বাংলার ব্রত
আমাদের দেশে দু-রকমের ব্রত চলিত রয়েছে দেখা যায়। কতকগুলি শাস্ত্রীয় ব্রত,আর কতকগুলি শাস্ত্রে যাকে বলেছে যোষিৎপ্রচলিত বা মেয়েলি ব্রতেরও দুটো ভাগ; একপ্রস্থ ব্রত কুমারী ব্রত-পাঁচ-ছয় থেকে আট-নয় বছরের মেয়েরা এগুলি করে, আর বাকিগুলি নারী ব্রত-বড়ো মেয়েরা বিয়ের পর থেকে এগুলি করতে আরম্ভ করে। এই শাস্ত্রীয় বা পৌরাণেক ব্রত যেগুলি হিন্দুধর্মের সঙ্গে এদেশে প্রচার লাভ করেছে, এবং দুই-থেকে বিভক্ত এই মেয়েলি ব্রত! এই মেয়েলি ব্রতেরও দুটো ভাগ; একপ্রস্থ ব্রত কুমারী ব্রত-পাঁচ-ছয় থেকে আট-নয় বছরের মেয়েরা এগুলি করে, আর বাকিগুলি নারী ব্রত-বড়ো মেয়েরা পর থেকে এগুলি করতে আরম্ভ করে। এই শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক ব্রত যেগুলি হিন্দুধর্মের সঙ্গে এদেশে প্রচার লাভ করেছে, এবং দুই-থেকে বিভক্ত এই মেয়েলি ব্রত আর অনুষ্ঠানগুলি খুঁটিয়ে দেখলে পুরাণেরও পূর্বেকার বলে বোধ হয় এবং যার মধ্যে হিন্দু-পূর্বে এবং হিন্দু এই দুই ধর্মের একটি আদানপ্রদানের ইতিহাস পড়তে পারি, এই দুইপ্রস্থ ব্রতের গঠনের ভন্নতা বেশ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। শাস্ত্রীয় ব্রত, নারী ব্রত এবং কুমারী ব্রত-ব্রতকে এই তিন ভাগে রেখে প্রত্যেকটির গত্যন কেমন দেখা যাক। কিছু কামঅনা ক’রে যে অনুষ্ঠান সমাজে চলে তাকেই বলি ব্রত।
শাস্ত্রীয় ব্রত
প্রথমে সামান্যকান্ড-যেমন আচমন, স্বস্তবাচন, কর্মারম্ভ, সংকল্প, ঘট-স্থাপন, পঞ্চগোব্যশোধন, শান্তিমন্ত্র, সামান্যার্ঘ আসনশুদ্ধি, ভূতশুদ্ধি, মাতৃকান্যাসাদি বিশেষার্ঘ্যস্থাপন । এর পরে ভুজ্জি-উৎসর্গ এবং ব্রাহ্মণকে দান-দহ্মিণা দিয়ে কথা-শ্রবন বা রোচনার্থে ফলশ্রুতি, ব্রতে যাতে রুচি জন্মায় সাজন্য ব্রতকথা শোনা। সামান্যকান্ড এবং ব্রতকথা এই দুটি হল পৌরাণিক ব্রতে উপাদান।
নারী ব্রত
শাস্ত্রীয় ব্রতের অনেকখানি এবং খাঁটি মেয়েলি ব্রতেরও কতকটা মিলিয়ে এগুলি। এগুলি শাস্ত্রীয় এবং অশাস্ত্রীয় দুই অনুশষ্ঠানের যুগলমূর্তি বলা যেতে পারে। বৈদিক অনুষ্ঠানের গভীরতা ও সজীবতা অনেকখানি চলে গিয়ে এবং লৌকিক ব্রতের সরলতা প্রায় নষ্ট হয়ে পূজারি ব্রাহ্মণ এবং সামান্যকান্ডের জটিল অনুষ্ঠান ন্যাসমুদ্রা তন্ত্রমন্ত্র এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।
কুমারি ব্রত
এই ব্রতগুলিই অনেকখানি খাঁটি অবস্থায় পাওয়া যায়। এদের গঠন এইরুপ-আহরন,যেমন ব্রত করতে যা যা লাগবে তা সংগ্রহ করা; আচারণ, যেমন কামনার প্রতিচ্ছবি, আলপনা দেওয়া, পুকুরকাটা ইত্যাদি এবং কামনা জানিয়ে কামনার প্রতিচ্ছবি বা প্রতিকৃতিতে ফুল ধরে, শেষে যদি কোনো ব্রতকথা থাকে তো সেটা শোনা, নয়তো ফুল ধরেই শেষ কামনা জানিয়ে ব্রত সাঙ্গ। পূজারি এবং তন্ত্রমন্ত্রের জায়গাই এখানে নেই।
