সিন্ধবাদ বিবরণ পদ্য
ছন্দবাদ সওদাগর বড় হুসিয়ার।
বোগদাদ শহরে ঘর জানিবা তাহার।
বাসরা বন্দরে হইল জাহাজে সওয়ার।
জাহাজ ক্রমেতে চলে কালাপানি পার।
ভাসিয়া জাহাজ যায় দরিয়া উপরে।
ছামনে জাজীরা এক পড়িল নজরে।
ছন্দবাদ আর কত জাহাজি মিলিয়া।
তামাসা দেখিতে যায় সব উতরিয়া।।
(তুড়ি)
এহারা সকলে যারে জাজীরা বুঝিল।
হকিমতে মাছ সেটা জরিয়ায় ছিল।
ভাসিতে আছিল মাছ সোঁতের উপরে।
এহারা জানিল দেলে জাজীরা তাহারে।।
মাছের পিঠেতে যদি পৌঁছিল সকলে।
খানা পাকাইতে আগ সেইখানে জ্বালে।
আসতের তাপ যদি লাগে মাছ পরে।
সেতাবি ডুবিয়া গেল দরিয়া ভিতরে।
যত লোগ ছিল সেই মাছের পিঠেতে।
বহুত মুশকিলে তারা পৌঁছিল ডাঙ্গাতে।
(জুড়ি)
ডাঙ্গার উপরে যদি পৌঁছিল সবাই।
তদারক করি আমি দেখিনু এয়ছাই।
ছন্দবাদ নামে ছিল যেই ছওদাগর।
না পৌঁছিল সেই জন ডাঙ্গার উপর।
দরিয়ার নীচে সে মরিল ডুবিয়া।
এই তো আওহাল তার শুন মন দিয়া।
(সিন্ধবাদ ও কাঠুরিয়াগণের প্রবেশ)
(সিন্ধবাদের কথা)
মেরা নাম ছন্দবাদ শুনহ কপ্তান।
আমি সেই জন বটি দেখ মেহেরবান।।
আপনি জানিলে যারে মরিল দরিয়ায়।
ভালো মতে আছি হৈ দেখহ আমায়।
(সিন্ধবাদের গজল গীত)
খার হাজরত কররে তক দেলসে খাটকতা যায়েগা
মোরগে বেচমেল কি তারে লাসা তড়প্তা যায়েগা
মর্ গিয়া হোঁ মেয় দুনিয়াকি হাদ্বরাত দিদার মে
করবে তর্ক মেরাজ কী রাহ তাকতা যায়ে।
পূর্বের দিকে বনের মধ্যে একটা আর্তনাদ শুনা যায়, কে জেন কোন বিপদে পৈরাছে বোধহয়। কাঠুরিয়াগণ তলাশ কৈরা দেখো ব্যাপারখানা কী ঘটিল।
(গীত)
কাঠুরিয়া। দেখো হে খালাসিগণ কৈরা খুব নিরীক্ষন
বীপদে পৈরাছে জানি হবে কোন মহাজন।
খালাসি। কীবা কোন ছওদাগর যেতেছিল ছপর
তুফানে পইরা ডিঙা হৈল তর এইক্ষণ।
কীবা কোন লাখপতি কীবা কোন শ্রীমতী
কীবা কর্ণধার ব্যক্তি কীবা চাকরান সেইজন।
সিন্ধ। জাহাজই কি একজন টেণ্ডেল খালাসি কোন
কী বা কোন কাপ্তান হবে কি মানুষ ছোখান্আ।
(পদ্য)
নজর করিয়া সবে দেখ তাকাইয়া
আছে কোন জন বনে একলা ঘাবড়াইয়া।।
আদমের হাঁক যেন শুনিনু এয়ছাই।
দেখো দেখো খালাসিরা দেখহ সবাই।।
(খালাসি কাঠুরিয়ার পদ্য)
(গীত)
১। ওরে ওরে দেখো রে কাঠুরিয়া ভাই
মাটিতে করিল চাঁদ দেখিবারে পাই।।
২। কী বলো হে চান্দ নয় তুমি কী বা বলো।
৩। মোর মনে লয় যেন সুরয উঠিল
৪। আরে আরে আরে ভাই তুমি চেন নাই,
আমি যেন কাঞ্চা সোনা দেখিবারে পাই।।
