হয়ে মেঝে থেকে নেমে পড়েছিলো । দেখে মনে হতো সেটাকে, যেন একটা রবারের গোলা, ভুঁয়ে পড়ে একটু লাফিয়ে উঠে শূন্যে দাঁড়িয়ে গেছে । লুকোবার অনেকগুলো জায়গা ছিলো আমাদের, তার মধ্যে এও ছিলো একটা । ইদুর যেমন গর্তে গুটিসুটি বসে থাকে, তেমনি এক-একদিন গিয়ে বসতেম সকারণে, অকারণেও । পুব-পশ্চিমে দেওয়াল-জোড়া গলি, ছাওয়া দিয়ে নিকোনো । নানা কাজে ব্যস্ত চাকর-দাসী, তারা এই পথটুকু চকিতে মাড়িয়ে জাওয়া-আসা করে— আমাকে দেখতেই পায় না । আমি দেখি তাদের খালি কালো কালো পায়ের চলাচল ।
ঠিক আমার সামনেই একতলার ঘরের একটা মেটে সিঁড়ি একতলার একটা তালাবন্ধ সেকেলে দরজার সামনে পা রেখে, দোতলায় মাথা রেখে, আড় হয়ে পড়ে থাকে— যেন একটা গজগীর দৈত্য আজব শহরের তেল-কালি-পড়া সিংহদ্বার আগলে ঘুম দিচ্ছে এই ভাব । এলা-মাটির উপরে সোঁতা অন্ধকার— তারই দিকে চেয়ে বসে থাকি লুকিয়ে চুপচাপ । বেশিক্ষণ একলা থাকতে হতো না, ঘড়ি ধরে ঠিক সময়ে সিঁড়ির গোড়ায় বিছিয়ে, পড়তো রোদ— একখানি সোনায় বোনা নতুন মাদুর যেন থাকতে থাকতে এরই উপর দিয়ে আগে আসতো এক ছায়া, তার পাছে প্রায় ছায়ারই মতো একটি বুড়ি গুটি গুটি । তার লাঠির ঠকঠক শব্দ জানাতো যে সে ছায়া নয়, কায়া । বুড়ি এসে চুপ করে বসে যেত তালাবন্ধ কপাটের একপাশে । বসে থাকে তো বসেই থাকে বুড়ি । সিঁড়ি আড় হয়ে পড়ে থাকে তো থাকেই— সাড়া শব্দ দেয় না দু’জনে কেউ ! রোদ ক্রমে সরে, একটু একটু করে আলো এলা-মাটির দেওয়াল গুলোকে সোনার আভায় একটু ক্ষণের জন্যে উজলে দিয়ে, মাদুর গুটিয়ে নিয়ে যেন চলে যায় । সেই সময় একটা ভিখিরী দুটো লাঠির উপর ভর দিয়ে যেন ঝুলতে-ঝুলতে এসে বসে বন্ধ-দরজার অন্য পাশে, হাতে তার একটা পিতলের বাটি । সে বসে থাকে, নেকড়া-জড়ানো খোঁড়া পা একটা সিঁড়িটার দিকে মেলিয়ে গম্ভীর ভাবে । বুড়ো বুড়ি কারো মুখে কথা নেই । কোথা খেকে বড়ো বউঠাকরুণের পোষা বেড়াল ‘গোলাপী’— গায়ে তিন রঙের ছাপ— মোটা ল্যাজ তুলে বুড়ির গা ঘেঁষে গিয়ে বলে মিঁয়া । বুড়ো ভিখিরী অমনি
হাতের লাঠিটা ঠুকে দেয় । বেড়াল দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায় উঠে আসে ! ঠিক এই সময় শুনি ঠাকুরঘরে ভোগের ঘন্টা শাঁখ বেজে ওঠে । অমনি দেখি বুড়ো বুড়ি দুটোতে চলে গেল— ঠিক যেন নেপথ্যে প্রস্হান হলো তাদের থিয়েটারে । কুলুঙ্গিতে বসে আমি শুনতে থাকলেম কাঁসর বাজছে—
