আসামী বুরুঞ্জি
উত্তর থেকে বড় নদী যেখানে ব্রহ্মপুত্রের জলে এসে মিলেছে ঠিক সেই বাঁকের মুখেই কতকালের পুরোনো ডিমরুয়ার আসামী রাজা আড়িমাওয়ের বাড়ি। নাটবাড়ির নিচেই নদী মজে গিয়ে মস্ত চর পড়েছে। এত কাল থেকে হাড়গিলে পাখিরা এই চর দখল করে আছে যে, ক্রমে চরটার নামই হয়ে গেছে হাড়গিলার চর। এই চরের ওপারেই দেওয়ানগিরি মস্ত একটা বুড়ো আঙুলের মতো আকাশের দিকে ঠেলে উঠেচে। এই দেওয়ান-গিরি হল যত ফরিয়াদি পাখির আড্ডা। একপারে রইল আসামী মাছেদের রাজা আড়িমাওয়ের নাটবাড়ি আর এক পারে দেওয়ানী ফরিয়াদীর আড্ডা দেওয়ানগিরি, মাঝখানে বসে রয়েছেন হাড়গিলে। আসামী ফরিয়াদিতে লড়াই মোকদ্দামা প্রায়ই হয়, তাতে দুই দলই মাঝে-মাঝে মারা পড়ে।
হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং রাজা দুই দলের মধ্যে আরামে বসে দুই দলেরই হাড়-মাস খেয়ে সুখে আছেন, এমন সময় চর মুখে খবর পৌঁছল বুড়ো-আংলা আসছেন। হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং লম্বা-লম্বা পা ফেলে জলের ধারে তাঁর কাশবাগিচায় বেরিয়ে বেড়াচ্ছেন! ‘চুপিম-পা’ আর ‘চোরম-পা’ দুই সেনাপতি পায়ে-পায়ে হাড়গিলের রাজার কাছে হুকুম নিতে এল – রিদয় হংপালকে এ-পথে আসতে দেওয়া হবে কিনা! খাম্বাজং হাড়গিলে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে ঠোঁট উঁচিয়ে ভেবে বললেন – “আসতে দিতে পার।” হঠাৎ দেশের মধ্যে মানুষ আসতে দিতে হাড়গিলে-চরের প্রজারা রাজি ছিল না। দুই সেনাপতি একটু ইতস্তত করছে দেখে খাম্বাজং সভাপণ্ডিত চুহুংমুংকে ডেকে বললেন – “দেখ তো বুরুঞ্জি পুঁথিতে কলির কত হাজার বছরে এখানে মানুষের আগমন লিখেছে?”
চুহুংমুং মুখ গম্ভীর করে বুরুঞ্জির পাতা উল্টে-পাল্টে মাটিতে খানিক আঁক-জোঁক কেটে বললেন – “আগামী ভূতচতুর্দশীতে এখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের শাপভ্রষ্ট একজন উপস্থিত হবেন, বারো বৎসর এগারো দিন এক-দণ্ড তিনপল ঊনপঞ্চাশ বিপল বয়সে, বুরুঞ্জিতে লেখে – সুন্দরবনস্থ আমতলি গ্রামের কাশ্যপ গোত্রের অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ এই মহাপুরুষ তার আগমনে দেশের সুখসৌভাগ্য সঙ্গে-সঙ্গে মূষিক ও মশক বৃদ্ধি, হেঁড়েল বংশ ধ্বংস ও চুয়াদিগের নাটবাড়ি আক্রমণ এবং হাড়গিলা প্রভৃতির প্রচুর ভোগ-ঐশ্বর্য এবং সর্ব-সিদ্ধি যোগ। গণেশ চতুর্থীতে এই কলির বামন অবতার হংসরথে গৃহত্যাগ করবেন এবং ভূতচতুর্দশীতে ঊনপঞ্চাশ পবনে ভর দিয়ে কল্পাব্দ ঊনশত ঊনপঞ্চাশের সূর্যাস্তের দিক হতে উদয় হয়ে ক্রমে সূর্যোদয়ের দিকে অভ্যুত্থান করবেন। শ্যামবর্ণ সুন্দর বপুঃ বুড়োরষ্ট বৃষস্কন্ধ শালপ্রাংশু মহাভুজ” বলে চুহুংমুং বুরুঞ্জি বন্ধ করলেন।
সেই থেকে হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং ভাঙাচোরা পুরোনো নাটবাড়ির চুড়োয় গিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমমুখো হয়ে ঘাড় তুলে রইলেন – হংপাল কখন আসেন দেখতে, ওদিকে কাকচিরাতে কাকেদের রাজা যোম কাকের কাছে চাঁদপুরী শেয়াল খবর দিয়ে গেল – টিকটিকির মতো এক মানুষ এসে ভেড়াদের বিদ্রোহী করে তুলে হেঁড়েল বংশ ধ্বংস করলে, এবারে কাকেদের আর এঁটো-কাঁটা হাড়গোড় কিছু পাবার উপায় থাকবে না। মাংসখোর সব মারা গেল্ম কেইবা আর ভেড়া মারবে, ছাগল ধরবে। কাকচিরাতে কাকের ঘোট বসে গেল, কি করলে মানুষটাকে সরানো যায় দেশ থেকে, আর ভেড়া গরু ছাগল এদের আরো বেশি করে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় – যাতে কোনো দিন তারা ফেরুপাল বা সনাতন স্বধর্মের ভুঁড়ো-শেয়ালদের বিরুদ্ধে শিং চালাতে না পারে।
নদী মাঠ আর জঙ্গল এই তেমাথার মধ্যে রয়েছে কাকচিরার না-জঙ্গল, না-মাঠ, না-বালুচর – দূরে থেকে দেখলে বোধ হবে জমিটাতে ঘাসও যেমন গাছও তেমন, পাহাড়ও রয়েছে, নদীও বইছে কিন্তু কাছে গিয়ে দেখ কেবল চোরকাঁটা, শেওড়া আর বড়-বড় নোড়ানুড়ি, কাঁকর, বালি। আর তার মধ্যে এখানে-ওখানে কাদাজল নালা-নর্দমা!
কোনকালে ফেনচুগঞ্জের এক নীলকর সাহেব এখানে এক মস্ত কুঠি বানিয়েছিল। সেই বাংলা-ঘরখানা এখনো রয়েছে, কিন্তু মানুষ কেউ নেই। কুঠিবাড়ির বাগানে চোরকাঁটার সঙ্গে গোটাকতক দোপাটি ফুলের গাছ, ঘরের সমস্ত সার্সি দরজা বন্ধ, জিনিসপত্র যেখানকার সেখানে গোছানো অথচ কেউ নেই এখানে। দরজায় চাবি দিয়ে বাড়িওয়ালা যেন দু-দিনের মধ্যে আসবে বলে গেল, সেখানে সার্সিটা ভাঙা ছিল সেখানে কাগজ মেরে ঘরগুলি গুছিয়ে রেখে চোরের ভয়ে তালাবন্ধ করে সব ঠিকঠাক রেখে গেল, কিন্তু কোনো দিন এসে আর চাবি খুলে কেউ ঘরে ঢুকল না। বর্ষা এসে সার্সির ফাঁকে আঁটা পুরোনো খবরের কাগজটা গলিয়ে দিলে, কাক-চিরার একটা কাক কোন সময়ে একদিন ঠোঁটে সেই কাগজখানা ঠেলে ফেলে ঘরের ভিতরে যাবার আসবার একটা পথ করে রেখে দিলে। তারপর একদিন বোশেখ মাসে ডিম পারবার সময় দলে-দলে কাক এসে কাকচিরায় চিরকাল যেমন বাসা বেঁধে আসছে তেমনি ঘরকন্না পেতে জায়গাটা দখল করে বসল। সকাল না হতে দূর-দূর গ্রামে তারা চরতে যায়, এঁটো-কাঁটার সন্ধানে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই দলে-দলে এই আপন রাজত্বে তারা ফিরে আসে, রাঙা আকাশ কালো করে।
আমাদের মধ্যে যেমন ডোম চাঁড়াল তেলি মালি যুগি কায়েত বামুন এমনি নানা জাত, কিন্তু দেখতে চেহারায় মানুষ, তেমনি কাকেদের মধ্যেও দেখতে কাক কিন্তু জাত হরেক রকমের রয়েছে – যেমন ডোমকাক বা যোমকাক, ধাড়িকাক বা দাঁড়াকাক বা দাঁড়কাক, ধোড়াকাক, ঝোড়োকাক, ঢোঁড়াকাক, পাণিকাক বা পাতিকাক, শ্বেতকাক বা ছিটেকাক, ভুষোকাক বা ভূষুন্ডেকাক! সব কাকেরই চালচলন এক ভাবা ভুল, এদের মধ্যে কোনো দল তারা ভদ্দর সভ্য-ভব্য কাক, ছোলাকলা চিংড়িমাছটা আঁসটা আর বামুনের মতো মরা জানোয়ারের শ্রাদ্ধের ফল খেয়ে দিন কাটায়, আর একদল কাক তারা যা তা খায় বাচবিচার নেই, পাখির ছানা খরগোসের ছানা খেয়েই এরা সুখ পায়। কোনো দলের পেশাই হল লুটতরাজ চুরিচামারি খুনখারাবি। এদের জ্বালায় পাখির বাসায় ডিম রাখবার যো নেই, বাইরের কিছু চকচকে জিনিস রাখবার উপায় নেই! আমসত্ত্ব শুকোতে দিলে এরা খেয়ে যায়, কাপড় শুকোতে দিলেও টেনে ছেঁড়ে, ছেলের হাতের মোয়া কেড়ে খায়, বুড়োর পাকা মাথায় ঠোকর বসায়, চালের খড় টেনে ফেলে, ভাতের থালায় ছোঁ দেয়, এমনি নানা উৎপাত করে বেড়ানোই এদের কাজ।
কাকেদের নাম শুনলেই বোঝা যায় কোন দল কেমন – যেমন যোমকাকের বংশ হল তারা ডোমকাক, এদের সবাই ভয় করে। মরা জানোয়ার নিয়ে ছেঁড়াছেঁড়ি মারামারি এদের কাজ। তারপর ধাড়িকাক বা দাঁড়কাক – এরা পুরোনো চালের, কাক যখন কোকিলের মতো গাইতে পারত তখন লোকে এদের পুষে দাঁড়ে বসিয়ে-বসিয়ে ছোলা খাওয়াত। সেই থেকে এরা নানা বিদ্যেতে কৌশলে কারিগরীতে মজবুদ বলে সব কাকই দায়ে পড়লে এদের পরামর্শ মতো চলে। তারপর, ঝোড়োকাক – এরা এককালে সব চেয়ে সাহসী বড়ই নামজাদা রাজবংশ ছিল, এখন বিষ হারিয়ে ঢোঁড়াকাক হয়ে পড়েছে কাজেই চুপচাপ থাকে সন্ন্যাসীর মতো। পাতিকাক হল পাণিকাকের বংশ, এরা সব দলেই আছে কিন্তু কোনো দলেই এদের পৌঁছে না, পুকুর পাড়ে এরা গুগলী শামুক এঁটো-কাঁটা খেয়েই দিন চালায়। শ্বেতকাক – এরা আসলে দিশি কালো কাকেরই বংশ কিন্তু রঙ বদলে শাদা বিলিতি কাক হতে যাচ্ছে – এদের কারু গলা শাদা, কারু ডানা শাদা, কারু মাথা শাদা, এখনো দোরঙা আছে বলে এদের নাম ছিটেকাক হয়েছে। পৃথিবীর আদিকাক হল ভুষুণ্ডিকাক, তারি বংশে ভুষুণ্ডে বা ভুষো, দেখতে কালিঝুলি, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, এই কাকের বংশ চলে আসছে – এদেরই পূর্বপুরুষ রামের সঙ্গে লড়াইয়ে একচোখ হারিয়েছিল, সেই থেকে এদের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে, এমন কি এদের নকল করে অনেক কাক একচোখা সেজে নিজেদের বলাতে চাচ্ছে এদেরই একজন, আসলে হয়তো সে পাতিকাক, কিন্তু লেখবার বেলায় লিখছে পাতি অব্ ভুষুণ্ডি! এই সব নানা ধরনের কাকেদের মধ্যে যখন যে দলপতি হয় তখন কাক সমাজকে সে নিজের মতো ভালো-মন্দ নরম-গরম ভাবে চালায়, এই হল সমাজের নিয়ম।
যে কাকটা নীলকর সাহেবের ঘরের সার্সিতে মস্ত ফাঁকটা আবিষ্কার করেছিল, সে বহুকালের পুরোনো রাজবংশী ঢোঁড়াকাক। যতদিন এই ঢোঁড়াকাক দলপতি ছিল ততদিন কাক সমাজ ভদ্ররকম ছিল, কোনো পাখিই তাদের কোনো দোষ কোনো খুঁত ধরতে পারেনি। কিন্তু কাক সমাজে ক্রমে প্রজা বৃদ্ধি হয়ে নানারকম কাক তাতে এসে যখন সেঁধোল তখন চাল-চোলও ক্রমে বদলাতে আরম্ভ করলে। শেষে একদিন সবাই মিলে ঢোঁড়াকাককে সিংহাসন থেকে তাড়িয়ে ডোমকাককে সর্দার করে এমন লুটতরাজ মারামারি আরম্ভ করে দিলে যে, পায়রা , সিকরে, গেরোবাজ এমন কি পেঁচারা পর্যন্ত অস্থির হয়ে কাকচিরে ছেড়ে পালাতে পথ পেলে না।
পুরোনো দলপতি ধোড়াকাক সিংহাসন ছেড়ে মনের দুঃখে ঝোড়োকাকের মতো হয়ে ডানা ঝুলিয়ে চুপচাপ শেওড়াগাছের ডালে দিন কাটায়, কেউ তাকে কোনো কথা শুধোয় না, সবাই মিলে বলতে লাগল ওটা বিষ হারিয়ে ঢোঁড়া হয়েছে, বুড়ো হয়ে বুদ্ধি-সুদ্ধি লোপ পেয়েছে। নতুন দলপতি ডোমকাক তামাশা করে তার নাম রাখলে ডরা-কাক, দেশের লোক তাকে বললে ঢোঁড়াকাক! একেবারে কাজের বার ভেবে সবাই তাকে তুচ্ছ করছে দেখে ঢোঁড়াকাক মনে-মনে একটুখানি হেসে আপনার কোণটিতে চুপচাপ বসে রইল। নতুন রাজা ডোম জাঁক দেখাবার জন্য প্রায়ই ঢোঁড়াকে রাজবাড়িতে নিমন্ত্রণ দিত। কোনো দিন বা নিজের বীরত্ব আর বাহাদুরি দেখাতে শিকারের সময় প্রায়ই সঙ্গে নিত। ঢোঁড়া সব বুঝত কিন্তু বুঝেও বোবা হয়ে থাকত।
ফেনচুগঞ্জের নীলকর সাহেব যদিও অনেক কাল হল কুঠিবাড়ি ছেড়ে গেছে, কিন্তু এখনও কোনো কাকের এমন সাহস হয় না যে সেদিকে যায়, কিন্তু ডরাকাক বলে ডোমকাকের দল যাকে তুচ্ছ করছে সেই কাকটি গিয়ে একদিন কুঠিবাড়ির মধ্যে যাবার একটি রাস্তাআ করে এল নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে একলা গিয়ে, কিন্তু খবরটা সে কাউকে জানায়নি! একে মানুষ তাতে গোরা, তার ঘরে সুড়ঙ্গ কাটা, বাঘের ঘরে যোগের বাসার চেয়েও অসমসাহসের কাজ, কোনো কাক এ পর্যন্ত যা পারেনি ঢোঁড়া সেই কাজটা করেছে – অথচ মুখে তার কথাটি নেই, অন্য কাক হলে চীৎকারের চোটে কাকচিরে মাত করত! নতুন দলপতি ডোমকাকটা দিনের বেলায় এই বুকে পাটকিলে ডোরা-টানা ধোড়াকাককে ভয় করে খাতির করে চলত, ধোড়ার বুকে লাল-ডোরা দেখে তার মনে হত যেন কতকালের মহাযুদ্ধের রক্তের দাগ রাজটিকের মতো এখনো এর বুকে দাগা রয়েছে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে যখন লাল-কালো সব এক হয়ে গেছে তখন ডোমকাক ধোড়াকে জ্বালাতন করতে ছাড়ত না – একদিন প্রায় মেরেই ফেলেছিল। সেইদিন থেকে ধোড়া বা ঢোঁড়াকাক শেওড়া গাছে আর ঘুমোতে যেত না, সেই সার্সি দিয়ে চুপিচুপি ঘরের মধ্যে দেওয়ালের গায়ে বেলা আড়াইটা বেজে বন্ধ হওয়া একটি ঘড়ির পিছনে বসে রাত কাটাতে আরম্ভ করলে।
রিদয় যে ঝড়ে পড়ে যোগী-গোফায় আশ্রয় নিয়েছিল সেই ঝড়ে কাকচিরার বহুকালের পুরোনো শেওড়া গাছটা গোড়া সুদ্ধু উপড়ে রাজ্যের ডোমকাকের বাসা ডিম ছানা-পোনা নিয়ে উল্টে পড়ল ঠিক বেলা আড়াইটাতে। বাসা গেল, ডিম ভাঙল, তাতে কাগেদের বড় একটা দুঃখ হল না, কিন্তু গাছের গোড়াটা যেখানে উল্টে পড়ে বড় একটা গর্ত দেখা দিয়েছে, সেই গর্তটায় কি আছে না আছে খুঁজে দেখবার জন্যে দলে-দলে কাক আকাশের দিকে পা-করা গাছের মোটা-মোটা শিকড়গুলো নিয়ে টানাটানি চেঁচামেচি বাধিয়ে দিলে।
ডোমকাক, ঢোঁড়াকাক পাতিকাক দুজনকে নিয়ে একেবারে ডোবাটার মধ্যে উড়ে পড়ে এদিক-ওদিক তদারক করে ইট পাটকেল উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল। হঠাৎ এত বড় গর্তটা কেন এখানে আসে, ঠোকর দিয়ে সন্ধান করতে-করতে গর্তের একদিকে খানিক কাঁকর-মাটি ঝরঝর করে খসে পড়ল, আর দেখা গেল ইঁটে-গাঁথা একটা চোর-কুঠুরী, তার মধ্যে তালা দেওয়া ছোট একটা পেঁটরার সামনে একটা মড়ার মাথা, কতকালের কলঙ্ক-ধরা একটা পিদুম আর গোখরো সাপের একটা খোলস! মড়ার মাথা সাপের খোলস দুটোই সব কাকের দেখা ছিল, পিদুম নিয়েও তারা অনেকবার পালিয়েছে, কিন্তু পোঁটরাটার মধ্যে কি আছে কোনো কাকই তা জানে না, কাজেই এদিকে-ওদিকে ঠোকর দিয়ে তালাটা ধরে নাড়া দিয়ে দেখছে এমন সময় গর্তের উপর থেকে খেঁকশেয়াল আস্তে-আস্তে বললে – “হচ্ছে কি? ওটা নিয়ে নাড়াচড়া কর না, ওতে সাত রাজার ধন আছে, যদি খুলতে চাও তো একজন যক্ ধরে আনো, যকের ধন যক্ না হলে কেউ খুলতে পারবে না।”
সাত রাজার ধন আছে শুনে কাকদের চক্ষু স্থির! চকচকে পয়সা মোহর ভালবাসতে তাদের মতো দুটো নেই, ডোমকাক পাতিকাক ভুষোকাক ছিটেকাক দাঁড়কাক সব কাক এসে শেয়ালকে ঘিরে – ক্যা-ক্যা-ক্যা কও-কও-কও রব করে গণ্ডগোল বাধিয়ে দিলে। ডোমকাক সবাইকে ধমকে চুপ করিয়ে শেয়ালকে শুধোলে – “জক্ এখন কেমন করে পাওয়া যায়?”
শেয়াল ডাঁওর করে মাথা চুলকে নাক রগড়ে যেন কতই ভেবে বললে – “আমি জানি এক যকের সন্ধান, সে ছুঁলেই এই বাক্স খুলে যাবে!”
কাকেরা অমনি চীৎকার করে উঠল – “কই-কই” – বলে এগিয়ে গর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডোমকাক তাড়াতাড়ি পেঁটরার উপরে চেপে বললে – “রও-রও”।
তারপর শেয়াল এগিয়ে এসে বললে – “আমি সেই যকের সন্ধান তোমাদের দিতে পারি, যদি তোমরা এই সিন্দুক খুলিয়ে নিয়ে যক্টিকে আমার পেট ভরাবার জন্যে দিতে রাজী হও।”
কাকেরা শেয়ালের কথায় রাজী হলে শেয়াল তাদের রিদয়ের খবর জানিয়ে দিলে। তিনকুড়ি কাক সঙ্গে ডোমরাজা ঢোঁড়াকাককে সঙ্গে নিয়ে যক্ ধরতে চলল পাহাড়-জঙ্গলের উপর দিয়ে।
হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং যখন চৌষট্টিখানা নাটবাড়ির নহবতখানার চুড়োয় পশ্চিমমুখো হয়ে রিদয়ের আশায় রয়েছেন, আর কাকদের রাজা ডোম রিদয়কে ধরবার জন্যে বনে-জঙ্গলে সন্ধান করে বেড়াচ্ছে, সেই সময় গণেশের নেংটি ইঁদুরের সঙ্গে পাহাড়ি চুয়োদের যুদ্ধ বেধে গেল। ব্রহ্মপুত্র আর বড়নদীর মোহনার পুরোনো নাটবাড়িটা ইঁদুরের দখলে, কতকাল থেকে আছে তার ঠিকানা নেই। দেওয়ানগিরির উপরের কেল্লার মতো আড়িমাও রাজাদের নাটবাড়ি, প্রকাণ্ড কারখানা, এত বড় নাটবাড়ি যে সেখানে রাজাদের আমলে যে-সব হাতি-ঘোড়া সেপাই-শাস্ত্রী থাকত সেগুলোকে দূর থেকে মনে হত যেন ছোট পুতুল চলে বেড়াচ্ছে। দশ-বারো-হাত চওড়া এক-একখানা পাথরের ইঁটে-গাঁথা বাড়ির দেওয়ালগুলো, এক-একটা থাম যেন এক-একটা তালগাছ! সাততলা বাড়ি কিন্তু তার নিচের পাঁচতলা নিরেট দেওয়ালে ভরাট করা, তার মাঝে পাহাড়ের গহ্বরের মতো অন্ধকার একটা সিংগি দরজা, আশে-পাশে বাক্সের মতো চোরকুঠুরী। সেগুলোতে দেওয়ালই সব, থাকবার জায়গা অল্পই, তাও আবার এখানে-ওখানে লোহার গরাদ দিয়ে বন্ধ, কত কালের অস্তর-শস্ত্র, রাজাদের আসবাব-পত্র, চাল-ডাল, ঘি-ময়দা, ধন-দৌলত দিয়ে ঠাসা। যেমন সোঁতা তেমনি অন্ধকার, সে-সব ঘরে একবার ঢুকলে রাস্তা হারিয়ে চিরকাল গোলকধাঁধার মতো ঘুরে বেড়াতে হয়, আর বাইরে আসবার উপায় নেই, এমনি প্যাঁচাও রকমে সে-সব ঘর সাজানো। ছ-তলার উপরে রাজসভা, সেখানে কতকটা আলো-বাতাস আসবার জন্যে সারি-সারি জানলা-বারাণ্ডা, সাততলায় অন্দর মহল, সেখানে জানলা সব খাঁচার মতো পাথরের জাল দিয়ে বন্ধ, পোষা-পাখির মতো রানীদের ধরে রাখার জন্যে ছোট-ছোট কুলুঙ্গি দেওয়া দরজায় শিকল-আঁটা সব শয়ন-মন্দির।
অন্ধকূপ এই নাটবাড়িতে আড়িমাও রাজাদের বংশ ভালো আলো-বাতাস না পেয়ে গুষ্ঠিসুদ্ধ লোকলস্কর সমেত অল্পদিনের মধ্যেই মরে ভূত হয়ে গেল, রইল কেবল বাড়ির চুড়োয় মস্ত একটা পাথরের আলসের উপরে খড়-কুটো দিয়ে বাসা বানিয়ে এক ঠেঙে – সে হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং। রানীর শয়ন-ঘরের কুলুঙ্গিগুলোতে গোটাকতক লক্ষ্মী-পেঁচা কালো-পেঁচা ভুতুম-পেঁচা, রাজসভার কার্নিশে-কার্নিশে ঝুলে দলে-দলে বাদুড়, রন্ধনশালায় একটা কালো বেরাল, আর ঘি-ময়দা চাল-ডাল শাল-দোশালা ধন-দৌলতে ঠাসা নিচেকার ভাঁড়ার ঘরগুলোতে গড়বন্দি নেংটি ইঁদুর। হাড়গিলে পেঁচা বেরাল এরা সবাই ইঁদুরের শত্রু হলেও গণেশের ইঁদুরকে তারা খাতির করে চলত, পৃথিবীর যেখানে যত গণেশ আছে, সবার জন্যে এই নাটবাড়ি থেকে ইঁদুর যায়, এদের কেউ কিছু বলবার যো নেই, কাজেই নেংটি ইঁদুরের দল দেশ জুড়ে নানা উৎপাত আর রাজত্ব করছিল, এই সময় কোথা থেকে তাতারি-চুয়ো এসে হানা দিয়ে, যেখানে-সেখানে গণেশ উল্টে ফেলে নেংটি বংশ ধ্বংস করতে শুরু করে দিলে।
গোলাবাড়ি, ঠাকুর-বাড়ি, গোয়ালঘর, রান্নাঘর, কাচারিঘর, হেঁসেল-ঘর, শোবারঘর, বসবারঘর, তোষাখানা, বৈঠকখানা, দেশের সব জায়গা থেকে তাড়া খেয়ে নেংটি সরে পড়তে লাগল, লড়ায়ে হারতে থাকল, না খেয়ে মরতে লাগল; শেষে এমন হল যে, এক পুরোনো নাটবাড়ি ছাড়া গণেশের ইঁদুর আর কোথাও রইল না। গণেশের সিংহাসন টলমল করতে থাকল, মানুষে নেংটি ইঁদুর মারত বটে কিন্তু গণেশ তাতে টলেননি, কেন না এত ইঁদুর বাইরে-বাইরে জন্মাত যে, মানুষ জন্ম-জন্ম মেরেও তাদের বংশ লোপ করতে পারত না। কিন্তু নেংটিরই বড় জাত যে চুয়ো, তারা যখন এসে হানা দিয়ে পড়ল, তখন গণেশ ভেবে অস্থির হলেন।
এই চুয়োরা একেবারে চোয়াড়, যা-তা খায়, দেবতা-ব্রাহ্মণে ভক্তি মোটেই নেই, একেবারে গোঁয়ার-গোবিন্দ, দুটি-একটি করে, যেন ভালোমানুষের মতো, প্রথমে নদী-নালার ধারে-ধারে নৌকোর খোলে এসে বাসা বাঁধলে, দেবতার মন্দিরে কিংবা মানুষের ভাঙা ঘরের উপরে, গ্রাম-নগরের দিকেই ঘেঁষতো না – নেংটি ইঁদুরগুলো যে সব পোড়ো-বাড়ি, পতিত জমি ছেড়ে গেছে সেই জায়গাগুলোয় এসে রইল, নেংটিদের ফেলে-দেওয়া যা কিছু কুড়িয়ে খেয়ে বড় হতে লাগল। ক্রমে তারা বড় হতে হতে শেষে নেংটিদের মাটির কেল্লাগুলো দখল করে জমিদারী ফাঁদলে, সেখান থেকে এ-জমিদারী, এ-পরগণা সে-পরগণা, এদেশ-সেদেশ, করে সারা দেশ তারা দখল করলে। মাটির নিচেটা দখল করে মাটির উপরে চুয়োর দল লড়াই দিতে যখন বার হল, তখন নেংটিরা বুঝলে দাঁড়াবার স্থান গেছে, নিরুপায় হয়ে তারা যে ক’টা পারে তাদের পুরোনো নাটবাড়ির কেল্লায় এসে ঢুকে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করতে লাগল। নাট-বাড়ির দেওয়াল মোটা, কাজেই নেংটিরা কতকটা নির্ভয়ে রইল, কিন্তু চুয়োরাও ছাড়বার পাত্র নয়; তারা বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে শেষে একদিন নাটবাড়ির উঠোনটা দখল করতে বারোজন তাতারি সওয়ার পাঠিয়ে দিলে! যুদ্ধং দেহি বলে শত্রুদল চারদিক ঘিরে লেজ আপসে লাফালাফি সুরু করে দিয়েছে, চারদিকে সাজ রে রব পড়ে গেছে –
পায় দল কলবল ভূতল টলমল
সাজল দলবল অটল তাতারি।
দামিনি তক-তক জামকী ধক-ধক
ঝকমক চমকত খরতর বারি।
ধূধূ-ধূধূধূ নৌবত বাজে,
ঘন ভোরঙ্গ ভম্-ভম্, দামামা দদদম্
ঝনন্ন ঝম-ঝম ঝাঁজে –
ধা-ধা গুড়-গুড় বাজে।
নিশান ফরফর নিনাদ ধর-ধর
তাতারি গর-গর গাজে।
ধূধূ ধম-ধম ঝাঁ-ঝাঁ ঝম-ঝম
দামামা দম-দম বাজে।
রণজয় ভেরী বাজে রে ঝাঁগড়-ঝাঁগড় ঝাঁ-ঝাঁ ঝাঁজে রে
মুচকিয়া গোঁফে চলে লাফে-লাফে
খেলে উড়ো পাকে থাকে-থাকে-থাকে ঝাঁপে রে
বাজে রণ ভেরী বাজে রে।
ভয় পেয়ে মরে নেংটি হাজার-হাজার
তল গেল মানমত্তা ইঁদুর রাজার
ঘাসের বোঝায় বসি ইন্দুরানী কাঁদে
ইন্দুরায় এতদিনে পড়িয়াছে ফাঁদে
কান্দি কহে ইন্দুরানী গণেশ গোঁসাই
এমন বিপাকে কভু আর ঠেকি নাই।
এইভাবে ইঁদুর রানী কাঁদছেন, এদিকে একশো বছরের ইঁদুরের রাজা তাতারিদের ভয়ে থরথরি কম্পমান, রানীর আঁচল ধরে মন্ত্র পড়ছেন, খট্ ভৈরবী – দ্রুত ত্রিতালি – আর কেঁদে বলছেন সুর করেঃ
চল-চল যাই নীলাচলে। (রে অরে যাই)
ঘটালে বিধি ভাগ্যফলে।।
মহাপ্রভু জগন্নাথ সুভদ্রা বলাই সাথ
দেখিব অক্ষয় বটতলে,
খাইয়া প্রসাদ ভাত মাথায় মুছিব হাত
নাচি বেড়াই কুতূহলে
ভবসিন্ধু বিন্দু জানি পার হইনু হেন মানি
সাঁতার খেলিব সিন্ধুজলে।।
নেংটির রাজা যখন কেল্লা ছেড়ে রানীকে নিয়ে পাছ-দুয়োর দিয়ে গঙ্গাসাগরের দিকে পলায়নের মতলব করছেন – লড়াই না দিয়ে, সেই সময় হাঁসের দল রিদয়কে নিয়ে দেওয়ানগিরির তলায় এসে উড়ে বসল। একদিকে নাটবাড়ির পাথরের পাঁচিল, আর একদিকে হাড়গিলের চর, এরি মাঝে জলের ধারে শুশনি কলমি শাক খেয়ে হাঁসের দল চরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় আণ্ডামানি হাঁসের সঙ্গে দেখা, ছোট দল বড় দল দুই দলে অমনি কথাবার্তা চলল, সাঁতার খেলা আরম্ভ হল।
যোগীগোফাতে ভেড়াদের নিয়ে যে কাণ্ড হয়েছে শুনে আণ্ডামানি বললে – “তা হলে শেয়াল লোভ সহজে ছাড়বে না, নিশ্চয়ই আমাদের পিছু নেবে, আর এখন দুদিন উড়ে কাজ নেই, এইখানেই থাকা যাক, আর ব্রহ্মপুত্রের বাঁক ধরে মানস সাগরেও গিয়ে কাজ নেই। এইখান থেকে বাঁহাতি মোড় নিয়ে একেবারে পাহাড়ের পাশ দিয়ে সোজা উত্তরে চলাই ভালো।”
চকা বললে – “অজানা রাস্তা কেমন করে যাব।”
আণ্ডামানি অমনি জবাব দিলে – “অজানা নয়, উত্তর সমুদ্রের ধারে রুশ দেশে যে সব পাখিরা থাকে তারা পাহাড়ের এই গলি পথটা দিয়ে সোজা হিমালয়ের ওপারে চলে যায়। আজ ক’দিন ধরে দলে-দলে সারস বুক কাদাখোঁচা জলপীপী এরা দেখি এই পথ দিয়ে যাওয়া-আসা করছে।”
বুড়ো চকা ঘার নেড়ে বললে – “ওহে রাস্তা তো আছে জেনেছ, রাস্তার কোথায়, কেমন দানাপানির ব্যবস্থা তার খবর নিয়েছ কি?”
আণ্ডামানি লালসেরা মাথা নেড়ে বললে – “সে খবরও নিতে বাকি রাখিনি। এই দেওয়ানগিরি থেকে বড়নদীর রাস্তা বেয়ে সোজা উত্তরে গেলে তাস্গং, তাউয়াং, দুটো বড়-বড় বস্তি, তার পরই চুথাং-এর জলা। সেখানে এক রাত্রি কাটিয়ে তার পরদিন সন্ধ্যায় চোনা হ্রদ পাওয়া যাবে, তারপর একদিনে নারায়ুম হ্রদ, সেখান থেকে একবেলার পথ ‘তিগুৎসো’। সেখান থেকে পশ্চিমে গেলে পেমো চাং, বাসাং সো, চোলু, খাম্বাজং গোঁসাইথান হয়ে ধবলাগিরি, আর উত্তর-পুবে গেলে যমদক্ষা নগরের ধারে প্রকাণ্ড পালতি হ্রদ, তার পরে ‘তামলং কঙ্কজং’ হয়ে আবার ব্রহ্মপুত্রের রাস্তায় পড়া যেতে পারে, অনেক পাখিই এই রাস্তা দিয়ে চলেছে, সেথোর অভাব হবে না। তাছাড়া কঙ্কজং-এর রাজা কঙ্ক-পাখির সঙ্গে যখন তোমাদের পরিচয় আগেই হয়ে গেছে, তখন সেখানেও কিছুদিন জিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে।”
চকা ঘাড় নেড়ে বললে – “সে সব ভালো, কিন্তু ওদিকের আকাশটা যেন কেমন ঘোলাটে ঠেকছে, দেওয়ানগিরির উত্তর গা-টাতে মেঘের ছাওয়াটাও দেখতে পাচ্ছি; হঠাৎ ওদিকে যাওয়া নয়, দু-একদিন দেখা যাক।”
হাঁসদের মধ্যে এই সব পরামর্শ চলছে এদিকে রিদয় একটা ডোবায় পা ডুবিয়ে আড়িমাও রাজার পুরোনো নাটবাড়িটার পাঁচিলের দিকে চেয়ে রয়েছে, এমন সময় দেখলে সন্ধ্যের অন্ধকারে পাঁচিলের ধারে রাশ-রাশ নুড়িগুলো যেন নড়তে-চড়তে আরম্ভ করলে, তারপর সার বেঁধে সব নুড়িগুলো কেল্লার দিকে এগোতে লাগল! রিদয় চেঁচিয়ে উঠল – “দেখ-দেখ!” অমনি সব হাঁস সেদিকে চেয়ে দেখলে দলে-দলে চুয়া রাস্তা ঢেকে চলেছে।
রিদয় যখন বড় ছিল তখন একবার ইঁদুরের কামড় কেমন টের পেয়েছে, এখন এই বুড়ো-আংলা অবস্থায় ইঁদুরের পাল্লায় পড়লে যে কি হবে তাই ভেবে সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাঁসেরাও রিদয়ের মতো ইঁদুরের গন্ধ মোটেই সইতে পারত না, যতক্ষণ সেদিক দিয়ে ইঁদুরগুলো গেল ততক্ষণ সবাই মুখ বন্ধ করে রইল। তারপর ‘ছি-ছি’ বলে যেন কেবলি ডানা ঝাড়া দিতে শুরু করে দিলে।
চুয়োর দল ছোট-বড় নুড়ির ঝরনার মতো গড়াতে-গড়াতে পাথরের পাঁচিলের গোড়া বেয়ে নাটবাড়ির সিংগি দরজার দিকে চলে গেল, ঠিক সেই সময় আকাশে পা লটপট করতে-করতে হাড়গিলে-রাজ খাম্বাজং ঝুপ করে হাঁসদের মধ্যে এসে পড়লেন। রিদয় এমনতরো পাখি কোনোদিন দেখেনি, এঁর মাথা, গলা আর পিঠ শাদা রাজহাঁসের মতো, ডানা দুখানা কালো দাঁড়কাকের মতো, তেলে পাকানো গেঁটে-বাঁশের ছড়ির মতো লাল দুখানা সরু ঠ্যাং, আর বারো-হাত কাঁকুড়ের তেরো-হাত বীচির মতো এতটুকু মাথায় এত বড় এক লম্বা ঠোঁট – এক আঙুল কলমের যেন দশ আঙুল নিব তার ভারে মাথাটা ঝুঁকেই আছে, মুখের দু-পাশে বোয়াল মাছের মতো চোখ দুটো বসানো! রিদয়ের বোধ হল, পাখি মাছ কাঁকুড় কলম বাঁশ সব মিলিয়ে যেন এই পক্ষীরাজ সৃষ্টি হয়েছে!