৫। সোনা নয় সোনা নয় মানিকের মুরতি
২। কভু বনে পয়েদা হয় মানিক আর মোতি।।
৩। শুন ভাই নির্জশ হয় বন মানুষ
৪। দূর দূর নাই তেরা কোন বুস বুস।।
(জবুথবু বাবুর প্রবেশ)
(সিন্ধবাদের গীত)
দেখো ভাই আজব জন্তু দুনিয়াতে এসেছে,
তার পশুর মতো সকল দেখি কিন্তু লেজটি নাহি আছে।
সে সকাল বেলা খেলা করে চারি পায় চলে ফেরে,
দুপুর বেলা দুই পদে হাঁটিতেছে,
সন্ধ্যাবেলা তিনটি পদে চলে খেলা ভাঙিতেছে।
দিবা নিশি ঘরে ঘরে কত জন্তু যাচ্ছে মরে,
এই জন্তু দেখেও তা না দেখিতেছে,
যে মোলো সে মোলো আমি মরিব না ভাবিতেছে।
(বাবুর জবাব গীত)
বিধি যারে ভালোবাসে তার কাছে কোন জনে
কোন উপলক্ষ দিয়ে সুখে রাখে ধনে মানে।
যত জীব জন্তুগণে ঘুরে ফিরে বনে বনে,
রক্ষা করে নিরঞ্জনে সংকটে ও পতনে।
(কাঠুরিয়া)
এতদিন কাঠ কাটি এই তো বনেতে।
কখনো এমন ধারা না দেখি চক্ষেতে।।
বুঝিনু মানব এই কখন না হবে।
পালাই চলো তা নইলে মুশকিল বাঁধাবে।
সিন্ধ। মুশকিল আসান , মুশকিল আসান।
বাবু। দোহাই ছাহেব, আমি মুশকিল আসান নয়, নিজেই বিয়ে করতে এসে মুশকিলে পড়ে গেছি। ও কাঠুরিয়াগণ, আমায় ছেড়ে যেও না, ও ছাহেব, আমি তমার শরণ নিলাম, আর ছাড়ি দিব না।
(বাবুতে সিন্ধবাদে ঝটাপটি)
সিন্ধ। দুষ্ট বুড়া কান্ধে চাপতি চাও পুনর্বার, মনে নাই পেরেসান কৈরাছিলে পঞ্চম ছপরে। ঘোড়া চাপিয়া বেড়াইলে আমার স্কন্ধে চড়ে! খালাসিগণ, ইহাকে বন্ধন করো শক্ত কৈরা। না বুঝে দুষ্টেরে লইয়া কান্ধে পৈরাছিলাম বিষম ফান্দে, এবারে রাহু ধরেছে চান্দে, এখন বিপদে পৈরে কান্দে!
(বাবুর গীত)
আমার যন্ত্রণা প্রাণে নাহি সয়,
বিপদে পড়েছি এবে রক্ষা করো দয়াময়।
বিপদ সাগরে ডুবিল ত্রী, উদ্ধার করো হে কান্ডারী।
স্বদেশে বিদেশে তুমি উপকারী, তোমা বিনে আর নাহিক উপায়।
(সিন্ধবাদের কথা)
শুন সবে একভাবে যতেক এয়ার।
পঞ্চমের ছপরের যে হাল আমার।।
জ্যায়ছা মছিবত হৈল আমার উপরে।
বর্ণন করিয়া তাহা ক্যেছি সবারে।।
বুড়ার খাতিরে আমি ঠাহরি কম জোর।
ছওয়ার করিয়াছিনু গর্দান উপর।।
যখন এশারা করি নামিতে এহায়।
দুই পায়ে নেপটিয়া ধরিল গলায়।।
এয়ছা গলা দেবে ধরে পাও লাগাইয়া।
আমি বলি দম বুঝি গেল নেকালিয়া।।
চাম বরাবর পাঁও আছিল এহার।
তছমার মাফিক ডালে গলেতে আমার।।
জোর করি বুড়া পাঁও লাগায়ে গর্দানে।
বেহোঁস করিয়া মোরে গেরায় জমিনে।।
হয়রান হইয়াছিনু কাবুতে পড়িয়া।
ঘোড়ার মাফিক ফিরি ছওয়ার লইয়া।।