তারপর...তারপর...তারপর... একদিন সকালে আমাদের দক্ষিণের বারান্দার সামনে লম্বা ঘরে চায়ের মজলিস বসেছে । পেয়ারী-বাবুর্চি উর্দি পরে ফিটফাট হয়ে সকাল থেকে দোতলায় হাজির । আমার সেই নীল মখমলের সেকেন্ড-হ্যান্ড কোট আড় শার্ট প্যান্টটার মধ্যে পুরে রামলাল আমাকে ছেড়ে দিয়েছে— যতটা পারে চা-য়ের মজলিস থেকে দুরে ।
কে জানে সে কে একজন— মনে তার চেহারাও নেই, নামও নেই— সাহেব সুবো গোছের মানুষ, চা খেতে খেতে হঠাৎ আমাকে কাছে যেতে ইশারা কড়লেন । চায়ের ঘরে ঢুকতে মানা ছিলো পূর্বে । কাজেই, আমি ধরা পড়েছি দেখে পালাবার মতলবে আছি, এমন সময় রামলাল কানের কাছে চুপি চুপি বললে, ‘যাও ডাকছেন, কিন্তু দেখো, খেও না কিছ ’ সাহস পেলেম, সোজা চলে গেলেম টেবিলের কাছে, যেখানে রুটি বিস্কুট, চায়ের পেয়ালা, কাচের প্লেট, তখমা-ঝোলোনো বাবুর্চি, আগে থেকে মনকে টানছিলো । ভুলে গেছি তখন রামলালের হুকুমের শেষ ভাগটা । ঘরের মধ্যে কি ঘটনা ঘটলো তা একটুও মনে নেই । মিনিট কতক পরে একখানা মাখন মাখানো পাঁউরুটি চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে আসতেই আড়ালে কেদারদাদার সামনে পড়লেম । ছেলে মাত্রকে কেদারদাদার অভ্যাস ছিল ‘শালা’ বলা । তিনি আমার কানটা মলে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন— ‘যাঃ, শালা, ব্যাপুটাইজ হয়ে গেলি ।’ রামলাল একবার কটমট করে আমার দিকে চেয়ে বললে— ‘বলেছিলুম না, খেও না কিছু ।’
কি যে অন্যায় হয়ে গেছে তা বুঝতে পারিনে ; কেউ স্পষ্ট করেও কিছু বলে না । দাসীদের কাছে গেলে বলে— ‘মাগো, খেলে কি করে ?’ ছোটো বোনেরা বলে বসে— ‘তুমি খেয়েছো, ছোঁবনা !’ বড়োপিশি মাকে ধমকে বলেন— ‘ওকে শিখিয়ে দিতে পারোনি, ছোটোবৌ !’
যে ভদ্রলোক চা খেতে এসেছিলেন তিনি তো গেলেন চলে খাতির-যত্ন পেয়ে । কেদারদাদাও গেলেন শিকদারপাড়ার গলিতে । কিন্তু ‘ব্যাপটাইজ’ কথাটা আমার আর কাছ-ছাড়া হয়না । রুটি খানা হজম হয়ে যাবার অনেক ঘন্টা পরে পর্যন্ত আমার মনে কেমন একটা বিভীষিকা জাগতে থাকলো । কারো কাছে এগোতে সাহস হয় না । চাকরদের কাছে তোষাখানায় যাই, সেখানে দেখি রটে গেছে ব্যাপটাইজ হবার ইতিহাস । দপ্তরখানায় পালাই, সেখান জোগেশদাদা মথুরাদাদাকে ডেকে বলে দেন— আমি ‘ব্যাপটাইজ’ হয়ে গোছি । এমনি একদিন দু’দিন কতদিন যায় মনে নেই— একলা একলা ফিরি, কোথাও আমল পাইনে, শেষে একদিন ছোটোপিশিমা আমায় দেখে বললেন— ‘তোর মুখটা শুকনো কেন রে?’
