ভূতপতরীর দেশ
-'মাসি পিসি বনগাঁ-বাসী বনের ধারে ঘর
কখনো মাসি বলেন না -যে খইমোয়াটা ধর'
কিন্তু এবারে মাসি পিসি দুজনেই ডেকেছেন । আগে মাসির বাড়ি এসেছি পালকি চড়ে । সেখানে মোয়াঁ খেয়ে পেট ধামা করেছি । এখন পালকিতে শুয়ে পিসির বাড়ি চলেছি । মাসি চাদরের খুঁটে খই বেধে দিয়েছেন-পথে জল খেতে, হাতে একগাছা ভূতপরী লাঠি দিয়েছেন-ভূত তাড়াতে; এক লন্ঠন দিয়েছেন-আলোয়-আলোয় যেতে ।
হুম্পাহুমা পালকি চলেছে বনগা পেরিয়ে; ধপড়ধাঁই পালকি চলেছে বনের ধার দিয়ে, মাসির ঘর ছাড়িয়ে, ভূতপতূরীর মাঠ ভেঙে, পিসির বাড়িতে ।
পিসির দেশে কখনো যাইনি । শুনেছি পিসি থাকেন তেপান্তরের মাঠের ওপারে সমুদ্দরের ধারে, বালির ঘরে । শুনেছি পিসি কাঁকড়া খেভে ভালোবাসেন । কিন্তু লোক তো পিসির বাড়ি যায় কত! যে ভূতপরীর মাঠ! দেখেই ভয় হয় । এই মাঠ ভেঙে দুপুর রাতে পিসির বাড়ি চলেছি । চলেছি তো চলেইছি; ‘হুইয়া মারি খপরদারি!’ ‘বড়া ভারি খপরদারি’ !, মাঠের মাঝে একটা শেওড়াগাছের ঝোপ, অন্ধকারে কালো বেড়ালের মভো ণ্ডঁড়ি মেরে বসে আছে । তারই কাছে ঘোড়ার গোর, তার পরেই তেপান্তর মাঠ ! হাটের বাট ওই শেওড়াতলা পর্যন্ত;তার পরে আর হাট ও নেই, বাট ও নেই; কেবল মাঠ ধু-ধু করছে ।
এই শেওড়া-তলায় পালকি এসেছে কি আর যত ঝিঁঝিঁপোকা তারা বলে উঠেছে – ‘চললে বাঁচি!’ ‘চললে বাঁচি!’, কেন রে বাপু, একটু না হয় বসেছি তাতে তোমাদের এত গায়ের জ্বালা কেন? ‘চললে বাঁচি!’ চলতে কি আর পারি রে বাপু ? অমনি ঝিঁঝিঁপোকার সর্দার দুই লম্বা-লম্বা ঠ্যাং নেড়ে বলছে ‘ওই আসছে চিঁচিঁ ঘোড়া চিঁচিঁ!’,ফিরে দেখি গোরের ভিতর থেকে ঘোড়া ভূত মুখ বার করে পালকির দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে! ওঠা রে পালকি পালা রে পালা! আর পালা! ঘোড়া ভূত তাড়া করেছে – ঘাড় বেঁকিয়ে, নাক ফুলিয়ে আগুনের মতো দুই চোখ পাকিয়ে!
ভয়ে তখন ভুতপতরীর লাঠির কথা ভুলে গেছি। কেবল ডাকছি- জগবন্ধু,রক্ষে করো, মাসিকে বলে
তোমায় খইয়ের মোয়া ভোগ দেব ।বলতেই আমার খুঁটে বাঁধা খই গুলো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে । মাসির বাড়ির খই- জুঁই ফুলের মতো ফুটন্ত ধবধব করছে খই- রাস্তা যেন আলো করে । ঘোড়া-ভূত কি সে লোভ সামলাতে পারে? খই খেতে অমনি দাঁড়িয়ে গেছে । বেচারা ঘোড়াভূত খই খেতে মুখটি নামিয়েছে কি, অমনি তার ভূতুড়ে নিশ্বাসে খইওলি উড়ে পালাচ্ছে!যেমন খইয়ের কাছে মুখ.নেওয়া অমনি খই উড়ে পালায়! খইও ধরা দেয় না, ঘোড়াও ছাড়তে চায় না। ঘোড়া-ভূত চায় খই খায়, খই কিন্তু উড়ে-উড়ে পালায় ।
ঘোড়া চলেছে খইয়ের পিছে খই উড়েছে বাতাসের আগে আমি চলেছি পালকিতে বসে
ঘোড়া-ভূতের ঘোড়দৌড় দেখতে মুখ বাড়িয়ে । কখন যে মাঠে এসে পড়েছি মনেই নেই । সেখানটায় বড়ো অন্ধকার,বড়ো হাওয়া-যেন ঝড় বইছে । মাসির দেওয়া একটি লন্ঠনের মিটমিটে আলো অনেকক্ষণ নিভে গেছে । অন্ধকারে আর ঘোড়াও দেখা যায় না, খইও চেনা যায় না। বেহারাদের বলি-আলো জ্বালো; কিন্তু হাওয়ায় কথা উড়ে যায়; কে শোনে কার কথা! এমন হাওয়া তো দেখিনি! আমার ভুতপতরীর লাঠিটা পর্যন্ত উড়ে পালাবার যোগাড় । লন্ঠন টি তো গেছে ,শেষে লাঠিটাও যাবে? আচ্ছা করে লাঠিটা ধরে বসে আছি বাতাসের জোর ক্রমেই বাড়ছে ।
সর্বনাশ! এ যে দেখছি বীর-বাতাস ! এ বাতাসের মুখে পড়লে তো রক্ষে থাকবে না- পালকি শুদ্ধু আমি, আমার লাঠি, আমার ছাতা, ধুতি-চাদর, পোঁটলা-পুঁটলি, বিছানা-বালিশ কাগজের টুকরোর মতন কোথায় উড়ে যারে তার ঠিকানা নেই ! পথে জল খেতে দু-মূঠো খই ছিল, তা তো ঘোড়া-ভূতের সঙ্গে কোথায় উড়ে গেছে । শেষে বীর-বাতাসে আমিও উড়ে যাব নাকি? শীতেও কাঁপছি, ভয়েও কাঁপছি । পালকি ধরে বীর-বাতাস একবার একবার ঝাঁকানি দিচ্ছে আর হাঁক দিচ্ছি- ‘সামাল, সামাল।’ ভয়ে জগবন্ধুর নাম ভুলে গেছি পালকিখাণা ছাতার মতো বেহারাদের কাঁধ খেকে উড়ে আমাকে শুদ্ধু নিয়ে গড়াতে গড়াতে চলেছে । পিছনে ‘ধর! ধর!’ করে পালকি –বেহারাগুলো ছুটে আসছে ।
একটা বুড়ো মনসা গাছ, মাথায় তার হলদে চুল, বড় বড় কাঁটার বঁড়শি ফেলে বালির উপর মাছ ধরছিল। মনসা বুড়োর ছিপে মাছ তো পড়ছিল কত ! কেবল রাজ্যের খড়কুটো আর পাখির পালক এসে বুড়োর বঁড়শি তে আটকা পড়ছিল। এমন সময়ে আমার চাদরখানা গেলো বঁড়শিতে গেঁথে। আর যাব কোথা ? পালকি সুদ্ধ বালির উপর উলটে পড়েছি। বেহারা গুলো একবার আমাকে ছাড়াবার জন্য পালকির ডাণ্ডা ধরে আমার চাদর টা ধরে টানাটানি করলে, কিন্তু বাতাসের চোটে কোথায় উড়ে গেল আমার সেই উড়ে বেহারা ছ-টা, তাদের টিকিও দেখা গেল না।
মনসাবুড়োর হাসি দেখে কে! ভাবলে, মস্ত মাছ পেয়েছি । কিন্তু আমার হাতে ভূতপতরী লাঠি আছে তা ভো বুড়ো জানে না। লাঠি দিরে ষেমন বুড়োর গায়ে খোঁচা দেওয়া অমনি ভয়ে বুড়োর রক্ত দুধ হয়ে গেছে-সে তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে দিয়েছে । পালকি টা ঠেলে তুলে বিছানা-পত্তর পোঁটলা-পুঁটলি যা যেখানে পড়েছিল গুছিয়ে নিয়ে চুপটি করে বসে আছি- কখন বেহারা গুলো ফিরে আসে। মনসা বুড়োর গা বেয়ে দরদর করে সাদা দুধের মতো রক্ত পড়ছে। সে কোনো কথা বলছে না,আমিও সাদা রক্ত দেখে অবাক হয়ে বসে আছি ।
বুড়ো খুব রেগেছে; তার গায়ের সব রোঁয়া গুলো কাঁটার মতো সোজা হয়ে উঠেছে। অনেক্ষন গোঁ হয়ে বসে থাকার পর মনসা বুড়ো আমার দিকে চেয়ে বলছে, ‘দেখছ কি? বড় আমোদ হচ্ছে,না? বুড়ো মানুষের গায়ে খোঁচা দিয়ে রক্তপাত করে আবার বসে বসে তামাশা দেখছ, লজ্জা নেই! যাও না ছাড়া পেয়েছ তো নিজের কাজে যাও না!’
আমি বললুম, ‘যেতে পারলে তো! পালকি-বেহারা নেই যে! তারা আসুক তবে যাব’ ।, শুনে বুড়ো হোহো করে হেসে বললে, ‘কেন পা নেই নাকি হেঁটে যেতে পারো না? নবাব হয়েছ?’
আমার ভারি রাগ হলো বুড়োর র্বড়শির আঁচড়ে দুই পা ছিড়ে তখনো আমার ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে । আমি রেগে বললাম, পা দুটো কি আর রেখেছ! আঁচড়ের চোটে দফা শেষ করেছ যে!