হাড়গিলেকে দেখে চকা তাড়াতাড়ি ডানার পালক ঝেড়েঝেড়ে সামনে এগিয়ে এসে দণ্ডবৎ হয়ে দু-তিন বার প্রণাম করে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল হঠাৎ খাম্বাজং কি কাজে এলেন! নাটবাড়ির চুড়োয় হাড়গিলের বাসা চকা জানে আর ফাল্গুন মাসের গোড়াতেই হাড়গিলেদের আনাবার পূর্বে খাম্বাজং বাসাটা একবার তদারক করতে প্রতি বছরে এখানে থাকেন সেটাও জানা কথা। কিন্তু হাড়গিলেরা তো হাঁসেদের সঙ্গে প্রায়ই আলাপ-সালাপ রাখে না, হঠাৎ আজ হাঁসের দলে রাজার আগমন হল কেন, এটা চকা না ভেবে না পেয়ে একবার ঘাড় চুলকে বললে – “জং বাহাদুরের বাসার খবর ভালো তো, গেল ঝড় বৃষ্টিতে কোনো লোকসান হয়নি তো?”
হাড়গিলের সবাই তোতলা, সহজে কথা কওয়া তাদের মুশকিল, খাম্বাজং অনেকক্ষণ ঠোঁট কাঁপিয়ে এ-চোখ বুজে ও-চোখ খুলে ভাঙা গলায় কাঁদুনি শুরু করলেন – “বুড়োবয়সে বাসাটা ঝড়ে পড়ে গেছে, একে উঁচু নাটবাড়ি, তায় আবার চুড়ো, গিন্নী দেখে-দেখে সেখানেই বাসা বাঁধলেন, টিকবে কেন? এই বুড়ো বয়সে জল-ঝড়ের মধ্যে ঐ গোটা কতক ভাঙা কাঠির বাসায় তো আমার টেকা দায় হয়েছে! এদিকে আবার মানুষগুলো সমস্ত জলা আর খাল-বিল ভরাট করে তার উপর দিয়ে রেলগাড়ি চালাবার বন্দোবস্ত করচে, দু-একটা সাপ ব্যাঙ যে ধরে খাব তারও রাস্তা বন্ধ! শুনেছি না কি আবার এই নাটবাড়িটাতে ইস্টিশান বসাবে, তাহলে তো আমাকে এদেশ ছাড়তে হয় দেখি!”
চকা খুব দুঃখ জানিয়ে বললে – “আপনি তো তবু এতকাল এই নাটবাড়িতেই কাটালেন, ইচ্ছে করলে পরেও আপনি ইস্টিশানের চুড়োটায় বাসা বাঁধতে পারেন। মানুষে কোনোদিন আপনার উপর গুলিও চালাবে না। আর বাসা থেকে আপনার আণ্ডাবাচ্চা চুরি করে ভেজেও খাবে না, আপনার তো কোনো পরোয়া নেই। বড় জোর এখন চুড়োয় আছেন, না হয় চরে নেমে বসবেন; কিন্তু আমাদের দশা দেখুন দেখি –
ভোজনং যত্র তত্র শয়নং হট্টমন্দিরে
মরণং গোমতী তীরে অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি!
এই ভাবেই সারা জীবন কাটাতে হবে। আপনার যা হোক একটা দাঁড়াবার স্থান আছে, আমাদের দশাটা ভাবুন তো। ভবঘুরের মতো –
যেখানে-সেখানে শোও আর খাও
পৃথিবীটা ঘিরে চক্কর দাও
শেষে একদিন অকস্মাৎ!
বিনা মেঘে বজ্রঘাৎ!
“তাগে পেলেই মানুষ গুলি চালাচ্ছে আমাদের দিকে!”
হাড়গিলে গলার পালকের দাড়ি বুলিয়ে বললেন – “কথাটি তো বলেছ ঠিক, কিন্তু নাটবাড়ি হয়ে পর্যন্ত ঐ চুড়োটায় বাস করে আসছি সাতপুরুষ ধরে, আজ হঠাৎ করে চুড়ো থেকে চরে নেমে বসা কি কম কষ্টের কথা, আর ঐ হাড়গিলের চরটাও শুনছি মানুষেরা চেঁচে ফেলে ওখান দিয়ে বড়-বড় মালের জাহাজ চালাবে!”
চকা এবারে আমতা-আমতা করে বলল – “তা হলে তো মুশকিল দেখছি, মানুষের সাথে তো আমরা পেরে উঠব না, এ বিষয়ে আপনি –”
এবারে হাড়গিলে ঠোঁট বাজিয়ে বলে উঠলেন – “আঃ, সে মানুষের কথা, যখন তারা আসবে ভাবা যাবে। এখন একটা কথা শুধোই, এদিক দিয়ে চুয়োদের পল্টন যেতে দেখেছ কি?” হাজার-হাজার চুয়ো এইমাত্র এইদিক দিয়ে গেছে শুনে হাড়গিলে আকাশে চোখ তুলে বললেন – “এতদিনে বুঝি গণেশের ইঁদুরের দফা রফা, আজ রাতের মধ্যেই চুয়োরা নাটবাড়ি দখল করবে।”
চকা ভয় পেয়ে বললে – “কি বলেন লড়াই বাধবে নাকি?”
হাড়গিলে বলে উঠলেন – “বাধবে আর কি, বিনা যুদ্ধে চুয়োরা আজ কেল্লা মেরে নেবে, রাজা গঙ্গাসাগরের দিকে রানীকে নিয়ে দৌড় দিয়েছেন। বামুন গেল ঘর তো লাঙ্গল তুলে ধর, কেল্লায় যারা ছিল তারা মানস-সরোবরের ধারে আসছে পূর্ণিমায় পঙ্কিরদলের বারোয়ারীর নাচ দেখতে ছুটেছে, ঠিক ঝোপ বুঝেই চুয়োর দল কোপ দিতে চলেছে। কেল্লায় গোটাকতক অকর্মণ্য বুড়ো নেংটি ছাড়া আর তো কেউ নেই, এতকাল নেংটিদের সঙ্গে এই নাটবাড়িতে কাটালেম, এখন বুড়ো বয়সে আর শিং ভেঙে বাছুরের দলে যাওয়ার মতো চুয়োর দলে ভিড়তে আমার ইচ্ছে যায় না, তাই ভাবচি থাকি কি যাই।”
হাড়গিলে যে ইঁদুরদের বিপদের খবরটা না দিয়ে হাঁসের দলে এসে কাঁদুনী শুরু করেছে এটা চকার মোটে ভালো লাগল না। সে একটু এগিয়ে গিয়ে হাড়গিলেকে বললে – ‘গণেশের ইঁদুরদের আপনি ও-খবরটা পাঠাননি এখনো?”
হাড়গিলে গলার থলি দুলিয়ে বললে – “খবর দিয়ে লাভ? তারা আসবার আগেই সে কেল্লা দখল হয়ে যাবে।”
চকা এবারে চটে বলল – “হয়ে যাবে বললেই হয়ে গেল, এমন অঘটন হতে দেব না আমি বলছি।”
যে চকার ঠোঁট একেবারে ভোঁতা, নেই বললেই হয়, আর যার পায়ের ততোধিক ধারাল, সন্ধ্যে না হলেই যার ঘুম আসে, তিনি লড়তে চান চিরুনিদাঁত চুয়োদের সঙ্গে! হাড়গিলে হেসেই অস্থির। ঘাড় নেড়ে চকাকে বললেন – “বুরুঞ্জিতে লেখা আছে এই ঘটবে, কারো সাধ্য নেই তা রদ করা, আমি পণ্ডিতদের দিয়ে গণিয়ে দেখেছি কোনো উপায় নেই, না হলে আমি চুপ করে বসে আছি!”
চকা হাড়গিলের কথায় কান না দিয়ে ডাক দিলে – “পাঁপড়া নান্কৌড়ি, নেড়োল কাটচাল, লালসেরা আণ্ডামানি, চোখ-ধলা ডানকানি, পাটাবুকো হামস্ত্রি, মারাগুই চাপড়া, তীরশুলি আকায়ব, তোমরা যাও মানস-সরোবরের পথে যত নেংটি দেখবে সবাইকে খবর দাও লড়াই বাধবে।” অমনি সাতটা বুনো-হাঁস অন্ধকারে ডানা ছড়িয়ে উড়ে পড়ল। চকা আবার বাঙলাদেশের হাঁসদের ডাক দিলে – “সনদ্বীপের বাঙাল, ধন-মাণিকের কাওয়াজী, রায়মঙ্গলার ঘেংরাল, চব্বিশ পরগণার সরাল!” অমনি তেল চুকচুকে মোটাপেট পাঁচজন উপস্থিত হল হেলতে-দুলতে, চকা তাদের বললে – “চট করে যাও গঙ্গাসাগরের দিকে, নেংটিদের রাজা ইন্দুরায় আর ইন্দুরাণীকে ফিরিয়ে আনো!” কিন্তু এবারের দল অত চটপট উড়ে পড়ল না, বাঙাল মাথা চুলকে বললে – “এ-কাজটা কি সমীচীন হবে, ইঁদুরের যুদ্ধে হাঁসেদের যোগ দেওয়া কি সঙ্গত, তা ছাড়া এই অন্ধকার রাতে আপনাকে একলা এই শত্রুদের মাঝে – ”
চকা ধমকে উঠলঃ “বড় দেরি করছ তোমরা!” বাঙলার হাঁসরা পটাস-পটাস করে ডানা ঝাপটে দক্ষিণ মুখে আস্তে-আস্তে উড়ে চলল।
চকা তাদের দিকে খানিক কটমট করে চেয়ে থেকে সুবচনীর হাঁসকে বললে – “তুমি গিয়ে হাড়গিলে চরে চুপচাপ বসে থাক, আমি কেবল হংপাল বুড়ো-আংলাকে পিঠে নিয়ে নাটবাড়িতে যাব, যদি কেউ চুয়োদের তাড়াতে পারে তো এই ছোকরা।” বলে চকা হাড়গিলের সাথে রিদয়ের আলাপ করিয়ে দিলে।
টিকটিকির মতো বুড়ো-আংলাকে দেখে হাড়গিলে একবার গলার থলি ফুলিয়ে খানিক হেলে-দুলে হেসে নিলেন। তারপরে ঝপ করে ঠোঁটে করে রিদয়কে আকাশে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে লোফালুফি শুরু করে দিলেন, রিদয় ভয় পেয়ে চীৎকার করতে লাগল। চকা তাড়াতাড়ি ছুটে এসে বললে – “জং বাহাদুর করেন কি! ওটা মানুষ – ব্যাঙ নয়, ওকে ছাড়ুন, গেল যে!”
“মানুষ!” বলেই হাড়গিলে মাটিতে রিদয়কে নামিয়ে দিয়ে দু-চারবার ডানা আপসে নৃত্য করে বললেন – “বুরুঞ্জিতে ঠিক তো লিখেছে, অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ এই মহাপুরুষ এসেছেন ঠিক ভূতচতুর্দশীতেই, আর ভয় নেই, আমি এখন গিয়ে নাটবাড়ির সকলকে এ খবর দিচ্ছি। জয় গণেশের জয়” – বলে হাড়গিলে নাটবাড়ির দিকে উড়ে গেল।
হাড়গিলের ব্যবহারে রিদয় ভারি চটে ছিল, সে গোঁ হয়ে চকার পিঠে উঠে বসল। নাটবাড়ির চুড়োয় একখানা যাঁতার মতো পাথর, তার মাঝখানটায় রাজাদের ধ্বজি গাড়বার একটা গর্ত, সেই গর্তে খান দুই পুরোনো হোগলা-পাতার মাদুর বিছানো, তার উপরে কাঠকুটো আর পালকের তোশক, একপাশে কোন কালের রানীদের ছেঁড়া কাপড়ের এক টুকরো জরির আঁচল মাদুর-ছেঁড়ার মধ্যে ঝিকমিক করছে, কতকালের মরচে-ধরা একটা খিল-ভাঙা তালা, একটা কলঙ্ক-পড়া রুপোর চুষিকাঠি, ভোঁতা একটা শরের কলম, ছেঁড়া একপাটি জরির লপেটা জুতো, আধখানা পরকলা লাগানো শিং-এর চশমা একটা, গেল বছরের ফাটা চিনের পেয়ালার মতো গোটাকতক ডিমের খোলা, পেটটা ফুটো-করা একটা আধমরা ব্যাঙ, এমনি সব নানা সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে বাসাটা ভর্তি। কতকালের যে বাসা তার ঠিক নেই, তার গায়ে ছোট-বড় ঘাস-পাতা গজিয়ে গেছে, এমন কি গোটাবারো লতাওয়ালা একটা বটগাছ পর্যন্ত, তাতে আবার ফল ধরেছে।
চকার সঙ্গে রিদয় এসে দেখলে নাটবাড়ির সবাই এসে আজ বাসায় হাড়গিলেকে ঘিরে কি সব পরামর্শ করছে, বুড়ো ভুতুম পেঁচা একদিকে বসে গোল দুই চোখ বার করে কেবলি হুঁ-হুঁ সায় দিচ্ছে কালো বেরালটা লেজ নাড়ছে আর মিউমিউ করে কি যে বকছে তার ঠিক নেই, হাড়গিলে মাঝে বসে কেবলি গলার থলি ঝাড়ছেন আর পাঁচ গণ্ডা বুড়ো নেংটি ইঁদুর শুকনো মুখে একধারে চুপটি করে বসে এদিক-ওদিক কান ঘোরাচ্ছে।
ইঁদুর বেরাল পেঁচা হাড়গিলে এখানে জমা হয়েছে দেখেই রিদয় বুঝলে নাটবাড়িতে আজ বিষম গণ্ডগোল! চকা আর রিদয়ের দিকে কেউ আজ চেয়েও দেখলে না, সবাই চেয়ে রয়েছে হাঁ করে যেদিক দিয়ে দলে-দলে চুয়ো সাঁর বেঁধে মাঠের উপর দিয়ে আসছে!
ভুতুম পেঁচা খানিক ভূতের মতো নাকিসুরে চুয়োদের বিষম উৎপাতের কথা বর্ণনা করে চলল। বেরাল মিউ মিউ করে খানিক কাঁদুনি গাইলে – “এই বুড়ো বয়সে শেষে কি চুয়োর পেটে যেতে হবে নাকি, আণ্ডাবাচ্চা কাউকেই তারা রেহাই দেবে না!”
হাড়গিলে ইঁদুরদের ধমকে বললেন – “এই দুঃসময়ে তোমাদের চাঁইদের বারোয়ারিতে যেতে দিয়ে যত মুখ্যুমি করেছ, লড়াই দেবার জন্যে একটা লোক পর্যন্ত রইল না কেল্লায়! আমি কি এই বুড়ো বয়সে চুয়ো মেরে ঠোঁটে গন্ধ করতে পারি, ছি-ছি! এমন করে কেল্লা ফাঁকা রেখে সব নেংটির চলে যাওয়াটা ভারি অন্যায় হয়েছে!”
ইঁদুরগুলো কেবল হতভম্ব হয়ে বেরালের দিকে চাইতে লাগল।
বেরাল ফোগলা দাঁত খিঁচিয়ে বললে – “আমার দিকে দেখছ কি? তোমরা নিজেদের ঘর সামলাতে না পার নিজেরাই মরবে। আমার কি, আমি ষষ্ঠীর দুয়ারে গিয়ে ধন্না দেব। সেখানে পেসাদের কিছু না পাই দুধ তো আছে।”
ইঁদুররা হাড়গিলের দিকে চাইতে তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন – “আমি আর কি করতে পারি বল? এই অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ টিকটিকির মতো মানুষটিকে তোমাদের এনে দিলেম, এঁর সঙ্গে পরামর্শ করে যা ভালো হয় কর। আমার যথাসাধ্য তো তোমাদের জন্যে করলেম, এখন যা করেন গণেশ ঠাকুর। আঃ আর পারিনে!” বলে হাড়গিলে পা মোড়া দিয়ে আকাশের দিকে ঠোঁট তুলে চোখ বুজলেন।
ইঁদুর বেরাল পেঁচা একবার রিদয়ের মুখের দিকে চাইলে তারপর আস্তে-আস্তে সভা ছেড়ে যে যার বাসায় যাবার উদ্যোগ করলে। এদের রকম দেখে চকার এমনি রাগ হচ্ছিল যে সব কটাকে ঠেলে সে চুয়োদের মুখে ফেলে দেয়, বিশেষ করে ওই একঠেঙ্গে হাড়গিলেটাকে এক ধাক্কায় নাটবাড়ির চুড়ো থেকে একেবারে নিচে ফেলে দেবার জন্যে চকা নিসপিস করতে লাগল।
রিদয় তাকে চোখ টিপে বললে – “চুয়োদের জব্দ করা শক্ত নয়, যদি নাটবাড়ির ঠাকুরঘরের লক্ষ্মী পেঁচা আমাকে এখনি একবার, ঠাকুরঘরে যে দুয়োরের উপরে কুলুঙ্গীতে গণেশ বসে আছেন, তাঁর কাছে নিয়ে যান!”
ভুতুম অমনি তাড়াতাড়ি লক্ষ্মী পেঁচাকে ডেকে আনলে। রিদয় লক্ষ্মী পেঁচাকে গণেশের কথা শুধোতে সে বললে – “ঠাকুর তো এখন শয়ন করেছেন, ঠাকুরঘরের দরজা বন্ধ!”
রিদয় চকার সঙ্গে চুপিচুপি দু-একটা কথা বলাবলি করে পেঁচাকে বললে – “পুরোনো দরজা খুলে নিতে কতক্ষণ? চল, পথ দেখাও।”
লক্ষ্মী পেঁচা আগে পথ দেখিয়ে চলল, সঙ্গে রিদয়।
চকা বললে – “এই ভূতচতুর্দশীর রাত্রে পোড়ো বাড়িতে একা তোমার সঙ্গে যেতে দিতে মন সরছে না – যদি পেঁচোয় পায়, আমাকেও সঙ্গে যেতে হল।”
হাড়গিলে অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন – “না না, সে হতে পারে না, তুমি গেলে গোল হবে, বুরুঞ্জিতে লিখেছে এই ভূতচতুর্দশীতে একা এই অঙ্গুলি প্রমাণ মানুষটি এসে নাটবাড়িতে মুষিকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে হাড়গিলে বংশের সুখসৌভাগ্য বৃদ্ধি করবেন। তুমি গেলে শাস্ত্রের কথা মিথ্যা হয়ে যায়। এই নাও শনিবার অমাবস্যাতে তোলা এই মানকচুর শিকড় সঙ্গে রাখ, ভূত পালাবে।” বলে রিদয়ের হাতে তাঁর বাসার ছেঁড়া মাদুর একটু ভেঙে দিয়ে তার কানে মন্তর দিলেন।
রিদয় ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে কচুর শিকড় গুঁজে চিলে ছাতের গোল সিঁড়ি বেয়ে পেঁচার সঙ্গে নেমে চলল, মনে-মনে ভূতের মন্তর আওড়াতে-আওড়াতে – হং সং বং লং হাঃ ফুঃ । ভূতচতুর্দশীর রাত্রি এমন অন্ধকার যে, ভূতকে পর্যন্ত দেখা যায় না! রিদয় সেই অন্ধকারে পেঁচার সঙ্গে চিলের ছাতের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ক্রমাগত নেমে চলেছে। দুদিকে পিছল পাথরের দেওয়াল, তার মাঝে-মাঝে এক-একটা ঘুলঘুলি, সেখান দিয়ে একটু যা আলো আর বাতাস আসতে পায়! রিদয় দেওয়ালের গা ঘেঁষে টিকটিকির মতো পায়ে-পায়ে নামছে, অন্ধকারে পেঁচা যে কোনদিকে চলেছে সেই জানে, কেবল সে এক একবার হাঁকছে – “উঁচা-নিচা!” আর সেই ডাক শুনে রিদয় চলেছে, ইস্ক্রুপের প্যাঁচের মতো পাক-দেওয়া সিঁড়ি পার হয়ে অন্ধকারে।
একটা কিসের গায়ে হাত পরতেই সেটা ক্যেঁ বলে ঝটপট করে উঠল, এক জায়গায় জল পড়ে ডোবা মতো হয়েছে হঠাৎ ঠাণ্ডা জলে পা রেখেই রিদয় থমকে দাঁড়াল, পেঁচা অমনি বলে উঠল – “বাঁয়ে ঘেঁষে।” কখনো বাঁয়ে কখনো ডাইনে কখনো উঁচায় কখনো নিচায় এইভাবে রিদয় চলেছে! চোখে কিছু দেখছে না, কানে শুনছে খালি কি যেন এখানে কি একটা ঝটপট করে উঠল, ওখানে মাথার উপরে থেকে কি ঠিক-ঠিক করে ডাক দিলে, কখনো শুনলে পাথরের গায়ে কে নখ আঁচড়াচ্ছে, ওদিকে কারা যেন দুদ্দার করে পালিয়ে গেল, পায়ের কাছে কি একটা পাশমোড়া দিলে, হঠাৎ গালে যেন কে একটা চিমটি কেটে গেল, কানের কাছে চট করে একটা কে ‘টু’ দিয়ে পালাল! এর উপরে রিদয় নানা বিভীষিকা দেখছে – হঠাৎ এক জায়গায় গোটাকতক চোখ আলেয়ার মত জ্বলেই আবার নিভে গেল। যেন ইলিশ মাছের জাল নাকের সামনে কে একবার ঝেড়ে দিয়েই সরে পড়ল, হঠাৎ একটা গরম হাওয়া মুখে লাগল, তার পরেই বরফের মতো বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিলে!
রিদয়ের মনে হচ্ছে এইবার সিঁড়ি শেষ হল কিন্তু খানিক গিয়ে আবার সিঁড়ি, আবার চাতাল, আবার ধাপ, আবার দেওয়াল, এমনি ক্রমাগত ওঠা, নামা করতে-করতে চলা – এর যেন শেষ নেই। আঁধি ধাদি ভূত পেত্নি ব্রহ্মদৈত্য ঝাম ঝামড়ি কন্ধকাটা শাঁকচুন্নি ডাকিনী যোগিনী ফ্যাল ভেলকি, পেটকামড়ি সবাই আজ ভূতচতুর্দশীতে জটলা করতে বেরিয়েছে, আঁদারে-পাঁদাড়ে রিদয়কে দেখে কেউ ঝম-ঝম করে নাচতে লাগল, কেউ ফিক-ফিক করে হাসতে লাগল। খুস-খাস খিট-খাট আওয়াজ করে ভূতেরা কেউ খড়ম পায়ে, কেউ হাড় মড়-মড় করে, কেউ বা ঘণ্টা বাজিয়ে, কেউ বা চটি চটপট করে তার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। ভয়ে রিদয়ের হাত-পা অবশ হয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময় সরু গলির শেষে মস্ত একটা চাতালের উপর এসে পেঁচা ‘ঠাকুরবাড়ি’ বলেই অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল!
অনেকক্ষণ ধরে কারুর সাড়াশব্দ নেই, রিদয় অন্ধকারে হাতড়ে দেখলে চারদিকে দেওয়াল, দরজাও নেই, কিছুই নেই! রিদয় ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, একটা কে তার পায়ে এসে সুড়সুড়ি দিয়ে তাকে আস্তে-আস্তে দেওয়ালের কাছে টেনে নিয়ে গেল, তারপর কিঁচ করে যেন চাবি খোলার শব্দ হল! একটা মস্ত দরজা হড়-হড় করে গড়িয়ে আপনি যেন খুলে যাচ্ছে, পায়ের নিচে পাথরের মেঝেটা তারই ভারে কাঁপছে!
ঠিক সেই সময় বিকট শব্দে মাথার উপরে ঘটং-ঘং-ঘটং-ঘং করে রাত বারোটার ঘড়ি পড়ল। অমনি দপ-দপ করে চারদিকে আলোয়-আলো এসে দেওয়ালির পিদুম জ্বালিয়ে দিলে, আর ঘণ্টা নাড়তে-নাড়তে ভয়ঙ্কর এক কাপালিক ব্রহ্মদৈত্য মড়ার মাথার খুলিতে ঘিয়ের সলতে জ্বালিয়ে উপস্থিত –
গলে দোলে ভীষণ রুদ্রাক্ষ মালা
পিঙ্গল নয়নে যেন মহেশের কোপানল জ্বালা!
রিদয় দেখলে ঘরের মধ্যে কালো পাথরের প্রকাণ্ড এক মূর্তি, তাতে কতকালের রক্তচন্দনের ছিটে, ভৈরবটির জিব লক-লক করছে আর গায়ে সোনা-রুপো হীরে-জহরত আর মুণ্ডমালা ঝুলছে! ব্রহ্মদৈত্য আরতি আরম্ভ করলেনঃ
রম্-ঝম্ রম্-ঝম্ শব্দ উঠে
ভূত-প্রেত পিশাচ দাঁড়ায় সবে জোড় করপুটে।
তাধিয়া-তাধিয়া বাজায় তাল
তাতা থেই-থেই বলে বেতাল
ববম-ববম বাজায়ে গাল
ডিমি-ডিমি বাজে ডমরু ভাল
ভবম-ভবম বাজায়ে শিঙ্গা
মৃদঙ্গ বাজায় তাধিঙ্গা-ধিঙ্গা
ধেই-ধেই নাচে পিশাচ দানা।
রিদয় হাঁ করে ভূতের কাণ্ড দেখছে এমন সময় পেঁচা কানের কাছে ফিস-ফিস করে বললে, “এখানে নয়, পাশের কুঠুরীতে গণেশ ঠাকুরের সভা।” হোমের ধোঁয়ায় আলোগুলো ক্রমে ঘোলাটে হয়ে এল; সেই সময় রিদয় পেঁচার সঙ্গে আস্তে-আস্তে পাশ কাটিয়ে গণেশ মহালের গলিতে সেঁধোল। দেউরিতে একটা মোটাপেট হিন্দুস্থানী দারোয়ান সিদ্ধি খেয়ে খালি গায়ে ভোঁ হয়ে ঢোলক পিটছে, অন্ধকারে রিদয় তাকেই গণেশ ভেবে ঢিপ করে একটা পেন্নাম দিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়াল।
দারোয়ানজী ভারি গলায় বললে, “কৌন হোঃ?”
রিদয় কিছুই বুঝলে না, তবু ঘাড় নেড়ে বললে – “আজ্ঞে আমি রিদয়, নেংটি ইঁদুরেরা বড় বিপদে পড়েছে তাই – ”
“ক্যা বক্-বক্ লাগায়া” – বলে দারোয়ান আবার ঢোল পিটতে লাগল।
রিদয় ভাবলে গণেশ বকের কথা শুধোচ্ছেন; সে তাড়াতাড়ি বললে – “আজ্ঞে বকের সঙ্গে আমার আলাপ আছে, কিন্তু আজ আমি ইঁদুরদের হয়ে লড়াই করতে চাই, সেইজন্যে আপনার ঐ জয়ঢাকটি আমি চাই।” বলে রিদয় যেমন ঢোলকে হাত দিয়েছে, অমনি গণেশের দারোয়ান ধমকে উঠল – “ধেৎ তেরি!”
রিদয় ভয়ে দশহাত পিছিয়ে পড়ল – সেই সময় পেঁচা এসে তার কানে-কানে বললেন – “করছ কি? উনি গণেশ নন, ভিতরে চল!” তারপর দারোয়ানের সঙ্গে পেঁচা গিয়ে কি খানিক বকাবকি করলে, তখন দারোয়ান দুয়ার ছেড়ে দিয়ে বললে – “আইয়ে বাবু!”
মহলের মধ্যে গণেশের পরিচয় চৌষট্টি ভাগ কলাবৌ, কেউ রঙ-তুলি দিয়ে আল্পনা দিচ্ছিল, কেউ সেঁতার বাজিয়ে গান-বাজনা করছিল, কেউ মালা গাঁথছিল, কাথা বুনছিল, এমনি চৌষট্টি খাম্বা ঘরের মধ্যে সবাই এক-এক কাজে, হঠাৎ রিদয়কে দেখে সবাই মাথায় ঘোমটা টেনে জুজু-বুড়িটি হয়ে বসল।
পেঁচা সেখান থেকে রিদয়কে নিয়ে আর একটা হাতিশুঁড়ো গজদন্তের খিলানের মধ্যে দিয়ে গণপতি গণেশের বৈঠকখানায় এনে হাজির করে দিলে। রিদয় দেখলে ঘরের উত্তর গায়ে মস্ত একটা তক্তাপোশে গেদা হেলান দিয়ে থান-ধুতি মেরজাই পরে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, তাঁর গজদাঁতও নেই শুঁড়ও নেই মোটা পেটও নয়, দিব্যি দেবতার মতো চেহারা।
পেঁচা রিদয়ের কানে-কানে বললে – “ইনিই রাজা গণেশ, এঁকে যা দরবার করতে হয় কর।”
রিদয়ের মুখে কথা নেই, ইনিই গণেশ! ভয়ে-ভয়ে সে এগিয়ে বললে – “মশায়ের নাম?”
উত্তর হল – “আমি গণপতি, কি চাই?”
রিদয় খুব নরম হয়ে বললে – “যে ইঁদুরগুলিতে চড়ে মশায় বেরিয়ে বেড়ান সেগুলির বড় বিপদ উপস্থিত!”
গণেশ ভুরু কুঁচকে বললেন – “ইঁদুর! আমি তো কোনোদিন ইঁদুরে চড়িনে!”
রিদয় বললে – “আজ্ঞে, ভুলে যাচ্ছেন আপনি, হস্তী-বেশ ধরে যখন হাওয়া খেতে বেরোন, সেই সময় ইঁদুর আপনার গাড়ি –
গণেশ হোঃ-হোঃ করে হেসে বললেন – “তুমি পাগল নাকি আমাকে সুদ্ধ গাড়ি টেনে চলতে পারে যে ইঁদুর তাকে তুমি কোথায় দেখলে? ছেলেবেলায় আমি দু-একটা ইঁদুর পুষেছিলেম কিন্তু সবগুলোর বাচ্চা হয়ে আমার ঘরে এমন উৎপাত লাগালে যে , সব ক’টাকে আমি ইঁদুর-কলে ধরে বিদায় করেছি। তুমি ভুল খবর শুনেছ, ইঁদুর আমি চড়িনে, হস্তীবেশেও সঙ সেজে আমি হাওয়া খেতে যাইনে, নিশ্চয়ই কেউ তোমায় ঠকিয়েছে!”
রিদয় অবাক হয়ে বললে “সে কি মশায়, ঘরে-ঘরে ইঁদুর চড়া আপনার ছবি, তাছাড়া আমি নিজে চোখে দেখেছি আপনি ঢোল বাজিয়ে ইঁদুর নাচ করছেন, আমাকে শাপ পর্যন্ত দিয়ে এলেন, এখন বলছেন উল্টো, আমাকে ছলনা করছেন!”
গণেশ গম্ভীর হয়ে বললেন – “বাপু আমি যাই করি, এটুকু জেনো আমি ছলনাও করিনি শাপও দিইনি! ইঁদুরেও চড়িনি কোনোদিন, ঢোলও পিটিনি। ওই আমার দারোয়ানগুলো মাঝে-মাঝে হোলিতে দেওয়ালিতে ঢোল পিটিয়ে আমার কান ঝালাপালা করে, ওদের গিয়ে শুধোও। যদি আর কোনো গণেশ থাকে তো বলতে পারিনে।”
রিদয় চোখ মুছে বললে – “মশায় যে আমাকে শাপ দিলেন, এখন শাপান্ত না করলে তো আমি মারা যাই!”
গণপতি চোখ পাকিয়ে বললেন – “কোনো সাপের ওঝাকে গিয়ে শুধোওগে বলে দেবে, কে তোমায় শাপ দিয়েছে আর কেমন করে শাপান্ত হবে – যাও, আমাকে বিরক্ত কর না!”
রিদয় মুখ কাঁচুমাচু করে বললে – “মশায়, আমি গরীব!”
গণেশ বিরক্ত হয়ে মুখ ফেরালেন।
রিদয় জানত স্তুতি করলেই দেবতারা খুশি হন তাই সে একেবারে গলার বস্তর দিয়ে গণেশের রূপ বর্ণনা করে গণেশ বন্দনা শুরু করে দিলেঃ
খর্বস্তল কলেবর গজমুখ লম্বোদর
বিঘ্ন নাশ কর বিঘ্নরাজ,
পুজা হোম যোগে যাগে তোমার অর্চনা আগে
তব নামে সিদ্ধ সর্ব কাজ।
শুণ্ডে তুলি খৈ মোয়া দন্তে খাও চিবাইয়া
ইঁদুর বাহন গণপতি,
আপনি আসরে উর রিদয়ের আশা পুর
নিবেদিনু করিয়া প্রণতি
গণেশ কানে হাত দিয়ে বললেন – “আরে রাম রাম কি বাজে বকছ, তুমি তো ভালো বিপদে ফেললে দেখি, বোসো আমি একবার বাড়ির মধ্যে থেকে আসছি, বিশেষ কাজ আছে।” বলে গণেশ উঠে গেলেন।
এতক্ষণ গণেশের চৌষট্টি কলাবৌ ঘরে কি হচ্ছে দরজার পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছিলেন, কর্তা উঠে যেতেই গণেশ-দাসীকে দিয়ে রিদয়কে ডেকে তাঁরা শুধোলেন – “হ্যাঁগো তুমি কর্তার কাছে কি নালিশ করছিলে?” রিদয়ের মুখে ইঁদুরের খবর শুনে তাঁরা বলে উঠলেন – “ওমা, এই দরবার করতে এসেছ তা বলতে হয়, ওই আমাদের কুমোর-বৌ কর্তার যে মূর্তিগুলো গড়ে-গড়ে ভটচায্যি মশায়ের হাতে দিয়ে লোকের ঘরে-ঘরে বিক্রি করতে পাঠায়, সেই গণেশের সন্ধান তুমি বুঝি সন্ধান করছ? ওই দারোয়ানজীকে বল সে তোমাকে সেই গণেশের দোকান দেখিয়ে দেবে।”
রিদয় কলাবৌদের পেন্নাম করে আবার দেউড়িতে এসে দারোয়ানজীর সঙ্গে আর একটা ঘুপসী ঘরে গিয়ে দেখলে, দোকানঘরের এক-এক কুলুঙ্গীতে এক-এক রকম গণেশ – গোবর-গণেশ তিনি কলম হাতে পুঁথি লিখছেন, সিদ্ধিদাতা-গণেশ তিনি এক ধামা দিল্লীর লাড্ডু নিয়ে বসেছেন, মাড়োয়ারি-পটির টঙ্ক-গণেশ বসে-বসে খালি আকাশে আঁকশি দিচ্ছেন, হেড়ম্ব-গণেশ তিনি খুব আড়ম্বর করে ঢোল পিটছেন।
রিদয় ঢিপ করে তাঁকে নমস্কার করে বললে – “গণেশদাদা, চিনতে পারেন?” হেড়ম্ব রিদয়ের কথার জবাব দিলেন সমস্কৃত দেবভাষায় “বুং!” রিদয় ভাবলে এ তো মুশকিল, যদি বা কত কষ্টে এসে ধরলেম এখন কথা না বুঝলে উপায়? সে একবার ইঁদুরের দিকে, একবার ঢোলকের দিকে, একবার নিজের দিকে আঙুল নেড়ে ইশারায় বোঝালে ঢোলকটা চাই। গণেশ ঢোলকটা রিদয়কে দিয়ে ওদিক-ওদিক শুঁড় নেড়ে কি বললেন বোঝা গেল না। রিদয় শুধু শুনলে – “বুং চটাপট্ ত্বং কং করং বাদনং পুনস্তম্ ব্যস্তম্ নাদম্ কুণ্ডমকুলম্ পৌউন্ড্রবর্ধমনম্ গণ্ডস্থলম্ আগচ্ছতু।
রিদয় গণেশের মুখ দেখে বুঝলে তিনি খুশি হয়েছেন। সে অমনি আচার্যি পুরুতকে দুর্গোপুজোয় শ্রাদ্ধে শান্তিতে যেমন করে সব মন্তর আওড়াতে শুনেছিল ঠিক তারি নকলে বললে –“হুং ভূত স্বাহা, কুরু-কুরু কুণ্ডলিনী নমোঃ আসিতো দেবল গৃহ্যং কুরু ভুত্যং হং যং ছট ফট ব্রহ্মবিদ্যা হবিষে স্বাহা অহঃ চিটপটাং হুং শান্তি ভূশান্তি ভ্যূতেরশান্তি অষুধেঃশান্তি ছিহরি ছিহরি ছিহরি হরিবোল হরিবোল হরিবোল সূর্য প্রণাম।” গণেশ খুশি হয়ে দুবার ঘাড় নেড়ে “তথাস্তু” বলে চোখ বুজলেন।
রিদয় আস্তে-আস্তে ঢোলক নিয়ে বেরিয়ে এল। দারোয়ান ঘরের দুয়োরেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে অমনি বখশিশের জন্যে হাত পাতল, রিদয় এদিক-ওদিক দেখে আস্তে-আস্তে মান-কচুর শিকড়টি বার করে বললে – “দারোয়ানজী আর তো সঙ্গে কিছু নেই, এইটে নাও।”
দারোয়ান “হাৎ-তেরি”, বলে হাত ঝাড়া দিলে।
শিকড় যেমন মাটিতে পড়া অমনি পেঁচা রিদয়কে ছোঁ দিয়ে একেবারে ঘুরোনো সিঁড়ি বেয়ে ছাতে এসে উপস্থিত। সঙ্গে-সঙ্গে পেঁচো এসে রিদয়কে পেয়ে বসল – রিদয় অজ্ঞান হয়ে পড়ল আর বহুরূপীর চামড়ার মতো তার গায়ের রং লাল, নীল, হলদে, রকম-রকম বদলাতে আরম্ভ করলে। হাড়গিলে অমনি তাড়াতাড়ি ছুটে এসে মন্তর পড়ে পেঁচো ঝাড়াতে বসে গেলেনঃ
স্কন্ধাপসার শকুনী
অন্ধ পুতনা শীত পুতনা মুখমণ্ডিকা
নৈগমেষ প্রসীদতু
ক্লীং চর্চ হুং হুং ঝংশা
ওঁলং শ্রীং কপালিকং জং জং
তিষ্টতি মূষিকং চং চং চর্বশং হংসঃ
হুং ফট্ স্বাহা।
মন্তরের চোটে রিদয় হাঁ করলে, যেন খেতে এল, অমনি চট করে হাড়গিলে ধুলোপড়া বেড়ি দিয়ে পেঁচোর মুখবন্ধন করে দিলেনঃ
ধুল-ধুল স্বর্গের ধুল
মর্তের মাটি
লাগ-লাগ পেঁচোর দন্ত কপাটি
হাঁ করে নাড়িস তুণ্ড খা পেঁচির মুণ্ড
যাঃ ফুঃ
কার আজ্ঞে হাড়িপ বাবার আজ্ঞে
হাড় মড়-মড় হাড়গিলের আজ্ঞে
শিগ্রি যাঃ শিগ্রি যাঃ।
পেঁচো রিদয়কে ছেড়ে পালাতেই রিদয় ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। চকা রিদয়ের কানে কানে শুধোলো – “গণেশ কি বললেন?”