মনের দুঃখ তখন আর চাপা থাকলো না— ছোটোপিশিমা, আমি ‘ব্যাপটাইজ’ হয়ে গেছি !’ ছোটোপিশি জানতেন হয়তো ‘ব্যাপটাইজ’ হওয়ার কাহিনী এবং যদি বিনা দোষে কেউ ‘ব্যাপটাইজ’ হয় তো তার উদ্ধার হয়ে কিসে, তাও তাঁর জানা ছিলো । তিনি রামলালকে একটু আমার মাখায় গঙ্গাজল দিয়ে আনতে বললেন । চললো নিয়ে আমাকে রামলাল ঠাকুরঘরে । পাহারাওয়ালার সঙ্গে যেমন চোর, সেই ভাবে চললেম রামলালের পেছনে পেছনে । রান্না-বাড়ির পুব-গায়ে, সরু মেটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে হয় ঠাকুর-বাড়ি । এই সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠে, দেওয়ালের গায়ে চৌকো একটা দরজা ফস্ করে খুলে, রামলাল বললে— ‘এটা কি জানো? চোর-কুটুরি পেত্নী থাকে এখানে ।’
আর বলতে হলো না, সোজা আমি উঠে চললেম সিঁড়ি যেখানে নিয়ে যাক ভেবে । খানিক পরে রামলালের গলা পেলেম— ‘জুতো খুলে দাঁড়াও, পঞ্চগব্যি আনতে বালি ।’ ভয়ে তখন রক্ত জল হয়ে গেছে । ছোটোপিশি দিয়েছেন গঙ্গাজলের ; কেন যে রামলাল পঞ্চগব্যির কথা তুলছে, সে-প্রশ্ন করার মতো অবস্থার বাইরে গেছে তখন । মনও দেখেছি সেই পর্যন্ত লিখে বাকিটা রেখেছে অসমাপ্ত।
উড়ো ভাষায় এসে গেলো হাতে-খড়ির খবরটা আমার কানে । কিন্তু রামলাল রেখেছিলো পাক্কা খবর ঠিক কখন, কোন তারিখে, কোন মাসে হবে হাতে-খড়িটা । কেননা এই শুভ কাজে তার কিছু পাওনা ছিলো । কাজেই সে ঠিক সময় বুঝে, রাত ন’টার আগেই আমাকে খাঁচার মধ্যে বন্ধ করে বললে, ‘ঘুমিয়ে নাও, সকালে হাতে-খড়ি, ভোরে ওঠা চাই ।’ দু’কানের মধ্যে দুটো কথা— ‘ভোরে ওঠা’, ‘হাতে-খড়ি’— থেকে থেকে মশার মতো বাঁশি বাজিয়ে চললো । অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসতে দেরি করে দিয়ে, ঠিক ভোরে আমাকে একটু ঘুমোতে দিয়ে পালাল দুটো কথা । পাছে হাতে-খড়ির শুভ-লগ্নটা উতরে যায়, রামলালের চেয়েও সজাগ ছিলো আমাদের ঠাকুরঘরের বামুন ! সে ঠিক আজকের একজন স্টেশন মাস্টারের মতো দিলে ফার্স্ট বেল । রামলালও বলে উঠল--চলো, আর দেরি নেই ।’
পাছে দেরি হয়ে পড়ে, সেজন্যে পা চালিয়ে চললো রামলাল । একতলায় তোষাখানা থেকে নানা গলি-ঘুঁজি সিঁড়ি উঠোন পেরিয়ে চলতে চলতে দেখছি কাঠের গরাদে-আঁটা একটা জানলা— জানলার ওপারে অন্ধকার ঘরের মধ্যে কালো একটা মূর্তি একটা মোটা জালা থেকে কি তুলছে । লোকের শব্দ পেয়ে সে মূর্তিটা গোল দুটো চোখ নিয়ে আমার দিকে দেখতে থাকলো । এর অনেক কাল পরে জেনেছিলেম এ-লোকটা আমাদের কালীভান্ডারী— রোজ এর হাতের রুটিই খাওয়ায় রামলাল । কালী লোকটা ছিলো ভালো, কিন্তু চেহারা ছিলো ভীষণ । আলিবাবার গল্পের তেলের কূপো আর ডাকাতের কথা পড়ি আর মনেপড়ে এখনো কালীর সেদিনের চোখ, গরাদে-আঁটা ঘর আর মেটে জালা । ভাঁড়ার ঘর পেরিয়ে এক ছোটো উঠোন— জলে ধোওয়া, লাল টালি বিছানো । সেখান খেকে ছাতের-ঘরের ঠাকুর-ঘরের উত্তর দেওয়াল দেখা যায়, কিন্তু সেখানে পৌঁছতে সহজে পারিনি । উঠোনের উত্তর-ধারে চার-পাঁচটা সিড়ি উঠে একটা ঘর-জোড়া মেটে