‘লেগেছে নাকি’? বলে বুড়ো খানিক চুপ করে বললে, ‘একটু দই দাও, সেরে যাবে’।, আমি বললুম, -‘এই মাঠের মধ্যে দই তামাশা করছ নাকি?’, ‘আচ্ছা তবে খানিক তেঁতুল- বাটা হলেও চলতে পারে’। আমার হাসি পেল । নিশ্চয় বুড়ো ঘুমের ঘোরে স্বপন দেখছে । ‘বলি ও দাদা! এখানে তুমি ছাড় তো গাছ দেখছি নে, আরেকবার লাঠির খোঁচা দিয়ে তোমার গা খেকে দুধ বার করে নিয়ে দই পাতব নাকি’?- বলেই ভূতপতরী লাঠিটা যেমন একটু বাগিয়ে ধরেছি, অমনি বুড়ো বলছে, ‘রও রও করো কী দাদা। বুড়োমানুষ কখন কী বলি, রাগ কোরো না । আমরা মনসাদেবীর বরে চিরকাল নানারকম স্বপন দেখি । এইখানটিতে কতকাল যে বসে আছি তার ঠিক নেই । ছিপ নিয়ে মাছ ধরছিলুম জলের ধারে-আজ সে কত কালের কথা;সে নদি শুকিয়ে জল সরে চড়া পড়ে গেছে, কিন্তু এখনো ঝোঁক কাটেনি; মনে হচ্চে নদীর ধারেই বসে মাছ ধরছি! আমার বেশ মনে পড়ছে এইখানেই একঘর গয়লা খাকত আর ঠিক তাদের ঘরের কোণে একটা মস্ত তেঁতুলগাছ ছিল, এখন তবে সেণ্ডলো গেছে?’ বলেই বুড়ো ঝিমিয়ে পড়ে দেখে আমি তাকে জাগিয়ে দিয়ে বললুম, ‘আচ্ছা দাদা ওই যে ঘোড়াভূত আর ঝি ঝি পোকা দেখে এলুম, ওদের কথা তুমি কিছু জানো কি?
জানি বইকি! ওরা তো সেদিলের ছেলে, বলেই বুড়ো গল্প শুরু করলেঃ
‘দেখো, এই পৃথিবী তখন সবে তৈরি হয়েছে আমাদের মতো দু-চারটি গাছ ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই;-নদী নেই, পাহাড় নেই, এমন কি বাতাসে শব্দটি পর্যন্ত নেই; কেবল বালি ধূধূ করছে- ঠিক এই জায়গাটির মতো। আমার তখন সবেমাত্র কচি-কচি দুটি কাঁটা বেরিয়েছে-ছোটো ছেলের কচিকচি দুটি দাঁতের মতো। সেই সময় তারা গান বড়ো ভালোবাসে, তাবা দেখতে অনেকটা মানুষের মতো, কিন্তু ফড়িংগুলোর মতো তাদের ডানা আছে, পাখিগুলোর মতো পা, ঝাঁক ধেঁধে তারা আমাদের কাছে উড়ে এসে বসল আর গান গাইতে আরম্ভ করলে । আকাশবাতাস তাদের গানের সুরে যেন বেজে উঠলা সে যে কী চমৎকার তা তোমাকে আর কী বলব! আমরা তার আগে শব্দ শুনিনি, গানও শুনিনি-আনন্দে যেন শিউরে উঠলুম । বালি ঠেলে যত গাছ, যত ঘাস মাথা তুলে কান পেতে সেই গান শুনতে বেরিয়ে এল, পৃথিবীর ভিতর থেকে পাহাড়ণ্ডলো গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে এল, পাহাড়ের ভিত; থেকে নদীগুলো ছুটে ছুটে বেরিয়ে এল । গান শুনতে-শুনভে দেখতে-দেখতে আমরা বড়ো হয়ে উঠলুম । কিন্তু যারা গান গাইতে এল, কী খেয়ে তারা বাঁচে? পৃথিবীতে ভো তখন ফুলও ছিল না, ফলও ছিল না; ছিল কেবল আমাদের মতো বড়ো-বড়ো গাছ; কাঁটা আর লতা আর পাতা নদীতে মাছ ও ছিল না, আকাশে পাখিও ছিল না যে তারা ধরে খায় । তবু তারা অনেকদিন বেঁচে ছিল কেবল গান গেয়ে । একদিন হঠাৎ শুনি গান বন্ধ হয়ে গেছে-তারা সবাই মরে গেছে শুকনো পাতার মতো। তাদের সোনার ডানা বাতাসে উড়ে এসে আমাদের গায়ে বিঁধতে লাগল, কিন্তু তাদের গানের সুর আর শোনা গেল না । তারপর পৃথিবীতে অনেকদিন আর কোনো সাড়াশব্দ নেই; কেবল দেখছি, একদল কারা জানি না, দেখতে অনেকটা মানুষ আর ঘোড়ার মতো, এদিকে-ওদিকে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদেরই খুঁজে-খুঁজে যারা গান গাইতে এসেছিল । ক্রমে দেখি তারাও মরে গেছে ।পৃথিবীতে আর তখন কিছু চলে বেড়াচেছ না, গান গাইছে না-কেবল গাছের দল আমরা চুপ করে বসে আছি । জামাদের বয়স ক্রমে বাড়ছে আর আমরা বুড়ো হচ্ছি । তখন জলে মাছ দু-একটি দেখা দিয়েছে; আমি কাঁটা আর বঁড়শি ফেলে এক রাত্তিরে মাছ - ধরছি এমন সময়’-
বলেই মনসাবুড়ো ঝিমিয়ে পড়ল! আমি যত বলি, ‘এমন সময় কী হল দাদা? আবার বুঝি সেই ফড়িংদের মতো মানুষণ্ডলো ঝিঁঝিঁপোকা হয়ে ফিরে এসে গান গাইছে দেখলে? দেখলে বুঝি সেই মানূষের মভো ঘোড়াগুলো ভুত হয়ে অন্ধকার থেকে মুখ বাড়িয়ে তাদের গান শুনতে এল?’, বুড়োর আর কথা নেই; কেবল একবার হু বলেই চুপ করলে ।
আমি ভাবছি দি আরএক ঘা লাঠি বুড়োর মাথায় বসিয়ে, এমন সময় দেখি দূর থেকে একটা আলো আসছে-যেন কে লন্ঠনহাতে আমার দিকে চলে আসছে । একবার ভাবছি বুঝি বেহারা কজন আলো নিয়ে আমাকে নিতে এল । একবার ভাবছি, কী জানি মাঠের মাঝে আলেয়া দেখা দেয়, তাও তো হভে পারে । কিন্তু দেখলুম আলোটা এসে পালকির খানিক দূরে থামল; আর চারটে জোয়ান উড়ে আমার পালকিটা কাঁধে নিলে । উড়েদের একেই একটু ভুতূড়ে চেহারা, কাজেই ঠিক আন্দাজ করতে পারলুম না যে তারা ভুত না মানুষ । একবার তাদের পায়ের দিকে চেয়ে দেখলুম, ভূতের মতো তাদের পায়ের গোড়ালি উলটো কিনা। কিন্তু অন্ধকারে কিছু ঠিক করতে পারা গেল না। মনসাবুড়োকে ডেকে বললুম, -দাদা, তবে যাচ্ছি-
দাদা আমার তখন ঝিমোচ্ছেন; চমকে উঠে বললেন, ‘যাবে নাকি? গল্প টা তো শেয হল না?’ - পালকি তখন চলেছে মুখ বাড়িয়ে বললুম, ‘দাদা, একরকম গল্পটা শেযই করেছিলে, কেবল তোমার মাথার চুল হলদে আর তোমার রক্ত শাদা -কেন, সেইটে বলতে বাকি রয়ে গেল’ ।, -
‘মাস্টারমশায়ের কাছে জেনে নিও-, বলেই দাদা আবার ঝিমিয়ে পড়লেন । হুহু করে পালকি আবার মাঠের দিকে বেরিয়ে গেল।
একটু ভয়-ভয় করছে; বেহারাগুলো মানুষ না ভুত বুঝতে পাচ্ছিনে । পাল্কির দরজা বন্ধ করে চুপ করে বসে আছি, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল- মানুষ উড়ে পালকি কাঁধে হুম্মাহুম্মা ডাক ছাড়ে, এরা তো হাঁক দিচ্ছে না। পড়েছি ভুতের হাতেই । পড়েছি, আর কোনো ভুল নেই । আচ্ছা দেখাযাক,ভুতপতরী লাঠি তো আছে । তেমন-তেমনদেখি তো দুহাতে লাঠি চালাব ।
ভুতপতরী লাঠির কথা মনে করেছি কি অমনি ধপাস করে পালকি টা তারা মাটিতে ফেলেছে, কোমরটা আবার খচ করে উঠেছে । ‘তবে রে ভূত-উড়ে আমাকেএইমাঠে একলা নামিয়ে দিয়ে পালাবে ভেবেছ ! তোল পালকি,ওঠা সোয়ারী’ বলেই লাঠি নিয়ে যেমন তেড়েযাব,কোমর টা আবার বেঁকে্ পড়লো।ভূতণ্ডলো দেখেই খলখলকরে হেসে অন্ধকারে মাঠে কোথায় মিলিয়ে গেল। মহাবিপদ ।এই রাত্তিরে-মাঠের মাঝে ভূতের ভয়,ঝমের ভয়,সাপের ভয়,তার ওপর কোমর ভেঙে গেল !লাঠিধরে যে গুড়িগুড়ি পালাব তারও জো নেই । মনসাকাঁটায় পা ছিঁড়ে গেছে।‘দূর কর আর ভাবতে পারিনে, যা হয় হবে!’ বলে পালকির ভেতরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম খিদেও পেয়েছে তেষ্টাও পেয়েছে ।
একলা থাকতে-থাকতে ক্রমে ঘুম এসেছে । একটু চোখ বুজেছি কি না বুজেছি অমনি খস করে একটা শব্দ হল । চোখ চেয়ে দেখি, বালির ওপরে গোটাকতক তালগাছ উঠেছে তাদের মাথা যেন আকাশে ঠেকেছে,- আর একটা আলো ঘুরে ঘুরে সেই তালগাছে ঠেকছে, আবার সড়সড় করে নেমে আসছে।আমি আর না-রাম না-গঙ্গা। কাঠ হয়ে পড়ে আছি কেবল দুটি চোখ চাদরের একটি কোণ দিয়ে -বের করে । --
দেখছি আলোটা ক্রমে এ-গাছ সে-গাছ করে ঘুরে বেড়াতে লাগল । তারপর আস্তে- আস্তে মাটিভে নেমে এল । সেই সময় দেখি পুর্ণিমার চাঁদের মতো প্রকাণ্ড একটা কাচের গোলা মাঠের ওপর দিয়ে বোঁবোঁ করে-গড়িয়ে আসছে-যেন একটা মস্ত আলোর ফুটবল । তালগাছের তলায় যে আলোটা টিপটিপ করছিল সেটা জোনাকি পোকার মতো উড়ে গিয়ে সেই গোলাটার ওপর বসল । বসেই গোলাটাকে আমার দিকে গড়িয়ে আনতে লাগল ।
দেখছি আলোটা ক্রমে এ-গাছ সে-গাছ করে ঘুরে বেড়াতে লাগলো । পালাবার জো নেই ।।একেবারে গড়িয়ে চলেছি-বনবন করে লাঠিমের মতো ঘুরতে-ঘুরতে । সে কী ঘুরুনি ! মনে হল,আকাশ ঘুরছে তারা ঘুরছে পৃথিবী ঘুরছে,পেটের ভেতর আমার - মাসির মোয়াগুলো ও যেন ঘুরতে লেগেছে । কখনো মাঠের ওপর দিয়ে, কখনো গাছের মাথা ডিঙিয়ে, গোলাটি সাদা খরগোশের মতো লাফিয়ে, গড়িয়ে, কখনো জোরে, কখনো আস্তে আমাকে নিয়ে ছুটে চলেছে ।
ভয়ে দুই হাতে চোখ ঢেকে চলেছি । ক্যা-ক চরকা-কাটার শব্দ শুনে চোখ খুলে দেখি এক বুড়ি সুতো কাটছে আর একটা খরগোশ তার চরকা ঘুরোচ্চে । বুড়িকে দেখেই চিনেছি,সেই আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি, যে চাঁদের ভেতরে বসে থাকে । আর ওই তার চরকা, ওই খরগোশ! আঃ বাঁচা গেল! এটা তবে গোলআভূত নয়! ইনিই আমাদের চাঁদমামা, আর বুড়ি তো আমাদের মামি! আর এ খরগোশ তো আমাদের সেই খাঁচার খরগোশটি, বিলিতি ইঁদুরের আর গিনিপিগুলির বড়োমামা!