রিদয় বললে – “তা তো সবটা বুঝলুম না, কেবল আসবার সময় তিনি বললেন – তথাস্তু।”
চকা হেসে বললে – “তবে আর কি, কেল্লা মার দিয়া। আর তোমার ভয় নেই। একদিন সকালে উঠে দেখবে, যে রিদয় সেই রিদয় হয়ে গেছ। চল এখন যুদ্ধং দেহি করা যাক গে।”
এদিকে কেল্লা খালি পেয়ে চুয়োর দল এ-ওর পিঠে চড়ে একটা ঘুলঘুলি দিয়ে কেল্লার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটার পর একটা নেংটি ইঁদুরের গড়-ভাণ্ডার সব দখল করে লুঠের চেষ্টায় দলে দলে পিলপিল করে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে তেতলায় চৌতলায় পাঁচতলায় উঠে ছতলায় রাজসভায় ঠাকুরবাড়িতে, এমন কি অন্দরমহলে পর্যন্ত ঢোকবার যোগাড়, দু-একটা চুয়ো ছাতেও উঠে হাড়গিলের বাসাটা পর্যন্ত প্রায় এগিয়েছে। এমন সময় উত্তর দক্ষিণ থেকে নেংটি ইঁদুরের দলকে খবর দিয়ে চকার বাকি হাঁসেরা ফিরে এল। ঠিক সেই সময় গণেশের ঢোলকে রিদয় চাঁটি বসালে – ধিক-ধিক-ধিক ধাঁকুড়-ধাঁকুড়।
ঢোলের শব্দে চুয়োর দল লেজ উঁচু করে শিউড়ে উঠে যে যেখানে ছিল থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর তালে-তালে লেজ দোলাতে-দোলাতে দলে-দলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলে। চুয়োতে-চুয়োতে কেল্লার প্রকাণ্ড ছাত ভরে গেল, রিদয় চুড়োয় বসে ঢোল বাজাচ্ছে –
চুয়ো, হাততালি দুয়ো
নেংটি ধিং নিগিরি টিং
ধাতিং তিং নাতিং থিং
চুয়ো, হাততালি দুয়ো।
আর সব চুয়ো লেজে-লেজে জড়াজড়ি করে নৃত্য করছে, পেঁচা পালক ফাঁপিয়ে, বেরাল লেজ ফুলিয়ে, হাড়গিলে গলার থলি দুলিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাল দিচ্ছে! সব চুয়ো যখন ছাতে এসে জড়ো হল, তখন রিদয় চকার পিঠে ঢোল বাজাতে বাজাতে আকাশে উড়তে আরম্ভ করলে, চুয়াগুলো নাচতে নাচতে লাফাতে থাকল। আনন্দে তারা মনে করলে যেন সবার ডানা গজিয়েছে, তারা প্রথমে ছাতের পাঁচিল, তারপর ছাতের আলসে, শেষে একেবারে আকাশে ঝম্প দিয়ে ডিগবাজী খেতে-খেতে মাটিতে এসে পড়ে জোড়া-জোড়া হাঁ করে আকাশের পানে চার পা তুলে চেয়ে রইল।
চুয়োগুলো নাটবাড়ির লীলাখেলা সাঙ্গ করে সরে পড়েছে অনেকক্ষণ। হাড়গিলে, বেরাল, পেঁচা পর্যন্ত ঢোলের আওয়াজে এমনি মশগুল হয়ে গেছে যে পায়ে-পায়ে কখন সবাই একেবারে ছাতের প্রায় কিনারায় এসে পড়েচে টেরই পায়নি, হঠাৎ রাত একটার ঘণ্টা পড়ল অমনি রিদয় ঢোল বন্ধ করলে, সবাই চটকা ভেঙে দেখলে কেল্লা খালি, আকাশে অমাবস্যার চাঁদ দেখা দিয়েছে, চুয়ো আর একটাও নেই। রিদয়কে নিয়ে চকা উড়ে চলেছে। হাড়গিলে, পেঁচা চটকা ভেঙেই দেখলে বেরাল আলসে থেকে আকাশে একটা পা বাড়িয়ে চুয়োদের মতো ঝাঁপ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে আর কি! হাড়গিলে তার লেজ ধরে এক টান দিয়ে বললে – “কর কি, পড়ে মরবে যে!”
বেরাল ফ্যাল-ফ্যাল করে খানিক চেয়ে থেকে – “ইকি” – বলেই ফ্যাঁচ করে হেঁচে আস্তে-আস্তে পিছিয়ে এল।
ওদিকে নেংটির দল আস্তে-আস্তে কেল্লায় এসে যে যার ঘরে ঢুকে ধান ভানতে বসে গেল। চুয়ো তাড়াবার জন্যে হেড়ম্ব-গণেশের ঢোলককে ছাড়া আর কাউকে যে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার সেটা তাদের মনেই এল না!
রাতের মধ্যে পেঁচার দল প্রায় বারো আনা মরা চুয়ো খেয়ে সাফ করে দিলে, বাকি যা রইল সেগুলোর উপরে সকালবেলায় কাক চিল এসে পড়ল। বেলা আটটার মধ্যে সব সাঙ্গ হয়ে গেল।
আজ অমাবস্যা তিথি, রাত্তিরটা হিমালয়ের এপারটায় কাটিয়ে কাল থেকে হাঁসেরা পাহাড়ের ওপারে নিজের-নিজের দেশের দিকে রওনা হবে, দেশের কথা ছাড়া আজ আর কারু মুখে অন্য কথা নেই। আকাশে মেঘ করেছে, বিষ্টি নেই, কেবল ঠাণ্ডা হাওয়া আর শিতালু বাতাস। মাথার উপর দিয়ে দলে-দলে পাখি হু-হু করে উত্তরমুখো চলেছে – সবাই দেশে যেতে ব্যস্ত, তার উপর এ-বছর পাখিদের বারোয়ারি পড়েছে। কুঁচেবক কুঁচিবক তারা বারোয়ারির নেমতন্ন করতে বেরিয়েছে, যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে চেঁচিয়ে তারা জানাচ্ছে পুন্নিমার দিনে বারোয়ারিতে যেতে হবে ভারি জলসা।
চকা নিমন্ত্রণ পেয়ে চারি খুশি, রিদয়কে বললে – “তোমাদের দুজনের কপাল ভালো, বারো বছর অন্তর কৈলাস-পর্বতের ধারে মানস-সরোবরে এই বারোয়ারি মজলিস হয়, সেখানে সারসের নাচ, হরিণ-দৌড়, আর্গিন পাখির কনসার্ট, গাঙ-শালিকের গীত, ছুঁচোর কেত্তন, শেয়ালের যুক্তি, মেড়ার লড়াই, ভালুক-নাচ, সাপ-বাজি, মাছের চান, এমনি আরো কত কি হবে তার ঠিকানা নেই। ব্রহ্মার হাঁস কর্মকর্তা, স্বয়ং পশুপতি হবেন সভাপতি, পৃথিবীর পশুপক্ষী সেখানে হাজির হবে। মানুষের কপালে এমন আশ্চর্য কারখানা দেখা এ-পর্যন্ত ঘটেনি, কোথায় লাগে তোমাদের হরিদ্বারের কুম্ভমেলা! আর পাহাড়ের ওধারে আমাদের দেশটা কি চমৎকার তোমায় কি বলব, পালতি জলা – যেটা ব্রহ্মার হাঁস আর পৃথিবীর জলচর পাখি, কি পোষা কি বুনো সবাইকার আড্ডা, সেটা যে কত বড় তা কেউ জানে না, উত্তরের সমস্ত নদী পাহাড় এসে সেইখানেই শেষ হয়ে আবার নতুন-নতুন নাম নিয়ে দক্ষিণ দিকে নেমে এসেছে। এই পালতির উত্তর গায়ে ঢোলা পর্বত, সেই ঢোলা পর্বতের ওপারে পাঁচিলে ঘেরা চীন মুল্লুক, তারো ওধারে বরফের দেশের ধারে ‘তন্দ্রা’ বলে একটা দেশ। বছরে প্রায় দশ মাস সেখানে বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে ফুল পাতা নদ নদী সবাই ঘুমিয়ে থাকে, কেবল বসন্তের মাস দুই সেখানে সূর্য দেখা দেন, আর অমনি সারা দেশ ফুলে-ফলে পাতায়-ঘাসে দেখতে-দেখতে সবুজ হয়ে ওঠে, আর আমরা সব পাখিরা মিলে সেখানে গিয়ে বাসা বেঁধে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে চলে আসি। বসন্তের শেষে পালতি জলায় বাচ্চারা বড় হবার জন্যে আপনারাই উড়ে আসে, আমরা সারা বছর দেশে-বিদেশে ঘুরে আবার বছরের এই সময়টিতে গিয়ে দেখি আমাদের ছেলে-পিলেরা কেউ বড় হয়েছে, কেউ বড় হয়ে নিজের পথ দেখে নিতে বিদেশে চলেছে, কোনো-কোনো বাচ্চা বা মরে গেছে, কেউ-কেউ বা এরি মধ্যে বিয়ে-থাওয়া করে ঘরকন্না পাতবার চেষ্টায় আছে, কোনো বাচ্ছা বা সন্ন্যাসী হয়ে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, কাউকে ধরে মানুষে খেয়ে ফেলেছে, কাউকে মানুষে গুলি করে মেরে ফেলেছে, আর কাউকে বা তারা জেলখানার মতো খাঁচায় ভরেছে, আর কাউকে বা ডানা কেটে পোষ মানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। বছরের এই সময়টিতে আমরা একবার করে নিজেদের জন্মস্থানে আর পুরনো বাসায় ফিরে আসতে পাই, নিজের ছেলেমেয়ের দেখা পাই, সুখ-দুঃখের দুটো কথা কয়ে নিই, তারপর আবার চলে এদেশ-সেদেশ করে।”
রিদয় বলে উঠল – “আমারও তো দেশ আছে কিন্তু আমার তো সেখানে ফিরতে একটুও ইচ্ছে হয় না।”
চকা বললে – “সে কি! তোমার বাপ মা কেউ নেই নাকি? যখন বড় হবে, বৌ সংসার হবে, ছেলে-পুলে নাতি-পুতি হবে তখন বুঝবে সারা বছরের পরে দেশে ফিরতে কি আনন্দ। তখন দেশের ডাক যখন এসে পৌঁছবে দেখবে মন অমনি উধাও হয়ে ছুটেছে আর কিছুতে মন বসছে না, প্রাণ নীল আকাশে প্রজাপতির মতো সোনার পাখনা মেলে দিয়ে উড়ে পড়তে চাচ্ছে, তখন দেশের কথাই কইতে থাকবে। এর সঙ্গে, তার সঙ্গে, দিন নেই রাত নেই কি সকাল কি সন্ধ্যে কেবল বঁধুর মুখে মধুর হাসিই মনে জাগবে তখন।”
চকার কথা শুনতে-শুনতে রিদয় কেমন আনমনা হয়ে গেল। সারাদিন ধরে আজ কেবলি মনে পড়তে লাগল – আমতলির সেই ঘর ক’খানি, সেই তেঁতুলতলার ঘাট, তেপান্তর মাঠ, হাঁসপুকুরের কাদা জল, তাতে শালুক ফুল, বাড়ির ধারে ঝুমকো-লতার মাচা তার উপরে দুগ্গা টুনটুনি পাখিটি, উঠোনের কোণে তুলসীমঞ্চটি, কালো মাটি-লেপা ঘরের দেওয়াল তার উপরে মায়ের হাতে লেখা লক্ষ্মীপুজোর আলপনা, দড়ির আলনায় বাপের কোঁচানো চাদর, পুরোনো শোবার তক্তা তার উপরে শীতলপাটি আর লাল ঝালর দেওয়া তালপাতার পাখাখানি। সব আজ পরিষ্কার যেন রিদয় চোখে দেখতে লাগল, আর থেকে-থেকে মন তার ঘরে যেতে আকুলি-বিকুলি করতে থাকল – সকাল কেটে দুপুর হয়েছে, তখনো রিদয় আকাশের দিকে চেয়ে ঘরের কথা ভাবছে – দলে দলে কত পাখির ঝাঁক দেশমুখে চলে গেল – “চল-চল চলরে চল” বলতে-বলতে। নাটবাড়ির জলায় যত পাখি –
কাদাখোঁচা জলপিপি কামি কোড়া কঙ্ক
পালতির কুঁচেবক আর মৎস্য বঙ্ক।
ডাহুকা ডাহুকি আর খঞ্জনা খঞ্জন
সারস সারসী যত বক বকীগণ।
তিত্তিরা তিত্তিরা পানিকাক পানিকাকি
কুরবী কুরল চক্রবাক চক্রবাকি।
সবাই দলে-দলে দেশমুখে উড়ে পড়ছে! রিদয় দেখলে মাথার উপর দিয়ে কত পাখির ঝাঁক দেশ-বিদেশ থেকে, কেউ বন ছেড়ে, কেউ খাঁচা ভেঙে হু-হু করে দেশে চলেছে –
ময়না শালিক টিয়া তোতা কাকাতুয়া
চাতক চকোর নুরী তুরী রাঙ্গচুয়া।
ময়ূর ময়ূরী সারিশুক আদি খগ
কোকিল কোকিলা আদি মরাল বিগহ।
সীকরী বহরী বাসা বাজ তুরমতী
কাহা-কুহি লগড় ঝগড় জোড়া ধুতি।
শকুনী গৃধিনী হাড়গিলা মেটেচিল
শঙ্খচিল নীলকণ্ঠ শ্বেত রক্ত নীল।
ঠেকি ভেটি ভাটা হরিতাল গুড়-গুড় –
বাকচা হারিত পারাবৎ পাকরাল
হাতারিয়া করকটে ফিঙ্গা দহিয়াল।
চড়ুই মুনিয়া পাবদুয়া টুনটুনি বুলবুলি ফুলঝুঁটি ভিংরাজ রঙে-রঙে সবুজে-লালে সোনালীতে-রুপোলীতে আকাশ রাঙিয়ে চলেছে যে যার দেশে বাতাসে ডানা ছড়িয়ে। রিদয় কেবলি বসে-বসে দেখতে লাগল আর মনে-মনে বলতে লাগল – “যদি ডানা পেতুম!”
পাখিদের দেখাদেখি ভীমরুল ডাঁশ মশা দলে-দলে উড়তে আরম্ভ করেছে, চকার দলের হাঁসেরা আর থির থাকতে পারছে না। এখনো সারারাত এখানে কাটাতে হবে, তারা কেবলি উসখুস করছে আর ডানা ঝাড়া দিচ্ছে!
চকা একবার রিদয়ের কানের কাছে বলে গেল, যা কিছু নেবার আছে সঙ্গে, এইবেলা বেঁধে-ছেঁদে রাখ, কাল ভোরেই রওনা হতে হবে। রিদয়ের দেশের জন্য মনটা আনচান করছে কিন্তু বেড়াবার শখ এখনো মেটেনি। সে পথের মাঝে নিজের আর খোঁড়ার জন্যে গোটাকতক গুগলী টোপাপানা এটা-ওটা সেটা নিয়ে উলুখেড়ের একটি গেঁজে বুনতে বসে গেল।
থলেটা তৈরি হতে প্রায় সন্ধে হয়ে এলো। হাঁসেরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চোখ বুজে রাতটা কোনো রকমে কাটিয়ে দেবার যোগাড় করছে এমন সময় চকা এসে রিদয়কে শুধালো – “খোঁড়াকে দেখেছ কি? তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” রিদয় তাড়াতাড়ি থলে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বললে – “সে কি, গেল কোথায়, শেয়াল নিলে না তো?”
চকা শুকনো মুখে বললে – “এই তো একটু আগেই ছিল, হঠাৎ গেল কোথায়!”
রিদয় বিষম ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক খোঁজা-খুঁজি করতে লাগল। একে সন্ধ্যা হয়ে গেল, যেখানে পাখির ডাক শোনে সেইদিকে রিদয় ছুটে যায় ঝোপ-ঝাড় নেড়ে দেখে, নাম ধরে ডাক দেয়, এমনি সারারাত রিদয় ছুটোছুটি করতে লাগল অন্ধকারে জল কাদা ভেঙে! নাটবাড়ির উঠোনটা পর্যন্ত রিদয় খুঁজে এল, কিন্তু সুবচনীর খোঁড়া-হাঁস কোথাও নেই!
এদিকে সকাল হয়ে এল, চকা বললে – “সে নিশ্চয়ই অন্য দলে মিশে এগিয়ে গেছে, আর মিছে খোঁজা, চল আমরা বেরিয়ে পড়ি, সময় উৎরে যাচ্ছে!”
রিদয় ঘাড় নেড়ে বললে – “তাকে না নিয়ে আমি এখান থেকে নড়ছিনে, তোমরা যেতে চাও যাও।”
চকা মুশকিলে পড়ল! রিদয় নড়তে চায় না, এদিকে সব হাঁসেরই দেশে যাবার টান রয়েছে, তবু খোঁড়ার সন্ধানের জন্যে চকা আরো এক ঘণ্টা দেরি করলে, তাতেও যখন খোঁড়ার সন্ধান পাওয়া গেল না তখন তারা রিদয়কে একলা রেখে চট করে দেশ থেকে ঘুরে আসবার জন্য উত্তরমুখে উড়ে পড়ল – আসি-আসি বলতে-বলতে।
চকার দল চলে যেতে রিদয়ের চারদিক যেন শূন্য বোধ হতে লাগল! সে আস্তে-আস্তে নাটবাড়ির ভাঙা পাঁচিলটা আর একবার সন্ধান করতে চলেছে, এমন সময় দূর থেকে দেখলে খোঁড়া কিরাশ-কলমীর ডাঁটা মুখে নিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে পাঁচিলের গায়ে একরাশ ভাঙাচোরা পাথরের মধ্যে গিয়ে সেঁধোলে। এমনি খোঁড়াকে শেওলাগুলি নিয়ে সেখানটায় আনাগোনা করতে দেখে রিদয়ও লুকিয়ে-লুকিয়ে পাঁচিলে উঠে দেখলে – জড়ো করা পাথরের মধ্যে চমৎকার ছাই রঙের একটি বালিহাঁস শুয়ে আছে, খোঁড়া তার মুখে খাবার তুলে-তুলে দিচ্ছে আর দুজনে কথা হচ্ছে – “আজ কেমন আছ? তেমনই? ডানার ব্যথাটা যায়নি?”
“না, এখনো নাড়তে গেলে বুকটায় ব্যথা করে।”
“মানুষগুলো ক নিষ্ঠুর! ভাগ্যি গুলিটা বুকে লাগেনি।”
“লাগলে আর কি হত, না হয় মরে যেতুম!”
“ছি-ছি অমন কথা বল না, আমার ভারি দুঃখ হয়।”
“আমি তোমার কে যে আমার জন্যে দুঃখ হবে; আজ এই দেখা শোনা এত ভাব এত যত্ন, কাল হয়তো তুমি চলে যাবে, দুদিন পরে মনেও থাকবে না, কে বালি কোথাকার বালি!”
খোঁড়া ঘাড় নেড়ে বললে – “অমন কথা বল না, যতদিন বাঁচব তোমায় ভুলব না, জলার মধ্যে এই দিনটি মনে থাকবে!”
বালিহাঁস একটু ঘাড় হেলিয়ে খোঁড়ার গা ঘেঁষে বললে – “আমি দল ছাড়া হয়ে পড়লুম, কতদিনে সারবো তার ঠিক নেই।”
খোঁড়া বুক ফুলিয়ে বললে – “ভয় কি আমি তোমার কাছে রইলুম, এখন একটু ঘুমোও আমি একবার ঘুরে আসি।”
খোঁড়া চলে গেলে রিদয় আস্তে-আস্তে গর্তের মধ্যে ঢুকে দেখলে এমন সুন্দরী হাঁস সে কোনোদিন দেখেনি, এতটুকু তার মুখটি, পালকগুলি নরম যেন তুলো, সাটিনের মতো ঝকঝক করছে, চোখদুটিও কাজলটানা যেন ঢলঢল করছে! রিদয়কে হঠাৎ দেখে বালিহাঁস ভয় পেয়ে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু বেচারার ডানায় বেদনা, উড়তে পারে না, বালি চআঁ করে কাঁদতে লাগল।
রিদয় তাড়াতাড়ি বললে – “আমি হংপাল হাঁসেদের বন্ধু, খোঁড়া-হাঁসের সেঙাত, আমায় দেখে ভয় কি?”
বালিহাঁস রিদয়ের কথায় সাহস পেয়ে ঘাড়টি একটু নিচু করে বললে – “তাঁর মুখে আপনার নাম শুনেছি, আপনি অতি মহাশয় লোক।” এমনি ভাবে এই কথাগুলি বালি বললে যে, রিদয়ের মনে হল কোনো রাজকন্যে যেন তার সঙ্গে আলাপ করছেন!
রিদয় বললে – “দেখি, আপনার কোথায় হাড়টা ভেঙেছে সোজা করে দিই।” আস্তে-আস্তে বালিহাঁসের ডানার তলায় হাত দিয়ে রিদয় মচকানো হাড়টা ধরে খুট করে যেমন সরিয়ে দেওয়া, অমনি বালিহাঁসটি “মাগো” বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
রিদয় কখনো ডাক্তারি করেনি, পাখিটা মরে গেল ভেবে সে তাড়াতাড়ি পাছে খোঁড়া এসে দেখে সেই ভয়ে লম্ফ দিয়ে চোঁচা চম্পট। খোঁড়া বেশিদূর যায়নি, দু-ঢোক জল খেয়েই ফিরে আসছে, পথের মধ্যে রিদয়ের সঙ্গে দেখা! রিদয় তাড়াতাড়ি খোঁড়াকে বললে – “কোথায় ছিলে, সবাই যে চলে গেল, সারারাত তোমাকে খোঁজাখুঁজি করেছি, চল আর দেরি নয়, এই বেলা গিয়ে তাদের ধরি; বেশিদূর এখনো যায়নি!”
খোঁড়া আমতা-আমতা করে বললে – “বোসো, এখনই যেতে হবে? এত শিগ্রি কি না গেলেই নয়!”
রিদয়ের ভয় হল পাছে খোঁড়া গিয়ে দেখে বালিহাঁস মরে গেছে। সে তাড়াতাড়ি খোঁড়ার পিঠে চেপে তাকে ওড়াবার চেষ্টা করতে লাগল।
খোঁড়া ঘাড় নেড়ে বললে – “দেখ ভাই আমার এক বন্ধু বড় বিপদে পড়েছে, তাকে একলা ছেড়ে যাওয়া তো হতে পারে না, বেচারার ডানাটি জখম হয়েছে নড়তে পারে না, আমি গেলে তাকে কেবা খাওয়ায় আর কেই বা যত্ন করে!”
রিদয়ের ইচ্ছে হাঁস সেদিকে না যায়, সে কেবলি তাকে ফেরাতে চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু খোঁড়ার মন পড়ে আছে সেই রূপকথার রাজকন্যের মতো সুন্দর সেই বালিহাঁসের দিকে। রিদয়কে নিয়ে একবার উত্তরমুখে উড়ল, কিন্তু খানিক পথ গিয়েই বলল – “ভাই, বড় মন কেমন করছে, মানস-সরোবরের এই নাটবাড়ির চালায় দু-চারদিন কাটিয়ে চল বাড়িমুখো হওয়া যাক্, দেশে যাবার জন্যে মন টেনেছে আর ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগছে না।”
রিদয়েরও মনটা সকাল থেকে দেশের দিকেই টানছিল, সে কোনো কথা কইল না। খোঁড়া-হাঁস আস্তে-আস্তে উড়ে এসে আবার নাটবাড়ির ধারে নামল ঠিক বেছে-বেছে সেইখানটিতে, যেখানে তার বালিহাঁস রয়েছে। খোঁড়া রিদয়কে পিঠ থেকে নামিয়ে গলা উঁচু করে দুবার ডাক দিলে – “বালি ও বালি!” কোনো উত্তর এল না, তারপর ছুটে গিয়ে দেখলে পাথরের মধ্যে শুকনো ঘাস পাতা বিছানো তাদের দুদিনের বাসাটি খালি হা-হা করছে, কেউ কোথাও নেই। রিদয় চুপ করে রইল, ভাঙা গলায় খোঁড়া-হাঁস আবার ডাক দিলে – “বালি, কোথায় বালি!”
রিদয় ভাবছে নিশ্চয় শেয়াল এসে মরা হাঁসটা টেনে নিয়ে গেছে, ঠিক সেই সময় জলার ধারে বেনা-বনের সবুজ পাতাগুলো নড়ে উঠল, তার পরেই মিঠে সুরে – “এই যে আমি, একটু গা ধুয়ে নিচ্ছি” বলে বালি আস্তে-আস্তে জলা থেকে উঠে এল! তার ঝকঝকে পালকে শিশিরের মতো জলের ফোঁটাগুলি আলো পেয়ে হীরের মতো ঝকঝক করছে, রিদয়ের মনে হল যেন জলদেবী জল থেকে উঠে এলেন।
খোঁড়া হেলতে-দুলতে বালির কাছে গিয়ে আস্তে-আস্তে গলা চুলকে দিয়ে বললে – “বেদনা কি আছে?” বালি ঘাড় নেড়ে বললে – “একটুও না, তোমার বন্ধুর কৃপায় আর তোমার যত্নে আমি ভালো হয়ে গেছি।” তারপর দুজনে জলে গিয়ে সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলে, রিদয় জলের ধারে বসে একটা বেনার শিষ চিবোতে থাকল।
বালিহাঁসকে সঙ্গে নিয়ে খোঁড়া এর মধ্যে একদিন চুপি চুপি পদ্মবনে পদ্ম-ফুলের সোনালী রেণু এ-ওর গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেরাই নিজেদের গায়ে হলুদ মেখে, মাছরাঙা পাখিদের বৌ-ভাতে মাছ খাইয়ে, বিয়ে-থাওয়া খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে জলার ধারে বাসা বাঁধবার যোগাড়ে আছে, দেশে ফেরার কিম্বা বিদেশে উড়ে চলার আর নামটি করে না। রিদয় শুধোলে বলে – “আমরা যেখানে থাকি সেইখানেই আমাদের দেশ।”
রিদয় বলে – “আমার তো দেশ আছে, আমাকে তো সেখানে যেতে হবে, বিয়ে-থাওয়াও করতে হবে। এই জলার মধ্যে না পাওয়া যায় ভালো খাবার, না আছে ভালো শোবার জায়গা, এখানে বাসা বাঁধলে তো আমার চলবে না।”
বালিহাঁস বললে – “তা বেশ তো, এই জলার ওপারেই একটা গয়লাপাড়া আছে, চলুন আপনাকে তাদের গোয়ালে রেখে আসি। একটি বুড়ি গাই তাদের আছে এক ছটাক করে দুধ দেয়, দুধ ভাত সবই সেখানে পাবেন।”
রিদয় শুধোলে – “আর তোমরা?”
বালিহাঁস লজ্জায় মুখটি নিচু করে রইল। খোঁড়া চুপি-চুপি রিদয়ের কানে-কানে বললে – “ভাই, ওর ডিম পাড়বার সময় হয়েছে, দুটো মাস অপেক্ষা কর, তারপরে সবাই এক সঙ্গে বাড়ি ফেরা যাবে, এই কটা দিন তুমি কোনো রকমে গৌহাটিতে কাটাও।”
হাঁসের বাচ্ছা হবে রিদয় ভারি খুশি, সে একখানা শালপাতার নৌকোতে ভর দিয়ে গয়লাপাড়ার ঘাটে গিয়ে উঠল। গয়লাপাড়া নামেই পাড়া, একঘর বই গয়লা নেই, তাও আবার গয়লা-বুড়ো অনেককাল হল মরেছে, আছে কেবল এক বুড়ি গাই আর এক বুড়ি গয়লানী!
গয়লাবাড়ির উঠোনে ঢুকে রিদয় এদিক-ওদিক চাইতে লাগল, ঘুটঘুটে আঁধার রাতটা বাড়ির কোথাও একটি আলো নেই, কোনদিকে গোয়াল কোনদিকে ঢেঁকিশাল কোথায় বা হেঁসেল কিছুই দেখবার যো নেই, একটা কেবল বেল গাছ ভূতের মতো এঁকে-বেঁকে টেরা-বাঁকা মোচড়ানো-দোমড়ানো শুকনো ডাল নিয়ে উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার উপরে বসে একটা কালো পেঁচা কেবলি চেঁচাচ্ছে – “যো-মেঁ-র বাড়ি-যাঃ, মাথা খাঃ!”
ঝড় উঠল, তার সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টি নামল, আরো দুটি পথিক নেউল, আর খটাস তাড়াতাড়ি উঠোনে ঢুকে এদিক-ওদিক চাইতে-চাইতে রিদয়কে দেখে শুধোলে – “এটা কি গৌহাটির চটি, রাতে থাকবার ঘর পাওয়া যাবে কি এখানে?”
রিদয় বললে – “আমি তো গয়লাবাড়ি বলে এখানে ঢুকেছি কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখছিনে। এটা গোয়াল কি চটি কি ধর্মশালা বা পাঠশালা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, কারু সাড়াশব্দ পাচ্ছিনে, কেবল একটা পেঁচা ডাকছিল একটু আগেই শুনেছি।”
খটাস বললে – “তবে নিশ্চয় এটা গঙ্গাযাত্রীর ঘর!”
নেউল বলে উঠল – “মাঠের মধ্যে কখনো মড়া পোড়ার ঘাট হয়? বাড়িই বটে, তবে একটা কলুর বাড়ি কি গয়লাবাড়ি কিম্বা পুলিসের খাদাবাড়ি তা বোঝা যাচ্ছে না!”
খটাস বললে – “সেটা বোঝবার সহজ উপায় আছে।”
রিদয় শুধোলে – “কোনো বাড়ি সহজে চিনবার উপায় কি প্রকাশ কর!”
খটাস খানিক ভেবে বললে – “মানুষেরা নানা কাজের জন্যে নানারকম বাড়ি-ঘর বাঁধে তা তো জানো – উত্তরমুখো, দক্ষিণমুখো, পূবমুখো, পশ্চিমমুখো। গয়লা বাঁধবে একরকম, তেলি বাঁধবে অন্যরকম, মালি বাঁধবে একরকম, কুমোর বাঁধবে একরকম, আর্ট বোঝো না? কে কি রকম বাঁধবে তার হিসাবটা জানলেই কোনটা কি বাড়ি বোঝা যাবে।”
নেউল বললে – “হিসেবটা কেমন শুনি?”
“শোনো তবে, প্রথমে মালির বাড়ি কেমন তা বলি শোনো,” বলে খটাস খনার বচন আরম্ভ করলেঃ
চৌদিকে প্রাচীর উচা কাছে নাই গলি কুচা
পুষ্প বনে ঢাকে রবি শশি
নানা জাতি ফোটে ফুল উড়ে বৈসে অলি কুল
কোকিল কুহুরে দিবা নিশি।
মন্দ-মন্দ সমীরণ বহে সেথা অনুক্ষণ
বসন্ত না ছাড়ে এক তিল!
রিদয় বলে উঠল – “এখানে তো ফুলের গন্ধ মোটেই পাচ্ছিনে! তবে এটা মালির ঘর নয়।”
“আচ্ছা, গন্ধে গন্ধে বোঝো এটা তেলির বাড়ি কিনা” বলেই খটাস আবার শুরু করলেঃ
সরষের ঝাঁঝে তেলি হাঁচে ফ্যেঁচ-ফ্যেঁচ
বলদেতে ঘানি টানে ঘ্যেঁচ-ঘ্যেঁচ ঘ্যেঁচ।
নেউল বাতাসে নাক উঁচিয়ে বললে – “কই হাঁচি তো পাচ্ছে না! তবে এটা তেলির বাড়ি নয়, মালির বাড়িও নয়।”
“কুমোর বাড়ি কিনা দেখ তো”, বলে খটাস শোলক আওড়ালেঃ
হাঁড়ি পাতিল ঠুকুর ঠাকুর কলসীর কাঁধা
পাতখোলার সোঁদা গন্ধ কুমোর বাড়ি বাঁধা।
রিদয় এদিক-ওদিক নাক ঘুরিয়ে বললে – “নাঃ, কোনো গন্ধই পাচ্ছিনে!”
“আচ্ছা দেখ দেখি গয়লাবাড়ি কিনাঃ”
গোয়াল ঘরে দিচ্ছে হামা নেহাল বাছুর
ঘোল মউলি বলছে ঘরে গাবুর গুবুর
ভালো দুধ টোকো দই দিচ্ছে সেথা বাস
মোষ দিচ্ছে নাক ঝাড়া গরু চিবায় ঘাস।
রিদয় পুবদিকে নাক তুলে বললে – “এসব কিছুই নেই এখানে!”
নেউল পশ্চিম দিকে শুঁকে শুঁকে বললে – “যেন ভিজে ঘাসের গন্ধ পাচ্ছি।”
খটাস উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম চারদিকে কান পেতে নাক ঘুরিয়ে বললে – “এটা গয়লাবাড়ি বটে, কিন্তু তেমন গোঁড়া গয়লা নয়, শব্দ আর গন্ধগুলো কেমন ফিকে-ফিকে ঠেকছে, বিচিলী আছে, ঘাসও কিছু আছে, গরুও একটা যেন আছে বোধ হচ্ছে!”
ঠিক সেই সময় বুদিগাই “ওমঃ” বলে একবার ডাক দিলে! তিন পথিক তাড়াতাড়ি সেই দিকে গিয়ে দেখলে – কত কালের পুরোনো চালখানা তার ঠিক নেই, বিষ্টির জলে মাটির দেওয়াল গলে গিয়ে বুড়ো মানুষের পাঁজরের হাড়গুলোর মতো ভিতরের চাঁচ আর খোঁটাখুঁটি বেরিয়ে পড়েছে, দরজার একটা ঝাঁপ খুলে কাটিতে শুয়ে পড়েছে, আর একটা পচা দড়ি ধরে পড়ো-পড়ো হয়ে এখনো ঝুলে রয়েছে! চালের খড় এখানে-ওখানে উড়ে গিয়ে ভিতর থেকে ঘুণ-ধরা বাঁশের আড়া দু-চারটে ফোগলা দাঁতের মতো দেখা যাচ্ছে!