সিঁড়ি সোজা দোতলায় উঠেছে । এই সিঁড়ির গায়েই পাল্কি নামবার ঘর । সেটা ছাড়িয়ে একটা সরু গলি— একধারে দেওয়াল, অন্যধারে কাঠের বেড়া । গলিটা পেরিরে এলেম একটা ছাত আর সরু একটা বারান্দা । তারই একপাশে সারি সারি মাটির উনুন গাঁথা আছে– দুধ জ্বাল দেবার, লুচি ভাজবার স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র চুল্লি । এই সরু বারান্দা, সরু গলির শেষে, চার-পাঁচ ধাপ সিঁড়ি— অন্ধকার আর ঘোরতর ঘর্ঘর শব্দ পরিপূর্ণ একটা ছোটো ঘরে নেমে গেছে । ঘরের মেঝেটা থরথর করে পায়ের তলায় কাঁপছে টের পেলেম । সেখানে দেখলেম একটা দাসী, হাত দু’খানা তার মোটা মোটা— গোল দুখানা পাথর একটার উপর আর একটা রেখে, একটা হাতল ধরে ক্রমাগত ঘুরিয় চলেছে— পাশে তার স্তূপাকার করা সোনামূগ । এই ডাল দিয়ে যে রুটি খাই তা কি তখন জানি ? সে-ঘরটা পেরিয়ে আর একটা উঠোনের চক-মিলানো বারান্দা । সেখানে পৌঁছে একটা চেনা লোক— অমৃত দাসী— সে একটা শিল আর নোড়ায় ঘষা-ঘষি করে শব্দ তুলছে ঘটর- ঘটর ! এক মুঠো কি সে শিলের উপরে ছেড়ে দিয়ে খানিক নোড়া ঘযে দিলে ঘটাঘট, অমনি হয়ে গেল লাল রঙের একটা পদার্থ । অমনি হলুদ, সবুজ, শাদা, কত কী রঙ বাটছে বসে বসে সে-কে জানে তখন সেগুলো দিয়ে কালিয়া, পোলাও, মাছের ঝোল, ডাল, অম্বল রঙ করা হয় ভাত খাবার বেলায় । এখান থেকে টালি-খসা ফোকলা একটা মেটে সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে ঠাকুর-ঘরের ঠিক দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেম । রামলাল ফস্ করে চঢিজুতোটা পা থেকে খুলে নিয়ে বললে— ‘যাও।’
ঠাকুরঘরের দেওয়ালে শাদা পঙ্খের প্রলেপ ; খাটলে খাটলে ছোটো ছোটো সারি সারি কুলুঙ্গি ; তারই একটাতে তেল-কালি-পড়া পিলসুজে পিদুম জলছে সকাল বেলায় । ঠিক তারই নিচে, দেওয়ালের গায়ে, প্রায় মুছে গেছে এমন একটা বসুধারার ছোপ । ঘরের মেঝেয় একটা শাদা চুন-মাখানো দেলকো, আর আমপাতা, ডাব আর সিঁদুর মাখানো একটা ঘট । পুজোর সামগ্রী নিয়ে তারই কাছে পুরুত বসে ; আর গায়ে নামাবলি জড়িয়ে হরিনামের মালা হাতে ছোটোপিশিমা । ধুপ-ধুনোর ধোঁয়ার গন্ধে ভরা ঘরের মধ্যেটায় কী আছে দেখবার আগেই আমার চোখ জ্বালা করভে থাকলো । তারপর কে যে সে মনে নেই, মেঝেতে একটা বড়ো ক লিখে দিলো । রামখড়ি হাতের মুঠোয় ধরে দাগা বুলোলেম— একবার, দু’বার, তিনবার । তার পরেই শাঁখ বাজলো । হাতে-খড়িও হয়ে গেলো ।
পুজোর ঘর থেকে একটা বাতাসা চিবোতে চিবোতে ফিরতে থাকলেম এবারে । একেবারে একতলায় যোগেশদাদার দপ্তরে এসে একতাড়া তালপাতা, কঞ্চির কলম ও মাটির নতুন দোয়াত নিতে হলো, বাড়ির বুড়ো আধবুড়ো ছোকরা করমচারী সবারই পায়ের ধুলো ও আশীর্বাদের সঙ্গে— এও মনে আছে । তারপর সদরে-অন্দরে সবাইকে দেখা দিয়ে কোথায় গেলেম, কি করলেম কিছুই মনে নেই । কিন্তু তার পরদিনই আবার সরস্বতী পুজোয় দোয়াত, কলম, বই, শেলেট রামলাল দিয়ে এল, তা মনে পড়ে কিন্তু । গুরুমশায় বলে সেদিনের একটা কেউ আমার মনের খোপে ধরা নেই হাতে-খড়ির সকালটার সঙ্গে ।