‘বলি মামি, এমন করে কি ভয় দেখাতে হয়’। বলেই আমি খরগোশটাকে খপ করে কোলে তুলে নিয়েছি ।
‘ওরে ছাড়, ছাড়! আমার চরকা-কাটা বন্ধ করিস নে,দেখছিস নে এই চরকার জোরেই চাঁদমামার সংসার চলছে’ ।
সত্যিই দেখি চরকা বন্ধ হতেই চাঁদমামা গড়াতে-গড়াতে থেমে গিয়ে লাঠিমের মতো মাটির ওপর কাত হয়ে পড়েছ্ন । আমি থরগোশটি মামির হাতে দিয়ে বললুম, ‘কই মামি, চালাও দেখি মামাকে’ ।,
খরগোশ চরকায় যেমন এক পাল দিয়েছে অমনি চাঁদামামা গাঝাড়া দিয়ে ঘুরতে লেগেছেন । বুড়ি ডাকছে, ‘ দে পাক, দে পাক’ খরগোশ ততই পাক দিচ্ছে আর চাঁদমামাও তত ঘুরুপাক দিয়ে ডিগবাজি খেরে রবারের বলের মভো নাচতে-নাচতে চলেছেন। যত বলি, ‘মামি আর পাক দিও না,মামাকে আমার অত ঘুরিও না, মামা হাঁপিয়ে দম আটকে কোনদিন মারা পড়বেন যে ! একটু রয়ে-বসে চালাও শেষে বুড়োবয়েসে মামার কি মাথা ঘুরনির রোগ ধরিয়ে দেবে? জানি কি যে মামি আমার কালা। আমার একটি কথাও বুড়ির কানে যায়নি । সে কেবল বলছে- ‘দে পাক, দে পাক !’ আমি যত ইশারা করে বলি,‘আস্তে, আস্তে--বুড়ি ভাবে জোরে চালাতে বলছি, ততই ডাকে, ‘দে পাক, দে পাক’!
মামা রেলের গাড়ির মভো হুহু করে ছুটে চলেছেন। ‘ওরে থামা, থামা! মাথা ঘুরে গেল, আর যে পারিনে’ -বলেই লাঠি তুলেছি খরগোশ টা মারতে । যেমন লাঠি তোলা অমনি খরগোশটা খ্যাঁক করে তেড়ে এসেছে, ক্যাঁচ করে চরকাটা বন্ধ হয়ে গেছে আর পটাং করে মামির হাতের সুতো কেটে গেছে ।যেমন সুতো কাঁটা আর ঝপাং করে চাঁদ মামা গিয়ে একটি নদীর জলে পড়েছেন, পড়েই ফেটে চৌচির! –
‘কী করলে গো মামি !’, বলেই চমকে দেখি নদীর ওপারে পালকিসুদ্ধ আমি ঠিকরে পড়েছি । কোথায় বুড়ি, কোথায় চরকা, কোথায় বা সে খরগোশ! নদীর জলে দেখি একরাশ কাঁচের টুকরোর মতো চাঁদমামার ভাঙা আলো! খানিক চকচক করেই নিভে গেল । আকাশের দিকে চেয়ে দেখি চাঁদমামার আধখানা কোথায় উড়ে গেছে ।
ভাগ্যি নদীতে তেমন জল ছিল না, নইলে সবাই আজ ডুবেছিলাম আরকি !বড় তেষ্টা পেয়েছিল। নদী থেকে এক ঘটি জল খেয়ে ঠান্ডা হয়ে তবে বাঁচি!
নদীর ধারেই একটা গাঁ রয়েছে । দেখে সাহস হল; ভাবলুম-আজ রাত্তিরে ওই গাঁয়ে কারোর গোয়ালখঘরে শুয়ে থাকি; কাল সকালে এখান খেকেই ফিরে পালাব, পিসির বাড়ি যাওয়ায় আর কাজ নেই বাবা! এই মনে করে গাঁয়ের ভেতরে গিয়ে দেখি সেখানে জনমানব নেই । ডাক-হাঁক করে কারো সাড়াও পাইনে। যাইহোক, গাঁ ছেড়ে আর এক পা-ও নড়া নয় । চাদর মুড়ি দিয়ে একটি ঘরের দাওয়ায় শুয়ে পড়লাম। যেমন শোয়া, আর ঘুম- অকআতরে ঘুম ।
খানিক পরে জেগে দেখি, সেই মনসাতলার লন্ঠন-ভূতটা আর তার চার বন্দু আলো নিয়ে আমার মুখের কাছে বসে আছে।‘তবে রে!’, বলেই যেমন উঠতে যাব অমনি তারা বলে উঠেছে, ‘দেখো বাবু’, ফের যদি লাঠি দেখাও কি মারতে আস,তবে আবার আমরা তোমাকে ফেলে পালাব । আর যদি চুপ করে ভালোমানুষটি হয়ে পালকিটে বসে থাক, তবে ওই-কি বলে ও-কিতলা পর্যন্ত তোমাকে আমরা পৌঁছে দেব।, বুঝলুম ভূতওলো ভয়ে - রামনাম মুখে আনতে পারছে না, তাই পিসির বাড়ি যেতে যে রামচণ্ডী তলার র কথা-শুনেছি তাকে বলছে- কি-বলে-ও-কি তলা।
ভূতগুলো ভয় পেয়েছে দেখে সাহস হল; পালকিতে আবার উঠে বসলুম ।
এবারে আর ভয় করছে না-ভোর হবার এখনো দেরি আছে ।কিন্তু এরই মধ্যে ভুতগুলো যেন একটু ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে, মাঠে আর ঘন-ঘন আলেয়া দেখা দিচ্ছে না, পথের ধারে তালগাছ তো দেখাই দিচ্ছে না, কোথাও মানসাগাছের ছায়াটি পর্যন্ত আর দেখা যায় না।পূর্বদিক থেকে ভোরের বাতাস একটু-একটু আসছে;ভূত ণ্ডলো হাওয়া পেয়েই যেন জড়োসড়ো।আমি কিন্তু বেশ আরামে পালকিতে দরজা খুলে ঘুম দিতে দিতে-চলেছি ।
ভোর হয় দেখে ভূত-বেহারা চারটে ভয় পেয়েছে, কিন্তু রামচণ্ডীতলায় আমাকে পৌঁছে দিলেই তাদের ছুটি হয়ে যাবে এই ভেবে তাদের একটু আলহাদ ও হয়েছে । চার ভূত চার সুরে চিঁচিঁ,পিঁপিঁ , খিটখিট, টিকটিক করে গান গাইতে গাইতে চলেছে-ঠিক যেন কত দূর থেকে চিল ডাকছে আর কোলাব্যাঙ কটকট করছে । ঘুমের ঘোরে শুনছি যেন ‘কুহুকেকা’ র ঠিক সেই পালকির গানটা। কিন্তু কথাণ্ডলো সব উলটোপালটা আর সুরটাও বেখাপ্পা বেয়াড়া-বেজায় ভুতূড়ে । কেবল হাড় খটখট, দাঁত কিটমিট, গোঙানি আর কাতরানি ওনে যে গায়ে জ্বর এল! ঘুমিয়ে আছি কিন্তু তবু শুনছি:
চলে চলে
হুমকিতালে
পংখী গালে
মাসিপিসি
বাঘবেরালে ।
ভূতপেরেতে
চলেছে রেতে
হনহনিয়ে
ভূতপেরেতে ।
পালকি দোলে
উঠতি আলে
নালকি দোলে –
নাসতি খালে
আলো-আঁধারে
শেওড়াগাছ
কালোয় শাদায়
বেরাল নাচ
।
মরানদী
বালির ঘাট
মনসাতলায়
মাছের হাট ।
ভূতের জমি
ভূতের জমি
ভূতপেরেতের নাইকো কমি ।
উড়ছে কতক –
ভনভনিয়ে
চলছে কতক
হনহনিয়ে
হণহনিয়ে ।
চলছে কতক
গাছতলাতে
দুলছে কতক তালপাতাতে ।
দিনদুপুরে
বাদুড় ঘুমোয়
রাতদুপুরে
হুতোম ঘুমোয়।
ভোঁদড় ভাম
ব্যাঙ-ব্যাঙাচি
টিকটিকি আর
কানামাচি ।
গঙ্গাফড়িং
জোনাকপোকা
আরসোল্লা
ন্যাংটা খোকা।
ছুঁচো ইঁদুর
খ্যাকশেয়ালে।
শুকনো পাতা
গাছের ডাল!