এইরূপ বহুদিন গর্দানে আমার।
ছওয়ার হইয়া রহে বুড়া দুরাচার।।
কোদরত কামাল বাঁচাইল কোনো মতে।
নহে তো মরিয়াছিনু এ বুড়ার হাতে।।
বাবু। সে কোথাকার একটা গাল-গল্পের চিম্সে বুড়োর সঙ্গে আমার তুলনা দিচ্ছ ছাহেব! সে ছিল রোগা আমি দেখো মোটা বুড়োই নি, চুল কালো, দাঁত পড়েনি একটি, কমে নাও বয়েস।
খালাসি। খেজাব লাগিয়েছে, দাঁত বাঁধিয়েছে কর্তা।
সিন্ধ। একা কেন বনমধ্যে কহো দেখি শুনি।
এখানে আইলে কেন নাহি জনপ্রাণী।।
বাবু। যেতেছিলাম হস্তিরাজার কন্যাদানে।
বনবাস হল সেই কারণে।।
ও হিন্দবাদ তোমার নাম কী, আমায় রক্ষা ক্রো।
সিন্ধ। আমার নাম হিন্দবাদ নয়— ছন্দবাজ জাহাজি, বোগদাদ হলো ডেরা আমার। আমার জাহাজগুলো সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর লোনা আর মিঠা জলে চলাচল কৈরা কিঞ্চিৎ জখম হয়েছে, সেই কারণে কিছু মন-পবন কাষ্ঠের পিয়োজনে এ দেশে আগমন। হঠাৎ বনের মধ্যে মশয়ের সাতে সাক্ষাৎ।
(পদ্য)
মালামৎ না করিব তোমার খাতেরে।
রহম হইল মুঝে দেখিয়া তোমারে।।
বোঝা মেরা ধরা আছে জাহাজ উপরে।
চলহ খালাসিগণ লইয়া এহারে।।
তোমার বোঝায় কেহ না ডালিবে হাত।
সেতাবি করিয়া তুমি চলো মেরা সাথ।।
বাবু। খেতে কিছু দাও না ভাই, নড়িবার শক্তি নাই
তিনদিন হইল আজ ঘুরিয়া বেড়াই,
ক্ষুধা হইলে বনফুল তুলিয়া যে খাই।।
সিন্ধ। খাদেমের সাতে দেখ জাহাজে উঠিয়ে,
রঙ্গ রঙ্গ খানা কত রেখেছে চুনিয়া।।
নজর পড়িয়া তুমি দেখিবে সেথায়,
দস্তখান ধরা আছে চারি কেনারায়।।
ভাতে ভাতে খানা সে আপনি উঠাইয়া
আহুদা করিয়া তোমায় দেব খিলাইয়া।।
খানা বাদে ছের উঠাইয়া আপনার,
মজলিছের লোক কই তব সমাচার।।
বাবু। কালাপানি পার হলে, খানা খেলেম জাতও দিলেম, তারপর?
সিন্ধ। সেখানে পৌঁছি জাহাজ কেরায়া করিয়া,
ছওয়ার হইবে চলো খোদায় ভাবিয়া।।
রওনা করিয়া জাহাজ তুলিয়া লঙ্গর,
পারছের দরিয়া মোরা যাব তারপর।।
ডাহিনে আরব রহে পারছ বামেতে
হিন্দুস্থানের সিধা রাহা ফিরিব ডানেতে।।
বাবু। এ যে মাথা ঘুরিয়া নাক দেখাতে বলা!
সিন্ধ। জাহাজ বাহিয়া যাব দরিয়ার উপরে,
এয়ছা যে দরিয়া আর না দেখি নজরে।।
সত্তর মাইল সেই দরিয়ার খাই,
আড়াই হাজার মাইল তাহার চৌড়াই।।
এক দিকে নোনা পানি বহে যে দরিয়ার,
তাহার ছবরে আমি হইনু বিমার।।
পানির ছবরে দুঃখু পাই কিছু দিন,
তার পরে ভালো কৈল এলাহি আল্মিন।।
— মশায়ের নাম জানতে পারি?