একটা অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো এই হাতে-খড়ি ব্যাপারটা । এরই মতো আরো কতকগুলো অসমাপ্ত, কতকটা বায়োস্কোপের টুকরো ছবির মতো, মনের কোণে রয়েছে জমা ।
খুব ছোটোবেলার একটা ঘটনার কথা । সেটা শুনে-পাওয়া সংগ্রহ মনের— মা বলতেন— আমাকে নিয়ে কাটোয়াতে যাচ্ছেন ছোটো পিশিমার শ্বশুরবাড়ি । পথে ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে পালকি চলছে ।সঙ্গের দাসী একগোছা ধানের শীষ ভেঙে মাকে দিয়েছে ; তারই একটা শীষ মা দিয়েছেন আমাকে খেলতে । মা চলেছেন অন্য মনে মাঠ-ঘাট দেখতে দেখতে, বন্ধ পাল্কির ফাঁকে চোখ দিয়ে । সেই ফাঁকে হাতের ধান-শীষ মুখের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আমার গলায় বেধে দম বন্ধ করে আর কি ! এমন সময়— এ-ঘটনা বারবার বলতেন মা, কিন্তু এ-ঘটনা কোনো কিছু স্মৃতি কি ছবির সঙ্গে জড়িয়ে দেখতে পেতো না মন । যেন মনের ঘুমন্ত অবস্হার ঘটনা এটা জন্মের পরের, কিন্তু মনের ছাপাখানা খোলার পূর্বের ঘটনা।
পুরনো বৈঠকখানা –বাড়িটা । অনেক অদলবদল জোড়া-তাড়া দিয়ে হয়েছে জোড়াসাঁকোর আমাদের এই বসত বাড়িটা । খাপছাড়া রকমের অলি, গলি, সিঁড়ি, চোর-কুঠরি, কুলুঙ্গি ইত্যাদিতে ভরা এই বাড়ি, খানিক সমাপ্ত খানিক অসমাপ্ত ছবিও ঘটনার ছাপ আপানা হতেই দিত তখন মনের উপর । অন্দর-বাড়ি থেকে রান্না-বাড়িতে যাবার একটা গলিপথ ; ছোটখাটো একটা উঠোনের পশ্চিম গায়ে, সরু দুটো মেটে সিঁড়ির মাথায়, দোতলার উপর ধরা এই গলিটার পশ্চিম দেওয়ালে পিদুম দেবার একটা কুলুঙ্গি । বাড়ির আর সব কুলুঙ্গি ক’টা ছিলো মেঝে ছেড়ে অনেক উপরে, ছোটো আমাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু এই কুলুঙ্গিটা— ঠিক একটি পূর্ণচন্দ্র যতো বড়ো দেখা যায় ততো বড়ো— আর সব কুলুঙ্গি থেকে স্বতন্ত্র হয়ে মেঝে থেকে নেমে পড়েছিলো । দেখে মনে হতো সেটাকে, যেন একটা রবারের গোলা, ভুঁয়ে পড়ে একটু লাফিয়ে উঠে শূন্যে দাঁড়িয়ে গেছে । লুকোবার অনেকগুলো জায়গা ছিলো আমাদের, তার মধ্যে এও ছিলো একটা । ইদুর যেমন গর্তে গুটিসুটি বসে থাকে, তেমনি এক-একদিন গিয়ে বসতেম সকারণে, অকারণেও । পুব-পশ্চিমে দেওয়াল-জোড়া গলি, ছাওয়া দিয়ে নিকোনো । নানা কাজে ব্যস্ত চাকর-দাসী, তারা এই পথটুকু চকিতে মাড়িয়ে জাওয়া-আসা করে— আমাকে দেখতেই পায় না । আমি দেখি তাদের খালি কালো কালো পায়ের চলাচল ।
ঠিক আমার সামনেই একতলার ঘরের একটা মেটে সিঁড়ি একতলার একটা তালাবন্ধ সেকেলে দরজার সামনে পা রেখে, দোতলায় মাথা রেখে, আড় হয়ে পড়ে থাকে— যেন একটা গজগীর দৈত্য আজব শহরের তেল-কালি-পড়া সিংহদ্বার আগলে ঘুম দিচ্ছে এই ভাব । এলা-মাটির উপরে সোঁতা অন্ধকার— তারই দিকে চেয়ে বসে থাকি লুকিয়ে চুপচাপ । বেশিক্ষণ একলা থাকতে হতো না, ঘড়ি ধরে ঠিক সময়ে সিঁড়ির গোড়ায় বিছিয়ে, পড়তো রোদ— একখানি সোনায় বোনা নতুন মাদুর যেন থাকতে থাকতে এরই উপর দিয়ে আগে আসতো এক ছায়া, তার পাছে