সব ভূতুড়ে
সব ভূতুড়ে
ঘুরনি-হাওয়ায়
চলছে ঘুরে
জগৎ জুড়ে
ঘুরছে ধুলো
বাতাস দিয়ে দুলছে কুলো।
সব ভূতুড়ে
সব ভূতুড়ে
আলো-আলেয়া
জ্বলছে দূরে
সব ভূতুড়ে
ভূতের খেলা
খেজুরতলায়
ইটের ঢেলা--
গানটা শুনেছি একবার-ছুঁচো, ইঁদুর, কানামাছি, ভোঁদড় প্যাঁচা, টিকটিকি, র্খ্যাঁকশেয়াল ।, গানটা শুনছি দু-বার- ‘গঙ্গাফড়িং, জোনাকপোকা, আরসোলা, বাদুড়’।- গানটা ওনছি তিনবার—‘আলো-আলেয়া, ঘূর্ণি-হাওয়া, খেজুরগাছ, ইটের ঢেলা’ ।, একবার, দু-বার, তিনবার, বারবার তিনবার ইটের ঢেলা পড়েছে কি আর পালকিসুদ্ধ আমাকে ভূতগুলো ঝপাং করে মাটিতে ফেলে খেজুরগাছের তলায় একটা মরা গরু পড়েছিল সেটাকে নিয়ে লুফতে-লুফতে দৌড় মেরেছে! ওদিকে অমনি রামচণ্ডী থেকে রাত তিনটের আরতি বেজেছে-টংটং, টংআ-টং, টংটং-আ-টং ।
- এই খেজুড়তলা পর্যন্ত ভূত আসভে পারে,তার ওদিকে রামচণ্ডীতলা , সেখানে রামসীতা বসে আছেন , হনুমান, জ্বাম্ববান পাহারা দিচ্ছে, ভূতের আর সেখানে এগোবার জো নেই । ভূতপতরীর লাঠিরও জোর সেখানে খাটবে না। কাজেই পোঁটলাপুঁটলী লাঠিছাতা সমস্ত পালকিতে রেখে, কোমর ধরে, খোঁড়াতে- খোঁড়াতে বালি ভেঙে রামচণ্ডীতলায় রামসীতা দেখতে তিনটে রাতে অন্ধকার দিয়ে একলা চলেছি । সঙ্গে একঢি আলো নেই, হাতে লাঠিটি পর্যন্ত নেবার জো নেই । কী জানি দেখে যদি হনুমান মন্দিরে ঢুকতে না দেয়! তখন যাই কোথা?
রাম-রাম, বলতে বলতে বালি ভেঙে চলেছি । বালি তো বালি একেবারে বালির পাহাড় । এক একবার পিছন দেখছি ভূতগুলো আসছে কিনা। যদিও এখানকার বালিতে পা দিলেই তাদের মাথার খুলি ফটাস করে ফেটে যাবে তবুও খেজুরগাছটার ওপর থেকে তারা ভয় দেখাতে ছাড়ে না; টুপ করে হয়তো একটা খেজুর আঁটি এসে গায়ে পড়ল, হয়তো দেখছি খেজুরতলায় যেন একটি কচি ছেলে ওমা-ওমা করে কাঁদছে, শুনে ইচ্ছে হয় দৌড়ে গিয়ে দেখি-বুঝি কাদের ছেলে পথ হারিয়ে কেঁদে বেড়াচ্ছে; হয়তো আমার নাম ধরেই পথে কে একবার ডাকলে, গলাটা যেন চেনা-চেনা, ফিরে দেখি কেউ কোথাও নেই! অন্ধকারে হয়তো দেখলুম মাঠের মাঝে একটা জায়গায় খানিকটা জ্বলন্ত বালি তুবড়ি- বাজির মতো ফস করে জ্বলে উঠল, ইচ্ছে হয় গিয়ে দেখি কিন্তু গেলেই বিপদ-একেবারে ভূতে ধরে জরিমাণা করে তবে ছাড়বে, নয়তো মট করে ঘাড় মটকে দেবে ।
আমি আর এদিক-ওদিক কোনোদিক না দেখে ‘সীতারামসীতারাম’ বলতে-বলতে চলেছি । ওই দেখা যাচ্ছে বালির পাহাড়ের ওপরে পঞ্চবটীর বন, বনের মাথায় রামসীতা মন্দিরের চূড়ো। মনে হচ্ছে এই কাছেই আর একটূ গেলেই পৌঁছে যাব, কিন্তু যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই যেন সব দুরে সরে যাচ্ছে-আমার কাছ থেকে দৌড়ে পালাচেছ । আমিও দৌড়েছি খোঁড়া পা নিয়ে, দৌড়েছি হাঁপাতে- হাঁপাতে, দৌড়েছি উঠি-তো পড়ি বালির ওপর দিয়ে ।
এইবার শুনতে পাচ্ছি মন্দিরের খল-করতাল বাজছে; দেখতে পাচ্ছি জাম্বুবানের দল আগুন জ্বালিয়ে গাছতলায় বসে আছে; হনুমানের ল্যাজ বটের ঝুরির মভো পাতার ফাঁক দিয়ে ঝুলে পড়েছে । আর ভয় কী! বলে যেমন রামচণ্ডীতলায় ছুটে যাব আর নাকটা গেল ঠুকে-একি, নাক ঠুকল কিসে? এই তো সামনে সোজা রাস্তা-গাছের তলা দিয়ে মন্দিরের উঠেছে; তবে নাক ঠোকে কিসে?
নাকে হাত দিয়ে দেখি নাকটা বিলিতি-বেগুনের মতো ফুলে উঠেছে ।সামনে হাতড়ে দেখি প্রকাণ্ড কাঁচ, তার ভেতর থেকে ফ্রেমেবাঁধা ছবির মতো রামচণ্ডীর মন্দির, পঞ্চবঢী বন, হনুমানের ল্যাজ, সবই দেখা যাচ্ছে; কেবল তার ভেতরে যাওয়া যাচেছ না । ফড়িংগুলো যেমন লন্ঠনের চারদিকে মাথা ঠুকে মরে,আমিও তেমনি ঘুরে রেড়াচ্ছি চারদিকে কেবল নাক ঠুকে-ঠুকে । নাকটা বেগুনের মতো গোল হয়ে ফুলে উঠেছিল । কাঁচে লেগে-লেগে ক্রমে চ্যাপটা হয়ে গেল, তবু ভেতরে ঢোকবার রাস্তা কিন্তু পেলুম না।
র্হাঁপিয়ে গেছি, বালির ওপরে বসে পড়েছি, হনুমানের গোটাকতক ছানা আমাকে দেখে দাঁত রের করে হাসছে । ভারি রাগ হল, রাগে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল । ‘জয় রাম’! বলে দিয়েছি এক লাফ সেই কাঁচের ওপরে । লাফ দিয়েই ভাবলুম-গেছি হাত-পা কেটে, সব গায়ে কাঁচ ফুটে রক্তারক্তি হল দেখছি । কিন্তু আশ্চর্য! রামনামের গুনে জলের মতো কাঁচ কেটে একেবারে ভেতরে পড়েছি-হনুমানের জাম্বুবানের দলের মাঝখানে ।আর অমনি চারদিকে রব উঠেছে-‘জয় রাম! জয়-জয় রাম,!সীতারাম!’- সমুদ্দুরের ডাক শুনছি-‘জয়-জয় রাম’,বাতাসে শব্দ শুনছি, ‘জয় রাম! চারদিকে জয় রাম সীতারাম!’
কেউ আমাকে একটি কথাও বললে না, আমার দিকে ফিরেও চাইলে না! আমি রামসীতা
দর্শন করে একটা -কাঁটাবন পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে পড়েছি । সেখানে দেখি, ছটা বেহারা আমার পালকিটি নিয়ে বসে আছে-দেখতে কালো কিচকিন্দে ।
‘কে হে বাপু তোমরা পাল্কিটি নিয়ে’?- -
‘বাবুজি, আমরা তোমার পিসর চাকর-কিসকিন্দে, কাসুন্দে, বাসুন্দে, ঝাপুন্দে, মালুন্দে, হারুন্দে!’
