সাইক্লোন
এটা জানি তখন— দিন আছে, রাত আছে, আর তারা দু’জনে একসঙ্গে আসে না আমাদের তিনতলায়। এও জেনেছি, বাতাস একজন ঠাণ্ডা, একজন গরম ; কিন্তু তাদের দু’জনের কারো একটা করে ছাতা নেই গোলপাতার। রোদে পোড়ে, বিষ্টিতে ভেজে ওদের গা। এও জেনে নিয়েছি যে একটা একটা সময় অনেকজন রোদ বাইরে থেকে ঘরে এসেই জানলাগুলোর কাছে একটা একটা মাদুর বিছিয়ে রোদ পোহাতে বসে যায়। কোনো দিন বা রোদ একজন হঠাৎ আসে খোলা জানলা দিয়ে সক্কালেই। তক্তপোশের কোণে বসে থাকে সে, মানুষ বিছানা ছেড়ে গেলেই তাড়াতাড়ি রোদটা গড়িয়ে নেয় বালিশে তোশকে চাদরে আমার খাটেই। তারপর চট্ করে রোদ ধরা পরার ভয়ে বিছানা ছেড়ে দেয়াল বেয়ে উঠে পড়ে কড়িকাঠে। ছাতের কাছেই আল্সের কোণে দুটো নীল পায়রা থাকে জানি, আলো হলেই তারা দু’জনে পড়া মুখস্থ করে—পাক্পাখম্...মেজদি...সেজদি...
কড়ে আঙ্গুল বলে খাবো ; আংটির আঙ্গুল বলে কোথায় পাবো ; মাঝের আঙ্গুল বলে ধার করোগে ; আর একটা আঙ্গুল তার নাম যে তর্জনী, তা জানিনে, কিন্তু সে বলে জানি, শুধবো কিসে ; বুড়ো আঙ্গুল বলে লবডঙ্কা। কি সেটা, দেখতে লঙ্কার মতো আর খেতে ঝাল না মিষ্টি তা জানিনে, কিন্তু খুব চেঁচিয়ে কথাটা বলে মজা পাই। বন্ধ খড়খড়ির একটু ফাঁক পেয়ে জানি রাত আসে এক-একদিন, শাদা প্রজাপতির মতো এক ফোটা আলো, মাথার বালিশে ডানা বন্ধ করে ঘুমোয় সে, হাত চাপা দিলে হাতের তলা থেকে হাতের উপরে-উপরে চলাচলি করে। এমন চটুল এমন ছোটো যে, বালিশ চাপা দিলেও ধরে রাখা যায়না ; বালিশের উপরে চট করে উঠে আসে। চিৎ হয়ে তার উপর শুয়ে পড়ি তো দেখি পিঠ ফুঁড়ে এসে বসেছে আমারই নাকের ডগায়। উপুড় হয়ে চেপে পড়লেই মুশকিল বাধে তার—ধরা পড়ে যায় একেবারে, ঐটা নিশ্চয় করে জেনেছি তখন। পড়তে শেখার আগেই, দেখতে শুনতে চলতে বলতে শেখারও আগে, ছেলেমেয়েদের গ্রহ-নক্ষত্র, জল-স্থল, জন্তু-জানোয়ার। আকাশ-বাতাস, গাছপালা, দেশবিদেশের কথা বেস করে জানিয়ে দেবার জন্যে বইগুলো তখন ছিলোই না। বই লিখিয়েও ছিলো না হয়তো, কাজেই খানিক জানি তখন নিজে নিজে, দেখে কতক, ঠেকে কতক, শুনে কতক, ভেবে ভেবেও বা কতক। আমি দিচ্ছি পরীক্ষা তখন আমারই কাছে, কাজেই পাশই হয়ে চলেছি জানা-শোনার পরীক্ষাতে। আমাদের শান্তিনিকেতনের জগদানন্দবাবুর ‘পোকা-মাকড়’ বই কোথায় তখন, কিন্তু মাকড়সার জালশুদ্ধ মাকড়সাকে আমি দেখে নিয়েছি। আর জেনে ফেলেছি যে, মাকড় মরে গেলে বোকড় হয়ে খাটের তলায় কম্বল বোনে রাতের বেলা। ‘মাছের-কথা’ পড়া দূরে থাক, মাছ খাবারই উপায় নেই তখন, কাঁটা বেছে দিলেও। কিন্তু এটা জেনেছি যে, ইলিশ মাছের পেটে এক থলিতে থাকে একটু সতীর কয়লা, অন্য থলি ক’টাতে থাকে ঘোড়ার ক্ষুর, বামুনের পৈতে, টিক্টিকির লেজ এমনি নানা সব খারাপ জিনিস যা মাছ-কোটার বেলায় বার করে না ফেললে খাবার পরে মাছটা মুশকিল বাধায় পেটে গিয়ে। জেনেছি সব রুই মাছ গুলোই পেটের ভিতরে একটা করে ভুঁই-পটকা লুকিয়ে রাখে। জলে থাকে বলে পটকাগুলো ফাটাতে পারে না ; ডাঙ্গায় এলেই তারা মরে যায় বলে পটকাও ফাটাতে পারে না নিজেরা। সে-জন্যে মাছের দুঃখ থাকে, আর এইজন্যেই মাছ-কোটার বেলায় আগে-ভাগে পটকাটা মাটিতে ফাটিয়ে দিতে হয়। না হলে মাছ রাগ করে ভাজা হতে চায় না, দুঃখে পোড়ে, নয়তো গলায় গিয়ে কাঁটা বেঁধায় হঠাৎ।