প্রায় ছায়ারই মতো একটি বুড়ি গুটি গুটি । তার লাঠির ঠকঠক শব্দ জানাতো যে সে ছায়া নয়, কায়া । বুড়ি এসে চুপ করে বসে যেত তালাবন্ধ কপাটের একপাশে । বসে থাকে তো বসেই থাকে বুড়ি । সিঁড়ি আড় হয়ে পড়ে থাকে তো থাকেই— সাড়া শব্দ দেয় না দু’জনে কেউ ! রোদ ক্রমে সরে, একটু একটু করে আলো এলা-মাটির দেওয়াল গুলোকে সোনার আভায় একটু ক্ষণের জন্যে উজলে দিয়ে, মাদুর গুটিয়ে নিয়ে যেন চলে যায় । সেই সময় একটা ভিখিরী দুটো লাঠির উপর ভর দিয়ে যেন ঝুলতে-ঝুলতে এসে বসে বন্ধ-দরজার অন্য পাশে, হাতে তার একটা পিতলের বাটি । সে বসে থাকে, নেকড়া-জড়ানো খোঁড়া পা একটা সিঁড়িটার দিকে মেলিয়ে গম্ভীর ভাবে । বুড়ো বুড়ি কারো মুখে কথা নেই । কোথা খেকে বড়ো বউঠাকরুণের পোষা বেড়াল ‘গোলাপী’— গায়ে তিন রঙের ছাপ— মোটা ল্যাজ তুলে বুড়ির গা ঘেঁষে গিয়ে বলে মিঁয়া । বুড়ো ভিখিরী অমনি
হাতের লাঠিটা ঠুকে দেয় । বেড়াল দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায় উঠে আসে ! ঠিক এই সময় শুনি ঠাকুরঘরে ভোগের ঘন্টা শাঁখ বেজে ওঠে । অমনি দেখি বুড়ো বুড়ি দুটোতে চলে গেল— ঠিক যেন নেপথ্যে প্রস্হান হলো তাদের থিয়েটারে । কুলুঙ্গিতে বসে আমি শুনতে থাকলেম কাঁসর বাজছে—
তারপর...তারপর...তারপর... একদিন সকালে আমাদের দক্ষিণের বারান্দার সামনে লম্বা ঘরে চায়ের মজলিস বসেছে । পেয়ারী-বাবুর্চি উর্দি পরে ফিটফাট হয়ে সকাল থেকে দোতলায় হাজির । আমার সেই নীল মখমলের সেকেন্ড-হ্যান্ড কোট আড় শার্ট প্যান্টটার মধ্যে পুরে রামলাল আমাকে ছেড়ে দিয়েছে— যতটা পারে চা-য়ের মজলিস থেকে দুরে ।
কে জানে সে কে একজন— মনে তার চেহারাও নেই, নামও নেই— সাহেব সুবো গোছের মানুষ, চা খেতে খেতে হঠাৎ আমাকে কাছে যেতে ইশারা কড়লেন । চায়ের ঘরে ঢুকতে মানা ছিলো পূর্বে । কাজেই, আমি ধরা পড়েছি দেখে পালাবার মতলবে আছি, এমন সময় রামলাল কানের কাছে চুপি চুপি বললে, ‘যাও ডাকছেন, কিন্তু দেখো, খেও না কিছ ’ সাহস পেলেম, সোজা চলে গেলেম টেবিলের কাছে, যেখানে রুটি বিস্কুট, চায়ের পেয়ালা, কাচের প্লেট, তখমা-ঝোলোনো বাবুর্চি, আগে থেকে মনকে টানছিলো । ভুলে গেছি তখন রামলালের হুকুমের শেষ ভাগটা । ঘরের মধ্যে কি ঘটনা ঘটলো তা একটুও মনে নেই । মিনিট কতক পরে একখানা মাখন মাখানো পাঁউরুটি চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে আসতেই আড়ালে কেদারদাদার সামনে পড়লেম । ছেলে মাত্রকে কেদারদাদার অভ্যাস ছিল ‘শালা’ বলা । তিনি আমার কানটা মলে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন— ‘যাঃ, শালা, ব্যাপুটাইজ হয়ে গেলি ।’ রামলাল একবার কটমট করে আমার দিকে চেয়ে বললে— ‘বলেছিলুম না, খেও না কিছু ।’
কি যে অন্যায় হয়ে গেছে তা বুঝতে পারিনে ; কেউ স্পষ্ট করেও কিছু বলে না । দাসীদের কাছে গেলে বলে— ‘মাগো, খেলে কি করে ?’ ছোটো বোনেরা বলে বসে— ‘তুমি খেয়েছো, ছোঁবনা !’ বড়োপিশি মাকে ধমকে বলেন— ‘ওকে শিখিয়ে দিতে পারোনি, ছোটোবৌ !’