তিন পথিকের পায়ের শব্দ পেয়ে গোয়ালের মধ্যে থেকে বুদি ভাবলে গয়লাবুড়ি তার জাব নিয়ে এল – সে দরজা থেকে মুখটা বাড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখে বললে – “মাগোঃ মাঃ, রাত হল আজ কি খেতে দিবিনে!”
খটাস, রিদয় আর নেউল বুদির কথায় উত্তর দিলে – “তিন পথিক মোরা, রাতের মতো জায়গা মিলবে কি?”
বুদি মাথা হেলিয়ে কেবলি শুধাতে লাগল – “কেগাঃ কে?”
রিদয় বললে – “আমি আমতলির তাঁতির পুত্তুর শাপভ্রষ্ট বুড়ো-আংলা দেশভ্রমণে বেরিয়েছি।”
বুদি নেউলের দিকে শিং হেলিয়ে বললে – “ইনি?”
“নেউল পুত্তুর ইনিও বেরিয়েছেন মৃগয়া করতে।”
খটাসের দিকে চোখ ফিরিয়ে বুদি রিদয়কে শুধোলে – “আর ইনি কে?”
“ইনি হচ্ছেন খটাস পুত্তুর, দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন।”
বুদি গোয়ালের দুয়োর ছেড়ে একপাশ হল, তিন বন্ধুতে বাদলার রাতে গোয়ালে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটাবার যোগাড় করতে চলেছেন, বুদি গাই লেজ নেড়ে বললে –“আর জন্মে কত তপিস্যি করেছে, তাই কাঙালিনীর ঘরে রাজপুত্তুর পাত্তরের পুত্তুর আর কোটালের পুত্তুরের পা পড়ল।” রিদয় খুশি হয়ে বুদির ঘাড়টা একটু চুলকে দিলে, তারপর খড়ের গাদায় শুয়ে তিন বন্ধুতে চোখ বুজলে।
এদিকে বুদিগাই সারাদিন জাব পায়নি, সে পেটের জ্বালায় কেবলি উসখুস করছে – “ওমঃ মাগোঃ কোথায় গেলে আজ কি আর খাব না? ও ভাই রাজপুত্তুর মাচানের ওপর থেকে এক বোঝা খড় নামিয়ে দিতে পার, বড় খিদে লেগেছে!”
রিদয় দেখলে চালের বাতায় মস্ত এক বোঝা খড় চাপানো রয়েছে বটে কিন্তু সেটা টেনে নামানো রিদয়ের সাধ্যি নয়, একটা আঁটি কোনো রকমে টেনে রিদয় বুদির মুখের কাছে ধরে দিলে। গাই খড়গুলো মুখে নিয়ে জাবর কাটতে লাগল।
রিদয়ের একটু তন্দ্রা এসেছে, এমন সময় বুদি আবার বলে উঠল, - “ওমা গো, ভাই পাত্তরের পুত্তুর একটুখানি জল এনে দিতে পার?”
নেউল ঘুমের ঘোরে বললে – “এত রাত্রে জল পাই কোথা!”
বুদি বিনয় করে বললে – “বাইরেই বিষ্টির জল জমা হয়েছে, উঃ বড় তেষ্টা, আমার গলার দড়িটা যদি খুলে দাও তো ওখানে গিয়ে একটু জল খেয়ে বাঁচি!”
নেউল বুদির গলার দড়িটা দাঁতে কেটে দিয়ে বললে – “যাও তবে!”
বুদি দু-পা গিয়ে বললে – “ইস ভারি অন্ধকার, ভাই কোটালের পুত্তুর আমি রাতকানা, যদি গলার দড়িটা ধরে একটুখানি এগিয়ে দিয়ে এস তো ভালো হয়!”
“ভালো বিপদেই পড়া গেল,” বলে খটাস দড়িটা ধরে বুদিগাইকে উঠানের মাঝে টেনে নিয়ে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে সরে পড়ল!
রাত তখন বারোটা, খড়ের গাদায় তিন বন্ধু আরামে নিদ্রা যাচ্ছে, এমন সময় বুদিগাই এসে সবার কানে-কানে বললে – “বড় বিপদ, বুড়িটা মরে গেছে!”
রিদয় তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললে – “সে কি! মরলো কেমন করে?
বুদি নিশ্বেস ফেলে বললে – “দুঃখের কথা কইব কি, এই সন্ধ্যেবেলা সে আমার গলাটি ধরে বলে গেল – “বুদি শুনেছিস এই নাটবাড়ির জলায় রাজা এবার ধান বোনবার হুকুম দিয়েছেন, এতকালে জমি সব আবাদ হবে; আমাদেরও দুঃখ ঘুচবে।” আমি বললেম – “মা, তোমার আর দুঃখু ঘুচবে কি, তোমার ছেলেপুলে ক’টাই বিদেশে গিয়ে সংসার ফেঁদে কাজ-কারবার করতে বসে গেল, বুড়ি মাকে তো তারা একটিবার মনেও করলে না!” মা বললে – “বুদি লো বুদি, তাদের দুষিসনে, ঘরের ভাত পেলে কি তারা আমাকে একলা ফেলে বিদেশে যায়, না পরের চাকরি করে? এইবার তাদের চিঠি দেব দেখিস কেমন না তারা আসে! আমার মরবার সময় সব ছেলেরা এসে আমায় ঘিরে দাঁড়াবে আর আমি ডঙ্কা মেরে স্বর্গে চলে যাব এই সাধটি আমার কি পূর্ণ হবে বুদি!” এই বলে মা ঘরের মধ্যে চিঠি লিখতে গেল, গোয়াল-ঘরে আর জাবও দিতে এল না, পিদুমও জ্বাললে না! সন্ধ্যেবেলা মাকে যেন কেমন-কেমন দেখিনু, তাই বলি একবার যাই দেখে আসি। ওমা, ঘরে ঢুকে দেখি যেখানকার যেটি সব তেমনই গোছানো রয়েছে – পিদুমটি জ্বলছে বিছানা পাতা রয়েছে কিন্তু মা আমার চিঠিটুকু হাতে নিয়ে আলুথালু হয়ে দরজার ধারে পড়ে রয়েছেন, ছেলেরা আসবে ছেলেরা আসবে করেই বুড়ি মলো গো।
“আহা! এই গয়লা বোয়ের দশা কি এমন ছিল। এই বাড়িতে দেখেছি ছেলে-মেয়ে চাকর-বাকর গিসগিস করছে – ঐ নাটবাড়ির সমস্ত জলাটা ওদের জমিতে পড়েছে, আজ এখনও কত জমি যে বেখবর পড়ে আছে তার ঠিক নেই। কর্তা যতদিন ছিলেন যেমন বোলাবোলা তেমনি লক্ষ্মিরছিরি। আহা, ওই গয়লা-বৌ তখন দু-বেলা সেজেগুজে পাঁচজন গয়লানী সঙ্গে গাই দোহাতে আসত, নুপূরের শব্দ শুনলে গাই-গরু সব চারদিক থেকে হামা দিয়ে ছুটে আসত গো। এমন লক্ষ্মী বৌ কচি-কাচা নিয়ে বিধবা হল গো! তখন এক-একদিন আমার গলা ধরে কানতো আর বলতো – “বুদি, আর পারিনে যন্ত্রণা সইতে।” আমি বলি, “মা এই শরীর তোমার, একা সবদিক দেখা কি তোমার কর্ম, দু-চারটে দাস-দাসী নায়েব-গোমস্তা বেশি রাখলে হয় না?” কিন্তু সে বড় কর্মিষ্টি, নিজেদের হাতে ছেলে-মানুষ ধান-বোনা রান্না করা গাই-দোয়া সব করবে! আমি বলি – “মা, শরীর যে ক্ষয় হল!” কিন্তু বৌ কেবলি বলে – “ভালো দিন আসছে বুদি আসছে!” আর ভালো দিন! ছেলেগুলো বড় হয়ে চাকরির চেষ্টায় বিভূঁয়ে টো-টো করতে লাগল, কেউ বিদেশে গিয়ে সংসার পাতলে, ছেলেপুলে হল কিন্তু বুড়িকে আর কেউ দেখলে না। জমি-জমা গহনা-গাঁটি বেচে ছেলেমেয়ে নাতি-পুতি এমনি তিন পুরুষ ধরে সবাইকে বিয়ে দিয়ে চাকরি নিয়ে বিদেশে পাঠাতে-পাঠাতে বুড়ি ক্রমে সর্বস্বান্ত হয়ে না খেয়ে মরবার দাখিল হল! ছেলে-মেয়ে কত যে জন্মাল, মানুষ হল, বড় হয়ে বুড়িকে একলা রেখে চলে গেল, এই গয়লাবাড়িতে ক’পুরুষ ধরে কত কারখানাই দেখলুম যে, তা কি বলি!
“এদানি বুড়ি আর দুঃখু করত না, ছেলেদের কথা হলে বলত – ‘বুদি এখানে এলে তাদের তো কষ্ট বই আরাম হবে না, তবে কেন আর তাদের ডেকে পাঠাই; এই তো ভাঙাবাড়ি, এখানে জায়গা কোথায় তাদের বসবার শোবার খাবার!
ওই বাপ-মা হারা, আমার শিবরাত্রির সলতে বলতে ওই ছোট নাতিটি বেঁচে থাক, মরবার সময় তবু মুখে জল দেবার একজন তো রইল – কি বলিস!’ কিন্তু এ নাতিও বড় হয়ে যেদিন কুলির সর্দারি করতে বিদেশে গেল সেদিন থেকে বুড়ির আর চোখের জল থামল না। সে দিন-দিন কুঁজো হয়ে পড়ল, হাল-গরু জোত-জমা সমস্ত পাঁচভূতে লুটে পালাল, বুড়ি দেখেও দেখলে না – শেষে এখানে আর কেউ রইল না – এই বুদি আর এই বুড়ি ছাড়া। বুড়ি খেতে পায় না দেখে আমি একদিন বললুম – ‘মাগো, কসায়ের কাছে আমাকে বেচলে তো পয়সা পাও, তা কর না কেন!’ বুড়ি আমার গলা ধরে বললে – ‘বুদি সব ছেলেমেয়ে তোর দুধ খেয়ে মানুষ হল তোকে আমি কি ছাড়তে পারি!’ আহা সেই আমার সেঙাতনী, মনিবনী, গিন্নি মা-জননী আজ নিজেই চলে গে; গোঃ, ওমা” – বলে সে অঝোরে কাঁদতে লাগল।
রিদয় অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল – “আহা বুদি, আমতলিতে মাকে আমি এমনি করে ফেলে এসেছি যে!”
বুদি বলে উঠল – “যাও কালই ফিরে যাও, না হলে হয়তো এই বুড়ির মতো ছেলে-ছেলে করে শেষে সেও মরবে। তোমার তো এখনো গিয়ে মাকে দেখবার সময় আছে কিন্তু এই বুড়ির ছেলেরা কি পোড়াকপাল নিয়েই জন্মেছিল, কখনো দেশে এল না, মা মরে গেল তাকেও দেখতে পেলে না!”
সকাল বেলায় মিউনিসিপালের মুর্দোফরাসগুলো এসে বুড়িকে পোড়াতে চলে গেল, খটাস গেল দিগ্বিজয়ে, নেউল চলে গেল মৃগয়াতে, রিদয় বুড়ির ঘর থেকে, তার ছেলেদের নামের ছিঠিখানি ডাকে ফেলে দিয়ে, বুদিকে মাঠে রেখে খোঁড়ার কাছে ফিরে চলল। পাতি-জলার কাছ বরাবর এসে রিদয় দেখলে খোঁড়া-হাঁস সকালে উঠে জলের মাঝে একটা ঢিপিতে দাঁড়িয়ে ডানা ঝাড়ছে, বালি-হাঁস তখনো ঝোপের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। রিদয় সারারাত কিছু খায়নি, হাঁসের কাছে না গিয়ে সে বরাবর বুদিগাইটার পিছনে-পিছনে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল! দু-একটা পাতবাদামের চেষ্টায় রিদয় একটা শিরীষ গাছের উঁচুডালে কাঠবেড়ালিদের ঘরে ভিক্ষে করতে চলেছে। মস্ত শিরীষ গাছ, তার সব উপরের ডালে কাঠবেড়ালিদের খোপ বসতি। এমনি এপাড়া-ওপাড়ায় রিদয় “জয়রাম” বলে গান গেয়ে দাঁড়াচ্ছে আর কেউ এসে তাকে দুটো শুকনো ছোলা, কেউ একটা বাদাম, এমনি টুকি-টাকি ভিক্ষে দিচ্ছে। রামের দোহাই দিলে কাঠবেড়ালিদের ভিক্ষে দিতেই হয়, কিন্তু এক-এক কাঠবেড়ালি গিন্নি ভারি কিপটে, রিদয়কে দূর থেকে দেখেই বলছে – “ওগো ঘরে কিছু নেই, কর্তারা হাটে গেছেন, ওবেলা এস – এখন কিছু হবে না।” রিদয় পাকা ভিখিরী, সহজে ছাড়বে কেন, গান শুরু করলেঃ
বাসনা করায় মন পাই কুবেরের ধন
সদা করি বিতরণ তুমি যত আশ না
আস তাই আরো চাই ইন্দ্রের ঐশ্বর্য পাই
ক্ষুধা মাত্র সুধা খাই মরি-মরি ফাঁস না
ফাঁসনা কেবল রৈল বাসনা পূরণ নৈল
লাভে হতে লাভ হৈল লোকে মিথ্যা ভাসনা!
কাঠবেড়ালি গিন্নি এতেও সাড়া দেয় না, রিদয় এবার হিন্দী গান ধরলেঃ
ধুম বড়া ধুম কিয়া খানে জোনে নাহি দিয়া
চহুঁয়ার ঘেরালিয়া ফোজ কি গিতাপয়া!
আরে চহুঁয়ার, আরে চহুঁয়ার।
এক থোকা শিরীষ-ফুলের তলায় দাঁড়িয়ে বুড়ো-আংলা পেট বাজিয়ে গাইছে, এমন সময় মনে হল তার কোমরের কাপড় ধরে কে টান দিচ্ছে, রিদয় ফিরে দেখতেই একটা কাক ‘খাও’ বলে তার ঠোঁট আর ডান হাতটা চেপে ধরলে, অমনি আর একটা কাক, তারপর আর একটা এসে রিদয়কে ছোঁ দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলল। ডোমকাকের দল রিদয়কে চোখে-মুখে কিছু দেখতে দিচ্ছে না – “যাক-যাক” বলে এর মুখ থেকে ও, তার মুখ থেকে সে, এমনি রিদয়কে ফুটবলের মতো ছুঁড়ে দিতে-দিতে দল বেঁধে গোলমাল করতে করতে চলেছে দেখে বুদি গাই “ওমা-ওমা” করে চেঁচাতে-চেঁচাতে লেজ তুলে ছুটোছুটি করতে লাগল। ইচ্ছেটা কাকগুলোকে শিং দিয়ে গোঁতায়, কিন্তু তারা আকাশে সে বেচারা মাটিতে – বুদি কেবল ধুলো উড়িয়ে মাঠে ছোটাছুটি করতে লাগল!
খোঁড়া-হাঁসও আকাশে কাক দেখে – “ক্যা-ক্যা” বলে একবার ডাক দিলে কিন্তু দেখতে-দেখতে কাকের দল অদৃশ্য হয়ে গেল।
রিদয় চটকা ভেঙে যখন চেয়ে দেখলে, তখন কাকেরা পাতি-জলা পেরিয়ে নাটবাড়ি ছাড়িয়ে কাকচিরের দিকে চলেছে। হাঁসের পিঠে আরামে উড়ে চলা এক, আর কাকের ঠোঁটে ঝুলতে-ঝুলতে চলা অন্য একরকম। রিদয় দেখলে যেন জলা-জমি যেন একখানা ফাটা-ফুটো গালচের উল্টো পিটের মতো পায়ের তলায় বিছানো রয়েছে, সবুজ লাল কালো কত রকমের যেন সুয়োঁ-ওঠা পশমে বোনা, বাঙলাদেশের পরিষ্কার ছককাটা জমির মতো মোটেই নয়, জলগুলো দেখাচ্ছে যেন মাঝে-মাঝে ছোট বড় আয়না ভাঙা।
দেখতে-দেখতে সূর্যি উঠল, আলো পেয়ে মাটি যেন সোনা রুপো আর নানা রঙের উলে-বোনা কাশ্মিরী শালের মতো দেখাতে লাগল। তারপর জলা পার হয়ে বন-জঙ্গল মাঠ-ঘাটের উপর দিয়ে কাকেরা রিদয়কে নিয়ে উড়ে চলল! কাকেরা তাকে ধরে নিয়ে কোথায় চলেছে, কোথা রইল খোঁড়া-হাঁস, কোথায় বা চকার দল, কোথা বুদি, কোথা বালি!
রিদয় ভয় পেয়ে চারদিকে চাইছে এমন সময় ডোমকাক ডাক দিলে – “খবরদার!” অমনি সব কাক রিদয়কে নিয়ে জঙ্গলের তলায় নেমে পড়ল! চোরকাঁটার বনে রিদয়কে ঠেলে ফেলে গোটা পঞ্চাশেক কাক সঙিনের মতো ঠোঁট উঁচিয়ে তার চারিদিকে পাহারা দিতে দাঁড়িয়ে গেল।
রিদয় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললে – “তোরা যে আমাকে বড় ধরে আনলি!”
ডোমরাজা দৌড়ে এসে বললে – “চুপ, কথা কইবি তো চোখ ঠুকরে নেব!”
রিদয় বুঝলে এবার সহজে ছাড়ান নেই, এরা সব ডাকাতে-পাখি। গোলযোগ করলে হয়তো মাথাটাই ফাটিয়ে দেবে। সে কি করে, শুকনো মুখে কাকগুলোর দিকে চেয়ে রইল। কাকগুলোও তাকে ঘিরে ধারাল ঠোঁট বাড়িয়ে একচোখে তাগ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
দূর থেকে দেখে রিদয় ভাবত কাকগুলো বেশ কালো চিকচিকে, যেন কালো আলপাকার চায়না-কোট পরা নতুন উকিল কৌছিঁলের মতো, চালাক চতুর চটপটে। কিন্তু কাছ থেকে কাকগুলোকে রিদয় দেখলে কদাকার কালো কুচ্ছিত যতদূর হতে হয়, পালকগুলো রুখো মড়মড়ে যেন কালিতে ছুপোনো তালপাতা, পাগুলো গেঁটে-গেঁটে কাদামাখা খরখরে, ঠোঁটের কোণে এঁটো ঝোলঝাল মাখানো, একটা চোখ যেন ছানি পড়া আর একটা যেন ময়লা পয়সার মতো তামাটে কালো। কোথায় শাদা ধপধপে সুবচনীর হাঁস আর কোথায় এই কালো কুচ্ছিত কাগের ছা সব।
রিদয় এই কথা ভাবছে এমন সময় মাথার উপরে অনেক দূর থেকে হাঁসের ডাক এল – “কোথায় কোথায়?” রিদয় গলা শুনে বুঝলে খোঁড়া তার সন্ধানে চলেছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে বালি হাঁসও ডাক দিয়ে গেল “সেঙাত সেঙাত!” বনের ওধারটায় বুদিও একবার হাঁক দিলে – “ওগোঃ ওগোঃ!” রিদয় বুঝলে তিনজনেই এসেছে, সে অমনি হাত নেড়ে হেথায় বলে চেঁচাতে যাবে আর ডোমরাজা ছুটে এসে ধমকে বললে – “কিও! আয় দিই চোখ দুটো খুবলে!” রিদয় অমনি মুখ বুজে গোঁ হয়ে বসল।
হাঁসেরা চলে গেল বুদি গাইও ডেকে ডেকে থামল, তখন ডোমকাক হুকুম দিলে – “উঠাও!” দুটো কাক তাকে আবার ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিয়ে ওড়বার চেষ্টায় আছে দেখে রিদয় বললে – “বাপু তোমাদের মধ্যে কেউ পালোয়ান কাক থাকে তো আমাকে পিঠে করে নিয়ে চল, অমন ঝোলাঝুলি করলে আমার হাত পায়ের সব জোড় খুলে যাবে যে!”
ডোমকাক ধমকে বললে – “চল-চল, অত বাবুগিরিতে কাজ নেই। কাগে চড়বেন এত সুখ তোর কপালে – আমরা কি ঘোড়া যে তোকে পিঠে নেব!”
এবারে ঝোড়োকাক এগিয়ে এসে বললে – “মহারাজ, মানুষটাকে হাড়গোড় ভেঙে দ করে নিয়ে গেলে তো ওটা আমাদের কোনো কাজে আসবে না, আমি বরং ওটাকে পিঠে নিই, কি বলেন?”
ডোমকাক মুখ সিঁটকে বললে – “তোমার ইচ্ছে হয় তো ওর পালকি-বেহারার কাজ করতে পার, কিন্তু দেখ পালায় না যেন!”
রিদয় দেখলে ঢোঁড়াকাগটা ওর মধ্যে দেখতে-শুনতে ভদ্দর রকম, সে আস্তে-আস্তে তার পিঠে চড়ে বসল।
কাকের দল ক্রমাগত দক্ষিণ মুখেই উড়ে চলেছে। পরিষ্কার দিনটি খটখট করছে, চারদিকে যেন বাতাস আর আলো ছড়িয়ে পড়েছে, বনের শিয়র দিয়ে রিদয়কে নিয়ে কাকেরা উড়ে চলল।
রিদয় দেখলে বৌ-কথা-কও পাখি বকুল গাছের আগডালে বসে বৌকে শুনিয়ে কেবলই গাইছে – “কথা কও বৌ কথা কও, মাথা খাও বৌ কথা কও!” রিদয় অমনি বলে উঠল – “কথা কইবে কি ছলে, কথা শুনলে গা জ্বলে!”
“কে রে?” বলে হলদী পাখি আকাশের দিকে ঘাড় তুলতেই, রিদয় তাকে শুনিয়ে বললে – “কাকে-ধরা যক্! কাকে-ধরা যক্!”
ডোমকাক অমনি ধমকে উঠল – “আবার কথা!”
আরো দক্ষিণ মুখো গিয়ে রিদয় দেখলে আমবাগানের মাথায় ঘুঘু বসে তার বৌকে গান গেয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছে আর গলা ফুলিয়ে আদর করে ডাকছে – “বুবু ওঠো দেখি ম্ম্।”
রিদয় অমনি বলে উঠল – “আদর দেখ উহুঃ।”
ঘুঘু গলা তুলে বললে – “কে রে কে রে?”
রিদয় তাকেও শুনিয়ে দিলে – “কাকে-ধরা যক্!”
এবার ডোমকাক রেগে রিদয়কে ডানার থাপ্পড় দিয়ে বললে – “ফের বকচিস, চুপ!”
ঢোঁড়াকাক বলে উঠল – “বকুক না যত পারে, পাখিগুলো ভাবচে আমরাও ঠাট্টা তামাশা শিখেছি।”
ডোমকাক আর উচ্চবাচ্য করলে না। রিদয় ঘাঁটিতে-ঘাঁটিতে সব পাখিকে জানিয়ে দিতে-দিতে চলল – তাকে কাকে ধরেছে!
এমনি বন ছাড়িয়ে তারা একটা নগরের উপর এসে পড়ল। নদীর ধারে মস্ত শিব-মন্দির, তারি চুড়োয় ত্রিশূলের ডগায় বসে শালিক তার বৌকে শুনিয়ে রাগরাগিণীতে গলা সাধছে; বৌ তার পঞ্চবটির বাসায় ডিমে তা দিচ্ছে আর কর্তার গান শুনছে – “সা রে গা মা পা – চারটে ডিমে তা, ধা নি সা – দুই জোড়া ছা!”
রিদয় অমনি আকাশ থেকে বলে উঠল – “কাগে খাবে গা!” শালিক “কেও?” বলে মুখ ফেরাতেই রিদয় শুনিয়ে দিলে - “কাকে-ধরা যক্!”
যতই দক্ষিণ দিকে এরা এগোতে থাকল ততই বড়-বড় নদী খাল-বিল ক্ষেত মাঠ-ঘাট গ্রাম-নগর দেখা দিতে থাকল! একটা মস্ত বিলের ধারে একটা হাঁস আর একটা হাঁসের সামনে দাঁড়িয়ে কেবলি ঘাড় নাড়ছে আর বলছে। “চেয়ে দেখ আমি তোরি চিরদিন আমি তোরি।”
রিদয়ের মনে হল যেন খোঁড়া আর বালি দুজনে কথা কইছে; সে অমনি তাদের শুনিয়ে বলে উঠল – “এসা দিন রহে থোড়ি! রহে থোড়ি!”
“কেও-কেও?” বলে হাঁস মুখ ফেরাতেই রিদয় শুনিয়ে দিলে - “কাকে-ধরা যক্!” এমনি যাকে দেখে, তাকেই নিজের খবর শুনিয়ে দিতে-দিতে রিদয় চলেছে!
বেলা দুপুর, কাকের ঝাঁক এক মাঠের জমিতে নেবে সড়া পেসাদ খেতে আরম্ভ করলে। রিদয় খেলে কিনা সে দিকে কারু লক্ষ্য নেই। ডোমকাক রিদয়কে আগলে বসে আছে, এমন সময় ঢোঁড়াকাক একটা ডালিম এনে ডোমকাককে বললে – “মহারাজ দুটো ফল খেতে আজ্ঞা হোক্!” ডালিম ভাঙা কাকের কর্ম নয়, তা ঢোঁড়াকাক জানত – ডোম-রাজা নাক তুলে বললে – “ওই শুকনো ফল আমি খাব, থুঃ!” ঢোঁড়া অমনি রিদয়ের পায়ের কাছে ফেলে, তাড়াতাড়ি রাজার জন্যে যেন ভালো ফল আনতেই যাচ্ছে এইভাবে ছুটে পালাল। রিদয় বুঝলে ঢোঁড়া তার জন্যেই ডালিমটা এনেছে; সে অমনি সেটা দাঁতে চিবিয়ে ছালসুদ্ধ খেয়ে ফেললে।
ভাত খেয়ে ডোমরাজ মঠের চুড়োর উপরেতে গেলেন, অন্য সব কাক খেয়ে-দেয়ে পেট ভরিয়ে রিদয়কে ঘিরে গাল-গল্প শুরু করলে। পাতিকাক দাঁড়কাককে শুধোলেন – “দাদা চুপচাপ ভাবছ কি শুনি!”
দাঁড়কাক গলা খাঁকরি দিয়ে বললে – “ভাবছিলুম এই তল্লাটে এল মিয়া সাহেব একটি মুরগি পুষেছিল, মুরগি ঐ মোসলমানের বিবিকে এত ভালবাসতো যে তাকে খাওয়াবার জন্যে লুকিয়ে বিবির পানের ডাবরে গিয়ে চারটে করে ডিম পেড়ে আসত। মিয়া ডিম খুঁজে-খুঁজে হয়রান, তখন কিন্তু আমাদের মধ্যে কে একটা চালাক কাক সেই লুকানো ডিম খুঁজে বার করেছিল না? তার নামটা কি মনে পড়ছে না। সে কি তুমি না আমি, না ওই ডোম না এই ঝোড়োকাক?”
পাতিকাক বলে উঠল – “ওঃ ! বুঝেছি, আচ্ছা শোনো দেখি বলি, বোষ্টম-বাড়ির সেই বেরালটাকে মনে আছে তো? সেই যেটা বোষ্টম-বৌয়ের হেঁসেলের মাছ রোজ নিয়ে পালাত, কোথায় সে লুকিয়ে মাছটা রাখত তা বোষ্টম না বোষ্টমী না কালো কেউ টের পেত না, সেই মাছের সন্ধান কে-কে পেয়েছিল দাদা, তুমি না আমি, রাজা না মন্ত্রী?”
সব কাক অমনি এগিয়ে এসে নিজের-নিজের বড়াই করতে আরম্ভ করলে। কেউ বললে – “মাছ চুরি আবার একটা কাজের মধ্যে, আমি একবার একটা খরগোসের লেজ ঠুকরে দিয়েছিলাম, আর একটু হলেই সেটাকে নিয়ে ছিলের মতো ছোঁ দিয়ে উড়েছি আর কি, এমন সময় সেটা তার গর্তে সেঁধিয়ে গেল!”
আর এক কাগ বলে উঠল – “আরে বাবা খরগোসছানা বেরালছানা এদের নিয়ে খেলা করেছ – মানুষের কাছে কখনো এগিয়েছ? আমি একবার ফিরিঙ্গির বাড়িতে গিয়ে তাদের টেবিলের রুপোর কাঁটা চামচে চুরি করে সাফ বেরিয়ে এসেছি, একটি পালকে পর্যন্ত আঁচড় লাগেনি!”
রিদয় থেকে-থেকে বলে উঠল – “এই বিদ্যের আবার এত বড়াই, এই বেলা ওসব চুরিচামারি ছাড়, না হলে মানুষ বিরক্ত হয়ে একদিন এমন গুলি চালাতে আরম্ভ করবে যে কাকবংশ ধ্বংস করে তবে ছাড়বে!”
“কি বলিস?” বলে সব কাক রিদয়কে তেড়ে এল, মনে হল এখনি তাকে ছিঁড়ে খাবে।
ঢোঁড়াকাক তাড়াতাড়ি সবাইকে ঠাণ্ডা করে বললে – “ছেলেমানুষ কি বলতে কি বলেছে। থাম হে ওকে মেরো না, রাজা তাহলে ভারি দুঃখিত হবেন। মনে নেই সেই যকের ধনটা বার করা চাই। ছোঁড়াটা না হলে সে কাজটা করে কে? তাছাড়া এটা মানুষ, একে মারলে পুলিস হাঙ্গামা হতে পারে।”
কাকেরা রিদয়কে আর কিছু না বলে ঢোঁড়াকেই ধমকাতে লাগল – “হাঃ মানুষ, ভারি তো উনি বড়লোক যে ভয় করতে হবে, ঢের-ঢের অমন মানুষ দেখেছি – ”
এই সময় ডোমকাক উপর থেকে হাঁক দিলে – “চালাও!” এবারে কাকের দল রিদয়কে নিয়ে কাকচিরার পতিতজমির দিকে চলেছে – গ্রাম নগর আর দেখা যাচ্ছে না, কেবল ধূ-ধূ বালি আর কাঁটাগাছ। মানুষ নেই, গরু নেই, পাখি নেই – কেবল আগুনের মতো রাঙা সূর্যটা পশ্চিম দিকে ডুবছে – সমস্ত আকাশে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়ে।
ভর সন্ধ্যেবেলা ডোমকাক রিদয়কে ধরে নিয়ে কাকচিরার জঙ্গলে এসে নামল। ডোমকাক দূত হয়ে আগে গিয়ে সবার বাসায় খবর দিলে রাজা এলেন, অমনি সব কাকিনী “বা-বা-বা তোবা-তোবা” বলে বাসা ছেড়ে তামাশা দেখতে ছুটল।
শেয়ালের দল আহ্লাদে লেজ ফুলিয়ে হাঁক দিলে – “হুয়া – কয়েদ হুয়া তোফা হুয়া!” চারদিকে হৈ-চৈ – ক্কা-ক্কা হুয়া শব্দ উঠছে, তারি মধ্যে ঢোঁড়া রিদয়ের কানে-কানে বললে – “আমি তোমার দিকে আছি, দেখ খবরদার ওদের কথা শুনে কোনো কাজ কর না। কাজ করিয়ে নিয়েই তোমায় মেরে ফেলবে, সাবধান।”
ডোমকাক এসে রিদয়কে টানতে-টানতে সেওড়াগাছের গোড়ায় গর্তটার মধ্যে নামিয়ে দিলে, রিদয় যেন জেরবার হয়ে পড়েছে এমনিভাবে আধমরার মতো গর্তের মধ্যে শুয়ে পড়ল। ডোম রাজা ডাকলে – “ওঠ, যা বলি তাই কর।” রিদয় যেন শুনতেই পেল না, চোখ বুজে রইল। ডোম তাকে ধরে যকের পেঁটরার কাছে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বললে – “খোল এটা।”
রিদয় ধাক্কা দিয়ে ডোমকে সরিয়ে বললে – “খিদেয় পেট জ্বলছে এখন আমি কাজ করব? আজ রাত্তিরটা না ঘুমিয়ে নিলে আমি কিছু কাজ পারব না, গা-হাত-পা টাটিয়ে গেছে।”
“খোল আভি!” বলে ডোম রিদয়কে ঝাপটা মেরে পেঁটরার গায়ে ঠেলে দিলেঃ রিদয় গোঁ হয়ে পেঁটরা ধরে নেড়ে বললে – “বাবা, যে মরচে-ধরা তালা, এ তো খোলা সহজ নয়, আজ খেয়ে-দেয়ে গায়ে জোর হোক, কাল তখন দেখা যাবে!”
ডোম রেগে রিদয়ের গায়ে একটা ঠোকর বসিয়ে বললে – “খোল বলছি!”
রিদয় এবারে আর রাগ সামলাতে পারলে না, ডোমকে এক থাপ্পড় কষিয়ে কোমর থেকে ছুরি বার করে বললে – “ফের বজ্জাতি, পাজি কোথাকার!”
ডোমকাক রাগে আর চোখে দেখতে পাচ্ছে না – “তবে রে” বলে সে রিদয়ের উপরে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ল, অমনি রিদয় ছুরিটা তার চোখে বসিয়ে দিলে। ডোমকাক দু’বার ডানা ঝটপট করেই অক্কা পেলে।
“হত্যা হুয়া, হত্যা হুয়া”, বলে শেয়াল চেঁচাতে লাগল, “ক্যা-ক্যা” বলে কাকরা গোলমাল করে তেড়ে এল। ঢোঁড়া বোকা সেজে কেবলি রিদয়কে আড়াল করে-করে ডানা ঝাপটাতে লাগল, যেন কতই রেগেছে এইভাবে। রিদয় বিপদ গুণে পেঁটরাটা জোরে টেনে খুলে তার মধ্যে লুকোবার চেষ্টা করতে লাগল। পেঁটরাটা কিন্তু টাকায় পয়সায় ঠাসা, তার মধ্যে জায়গা নেই দেখে দু-চার মুঠো পয়সা বাইরে ছড়িয়ে ফেললে!
এতক্ষণ কাকরা হট্টগোল করছিল যেন কাঙালী বিদেয়ের ভির লাগিয়েছে। পয়সা পড়তে সবাই ছোঁ দিয়ে এক-একটা বাসার দিকে দৌড় – চকচকে পয়সা পেয়ে তারা রাজা, রাজহত্যা সব কথাই ভুলে গেল।
সব কাক যে-যার ঘরে গেছে, তখন ঢোঁড়াকাক এসে রিদয়কে বললে – “তুমি জানো না আমার কি উপকার করেছ। এস আমার পিঠে চড়ো আমি তোমাকে এমন জায়গায় রেখে আসব যেখানে শেয়ালের বাবাও আর ধরতে পারবে না।”
এত হুটোপাটির পর রিদয়ের ঘুম পাচ্ছিল, সে কাকের পিঠে চড়ে ঢুলে-ঢুলে পড়তে লাগল! ঘুমের ঘোরে তার যেন মনে হল অন্ধকারে কাকের চেহারাটা গণেশের ইঁদুরের মতো হয়ে যাচ্ছে – কাগ বগ হাঁস শেয়াল সব একসঙ্গে তার মাথার ভিতরে ঘুরছে। এমনসময় আকাশ থেকে যেন বোধ হল চকার দল হাঁকলে – “কোথায়?”
“হেথায়” বলে যেমন রিদয় চেয়েছে অমনি দেখলে কোঁ করে দরজা খুলে গণেশের মতো পেট নিয়ে তার বাপ ঘরে ঢুকে বললেন – “কিছু ভাঙিসনি তো?”
রিদয় তখন ভয়ে-ভয়ে একবার কুলুঙ্গিটার দিকে চেয়ে দেখলে যেখানকার গণেশ সেখানেই রয়েছে – দুবার মাথা চুলকে রিদয় এক দৌড়ে বাড়ির উঠোনে এসে দেখলে খোঁড়া-হাঁস পুকুর পাড়ে একটা বুনো হাঁসের সঙ্গে ভাব করছে – আর একটা ঝোড়োকাক চালে বসে “কা-কা” করে ডাকছে – গোয়ালঘর থেকে কপ্লে গাই ডাক দিলে “ওমঃ,” ঠিক সেই সময় একটা গুগলী পুকুর ঘাট বেয়ে আস্তে-আস্তে জলে নেমে গেল!
রিদয় পুকুর পাড়ে হাঁ করে কি ভাবছে দেখে রিদয়ের মা কাছে এসে বললে – “কি হল তোর?”
রিদয় মাথা চুলকে বললে – “মা, আমি কি সত্যিই বড় হয়ে গেছি?” বলে আপনার মাথায় হাত বুলাতে লাগল!
সেই সময় ডালিমগাছে টুনটুনি পাখি বলে উঠল – “ওকি রিদয় হল কি!”