কালোজামের বিচি পেটে গেলেই সর্বনাশ, মাথা ফুঁড়ে মস্ত জামগাছ বেরিয়ে পড়ে। আর কাগ এসে চোখ দুটোকে কালোজাম ভেবে ঠুকরে খায়। জোনাকি—সে আলো খুঁজতে পিদুমের কাছে এলো তো জানি লক্ষণ খারাপ, তখন ‘তারা’ ‘তারা’ না স্মরণ করলে ঘরের দোষ কিছুতেই কাটে না।
বটতলার ছাপা ‘হাজার জিনিস’ বইখানার চেয়েও মজার একখানা বই—তারই পাণ্ডুলিপির মাল-মশলা সংগ্রহ করে চলেছে বয়েসটা আমার তখন। বড়ো হয়ে ছাপাবার মতলবে কিংবা সর্ট-হ্যান্ড রিপোর্টের মতো ছাঁট অক্ষরে সাটে টুকে নিচ্ছে সব কথা—এ মনেই হয় না। আজও যেমন বোধকরি—যা কিছু সবই—এরা আমাকে আপনা হতে এসে দেখা দিচ্ছে—ধরা দিচ্ছে এসে এরা। খেলতে আসার মতো এসেছে, নিজে থেকে তাদের খুঁজতে যাচ্ছিনে—নিজের ইচ্ছামতো তারাই এসে চোখে পড়ছে আমার, যথাভিরুচি রূপ দেখিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে খেলুড়ির মতো খেলা শেষে। সে পঞ্চাশ বছর আগে তখনো তেমনি বোধ হতো। দেখছি না আমি, কিন্তু দেখা দিচ্ছে আমাকে সবাই ; আর এই করেই জেনে চলেছি তাদের নির্ভুল ভাবে। রোদ, বাতাস, ঘর, বাড়ি, ফুল, পাতা, পাখি এরা সবই তখন কি ভুল বোঝাতেই চললো অথবা স্বরূপটা লুকিয়ে মন-ভোলানো বেশে এসে সত্যি পরিচয় ধরে দিয়ে গেলো আমাকে, তা কে ঠিক করে বলে দেয়?
এ-বাড়িটা তখন আমায় জানিয়েছে—মাত্র তেতলা সে। তেতলার নিচে যে আর একটা তলা আছে, দোতলা বলে যাকে, এবং তারও নিচে একতলা বলে আর একটা তলও আছে—এ-কথা জানতেই দেয়নি বাড়িটা। কিন্তু সে জলে না হাওয়ায় ভাসছে এ মিছে কথাটাও তো বলেনি বাড়িটা। অসত্য রূপটাও তো দেখা যায়নি। আপনার খানিকটা রেখেছিলো বাড়ি আড়ালে, খানিকটা দেখতে দিয়েছিল, তাও এমন একটি চমৎকার দেখা এবং না-দেখার মধ্য দিয়ে যে তেমন করে সারা বাড়ির ছবি ধরে, কিম্বা ইঞ্জিনিয়ারের প্ল্যান ধরে, অথবা আজকের দিনে সারা বাড়িখানা ঘুরে ঘুরেও দেখা সম্ভব হয় না। আজকের দেথা এই বাড়ি সে একটা ম্বতন্ত্র বাড়ি বলে ঠেকে, যেটা সত্যিই আমাকে দেয় নি। কিন্তু সেদিনের সে একতলা দোতলা নেই এমন যে তিনতলা, সে এখনও তেমনিই রয়েছে আমার কাছে। নিজে থেকে জানাশোনা দেখা ও পরিচয় করে নেওয়া আমার ধাতে সয় না। কেউ এসে দেখা দিলে, জানান দিলে তো হল ভাব; কেউ কিছু দিয়ে গেল তো পেয়ে গেলাম। পড়ে পাওয়ার আদর বেশি আমার কাছে; কুড়িয়ে পাওয়ার নূড়ির মুল্য আছে আমার কাছে, কিন্তু খেটে পাওয়া পাঠার মুড়ির দিকে টান নেই আমার। হঠাৎ খাটুনি জুটে গেলে মজা পাই কিন্তু ‘হঠাৎ’ সত্যি ‘হঠাৎ’ হওয়া চাই, না-হলে নকল ‘হঠাৎ’ কোনাদিনই মজা দেয় না, দেয়ওনি আমাকে। আমি যদি সাহেব হতেম তো অবিবাহিতই থাকতে হত, কোর্টিশিপটা আমার দ্বারা হতই না। দাসীটা চলে গেল তার যেটূকু ধরে দেবার ছিলো দিয়ে হঠাৎ। এমনি হঠাৎ একদিন উত্তর-পুব কোণের ঘরটাও যা কিছু দেখবার ছিল দেখিয়ে যেন সরে গেল আমার কাছ থেকে।
মনে আছে এক অবস্থায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষা কিছুই নেই আমার কাছে। সেই সময়টাতে ছোটো ঘরে হঠাৎ একদিন সকালে জেগেই দেখলেম-লেপের মধ্যে থাকতে থাকতে কোন্ এক সময় শীতকাল গিয়ে গরম কাল এলা আজ সকালে আমার র্কপালটায় ঘাম দিয়েচে, আজই দাসীরা বিছানার তলায় লেপটিকে তাড়িয়ে দেবে, আজ রাতে খোলা জানলায় দেখা যাবে নীল আকাশ আর থেকে থেকে তারা, আর আমাকে একটা শাদা জামার উপরে আর- একটা সুতোর কাপড়ের ঠিক তেমনি জামা পরে নিতে হবে না, সক্কাল থেকে মোজা পায়ে দিয়েও কর্মভোগে ভুগতে হবে না জেনে ফেললাম হঠাৎ।