- আচ্ছা বাপু, চলো তো পিসির বাড়ি’,বলেই আমি পালকি চেপে বসেছি ।
এবার চলেছি আরামে, কোনো-ভয় নেই; পা ছড়িয়ে বসে, পালকির দুই দরজা খুলে, মনের আনন্দে চারদিক দ্ঘেতে-দেখতে চলেছি । কেমন তালে-তালে এবার পালকি চলেছে- কালকাসুন্দি, ঝালকাসুন্দি! ঝাঁকুনি নেই পালকি চলেছে-আমকাসুন্দি,জামকাসুন্দি যেন জলের ওপর দুলতে দুলতে-নেচে চলেছে ।--পিসির পালকি চলেছে-ধর কাসুন্দে, চল বাসুন্দে, বড়া ঝালুন্দে,খোঁড়া মালুন্দে পালকির এক দরজা ধরে চলেছে হারুন্দে, আর এক দরজা ধরে চলেছে উড়েদের সর্দার-কালো কিচকিন্দে ।
হারুন্দের মাথায় কালো চুলের উঁচু ঝুঁটি আর কিচকিন্দের মাথায় পাকা চুলের শনের নুটি । হারুন্দে ফরসা, কিচকিন্দে কালো মিশ-যেন বাংলা কালি! হারুন্দের চুল যেন বালির ওপরে মনসাগাছ-খাড়াখাড়া, খোঁচা-খোঁচা, আর কিচকিন্দের চুল যেন সমুদ্দুরের শাদা ঢেউ-হওয়ায় লটপট করছে । কিচকিন্দের-মাঠটাও দেখছি খানিক শাদা, খানিক কালো, খানিক আলো, খানিক-অন্ধকার-একদিকে ধুপধাপ-করছে শুকনো বালি আর-দিকে টলমল করছে কালো জল-নুনে গোলা ।মাঠ দিয়ে-চলছি, না, শাদা-কালো মস্ত এক-খানা শতরঞ্জির ওপর দিয়েই চলেছি ।
আমার বাঁদিকে কেবল বালি-শাদা ধপধপ করছে বালি; আর আমার ডানদিকে রয়েছে কালি-গোলা সমুদ্দর-কালো কাজলের মতো কালো, র্বাঁয়ে চলেছে হারুন্দে-ডাঙার খবর দিতে-দিতে, ডাইনে চলেছে কিচকিন্দে-জলের আদি-অন্ত কইতে-কইতে আমি চলেছি পালকিতে শুয়ে মনে-মনে দুজনের দুর্টো- গল্প শাদা একটা শেলেটের উপর কালো পেনসিল দিয়ে লিখে নিতে নিতে । কিচকিন্দের গল্পটা জলের কিনা তাই সেটা লিখে নিতে-নিতেই ধুয়ে মুছে গেছে, একটুও আর পড়া খাচ্ছে না! কিন্তু হারুন্দের গল্পটা বালির আঁচড়ের মতো একেবারে শেলেটে কেটে বসে গেছে-ধুলেও যায় না, মুছলেও যায় না-বেশ পষ্ট-পষ্ট পড়া যাচ্ছে ।
-'মাসি পিসি বনগাঁ-বাসী বনের ধারে ঘর
কখনো মাসি বলেন না -যে খইমোয়াটা ধর'
কিন্তু এবারে মাসি পিসি দুজনেই ডেকেছেন । আগে মাসির বাড়ি এসেছি পালকি চড়ে । সেখানে মোয়াঁ খেয়ে পেট ধামা করেছি । এখন পালকিতে শুয়ে পিসির বাড়ি চলেছি । মাসি চাদরের খুঁটে খই বেধে দিয়েছেন-পথে জল খেতে, হাতে একগাছা ভূতপরী লাঠি দিয়েছেন-ভূত তাড়াতে; এক লন্ঠন দিয়েছেন-আলোয়-আলোয় যেতে ।
হুম্পাহুমা পালকি চলেছে বনগা পেরিয়ে; ধপড়ধাঁই পালকি চলেছে বনের ধার দিয়ে, মাসির ঘর ছাড়িয়ে, ভূতপতূরীর মাঠ ভেঙে, পিসির বাড়িতে ।
পিসির দেশে কখনো যাইনি । শুনেছি পিসি থাকেন তেপান্তরের মাঠের ওপারে সমুদ্দরের ধারে, বালির ঘরে । শুনেছি পিসি কাঁকড়া খেভে ভালোবাসেন । কিন্তু লোক তো পিসির বাড়ি যায় কত! যে ভূতপরীর মাঠ! দেখেই ভয় হয় । এই মাঠ ভেঙে দুপুর রাতে পিসির বাড়ি চলেছি । চলেছি তো চলেইছি; ‘হুইয়া মারি খপরদারি!’ ‘বড়া ভারি খপরদারি’ !, মাঠের মাঝে একটা শেওড়াগাছের ঝোপ, অন্ধকারে কালো বেড়ালের মভো ণ্ডঁড়ি মেরে বসে আছে । তারই কাছে ঘোড়ার গোর, তার পরেই তেপান্তর মাঠ ! হাটের বাট ওই শেওড়াতলা পর্যন্ত;তার পরে আর হাট ও নেই, বাট ও নেই; কেবল মাঠ ধু-ধু করছে ।
এই শেওড়া-তলায় পালকি এসেছে কি আর যত ঝিঁঝিঁপোকা তারা বলে উঠেছে – ‘চললে বাঁচি!’ ‘চললে বাঁচি!’, কেন রে বাপু, একটু না হয় বসেছি তাতে তোমাদের এত গায়ের জ্বালা কেন? ‘চললে বাঁচি!’ চলতে কি আর পারি রে বাপু ? অমনি ঝিঁঝিঁপোকার সর্দার দুই লম্বা-লম্বা ঠ্যাং নেড়ে বলছে ‘ওই আসছে চিঁচিঁ ঘোড়া চিঁচিঁ!’,ফিরে দেখি গোরের ভিতর থেকে ঘোড়া ভূত মুখ বার করে পালকির দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে! ওঠা রে পালকি পালা রে পালা! আর পালা! ঘোড়া ভূত তাড়া করেছে – ঘাড় বেঁকিয়ে, নাক ফুলিয়ে আগুনের মতো দুই চোখ পাকিয়ে!
ভয়ে তখন ভুতপতরীর লাঠির কথা ভুলে গেছি। কেবল ডাকছি- জগবন্ধু,রক্ষে করো, মাসিকে বলে
তোমায় খইয়ের মোয়া ভোগ দেব ।বলতেই আমার খুঁটে বাঁধা খই গুলো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে । মাসির বাড়ির খই- জুঁই ফুলের মতো ফুটন্ত ধবধব করছে খই- রাস্তা যেন আলো করে । ঘোড়া-ভূত কি সে লোভ সামলাতে পারে? খই খেতে অমনি দাঁড়িয়ে গেছে । বেচারা ঘোড়াভূত খই খেতে মুখটি নামিয়েছে কি, অমনি তার ভূতুড়ে নিশ্বাসে খইওলি উড়ে পালাচ্ছে!যেমন খইয়ের কাছে মুখ.নেওয়া অমনি খই উড়ে পালায়! খইও ধরা দেয় না, ঘোড়াও ছাড়তে চায় না। ঘোড়া-ভূত চায় খই খায়, খই কিন্তু উড়ে-উড়ে পালায় ।
ঘোড়া চলেছে খইয়ের পিছে খই উড়েছে বাতাসের আগে আমি চলেছি পালকিতে বসে
ঘোড়া-ভূতের ঘোড়দৌড় দেখতে মুখ বাড়িয়ে । কখন যে মাঠে এসে পড়েছি মনেই নেই । সেখানটায় বড়ো অন্ধকার,বড়ো হাওয়া-যেন ঝড় বইছে । মাসির দেওয়া একটি লন্ঠনের মিটমিটে আলো অনেকক্ষণ নিভে গেছে । অন্ধকারে আর ঘোড়াও দেখা যায় না, খইও চেনা যায় না। বেহারাদের বলি-আলো জ্বালো; কিন্তু হাওয়ায় কথা উড়ে যায়; কে শোনে কার কথা! এমন হাওয়া তো দেখিনি! আমার ভুতপতরীর লাঠিটা পর্যন্ত উড়ে পালাবার যোগাড় । লন্ঠন টি তো গেছে ,শেষে লাঠিটাও যাবে? আচ্ছা করে লাঠিটা ধরে বসে আছি বাতাসের জোর ক্রমেই বাড়ছে ।
সর্বনাশ! এ যে দেখছি বীর-বাতাস ! এ বাতাসের মুখে পড়লে তো রক্ষে থাকবে না- পালকি শুদ্ধু আমি, আমার লাঠি, আমার ছাতা, ধুতি-চাদর, পোঁটলা-পুঁটলি, বিছানা-বালিশ কাগজের টুকরোর মতন কোথায় উড়ে যারে তার ঠিকানা নেই ! পথে জল খেতে দু-মূঠো খই ছিল, তা তো ঘোড়া-ভূতের সঙ্গে কোথায় উড়ে গেছে । শেষে বীর-বাতাসে আমিও উড়ে যাব নাকি? শীতেও কাঁপছি, ভয়েও কাঁপছি । পালকি ধরে বীর-বাতাস একবার একবার ঝাঁকানি দিচ্ছে আর হাঁক দিচ্ছি- ‘সামাল, সামাল।’ ভয়ে জগবন্ধুর নাম ভুলে গেছি পালকিখাণা ছাতার মতো বেহারাদের কাঁধ খেকে উড়ে আমাকে শুদ্ধু নিয়ে গড়াতে গড়াতে চলেছে । পিছনে ‘ধর! ধর!’ করে পালকি –বেহারাগুলো ছুটে আসছে ।
একটা বুড়ো মনসা গাছ, মাথায় তার হলদে চুল, বড় বড় কাঁটার বঁড়শি ফেলে বালির উপর মাছ ধরছিল। মনসা বুড়োর ছিপে মাছ তো পড়ছিল কত ! কেবল রাজ্যের খড়কুটো আর পাখির পালক এসে বুড়োর বঁড়শি তে আটকা পড়ছিল। এমন সময়ে আমার চাদরখানা গেলো বঁড়শিতে গেঁথে। আর যাব কোথা ? পালকি সুদ্ধ বালির উপর উলটে পড়েছি। বেহারা গুলো একবার আমাকে ছাড়াবার জন্য পালকির ডাণ্ডা ধরে আমার চাদর টা ধরে টানাটানি করলে, কিন্তু বাতাসের চোটে কোথায় উড়ে গেল আমার সেই উড়ে বেহারা ছ-টা, তাদের টিকিও দেখা গেল না।
মনসাবুড়োর হাসি দেখে কে! ভাবলে, মস্ত মাছ পেয়েছি । কিন্তু আমার হাতে ভূতপতরী লাঠি আছে তা ভো বুড়ো জানে না। লাঠি দিরে ষেমন বুড়োর গায়ে খোঁচা দেওয়া অমনি ভয়ে বুড়োর রক্ত দুধ হয়ে গেছে-সে তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে দিয়েছে । পালকি টা ঠেলে তুলে বিছানা-পত্তর পোঁটলা-পুঁটলি যা যেখানে পড়েছিল গুছিয়ে নিয়ে চুপটি করে বসে আছি- কখন বেহারা গুলো ফিরে আসে। মনসা বুড়োর গা বেয়ে দরদর করে সাদা দুধের মতো রক্ত পড়ছে। সে কোনো কথা বলছে না,আমিও সাদা রক্ত দেখে অবাক হয়ে বসে আছি ।
বুড়ো খুব রেগেছে; তার গায়ের সব রোঁয়া গুলো কাঁটার মতো সোজা হয়ে উঠেছে। অনেক্ষন গোঁ হয়ে বসে থাকার পর মনসা বুড়ো আমার দিকে চেয়ে বলছে, ‘দেখছ কি? বড় আমোদ হচ্ছে,না? বুড়ো মানুষের গায়ে খোঁচা দিয়ে রক্তপাত করে আবার বসে বসে তামাশা দেখছ, লজ্জা নেই! যাও না ছাড়া পেয়েছ তো নিজের কাজে যাও না!’
আমি বললুম, ‘যেতে পারলে তো! পালকি-বেহারা নেই যে! তারা আসুক তবে যাব’ ।, শুনে বুড়ো হোহো করে হেসে বললে, ‘কেন পা নেই নাকি হেঁটে যেতে পারো না? নবাব হয়েছ?’
আমার ভারি রাগ হলো বুড়োর র্বড়শির আঁচড়ে দুই পা ছিড়ে তখনো আমার ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে । আমি রেগে বললাম, পা দুটো কি আর রেখেছ! আঁচড়ের চোটে দফা শেষ করেছ যে!