“মাথা আর মুণ্ডু হল!” বলে রিদয় পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতার আরম্ভ করলে।
রিদয়ের মা চেঁচিয়ে বললে – “এত বড়টি হলি তবু তোর ছেলেমানুষি গেল না। উঠে আয়, পাঠশালায় যাঃ।”
উত্তর থেকে বড় নদী যেখানে ব্রহ্মপুত্রের জলে এসে মিলেছে ঠিক সেই বাঁকের মুখেই কতকালের পুরোনো ডিমরুয়ার আসামী রাজা আড়িমাওয়ের বাড়ি। নাটবাড়ির নিচেই নদী মজে গিয়ে মস্ত চর পড়েছে। এত কাল থেকে হাড়গিলে পাখিরা এই চর দখল করে আছে যে, ক্রমে চরটার নামই হয়ে গেছে হাড়গিলার চর। এই চরের ওপারেই দেওয়ানগিরি মস্ত একটা বুড়ো আঙুলের মতো আকাশের দিকে ঠেলে উঠেচে। এই দেওয়ান-গিরি হল যত ফরিয়াদি পাখির আড্ডা। একপারে রইল আসামী মাছেদের রাজা আড়িমাওয়ের নাটবাড়ি আর এক পারে দেওয়ানী ফরিয়াদীর আড্ডা দেওয়ানগিরি, মাঝখানে বসে রয়েছেন হাড়গিলে। আসামী ফরিয়াদিতে লড়াই মোকদ্দামা প্রায়ই হয়, তাতে দুই দলই মাঝে-মাঝে মারা পড়ে।
হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং রাজা দুই দলের মধ্যে আরামে বসে দুই দলেরই হাড়-মাস খেয়ে সুখে আছেন, এমন সময় চর মুখে খবর পৌঁছল বুড়ো-আংলা আসছেন। হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং লম্বা-লম্বা পা ফেলে জলের ধারে তাঁর কাশবাগিচায় বেরিয়ে বেড়াচ্ছেন! ‘চুপিম-পা’ আর ‘চোরম-পা’ দুই সেনাপতি পায়ে-পায়ে হাড়গিলের রাজার কাছে হুকুম নিতে এল – রিদয় হংপালকে এ-পথে আসতে দেওয়া হবে কিনা! খাম্বাজং হাড়গিলে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে ঠোঁট উঁচিয়ে ভেবে বললেন – “আসতে দিতে পার।” হঠাৎ দেশের মধ্যে মানুষ আসতে দিতে হাড়গিলে-চরের প্রজারা রাজি ছিল না। দুই সেনাপতি একটু ইতস্তত করছে দেখে খাম্বাজং সভাপণ্ডিত চুহুংমুংকে ডেকে বললেন – “দেখ তো বুরুঞ্জি পুঁথিতে কলির কত হাজার বছরে এখানে মানুষের আগমন লিখেছে?”
চুহুংমুং মুখ গম্ভীর করে বুরুঞ্জির পাতা উল্টে-পাল্টে মাটিতে খানিক আঁক-জোঁক কেটে বললেন – “আগামী ভূতচতুর্দশীতে এখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের শাপভ্রষ্ট একজন উপস্থিত হবেন, বারো বৎসর এগারো দিন এক-দণ্ড তিনপল ঊনপঞ্চাশ বিপল বয়সে, বুরুঞ্জিতে লেখে – সুন্দরবনস্থ আমতলি গ্রামের কাশ্যপ গোত্রের অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ এই মহাপুরুষ তার আগমনে দেশের সুখসৌভাগ্য সঙ্গে-সঙ্গে মূষিক ও মশক বৃদ্ধি, হেঁড়েল বংশ ধ্বংস ও চুয়াদিগের নাটবাড়ি আক্রমণ এবং হাড়গিলা প্রভৃতির প্রচুর ভোগ-ঐশ্বর্য এবং সর্ব-সিদ্ধি যোগ। গণেশ চতুর্থীতে এই কলির বামন অবতার হংসরথে গৃহত্যাগ করবেন এবং ভূতচতুর্দশীতে ঊনপঞ্চাশ পবনে ভর দিয়ে কল্পাব্দ ঊনশত ঊনপঞ্চাশের সূর্যাস্তের দিক হতে উদয় হয়ে ক্রমে সূর্যোদয়ের দিকে অভ্যুত্থান করবেন। শ্যামবর্ণ সুন্দর বপুঃ বুড়োরষ্ট বৃষস্কন্ধ শালপ্রাংশু মহাভুজ” বলে চুহুংমুং বুরুঞ্জি বন্ধ করলেন।
সেই থেকে হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং ভাঙাচোরা পুরোনো নাটবাড়ির চুড়োয় গিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমমুখো হয়ে ঘাড় তুলে রইলেন – হংপাল কখন আসেন দেখতে, ওদিকে কাকচিরাতে কাকেদের রাজা যোম কাকের কাছে চাঁদপুরী শেয়াল খবর দিয়ে গেল – টিকটিকির মতো এক মানুষ এসে ভেড়াদের বিদ্রোহী করে তুলে হেঁড়েল বংশ ধ্বংস করলে, এবারে কাকেদের আর এঁটো-কাঁটা হাড়গোড় কিছু পাবার উপায় থাকবে না। মাংসখোর সব মারা গেল্ম কেইবা আর ভেড়া মারবে, ছাগল ধরবে। কাকচিরাতে কাকের ঘোট বসে গেল, কি করলে মানুষটাকে সরানো যায় দেশ থেকে, আর ভেড়া গরু ছাগল এদের আরো বেশি করে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় – যাতে কোনো দিন তারা ফেরুপাল বা সনাতন স্বধর্মের ভুঁড়ো-শেয়ালদের বিরুদ্ধে শিং চালাতে না পারে।
নদী মাঠ আর জঙ্গল এই তেমাথার মধ্যে রয়েছে কাকচিরার না-জঙ্গল, না-মাঠ, না-বালুচর – দূরে থেকে দেখলে বোধ হবে জমিটাতে ঘাসও যেমন গাছও তেমন, পাহাড়ও রয়েছে, নদীও বইছে কিন্তু কাছে গিয়ে দেখ কেবল চোরকাঁটা, শেওড়া আর বড়-বড় নোড়ানুড়ি, কাঁকর, বালি। আর তার মধ্যে এখানে-ওখানে কাদাজল নালা-নর্দমা!
কোনকালে ফেনচুগঞ্জের এক নীলকর সাহেব এখানে এক মস্ত কুঠি বানিয়েছিল। সেই বাংলা-ঘরখানা এখনো রয়েছে, কিন্তু মানুষ কেউ নেই। কুঠিবাড়ির বাগানে চোরকাঁটার সঙ্গে গোটাকতক দোপাটি ফুলের গাছ, ঘরের সমস্ত সার্সি দরজা বন্ধ, জিনিসপত্র যেখানকার সেখানে গোছানো অথচ কেউ নেই এখানে। দরজায় চাবি দিয়ে বাড়িওয়ালা যেন দু-দিনের মধ্যে আসবে বলে গেল, সেখানে সার্সিটা ভাঙা ছিল সেখানে কাগজ মেরে ঘরগুলি গুছিয়ে রেখে চোরের ভয়ে তালাবন্ধ করে সব ঠিকঠাক রেখে গেল, কিন্তু কোনো দিন এসে আর চাবি খুলে কেউ ঘরে ঢুকল না। বর্ষা এসে সার্সির ফাঁকে আঁটা পুরোনো খবরের কাগজটা গলিয়ে দিলে, কাক-চিরার একটা কাক কোন সময়ে একদিন ঠোঁটে সেই কাগজখানা ঠেলে ফেলে ঘরের ভিতরে যাবার আসবার একটা পথ করে রেখে দিলে। তারপর একদিন বোশেখ মাসে ডিম পারবার সময় দলে-দলে কাক এসে কাকচিরায় চিরকাল যেমন বাসা বেঁধে আসছে তেমনি ঘরকন্না পেতে জায়গাটা দখল করে বসল। সকাল না হতে দূর-দূর গ্রামে তারা চরতে যায়, এঁটো-কাঁটার সন্ধানে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই দলে-দলে এই আপন রাজত্বে তারা ফিরে আসে, রাঙা আকাশ কালো করে।
আমাদের মধ্যে যেমন ডোম চাঁড়াল তেলি মালি যুগি কায়েত বামুন এমনি নানা জাত, কিন্তু দেখতে চেহারায় মানুষ, তেমনি কাকেদের মধ্যেও দেখতে কাক কিন্তু জাত হরেক রকমের রয়েছে – যেমন ডোমকাক বা যোমকাক, ধাড়িকাক বা দাঁড়াকাক বা দাঁড়কাক, ধোড়াকাক, ঝোড়োকাক, ঢোঁড়াকাক, পাণিকাক বা পাতিকাক, শ্বেতকাক বা ছিটেকাক, ভুষোকাক বা ভূষুন্ডেকাক! সব কাকেরই চালচলন এক ভাবা ভুল, এদের মধ্যে কোনো দল তারা ভদ্দর সভ্য-ভব্য কাক, ছোলাকলা চিংড়িমাছটা আঁসটা আর বামুনের মতো মরা জানোয়ারের শ্রাদ্ধের ফল খেয়ে দিন কাটায়, আর একদল কাক তারা যা তা খায় বাচবিচার নেই, পাখির ছানা খরগোসের ছানা খেয়েই এরা সুখ পায়। কোনো দলের পেশাই হল লুটতরাজ চুরিচামারি খুনখারাবি। এদের জ্বালায় পাখির বাসায় ডিম রাখবার যো নেই, বাইরের কিছু চকচকে জিনিস রাখবার উপায় নেই! আমসত্ত্ব শুকোতে দিলে এরা খেয়ে যায়, কাপড় শুকোতে দিলেও টেনে ছেঁড়ে, ছেলের হাতের মোয়া কেড়ে খায়, বুড়োর পাকা মাথায় ঠোকর বসায়, চালের খড় টেনে ফেলে, ভাতের থালায় ছোঁ দেয়, এমনি নানা উৎপাত করে বেড়ানোই এদের কাজ।
কাকেদের নাম শুনলেই বোঝা যায় কোন দল কেমন – যেমন যোমকাকের বংশ হল তারা ডোমকাক, এদের সবাই ভয় করে। মরা জানোয়ার নিয়ে ছেঁড়াছেঁড়ি মারামারি এদের কাজ। তারপর ধাড়িকাক বা দাঁড়কাক – এরা পুরোনো চালের, কাক যখন কোকিলের মতো গাইতে পারত তখন লোকে এদের পুষে দাঁড়ে বসিয়ে-বসিয়ে ছোলা খাওয়াত। সেই থেকে এরা নানা বিদ্যেতে কৌশলে কারিগরীতে মজবুদ বলে সব কাকই দায়ে পড়লে এদের পরামর্শ মতো চলে। তারপর, ঝোড়োকাক – এরা এককালে সব চেয়ে সাহসী বড়ই নামজাদা রাজবংশ ছিল, এখন বিষ হারিয়ে ঢোঁড়াকাক হয়ে পড়েছে কাজেই চুপচাপ থাকে সন্ন্যাসীর মতো। পাতিকাক হল পাণিকাকের বংশ, এরা সব দলেই আছে কিন্তু কোনো দলেই এদের পৌঁছে না, পুকুর পাড়ে এরা গুগলী শামুক এঁটো-কাঁটা খেয়েই দিন চালায়। শ্বেতকাক – এরা আসলে দিশি কালো কাকেরই বংশ কিন্তু রঙ বদলে শাদা বিলিতি কাক হতে যাচ্ছে – এদের কারু গলা শাদা, কারু ডানা শাদা, কারু মাথা শাদা, এখনো দোরঙা আছে বলে এদের নাম ছিটেকাক হয়েছে। পৃথিবীর আদিকাক হল ভুষুণ্ডিকাক, তারি বংশে ভুষুণ্ডে বা ভুষো, দেখতে কালিঝুলি, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, এই কাকের বংশ চলে আসছে – এদেরই পূর্বপুরুষ রামের সঙ্গে লড়াইয়ে একচোখ হারিয়েছিল, সেই থেকে এদের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে, এমন কি এদের নকল করে অনেক কাক একচোখা সেজে নিজেদের বলাতে চাচ্ছে এদেরই একজন, আসলে হয়তো সে পাতিকাক, কিন্তু লেখবার বেলায় লিখছে পাতি অব্ ভুষুণ্ডি! এই সব নানা ধরনের কাকেদের মধ্যে যখন যে দলপতি হয় তখন কাক সমাজকে সে নিজের মতো ভালো-মন্দ নরম-গরম ভাবে চালায়, এই হল সমাজের নিয়ম।
যে কাকটা নীলকর সাহেবের ঘরের সার্সিতে মস্ত ফাঁকটা আবিষ্কার করেছিল, সে বহুকালের পুরোনো রাজবংশী ঢোঁড়াকাক। যতদিন এই ঢোঁড়াকাক দলপতি ছিল ততদিন কাক সমাজ ভদ্ররকম ছিল, কোনো পাখিই তাদের কোনো দোষ কোনো খুঁত ধরতে পারেনি। কিন্তু কাক সমাজে ক্রমে প্রজা বৃদ্ধি হয়ে নানারকম কাক তাতে এসে যখন সেঁধোল তখন চাল-চোলও ক্রমে বদলাতে আরম্ভ করলে। শেষে একদিন সবাই মিলে ঢোঁড়াকাককে সিংহাসন থেকে তাড়িয়ে ডোমকাককে সর্দার করে এমন লুটতরাজ মারামারি আরম্ভ করে দিলে যে, পায়রা , সিকরে, গেরোবাজ এমন কি পেঁচারা পর্যন্ত অস্থির হয়ে কাকচিরে ছেড়ে পালাতে পথ পেলে না।
পুরোনো দলপতি ধোড়াকাক সিংহাসন ছেড়ে মনের দুঃখে ঝোড়োকাকের মতো হয়ে ডানা ঝুলিয়ে চুপচাপ শেওড়াগাছের ডালে দিন কাটায়, কেউ তাকে কোনো কথা শুধোয় না, সবাই মিলে বলতে লাগল ওটা বিষ হারিয়ে ঢোঁড়া হয়েছে, বুড়ো হয়ে বুদ্ধি-সুদ্ধি লোপ পেয়েছে। নতুন দলপতি ডোমকাক তামাশা করে তার নাম রাখলে ডরা-কাক, দেশের লোক তাকে বললে ঢোঁড়াকাক! একেবারে কাজের বার ভেবে সবাই তাকে তুচ্ছ করছে দেখে ঢোঁড়াকাক মনে-মনে একটুখানি হেসে আপনার কোণটিতে চুপচাপ বসে রইল। নতুন রাজা ডোম জাঁক দেখাবার জন্য প্রায়ই ঢোঁড়াকে রাজবাড়িতে নিমন্ত্রণ দিত। কোনো দিন বা নিজের বীরত্ব আর বাহাদুরি দেখাতে শিকারের সময় প্রায়ই সঙ্গে নিত। ঢোঁড়া সব বুঝত কিন্তু বুঝেও বোবা হয়ে থাকত।
ফেনচুগঞ্জের নীলকর সাহেব যদিও অনেক কাল হল কুঠিবাড়ি ছেড়ে গেছে, কিন্তু এখনও কোনো কাকের এমন সাহস হয় না যে সেদিকে যায়, কিন্তু ডরাকাক বলে ডোমকাকের দল যাকে তুচ্ছ করছে সেই কাকটি গিয়ে একদিন কুঠিবাড়ির মধ্যে যাবার একটি রাস্তাআ করে এল নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে একলা গিয়ে, কিন্তু খবরটা সে কাউকে জানায়নি! একে মানুষ তাতে গোরা, তার ঘরে সুড়ঙ্গ কাটা, বাঘের ঘরে যোগের বাসার চেয়েও অসমসাহসের কাজ, কোনো কাক এ পর্যন্ত যা পারেনি ঢোঁড়া সেই কাজটা করেছে – অথচ মুখে তার কথাটি নেই, অন্য কাক হলে চীৎকারের চোটে কাকচিরে মাত করত! নতুন দলপতি ডোমকাকটা দিনের বেলায় এই বুকে পাটকিলে ডোরা-টানা ধোড়াকাককে ভয় করে খাতির করে চলত, ধোড়ার বুকে লাল-ডোরা দেখে তার মনে হত যেন কতকালের মহাযুদ্ধের রক্তের দাগ রাজটিকের মতো এখনো এর বুকে দাগা রয়েছে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে যখন লাল-কালো সব এক হয়ে গেছে তখন ডোমকাক ধোড়াকে জ্বালাতন করতে ছাড়ত না – একদিন প্রায় মেরেই ফেলেছিল। সেইদিন থেকে ধোড়া বা ঢোঁড়াকাক শেওড়া গাছে আর ঘুমোতে যেত না, সেই সার্সি দিয়ে চুপিচুপি ঘরের মধ্যে দেওয়ালের গায়ে বেলা আড়াইটা বেজে বন্ধ হওয়া একটি ঘড়ির পিছনে বসে রাত কাটাতে আরম্ভ করলে।
রিদয় যে ঝড়ে পড়ে যোগী-গোফায় আশ্রয় নিয়েছিল সেই ঝড়ে কাকচিরার বহুকালের পুরোনো শেওড়া গাছটা গোড়া সুদ্ধু উপড়ে রাজ্যের ডোমকাকের বাসা ডিম ছানা-পোনা নিয়ে উল্টে পড়ল ঠিক বেলা আড়াইটাতে। বাসা গেল, ডিম ভাঙল, তাতে কাগেদের বড় একটা দুঃখ হল না, কিন্তু গাছের গোড়াটা যেখানে উল্টে পড়ে বড় একটা গর্ত দেখা দিয়েছে, সেই গর্তটায় কি আছে না আছে খুঁজে দেখবার জন্যে দলে-দলে কাক আকাশের দিকে পা-করা গাছের মোটা-মোটা শিকড়গুলো নিয়ে টানাটানি চেঁচামেচি বাধিয়ে দিলে।
ডোমকাক, ঢোঁড়াকাক পাতিকাক দুজনকে নিয়ে একেবারে ডোবাটার মধ্যে উড়ে পড়ে এদিক-ওদিক তদারক করে ইট পাটকেল উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল। হঠাৎ এত বড় গর্তটা কেন এখানে আসে, ঠোকর দিয়ে সন্ধান করতে-করতে গর্তের একদিকে খানিক কাঁকর-মাটি ঝরঝর করে খসে পড়ল, আর দেখা গেল ইঁটে-গাঁথা একটা চোর-কুঠুরী, তার মধ্যে তালা দেওয়া ছোট একটা পেঁটরার সামনে একটা মড়ার মাথা, কতকালের কলঙ্ক-ধরা একটা পিদুম আর গোখরো সাপের একটা খোলস! মড়ার মাথা সাপের খোলস দুটোই সব কাকের দেখা ছিল, পিদুম নিয়েও তারা অনেকবার পালিয়েছে, কিন্তু পোঁটরাটার মধ্যে কি আছে কোনো কাকই তা জানে না, কাজেই এদিকে-ওদিকে ঠোকর দিয়ে তালাটা ধরে নাড়া দিয়ে দেখছে এমন সময় গর্তের উপর থেকে খেঁকশেয়াল আস্তে-আস্তে বললে – “হচ্ছে কি? ওটা নিয়ে নাড়াচড়া কর না, ওতে সাত রাজার ধন আছে, যদি খুলতে চাও তো একজন যক্ ধরে আনো, যকের ধন যক্ না হলে কেউ খুলতে পারবে না।”
সাত রাজার ধন আছে শুনে কাকদের চক্ষু স্থির! চকচকে পয়সা মোহর ভালবাসতে তাদের মতো দুটো নেই, ডোমকাক পাতিকাক ভুষোকাক ছিটেকাক দাঁড়কাক সব কাক এসে শেয়ালকে ঘিরে – ক্যা-ক্যা-ক্যা কও-কও-কও রব করে গণ্ডগোল বাধিয়ে দিলে। ডোমকাক সবাইকে ধমকে চুপ করিয়ে শেয়ালকে শুধোলে – “জক্ এখন কেমন করে পাওয়া যায়?”
শেয়াল ডাঁওর করে মাথা চুলকে নাক রগড়ে যেন কতই ভেবে বললে – “আমি জানি এক যকের সন্ধান, সে ছুঁলেই এই বাক্স খুলে যাবে!”
কাকেরা অমনি চীৎকার করে উঠল – “কই-কই” – বলে এগিয়ে গর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডোমকাক তাড়াতাড়ি পেঁটরার উপরে চেপে বললে – “রও-রও”।
তারপর শেয়াল এগিয়ে এসে বললে – “আমি সেই যকের সন্ধান তোমাদের দিতে পারি, যদি তোমরা এই সিন্দুক খুলিয়ে নিয়ে যক্টিকে আমার পেট ভরাবার জন্যে দিতে রাজী হও।”
কাকেরা শেয়ালের কথায় রাজী হলে শেয়াল তাদের রিদয়ের খবর জানিয়ে দিলে। তিনকুড়ি কাক সঙ্গে ডোমরাজা ঢোঁড়াকাককে সঙ্গে নিয়ে যক্ ধরতে চলল পাহাড়-জঙ্গলের উপর দিয়ে।
হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং যখন চৌষট্টিখানা নাটবাড়ির নহবতখানার চুড়োয় পশ্চিমমুখো হয়ে রিদয়ের আশায় রয়েছেন, আর কাকদের রাজা ডোম রিদয়কে ধরবার জন্যে বনে-জঙ্গলে সন্ধান করে বেড়াচ্ছে, সেই সময় গণেশের নেংটি ইঁদুরের সঙ্গে পাহাড়ি চুয়োদের যুদ্ধ বেধে গেল। ব্রহ্মপুত্র আর বড়নদীর মোহনার পুরোনো নাটবাড়িটা ইঁদুরের দখলে, কতকাল থেকে আছে তার ঠিকানা নেই। দেওয়ানগিরির উপরের কেল্লার মতো আড়িমাও রাজাদের নাটবাড়ি, প্রকাণ্ড কারখানা, এত বড় নাটবাড়ি যে সেখানে রাজাদের আমলে যে-সব হাতি-ঘোড়া সেপাই-শাস্ত্রী থাকত সেগুলোকে দূর থেকে মনে হত যেন ছোট পুতুল চলে বেড়াচ্ছে। দশ-বারো-হাত চওড়া এক-একখানা পাথরের ইঁটে-গাঁথা বাড়ির দেওয়ালগুলো, এক-একটা থাম যেন এক-একটা তালগাছ! সাততলা বাড়ি কিন্তু তার নিচের পাঁচতলা নিরেট দেওয়ালে ভরাট করা, তার মাঝে পাহাড়ের গহ্বরের মতো অন্ধকার একটা সিংগি দরজা, আশে-পাশে বাক্সের মতো চোরকুঠুরী। সেগুলোতে দেওয়ালই সব, থাকবার জায়গা অল্পই, তাও আবার এখানে-ওখানে লোহার গরাদ দিয়ে বন্ধ, কত কালের অস্তর-শস্ত্র, রাজাদের আসবাব-পত্র, চাল-ডাল, ঘি-ময়দা, ধন-দৌলত দিয়ে ঠাসা। যেমন সোঁতা তেমনি অন্ধকার, সে-সব ঘরে একবার ঢুকলে রাস্তা হারিয়ে চিরকাল গোলকধাঁধার মতো ঘুরে বেড়াতে হয়, আর বাইরে আসবার উপায় নেই, এমনি প্যাঁচাও রকমে সে-সব ঘর সাজানো। ছ-তলার উপরে রাজসভা, সেখানে কতকটা আলো-বাতাস আসবার জন্যে সারি-সারি জানলা-বারাণ্ডা, সাততলায় অন্দর মহল, সেখানে জানলা সব খাঁচার মতো পাথরের জাল দিয়ে বন্ধ, পোষা-পাখির মতো রানীদের ধরে রাখার জন্যে ছোট-ছোট কুলুঙ্গি দেওয়া দরজায় শিকল-আঁটা সব শয়ন-মন্দির।
অন্ধকূপ এই নাটবাড়িতে আড়িমাও রাজাদের বংশ ভালো আলো-বাতাস না পেয়ে গুষ্ঠিসুদ্ধ লোকলস্কর সমেত অল্পদিনের মধ্যেই মরে ভূত হয়ে গেল, রইল কেবল বাড়ির চুড়োয় মস্ত একটা পাথরের আলসের উপরে খড়-কুটো দিয়ে বাসা বানিয়ে এক ঠেঙে – সে হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং। রানীর শয়ন-ঘরের কুলুঙ্গিগুলোতে গোটাকতক লক্ষ্মী-পেঁচা কালো-পেঁচা ভুতুম-পেঁচা, রাজসভার কার্নিশে-কার্নিশে ঝুলে দলে-দলে বাদুড়, রন্ধনশালায় একটা কালো বেরাল, আর ঘি-ময়দা চাল-ডাল শাল-দোশালা ধন-দৌলতে ঠাসা নিচেকার ভাঁড়ার ঘরগুলোতে গড়বন্দি নেংটি ইঁদুর। হাড়গিলে পেঁচা বেরাল এরা সবাই ইঁদুরের শত্রু হলেও গণেশের ইঁদুরকে তারা খাতির করে চলত, পৃথিবীর যেখানে যত গণেশ আছে, সবার জন্যে এই নাটবাড়ি থেকে ইঁদুর যায়, এদের কেউ কিছু বলবার যো নেই, কাজেই নেংটি ইঁদুরের দল দেশ জুড়ে নানা উৎপাত আর রাজত্ব করছিল, এই সময় কোথা থেকে তাতারি-চুয়ো এসে হানা দিয়ে, যেখানে-সেখানে গণেশ উল্টে ফেলে নেংটি বংশ ধ্বংস করতে শুরু করে দিলে।
গোলাবাড়ি, ঠাকুর-বাড়ি, গোয়ালঘর, রান্নাঘর, কাচারিঘর, হেঁসেল-ঘর, শোবারঘর, বসবারঘর, তোষাখানা, বৈঠকখানা, দেশের সব জায়গা থেকে তাড়া খেয়ে নেংটি সরে পড়তে লাগল, লড়ায়ে হারতে থাকল, না খেয়ে মরতে লাগল; শেষে এমন হল যে, এক পুরোনো নাটবাড়ি ছাড়া গণেশের ইঁদুর আর কোথাও রইল না। গণেশের সিংহাসন টলমল করতে থাকল, মানুষে নেংটি ইঁদুর মারত বটে কিন্তু গণেশ তাতে টলেননি, কেন না এত ইঁদুর বাইরে-বাইরে জন্মাত যে, মানুষ জন্ম-জন্ম মেরেও তাদের বংশ লোপ করতে পারত না। কিন্তু নেংটিরই বড় জাত যে চুয়ো, তারা যখন এসে হানা দিয়ে পড়ল, তখন গণেশ ভেবে অস্থির হলেন।
এই চুয়োরা একেবারে চোয়াড়, যা-তা খায়, দেবতা-ব্রাহ্মণে ভক্তি মোটেই নেই, একেবারে গোঁয়ার-গোবিন্দ, দুটি-একটি করে, যেন ভালোমানুষের মতো, প্রথমে নদী-নালার ধারে-ধারে নৌকোর খোলে এসে বাসা বাঁধলে, দেবতার মন্দিরে কিংবা মানুষের ভাঙা ঘরের উপরে, গ্রাম-নগরের দিকেই ঘেঁষতো না – নেংটি ইঁদুরগুলো যে সব পোড়ো-বাড়ি, পতিত জমি ছেড়ে গেছে সেই জায়গাগুলোয় এসে রইল, নেংটিদের ফেলে-দেওয়া যা কিছু কুড়িয়ে খেয়ে বড় হতে লাগল। ক্রমে তারা বড় হতে হতে শেষে নেংটিদের মাটির কেল্লাগুলো দখল করে জমিদারী ফাঁদলে, সেখান থেকে এ-জমিদারী, এ-পরগণা সে-পরগণা, এদেশ-সেদেশ, করে সারা দেশ তারা দখল করলে। মাটির নিচেটা দখল করে মাটির উপরে চুয়োর দল লড়াই দিতে যখন বার হল, তখন নেংটিরা বুঝলে দাঁড়াবার স্থান গেছে, নিরুপায় হয়ে তারা যে ক’টা পারে তাদের পুরোনো নাটবাড়ির কেল্লায় এসে ঢুকে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করতে লাগল। নাট-বাড়ির দেওয়াল মোটা, কাজেই নেংটিরা কতকটা নির্ভয়ে রইল, কিন্তু চুয়োরাও ছাড়বার পাত্র নয়; তারা বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে শেষে একদিন নাটবাড়ির উঠোনটা দখল করতে বারোজন তাতারি সওয়ার পাঠিয়ে দিলে! যুদ্ধং দেহি বলে শত্রুদল চারদিক ঘিরে লেজ আপসে লাফালাফি সুরু করে দিয়েছে, চারদিকে সাজ রে রব পড়ে গেছে –
পায় দল কলবল ভূতল টলমল
সাজল দলবল অটল তাতারি।
দামিনি তক-তক জামকী ধক-ধক
ঝকমক চমকত খরতর বারি।
ধূধূ-ধূধূধূ নৌবত বাজে,
ঘন ভোরঙ্গ ভম্-ভম্, দামামা দদদম্
ঝনন্ন ঝম-ঝম ঝাঁজে –
ধা-ধা গুড়-গুড় বাজে।
নিশান ফরফর নিনাদ ধর-ধর
তাতারি গর-গর গাজে।
ধূধূ ধম-ধম ঝাঁ-ঝাঁ ঝম-ঝম
দামামা দম-দম বাজে।
রণজয় ভেরী বাজে রে ঝাঁগড়-ঝাঁগড় ঝাঁ-ঝাঁ ঝাঁজে রে
মুচকিয়া গোঁফে চলে লাফে-লাফে
খেলে উড়ো পাকে থাকে-থাকে-থাকে ঝাঁপে রে
বাজে রণ ভেরী বাজে রে।
ভয় পেয়ে মরে নেংটি হাজার-হাজার
তল গেল মানমত্তা ইঁদুর রাজার
ঘাসের বোঝায় বসি ইন্দুরানী কাঁদে
ইন্দুরায় এতদিনে পড়িয়াছে ফাঁদে
কান্দি কহে ইন্দুরানী গণেশ গোঁসাই
এমন বিপাকে কভু আর ঠেকি নাই।
এইভাবে ইঁদুর রানী কাঁদছেন, এদিকে একশো বছরের ইঁদুরের রাজা তাতারিদের ভয়ে থরথরি কম্পমান, রানীর আঁচল ধরে মন্ত্র পড়ছেন, খট্ ভৈরবী – দ্রুত ত্রিতালি – আর কেঁদে বলছেন সুর করেঃ
চল-চল যাই নীলাচলে। (রে অরে যাই)
ঘটালে বিধি ভাগ্যফলে।।
মহাপ্রভু জগন্নাথ সুভদ্রা বলাই সাথ
দেখিব অক্ষয় বটতলে,
খাইয়া প্রসাদ ভাত মাথায় মুছিব হাত
নাচি বেড়াই কুতূহলে
ভবসিন্ধু বিন্দু জানি পার হইনু হেন মানি
সাঁতার খেলিব সিন্ধুজলে।।
নেংটির রাজা যখন কেল্লা ছেড়ে রানীকে নিয়ে পাছ-দুয়োর দিয়ে গঙ্গাসাগরের দিকে পলায়নের মতলব করছেন – লড়াই না দিয়ে, সেই সময় হাঁসের দল রিদয়কে নিয়ে দেওয়ানগিরির তলায় এসে উড়ে বসল। একদিকে নাটবাড়ির পাথরের পাঁচিল, আর একদিকে হাড়গিলের চর, এরি মাঝে জলের ধারে শুশনি কলমি শাক খেয়ে হাঁসের দল চরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় আণ্ডামানি হাঁসের সঙ্গে দেখা, ছোট দল বড় দল দুই দলে অমনি কথাবার্তা চলল, সাঁতার খেলা আরম্ভ হল।
যোগীগোফাতে ভেড়াদের নিয়ে যে কাণ্ড হয়েছে শুনে আণ্ডামানি বললে – “তা হলে শেয়াল লোভ সহজে ছাড়বে না, নিশ্চয়ই আমাদের পিছু নেবে, আর এখন দুদিন উড়ে কাজ নেই, এইখানেই থাকা যাক, আর ব্রহ্মপুত্রের বাঁক ধরে মানস সাগরেও গিয়ে কাজ নেই। এইখান থেকে বাঁহাতি মোড় নিয়ে একেবারে পাহাড়ের পাশ দিয়ে সোজা উত্তরে চলাই ভালো।”
চকা বললে – “অজানা রাস্তা কেমন করে যাব।”
আণ্ডামানি অমনি জবাব দিলে – “অজানা নয়, উত্তর সমুদ্রের ধারে রুশ দেশে যে সব পাখিরা থাকে তারা পাহাড়ের এই গলি পথটা দিয়ে সোজা হিমালয়ের ওপারে চলে যায়। আজ ক’দিন ধরে দলে-দলে সারস বুক কাদাখোঁচা জলপীপী এরা দেখি এই পথ দিয়ে যাওয়া-আসা করছে।”
বুড়ো চকা ঘার নেড়ে বললে – “ওহে রাস্তা তো আছে জেনেছ, রাস্তার কোথায়, কেমন দানাপানির ব্যবস্থা তার খবর নিয়েছ কি?”
আণ্ডামানি লালসেরা মাথা নেড়ে বললে – “সে খবরও নিতে বাকি রাখিনি। এই দেওয়ানগিরি থেকে বড়নদীর রাস্তা বেয়ে সোজা উত্তরে গেলে তাস্গং, তাউয়াং, দুটো বড়-বড় বস্তি, তার পরই চুথাং-এর জলা। সেখানে এক রাত্রি কাটিয়ে তার পরদিন সন্ধ্যায় চোনা হ্রদ পাওয়া যাবে, তারপর একদিনে নারায়ুম হ্রদ, সেখান থেকে একবেলার পথ ‘তিগুৎসো’। সেখান থেকে পশ্চিমে গেলে পেমো চাং, বাসাং সো, চোলু, খাম্বাজং গোঁসাইথান হয়ে ধবলাগিরি, আর উত্তর-পুবে গেলে যমদক্ষা নগরের ধারে প্রকাণ্ড পালতি হ্রদ, তার পরে ‘তামলং কঙ্কজং’ হয়ে আবার ব্রহ্মপুত্রের রাস্তায় পড়া যেতে পারে, অনেক পাখিই এই রাস্তা দিয়ে চলেছে, সেথোর অভাব হবে না। তাছাড়া কঙ্কজং-এর রাজা কঙ্ক-পাখির সঙ্গে যখন তোমাদের পরিচয় আগেই হয়ে গেছে, তখন সেখানেও কিছুদিন জিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে।”
চকা ঘাড় নেড়ে বললে – “সে সব ভালো, কিন্তু ওদিকের আকাশটা যেন কেমন ঘোলাটে ঠেকছে, দেওয়ানগিরির উত্তর গা-টাতে মেঘের ছাওয়াটাও দেখতে পাচ্ছি; হঠাৎ ওদিকে যাওয়া নয়, দু-একদিন দেখা যাক।”
হাঁসদের মধ্যে এই সব পরামর্শ চলছে এদিকে রিদয় একটা ডোবায় পা ডুবিয়ে আড়িমাও রাজার পুরোনো নাটবাড়িটার পাঁচিলের দিকে চেয়ে রয়েছে, এমন সময় দেখলে সন্ধ্যের অন্ধকারে পাঁচিলের ধারে রাশ-রাশ নুড়িগুলো যেন নড়তে-চড়তে আরম্ভ করলে, তারপর সার বেঁধে সব নুড়িগুলো কেল্লার দিকে এগোতে লাগল! রিদয় চেঁচিয়ে উঠল – “দেখ-দেখ!” অমনি সব হাঁস সেদিকে চেয়ে দেখলে দলে-দলে চুয়া রাস্তা ঢেকে চলেছে।
রিদয় যখন বড় ছিল তখন একবার ইঁদুরের কামড় কেমন টের পেয়েছে, এখন এই বুড়ো-আংলা অবস্থায় ইঁদুরের পাল্লায় পড়লে যে কি হবে তাই ভেবে সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাঁসেরাও রিদয়ের মতো ইঁদুরের গন্ধ মোটেই সইতে পারত না, যতক্ষণ সেদিক দিয়ে ইঁদুরগুলো গেল ততক্ষণ সবাই মুখ বন্ধ করে রইল। তারপর ‘ছি-ছি’ বলে যেন কেবলি ডানা ঝাড়া দিতে শুরু করে দিলে।
চুয়োর দল ছোট-বড় নুড়ির ঝরনার মতো গড়াতে-গড়াতে পাথরের পাঁচিলের গোড়া বেয়ে নাটবাড়ির সিংগি দরজার দিকে চলে গেল, ঠিক সেই সময় আকাশে পা লটপট করতে-করতে হাড়গিলে-রাজ খাম্বাজং ঝুপ করে হাঁসদের মধ্যে এসে পড়লেন। রিদয় এমনতরো পাখি কোনোদিন দেখেনি, এঁর মাথা, গলা আর পিঠ শাদা রাজহাঁসের মতো, ডানা দুখানা কালো দাঁড়কাকের মতো, তেলে পাকানো গেঁটে-বাঁশের ছড়ির মতো লাল দুখানা সরু ঠ্যাং, আর বারো-হাত কাঁকুড়ের তেরো-হাত বীচির মতো এতটুকু মাথায় এত বড় এক লম্বা ঠোঁট – এক আঙুল কলমের যেন দশ আঙুল নিব তার ভারে মাথাটা ঝুঁকেই আছে, মুখের দু-পাশে বোয়াল মাছের মতো চোখ দুটো বসানো! রিদয়ের বোধ হল, পাখি মাছ কাঁকুড় কলম বাঁশ সব মিলিয়ে যেন এই পক্ষীরাজ সৃষ্টি হয়েছে!