সেই ছেলেবেলা থেকে আজ পযন্ত না-জানা থেকে জানার সীমাতে পৌছনোর বেলা একটা কোনো নিদিট ধারা ধরে অঙ্কের যোগ বিয়োগ-ভাগফলটার মতো এসে গেল জগৎ- সংসারের যা-কিছু, তা হল না তো আমার বেলায়। কিম্বা ঘটা করে আগে থাকতে জানান দিয়ে ঘটল ঘটনা সমস্ত তাও নয়। হঠাৎ এসে বললে তারা বিস্ময়ের পর বিস্ময়ের জাগিয়ে 'আমি এসে গেছিা!' ঠিক যেমন ছবি এসে বলে আজও হঠাৎ— 'আমি এসে গেলেম, এঁকে নাও চটপট।', ষেমন লেখা বলে 'হয়ে গেছি তৈরি, চালিয়ে চলো কলম।' চম্কি দেবী বলে নিশ্চয় জানি কেউ আছেন আর কাজই জাঁর গোড়া থেকেই চমক ভাঙিয়ে দেওয়া। দেখার পুঁজি জানার সম্বল তিল তিল ফূটে ভরে তুলতে কত দেরি লাগত যদি চম্কি না থাকতেন সঙ্গে দাসীটা ছেড়ে যাবার পরেও। কিণ্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্রের মতো স্টেপ বহি স্টেপ পড়তে পড়তে চলতে দিলেন না দেবী আমাকে, হঠাৎ পড়া হঠাৎ না-পড়া দিয়ে শুরু করলেন শিক্ষা তিনি।
বাড়ির অলিগলি আপন-পর সব চেনা হয়ে গেছে বাড়ির বইরেটাকেও জেনে নিয়েছে। কাকের বুলি কোকিলের ডাক ভিন্নতা জানিয়ে দিয়েছে আপনাদের। গোরু-গাধাতে, মানুষে- বানরে, ঘোড়াতে আর ঘোড়ার গাড়িতে মিল অমিল কোন্খানে বুঝে নিয়েছি। বাড়ির চাকর- চাকরানী তাদের কার কী কাজ; কার মনিব কে-বা—সবই জানা হয়ে গেছে। বুঝেও নিয়েছিা আমি এ-বাড়ির একজন। কিন্তু কী নাম আমার সেটা বলার বেলায় হাঁ করে থাকি বোকার মতো-অথচ থামকে বলি থামই, ছাতকে ছাতা বলে ভুল করি নে; পুকূরকে জানি পুকূর আর তার জলে পড়লে হাবুড়ুবু খেয়ে মরতএ হয় তাও জানি । চলি চলি পা নেই-বড়ো বড়ো সিড়ির চার-পাঁচটা ধাপ লাফিয়ে পড়ি। জেনেছি কাঁচা পেয়ারা লুন দিয়ে খেতে লাগে ভালো; ডাক্তারের রেড মিক্শ্চার চিংড়ি মাছের ঘি নয়, কিন্তু বিম্বাদ বিশ্রী জিনিস। দুধের সর ভালোবাসি কিন্তু দাসীরা কেউ সেটাতে একএকদিন ভাগ বসায় তো ধরে ফেলি।
কেবল একটা কথা থেকে ভুলতে পারিনে—আমি ছোটো ছেলে। অনেকদিন লাগছে, বড়ো হতে- গোপদাড়ি উঠতে, ইচ্ছামতো নিভয়ে পুকূরের এপার-ওপার করতে, চৌতলার ছাতে উঠে ঘুড়ি ওড়াতে এবং তামাক খেতে বিষটিতে ভিজতে।
বাড়ির চাকর ওলো স্বাধীন ভাবে রোদ পোহায় —বিষটিতে ভেজে, ছোলা ভোজা খায়। পুকূরে নামে ওঠে। তামুক খায়, ফটকের বাইরে চলে যায় গোল-পাতার ছাতা ঘাড়ে হাঁটতে হাঁটতে- এ-সব কেবলই মনে,পড়ায় বড়ো হইনি, ছোটোই আছি-বুঝি বা এমনই থাকব চিরোদিন তেতলায় ধরা। সেই সময় সেই বহুকাল আগের একটা ঝড় পাঠালেন আমাকে দেখতে চম্কি দেবী। ঝড়টা এসেছিল রাতের বেলায় এটূকু মনে আছে তা ছাড়া ঝড় আসার পূর্বের ঘটনা, ঘনঘটা, বজ্রবিদ্যূৎ, বৃষ্টি, বন্ধ-ঘর অন্ধকার কি আলো কিছুই মনে নেই। ঘুমিয়ে পড়েছি, তখন উঠল তেতলায় ঝড়। কেবলই শব্দ, কেবলই শব্দ। বাতাস ডাকে, দরজা পড়ে; শিড়িতে ছুটোছুটি পায়ের ।শব্দ ওঠে দাসী চাকরদের। হঠাৎ দেখেও ফেললেম চিনেও ফেললেম-দুই পিসিমা, দুই পিসেমশায়, বাবামশায়, আর মাকে, যেন প্রথম সেইবার তিনতলায় এ-ঘর ও-ঘর সে-ঘর সবকটা ঘরই যেন ছুটোছুটি করে এসে একসঙ্গে একবার আমাকে দেখা দিয়েই পালিয়ে গেল।