বাবু। মুই রাজা বাবুরাম, বৈঠকখানায় পাই মান।
সভাতে বসিলেই হতমান।
খালাসি। মশায়ের রাজত্তি?
বাবু। গোবিন্দপুর সুতানুটির মধ্যস্থান খাটিয়াটি বসে থাকি হাতে জাঁতি
সুন্দরবনের সুপারি কাটি,
থেকে থেকে মারি তবলায় চাঁটি
অধিক করিনে হাঁটাহাঁটি!
সিন্ধ। কী কইলেন সুন্দরবন,
আমাগর কাষ্ঠের নিমিত্তে সেহানে যাওয়াই পিয়োজন
কাঠুরিয়া। রাজামশায় আমাগর সাথে আইসেন
সুপারি গাছে চড়ায়ে দিব যত চান সুপারি কাটেন!
বাবু। শুনেছি সে বাঘের জঙ্গল,
গেলেই ঘটে অমঙ্গল!
সিন্ধ। কী কইলেন যাইবেন না? খালাসিগণ, বাবুকে বন্ধন কৈরা টানি লৈয়া চল, বাদশাহি মাল জাহাজে উঠাইয়া লও, এই মাল হারুন বাদশাহের নিকট পৌঁছাও যত্নে। বহুত এনাম বকশিশ খেতাব খিল্লত পাইবা। মাল কোনরূপ নকছান না হয়, দানাপানি নিয়মিত খিলাইয়া পিলাইয়া তাজা অবস্হায় দরবারে হাজির করিবা, এ প্রকার মাল জলদি পাওয়া দুষ্কর। সেবার বড়ো পেরেসান কৈরাছিলে মোরে, ঘোড়া নাচাইয়া ফিরায়েছিলে স্কন্দে চড়ে।
বাবু। আঃ ছাড়্ ছাড়্ ছাড়্! জাতিকুল যায় যাক, পরনডা যায় যে হায়!
(পতন ও মূর্ছা)
খালাসিদের কথা।
১। মালের ছিন্দুক যে কাত হল কর্তা!
২। জমি লিয়েছে উঠতি চায় না।
৩। মারো টান হেঁইয়ো জোয়ান, নাখোদা কাপ্তান মালুম ছোকান।
৪। ওঠাও আঁকরি লঙ্গর উঠাও বাদাম হৈরে জোয়ান মাস্তুল কামান।
৫। উঠতি চায় না মাস্তুল কামান কর্তা। ভারি বোঝা।
সিন্ধ। গরান কাষ্ঠমতো গরায় লয়ে চল, জলে নিয়া ফেল, জাহাজের সাথে কাছি দিয়া বাঁধ কৈসে, ভাসাইয়া চল জালিডিঙ্গার প্রায়, নোনাপানি কালাপানি খাইতে খাইতে চলুক জালিবোট।
বাবু। আর টানাহেঁচড়া কেন, ভালো-মানুষের মত জেতেছি, বন-মনুষ্যের মতো কোমরে দড়ি দাও কেন।
(বাবুর গীত)
হাহা বিষম সাগরে পড়ে হইল মরন,
কুম্বীরের পেটে হৈল হৈতে হজম
এ হালে গেনু মারা, ভন জন কথা রৈল তারা,
এই হৈতে হৈল সারা কপালের লিখন।
কার দুঃখ কেবা দেখে, কে আসিয়া পোছে মোকে
কুম্বীরের পেটে কাকে করি জিজ্ঞাসন।
সিন্ধ। তুমি অতি মূর্খ, ধিয়ান গোয়ান কিছু নাই, লইলা চল জলদি কৈরা, জাহাজ ধোরো গিয়া আধীক বাক্যবায় করহ বৃথা! আইসহ, তোমার পক্ষে ডাঙ্গায় থাকা যুক্তিযুক্ত নয়।
(বাবুর গীত)
আজ হতে তোমার হাতে আমি সঁপিলাম আমায়,
অহে দেখো যেন দীন দুঃখী প্রানে রক্ষা পায়।
আমার নিশিদিন বিষাদে হে সমভাবে যায়,
তুমি দেখিতেছ সে অবধি আছি যে দশায়।
(সকলের প্রস্থান)