হাড়গিলেকে দেখে চকা তাড়াতাড়ি ডানার পালক ঝেড়েঝেড়ে সামনে এগিয়ে এসে দণ্ডবৎ হয়ে দু-তিন বার প্রণাম করে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল হঠাৎ খাম্বাজং কি কাজে এলেন! নাটবাড়ির চুড়োয় হাড়গিলের বাসা চকা জানে আর ফাল্গুন মাসের গোড়াতেই হাড়গিলেদের আনাবার পূর্বে খাম্বাজং বাসাটা একবার তদারক করতে প্রতি বছরে এখানে থাকেন সেটাও জানা কথা। কিন্তু হাড়গিলেরা তো হাঁসেদের সঙ্গে প্রায়ই আলাপ-সালাপ রাখে না, হঠাৎ আজ হাঁসের দলে রাজার আগমন হল কেন, এটা চকা না ভেবে না পেয়ে একবার ঘাড় চুলকে বললে – “জং বাহাদুরের বাসার খবর ভালো তো, গেল ঝড় বৃষ্টিতে কোনো লোকসান হয়নি তো?”
হাড়গিলের সবাই তোতলা, সহজে কথা কওয়া তাদের মুশকিল, খাম্বাজং অনেকক্ষণ ঠোঁট কাঁপিয়ে এ-চোখ বুজে ও-চোখ খুলে ভাঙা গলায় কাঁদুনি শুরু করলেন – “বুড়োবয়সে বাসাটা ঝড়ে পড়ে গেছে, একে উঁচু নাটবাড়ি, তায় আবার চুড়ো, গিন্নী দেখে-দেখে সেখানেই বাসা বাঁধলেন, টিকবে কেন? এই বুড়ো বয়সে জল-ঝড়ের মধ্যে ঐ গোটা কতক ভাঙা কাঠির বাসায় তো আমার টেকা দায় হয়েছে! এদিকে আবার মানুষগুলো সমস্ত জলা আর খাল-বিল ভরাট করে তার উপর দিয়ে রেলগাড়ি চালাবার বন্দোবস্ত করচে, দু-একটা সাপ ব্যাঙ যে ধরে খাব তারও রাস্তা বন্ধ! শুনেছি না কি আবার এই নাটবাড়িটাতে ইস্টিশান বসাবে, তাহলে তো আমাকে এদেশ ছাড়তে হয় দেখি!”
চকা খুব দুঃখ জানিয়ে বললে – “আপনি তো তবু এতকাল এই নাটবাড়িতেই কাটালেন, ইচ্ছে করলে পরেও আপনি ইস্টিশানের চুড়োটায় বাসা বাঁধতে পারেন। মানুষে কোনোদিন আপনার উপর গুলিও চালাবে না। আর বাসা থেকে আপনার আণ্ডাবাচ্চা চুরি করে ভেজেও খাবে না, আপনার তো কোনো পরোয়া নেই। বড় জোর এখন চুড়োয় আছেন, না হয় চরে নেমে বসবেন; কিন্তু আমাদের দশা দেখুন দেখি –
ভোজনং যত্র তত্র শয়নং হট্টমন্দিরে
মরণং গোমতী তীরে অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি!
এই ভাবেই সারা জীবন কাটাতে হবে। আপনার যা হোক একটা দাঁড়াবার স্থান আছে, আমাদের দশাটা ভাবুন তো। ভবঘুরের মতো –
যেখানে-সেখানে শোও আর খাও
পৃথিবীটা ঘিরে চক্কর দাও
শেষে একদিন অকস্মাৎ!
বিনা মেঘে বজ্রঘাৎ!
“তাগে পেলেই মানুষ গুলি চালাচ্ছে আমাদের দিকে!”
হাড়গিলে গলার পালকের দাড়ি বুলিয়ে বললেন – “কথাটি তো বলেছ ঠিক, কিন্তু নাটবাড়ি হয়ে পর্যন্ত ঐ চুড়োটায় বাস করে আসছি সাতপুরুষ ধরে, আজ হঠাৎ করে চুড়ো থেকে চরে নেমে বসা কি কম কষ্টের কথা, আর ঐ হাড়গিলের চরটাও শুনছি মানুষেরা চেঁচে ফেলে ওখান দিয়ে বড়-বড় মালের জাহাজ চালাবে!”
চকা এবারে আমতা-আমতা করে বলল – “তা হলে তো মুশকিল দেখছি, মানুষের সাথে তো আমরা পেরে উঠব না, এ বিষয়ে আপনি –”
এবারে হাড়গিলে ঠোঁট বাজিয়ে বলে উঠলেন – “আঃ, সে মানুষের কথা, যখন তারা আসবে ভাবা যাবে। এখন একটা কথা শুধোই, এদিক দিয়ে চুয়োদের পল্টন যেতে দেখেছ কি?” হাজার-হাজার চুয়ো এইমাত্র এইদিক দিয়ে গেছে শুনে হাড়গিলে আকাশে চোখ তুলে বললেন – “এতদিনে বুঝি গণেশের ইঁদুরের দফা রফা, আজ রাতের মধ্যেই চুয়োরা নাটবাড়ি দখল করবে।”
চকা ভয় পেয়ে বললে – “কি বলেন লড়াই বাধবে নাকি?”
হাড়গিলে বলে উঠলেন – “বাধবে আর কি, বিনা যুদ্ধে চুয়োরা আজ কেল্লা মেরে নেবে, রাজা গঙ্গাসাগরের দিকে রানীকে নিয়ে দৌড় দিয়েছেন। বামুন গেল ঘর তো লাঙ্গল তুলে ধর, কেল্লায় যারা ছিল তারা মানস-সরোবরের ধারে আসছে পূর্ণিমায় পঙ্কিরদলের বারোয়ারীর নাচ দেখতে ছুটেছে, ঠিক ঝোপ বুঝেই চুয়োর দল কোপ দিতে চলেছে। কেল্লায় গোটাকতক অকর্মণ্য বুড়ো নেংটি ছাড়া আর তো কেউ নেই, এতকাল নেংটিদের সঙ্গে এই নাটবাড়িতে কাটালেম, এখন বুড়ো বয়সে আর শিং ভেঙে বাছুরের দলে যাওয়ার মতো চুয়োর দলে ভিড়তে আমার ইচ্ছে যায় না, তাই ভাবচি থাকি কি যাই।”
হাড়গিলে যে ইঁদুরদের বিপদের খবরটা না দিয়ে হাঁসের দলে এসে কাঁদুনী শুরু করেছে এটা চকার মোটে ভালো লাগল না। সে একটু এগিয়ে গিয়ে হাড়গিলেকে বললে – ‘গণেশের ইঁদুরদের আপনি ও-খবরটা পাঠাননি এখনো?”
হাড়গিলে গলার থলি দুলিয়ে বললে – “খবর দিয়ে লাভ? তারা আসবার আগেই সে কেল্লা দখল হয়ে যাবে।”
চকা এবারে চটে বলল – “হয়ে যাবে বললেই হয়ে গেল, এমন অঘটন হতে দেব না আমি বলছি।”
যে চকার ঠোঁট একেবারে ভোঁতা, নেই বললেই হয়, আর যার পায়ের ততোধিক ধারাল, সন্ধ্যে না হলেই যার ঘুম আসে, তিনি লড়তে চান চিরুনিদাঁত চুয়োদের সঙ্গে! হাড়গিলে হেসেই অস্থির। ঘাড় নেড়ে চকাকে বললেন – “বুরুঞ্জিতে লেখা আছে এই ঘটবে, কারো সাধ্য নেই তা রদ করা, আমি পণ্ডিতদের দিয়ে গণিয়ে দেখেছি কোনো উপায় নেই, না হলে আমি চুপ করে বসে আছি!”
চকা হাড়গিলের কথায় কান না দিয়ে ডাক দিলে – “পাঁপড়া নান্কৌড়ি, নেড়োল কাটচাল, লালসেরা আণ্ডামানি, চোখ-ধলা ডানকানি, পাটাবুকো হামস্ত্রি, মারাগুই চাপড়া, তীরশুলি আকায়ব, তোমরা যাও মানস-সরোবরের পথে যত নেংটি দেখবে সবাইকে খবর দাও লড়াই বাধবে।” অমনি সাতটা বুনো-হাঁস অন্ধকারে ডানা ছড়িয়ে উড়ে পড়ল। চকা আবার বাঙলাদেশের হাঁসদের ডাক দিলে – “সনদ্বীপের বাঙাল, ধন-মাণিকের কাওয়াজী, রায়মঙ্গলার ঘেংরাল, চব্বিশ পরগণার সরাল!” অমনি তেল চুকচুকে মোটাপেট পাঁচজন উপস্থিত হল হেলতে-দুলতে, চকা তাদের বললে – “চট করে যাও গঙ্গাসাগরের দিকে, নেংটিদের রাজা ইন্দুরায় আর ইন্দুরাণীকে ফিরিয়ে আনো!” কিন্তু এবারের দল অত চটপট উড়ে পড়ল না, বাঙাল মাথা চুলকে বললে – “এ-কাজটা কি সমীচীন হবে, ইঁদুরের যুদ্ধে হাঁসেদের যোগ দেওয়া কি সঙ্গত, তা ছাড়া এই অন্ধকার রাতে আপনাকে একলা এই শত্রুদের মাঝে – ”
চকা ধমকে উঠলঃ “বড় দেরি করছ তোমরা!” বাঙলার হাঁসরা পটাস-পটাস করে ডানা ঝাপটে দক্ষিণ মুখে আস্তে-আস্তে উড়ে চলল।
চকা তাদের দিকে খানিক কটমট করে চেয়ে থেকে সুবচনীর হাঁসকে বললে – “তুমি গিয়ে হাড়গিলে চরে চুপচাপ বসে থাক, আমি কেবল হংপাল বুড়ো-আংলাকে পিঠে নিয়ে নাটবাড়িতে যাব, যদি কেউ চুয়োদের তাড়াতে পারে তো এই ছোকরা।” বলে চকা হাড়গিলের সাথে রিদয়ের আলাপ করিয়ে দিলে।
টিকটিকির মতো বুড়ো-আংলাকে দেখে হাড়গিলে একবার গলার থলি ফুলিয়ে খানিক হেলে-দুলে হেসে নিলেন। তারপরে ঝপ করে ঠোঁটে করে রিদয়কে আকাশে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে লোফালুফি শুরু করে দিলেন, রিদয় ভয় পেয়ে চীৎকার করতে লাগল। চকা তাড়াতাড়ি ছুটে এসে বললে – “জং বাহাদুর করেন কি! ওটা মানুষ – ব্যাঙ নয়, ওকে ছাড়ুন, গেল যে!”
“মানুষ!” বলেই হাড়গিলে মাটিতে রিদয়কে নামিয়ে দিয়ে দু-চারবার ডানা আপসে নৃত্য করে বললেন – “বুরুঞ্জিতে ঠিক তো লিখেছে, অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ এই মহাপুরুষ এসেছেন ঠিক ভূতচতুর্দশীতেই, আর ভয় নেই, আমি এখন গিয়ে নাটবাড়ির সকলকে এ খবর দিচ্ছি। জয় গণেশের জয়” – বলে হাড়গিলে নাটবাড়ির দিকে উড়ে গেল।
হাড়গিলের ব্যবহারে রিদয় ভারি চটে ছিল, সে গোঁ হয়ে চকার পিঠে উঠে বসল। নাটবাড়ির চুড়োয় একখানা যাঁতার মতো পাথর, তার মাঝখানটায় রাজাদের ধ্বজি গাড়বার একটা গর্ত, সেই গর্তে খান দুই পুরোনো হোগলা-পাতার মাদুর বিছানো, তার উপরে কাঠকুটো আর পালকের তোশক, একপাশে কোন কালের রানীদের ছেঁড়া কাপড়ের এক টুকরো জরির আঁচল মাদুর-ছেঁড়ার মধ্যে ঝিকমিক করছে, কতকালের মরচে-ধরা একটা খিল-ভাঙা তালা, একটা কলঙ্ক-পড়া রুপোর চুষিকাঠি, ভোঁতা একটা শরের কলম, ছেঁড়া একপাটি জরির লপেটা জুতো, আধখানা পরকলা লাগানো শিং-এর চশমা একটা, গেল বছরের ফাটা চিনের পেয়ালার মতো গোটাকতক ডিমের খোলা, পেটটা ফুটো-করা একটা আধমরা ব্যাঙ, এমনি সব নানা সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে বাসাটা ভর্তি। কতকালের যে বাসা তার ঠিক নেই, তার গায়ে ছোট-বড় ঘাস-পাতা গজিয়ে গেছে, এমন কি গোটাবারো লতাওয়ালা একটা বটগাছ পর্যন্ত, তাতে আবার ফল ধরেছে।
চকার সঙ্গে রিদয় এসে দেখলে নাটবাড়ির সবাই এসে আজ বাসায় হাড়গিলেকে ঘিরে কি সব পরামর্শ করছে, বুড়ো ভুতুম পেঁচা একদিকে বসে গোল দুই চোখ বার করে কেবলি হুঁ-হুঁ সায় দিচ্ছে কালো বেরালটা লেজ নাড়ছে আর মিউমিউ করে কি যে বকছে তার ঠিক নেই, হাড়গিলে মাঝে বসে কেবলি গলার থলি ঝাড়ছেন আর পাঁচ গণ্ডা বুড়ো নেংটি ইঁদুর শুকনো মুখে একধারে চুপটি করে বসে এদিক-ওদিক কান ঘোরাচ্ছে।
ইঁদুর বেরাল পেঁচা হাড়গিলে এখানে জমা হয়েছে দেখেই রিদয় বুঝলে নাটবাড়িতে আজ বিষম গণ্ডগোল! চকা আর রিদয়ের দিকে কেউ আজ চেয়েও দেখলে না, সবাই চেয়ে রয়েছে হাঁ করে যেদিক দিয়ে দলে-দলে চুয়ো সাঁর বেঁধে মাঠের উপর দিয়ে আসছে!
ভুতুম পেঁচা খানিক ভূতের মতো নাকিসুরে চুয়োদের বিষম উৎপাতের কথা বর্ণনা করে চলল। বেরাল মিউ মিউ করে খানিক কাঁদুনি গাইলে – “এই বুড়ো বয়সে শেষে কি চুয়োর পেটে যেতে হবে নাকি, আণ্ডাবাচ্চা কাউকেই তারা রেহাই দেবে না!”
হাড়গিলে ইঁদুরদের ধমকে বললেন – “এই দুঃসময়ে তোমাদের চাঁইদের বারোয়ারিতে যেতে দিয়ে যত মুখ্যুমি করেছ, লড়াই দেবার জন্যে একটা লোক পর্যন্ত রইল না কেল্লায়! আমি কি এই বুড়ো বয়সে চুয়ো মেরে ঠোঁটে গন্ধ করতে পারি, ছি-ছি! এমন করে কেল্লা ফাঁকা রেখে সব নেংটির চলে যাওয়াটা ভারি অন্যায় হয়েছে!”
ইঁদুরগুলো কেবল হতভম্ব হয়ে বেরালের দিকে চাইতে লাগল।
বেরাল ফোগলা দাঁত খিঁচিয়ে বললে – “আমার দিকে দেখছ কি? তোমরা নিজেদের ঘর সামলাতে না পার নিজেরাই মরবে। আমার কি, আমি ষষ্ঠীর দুয়ারে গিয়ে ধন্না দেব। সেখানে পেসাদের কিছু না পাই দুধ তো আছে।”
ইঁদুররা হাড়গিলের দিকে চাইতে তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন – “আমি আর কি করতে পারি বল? এই অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ টিকটিকির মতো মানুষটিকে তোমাদের এনে দিলেম, এঁর সঙ্গে পরামর্শ করে যা ভালো হয় কর। আমার যথাসাধ্য তো তোমাদের জন্যে করলেম, এখন যা করেন গণেশ ঠাকুর। আঃ আর পারিনে!” বলে হাড়গিলে পা মোড়া দিয়ে আকাশের দিকে ঠোঁট তুলে চোখ বুজলেন।
ইঁদুর বেরাল পেঁচা একবার রিদয়ের মুখের দিকে চাইলে তারপর আস্তে-আস্তে সভা ছেড়ে যে যার বাসায় যাবার উদ্যোগ করলে। এদের রকম দেখে চকার এমনি রাগ হচ্ছিল যে সব কটাকে ঠেলে সে চুয়োদের মুখে ফেলে দেয়, বিশেষ করে ওই একঠেঙ্গে হাড়গিলেটাকে এক ধাক্কায় নাটবাড়ির চুড়ো থেকে একেবারে নিচে ফেলে দেবার জন্যে চকা নিসপিস করতে লাগল।
রিদয় তাকে চোখ টিপে বললে – “চুয়োদের জব্দ করা শক্ত নয়, যদি নাটবাড়ির ঠাকুরঘরের লক্ষ্মী পেঁচা আমাকে এখনি একবার, ঠাকুরঘরে যে দুয়োরের উপরে কুলুঙ্গীতে গণেশ বসে আছেন, তাঁর কাছে নিয়ে যান!”
ভুতুম অমনি তাড়াতাড়ি লক্ষ্মী পেঁচাকে ডেকে আনলে। রিদয় লক্ষ্মী পেঁচাকে গণেশের কথা শুধোতে সে বললে – “ঠাকুর তো এখন শয়ন করেছেন, ঠাকুরঘরের দরজা বন্ধ!”
রিদয় চকার সঙ্গে চুপিচুপি দু-একটা কথা বলাবলি করে পেঁচাকে বললে – “পুরোনো দরজা খুলে নিতে কতক্ষণ? চল, পথ দেখাও।”
লক্ষ্মী পেঁচা আগে পথ দেখিয়ে চলল, সঙ্গে রিদয়।
চকা বললে – “এই ভূতচতুর্দশীর রাত্রে পোড়ো বাড়িতে একা তোমার সঙ্গে যেতে দিতে মন সরছে না – যদি পেঁচোয় পায়, আমাকেও সঙ্গে যেতে হল।”
হাড়গিলে অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন – “না না, সে হতে পারে না, তুমি গেলে গোল হবে, বুরুঞ্জিতে লিখেছে এই ভূতচতুর্দশীতে একা এই অঙ্গুলি প্রমাণ মানুষটি এসে নাটবাড়িতে মুষিকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে হাড়গিলে বংশের সুখসৌভাগ্য বৃদ্ধি করবেন। তুমি গেলে শাস্ত্রের কথা মিথ্যা হয়ে যায়। এই নাও শনিবার অমাবস্যাতে তোলা এই মানকচুর শিকড় সঙ্গে রাখ, ভূত পালাবে।” বলে রিদয়ের হাতে তাঁর বাসার ছেঁড়া মাদুর একটু ভেঙে দিয়ে তার কানে মন্তর দিলেন।
রিদয় ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে কচুর শিকড় গুঁজে চিলে ছাতের গোল সিঁড়ি বেয়ে পেঁচার সঙ্গে নেমে চলল, মনে-মনে ভূতের মন্তর আওড়াতে-আওড়াতে – হং সং বং লং হাঃ ফুঃ । ভূতচতুর্দশীর রাত্রি এমন অন্ধকার যে, ভূতকে পর্যন্ত দেখা যায় না! রিদয় সেই অন্ধকারে পেঁচার সঙ্গে চিলের ছাতের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ক্রমাগত নেমে চলেছে। দুদিকে পিছল পাথরের দেওয়াল, তার মাঝে-মাঝে এক-একটা ঘুলঘুলি, সেখান দিয়ে একটু যা আলো আর বাতাস আসতে পায়! রিদয় দেওয়ালের গা ঘেঁষে টিকটিকির মতো পায়ে-পায়ে নামছে, অন্ধকারে পেঁচা যে কোনদিকে চলেছে সেই জানে, কেবল সে এক একবার হাঁকছে – “উঁচা-নিচা!” আর সেই ডাক শুনে রিদয় চলেছে, ইস্ক্রুপের প্যাঁচের মতো পাক-দেওয়া সিঁড়ি পার হয়ে অন্ধকারে।
একটা কিসের গায়ে হাত পরতেই সেটা ক্যেঁ বলে ঝটপট করে উঠল, এক জায়গায় জল পড়ে ডোবা মতো হয়েছে হঠাৎ ঠাণ্ডা জলে পা রেখেই রিদয় থমকে দাঁড়াল, পেঁচা অমনি বলে উঠল – “বাঁয়ে ঘেঁষে।” কখনো বাঁয়ে কখনো ডাইনে কখনো উঁচায় কখনো নিচায় এইভাবে রিদয় চলেছে! চোখে কিছু দেখছে না, কানে শুনছে খালি কি যেন এখানে কি একটা ঝটপট করে উঠল, ওখানে মাথার উপরে থেকে কি ঠিক-ঠিক করে ডাক দিলে, কখনো শুনলে পাথরের গায়ে কে নখ আঁচড়াচ্ছে, ওদিকে কারা যেন দুদ্দার করে পালিয়ে গেল, পায়ের কাছে কি একটা পাশমোড়া দিলে, হঠাৎ গালে যেন কে একটা চিমটি কেটে গেল, কানের কাছে চট করে একটা কে ‘টু’ দিয়ে পালাল! এর উপরে রিদয় নানা বিভীষিকা দেখছে – হঠাৎ এক জায়গায় গোটাকতক চোখ আলেয়ার মত জ্বলেই আবার নিভে গেল। যেন ইলিশ মাছের জাল নাকের সামনে কে একবার ঝেড়ে দিয়েই সরে পড়ল, হঠাৎ একটা গরম হাওয়া মুখে লাগল, তার পরেই বরফের মতো বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিলে!
রিদয়ের মনে হচ্ছে এইবার সিঁড়ি শেষ হল কিন্তু খানিক গিয়ে আবার সিঁড়ি, আবার চাতাল, আবার ধাপ, আবার দেওয়াল, এমনি ক্রমাগত ওঠা, নামা করতে-করতে চলা – এর যেন শেষ নেই। আঁধি ধাদি ভূত পেত্নি ব্রহ্মদৈত্য ঝাম ঝামড়ি কন্ধকাটা শাঁকচুন্নি ডাকিনী যোগিনী ফ্যাল ভেলকি, পেটকামড়ি সবাই আজ ভূতচতুর্দশীতে জটলা করতে বেরিয়েছে, আঁদারে-পাঁদাড়ে রিদয়কে দেখে কেউ ঝম-ঝম করে নাচতে লাগল, কেউ ফিক-ফিক করে হাসতে লাগল। খুস-খাস খিট-খাট আওয়াজ করে ভূতেরা কেউ খড়ম পায়ে, কেউ হাড় মড়-মড় করে, কেউ বা ঘণ্টা বাজিয়ে, কেউ বা চটি চটপট করে তার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। ভয়ে রিদয়ের হাত-পা অবশ হয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময় সরু গলির শেষে মস্ত একটা চাতালের উপর এসে পেঁচা ‘ঠাকুরবাড়ি’ বলেই অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল!
অনেকক্ষণ ধরে কারুর সাড়াশব্দ নেই, রিদয় অন্ধকারে হাতড়ে দেখলে চারদিকে দেওয়াল, দরজাও নেই, কিছুই নেই! রিদয় ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, একটা কে তার পায়ে এসে সুড়সুড়ি দিয়ে তাকে আস্তে-আস্তে দেওয়ালের কাছে টেনে নিয়ে গেল, তারপর কিঁচ করে যেন চাবি খোলার শব্দ হল! একটা মস্ত দরজা হড়-হড় করে গড়িয়ে আপনি যেন খুলে যাচ্ছে, পায়ের নিচে পাথরের মেঝেটা তারই ভারে কাঁপছে!
ঠিক সেই সময় বিকট শব্দে মাথার উপরে ঘটং-ঘং-ঘটং-ঘং করে রাত বারোটার ঘড়ি পড়ল। অমনি দপ-দপ করে চারদিকে আলোয়-আলো এসে দেওয়ালির পিদুম জ্বালিয়ে দিলে, আর ঘণ্টা নাড়তে-নাড়তে ভয়ঙ্কর এক কাপালিক ব্রহ্মদৈত্য মড়ার মাথার খুলিতে ঘিয়ের সলতে জ্বালিয়ে উপস্থিত –
গলে দোলে ভীষণ রুদ্রাক্ষ মালা
পিঙ্গল নয়নে যেন মহেশের কোপানল জ্বালা!
রিদয় দেখলে ঘরের মধ্যে কালো পাথরের প্রকাণ্ড এক মূর্তি, তাতে কতকালের রক্তচন্দনের ছিটে, ভৈরবটির জিব লক-লক করছে আর গায়ে সোনা-রুপো হীরে-জহরত আর মুণ্ডমালা ঝুলছে! ব্রহ্মদৈত্য আরতি আরম্ভ করলেনঃ
রম্-ঝম্ রম্-ঝম্ শব্দ উঠে
ভূত-প্রেত পিশাচ দাঁড়ায় সবে জোড় করপুটে।
তাধিয়া-তাধিয়া বাজায় তাল
তাতা থেই-থেই বলে বেতাল
ববম-ববম বাজায়ে গাল
ডিমি-ডিমি বাজে ডমরু ভাল
ভবম-ভবম বাজায়ে শিঙ্গা
মৃদঙ্গ বাজায় তাধিঙ্গা-ধিঙ্গা
ধেই-ধেই নাচে পিশাচ দানা।
রিদয় হাঁ করে ভূতের কাণ্ড দেখছে এমন সময় পেঁচা কানের কাছে ফিস-ফিস করে বললে, “এখানে নয়, পাশের কুঠুরীতে গণেশ ঠাকুরের সভা।” হোমের ধোঁয়ায় আলোগুলো ক্রমে ঘোলাটে হয়ে এল; সেই সময় রিদয় পেঁচার সঙ্গে আস্তে-আস্তে পাশ কাটিয়ে গণেশ মহালের গলিতে সেঁধোল। দেউরিতে একটা মোটাপেট হিন্দুস্থানী দারোয়ান সিদ্ধি খেয়ে খালি গায়ে ভোঁ হয়ে ঢোলক পিটছে, অন্ধকারে রিদয় তাকেই গণেশ ভেবে ঢিপ করে একটা পেন্নাম দিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়াল।
দারোয়ানজী ভারি গলায় বললে, “কৌন হোঃ?”
রিদয় কিছুই বুঝলে না, তবু ঘাড় নেড়ে বললে – “আজ্ঞে আমি রিদয়, নেংটি ইঁদুরেরা বড় বিপদে পড়েছে তাই – ”
“ক্যা বক্-বক্ লাগায়া” – বলে দারোয়ান আবার ঢোল পিটতে লাগল।
রিদয় ভাবলে গণেশ বকের কথা শুধোচ্ছেন; সে তাড়াতাড়ি বললে – “আজ্ঞে বকের সঙ্গে আমার আলাপ আছে, কিন্তু আজ আমি ইঁদুরদের হয়ে লড়াই করতে চাই, সেইজন্যে আপনার ঐ জয়ঢাকটি আমি চাই।” বলে রিদয় যেমন ঢোলকে হাত দিয়েছে, অমনি গণেশের দারোয়ান ধমকে উঠল – “ধেৎ তেরি!”
রিদয় ভয়ে দশহাত পিছিয়ে পড়ল – সেই সময় পেঁচা এসে তার কানে-কানে বললেন – “করছ কি? উনি গণেশ নন, ভিতরে চল!” তারপর দারোয়ানের সঙ্গে পেঁচা গিয়ে কি খানিক বকাবকি করলে, তখন দারোয়ান দুয়ার ছেড়ে দিয়ে বললে – “আইয়ে বাবু!”
মহলের মধ্যে গণেশের পরিচয় চৌষট্টি ভাগ কলাবৌ, কেউ রঙ-তুলি দিয়ে আল্পনা দিচ্ছিল, কেউ সেঁতার বাজিয়ে গান-বাজনা করছিল, কেউ মালা গাঁথছিল, কাথা বুনছিল, এমনি চৌষট্টি খাম্বা ঘরের মধ্যে সবাই এক-এক কাজে, হঠাৎ রিদয়কে দেখে সবাই মাথায় ঘোমটা টেনে জুজু-বুড়িটি হয়ে বসল।
পেঁচা সেখান থেকে রিদয়কে নিয়ে আর একটা হাতিশুঁড়ো গজদন্তের খিলানের মধ্যে দিয়ে গণপতি গণেশের বৈঠকখানায় এনে হাজির করে দিলে। রিদয় দেখলে ঘরের উত্তর গায়ে মস্ত একটা তক্তাপোশে গেদা হেলান দিয়ে থান-ধুতি মেরজাই পরে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, তাঁর গজদাঁতও নেই শুঁড়ও নেই মোটা পেটও নয়, দিব্যি দেবতার মতো চেহারা।
পেঁচা রিদয়ের কানে-কানে বললে – “ইনিই রাজা গণেশ, এঁকে যা দরবার করতে হয় কর।”
রিদয়ের মুখে কথা নেই, ইনিই গণেশ! ভয়ে-ভয়ে সে এগিয়ে বললে – “মশায়ের নাম?”
উত্তর হল – “আমি গণপতি, কি চাই?”
রিদয় খুব নরম হয়ে বললে – “যে ইঁদুরগুলিতে চড়ে মশায় বেরিয়ে বেড়ান সেগুলির বড় বিপদ উপস্থিত!”
গণেশ ভুরু কুঁচকে বললেন – “ইঁদুর! আমি তো কোনোদিন ইঁদুরে চড়িনে!”
রিদয় বললে – “আজ্ঞে, ভুলে যাচ্ছেন আপনি, হস্তী-বেশ ধরে যখন হাওয়া খেতে বেরোন, সেই সময় ইঁদুর আপনার গাড়ি –
গণেশ হোঃ-হোঃ করে হেসে বললেন – “তুমি পাগল নাকি আমাকে সুদ্ধ গাড়ি টেনে চলতে পারে যে ইঁদুর তাকে তুমি কোথায় দেখলে? ছেলেবেলায় আমি দু-একটা ইঁদুর পুষেছিলেম কিন্তু সবগুলোর বাচ্চা হয়ে আমার ঘরে এমন উৎপাত লাগালে যে , সব ক’টাকে আমি ইঁদুর-কলে ধরে বিদায় করেছি। তুমি ভুল খবর শুনেছ, ইঁদুর আমি চড়িনে, হস্তীবেশেও সঙ সেজে আমি হাওয়া খেতে যাইনে, নিশ্চয়ই কেউ তোমায় ঠকিয়েছে!”
রিদয় অবাক হয়ে বললে “সে কি মশায়, ঘরে-ঘরে ইঁদুর চড়া আপনার ছবি, তাছাড়া আমি নিজে চোখে দেখেছি আপনি ঢোল বাজিয়ে ইঁদুর নাচ করছেন, আমাকে শাপ পর্যন্ত দিয়ে এলেন, এখন বলছেন উল্টো, আমাকে ছলনা করছেন!”
গণেশ গম্ভীর হয়ে বললেন – “বাপু আমি যাই করি, এটুকু জেনো আমি ছলনাও করিনি শাপও দিইনি! ইঁদুরেও চড়িনি কোনোদিন, ঢোলও পিটিনি। ওই আমার দারোয়ানগুলো মাঝে-মাঝে হোলিতে দেওয়ালিতে ঢোল পিটিয়ে আমার কান ঝালাপালা করে, ওদের গিয়ে শুধোও। যদি আর কোনো গণেশ থাকে তো বলতে পারিনে।”
রিদয় চোখ মুছে বললে – “মশায় যে আমাকে শাপ দিলেন, এখন শাপান্ত না করলে তো আমি মারা যাই!”
গণপতি চোখ পাকিয়ে বললেন – “কোনো সাপের ওঝাকে গিয়ে শুধোওগে বলে দেবে, কে তোমায় শাপ দিয়েছে আর কেমন করে শাপান্ত হবে – যাও, আমাকে বিরক্ত কর না!”
রিদয় মুখ কাঁচুমাচু করে বললে – “মশায়, আমি গরীব!”
গণেশ বিরক্ত হয়ে মুখ ফেরালেন।
রিদয় জানত স্তুতি করলেই দেবতারা খুশি হন তাই সে একেবারে গলার বস্তর দিয়ে গণেশের রূপ বর্ণনা করে গণেশ বন্দনা শুরু করে দিলেঃ
খর্বস্তল কলেবর গজমুখ লম্বোদর
বিঘ্ন নাশ কর বিঘ্নরাজ,
পুজা হোম যোগে যাগে তোমার অর্চনা আগে
তব নামে সিদ্ধ সর্ব কাজ।
শুণ্ডে তুলি খৈ মোয়া দন্তে খাও চিবাইয়া
ইঁদুর বাহন গণপতি,
আপনি আসরে উর রিদয়ের আশা পুর
নিবেদিনু করিয়া প্রণতি
গণেশ কানে হাত দিয়ে বললেন – “আরে রাম রাম কি বাজে বকছ, তুমি তো ভালো বিপদে ফেললে দেখি, বোসো আমি একবার বাড়ির মধ্যে থেকে আসছি, বিশেষ কাজ আছে।” বলে গণেশ উঠে গেলেন।
এতক্ষণ গণেশের চৌষট্টি কলাবৌ ঘরে কি হচ্ছে দরজার পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছিলেন, কর্তা উঠে যেতেই গণেশ-দাসীকে দিয়ে রিদয়কে ডেকে তাঁরা শুধোলেন – “হ্যাঁগো তুমি কর্তার কাছে কি নালিশ করছিলে?” রিদয়ের মুখে ইঁদুরের খবর শুনে তাঁরা বলে উঠলেন – “ওমা, এই দরবার করতে এসেছ তা বলতে হয়, ওই আমাদের কুমোর-বৌ কর্তার যে মূর্তিগুলো গড়ে-গড়ে ভটচায্যি মশায়ের হাতে দিয়ে লোকের ঘরে-ঘরে বিক্রি করতে পাঠায়, সেই গণেশের সন্ধান তুমি বুঝি সন্ধান করছ? ওই দারোয়ানজীকে বল সে তোমাকে সেই গণেশের দোকান দেখিয়ে দেবে।”
রিদয় কলাবৌদের পেন্নাম করে আবার দেউড়িতে এসে দারোয়ানজীর সঙ্গে আর একটা ঘুপসী ঘরে গিয়ে দেখলে, দোকানঘরের এক-এক কুলুঙ্গীতে এক-এক রকম গণেশ – গোবর-গণেশ তিনি কলম হাতে পুঁথি লিখছেন, সিদ্ধিদাতা-গণেশ তিনি এক ধামা দিল্লীর লাড্ডু নিয়ে বসেছেন, মাড়োয়ারি-পটির টঙ্ক-গণেশ বসে-বসে খালি আকাশে আঁকশি দিচ্ছেন, হেড়ম্ব-গণেশ তিনি খুব আড়ম্বর করে ঢোল পিটছেন।
রিদয় ঢিপ করে তাঁকে নমস্কার করে বললে – “গণেশদাদা, চিনতে পারেন?” হেড়ম্ব রিদয়ের কথার জবাব দিলেন সমস্কৃত দেবভাষায় “বুং!” রিদয় ভাবলে এ তো মুশকিল, যদি বা কত কষ্টে এসে ধরলেম এখন কথা না বুঝলে উপায়? সে একবার ইঁদুরের দিকে, একবার ঢোলকের দিকে, একবার নিজের দিকে আঙুল নেড়ে ইশারায় বোঝালে ঢোলকটা চাই। গণেশ ঢোলকটা রিদয়কে দিয়ে ওদিক-ওদিক শুঁড় নেড়ে কি বললেন বোঝা গেল না। রিদয় শুধু শুনলে – “বুং চটাপট্ ত্বং কং করং বাদনং পুনস্তম্ ব্যস্তম্ নাদম্ কুণ্ডমকুলম্ পৌউন্ড্রবর্ধমনম্ গণ্ডস্থলম্ আগচ্ছতু।
রিদয় গণেশের মুখ দেখে বুঝলে তিনি খুশি হয়েছেন। সে অমনি আচার্যি পুরুতকে দুর্গোপুজোয় শ্রাদ্ধে শান্তিতে যেমন করে সব মন্তর আওড়াতে শুনেছিল ঠিক তারি নকলে বললে –“হুং ভূত স্বাহা, কুরু-কুরু কুণ্ডলিনী নমোঃ আসিতো দেবল গৃহ্যং কুরু ভুত্যং হং যং ছট ফট ব্রহ্মবিদ্যা হবিষে স্বাহা অহঃ চিটপটাং হুং শান্তি ভূশান্তি ভ্যূতেরশান্তি অষুধেঃশান্তি ছিহরি ছিহরি ছিহরি হরিবোল হরিবোল হরিবোল সূর্য প্রণাম।” গণেশ খুশি হয়ে দুবার ঘাড় নেড়ে “তথাস্তু” বলে চোখ বুজলেন।
রিদয় আস্তে-আস্তে ঢোলক নিয়ে বেরিয়ে এল। দারোয়ান ঘরের দুয়োরেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে অমনি বখশিশের জন্যে হাত পাতল, রিদয় এদিক-ওদিক দেখে আস্তে-আস্তে মান-কচুর শিকড়টি বার করে বললে – “দারোয়ানজী আর তো সঙ্গে কিছু নেই, এইটে নাও।”
দারোয়ান “হাৎ-তেরি”, বলে হাত ঝাড়া দিলে।
শিকড় যেমন মাটিতে পড়া অমনি পেঁচা রিদয়কে ছোঁ দিয়ে একেবারে ঘুরোনো সিঁড়ি বেয়ে ছাতে এসে উপস্থিত। সঙ্গে-সঙ্গে পেঁচো এসে রিদয়কে পেয়ে বসল – রিদয় অজ্ঞান হয়ে পড়ল আর বহুরূপীর চামড়ার মতো তার গায়ের রং লাল, নীল, হলদে, রকম-রকম বদলাতে আরম্ভ করলে। হাড়গিলে অমনি তাড়াতাড়ি ছুটে এসে মন্তর পড়ে পেঁচো ঝাড়াতে বসে গেলেনঃ
স্কন্ধাপসার শকুনী
অন্ধ পুতনা শীত পুতনা মুখমণ্ডিকা
নৈগমেষ প্রসীদতু
ক্লীং চর্চ হুং হুং ঝংশা
ওঁলং শ্রীং কপালিকং জং জং
তিষ্টতি মূষিকং চং চং চর্বশং হংসঃ
হুং ফট্ স্বাহা।
মন্তরের চোটে রিদয় হাঁ করলে, যেন খেতে এল, অমনি চট করে হাড়গিলে ধুলোপড়া বেড়ি দিয়ে পেঁচোর মুখবন্ধন করে দিলেনঃ
ধুল-ধুল স্বর্গের ধুল
মর্তের মাটি
লাগ-লাগ পেঁচোর দন্ত কপাটি
হাঁ করে নাড়িস তুণ্ড খা পেঁচির মুণ্ড
যাঃ ফুঃ
কার আজ্ঞে হাড়িপ বাবার আজ্ঞে
হাড় মড়-মড় হাড়গিলের আজ্ঞে
শিগ্রি যাঃ শিগ্রি যাঃ।
পেঁচো রিদয়কে ছেড়ে পালাতেই রিদয় ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। চকা রিদয়ের কানে কানে শুধোলো – “গণেশ কি বললেন?”