এর পরই দেখেছি বড়ো শিড়ির মাঝে একেবারে চৌতলার ছাত থেকে মেটা একগাছা শিকলে বাঁধা লোহার গির্জার চূড়োর মতো সেকেলে পুরোনো লঠনটাতে নিয়ে শিকলসুদ্ধ বিষম দোলা দিচ্ছে ঝড়। নন্দ ফরাশ-আমাদেরে লঠনটাকেই ভালোবাসে সে, সরু একগাছা শনের দড়া দিয়ে কোনোরকমে শিকল-সমেত লঠনটাকে টেনে বেঁধে ফেলতে চাচ্ছে সিঁড়ির কাটরায়। তুফানে পড়লে বজরাকে যেভাবে মাঝি চায় ডাঙ্গায় অটিকে ফেলতে ঠিক তেমনি ভাবটা তার।
কোন্দিন এর আগে জানিয়েছিল শিকলি, লঠন, সিঁড়ি ও ফরাশ আপন-আপন কথা আমাকে তা একটূও মনে নেই, কন্তু এটা বেশ মনে হচ্ছে সেই প্রথমে গিয়ে পড়লেম দোতলায়, বৈঠক-খানায় মাঝের ঘরটাতে।
কে যে আমাকে নামিয়ে আনলে, হাত ধরে টেনে ছিচড়ে আনলে, কিম্বা কোলে করে নামিয়ে আনলে তা মনে নেই। কেবল মাঝের ঘরটা মনে আছ। সেখানে সারিসারি বিছানা- কৌচ টেবিল সরিয়ে, মাদুরের উপর পেড়ে দিতে ব্যস্ত চাকরদাসীরা। হলেদ রঙের বড়ো বড়ো কাঠের দরজা সারিসারি সবকটি বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে বাতাস আসতে পারছে না, চাকরানীওলো দুধের বাটি জলের ঘটি, পানের বটা, পিতলের ডাবর ঝনঝন করে ফেলে ফেলে জমা করছে ঘরের কোণে । এরই মাঝে মাদুরে বসে দেখছি: মাথার উপরে শাদা কাপড়ের গেলাপমোড়া একটার পর একটা বড়ো ঝাড়, দেয়ালে দেয়ালে দেয়ালগিরি, ছোটো বড়ো সব অয়েলপেন্টিং বাড়ির লোকের। জানছি ঝড় যেন একটা কী জানোয়ার-গর্জন করে ফিরছে বন্ধ বাড়ির চারদিক। দরজাগুলোও ধাক্কা দিয়ে কেবলই পথ চাচ্ছে ঘরে ঢোকবার।
এক সময়ে হকুম হল ছেলেদের শুইয়ে দেবার । দক্ষিণ শিয়রে মায়ের কাছে সেদিন মেঝেতে পাতা শক্ত বিছানায় মুড়ি দিয়ে শুয়ে নিলেম- কিন্তু ঘুমিয়ে গেলেম না। অনেক রাত পর্জন্ত শুনতে থাকলেম-বাতাস ডাকছে, বৃষ্টি পড়ছে, আর দুই পিসি পান-দোক্তা খেয়ে বলাবলি করছেন এমনি আর একটা আশ্বিনের ঝড়ের কথা।
সেই রাতে একটা ইংরিজি কথা জানলেম- 'সাইক্লোন' । ঝড়ের এক ধাকায় যেন বাড়ির অনেকখানি, বাড়ির মানুষদের অনেকখানি, সেইসঙ্গে ঝড়ই বা কী, সইক্লোনই বা কাকে বলে জানা হয়ে গেল। এক রত্তিরে যেন মনে হল অনেকখানি বড়ো হয়ে গেছি, জেনেও ফেলেছি অনেকটা-ঘরকে, বাইরেকেও।
এটা জানি তখন— দিন আছে, রাত আছে, আর তারা দু’জনে একসঙ্গে আসে না আমাদের তিনতলায়। এও জেনেছি, বাতাস একজন ঠাণ্ডা, একজন গরম ; কিন্তু তাদের দু’জনের কারো একটা করে ছাতা নেই গোলপাতার। রোদে পোড়ে, বিষ্টিতে ভেজে ওদের গা। এও জেনে নিয়েছি যে একটা একটা সময় অনেকজন রোদ বাইরে থেকে ঘরে এসেই জানলাগুলোর কাছে একটা একটা মাদুর বিছিয়ে রোদ পোহাতে বসে যায়। কোনো দিন বা রোদ একজন হঠাৎ আসে খোলা জানলা দিয়ে সক্কালেই। তক্তপোশের কোণে বসে থাকে সে, মানুষ বিছানা ছেড়ে গেলেই তাড়াতাড়ি রোদটা গড়িয়ে নেয় বালিশে তোশকে চাদরে আমার খাটেই। তারপর চট্ করে রোদ ধরা পরার ভয়ে বিছানা ছেড়ে দেয়াল বেয়ে উঠে পড়ে কড়িকাঠে। ছাতের কাছেই আল্সের কোণে দুটো নীল পায়রা থাকে জানি, আলো হলেই তারা দু’জনে পড়া মুখস্থ করে—পাক্পাখম্...মেজদি...সেজদি...