ছন্দবাদ সওদাগর বড় হুসিয়ার।
বোগদাদ শহরে ঘর জানিবা তাহার।
বাসরা বন্দরে হইল জাহাজে সওয়ার।
জাহাজ ক্রমেতে চলে কালাপানি পার।
ভাসিয়া জাহাজ যায় দরিয়া উপরে।
ছামনে জাজীরা এক পড়িল নজরে।
ছন্দবাদ আর কত জাহাজি মিলিয়া।
তামাসা দেখিতে যায় সব উতরিয়া।।
(তুড়ি)
এহারা সকলে যারে জাজীরা বুঝিল।
হকিমতে মাছ সেটা জরিয়ায় ছিল।
ভাসিতে আছিল মাছ সোঁতের উপরে।
এহারা জানিল দেলে জাজীরা তাহারে।।
মাছের পিঠেতে যদি পৌঁছিল সকলে।
খানা পাকাইতে আগ সেইখানে জ্বালে।
আসতের তাপ যদি লাগে মাছ পরে।
সেতাবি ডুবিয়া গেল দরিয়া ভিতরে।
যত লোগ ছিল সেই মাছের পিঠেতে।
বহুত মুশকিলে তারা পৌঁছিল ডাঙ্গাতে।
(জুড়ি)
ডাঙ্গার উপরে যদি পৌঁছিল সবাই।
তদারক করি আমি দেখিনু এয়ছাই।
ছন্দবাদ নামে ছিল যেই ছওদাগর।
না পৌঁছিল সেই জন ডাঙ্গার উপর।
দরিয়ার নীচে সে মরিল ডুবিয়া।
এই তো আওহাল তার শুন মন দিয়া।
(সিন্ধবাদ ও কাঠুরিয়াগণের প্রবেশ)
(সিন্ধবাদের কথা)
মেরা নাম ছন্দবাদ শুনহ কপ্তান।
আমি সেই জন বটি দেখ মেহেরবান।।
আপনি জানিলে যারে মরিল দরিয়ায়।
ভালো মতে আছি হৈ দেখহ আমায়।
(সিন্ধবাদের গজল গীত)
খার হাজরত কররে তক দেলসে খাটকতা যায়েগা
মোরগে বেচমেল কি তারে লাসা তড়প্তা যায়েগা
মর্ গিয়া হোঁ মেয় দুনিয়াকি হাদ্বরাত দিদার মে
করবে তর্ক মেরাজ কী রাহ তাকতা যায়ে।
পূর্বের দিকে বনের মধ্যে একটা আর্তনাদ শুনা যায়, কে জেন কোন বিপদে পৈরাছে বোধহয়। কাঠুরিয়াগণ তলাশ কৈরা দেখো ব্যাপারখানা কী ঘটিল।
(গীত)
কাঠুরিয়া। দেখো হে খালাসিগণ কৈরা খুব নিরীক্ষন
বীপদে পৈরাছে জানি হবে কোন মহাজন।
খালাসি। কীবা কোন ছওদাগর যেতেছিল ছপর
তুফানে পইরা ডিঙা হৈল তর এইক্ষণ।
কীবা কোন লাখপতি কীবা কোন শ্রীমতী
কীবা কর্ণধার ব্যক্তি কীবা চাকরান সেইজন।
সিন্ধ। জাহাজই কি একজন টেণ্ডেল খালাসি কোন
কী বা কোন কাপ্তান হবে কি মানুষ ছোখান্আ।
(পদ্য)
নজর করিয়া সবে দেখ তাকাইয়া
আছে কোন জন বনে একলা ঘাবড়াইয়া।।
আদমের হাঁক যেন শুনিনু এয়ছাই।
দেখো দেখো খালাসিরা দেখহ সবাই।।
(খালাসি কাঠুরিয়ার পদ্য)
(গীত)
১। ওরে ওরে দেখো রে কাঠুরিয়া ভাই
মাটিতে করিল চাঁদ দেখিবারে পাই।।
২। কী বলো হে চান্দ নয় তুমি কী বা বলো।
৩। মোর মনে লয় যেন সুরয উঠিল
৪। আরে আরে আরে ভাই তুমি চেন নাই,
আমি যেন কাঞ্চা সোনা দেখিবারে পাই।।
৫। সোনা নয় সোনা নয় মানিকের মুরতি