‘লেগেছে নাকি’? বলে বুড়ো খানিক চুপ করে বললে, ‘একটু দই দাও, সেরে যাবে’।, আমি বললুম, -‘এই মাঠের মধ্যে দই তামাশা করছ নাকি?’, ‘আচ্ছা তবে খানিক তেঁতুল- বাটা হলেও চলতে পারে’। আমার হাসি পেল । নিশ্চয় বুড়ো ঘুমের ঘোরে স্বপন দেখছে । ‘বলি ও দাদা! এখানে তুমি ছাড় তো গাছ দেখছি নে, আরেকবার লাঠির খোঁচা দিয়ে তোমার গা খেকে দুধ বার করে নিয়ে দই পাতব নাকি’?- বলেই ভূতপতরী লাঠিটা যেমন একটু বাগিয়ে ধরেছি, অমনি বুড়ো বলছে, ‘রও রও করো কী দাদা। বুড়োমানুষ কখন কী বলি, রাগ কোরো না । আমরা মনসাদেবীর বরে চিরকাল নানারকম স্বপন দেখি । এইখানটিতে কতকাল যে বসে আছি তার ঠিক নেই । ছিপ নিয়ে মাছ ধরছিলুম জলের ধারে-আজ সে কত কালের কথা;সে নদি শুকিয়ে জল সরে চড়া পড়ে গেছে, কিন্তু এখনো ঝোঁক কাটেনি; মনে হচ্চে নদীর ধারেই বসে মাছ ধরছি! আমার বেশ মনে পড়ছে এইখানেই একঘর গয়লা খাকত আর ঠিক তাদের ঘরের কোণে একটা মস্ত তেঁতুলগাছ ছিল, এখন তবে সেণ্ডলো গেছে?’ বলেই বুড়ো ঝিমিয়ে পড়ে দেখে আমি তাকে জাগিয়ে দিয়ে বললুম, ‘আচ্ছা দাদা ওই যে ঘোড়াভূত আর ঝি ঝি পোকা দেখে এলুম, ওদের কথা তুমি কিছু জানো কি?
জানি বইকি! ওরা তো সেদিলের ছেলে, বলেই বুড়ো গল্প শুরু করলেঃ
‘দেখো, এই পৃথিবী তখন সবে তৈরি হয়েছে আমাদের মতো দু-চারটি গাছ ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই;-নদী নেই, পাহাড় নেই, এমন কি বাতাসে শব্দটি পর্যন্ত নেই; কেবল বালি ধূধূ করছে- ঠিক এই জায়গাটির মতো। আমার তখন সবেমাত্র কচি-কচি দুটি কাঁটা বেরিয়েছে-ছোটো ছেলের কচিকচি দুটি দাঁতের মতো। সেই সময় তারা গান বড়ো ভালোবাসে, তাবা দেখতে অনেকটা মানুষের মতো, কিন্তু ফড়িংগুলোর মতো তাদের ডানা আছে, পাখিগুলোর মতো পা, ঝাঁক ধেঁধে তারা আমাদের কাছে উড়ে এসে বসল আর গান গাইতে আরম্ভ করলে । আকাশবাতাস তাদের গানের সুরে যেন বেজে উঠলা সে যে কী চমৎকার তা তোমাকে আর কী বলব! আমরা তার আগে শব্দ শুনিনি, গানও শুনিনি-আনন্দে যেন শিউরে উঠলুম । বালি ঠেলে যত গাছ, যত ঘাস মাথা তুলে কান পেতে সেই গান শুনতে বেরিয়ে এল, পৃথিবীর ভিতর থেকে পাহাড়ণ্ডলো গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে এল, পাহাড়ের ভিত; থেকে নদীগুলো ছুটে ছুটে বেরিয়ে এল । গান শুনতে-শুনভে দেখতে-দেখতে আমরা বড়ো হয়ে উঠলুম । কিন্তু যারা গান গাইতে এল, কী খেয়ে তারা বাঁচে? পৃথিবীতে ভো তখন ফুলও ছিল না, ফলও ছিল না; ছিল কেবল আমাদের মতো বড়ো-বড়ো গাছ; কাঁটা আর লতা আর পাতা নদীতে মাছ ও ছিল না, আকাশে পাখিও ছিল না যে তারা ধরে খায় । তবু তারা অনেকদিন বেঁচে ছিল কেবল গান গেয়ে । একদিন হঠাৎ শুনি গান বন্ধ হয়ে গেছে-তারা সবাই মরে গেছে শুকনো পাতার মতো। তাদের সোনার ডানা বাতাসে উড়ে এসে আমাদের গায়ে বিঁধতে লাগল, কিন্তু তাদের গানের সুর আর শোনা গেল না । তারপর পৃথিবীতে অনেকদিন আর কোনো সাড়াশব্দ নেই; কেবল দেখছি, একদল কারা জানি না, দেখতে অনেকটা মানুষ আর ঘোড়ার মতো, এদিকে-ওদিকে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদেরই খুঁজে-খুঁজে যারা গান গাইতে এসেছিল । ক্রমে দেখি তারাও মরে গেছে ।পৃথিবীতে আর তখন কিছু চলে বেড়াচেছ না, গান গাইছে না-কেবল গাছের দল আমরা চুপ করে বসে আছি । জামাদের বয়স ক্রমে বাড়ছে আর আমরা বুড়ো হচ্ছি । তখন জলে মাছ দু-একটি দেখা দিয়েছে; আমি কাঁটা আর বঁড়শি ফেলে এক রাত্তিরে মাছ - ধরছি এমন সময়’-
বলেই মনসাবুড়ো ঝিমিয়ে পড়ল! আমি যত বলি, ‘এমন সময় কী হল দাদা? আবার বুঝি সেই ফড়িংদের মতো মানুষণ্ডলো ঝিঁঝিঁপোকা হয়ে ফিরে এসে গান গাইছে দেখলে? দেখলে বুঝি সেই মানূষের মভো ঘোড়াগুলো ভুত হয়ে অন্ধকার থেকে মুখ বাড়িয়ে তাদের গান শুনতে এল?’, বুড়োর আর কথা নেই; কেবল একবার হু বলেই চুপ করলে ।
আমি ভাবছি দি আরএক ঘা লাঠি বুড়োর মাথায় বসিয়ে, এমন সময় দেখি দূর থেকে একটা আলো আসছে-যেন কে লন্ঠনহাতে আমার দিকে চলে আসছে । একবার ভাবছি বুঝি বেহারা কজন আলো নিয়ে আমাকে নিতে এল । একবার ভাবছি, কী জানি মাঠের মাঝে আলেয়া দেখা দেয়, তাও তো হভে পারে । কিন্তু দেখলুম আলোটা এসে পালকির খানিক দূরে থামল; আর চারটে জোয়ান উড়ে আমার পালকিটা কাঁধে নিলে । উড়েদের একেই একটু ভুতূড়ে চেহারা, কাজেই ঠিক আন্দাজ করতে পারলুম না যে তারা ভুত না মানুষ । একবার তাদের পায়ের দিকে চেয়ে দেখলুম, ভূতের মতো তাদের পায়ের গোড়ালি উলটো কিনা। কিন্তু অন্ধকারে কিছু ঠিক করতে পারা গেল না। মনসাবুড়োকে ডেকে বললুম, -দাদা, তবে যাচ্ছি-
দাদা আমার তখন ঝিমোচ্ছেন; চমকে উঠে বললেন, ‘যাবে নাকি? গল্প টা তো শেয হল না?’ - পালকি তখন চলেছে মুখ বাড়িয়ে বললুম, ‘দাদা, একরকম গল্পটা শেযই করেছিলে, কেবল তোমার মাথার চুল হলদে আর তোমার রক্ত শাদা -কেন, সেইটে বলতে বাকি রয়ে গেল’ ।, -
‘মাস্টারমশায়ের কাছে জেনে নিও-, বলেই দাদা আবার ঝিমিয়ে পড়লেন । হুহু করে পালকি আবার মাঠের দিকে বেরিয়ে গেল।
একটু ভয়-ভয় করছে; বেহারাগুলো মানুষ না ভুত বুঝতে পাচ্ছিনে । পাল্কির দরজা বন্ধ করে চুপ করে বসে আছি, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল- মানুষ উড়ে পালকি কাঁধে হুম্মাহুম্মা ডাক ছাড়ে, এরা তো হাঁক দিচ্ছে না। পড়েছি ভুতের হাতেই । পড়েছি, আর কোনো ভুল নেই । আচ্ছা দেখাযাক,ভুতপতরী লাঠি তো আছে । তেমন-তেমনদেখি তো দুহাতে লাঠি চালাব ।
ভুতপতরী লাঠির কথা মনে করেছি কি অমনি ধপাস করে পালকি টা তারা মাটিতে ফেলেছে, কোমরটা আবার খচ করে উঠেছে । ‘তবে রে ভূত-উড়ে আমাকেএইমাঠে একলা নামিয়ে দিয়ে পালাবে ভেবেছ ! তোল পালকি,ওঠা সোয়ারী’ বলেই লাঠি নিয়ে যেমন তেড়েযাব,কোমর টা আবার বেঁকে্ পড়লো।ভূতণ্ডলো দেখেই খলখলকরে হেসে অন্ধকারে মাঠে কোথায় মিলিয়ে গেল। মহাবিপদ ।এই রাত্তিরে-মাঠের মাঝে ভূতের ভয়,ঝমের ভয়,সাপের ভয়,তার ওপর কোমর ভেঙে গেল !লাঠিধরে যে গুড়িগুড়ি পালাব তারও জো নেই । মনসাকাঁটায় পা ছিঁড়ে গেছে।‘দূর কর আর ভাবতে পারিনে, যা হয় হবে!’ বলে পালকির ভেতরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম খিদেও পেয়েছে তেষ্টাও পেয়েছে ।
একলা থাকতে-থাকতে ক্রমে ঘুম এসেছে । একটু চোখ বুজেছি কি না বুজেছি অমনি খস করে একটা শব্দ হল । চোখ চেয়ে দেখি, বালির ওপরে গোটাকতক তালগাছ উঠেছে তাদের মাথা যেন আকাশে ঠেকেছে,- আর একটা আলো ঘুরে ঘুরে সেই তালগাছে ঠেকছে, আবার সড়সড় করে নেমে আসছে।আমি আর না-রাম না-গঙ্গা। কাঠ হয়ে পড়ে আছি কেবল দুটি চোখ চাদরের একটি কোণ দিয়ে -বের করে । --
দেখছি আলোটা ক্রমে এ-গাছ সে-গাছ করে ঘুরে বেড়াতে লাগল । তারপর আস্তে- আস্তে মাটিভে নেমে এল । সেই সময় দেখি পুর্ণিমার চাঁদের মতো প্রকাণ্ড একটা কাচের গোলা মাঠের ওপর দিয়ে বোঁবোঁ করে-গড়িয়ে আসছে-যেন একটা মস্ত আলোর ফুটবল । তালগাছের তলায় যে আলোটা টিপটিপ করছিল সেটা জোনাকি পোকার মতো উড়ে গিয়ে সেই গোলাটার ওপর বসল । বসেই গোলাটাকে আমার দিকে গড়িয়ে আনতে লাগল ।
দেখছি আলোটা ক্রমে এ-গাছ সে-গাছ করে ঘুরে বেড়াতে লাগলো । পালাবার জো নেই ।।একেবারে গড়িয়ে চলেছি-বনবন করে লাঠিমের মতো ঘুরতে-ঘুরতে । সে কী ঘুরুনি ! মনে হল,আকাশ ঘুরছে তারা ঘুরছে পৃথিবী ঘুরছে,পেটের ভেতর আমার - মাসির মোয়াগুলো ও যেন ঘুরতে লেগেছে । কখনো মাঠের ওপর দিয়ে, কখনো গাছের মাথা ডিঙিয়ে, গোলাটি সাদা খরগোশের মতো লাফিয়ে, গড়িয়ে, কখনো জোরে, কখনো আস্তে আমাকে নিয়ে ছুটে চলেছে ।
ভয়ে দুই হাতে চোখ ঢেকে চলেছি । ক্যা-ক চরকা-কাটার শব্দ শুনে চোখ খুলে দেখি এক বুড়ি সুতো কাটছে আর একটা খরগোশ তার চরকা ঘুরোচ্চে । বুড়িকে দেখেই চিনেছি,সেই আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি, যে চাঁদের ভেতরে বসে থাকে । আর ওই তার চরকা, ওই খরগোশ! আঃ বাঁচা গেল! এটা তবে গোলআভূত নয়! ইনিই আমাদের চাঁদমামা, আর বুড়ি তো আমাদের মামি! আর এ খরগোশ তো আমাদের সেই খাঁচার খরগোশটি, বিলিতি ইঁদুরের আর গিনিপিগুলির বড়োমামা!