কড়ে আঙ্গুল বলে খাবো ; আংটির আঙ্গুল বলে কোথায় পাবো ; মাঝের আঙ্গুল বলে ধার করোগে ; আর একটা আঙ্গুল তার নাম যে তর্জনী, তা জানিনে, কিন্তু সে বলে জানি, শুধবো কিসে ; বুড়ো আঙ্গুল বলে লবডঙ্কা। কি সেটা, দেখতে লঙ্কার মতো আর খেতে ঝাল না মিষ্টি তা জানিনে, কিন্তু খুব চেঁচিয়ে কথাটা বলে মজা পাই। বন্ধ খড়খড়ির একটু ফাঁক পেয়ে জানি রাত আসে এক-একদিন, শাদা প্রজাপতির মতো এক ফোটা আলো, মাথার বালিশে ডানা বন্ধ করে ঘুমোয় সে, হাত চাপা দিলে হাতের তলা থেকে হাতের উপরে-উপরে চলাচলি করে। এমন চটুল এমন ছোটো যে, বালিশ চাপা দিলেও ধরে রাখা যায়না ; বালিশের উপরে চট করে উঠে আসে। চিৎ হয়ে তার উপর শুয়ে পড়ি তো দেখি পিঠ ফুঁড়ে এসে বসেছে আমারই নাকের ডগায়। উপুড় হয়ে চেপে পড়লেই মুশকিল বাধে তার—ধরা পড়ে যায় একেবারে, ঐটা নিশ্চয় করে জেনেছি তখন। পড়তে শেখার আগেই, দেখতে শুনতে চলতে বলতে শেখারও আগে, ছেলেমেয়েদের গ্রহ-নক্ষত্র, জল-স্থল, জন্তু-জানোয়ার। আকাশ-বাতাস, গাছপালা, দেশবিদেশের কথা বেস করে জানিয়ে দেবার জন্যে বইগুলো তখন ছিলোই না। বই লিখিয়েও ছিলো না হয়তো, কাজেই খানিক জানি তখন নিজে নিজে, দেখে কতক, ঠেকে কতক, শুনে কতক, ভেবে ভেবেও বা কতক। আমি দিচ্ছি পরীক্ষা তখন আমারই কাছে, কাজেই পাশই হয়ে চলেছি জানা-শোনার পরীক্ষাতে। আমাদের শান্তিনিকেতনের জগদানন্দবাবুর ‘পোকা-মাকড়’ বই কোথায় তখন, কিন্তু মাকড়সার জালশুদ্ধ মাকড়সাকে আমি দেখে নিয়েছি। আর জেনে ফেলেছি যে, মাকড় মরে গেলে বোকড় হয়ে খাটের তলায় কম্বল বোনে রাতের বেলা। ‘মাছের-কথা’ পড়া দূরে থাক, মাছ খাবারই উপায় নেই তখন, কাঁটা বেছে দিলেও। কিন্তু এটা জেনেছি যে, ইলিশ মাছের পেটে এক থলিতে থাকে একটু সতীর কয়লা, অন্য থলি ক’টাতে থাকে ঘোড়ার ক্ষুর, বামুনের পৈতে, টিক্টিকির লেজ এমনি নানা সব খারাপ জিনিস যা মাছ-কোটার বেলায় বার করে না ফেললে খাবার পরে মাছটা মুশকিল বাধায় পেটে গিয়ে। জেনেছি সব রুই মাছ গুলোই পেটের ভিতরে একটা করে ভুঁই-পটকা লুকিয়ে রাখে। জলে থাকে বলে পটকাগুলো ফাটাতে পারে না ; ডাঙ্গায় এলেই তারা মরে যায় বলে পটকাও ফাটাতে পারে না নিজেরা। সে-জন্যে মাছের দুঃখ থাকে, আর এইজন্যেই মাছ-কোটার বেলায় আগে-ভাগে পটকাটা মাটিতে ফাটিয়ে দিতে হয়। না হলে মাছ রাগ করে ভাজা হতে চায় না, দুঃখে পোড়ে, নয়তো গলায় গিয়ে কাঁটা বেঁধায় হঠাৎ।
কালোজামের বিচি পেটে গেলেই সর্বনাশ, মাথা ফুঁড়ে মস্ত জামগাছ বেরিয়ে পড়ে। আর কাগ এসে চোখ দুটোকে কালোজাম ভেবে ঠুকরে খায়। জোনাকি—সে আলো খুঁজতে পিদুমের কাছে এলো তো জানি লক্ষণ খারাপ, তখন ‘তারা’ ‘তারা’ না স্মরণ করলে ঘরের দোষ কিছুতেই কাটে না।