২। কভু বনে পয়েদা হয় মানিক আর মোতি।।
৩। শুন ভাই নির্জশ হয় বন মানুষ
৪। দূর দূর নাই তেরা কোন বুস বুস।।
(জবুথবু বাবুর প্রবেশ)
(সিন্ধবাদের গীত)
দেখো ভাই আজব জন্তু দুনিয়াতে এসেছে,
তার পশুর মতো সকল দেখি কিন্তু লেজটি নাহি আছে।
সে সকাল বেলা খেলা করে চারি পায় চলে ফেরে,
দুপুর বেলা দুই পদে হাঁটিতেছে,
সন্ধ্যাবেলা তিনটি পদে চলে খেলা ভাঙিতেছে।
দিবা নিশি ঘরে ঘরে কত জন্তু যাচ্ছে মরে,
এই জন্তু দেখেও তা না দেখিতেছে,
যে মোলো সে মোলো আমি মরিব না ভাবিতেছে।
(বাবুর জবাব গীত)
বিধি যারে ভালোবাসে তার কাছে কোন জনে
কোন উপলক্ষ দিয়ে সুখে রাখে ধনে মানে।
যত জীব জন্তুগণে ঘুরে ফিরে বনে বনে,
রক্ষা করে নিরঞ্জনে সংকটে ও পতনে।
(কাঠুরিয়া)
এতদিন কাঠ কাটি এই তো বনেতে।
কখনো এমন ধারা না দেখি চক্ষেতে।।
বুঝিনু মানব এই কখন না হবে।
পালাই চলো তা নইলে মুশকিল বাঁধাবে।
সিন্ধ। মুশকিল আসান , মুশকিল আসান।
বাবু। দোহাই ছাহেব, আমি মুশকিল আসান নয়, নিজেই বিয়ে করতে এসে মুশকিলে পড়ে গেছি। ও কাঠুরিয়াগণ, আমায় ছেড়ে যেও না, ও ছাহেব, আমি তমার শরণ নিলাম, আর ছাড়ি দিব না।
(বাবুতে সিন্ধবাদে ঝটাপটি)
সিন্ধ। দুষ্ট বুড়া কান্ধে চাপতি চাও পুনর্বার, মনে নাই পেরেসান কৈরাছিলে পঞ্চম ছপরে। ঘোড়া চাপিয়া বেড়াইলে আমার স্কন্ধে চড়ে! খালাসিগণ, ইহাকে বন্ধন করো শক্ত কৈরা। না বুঝে দুষ্টেরে লইয়া কান্ধে পৈরাছিলাম বিষম ফান্দে, এবারে রাহু ধরেছে চান্দে, এখন বিপদে পৈরে কান্দে!
(বাবুর গীত)
আমার যন্ত্রণা প্রাণে নাহি সয়,
বিপদে পড়েছি এবে রক্ষা করো দয়াময়।
বিপদ সাগরে ডুবিল ত্রী, উদ্ধার করো হে কান্ডারী।
স্বদেশে বিদেশে তুমি উপকারী, তোমা বিনে আর নাহিক উপায়।
(সিন্ধবাদের কথা)
শুন সবে একভাবে যতেক এয়ার।
পঞ্চমের ছপরের যে হাল আমার।।
জ্যায়ছা মছিবত হৈল আমার উপরে।
বর্ণন করিয়া তাহা ক্যেছি সবারে।।
বুড়ার খাতিরে আমি ঠাহরি কম জোর।
ছওয়ার করিয়াছিনু গর্দান উপর।।
যখন এশারা করি নামিতে এহায়।
দুই পায়ে নেপটিয়া ধরিল গলায়।।
এয়ছা গলা দেবে ধরে পাও লাগাইয়া।
আমি বলি দম বুঝি গেল নেকালিয়া।।
চাম বরাবর পাঁও আছিল এহার।
তছমার মাফিক ডালে গলেতে আমার।।
জোর করি বুড়া পাঁও লাগায়ে গর্দানে।
বেহোঁস করিয়া মোরে গেরায় জমিনে।।
হয়রান হইয়াছিনু কাবুতে পড়িয়া।
ঘোড়ার মাফিক ফিরি ছওয়ার লইয়া।।