‘বলি মামি, এমন করে কি ভয় দেখাতে হয়’। বলেই আমি খরগোশটাকে খপ করে কোলে তুলে নিয়েছি ।
‘ওরে ছাড়, ছাড়! আমার চরকা-কাটা বন্ধ করিস নে,দেখছিস নে এই চরকার জোরেই চাঁদমামার সংসার চলছে’ ।
সত্যিই দেখি চরকা বন্ধ হতেই চাঁদমামা গড়াতে-গড়াতে থেমে গিয়ে লাঠিমের মতো মাটির ওপর কাত হয়ে পড়েছ্ন । আমি থরগোশটি মামির হাতে দিয়ে বললুম, ‘কই মামি, চালাও দেখি মামাকে’ ।,
খরগোশ চরকায় যেমন এক পাল দিয়েছে অমনি চাঁদামামা গাঝাড়া দিয়ে ঘুরতে লেগেছেন । বুড়ি ডাকছে, ‘ দে পাক, দে পাক’ খরগোশ ততই পাক দিচ্ছে আর চাঁদমামাও তত ঘুরুপাক দিয়ে ডিগবাজি খেরে রবারের বলের মভো নাচতে-নাচতে চলেছেন। যত বলি, ‘মামি আর পাক দিও না,মামাকে আমার অত ঘুরিও না, মামা হাঁপিয়ে দম আটকে কোনদিন মারা পড়বেন যে ! একটু রয়ে-বসে চালাও শেষে বুড়োবয়েসে মামার কি মাথা ঘুরনির রোগ ধরিয়ে দেবে? জানি কি যে মামি আমার কালা। আমার একটি কথাও বুড়ির কানে যায়নি । সে কেবল বলছে- ‘দে পাক, দে পাক !’ আমি যত ইশারা করে বলি,‘আস্তে, আস্তে--বুড়ি ভাবে জোরে চালাতে বলছি, ততই ডাকে, ‘দে পাক, দে পাক’!
মামা রেলের গাড়ির মভো হুহু করে ছুটে চলেছেন। ‘ওরে থামা, থামা! মাথা ঘুরে গেল, আর যে পারিনে’ -বলেই লাঠি তুলেছি খরগোশ টা মারতে । যেমন লাঠি তোলা অমনি খরগোশটা খ্যাঁক করে তেড়ে এসেছে, ক্যাঁচ করে চরকাটা বন্ধ হয়ে গেছে আর পটাং করে মামির হাতের সুতো কেটে গেছে ।যেমন সুতো কাঁটা আর ঝপাং করে চাঁদ মামা গিয়ে একটি নদীর জলে পড়েছেন, পড়েই ফেটে চৌচির! –
‘কী করলে গো মামি !’, বলেই চমকে দেখি নদীর ওপারে পালকিসুদ্ধ আমি ঠিকরে পড়েছি । কোথায় বুড়ি, কোথায় চরকা, কোথায় বা সে খরগোশ! নদীর জলে দেখি একরাশ কাঁচের টুকরোর মতো চাঁদমামার ভাঙা আলো! খানিক চকচক করেই নিভে গেল । আকাশের দিকে চেয়ে দেখি চাঁদমামার আধখানা কোথায় উড়ে গেছে ।
ভাগ্যি নদীতে তেমন জল ছিল না, নইলে সবাই আজ ডুবেছিলাম আরকি !বড় তেষ্টা পেয়েছিল। নদী থেকে এক ঘটি জল খেয়ে ঠান্ডা হয়ে তবে বাঁচি!
নদীর ধারেই একটা গাঁ রয়েছে । দেখে সাহস হল; ভাবলুম-আজ রাত্তিরে ওই গাঁয়ে কারোর গোয়ালখঘরে শুয়ে থাকি; কাল সকালে এখান খেকেই ফিরে পালাব, পিসির বাড়ি যাওয়ায় আর কাজ নেই বাবা! এই মনে করে গাঁয়ের ভেতরে গিয়ে দেখি সেখানে জনমানব নেই । ডাক-হাঁক করে কারো সাড়াও পাইনে। যাইহোক, গাঁ ছেড়ে আর এক পা-ও নড়া নয় । চাদর মুড়ি দিয়ে একটি ঘরের দাওয়ায় শুয়ে পড়লাম। যেমন শোয়া, আর ঘুম- অকআতরে ঘুম ।
খানিক পরে জেগে দেখি, সেই মনসাতলার লন্ঠন-ভূতটা আর তার চার বন্দু আলো নিয়ে আমার মুখের কাছে বসে আছে।‘তবে রে!’, বলেই যেমন উঠতে যাব অমনি তারা বলে উঠেছে, ‘দেখো বাবু’, ফের যদি লাঠি দেখাও কি মারতে আস,তবে আবার আমরা তোমাকে ফেলে পালাব । আর যদি চুপ করে ভালোমানুষটি হয়ে পালকিটে বসে থাক, তবে ওই-কি বলে ও-কিতলা পর্যন্ত তোমাকে আমরা পৌঁছে দেব।, বুঝলুম ভূতওলো ভয়ে - রামনাম মুখে আনতে পারছে না, তাই পিসির বাড়ি যেতে যে রামচণ্ডী তলার র কথা-শুনেছি তাকে বলছে- কি-বলে-ও-কি তলা।
ভূতগুলো ভয় পেয়েছে দেখে সাহস হল; পালকিতে আবার উঠে বসলুম ।
এবারে আর ভয় করছে না-ভোর হবার এখনো দেরি আছে ।কিন্তু এরই মধ্যে ভুতগুলো যেন একটু ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে, মাঠে আর ঘন-ঘন আলেয়া দেখা দিচ্ছে না, পথের ধারে তালগাছ তো দেখাই দিচ্ছে না, কোথাও মানসাগাছের ছায়াটি পর্যন্ত আর দেখা যায় না।পূর্বদিক থেকে ভোরের বাতাস একটু-একটু আসছে;ভূত ণ্ডলো হাওয়া পেয়েই যেন জড়োসড়ো।আমি কিন্তু বেশ আরামে পালকিতে দরজা খুলে ঘুম দিতে দিতে-চলেছি ।
ভোর হয় দেখে ভূত-বেহারা চারটে ভয় পেয়েছে, কিন্তু রামচণ্ডীতলায় আমাকে পৌঁছে দিলেই তাদের ছুটি হয়ে যাবে এই ভেবে তাদের একটু আলহাদ ও হয়েছে । চার ভূত চার সুরে চিঁচিঁ,পিঁপিঁ , খিটখিট, টিকটিক করে গান গাইতে গাইতে চলেছে-ঠিক যেন কত দূর থেকে চিল ডাকছে আর কোলাব্যাঙ কটকট করছে । ঘুমের ঘোরে শুনছি যেন ‘কুহুকেকা’ র ঠিক সেই পালকির গানটা। কিন্তু কথাণ্ডলো সব উলটোপালটা আর সুরটাও বেখাপ্পা বেয়াড়া-বেজায় ভুতূড়ে । কেবল হাড় খটখট, দাঁত কিটমিট, গোঙানি আর কাতরানি ওনে যে গায়ে জ্বর এল! ঘুমিয়ে আছি কিন্তু তবু শুনছি:
চলে চলে
হুমকিতালে
পংখী গালে
মাসিপিসি
বাঘবেরালে ।
ভূতপেরেতে
চলেছে রেতে
হনহনিয়ে
ভূতপেরেতে ।
পালকি দোলে
উঠতি আলে
নালকি দোলে –
নাসতি খালে
আলো-আঁধারে
শেওড়াগাছ
কালোয় শাদায়
বেরাল নাচ
।
মরানদী
বালির ঘাট
মনসাতলায়
মাছের হাট ।
ভূতের জমি
ভূতের জমি
ভূতপেরেতের নাইকো কমি ।
উড়ছে কতক –
ভনভনিয়ে
চলছে কতক
হনহনিয়ে
হণহনিয়ে ।
চলছে কতক
গাছতলাতে
দুলছে কতক তালপাতাতে ।
দিনদুপুরে
বাদুড় ঘুমোয়
রাতদুপুরে
হুতোম ঘুমোয়।
ভোঁদড় ভাম
ব্যাঙ-ব্যাঙাচি
টিকটিকি আর
কানামাচি ।
গঙ্গাফড়িং
জোনাকপোকা
আরসোল্লা
ন্যাংটা খোকা।
ছুঁচো ইঁদুর
খ্যাকশেয়ালে।
শুকনো পাতা
গাছের ডাল!