বটতলার ছাপা ‘হাজার জিনিস’ বইখানার চেয়েও মজার একখানা বই—তারই পাণ্ডুলিপির মাল-মশলা সংগ্রহ করে চলেছে বয়েসটা আমার তখন। বড়ো হয়ে ছাপাবার মতলবে কিংবা সর্ট-হ্যান্ড রিপোর্টের মতো ছাঁট অক্ষরে সাটে টুকে নিচ্ছে সব কথা—এ মনেই হয় না। আজও যেমন বোধকরি—যা কিছু সবই—এরা আমাকে আপনা হতে এসে দেখা দিচ্ছে—ধরা দিচ্ছে এসে এরা। খেলতে আসার মতো এসেছে, নিজে থেকে তাদের খুঁজতে যাচ্ছিনে—নিজের ইচ্ছামতো তারাই এসে চোখে পড়ছে আমার, যথাভিরুচি রূপ দেখিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে খেলুড়ির মতো খেলা শেষে। সে পঞ্চাশ বছর আগে তখনো তেমনি বোধ হতো। দেখছি না আমি, কিন্তু দেখা দিচ্ছে আমাকে সবাই ; আর এই করেই জেনে চলেছি তাদের নির্ভুল ভাবে। রোদ, বাতাস, ঘর, বাড়ি, ফুল, পাতা, পাখি এরা সবই তখন কি ভুল বোঝাতেই চললো অথবা স্বরূপটা লুকিয়ে মন-ভোলানো বেশে এসে সত্যি পরিচয় ধরে দিয়ে গেলো আমাকে, তা কে ঠিক করে বলে দেয়?
এ-বাড়িটা তখন আমায় জানিয়েছে—মাত্র তেতলা সে। তেতলার নিচে যে আর একটা তলা আছে, দোতলা বলে যাকে, এবং তারও নিচে একতলা বলে আর একটা তলও আছে—এ-কথা জানতেই দেয়নি বাড়িটা। কিন্তু সে জলে না হাওয়ায় ভাসছে এ মিছে কথাটাও তো বলেনি বাড়িটা। অসত্য রূপটাও তো দেখা যায়নি। আপনার খানিকটা রেখেছিলো বাড়ি আড়ালে, খানিকটা দেখতে দিয়েছিল, তাও এমন একটি চমৎকার দেখা এবং না-দেখার মধ্য দিয়ে যে তেমন করে সারা বাড়ির ছবি ধরে, কিম্বা ইঞ্জিনিয়ারের প্ল্যান ধরে, অথবা আজকের দিনে সারা বাড়িখানা ঘুরে ঘুরেও দেখা সম্ভব হয় না। আজকের দেথা এই বাড়ি সে একটা ম্বতন্ত্র বাড়ি বলে ঠেকে, যেটা সত্যিই আমাকে দেয় নি। কিন্তু সেদিনের সে একতলা দোতলা নেই এমন যে তিনতলা, সে এখনও তেমনিই রয়েছে আমার কাছে। নিজে থেকে জানাশোনা দেখা ও পরিচয় করে নেওয়া আমার ধাতে সয় না। কেউ এসে দেখা দিলে, জানান দিলে তো হল ভাব; কেউ কিছু দিয়ে গেল তো পেয়ে গেলাম। পড়ে পাওয়ার আদর বেশি আমার কাছে; কুড়িয়ে পাওয়ার নূড়ির মুল্য আছে আমার কাছে, কিন্তু খেটে পাওয়া পাঠার মুড়ির দিকে টান নেই আমার। হঠাৎ খাটুনি জুটে গেলে মজা পাই কিন্তু ‘হঠাৎ’ সত্যি ‘হঠাৎ’ হওয়া চাই, না-হলে নকল ‘হঠাৎ’ কোনাদিনই মজা দেয় না, দেয়ওনি আমাকে। আমি যদি সাহেব হতেম তো অবিবাহিতই থাকতে হত, কোর্টিশিপটা আমার দ্বারা হতই না। দাসীটা চলে গেল তার যেটূকু ধরে দেবার ছিলো দিয়ে হঠাৎ। এমনি হঠাৎ একদিন উত্তর-পুব কোণের ঘরটাও যা কিছু দেখবার ছিল দেখিয়ে যেন সরে গেল আমার কাছ থেকে।
মনে আছে এক অবস্থায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষা কিছুই নেই আমার কাছে। সেই সময়টাতে ছোটো ঘরে হঠাৎ একদিন সকালে জেগেই দেখলেম-লেপের মধ্যে থাকতে থাকতে কোন্ এক সময় শীতকাল গিয়ে গরম কাল এলা আজ সকালে আমার র্কপালটায় ঘাম দিয়েচে, আজই দাসীরা বিছানার তলায় লেপটিকে তাড়িয়ে দেবে, আজ রাতে খোলা জানলায় দেখা যাবে নীল আকাশ আর থেকে থেকে তারা, আর আমাকে একটা শাদা জামার উপরে আর- একটা সুতোর কাপড়ের ঠিক তেমনি জামা পরে নিতে হবে না, সক্কাল থেকে মোজা পায়ে দিয়েও কর্মভোগে ভুগতে হবে না জেনে ফেললাম হঠাৎ।