এইরূপ বহুদিন গর্দানে আমার।
ছওয়ার হইয়া রহে বুড়া দুরাচার।।
কোদরত কামাল বাঁচাইল কোনো মতে।
নহে তো মরিয়াছিনু এ বুড়ার হাতে।।
বাবু। সে কোথাকার একটা গাল-গল্পের চিম্সে বুড়োর সঙ্গে আমার তুলনা দিচ্ছ ছাহেব! সে ছিল রোগা আমি দেখো মোটা বুড়োই নি, চুল কালো, দাঁত পড়েনি একটি, কমে নাও বয়েস।
খালাসি। খেজাব লাগিয়েছে, দাঁত বাঁধিয়েছে কর্তা।
সিন্ধ। একা কেন বনমধ্যে কহো দেখি শুনি।
এখানে আইলে কেন নাহি জনপ্রাণী।।
বাবু। যেতেছিলাম হস্তিরাজার কন্যাদানে।
বনবাস হল সেই কারণে।।
ও হিন্দবাদ তোমার নাম কী, আমায় রক্ষা ক্রো।
সিন্ধ। আমার নাম হিন্দবাদ নয়— ছন্দবাজ জাহাজি, বোগদাদ হলো ডেরা আমার। আমার জাহাজগুলো সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর লোনা আর মিঠা জলে চলাচল কৈরা কিঞ্চিৎ জখম হয়েছে, সেই কারণে কিছু মন-পবন কাষ্ঠের পিয়োজনে এ দেশে আগমন। হঠাৎ বনের মধ্যে মশয়ের সাতে সাক্ষাৎ।
(পদ্য)
মালামৎ না করিব তোমার খাতেরে।
রহম হইল মুঝে দেখিয়া তোমারে।।
বোঝা মেরা ধরা আছে জাহাজ উপরে।
চলহ খালাসিগণ লইয়া এহারে।।
তোমার বোঝায় কেহ না ডালিবে হাত।
সেতাবি করিয়া তুমি চলো মেরা সাথ।।
বাবু। খেতে কিছু দাও না ভাই, নড়িবার শক্তি নাই
তিনদিন হইল আজ ঘুরিয়া বেড়াই,
ক্ষুধা হইলে বনফুল তুলিয়া যে খাই।।
সিন্ধ। খাদেমের সাতে দেখ জাহাজে উঠিয়ে,
রঙ্গ রঙ্গ খানা কত রেখেছে চুনিয়া।।
নজর পড়িয়া তুমি দেখিবে সেথায়,
দস্তখান ধরা আছে চারি কেনারায়।।
ভাতে ভাতে খানা সে আপনি উঠাইয়া
আহুদা করিয়া তোমায় দেব খিলাইয়া।।
খানা বাদে ছের উঠাইয়া আপনার,
মজলিছের লোক কই তব সমাচার।।
বাবু। কালাপানি পার হলে, খানা খেলেম জাতও দিলেম, তারপর?
সিন্ধ। সেখানে পৌঁছি জাহাজ কেরায়া করিয়া,
ছওয়ার হইবে চলো খোদায় ভাবিয়া।।
রওনা করিয়া জাহাজ তুলিয়া লঙ্গর,
পারছের দরিয়া মোরা যাব তারপর।।
ডাহিনে আরব রহে পারছ বামেতে
হিন্দুস্থানের সিধা রাহা ফিরিব ডানেতে।।
বাবু। এ যে মাথা ঘুরিয়া নাক দেখাতে বলা!
সিন্ধ। জাহাজ বাহিয়া যাব দরিয়ার উপরে,
এয়ছা যে দরিয়া আর না দেখি নজরে।।
সত্তর মাইল সেই দরিয়ার খাই,
আড়াই হাজার মাইল তাহার চৌড়াই।।
এক দিকে নোনা পানি বহে যে দরিয়ার,
তাহার ছবরে আমি হইনু বিমার।।
পানির ছবরে দুঃখু পাই কিছু দিন,
তার পরে ভালো কৈল এলাহি আল্মিন।।
— মশায়ের নাম জানতে পারি?