যে ভদ্রলোক চা খেতে এসেছিলেন তিনি তো গেলেন চলে খাতির-যত্ন পেয়ে । কেদারদাদাও গেলেন শিকদারপাড়ার গলিতে । কিন্তু ‘ব্যাপটাইজ’ কথাটা আমার আর কাছ-ছাড়া হয়না । রুটি খানা হজম হয়ে যাবার অনেক ঘন্টা পরে পর্যন্ত আমার মনে কেমন একটা বিভীষিকা জাগতে থাকলো । কারো কাছে এগোতে সাহস হয় না । চাকরদের কাছে তোষাখানায় যাই, সেখানে দেখি রটে গেছে ব্যাপটাইজ হবার ইতিহাস । দপ্তরখানায় পালাই, সেখান জোগেশদাদা মথুরাদাদাকে ডেকে বলে দেন— আমি ‘ব্যাপটাইজ’ হয়ে গোছি । এমনি একদিন দু’দিন কতদিন যায় মনে নেই— একলা একলা ফিরি, কোথাও আমল পাইনে, শেষে একদিন ছোটোপিশিমা আমায় দেখে বললেন— ‘তোর মুখটা শুকনো কেন রে?’
মনের দুঃখ তখন আর চাপা থাকলো না— ছোটোপিশিমা, আমি ‘ব্যাপটাইজ’ হয়ে গেছি !’ ছোটোপিশি জানতেন হয়তো ‘ব্যাপটাইজ’ হওয়ার কাহিনী এবং যদি বিনা দোষে কেউ ‘ব্যাপটাইজ’ হয় তো তার উদ্ধার হয়ে কিসে, তাও তাঁর জানা ছিলো । তিনি রামলালকে একটু আমার মাখায় গঙ্গাজল দিয়ে আনতে বললেন । চললো নিয়ে আমাকে রামলাল ঠাকুরঘরে । পাহারাওয়ালার সঙ্গে যেমন চোর, সেই ভাবে চললেম রামলালের পেছনে পেছনে । রান্না-বাড়ির পুব-গায়ে, সরু মেটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে হয় ঠাকুর-বাড়ি । এই সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠে, দেওয়ালের গায়ে চৌকো একটা দরজা ফস্ করে খুলে, রামলাল বললে— ‘এটা কি জানো? চোর-কুটুরি পেত্নী থাকে এখানে ।’
আর বলতে হলো না, সোজা আমি উঠে চললেম সিঁড়ি যেখানে নিয়ে যাক ভেবে । খানিক পরে রামলালের গলা পেলেম— ‘জুতো খুলে দাঁড়াও, পঞ্চগব্যি আনতে বালি ।’ ভয়ে তখন রক্ত জল হয়ে গেছে । ছোটোপিশি দিয়েছেন গঙ্গাজলের ; কেন যে রামলাল পঞ্চগব্যির কথা তুলছে, সে-প্রশ্ন করার মতো অবস্থার বাইরে গেছে তখন । মনও দেখেছি সেই পর্যন্ত লিখে বাকিটা রেখেছে অসমাপ্ত।