সেই ছেলেবেলা থেকে আজ পযন্ত না-জানা থেকে জানার সীমাতে পৌছনোর বেলা একটা কোনো নিদিট ধারা ধরে অঙ্কের যোগ বিয়োগ-ভাগফলটার মতো এসে গেল জগৎ- সংসারের যা-কিছু, তা হল না তো আমার বেলায়। কিম্বা ঘটা করে আগে থাকতে জানান দিয়ে ঘটল ঘটনা সমস্ত তাও নয়। হঠাৎ এসে বললে তারা বিস্ময়ের পর বিস্ময়ের জাগিয়ে 'আমি এসে গেছিা!' ঠিক যেমন ছবি এসে বলে আজও হঠাৎ— 'আমি এসে গেলেম, এঁকে নাও চটপট।', ষেমন লেখা বলে 'হয়ে গেছি তৈরি, চালিয়ে চলো কলম।' চম্কি দেবী বলে নিশ্চয় জানি কেউ আছেন আর কাজই জাঁর গোড়া থেকেই চমক ভাঙিয়ে দেওয়া। দেখার পুঁজি জানার সম্বল তিল তিল ফূটে ভরে তুলতে কত দেরি লাগত যদি চম্কি না থাকতেন সঙ্গে দাসীটা ছেড়ে যাবার পরেও। কিণ্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্রের মতো স্টেপ বহি স্টেপ পড়তে পড়তে চলতে দিলেন না দেবী আমাকে, হঠাৎ পড়া হঠাৎ না-পড়া দিয়ে শুরু করলেন শিক্ষা তিনি।
বাড়ির অলিগলি আপন-পর সব চেনা হয়ে গেছে বাড়ির বইরেটাকেও জেনে নিয়েছে। কাকের বুলি কোকিলের ডাক ভিন্নতা জানিয়ে দিয়েছে আপনাদের। গোরু-গাধাতে, মানুষে- বানরে, ঘোড়াতে আর ঘোড়ার গাড়িতে মিল অমিল কোন্খানে বুঝে নিয়েছি। বাড়ির চাকর- চাকরানী তাদের কার কী কাজ; কার মনিব কে-বা—সবই জানা হয়ে গেছে। বুঝেও নিয়েছিা আমি এ-বাড়ির একজন। কিন্তু কী নাম আমার সেটা বলার বেলায় হাঁ করে থাকি বোকার মতো-অথচ থামকে বলি থামই, ছাতকে ছাতা বলে ভুল করি নে; পুকূরকে জানি পুকূর আর তার জলে পড়লে হাবুড়ুবু খেয়ে মরতএ হয় তাও জানি । চলি চলি পা নেই-বড়ো বড়ো সিড়ির চার-পাঁচটা ধাপ লাফিয়ে পড়ি। জেনেছি কাঁচা পেয়ারা লুন দিয়ে খেতে লাগে ভালো; ডাক্তারের রেড মিক্শ্চার চিংড়ি মাছের ঘি নয়, কিন্তু বিম্বাদ বিশ্রী জিনিস। দুধের সর ভালোবাসি কিন্তু দাসীরা কেউ সেটাতে একএকদিন ভাগ বসায় তো ধরে ফেলি।
কেবল একটা কথা থেকে ভুলতে পারিনে—আমি ছোটো ছেলে। অনেকদিন লাগছে, বড়ো হতে- গোপদাড়ি উঠতে, ইচ্ছামতো নিভয়ে পুকূরের এপার-ওপার করতে, চৌতলার ছাতে উঠে ঘুড়ি ওড়াতে এবং তামাক খেতে বিষটিতে ভিজতে।