রিদয় বললে – “তা তো সবটা বুঝলুম না, কেবল আসবার সময় তিনি বললেন – তথাস্তু।”
চকা হেসে বললে – “তবে আর কি, কেল্লা মার দিয়া। আর তোমার ভয় নেই। একদিন সকালে উঠে দেখবে, যে রিদয় সেই রিদয় হয়ে গেছ। চল এখন যুদ্ধং দেহি করা যাক গে।”
এদিকে কেল্লা খালি পেয়ে চুয়োর দল এ-ওর পিঠে চড়ে একটা ঘুলঘুলি দিয়ে কেল্লার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটার পর একটা নেংটি ইঁদুরের গড়-ভাণ্ডার সব দখল করে লুঠের চেষ্টায় দলে দলে পিলপিল করে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে তেতলায় চৌতলায় পাঁচতলায় উঠে ছতলায় রাজসভায় ঠাকুরবাড়িতে, এমন কি অন্দরমহলে পর্যন্ত ঢোকবার যোগাড়, দু-একটা চুয়ো ছাতেও উঠে হাড়গিলের বাসাটা পর্যন্ত প্রায় এগিয়েছে। এমন সময় উত্তর দক্ষিণ থেকে নেংটি ইঁদুরের দলকে খবর দিয়ে চকার বাকি হাঁসেরা ফিরে এল। ঠিক সেই সময় গণেশের ঢোলকে রিদয় চাঁটি বসালে – ধিক-ধিক-ধিক ধাঁকুড়-ধাঁকুড়।
ঢোলের শব্দে চুয়োর দল লেজ উঁচু করে শিউড়ে উঠে যে যেখানে ছিল থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর তালে-তালে লেজ দোলাতে-দোলাতে দলে-দলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলে। চুয়োতে-চুয়োতে কেল্লার প্রকাণ্ড ছাত ভরে গেল, রিদয় চুড়োয় বসে ঢোল বাজাচ্ছে –
চুয়ো, হাততালি দুয়ো
নেংটি ধিং নিগিরি টিং
ধাতিং তিং নাতিং থিং
চুয়ো, হাততালি দুয়ো।
আর সব চুয়ো লেজে-লেজে জড়াজড়ি করে নৃত্য করছে, পেঁচা পালক ফাঁপিয়ে, বেরাল লেজ ফুলিয়ে, হাড়গিলে গলার থলি দুলিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাল দিচ্ছে! সব চুয়ো যখন ছাতে এসে জড়ো হল, তখন রিদয় চকার পিঠে ঢোল বাজাতে বাজাতে আকাশে উড়তে আরম্ভ করলে, চুয়াগুলো নাচতে নাচতে লাফাতে থাকল। আনন্দে তারা মনে করলে যেন সবার ডানা গজিয়েছে, তারা প্রথমে ছাতের পাঁচিল, তারপর ছাতের আলসে, শেষে একেবারে আকাশে ঝম্প দিয়ে ডিগবাজী খেতে-খেতে মাটিতে এসে পড়ে জোড়া-জোড়া হাঁ করে আকাশের পানে চার পা তুলে চেয়ে রইল।
চুয়োগুলো নাটবাড়ির লীলাখেলা সাঙ্গ করে সরে পড়েছে অনেকক্ষণ। হাড়গিলে, বেরাল, পেঁচা পর্যন্ত ঢোলের আওয়াজে এমনি মশগুল হয়ে গেছে যে পায়ে-পায়ে কখন সবাই একেবারে ছাতের প্রায় কিনারায় এসে পড়েচে টেরই পায়নি, হঠাৎ রাত একটার ঘণ্টা পড়ল অমনি রিদয় ঢোল বন্ধ করলে, সবাই চটকা ভেঙে দেখলে কেল্লা খালি, আকাশে অমাবস্যার চাঁদ দেখা দিয়েছে, চুয়ো আর একটাও নেই। রিদয়কে নিয়ে চকা উড়ে চলেছে। হাড়গিলে, পেঁচা চটকা ভেঙেই দেখলে বেরাল আলসে থেকে আকাশে একটা পা বাড়িয়ে চুয়োদের মতো ঝাঁপ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে আর কি! হাড়গিলে তার লেজ ধরে এক টান দিয়ে বললে – “কর কি, পড়ে মরবে যে!”
বেরাল ফ্যাল-ফ্যাল করে খানিক চেয়ে থেকে – “ইকি” – বলেই ফ্যাঁচ করে হেঁচে আস্তে-আস্তে পিছিয়ে এল।
ওদিকে নেংটির দল আস্তে-আস্তে কেল্লায় এসে যে যার ঘরে ঢুকে ধান ভানতে বসে গেল। চুয়ো তাড়াবার জন্যে হেড়ম্ব-গণেশের ঢোলককে ছাড়া আর কাউকে যে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার সেটা তাদের মনেই এল না!
রাতের মধ্যে পেঁচার দল প্রায় বারো আনা মরা চুয়ো খেয়ে সাফ করে দিলে, বাকি যা রইল সেগুলোর উপরে সকালবেলায় কাক চিল এসে পড়ল। বেলা আটটার মধ্যে সব সাঙ্গ হয়ে গেল।
আজ অমাবস্যা তিথি, রাত্তিরটা হিমালয়ের এপারটায় কাটিয়ে কাল থেকে হাঁসেরা পাহাড়ের ওপারে নিজের-নিজের দেশের দিকে রওনা হবে, দেশের কথা ছাড়া আজ আর কারু মুখে অন্য কথা নেই। আকাশে মেঘ করেছে, বিষ্টি নেই, কেবল ঠাণ্ডা হাওয়া আর শিতালু বাতাস। মাথার উপর দিয়ে দলে-দলে পাখি হু-হু করে উত্তরমুখো চলেছে – সবাই দেশে যেতে ব্যস্ত, তার উপর এ-বছর পাখিদের বারোয়ারি পড়েছে। কুঁচেবক কুঁচিবক তারা বারোয়ারির নেমতন্ন করতে বেরিয়েছে, যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে চেঁচিয়ে তারা জানাচ্ছে পুন্নিমার দিনে বারোয়ারিতে যেতে হবে ভারি জলসা।
চকা নিমন্ত্রণ পেয়ে চারি খুশি, রিদয়কে বললে – “তোমাদের দুজনের কপাল ভালো, বারো বছর অন্তর কৈলাস-পর্বতের ধারে মানস-সরোবরে এই বারোয়ারি মজলিস হয়, সেখানে সারসের নাচ, হরিণ-দৌড়, আর্গিন পাখির কনসার্ট, গাঙ-শালিকের গীত, ছুঁচোর কেত্তন, শেয়ালের যুক্তি, মেড়ার লড়াই, ভালুক-নাচ, সাপ-বাজি, মাছের চান, এমনি আরো কত কি হবে তার ঠিকানা নেই। ব্রহ্মার হাঁস কর্মকর্তা, স্বয়ং পশুপতি হবেন সভাপতি, পৃথিবীর পশুপক্ষী সেখানে হাজির হবে। মানুষের কপালে এমন আশ্চর্য কারখানা দেখা এ-পর্যন্ত ঘটেনি, কোথায় লাগে তোমাদের হরিদ্বারের কুম্ভমেলা! আর পাহাড়ের ওধারে আমাদের দেশটা কি চমৎকার তোমায় কি বলব, পালতি জলা – যেটা ব্রহ্মার হাঁস আর পৃথিবীর জলচর পাখি, কি পোষা কি বুনো সবাইকার আড্ডা, সেটা যে কত বড় তা কেউ জানে না, উত্তরের সমস্ত নদী পাহাড় এসে সেইখানেই শেষ হয়ে আবার নতুন-নতুন নাম নিয়ে দক্ষিণ দিকে নেমে এসেছে। এই পালতির উত্তর গায়ে ঢোলা পর্বত, সেই ঢোলা পর্বতের ওপারে পাঁচিলে ঘেরা চীন মুল্লুক, তারো ওধারে বরফের দেশের ধারে ‘তন্দ্রা’ বলে একটা দেশ। বছরে প্রায় দশ মাস সেখানে বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে ফুল পাতা নদ নদী সবাই ঘুমিয়ে থাকে, কেবল বসন্তের মাস দুই সেখানে সূর্য দেখা দেন, আর অমনি সারা দেশ ফুলে-ফলে পাতায়-ঘাসে দেখতে-দেখতে সবুজ হয়ে ওঠে, আর আমরা সব পাখিরা মিলে সেখানে গিয়ে বাসা বেঁধে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে চলে আসি। বসন্তের শেষে পালতি জলায় বাচ্চারা বড় হবার জন্যে আপনারাই উড়ে আসে, আমরা সারা বছর দেশে-বিদেশে ঘুরে আবার বছরের এই সময়টিতে গিয়ে দেখি আমাদের ছেলে-পিলেরা কেউ বড় হয়েছে, কেউ বড় হয়ে নিজের পথ দেখে নিতে বিদেশে চলেছে, কোনো-কোনো বাচ্চা বা মরে গেছে, কেউ-কেউ বা এরি মধ্যে বিয়ে-থাওয়া করে ঘরকন্না পাতবার চেষ্টায় আছে, কোনো বাচ্ছা বা সন্ন্যাসী হয়ে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, কাউকে ধরে মানুষে খেয়ে ফেলেছে, কাউকে মানুষে গুলি করে মেরে ফেলেছে, আর কাউকে বা তারা জেলখানার মতো খাঁচায় ভরেছে, আর কাউকে বা ডানা কেটে পোষ মানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। বছরের এই সময়টিতে আমরা একবার করে নিজেদের জন্মস্থানে আর পুরনো বাসায় ফিরে আসতে পাই, নিজের ছেলেমেয়ের দেখা পাই, সুখ-দুঃখের দুটো কথা কয়ে নিই, তারপর আবার চলে এদেশ-সেদেশ করে।”
রিদয় বলে উঠল – “আমারও তো দেশ আছে কিন্তু আমার তো সেখানে ফিরতে একটুও ইচ্ছে হয় না।”
চকা বললে – “সে কি! তোমার বাপ মা কেউ নেই নাকি? যখন বড় হবে, বৌ সংসার হবে, ছেলে-পুলে নাতি-পুতি হবে তখন বুঝবে সারা বছরের পরে দেশে ফিরতে কি আনন্দ। তখন দেশের ডাক যখন এসে পৌঁছবে দেখবে মন অমনি উধাও হয়ে ছুটেছে আর কিছুতে মন বসছে না, প্রাণ নীল আকাশে প্রজাপতির মতো সোনার পাখনা মেলে দিয়ে উড়ে পড়তে চাচ্ছে, তখন দেশের কথাই কইতে থাকবে। এর সঙ্গে, তার সঙ্গে, দিন নেই রাত নেই কি সকাল কি সন্ধ্যে কেবল বঁধুর মুখে মধুর হাসিই মনে জাগবে তখন।”
চকার কথা শুনতে-শুনতে রিদয় কেমন আনমনা হয়ে গেল। সারাদিন ধরে আজ কেবলি মনে পড়তে লাগল – আমতলির সেই ঘর ক’খানি, সেই তেঁতুলতলার ঘাট, তেপান্তর মাঠ, হাঁসপুকুরের কাদা জল, তাতে শালুক ফুল, বাড়ির ধারে ঝুমকো-লতার মাচা তার উপরে দুগ্গা টুনটুনি পাখিটি, উঠোনের কোণে তুলসীমঞ্চটি, কালো মাটি-লেপা ঘরের দেওয়াল তার উপরে মায়ের হাতে লেখা লক্ষ্মীপুজোর আলপনা, দড়ির আলনায় বাপের কোঁচানো চাদর, পুরোনো শোবার তক্তা তার উপরে শীতলপাটি আর লাল ঝালর দেওয়া তালপাতার পাখাখানি। সব আজ পরিষ্কার যেন রিদয় চোখে দেখতে লাগল, আর থেকে-থেকে মন তার ঘরে যেতে আকুলি-বিকুলি করতে থাকল – সকাল কেটে দুপুর হয়েছে, তখনো রিদয় আকাশের দিকে চেয়ে ঘরের কথা ভাবছে – দলে দলে কত পাখির ঝাঁক দেশমুখে চলে গেল – “চল-চল চলরে চল” বলতে-বলতে। নাটবাড়ির জলায় যত পাখি –
কাদাখোঁচা জলপিপি কামি কোড়া কঙ্ক
পালতির কুঁচেবক আর মৎস্য বঙ্ক।
ডাহুকা ডাহুকি আর খঞ্জনা খঞ্জন
সারস সারসী যত বক বকীগণ।
তিত্তিরা তিত্তিরা পানিকাক পানিকাকি
কুরবী কুরল চক্রবাক চক্রবাকি।
সবাই দলে-দলে দেশমুখে উড়ে পড়ছে! রিদয় দেখলে মাথার উপর দিয়ে কত পাখির ঝাঁক দেশ-বিদেশ থেকে, কেউ বন ছেড়ে, কেউ খাঁচা ভেঙে হু-হু করে দেশে চলেছে –
ময়না শালিক টিয়া তোতা কাকাতুয়া
চাতক চকোর নুরী তুরী রাঙ্গচুয়া।
ময়ূর ময়ূরী সারিশুক আদি খগ
কোকিল কোকিলা আদি মরাল বিগহ।
সীকরী বহরী বাসা বাজ তুরমতী
কাহা-কুহি লগড় ঝগড় জোড়া ধুতি।
শকুনী গৃধিনী হাড়গিলা মেটেচিল
শঙ্খচিল নীলকণ্ঠ শ্বেত রক্ত নীল।
ঠেকি ভেটি ভাটা হরিতাল গুড়-গুড় –
বাকচা হারিত পারাবৎ পাকরাল
হাতারিয়া করকটে ফিঙ্গা দহিয়াল।
চড়ুই মুনিয়া পাবদুয়া টুনটুনি বুলবুলি ফুলঝুঁটি ভিংরাজ রঙে-রঙে সবুজে-লালে সোনালীতে-রুপোলীতে আকাশ রাঙিয়ে চলেছে যে যার দেশে বাতাসে ডানা ছড়িয়ে। রিদয় কেবলি বসে-বসে দেখতে লাগল আর মনে-মনে বলতে লাগল – “যদি ডানা পেতুম!”
পাখিদের দেখাদেখি ভীমরুল ডাঁশ মশা দলে-দলে উড়তে আরম্ভ করেছে, চকার দলের হাঁসেরা আর থির থাকতে পারছে না। এখনো সারারাত এখানে কাটাতে হবে, তারা কেবলি উসখুস করছে আর ডানা ঝাড়া দিচ্ছে!
চকা একবার রিদয়ের কানের কাছে বলে গেল, যা কিছু নেবার আছে সঙ্গে, এইবেলা বেঁধে-ছেঁদে রাখ, কাল ভোরেই রওনা হতে হবে। রিদয়ের দেশের জন্য মনটা আনচান করছে কিন্তু বেড়াবার শখ এখনো মেটেনি। সে পথের মাঝে নিজের আর খোঁড়ার জন্যে গোটাকতক গুগলী টোপাপানা এটা-ওটা সেটা নিয়ে উলুখেড়ের একটি গেঁজে বুনতে বসে গেল।
থলেটা তৈরি হতে প্রায় সন্ধে হয়ে এলো। হাঁসেরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চোখ বুজে রাতটা কোনো রকমে কাটিয়ে দেবার যোগাড় করছে এমন সময় চকা এসে রিদয়কে শুধালো – “খোঁড়াকে দেখেছ কি? তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” রিদয় তাড়াতাড়ি থলে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বললে – “সে কি, গেল কোথায়, শেয়াল নিলে না তো?”
চকা শুকনো মুখে বললে – “এই তো একটু আগেই ছিল, হঠাৎ গেল কোথায়!”
রিদয় বিষম ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক খোঁজা-খুঁজি করতে লাগল। একে সন্ধ্যা হয়ে গেল, যেখানে পাখির ডাক শোনে সেইদিকে রিদয় ছুটে যায় ঝোপ-ঝাড় নেড়ে দেখে, নাম ধরে ডাক দেয়, এমনি সারারাত রিদয় ছুটোছুটি করতে লাগল অন্ধকারে জল কাদা ভেঙে! নাটবাড়ির উঠোনটা পর্যন্ত রিদয় খুঁজে এল, কিন্তু সুবচনীর খোঁড়া-হাঁস কোথাও নেই!
এদিকে সকাল হয়ে এল, চকা বললে – “সে নিশ্চয়ই অন্য দলে মিশে এগিয়ে গেছে, আর মিছে খোঁজা, চল আমরা বেরিয়ে পড়ি, সময় উৎরে যাচ্ছে!”
রিদয় ঘাড় নেড়ে বললে – “তাকে না নিয়ে আমি এখান থেকে নড়ছিনে, তোমরা যেতে চাও যাও।”
চকা মুশকিলে পড়ল! রিদয় নড়তে চায় না, এদিকে সব হাঁসেরই দেশে যাবার টান রয়েছে, তবু খোঁড়ার সন্ধানের জন্যে চকা আরো এক ঘণ্টা দেরি করলে, তাতেও যখন খোঁড়ার সন্ধান পাওয়া গেল না তখন তারা রিদয়কে একলা রেখে চট করে দেশ থেকে ঘুরে আসবার জন্য উত্তরমুখে উড়ে পড়ল – আসি-আসি বলতে-বলতে।
চকার দল চলে যেতে রিদয়ের চারদিক যেন শূন্য বোধ হতে লাগল! সে আস্তে-আস্তে নাটবাড়ির ভাঙা পাঁচিলটা আর একবার সন্ধান করতে চলেছে, এমন সময় দূর থেকে দেখলে খোঁড়া কিরাশ-কলমীর ডাঁটা মুখে নিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে পাঁচিলের গায়ে একরাশ ভাঙাচোরা পাথরের মধ্যে গিয়ে সেঁধোলে। এমনি খোঁড়াকে শেওলাগুলি নিয়ে সেখানটায় আনাগোনা করতে দেখে রিদয়ও লুকিয়ে-লুকিয়ে পাঁচিলে উঠে দেখলে – জড়ো করা পাথরের মধ্যে চমৎকার ছাই রঙের একটি বালিহাঁস শুয়ে আছে, খোঁড়া তার মুখে খাবার তুলে-তুলে দিচ্ছে আর দুজনে কথা হচ্ছে – “আজ কেমন আছ? তেমনই? ডানার ব্যথাটা যায়নি?”
“না, এখনো নাড়তে গেলে বুকটায় ব্যথা করে।”
“মানুষগুলো ক নিষ্ঠুর! ভাগ্যি গুলিটা বুকে লাগেনি।”
“লাগলে আর কি হত, না হয় মরে যেতুম!”
“ছি-ছি অমন কথা বল না, আমার ভারি দুঃখ হয়।”
“আমি তোমার কে যে আমার জন্যে দুঃখ হবে; আজ এই দেখা শোনা এত ভাব এত যত্ন, কাল হয়তো তুমি চলে যাবে, দুদিন পরে মনেও থাকবে না, কে বালি কোথাকার বালি!”
খোঁড়া ঘাড় নেড়ে বললে – “অমন কথা বল না, যতদিন বাঁচব তোমায় ভুলব না, জলার মধ্যে এই দিনটি মনে থাকবে!”
বালিহাঁস একটু ঘাড় হেলিয়ে খোঁড়ার গা ঘেঁষে বললে – “আমি দল ছাড়া হয়ে পড়লুম, কতদিনে সারবো তার ঠিক নেই।”
খোঁড়া বুক ফুলিয়ে বললে – “ভয় কি আমি তোমার কাছে রইলুম, এখন একটু ঘুমোও আমি একবার ঘুরে আসি।”
খোঁড়া চলে গেলে রিদয় আস্তে-আস্তে গর্তের মধ্যে ঢুকে দেখলে এমন সুন্দরী হাঁস সে কোনোদিন দেখেনি, এতটুকু তার মুখটি, পালকগুলি নরম যেন তুলো, সাটিনের মতো ঝকঝক করছে, চোখদুটিও কাজলটানা যেন ঢলঢল করছে! রিদয়কে হঠাৎ দেখে বালিহাঁস ভয় পেয়ে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু বেচারার ডানায় বেদনা, উড়তে পারে না, বালি চআঁ করে কাঁদতে লাগল।
রিদয় তাড়াতাড়ি বললে – “আমি হংপাল হাঁসেদের বন্ধু, খোঁড়া-হাঁসের সেঙাত, আমায় দেখে ভয় কি?”
বালিহাঁস রিদয়ের কথায় সাহস পেয়ে ঘাড়টি একটু নিচু করে বললে – “তাঁর মুখে আপনার নাম শুনেছি, আপনি অতি মহাশয় লোক।” এমনি ভাবে এই কথাগুলি বালি বললে যে, রিদয়ের মনে হল কোনো রাজকন্যে যেন তার সঙ্গে আলাপ করছেন!
রিদয় বললে – “দেখি, আপনার কোথায় হাড়টা ভেঙেছে সোজা করে দিই।” আস্তে-আস্তে বালিহাঁসের ডানার তলায় হাত দিয়ে রিদয় মচকানো হাড়টা ধরে খুট করে যেমন সরিয়ে দেওয়া, অমনি বালিহাঁসটি “মাগো” বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
রিদয় কখনো ডাক্তারি করেনি, পাখিটা মরে গেল ভেবে সে তাড়াতাড়ি পাছে খোঁড়া এসে দেখে সেই ভয়ে লম্ফ দিয়ে চোঁচা চম্পট। খোঁড়া বেশিদূর যায়নি, দু-ঢোক জল খেয়েই ফিরে আসছে, পথের মধ্যে রিদয়ের সঙ্গে দেখা! রিদয় তাড়াতাড়ি খোঁড়াকে বললে – “কোথায় ছিলে, সবাই যে চলে গেল, সারারাত তোমাকে খোঁজাখুঁজি করেছি, চল আর দেরি নয়, এই বেলা গিয়ে তাদের ধরি; বেশিদূর এখনো যায়নি!”
খোঁড়া আমতা-আমতা করে বললে – “বোসো, এখনই যেতে হবে? এত শিগ্রি কি না গেলেই নয়!”
রিদয়ের ভয় হল পাছে খোঁড়া গিয়ে দেখে বালিহাঁস মরে গেছে। সে তাড়াতাড়ি খোঁড়ার পিঠে চেপে তাকে ওড়াবার চেষ্টা করতে লাগল।
খোঁড়া ঘাড় নেড়ে বললে – “দেখ ভাই আমার এক বন্ধু বড় বিপদে পড়েছে, তাকে একলা ছেড়ে যাওয়া তো হতে পারে না, বেচারার ডানাটি জখম হয়েছে নড়তে পারে না, আমি গেলে তাকে কেবা খাওয়ায় আর কেই বা যত্ন করে!”
রিদয়ের ইচ্ছে হাঁস সেদিকে না যায়, সে কেবলি তাকে ফেরাতে চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু খোঁড়ার মন পড়ে আছে সেই রূপকথার রাজকন্যের মতো সুন্দর সেই বালিহাঁসের দিকে। রিদয়কে নিয়ে একবার উত্তরমুখে উড়ল, কিন্তু খানিক পথ গিয়েই বলল – “ভাই, বড় মন কেমন করছে, মানস-সরোবরের এই নাটবাড়ির চালায় দু-চারদিন কাটিয়ে চল বাড়িমুখো হওয়া যাক্, দেশে যাবার জন্যে মন টেনেছে আর ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগছে না।”
রিদয়েরও মনটা সকাল থেকে দেশের দিকেই টানছিল, সে কোনো কথা কইল না। খোঁড়া-হাঁস আস্তে-আস্তে উড়ে এসে আবার নাটবাড়ির ধারে নামল ঠিক বেছে-বেছে সেইখানটিতে, যেখানে তার বালিহাঁস রয়েছে। খোঁড়া রিদয়কে পিঠ থেকে নামিয়ে গলা উঁচু করে দুবার ডাক দিলে – “বালি ও বালি!” কোনো উত্তর এল না, তারপর ছুটে গিয়ে দেখলে পাথরের মধ্যে শুকনো ঘাস পাতা বিছানো তাদের দুদিনের বাসাটি খালি হা-হা করছে, কেউ কোথাও নেই। রিদয় চুপ করে রইল, ভাঙা গলায় খোঁড়া-হাঁস আবার ডাক দিলে – “বালি, কোথায় বালি!”
রিদয় ভাবছে নিশ্চয় শেয়াল এসে মরা হাঁসটা টেনে নিয়ে গেছে, ঠিক সেই সময় জলার ধারে বেনা-বনের সবুজ পাতাগুলো নড়ে উঠল, তার পরেই মিঠে সুরে – “এই যে আমি, একটু গা ধুয়ে নিচ্ছি” বলে বালি আস্তে-আস্তে জলা থেকে উঠে এল! তার ঝকঝকে পালকে শিশিরের মতো জলের ফোঁটাগুলি আলো পেয়ে হীরের মতো ঝকঝক করছে, রিদয়ের মনে হল যেন জলদেবী জল থেকে উঠে এলেন।
খোঁড়া হেলতে-দুলতে বালির কাছে গিয়ে আস্তে-আস্তে গলা চুলকে দিয়ে বললে – “বেদনা কি আছে?” বালি ঘাড় নেড়ে বললে – “একটুও না, তোমার বন্ধুর কৃপায় আর তোমার যত্নে আমি ভালো হয়ে গেছি।” তারপর দুজনে জলে গিয়ে সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলে, রিদয় জলের ধারে বসে একটা বেনার শিষ চিবোতে থাকল।
বালিহাঁসকে সঙ্গে নিয়ে খোঁড়া এর মধ্যে একদিন চুপি চুপি পদ্মবনে পদ্ম-ফুলের সোনালী রেণু এ-ওর গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেরাই নিজেদের গায়ে হলুদ মেখে, মাছরাঙা পাখিদের বৌ-ভাতে মাছ খাইয়ে, বিয়ে-থাওয়া খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে জলার ধারে বাসা বাঁধবার যোগাড়ে আছে, দেশে ফেরার কিম্বা বিদেশে উড়ে চলার আর নামটি করে না। রিদয় শুধোলে বলে – “আমরা যেখানে থাকি সেইখানেই আমাদের দেশ।”
রিদয় বলে – “আমার তো দেশ আছে, আমাকে তো সেখানে যেতে হবে, বিয়ে-থাওয়াও করতে হবে। এই জলার মধ্যে না পাওয়া যায় ভালো খাবার, না আছে ভালো শোবার জায়গা, এখানে বাসা বাঁধলে তো আমার চলবে না।”
বালিহাঁস বললে – “তা বেশ তো, এই জলার ওপারেই একটা গয়লাপাড়া আছে, চলুন আপনাকে তাদের গোয়ালে রেখে আসি। একটি বুড়ি গাই তাদের আছে এক ছটাক করে দুধ দেয়, দুধ ভাত সবই সেখানে পাবেন।”
রিদয় শুধোলে – “আর তোমরা?”
বালিহাঁস লজ্জায় মুখটি নিচু করে রইল। খোঁড়া চুপি-চুপি রিদয়ের কানে-কানে বললে – “ভাই, ওর ডিম পাড়বার সময় হয়েছে, দুটো মাস অপেক্ষা কর, তারপরে সবাই এক সঙ্গে বাড়ি ফেরা যাবে, এই কটা দিন তুমি কোনো রকমে গৌহাটিতে কাটাও।”
হাঁসের বাচ্ছা হবে রিদয় ভারি খুশি, সে একখানা শালপাতার নৌকোতে ভর দিয়ে গয়লাপাড়ার ঘাটে গিয়ে উঠল। গয়লাপাড়া নামেই পাড়া, একঘর বই গয়লা নেই, তাও আবার গয়লা-বুড়ো অনেককাল হল মরেছে, আছে কেবল এক বুড়ি গাই আর এক বুড়ি গয়লানী!
গয়লাবাড়ির উঠোনে ঢুকে রিদয় এদিক-ওদিক চাইতে লাগল, ঘুটঘুটে আঁধার রাতটা বাড়ির কোথাও একটি আলো নেই, কোনদিকে গোয়াল কোনদিকে ঢেঁকিশাল কোথায় বা হেঁসেল কিছুই দেখবার যো নেই, একটা কেবল বেল গাছ ভূতের মতো এঁকে-বেঁকে টেরা-বাঁকা মোচড়ানো-দোমড়ানো শুকনো ডাল নিয়ে উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার উপরে বসে একটা কালো পেঁচা কেবলি চেঁচাচ্ছে – “যো-মেঁ-র বাড়ি-যাঃ, মাথা খাঃ!”
ঝড় উঠল, তার সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টি নামল, আরো দুটি পথিক নেউল, আর খটাস তাড়াতাড়ি উঠোনে ঢুকে এদিক-ওদিক চাইতে-চাইতে রিদয়কে দেখে শুধোলে – “এটা কি গৌহাটির চটি, রাতে থাকবার ঘর পাওয়া যাবে কি এখানে?”
রিদয় বললে – “আমি তো গয়লাবাড়ি বলে এখানে ঢুকেছি কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখছিনে। এটা গোয়াল কি চটি কি ধর্মশালা বা পাঠশালা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, কারু সাড়াশব্দ পাচ্ছিনে, কেবল একটা পেঁচা ডাকছিল একটু আগেই শুনেছি।”
খটাস বললে – “তবে নিশ্চয় এটা গঙ্গাযাত্রীর ঘর!”
নেউল বলে উঠল – “মাঠের মধ্যে কখনো মড়া পোড়ার ঘাট হয়? বাড়িই বটে, তবে একটা কলুর বাড়ি কি গয়লাবাড়ি কিম্বা পুলিসের খাদাবাড়ি তা বোঝা যাচ্ছে না!”
খটাস বললে – “সেটা বোঝবার সহজ উপায় আছে।”
রিদয় শুধোলে – “কোনো বাড়ি সহজে চিনবার উপায় কি প্রকাশ কর!”
খটাস খানিক ভেবে বললে – “মানুষেরা নানা কাজের জন্যে নানারকম বাড়ি-ঘর বাঁধে তা তো জানো – উত্তরমুখো, দক্ষিণমুখো, পূবমুখো, পশ্চিমমুখো। গয়লা বাঁধবে একরকম, তেলি বাঁধবে অন্যরকম, মালি বাঁধবে একরকম, কুমোর বাঁধবে একরকম, আর্ট বোঝো না? কে কি রকম বাঁধবে তার হিসাবটা জানলেই কোনটা কি বাড়ি বোঝা যাবে।”
নেউল বললে – “হিসেবটা কেমন শুনি?”
“শোনো তবে, প্রথমে মালির বাড়ি কেমন তা বলি শোনো,” বলে খটাস খনার বচন আরম্ভ করলেঃ
চৌদিকে প্রাচীর উচা কাছে নাই গলি কুচা
পুষ্প বনে ঢাকে রবি শশি
নানা জাতি ফোটে ফুল উড়ে বৈসে অলি কুল
কোকিল কুহুরে দিবা নিশি।
মন্দ-মন্দ সমীরণ বহে সেথা অনুক্ষণ
বসন্ত না ছাড়ে এক তিল!
রিদয় বলে উঠল – “এখানে তো ফুলের গন্ধ মোটেই পাচ্ছিনে! তবে এটা মালির ঘর নয়।”
“আচ্ছা, গন্ধে গন্ধে বোঝো এটা তেলির বাড়ি কিনা” বলেই খটাস আবার শুরু করলেঃ
সরষের ঝাঁঝে তেলি হাঁচে ফ্যেঁচ-ফ্যেঁচ
বলদেতে ঘানি টানে ঘ্যেঁচ-ঘ্যেঁচ ঘ্যেঁচ।
নেউল বাতাসে নাক উঁচিয়ে বললে – “কই হাঁচি তো পাচ্ছে না! তবে এটা তেলির বাড়ি নয়, মালির বাড়িও নয়।”
“কুমোর বাড়ি কিনা দেখ তো”, বলে খটাস শোলক আওড়ালেঃ
হাঁড়ি পাতিল ঠুকুর ঠাকুর কলসীর কাঁধা
পাতখোলার সোঁদা গন্ধ কুমোর বাড়ি বাঁধা।
রিদয় এদিক-ওদিক নাক ঘুরিয়ে বললে – “নাঃ, কোনো গন্ধই পাচ্ছিনে!”
“আচ্ছা দেখ দেখি গয়লাবাড়ি কিনাঃ”
গোয়াল ঘরে দিচ্ছে হামা নেহাল বাছুর
ঘোল মউলি বলছে ঘরে গাবুর গুবুর
ভালো দুধ টোকো দই দিচ্ছে সেথা বাস
মোষ দিচ্ছে নাক ঝাড়া গরু চিবায় ঘাস।
রিদয় পুবদিকে নাক তুলে বললে – “এসব কিছুই নেই এখানে!”
নেউল পশ্চিম দিকে শুঁকে শুঁকে বললে – “যেন ভিজে ঘাসের গন্ধ পাচ্ছি।”
খটাস উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম চারদিকে কান পেতে নাক ঘুরিয়ে বললে – “এটা গয়লাবাড়ি বটে, কিন্তু তেমন গোঁড়া গয়লা নয়, শব্দ আর গন্ধগুলো কেমন ফিকে-ফিকে ঠেকছে, বিচিলী আছে, ঘাসও কিছু আছে, গরুও একটা যেন আছে বোধ হচ্ছে!”
ঠিক সেই সময় বুদিগাই “ওমঃ” বলে একবার ডাক দিলে! তিন পথিক তাড়াতাড়ি সেই দিকে গিয়ে দেখলে – কত কালের পুরোনো চালখানা তার ঠিক নেই, বিষ্টির জলে মাটির দেওয়াল গলে গিয়ে বুড়ো মানুষের পাঁজরের হাড়গুলোর মতো ভিতরের চাঁচ আর খোঁটাখুঁটি বেরিয়ে পড়েছে, দরজার একটা ঝাঁপ খুলে কাটিতে শুয়ে পড়েছে, আর একটা পচা দড়ি ধরে পড়ো-পড়ো হয়ে এখনো ঝুলে রয়েছে! চালের খড় এখানে-ওখানে উড়ে গিয়ে ভিতর থেকে ঘুণ-ধরা বাঁশের আড়া দু-চারটে ফোগলা দাঁতের মতো দেখা যাচ্ছে!