সব ভূতুড়ে
সব ভূতুড়ে
ঘুরনি-হাওয়ায়
চলছে ঘুরে
জগৎ জুড়ে
ঘুরছে ধুলো
বাতাস দিয়ে দুলছে কুলো।
সব ভূতুড়ে
সব ভূতুড়ে
আলো-আলেয়া
জ্বলছে দূরে
সব ভূতুড়ে
ভূতের খেলা
খেজুরতলায়
ইটের ঢেলা--
গানটা শুনেছি একবার-ছুঁচো, ইঁদুর, কানামাছি, ভোঁদড় প্যাঁচা, টিকটিকি, র্খ্যাঁকশেয়াল ।, গানটা শুনছি দু-বার- ‘গঙ্গাফড়িং, জোনাকপোকা, আরসোলা, বাদুড়’।- গানটা ওনছি তিনবার—‘আলো-আলেয়া, ঘূর্ণি-হাওয়া, খেজুরগাছ, ইটের ঢেলা’ ।, একবার, দু-বার, তিনবার, বারবার তিনবার ইটের ঢেলা পড়েছে কি আর পালকিসুদ্ধ আমাকে ভূতগুলো ঝপাং করে মাটিতে ফেলে খেজুরগাছের তলায় একটা মরা গরু পড়েছিল সেটাকে নিয়ে লুফতে-লুফতে দৌড় মেরেছে! ওদিকে অমনি রামচণ্ডী থেকে রাত তিনটের আরতি বেজেছে-টংটং, টংআ-টং, টংটং-আ-টং ।
- এই খেজুড়তলা পর্যন্ত ভূত আসভে পারে,তার ওদিকে রামচণ্ডীতলা , সেখানে রামসীতা বসে আছেন , হনুমান, জ্বাম্ববান পাহারা দিচ্ছে, ভূতের আর সেখানে এগোবার জো নেই । ভূতপতরীর লাঠিরও জোর সেখানে খাটবে না। কাজেই পোঁটলাপুঁটলী লাঠিছাতা সমস্ত পালকিতে রেখে, কোমর ধরে, খোঁড়াতে- খোঁড়াতে বালি ভেঙে রামচণ্ডীতলায় রামসীতা দেখতে তিনটে রাতে অন্ধকার দিয়ে একলা চলেছি । সঙ্গে একঢি আলো নেই, হাতে লাঠিটি পর্যন্ত নেবার জো নেই । কী জানি দেখে যদি হনুমান মন্দিরে ঢুকতে না দেয়! তখন যাই কোথা?
রাম-রাম, বলতে বলতে বালি ভেঙে চলেছি । বালি তো বালি একেবারে বালির পাহাড় । এক একবার পিছন দেখছি ভূতগুলো আসছে কিনা। যদিও এখানকার বালিতে পা দিলেই তাদের মাথার খুলি ফটাস করে ফেটে যাবে তবুও খেজুরগাছটার ওপর থেকে তারা ভয় দেখাতে ছাড়ে না; টুপ করে হয়তো একটা খেজুর আঁটি এসে গায়ে পড়ল, হয়তো দেখছি খেজুরতলায় যেন একটি কচি ছেলে ওমা-ওমা করে কাঁদছে, শুনে ইচ্ছে হয় দৌড়ে গিয়ে দেখি-বুঝি কাদের ছেলে পথ হারিয়ে কেঁদে বেড়াচ্ছে; হয়তো আমার নাম ধরেই পথে কে একবার ডাকলে, গলাটা যেন চেনা-চেনা, ফিরে দেখি কেউ কোথাও নেই! অন্ধকারে হয়তো দেখলুম মাঠের মাঝে একটা জায়গায় খানিকটা জ্বলন্ত বালি তুবড়ি- বাজির মতো ফস করে জ্বলে উঠল, ইচ্ছে হয় গিয়ে দেখি কিন্তু গেলেই বিপদ-একেবারে ভূতে ধরে জরিমাণা করে তবে ছাড়বে, নয়তো মট করে ঘাড় মটকে দেবে ।
আমি আর এদিক-ওদিক কোনোদিক না দেখে ‘সীতারামসীতারাম’ বলতে-বলতে চলেছি । ওই দেখা যাচ্ছে বালির পাহাড়ের ওপরে পঞ্চবটীর বন, বনের মাথায় রামসীতা মন্দিরের চূড়ো। মনে হচ্ছে এই কাছেই আর একটূ গেলেই পৌঁছে যাব, কিন্তু যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই যেন সব দুরে সরে যাচ্ছে-আমার কাছ থেকে দৌড়ে পালাচেছ । আমিও দৌড়েছি খোঁড়া পা নিয়ে, দৌড়েছি হাঁপাতে- হাঁপাতে, দৌড়েছি উঠি-তো পড়ি বালির ওপর দিয়ে ।
এইবার শুনতে পাচ্ছি মন্দিরের খল-করতাল বাজছে; দেখতে পাচ্ছি জাম্বুবানের দল আগুন জ্বালিয়ে গাছতলায় বসে আছে; হনুমানের ল্যাজ বটের ঝুরির মভো পাতার ফাঁক দিয়ে ঝুলে পড়েছে । আর ভয় কী! বলে যেমন রামচণ্ডীতলায় ছুটে যাব আর নাকটা গেল ঠুকে-একি, নাক ঠুকল কিসে? এই তো সামনে সোজা রাস্তা-গাছের তলা দিয়ে মন্দিরের উঠেছে; তবে নাক ঠোকে কিসে?
নাকে হাত দিয়ে দেখি নাকটা বিলিতি-বেগুনের মতো ফুলে উঠেছে ।সামনে হাতড়ে দেখি প্রকাণ্ড কাঁচ, তার ভেতর থেকে ফ্রেমেবাঁধা ছবির মতো রামচণ্ডীর মন্দির, পঞ্চবঢী বন, হনুমানের ল্যাজ, সবই দেখা যাচ্ছে; কেবল তার ভেতরে যাওয়া যাচেছ না । ফড়িংগুলো যেমন লন্ঠনের চারদিকে মাথা ঠুকে মরে,আমিও তেমনি ঘুরে রেড়াচ্ছি চারদিকে কেবল নাক ঠুকে-ঠুকে । নাকটা বেগুনের মতো গোল হয়ে ফুলে উঠেছিল । কাঁচে লেগে-লেগে ক্রমে চ্যাপটা হয়ে গেল, তবু ভেতরে ঢোকবার রাস্তা কিন্তু পেলুম না।
র্হাঁপিয়ে গেছি, বালির ওপরে বসে পড়েছি, হনুমানের গোটাকতক ছানা আমাকে দেখে দাঁত রের করে হাসছে । ভারি রাগ হল, রাগে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল । ‘জয় রাম’! বলে দিয়েছি এক লাফ সেই কাঁচের ওপরে । লাফ দিয়েই ভাবলুম-গেছি হাত-পা কেটে, সব গায়ে কাঁচ ফুটে রক্তারক্তি হল দেখছি । কিন্তু আশ্চর্য! রামনামের গুনে জলের মতো কাঁচ কেটে একেবারে ভেতরে পড়েছি-হনুমানের জাম্বুবানের দলের মাঝখানে ।আর অমনি চারদিকে রব উঠেছে-‘জয় রাম! জয়-জয় রাম,!সীতারাম!’- সমুদ্দুরের ডাক শুনছি-‘জয়-জয় রাম’,বাতাসে শব্দ শুনছি, ‘জয় রাম! চারদিকে জয় রাম সীতারাম!’
কেউ আমাকে একটি কথাও বললে না, আমার দিকে ফিরেও চাইলে না! আমি রামসীতা
দর্শন করে একটা -কাঁটাবন পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে পড়েছি । সেখানে দেখি, ছটা বেহারা আমার পালকিটি নিয়ে বসে আছে-দেখতে কালো কিচকিন্দে ।
‘কে হে বাপু তোমরা পাল্কিটি নিয়ে’?- -
‘বাবুজি, আমরা তোমার পিসর চাকর-কিসকিন্দে, কাসুন্দে, বাসুন্দে, ঝাপুন্দে, মালুন্দে, হারুন্দে!’
- আচ্ছা বাপু, চলো তো পিসির বাড়ি’,বলেই আমি পালকি চেপে বসেছি ।
এবার চলেছি আরামে, কোনো-ভয় নেই; পা ছড়িয়ে বসে, পালকির দুই দরজা খুলে, মনের আনন্দে চারদিক দ্ঘেতে-দেখতে চলেছি । কেমন তালে-তালে এবার পালকি চলেছে- কালকাসুন্দি, ঝালকাসুন্দি! ঝাঁকুনি নেই পালকি চলেছে-আমকাসুন্দি,জামকাসুন্দি যেন জলের ওপর দুলতে দুলতে-নেচে চলেছে ।--পিসির পালকি চলেছে-ধর কাসুন্দে, চল বাসুন্দে, বড়া ঝালুন্দে,খোঁড়া মালুন্দে পালকির এক দরজা ধরে চলেছে হারুন্দে, আর এক দরজা ধরে চলেছে উড়েদের সর্দার-কালো কিচকিন্দে ।
হারুন্দের মাথায় কালো চুলের উঁচু ঝুঁটি আর কিচকিন্দের মাথায় পাকা চুলের শনের নুটি । হারুন্দে ফরসা, কিচকিন্দে কালো মিশ-যেন বাংলা কালি! হারুন্দের চুল যেন বালির ওপরে মনসাগাছ-খাড়াখাড়া, খোঁচা-খোঁচা, আর কিচকিন্দের চুল যেন সমুদ্দুরের শাদা ঢেউ-হওয়ায় লটপট করছে । কিচকিন্দের-মাঠটাও দেখছি খানিক শাদা, খানিক কালো, খানিক আলো, খানিক-অন্ধকার-একদিকে ধুপধাপ-করছে শুকনো বালি আর-দিকে টলমল করছে কালো জল-নুনে গোলা ।মাঠ দিয়ে-চলছি, না, শাদা-কালো মস্ত এক-খানা শতরঞ্জির ওপর দিয়েই চলেছি ।
আমার বাঁদিকে কেবল বালি-শাদা ধপধপ করছে বালি; আর আমার ডানদিকে রয়েছে কালি-গোলা সমুদ্দর-কালো কাজলের মতো কালো, র্বাঁয়ে চলেছে হারুন্দে-ডাঙার খবর দিতে-দিতে, ডাইনে চলেছে কিচকিন্দে-জলের আদি-অন্ত কইতে-কইতে আমি চলেছি পালকিতে শুয়ে মনে-মনে দুজনের দুর্টো- গল্প শাদা একটা শেলেটের উপর কালো পেনসিল দিয়ে লিখে নিতে নিতে । কিচকিন্দের গল্পটা জলের কিনা তাই সেটা লিখে নিতে-নিতেই ধুয়ে মুছে গেছে, একটুও আর পড়া খাচ্ছে না! কিন্তু হারুন্দের গল্পটা বালির আঁচড়ের মতো একেবারে শেলেটে কেটে বসে গেছে-ধুলেও যায় না, মুছলেও যায় না-বেশ পষ্ট-পষ্ট পড়া যাচ্ছে ।