বাড়ির চাকর ওলো স্বাধীন ভাবে রোদ পোহায় —বিষটিতে ভেজে, ছোলা ভোজা খায়। পুকূরে নামে ওঠে। তামুক খায়, ফটকের বাইরে চলে যায় গোল-পাতার ছাতা ঘাড়ে হাঁটতে হাঁটতে- এ-সব কেবলই মনে,পড়ায় বড়ো হইনি, ছোটোই আছি-বুঝি বা এমনই থাকব চিরোদিন তেতলায় ধরা। সেই সময় সেই বহুকাল আগের একটা ঝড় পাঠালেন আমাকে দেখতে চম্কি দেবী। ঝড়টা এসেছিল রাতের বেলায় এটূকু মনে আছে তা ছাড়া ঝড় আসার পূর্বের ঘটনা, ঘনঘটা, বজ্রবিদ্যূৎ, বৃষ্টি, বন্ধ-ঘর অন্ধকার কি আলো কিছুই মনে নেই। ঘুমিয়ে পড়েছি, তখন উঠল তেতলায় ঝড়। কেবলই শব্দ, কেবলই শব্দ। বাতাস ডাকে, দরজা পড়ে; শিড়িতে ছুটোছুটি পায়ের ।শব্দ ওঠে দাসী চাকরদের। হঠাৎ দেখেও ফেললেম চিনেও ফেললেম-দুই পিসিমা, দুই পিসেমশায়, বাবামশায়, আর মাকে, যেন প্রথম সেইবার তিনতলায় এ-ঘর ও-ঘর সে-ঘর সবকটা ঘরই যেন ছুটোছুটি করে এসে একসঙ্গে একবার আমাকে দেখা দিয়েই পালিয়ে গেল।
এর পরই দেখেছি বড়ো শিড়ির মাঝে একেবারে চৌতলার ছাত থেকে মেটা একগাছা শিকলে বাঁধা লোহার গির্জার চূড়োর মতো সেকেলে পুরোনো লঠনটাতে নিয়ে শিকলসুদ্ধ বিষম দোলা দিচ্ছে ঝড়। নন্দ ফরাশ-আমাদেরে লঠনটাকেই ভালোবাসে সে, সরু একগাছা শনের দড়া দিয়ে কোনোরকমে শিকল-সমেত লঠনটাকে টেনে বেঁধে ফেলতে চাচ্ছে সিঁড়ির কাটরায়। তুফানে পড়লে বজরাকে যেভাবে মাঝি চায় ডাঙ্গায় অটিকে ফেলতে ঠিক তেমনি ভাবটা তার।
কোন্দিন এর আগে জানিয়েছিল শিকলি, লঠন, সিঁড়ি ও ফরাশ আপন-আপন কথা আমাকে তা একটূও মনে নেই, কন্তু এটা বেশ মনে হচ্ছে সেই প্রথমে গিয়ে পড়লেম দোতলায়, বৈঠক-খানায় মাঝের ঘরটাতে।
কে যে আমাকে নামিয়ে আনলে, হাত ধরে টেনে ছিচড়ে আনলে, কিম্বা কোলে করে নামিয়ে আনলে তা মনে নেই। কেবল মাঝের ঘরটা মনে আছ। সেখানে সারিসারি বিছানা- কৌচ টেবিল সরিয়ে, মাদুরের উপর পেড়ে দিতে ব্যস্ত চাকরদাসীরা। হলেদ রঙের বড়ো বড়ো কাঠের দরজা সারিসারি সবকটি বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে বাতাস আসতে পারছে না, চাকরানীওলো দুধের বাটি জলের ঘটি, পানের বটা, পিতলের ডাবর ঝনঝন করে ফেলে ফেলে জমা করছে ঘরের কোণে । এরই মাঝে মাদুরে বসে দেখছি: মাথার উপরে শাদা কাপড়ের গেলাপমোড়া একটার পর একটা বড়ো ঝাড়, দেয়ালে দেয়ালে দেয়ালগিরি, ছোটো বড়ো সব অয়েলপেন্টিং বাড়ির লোকের। জানছি ঝড় যেন একটা কী জানোয়ার-গর্জন করে ফিরছে বন্ধ বাড়ির চারদিক। দরজাগুলোও ধাক্কা দিয়ে কেবলই পথ চাচ্ছে ঘরে ঢোকবার।
এক সময়ে হকুম হল ছেলেদের শুইয়ে দেবার । দক্ষিণ শিয়রে মায়ের কাছে সেদিন মেঝেতে পাতা শক্ত বিছানায় মুড়ি দিয়ে শুয়ে নিলেম- কিন্তু ঘুমিয়ে গেলেম না। অনেক রাত পর্জন্ত শুনতে থাকলেম-বাতাস ডাকছে, বৃষ্টি পড়ছে, আর দুই পিসি পান-দোক্তা খেয়ে বলাবলি করছেন এমনি আর একটা আশ্বিনের ঝড়ের কথা।
সেই রাতে একটা ইংরিজি কথা জানলেম- 'সাইক্লোন' । ঝড়ের এক ধাকায় যেন বাড়ির অনেকখানি, বাড়ির মানুষদের অনেকখানি, সেইসঙ্গে ঝড়ই বা কী, সইক্লোনই বা কাকে বলে জানা হয়ে গেল। এক রত্তিরে যেন মনে হল অনেকখানি বড়ো হয়ে গেছি, জেনেও ফেলেছি অনেকটা-ঘরকে, বাইরেকেও।