বাবু। মুই রাজা বাবুরাম, বৈঠকখানায় পাই মান।
সভাতে বসিলেই হতমান।
খালাসি। মশায়ের রাজত্তি?
বাবু। গোবিন্দপুর সুতানুটির মধ্যস্থান খাটিয়াটি বসে থাকি হাতে জাঁতি
সুন্দরবনের সুপারি কাটি,
থেকে থেকে মারি তবলায় চাঁটি
অধিক করিনে হাঁটাহাঁটি!
সিন্ধ। কী কইলেন সুন্দরবন,
আমাগর কাষ্ঠের নিমিত্তে সেহানে যাওয়াই পিয়োজন
কাঠুরিয়া। রাজামশায় আমাগর সাথে আইসেন
সুপারি গাছে চড়ায়ে দিব যত চান সুপারি কাটেন!
বাবু। শুনেছি সে বাঘের জঙ্গল,
গেলেই ঘটে অমঙ্গল!
সিন্ধ। কী কইলেন যাইবেন না? খালাসিগণ, বাবুকে বন্ধন কৈরা টানি লৈয়া চল, বাদশাহি মাল জাহাজে উঠাইয়া লও, এই মাল হারুন বাদশাহের নিকট পৌঁছাও যত্নে। বহুত এনাম বকশিশ খেতাব খিল্লত পাইবা। মাল কোনরূপ নকছান না হয়, দানাপানি নিয়মিত খিলাইয়া পিলাইয়া তাজা অবস্হায় দরবারে হাজির করিবা, এ প্রকার মাল জলদি পাওয়া দুষ্কর। সেবার বড়ো পেরেসান কৈরাছিলে মোরে, ঘোড়া নাচাইয়া ফিরায়েছিলে স্কন্দে চড়ে।
বাবু। আঃ ছাড়্ ছাড়্ ছাড়্! জাতিকুল যায় যাক, পরনডা যায় যে হায়!
(পতন ও মূর্ছা)
খালাসিদের কথা।
১। মালের ছিন্দুক যে কাত হল কর্তা!
২। জমি লিয়েছে উঠতি চায় না।
৩। মারো টান হেঁইয়ো জোয়ান, নাখোদা কাপ্তান মালুম ছোকান।
৪। ওঠাও আঁকরি লঙ্গর উঠাও বাদাম হৈরে জোয়ান মাস্তুল কামান।
৫। উঠতি চায় না মাস্তুল কামান কর্তা। ভারি বোঝা।
সিন্ধ। গরান কাষ্ঠমতো গরায় লয়ে চল, জলে নিয়া ফেল, জাহাজের সাথে কাছি দিয়া বাঁধ কৈসে, ভাসাইয়া চল জালিডিঙ্গার প্রায়, নোনাপানি কালাপানি খাইতে খাইতে চলুক জালিবোট।
বাবু। আর টানাহেঁচড়া কেন, ভালো-মানুষের মত জেতেছি, বন-মনুষ্যের মতো কোমরে দড়ি দাও কেন।
(বাবুর গীত)
হাহা বিষম সাগরে পড়ে হইল মরন,
কুম্বীরের পেটে হৈল হৈতে হজম
এ হালে গেনু মারা, ভন জন কথা রৈল তারা,
এই হৈতে হৈল সারা কপালের লিখন।
কার দুঃখ কেবা দেখে, কে আসিয়া পোছে মোকে
কুম্বীরের পেটে কাকে করি জিজ্ঞাসন।
সিন্ধ। তুমি অতি মূর্খ, ধিয়ান গোয়ান কিছু নাই, লইলা চল জলদি কৈরা, জাহাজ ধোরো গিয়া আধীক বাক্যবায় করহ বৃথা! আইসহ, তোমার পক্ষে ডাঙ্গায় থাকা যুক্তিযুক্ত নয়।
(বাবুর গীত)
আজ হতে তোমার হাতে আমি সঁপিলাম আমায়,
অহে দেখো যেন দীন দুঃখী প্রানে রক্ষা পায়।
আমার নিশিদিন বিষাদে হে সমভাবে যায়,
তুমি দেখিতেছ সে অবধি আছি যে দশায়।
(সকলের প্রস্থান)