তিন পথিকের পায়ের শব্দ পেয়ে গোয়ালের মধ্যে থেকে বুদি ভাবলে গয়লাবুড়ি তার জাব নিয়ে এল – সে দরজা থেকে মুখটা বাড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখে বললে – “মাগোঃ মাঃ, রাত হল আজ কি খেতে দিবিনে!”
খটাস, রিদয় আর নেউল বুদির কথায় উত্তর দিলে – “তিন পথিক মোরা, রাতের মতো জায়গা মিলবে কি?”
বুদি মাথা হেলিয়ে কেবলি শুধাতে লাগল – “কেগাঃ কে?”
রিদয় বললে – “আমি আমতলির তাঁতির পুত্তুর শাপভ্রষ্ট বুড়ো-আংলা দেশভ্রমণে বেরিয়েছি।”
বুদি নেউলের দিকে শিং হেলিয়ে বললে – “ইনি?”
“নেউল পুত্তুর ইনিও বেরিয়েছেন মৃগয়া করতে।”
খটাসের দিকে চোখ ফিরিয়ে বুদি রিদয়কে শুধোলে – “আর ইনি কে?”
“ইনি হচ্ছেন খটাস পুত্তুর, দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন।”
বুদি গোয়ালের দুয়োর ছেড়ে একপাশ হল, তিন বন্ধুতে বাদলার রাতে গোয়ালে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটাবার যোগাড় করতে চলেছেন, বুদি গাই লেজ নেড়ে বললে –“আর জন্মে কত তপিস্যি করেছে, তাই কাঙালিনীর ঘরে রাজপুত্তুর পাত্তরের পুত্তুর আর কোটালের পুত্তুরের পা পড়ল।” রিদয় খুশি হয়ে বুদির ঘাড়টা একটু চুলকে দিলে, তারপর খড়ের গাদায় শুয়ে তিন বন্ধুতে চোখ বুজলে।
এদিকে বুদিগাই সারাদিন জাব পায়নি, সে পেটের জ্বালায় কেবলি উসখুস করছে – “ওমঃ মাগোঃ কোথায় গেলে আজ কি আর খাব না? ও ভাই রাজপুত্তুর মাচানের ওপর থেকে এক বোঝা খড় নামিয়ে দিতে পার, বড় খিদে লেগেছে!”
রিদয় দেখলে চালের বাতায় মস্ত এক বোঝা খড় চাপানো রয়েছে বটে কিন্তু সেটা টেনে নামানো রিদয়ের সাধ্যি নয়, একটা আঁটি কোনো রকমে টেনে রিদয় বুদির মুখের কাছে ধরে দিলে। গাই খড়গুলো মুখে নিয়ে জাবর কাটতে লাগল।
রিদয়ের একটু তন্দ্রা এসেছে, এমন সময় বুদি আবার বলে উঠল, - “ওমা গো, ভাই পাত্তরের পুত্তুর একটুখানি জল এনে দিতে পার?”
নেউল ঘুমের ঘোরে বললে – “এত রাত্রে জল পাই কোথা!”
বুদি বিনয় করে বললে – “বাইরেই বিষ্টির জল জমা হয়েছে, উঃ বড় তেষ্টা, আমার গলার দড়িটা যদি খুলে দাও তো ওখানে গিয়ে একটু জল খেয়ে বাঁচি!”
নেউল বুদির গলার দড়িটা দাঁতে কেটে দিয়ে বললে – “যাও তবে!”
বুদি দু-পা গিয়ে বললে – “ইস ভারি অন্ধকার, ভাই কোটালের পুত্তুর আমি রাতকানা, যদি গলার দড়িটা ধরে একটুখানি এগিয়ে দিয়ে এস তো ভালো হয়!”
“ভালো বিপদেই পড়া গেল,” বলে খটাস দড়িটা ধরে বুদিগাইকে উঠানের মাঝে টেনে নিয়ে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে সরে পড়ল!
রাত তখন বারোটা, খড়ের গাদায় তিন বন্ধু আরামে নিদ্রা যাচ্ছে, এমন সময় বুদিগাই এসে সবার কানে-কানে বললে – “বড় বিপদ, বুড়িটা মরে গেছে!”
রিদয় তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললে – “সে কি! মরলো কেমন করে?
বুদি নিশ্বেস ফেলে বললে – “দুঃখের কথা কইব কি, এই সন্ধ্যেবেলা সে আমার গলাটি ধরে বলে গেল – “বুদি শুনেছিস এই নাটবাড়ির জলায় রাজা এবার ধান বোনবার হুকুম দিয়েছেন, এতকালে জমি সব আবাদ হবে; আমাদেরও দুঃখ ঘুচবে।” আমি বললেম – “মা, তোমার আর দুঃখু ঘুচবে কি, তোমার ছেলেপুলে ক’টাই বিদেশে গিয়ে সংসার ফেঁদে কাজ-কারবার করতে বসে গেল, বুড়ি মাকে তো তারা একটিবার মনেও করলে না!” মা বললে – “বুদি লো বুদি, তাদের দুষিসনে, ঘরের ভাত পেলে কি তারা আমাকে একলা ফেলে বিদেশে যায়, না পরের চাকরি করে? এইবার তাদের চিঠি দেব দেখিস কেমন না তারা আসে! আমার মরবার সময় সব ছেলেরা এসে আমায় ঘিরে দাঁড়াবে আর আমি ডঙ্কা মেরে স্বর্গে চলে যাব এই সাধটি আমার কি পূর্ণ হবে বুদি!” এই বলে মা ঘরের মধ্যে চিঠি লিখতে গেল, গোয়াল-ঘরে আর জাবও দিতে এল না, পিদুমও জ্বাললে না! সন্ধ্যেবেলা মাকে যেন কেমন-কেমন দেখিনু, তাই বলি একবার যাই দেখে আসি। ওমা, ঘরে ঢুকে দেখি যেখানকার যেটি সব তেমনই গোছানো রয়েছে – পিদুমটি জ্বলছে বিছানা পাতা রয়েছে কিন্তু মা আমার চিঠিটুকু হাতে নিয়ে আলুথালু হয়ে দরজার ধারে পড়ে রয়েছেন, ছেলেরা আসবে ছেলেরা আসবে করেই বুড়ি মলো গো।
“আহা! এই গয়লা বোয়ের দশা কি এমন ছিল। এই বাড়িতে দেখেছি ছেলে-মেয়ে চাকর-বাকর গিসগিস করছে – ঐ নাটবাড়ির সমস্ত জলাটা ওদের জমিতে পড়েছে, আজ এখনও কত জমি যে বেখবর পড়ে আছে তার ঠিক নেই। কর্তা যতদিন ছিলেন যেমন বোলাবোলা তেমনি লক্ষ্মিরছিরি। আহা, ওই গয়লা-বৌ তখন দু-বেলা সেজেগুজে পাঁচজন গয়লানী সঙ্গে গাই দোহাতে আসত, নুপূরের শব্দ শুনলে গাই-গরু সব চারদিক থেকে হামা দিয়ে ছুটে আসত গো। এমন লক্ষ্মী বৌ কচি-কাচা নিয়ে বিধবা হল গো! তখন এক-একদিন আমার গলা ধরে কানতো আর বলতো – “বুদি, আর পারিনে যন্ত্রণা সইতে।” আমি বলি, “মা এই শরীর তোমার, একা সবদিক দেখা কি তোমার কর্ম, দু-চারটে দাস-দাসী নায়েব-গোমস্তা বেশি রাখলে হয় না?” কিন্তু সে বড় কর্মিষ্টি, নিজেদের হাতে ছেলে-মানুষ ধান-বোনা রান্না করা গাই-দোয়া সব করবে! আমি বলি – “মা, শরীর যে ক্ষয় হল!” কিন্তু বৌ কেবলি বলে – “ভালো দিন আসছে বুদি আসছে!” আর ভালো দিন! ছেলেগুলো বড় হয়ে চাকরির চেষ্টায় বিভূঁয়ে টো-টো করতে লাগল, কেউ বিদেশে গিয়ে সংসার পাতলে, ছেলেপুলে হল কিন্তু বুড়িকে আর কেউ দেখলে না। জমি-জমা গহনা-গাঁটি বেচে ছেলেমেয়ে নাতি-পুতি এমনি তিন পুরুষ ধরে সবাইকে বিয়ে দিয়ে চাকরি নিয়ে বিদেশে পাঠাতে-পাঠাতে বুড়ি ক্রমে সর্বস্বান্ত হয়ে না খেয়ে মরবার দাখিল হল! ছেলে-মেয়ে কত যে জন্মাল, মানুষ হল, বড় হয়ে বুড়িকে একলা রেখে চলে গেল, এই গয়লাবাড়িতে ক’পুরুষ ধরে কত কারখানাই দেখলুম যে, তা কি বলি!
“এদানি বুড়ি আর দুঃখু করত না, ছেলেদের কথা হলে বলত – ‘বুদি এখানে এলে তাদের তো কষ্ট বই আরাম হবে না, তবে কেন আর তাদের ডেকে পাঠাই; এই তো ভাঙাবাড়ি, এখানে জায়গা কোথায় তাদের বসবার শোবার খাবার!
ওই বাপ-মা হারা, আমার শিবরাত্রির সলতে বলতে ওই ছোট নাতিটি বেঁচে থাক, মরবার সময় তবু মুখে জল দেবার একজন তো রইল – কি বলিস!’ কিন্তু এ নাতিও বড় হয়ে যেদিন কুলির সর্দারি করতে বিদেশে গেল সেদিন থেকে বুড়ির আর চোখের জল থামল না। সে দিন-দিন কুঁজো হয়ে পড়ল, হাল-গরু জোত-জমা সমস্ত পাঁচভূতে লুটে পালাল, বুড়ি দেখেও দেখলে না – শেষে এখানে আর কেউ রইল না – এই বুদি আর এই বুড়ি ছাড়া। বুড়ি খেতে পায় না দেখে আমি একদিন বললুম – ‘মাগো, কসায়ের কাছে আমাকে বেচলে তো পয়সা পাও, তা কর না কেন!’ বুড়ি আমার গলা ধরে বললে – ‘বুদি সব ছেলেমেয়ে তোর দুধ খেয়ে মানুষ হল তোকে আমি কি ছাড়তে পারি!’ আহা সেই আমার সেঙাতনী, মনিবনী, গিন্নি মা-জননী আজ নিজেই চলে গে; গোঃ, ওমা” – বলে সে অঝোরে কাঁদতে লাগল।
রিদয় অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল – “আহা বুদি, আমতলিতে মাকে আমি এমনি করে ফেলে এসেছি যে!”
বুদি বলে উঠল – “যাও কালই ফিরে যাও, না হলে হয়তো এই বুড়ির মতো ছেলে-ছেলে করে শেষে সেও মরবে। তোমার তো এখনো গিয়ে মাকে দেখবার সময় আছে কিন্তু এই বুড়ির ছেলেরা কি পোড়াকপাল নিয়েই জন্মেছিল, কখনো দেশে এল না, মা মরে গেল তাকেও দেখতে পেলে না!”
সকাল বেলায় মিউনিসিপালের মুর্দোফরাসগুলো এসে বুড়িকে পোড়াতে চলে গেল, খটাস গেল দিগ্বিজয়ে, নেউল চলে গেল মৃগয়াতে, রিদয় বুড়ির ঘর থেকে, তার ছেলেদের নামের ছিঠিখানি ডাকে ফেলে দিয়ে, বুদিকে মাঠে রেখে খোঁড়ার কাছে ফিরে চলল। পাতি-জলার কাছ বরাবর এসে রিদয় দেখলে খোঁড়া-হাঁস সকালে উঠে জলের মাঝে একটা ঢিপিতে দাঁড়িয়ে ডানা ঝাড়ছে, বালি-হাঁস তখনো ঝোপের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। রিদয় সারারাত কিছু খায়নি, হাঁসের কাছে না গিয়ে সে বরাবর বুদিগাইটার পিছনে-পিছনে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল! দু-একটা পাতবাদামের চেষ্টায় রিদয় একটা শিরীষ গাছের উঁচুডালে কাঠবেড়ালিদের ঘরে ভিক্ষে করতে চলেছে। মস্ত শিরীষ গাছ, তার সব উপরের ডালে কাঠবেড়ালিদের খোপ বসতি। এমনি এপাড়া-ওপাড়ায় রিদয় “জয়রাম” বলে গান গেয়ে দাঁড়াচ্ছে আর কেউ এসে তাকে দুটো শুকনো ছোলা, কেউ একটা বাদাম, এমনি টুকি-টাকি ভিক্ষে দিচ্ছে। রামের দোহাই দিলে কাঠবেড়ালিদের ভিক্ষে দিতেই হয়, কিন্তু এক-এক কাঠবেড়ালি গিন্নি ভারি কিপটে, রিদয়কে দূর থেকে দেখেই বলছে – “ওগো ঘরে কিছু নেই, কর্তারা হাটে গেছেন, ওবেলা এস – এখন কিছু হবে না।” রিদয় পাকা ভিখিরী, সহজে ছাড়বে কেন, গান শুরু করলেঃ
বাসনা করায় মন পাই কুবেরের ধন
সদা করি বিতরণ তুমি যত আশ না
আস তাই আরো চাই ইন্দ্রের ঐশ্বর্য পাই
ক্ষুধা মাত্র সুধা খাই মরি-মরি ফাঁস না
ফাঁসনা কেবল রৈল বাসনা পূরণ নৈল
লাভে হতে লাভ হৈল লোকে মিথ্যা ভাসনা!
কাঠবেড়ালি গিন্নি এতেও সাড়া দেয় না, রিদয় এবার হিন্দী গান ধরলেঃ
ধুম বড়া ধুম কিয়া খানে জোনে নাহি দিয়া
চহুঁয়ার ঘেরালিয়া ফোজ কি গিতাপয়া!
আরে চহুঁয়ার, আরে চহুঁয়ার।
এক থোকা শিরীষ-ফুলের তলায় দাঁড়িয়ে বুড়ো-আংলা পেট বাজিয়ে গাইছে, এমন সময় মনে হল তার কোমরের কাপড় ধরে কে টান দিচ্ছে, রিদয় ফিরে দেখতেই একটা কাক ‘খাও’ বলে তার ঠোঁট আর ডান হাতটা চেপে ধরলে, অমনি আর একটা কাক, তারপর আর একটা এসে রিদয়কে ছোঁ দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলল। ডোমকাকের দল রিদয়কে চোখে-মুখে কিছু দেখতে দিচ্ছে না – “যাক-যাক” বলে এর মুখ থেকে ও, তার মুখ থেকে সে, এমনি রিদয়কে ফুটবলের মতো ছুঁড়ে দিতে-দিতে দল বেঁধে গোলমাল করতে করতে চলেছে দেখে বুদি গাই “ওমা-ওমা” করে চেঁচাতে-চেঁচাতে লেজ তুলে ছুটোছুটি করতে লাগল। ইচ্ছেটা কাকগুলোকে শিং দিয়ে গোঁতায়, কিন্তু তারা আকাশে সে বেচারা মাটিতে – বুদি কেবল ধুলো উড়িয়ে মাঠে ছোটাছুটি করতে লাগল!
খোঁড়া-হাঁসও আকাশে কাক দেখে – “ক্যা-ক্যা” বলে একবার ডাক দিলে কিন্তু দেখতে-দেখতে কাকের দল অদৃশ্য হয়ে গেল।
রিদয় চটকা ভেঙে যখন চেয়ে দেখলে, তখন কাকেরা পাতি-জলা পেরিয়ে নাটবাড়ি ছাড়িয়ে কাকচিরের দিকে চলেছে। হাঁসের পিঠে আরামে উড়ে চলা এক, আর কাকের ঠোঁটে ঝুলতে-ঝুলতে চলা অন্য একরকম। রিদয় দেখলে যেন জলা-জমি যেন একখানা ফাটা-ফুটো গালচের উল্টো পিটের মতো পায়ের তলায় বিছানো রয়েছে, সবুজ লাল কালো কত রকমের যেন সুয়োঁ-ওঠা পশমে বোনা, বাঙলাদেশের পরিষ্কার ছককাটা জমির মতো মোটেই নয়, জলগুলো দেখাচ্ছে যেন মাঝে-মাঝে ছোট বড় আয়না ভাঙা।
দেখতে-দেখতে সূর্যি উঠল, আলো পেয়ে মাটি যেন সোনা রুপো আর নানা রঙের উলে-বোনা কাশ্মিরী শালের মতো দেখাতে লাগল। তারপর জলা পার হয়ে বন-জঙ্গল মাঠ-ঘাটের উপর দিয়ে কাকেরা রিদয়কে নিয়ে উড়ে চলল! কাকেরা তাকে ধরে নিয়ে কোথায় চলেছে, কোথা রইল খোঁড়া-হাঁস, কোথায় বা চকার দল, কোথা বুদি, কোথা বালি!
রিদয় ভয় পেয়ে চারদিকে চাইছে এমন সময় ডোমকাক ডাক দিলে – “খবরদার!” অমনি সব কাক রিদয়কে নিয়ে জঙ্গলের তলায় নেমে পড়ল! চোরকাঁটার বনে রিদয়কে ঠেলে ফেলে গোটা পঞ্চাশেক কাক সঙিনের মতো ঠোঁট উঁচিয়ে তার চারিদিকে পাহারা দিতে দাঁড়িয়ে গেল।
রিদয় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললে – “তোরা যে আমাকে বড় ধরে আনলি!”
ডোমরাজা দৌড়ে এসে বললে – “চুপ, কথা কইবি তো চোখ ঠুকরে নেব!”
রিদয় বুঝলে এবার সহজে ছাড়ান নেই, এরা সব ডাকাতে-পাখি। গোলযোগ করলে হয়তো মাথাটাই ফাটিয়ে দেবে। সে কি করে, শুকনো মুখে কাকগুলোর দিকে চেয়ে রইল। কাকগুলোও তাকে ঘিরে ধারাল ঠোঁট বাড়িয়ে একচোখে তাগ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
দূর থেকে দেখে রিদয় ভাবত কাকগুলো বেশ কালো চিকচিকে, যেন কালো আলপাকার চায়না-কোট পরা নতুন উকিল কৌছিঁলের মতো, চালাক চতুর চটপটে। কিন্তু কাছ থেকে কাকগুলোকে রিদয় দেখলে কদাকার কালো কুচ্ছিত যতদূর হতে হয়, পালকগুলো রুখো মড়মড়ে যেন কালিতে ছুপোনো তালপাতা, পাগুলো গেঁটে-গেঁটে কাদামাখা খরখরে, ঠোঁটের কোণে এঁটো ঝোলঝাল মাখানো, একটা চোখ যেন ছানি পড়া আর একটা যেন ময়লা পয়সার মতো তামাটে কালো। কোথায় শাদা ধপধপে সুবচনীর হাঁস আর কোথায় এই কালো কুচ্ছিত কাগের ছা সব।
রিদয় এই কথা ভাবছে এমন সময় মাথার উপরে অনেক দূর থেকে হাঁসের ডাক এল – “কোথায় কোথায়?” রিদয় গলা শুনে বুঝলে খোঁড়া তার সন্ধানে চলেছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে বালি হাঁসও ডাক দিয়ে গেল “সেঙাত সেঙাত!” বনের ওধারটায় বুদিও একবার হাঁক দিলে – “ওগোঃ ওগোঃ!” রিদয় বুঝলে তিনজনেই এসেছে, সে অমনি হাত নেড়ে হেথায় বলে চেঁচাতে যাবে আর ডোমরাজা ছুটে এসে ধমকে বললে – “কিও! আয় দিই চোখ দুটো খুবলে!” রিদয় অমনি মুখ বুজে গোঁ হয়ে বসল।
হাঁসেরা চলে গেল বুদি গাইও ডেকে ডেকে থামল, তখন ডোমকাক হুকুম দিলে – “উঠাও!” দুটো কাক তাকে আবার ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিয়ে ওড়বার চেষ্টায় আছে দেখে রিদয় বললে – “বাপু তোমাদের মধ্যে কেউ পালোয়ান কাক থাকে তো আমাকে পিঠে করে নিয়ে চল, অমন ঝোলাঝুলি করলে আমার হাত পায়ের সব জোড় খুলে যাবে যে!”
ডোমকাক ধমকে বললে – “চল-চল, অত বাবুগিরিতে কাজ নেই। কাগে চড়বেন এত সুখ তোর কপালে – আমরা কি ঘোড়া যে তোকে পিঠে নেব!”
এবারে ঝোড়োকাক এগিয়ে এসে বললে – “মহারাজ, মানুষটাকে হাড়গোড় ভেঙে দ করে নিয়ে গেলে তো ওটা আমাদের কোনো কাজে আসবে না, আমি বরং ওটাকে পিঠে নিই, কি বলেন?”
ডোমকাক মুখ সিঁটকে বললে – “তোমার ইচ্ছে হয় তো ওর পালকি-বেহারার কাজ করতে পার, কিন্তু দেখ পালায় না যেন!”
রিদয় দেখলে ঢোঁড়াকাগটা ওর মধ্যে দেখতে-শুনতে ভদ্দর রকম, সে আস্তে-আস্তে তার পিঠে চড়ে বসল।
কাকের দল ক্রমাগত দক্ষিণ মুখেই উড়ে চলেছে। পরিষ্কার দিনটি খটখট করছে, চারদিকে যেন বাতাস আর আলো ছড়িয়ে পড়েছে, বনের শিয়র দিয়ে রিদয়কে নিয়ে কাকেরা উড়ে চলল।
রিদয় দেখলে বৌ-কথা-কও পাখি বকুল গাছের আগডালে বসে বৌকে শুনিয়ে কেবলই গাইছে – “কথা কও বৌ কথা কও, মাথা খাও বৌ কথা কও!” রিদয় অমনি বলে উঠল – “কথা কইবে কি ছলে, কথা শুনলে গা জ্বলে!”
“কে রে?” বলে হলদী পাখি আকাশের দিকে ঘাড় তুলতেই, রিদয় তাকে শুনিয়ে বললে – “কাকে-ধরা যক্! কাকে-ধরা যক্!”
ডোমকাক অমনি ধমকে উঠল – “আবার কথা!”
আরো দক্ষিণ মুখো গিয়ে রিদয় দেখলে আমবাগানের মাথায় ঘুঘু বসে তার বৌকে গান গেয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছে আর গলা ফুলিয়ে আদর করে ডাকছে – “বুবু ওঠো দেখি ম্ম্।”
রিদয় অমনি বলে উঠল – “আদর দেখ উহুঃ।”
ঘুঘু গলা তুলে বললে – “কে রে কে রে?”
রিদয় তাকেও শুনিয়ে দিলে – “কাকে-ধরা যক্!”
এবার ডোমকাক রেগে রিদয়কে ডানার থাপ্পড় দিয়ে বললে – “ফের বকচিস, চুপ!”
ঢোঁড়াকাক বলে উঠল – “বকুক না যত পারে, পাখিগুলো ভাবচে আমরাও ঠাট্টা তামাশা শিখেছি।”
ডোমকাক আর উচ্চবাচ্য করলে না। রিদয় ঘাঁটিতে-ঘাঁটিতে সব পাখিকে জানিয়ে দিতে-দিতে চলল – তাকে কাকে ধরেছে!
এমনি বন ছাড়িয়ে তারা একটা নগরের উপর এসে পড়ল। নদীর ধারে মস্ত শিব-মন্দির, তারি চুড়োয় ত্রিশূলের ডগায় বসে শালিক তার বৌকে শুনিয়ে রাগরাগিণীতে গলা সাধছে; বৌ তার পঞ্চবটির বাসায় ডিমে তা দিচ্ছে আর কর্তার গান শুনছে – “সা রে গা মা পা – চারটে ডিমে তা, ধা নি সা – দুই জোড়া ছা!”
রিদয় অমনি আকাশ থেকে বলে উঠল – “কাগে খাবে গা!” শালিক “কেও?” বলে মুখ ফেরাতেই রিদয় শুনিয়ে দিলে - “কাকে-ধরা যক্!”
যতই দক্ষিণ দিকে এরা এগোতে থাকল ততই বড়-বড় নদী খাল-বিল ক্ষেত মাঠ-ঘাট গ্রাম-নগর দেখা দিতে থাকল! একটা মস্ত বিলের ধারে একটা হাঁস আর একটা হাঁসের সামনে দাঁড়িয়ে কেবলি ঘাড় নাড়ছে আর বলছে। “চেয়ে দেখ আমি তোরি চিরদিন আমি তোরি।”
রিদয়ের মনে হল যেন খোঁড়া আর বালি দুজনে কথা কইছে; সে অমনি তাদের শুনিয়ে বলে উঠল – “এসা দিন রহে থোড়ি! রহে থোড়ি!”
“কেও-কেও?” বলে হাঁস মুখ ফেরাতেই রিদয় শুনিয়ে দিলে - “কাকে-ধরা যক্!” এমনি যাকে দেখে, তাকেই নিজের খবর শুনিয়ে দিতে-দিতে রিদয় চলেছে!
বেলা দুপুর, কাকের ঝাঁক এক মাঠের জমিতে নেবে সড়া পেসাদ খেতে আরম্ভ করলে। রিদয় খেলে কিনা সে দিকে কারু লক্ষ্য নেই। ডোমকাক রিদয়কে আগলে বসে আছে, এমন সময় ঢোঁড়াকাক একটা ডালিম এনে ডোমকাককে বললে – “মহারাজ দুটো ফল খেতে আজ্ঞা হোক্!” ডালিম ভাঙা কাকের কর্ম নয়, তা ঢোঁড়াকাক জানত – ডোম-রাজা নাক তুলে বললে – “ওই শুকনো ফল আমি খাব, থুঃ!” ঢোঁড়া অমনি রিদয়ের পায়ের কাছে ফেলে, তাড়াতাড়ি রাজার জন্যে যেন ভালো ফল আনতেই যাচ্ছে এইভাবে ছুটে পালাল। রিদয় বুঝলে ঢোঁড়া তার জন্যেই ডালিমটা এনেছে; সে অমনি সেটা দাঁতে চিবিয়ে ছালসুদ্ধ খেয়ে ফেললে।
ভাত খেয়ে ডোমরাজ মঠের চুড়োর উপরেতে গেলেন, অন্য সব কাক খেয়ে-দেয়ে পেট ভরিয়ে রিদয়কে ঘিরে গাল-গল্প শুরু করলে। পাতিকাক দাঁড়কাককে শুধোলেন – “দাদা চুপচাপ ভাবছ কি শুনি!”
দাঁড়কাক গলা খাঁকরি দিয়ে বললে – “ভাবছিলুম এই তল্লাটে এল মিয়া সাহেব একটি মুরগি পুষেছিল, মুরগি ঐ মোসলমানের বিবিকে এত ভালবাসতো যে তাকে খাওয়াবার জন্যে লুকিয়ে বিবির পানের ডাবরে গিয়ে চারটে করে ডিম পেড়ে আসত। মিয়া ডিম খুঁজে-খুঁজে হয়রান, তখন কিন্তু আমাদের মধ্যে কে একটা চালাক কাক সেই লুকানো ডিম খুঁজে বার করেছিল না? তার নামটা কি মনে পড়ছে না। সে কি তুমি না আমি, না ওই ডোম না এই ঝোড়োকাক?”
পাতিকাক বলে উঠল – “ওঃ ! বুঝেছি, আচ্ছা শোনো দেখি বলি, বোষ্টম-বাড়ির সেই বেরালটাকে মনে আছে তো? সেই যেটা বোষ্টম-বৌয়ের হেঁসেলের মাছ রোজ নিয়ে পালাত, কোথায় সে লুকিয়ে মাছটা রাখত তা বোষ্টম না বোষ্টমী না কালো কেউ টের পেত না, সেই মাছের সন্ধান কে-কে পেয়েছিল দাদা, তুমি না আমি, রাজা না মন্ত্রী?”
সব কাক অমনি এগিয়ে এসে নিজের-নিজের বড়াই করতে আরম্ভ করলে। কেউ বললে – “মাছ চুরি আবার একটা কাজের মধ্যে, আমি একবার একটা খরগোসের লেজ ঠুকরে দিয়েছিলাম, আর একটু হলেই সেটাকে নিয়ে ছিলের মতো ছোঁ দিয়ে উড়েছি আর কি, এমন সময় সেটা তার গর্তে সেঁধিয়ে গেল!”
আর এক কাগ বলে উঠল – “আরে বাবা খরগোসছানা বেরালছানা এদের নিয়ে খেলা করেছ – মানুষের কাছে কখনো এগিয়েছ? আমি একবার ফিরিঙ্গির বাড়িতে গিয়ে তাদের টেবিলের রুপোর কাঁটা চামচে চুরি করে সাফ বেরিয়ে এসেছি, একটি পালকে পর্যন্ত আঁচড় লাগেনি!”
রিদয় থেকে-থেকে বলে উঠল – “এই বিদ্যের আবার এত বড়াই, এই বেলা ওসব চুরিচামারি ছাড়, না হলে মানুষ বিরক্ত হয়ে একদিন এমন গুলি চালাতে আরম্ভ করবে যে কাকবংশ ধ্বংস করে তবে ছাড়বে!”
“কি বলিস?” বলে সব কাক রিদয়কে তেড়ে এল, মনে হল এখনি তাকে ছিঁড়ে খাবে।
ঢোঁড়াকাক তাড়াতাড়ি সবাইকে ঠাণ্ডা করে বললে – “ছেলেমানুষ কি বলতে কি বলেছে। থাম হে ওকে মেরো না, রাজা তাহলে ভারি দুঃখিত হবেন। মনে নেই সেই যকের ধনটা বার করা চাই। ছোঁড়াটা না হলে সে কাজটা করে কে? তাছাড়া এটা মানুষ, একে মারলে পুলিস হাঙ্গামা হতে পারে।”
কাকেরা রিদয়কে আর কিছু না বলে ঢোঁড়াকেই ধমকাতে লাগল – “হাঃ মানুষ, ভারি তো উনি বড়লোক যে ভয় করতে হবে, ঢের-ঢের অমন মানুষ দেখেছি – ”
এই সময় ডোমকাক উপর থেকে হাঁক দিলে – “চালাও!” এবারে কাকের দল রিদয়কে নিয়ে কাকচিরার পতিতজমির দিকে চলেছে – গ্রাম নগর আর দেখা যাচ্ছে না, কেবল ধূ-ধূ বালি আর কাঁটাগাছ। মানুষ নেই, গরু নেই, পাখি নেই – কেবল আগুনের মতো রাঙা সূর্যটা পশ্চিম দিকে ডুবছে – সমস্ত আকাশে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়ে।
ভর সন্ধ্যেবেলা ডোমকাক রিদয়কে ধরে নিয়ে কাকচিরার জঙ্গলে এসে নামল। ডোমকাক দূত হয়ে আগে গিয়ে সবার বাসায় খবর দিলে রাজা এলেন, অমনি সব কাকিনী “বা-বা-বা তোবা-তোবা” বলে বাসা ছেড়ে তামাশা দেখতে ছুটল।
শেয়ালের দল আহ্লাদে লেজ ফুলিয়ে হাঁক দিলে – “হুয়া – কয়েদ হুয়া তোফা হুয়া!” চারদিকে হৈ-চৈ – ক্কা-ক্কা হুয়া শব্দ উঠছে, তারি মধ্যে ঢোঁড়া রিদয়ের কানে-কানে বললে – “আমি তোমার দিকে আছি, দেখ খবরদার ওদের কথা শুনে কোনো কাজ কর না। কাজ করিয়ে নিয়েই তোমায় মেরে ফেলবে, সাবধান।”
ডোমকাক এসে রিদয়কে টানতে-টানতে সেওড়াগাছের গোড়ায় গর্তটার মধ্যে নামিয়ে দিলে, রিদয় যেন জেরবার হয়ে পড়েছে এমনিভাবে আধমরার মতো গর্তের মধ্যে শুয়ে পড়ল। ডোম রাজা ডাকলে – “ওঠ, যা বলি তাই কর।” রিদয় যেন শুনতেই পেল না, চোখ বুজে রইল। ডোম তাকে ধরে যকের পেঁটরার কাছে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বললে – “খোল এটা।”
রিদয় ধাক্কা দিয়ে ডোমকে সরিয়ে বললে – “খিদেয় পেট জ্বলছে এখন আমি কাজ করব? আজ রাত্তিরটা না ঘুমিয়ে নিলে আমি কিছু কাজ পারব না, গা-হাত-পা টাটিয়ে গেছে।”
“খোল আভি!” বলে ডোম রিদয়কে ঝাপটা মেরে পেঁটরার গায়ে ঠেলে দিলেঃ রিদয় গোঁ হয়ে পেঁটরা ধরে নেড়ে বললে – “বাবা, যে মরচে-ধরা তালা, এ তো খোলা সহজ নয়, আজ খেয়ে-দেয়ে গায়ে জোর হোক, কাল তখন দেখা যাবে!”
ডোম রেগে রিদয়ের গায়ে একটা ঠোকর বসিয়ে বললে – “খোল বলছি!”
রিদয় এবারে আর রাগ সামলাতে পারলে না, ডোমকে এক থাপ্পড় কষিয়ে কোমর থেকে ছুরি বার করে বললে – “ফের বজ্জাতি, পাজি কোথাকার!”
ডোমকাক রাগে আর চোখে দেখতে পাচ্ছে না – “তবে রে” বলে সে রিদয়ের উপরে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ল, অমনি রিদয় ছুরিটা তার চোখে বসিয়ে দিলে। ডোমকাক দু’বার ডানা ঝটপট করেই অক্কা পেলে।
“হত্যা হুয়া, হত্যা হুয়া”, বলে শেয়াল চেঁচাতে লাগল, “ক্যা-ক্যা” বলে কাকরা গোলমাল করে তেড়ে এল। ঢোঁড়া বোকা সেজে কেবলি রিদয়কে আড়াল করে-করে ডানা ঝাপটাতে লাগল, যেন কতই রেগেছে এইভাবে। রিদয় বিপদ গুণে পেঁটরাটা জোরে টেনে খুলে তার মধ্যে লুকোবার চেষ্টা করতে লাগল। পেঁটরাটা কিন্তু টাকায় পয়সায় ঠাসা, তার মধ্যে জায়গা নেই দেখে দু-চার মুঠো পয়সা বাইরে ছড়িয়ে ফেললে!
এতক্ষণ কাকরা হট্টগোল করছিল যেন কাঙালী বিদেয়ের ভির লাগিয়েছে। পয়সা পড়তে সবাই ছোঁ দিয়ে এক-একটা বাসার দিকে দৌড় – চকচকে পয়সা পেয়ে তারা রাজা, রাজহত্যা সব কথাই ভুলে গেল।
সব কাক যে-যার ঘরে গেছে, তখন ঢোঁড়াকাক এসে রিদয়কে বললে – “তুমি জানো না আমার কি উপকার করেছ। এস আমার পিঠে চড়ো আমি তোমাকে এমন জায়গায় রেখে আসব যেখানে শেয়ালের বাবাও আর ধরতে পারবে না।”
এত হুটোপাটির পর রিদয়ের ঘুম পাচ্ছিল, সে কাকের পিঠে চড়ে ঢুলে-ঢুলে পড়তে লাগল! ঘুমের ঘোরে তার যেন মনে হল অন্ধকারে কাকের চেহারাটা গণেশের ইঁদুরের মতো হয়ে যাচ্ছে – কাগ বগ হাঁস শেয়াল সব একসঙ্গে তার মাথার ভিতরে ঘুরছে। এমনসময় আকাশ থেকে যেন বোধ হল চকার দল হাঁকলে – “কোথায়?”
“হেথায়” বলে যেমন রিদয় চেয়েছে অমনি দেখলে কোঁ করে দরজা খুলে গণেশের মতো পেট নিয়ে তার বাপ ঘরে ঢুকে বললেন – “কিছু ভাঙিসনি তো?”
রিদয় তখন ভয়ে-ভয়ে একবার কুলুঙ্গিটার দিকে চেয়ে দেখলে যেখানকার গণেশ সেখানেই রয়েছে – দুবার মাথা চুলকে রিদয় এক দৌড়ে বাড়ির উঠোনে এসে দেখলে খোঁড়া-হাঁস পুকুর পাড়ে একটা বুনো হাঁসের সঙ্গে ভাব করছে – আর একটা ঝোড়োকাক চালে বসে “কা-কা” করে ডাকছে – গোয়ালঘর থেকে কপ্লে গাই ডাক দিলে “ওমঃ,” ঠিক সেই সময় একটা গুগলী পুকুর ঘাট বেয়ে আস্তে-আস্তে জলে নেমে গেল!
রিদয় পুকুর পাড়ে হাঁ করে কি ভাবছে দেখে রিদয়ের মা কাছে এসে বললে – “কি হল তোর?”
রিদয় মাথা চুলকে বললে – “মা, আমি কি সত্যিই বড় হয়ে গেছি?” বলে আপনার মাথায় হাত বুলাতে লাগল!
সেই সময় ডালিমগাছে টুনটুনি পাখি বলে উঠল – “ওকি রিদয় হল কি!”
“মাথা আর মুণ্ডু হল!” বলে রিদয় পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতার আরম্ভ করলে।
রিদয়ের মা চেঁচিয়ে বললে – “এত বড়টি হলি তবু তোর ছেলেমানুষি গেল না। উঠে আয়, পাঠশালায় যাঃ।”