বেশ বোঝা যায়, হিন্দুর্ধের সুলভ সংস্করন হিন্দুব্রতমালাবিধান চিনির ডেলার আকারে যেন কুইনাইন পিল। লোকের মধ্যে হিন্দুর্ধের জটিল অনুষ্ঠান এবং নানা দেবদেবির মাহাত্ম্য প্রচারে উদ্দেশ্যে তন্ত্র ও পূরাণকে ব্রতের ছাঁচ দিয়ে রচনা করা হয়েছে। খাঁটি পুরাণগুলির ইতিহাস হিসাবে একটা দাম আছে। কিন্তু, এই শাস্ত্রীয় ব্রতগুলি না পুরাতন আচার-ব্যবহারের চর্চার বেলায় না লোকসাহিত্য বা লৌকিক ধর্মাচরণের অনুসন্ধানের সময় কাজে লাগে। লোকের সঙ্গে এই ব্রতগুলির খুব কম যোগ, লোকের চেষ্টা লোকের চিন্তার ছাপ এই শাস্ত্রীয় ব্রত গুলি মোটেই নয়। ছাঁচটা এদের ব্রতের মতো হলেও জোড়াতাড়া দেওয়া কৃত্রিম পদার্থে যে জরতা সেটা শাস্ত্রীয় ব্রতগুলির সমস্তটার মধ্যে লহ্ম্য করা যায়। যজুঃ এবং সামবেদের অনেক মন্ত্র ও অনুষ্ঠান এই ব্রতগুলিতে থাকলেও বৈদিক ক্রিয়ার সঙ্গে এগুলির কলের পুতুল আর জীবন্ত মানুষের মতো প্রভেদ, শুধু তাই নয়, যে মৌলিক ব্রতের ছদ্মবেশে এগুলিকে সাজানো হয়েছে সেই খাঁটি মেয়েলি ব্রতগুলির সঙ্গেও এদের ওই একই রকম প্রভেদ। খাঁআটি মেয়েলি ব্রতগুলিতে, তার ছড়ায় এবং আলপ্অনায় এক্তা জাতির মনের, তাদের চিন্তার, তাদের চেষ্টার ছাপ পাই। বেদের সূক্তগুলিতেও সমগ্র আর্যজাতির এক্তা চিন্তা, তার উদ্যম-উৎসাহ ফুটে উঠেছে দেখি। এ দুয়েরই মধ্যে লোকের আশা আশঙ্কা চেষ্টা ও কামনা আপনাকে ব্যক্ত করেছে এবং দুয়ের মধ্যে এই জন্য বেশ একটা মিল দেখা যাচ্ছে। নদী সূর্য এমনি অনেক বৈদিক দেবতা, মেয়েলি ব্রতেও দেখা এঁদেরই উদ্দেশ্য ছড়া বলে হচ্ছে। বৈদিক যুগে ঋষিরা উষাকে এবং সূর্য উদয়কে আবাহন করেছেন:
উষাদেবতা। অঙ্গিরাপুত্র কুৎস ঋষি।।
সূর্যের মতো শুভ্রবর্ণা। দীপ্তিমতী উষা আসিয়াছেন।
সূর্যদেবতা। কণ্বপুত্র প্রস্কণ্ব ঋষি।।
তাঁহার অশ্বগণ তাঁহাকে সমস্ত জগতের ঊর্ধ্বে বহন করিতেছে।
আবার নদীসকলকে উদ্দেশ ক’রে: কোনো কোনো জল একত্রে মিলিত হয়, অন্য জল তাদের সহিত মিলিত হইয়া সমুদ্রের বাড়বানলকে প্রীত করে।
এর পরে যেগুলি শাস্ত্রীয় ব্রত বলে মেয়েদের মধ্যে চলেছে তাঁর এক্তি সূর্যস্তব-
নমঃ নমঃ দিবাকর ভক্তির কারন
ভক্তিরুপে নাও প্রভু জগৎকারণ
ভক্তিরুপে প্রণাম করিলে তুয়া পায়
মনোবাঞ্চা সিদ্ধ করেন প্রভু দেবরায়
বৈদিক সূর্য আর শাস্ত্রীয় ব্রতের সূর্য, দুয়ে তফাত যে কতটা তা দেখতে পাচ্ছি। এইবার খাঁটি মেয়েলি ব্রতের ছড়াতে সূর্যকে উষাকে এবং নদনদীকে কীভাবে লোকে বর্ণন করেছে দেখি।
নদী থেকে জল তোলবার মন্ত্র বা ছড়া
এ নদী সে নদী একখানে মুখ,
ভাদুলি-ঠাকুরানি ঘুচাবেন দুখ।
এ নদী সে নদী একখানে মুখ
দিবেন ভাদুলি তিনকুলে সুখ।।
সমুদ্রে ফুল-ধরবার মন্ত্র বা ছড়া
সাত সমুদ্রে বাতাস খেলে,
কোন সমুদ্রে ঢেউ তুলে?
সকালে কুয়াশা ভাঙার মন্ত্র
কুয়া ভাঙ্গুম, কুয়া ভাঙুম বেথালের আগে
সক্কল কুআ গেল ওই বরই গাছটির আগে।
উষা ও সূর্যোদয়ের ছড়া
উরু উরু দেখা যায় বড়ো বড়ো বাড়ি
ওই যে দেখা যায় সূর্যের মরা বাড়ি
সূর্যর মা লো।কী করো দুয়ারে বসিয়া।
তোমার সূর্্য আসতেছেন জোড় ঘোড়ায় চাপিয়া
কিন্তু তাই বলে পুরান ভেঙে যেমন শাস্ত্রীয় ব্রত তেমনি বেদ ভেঙে এই মেয়েলি ব্রতগুলির সৃষ্টি হয়েছে, এ কথা একেবারেই বলা যায় না। কেননা সমস্ত প্রাচীন জাতির ইতিহাসেই দেখা যায় আদিম মানুষের মধ্যে বায়ু সূর্য চন্দ্র এঁরা উপাসিত হচ্ছেন- ভারতবর্ষে ইজিপ্তে, মেক্রিকোতে। সুতরাং বাংলার ব্রতের ছড়াগুলি বাঙালির ঘরের জিনিস বলে ধরা যেতে পারে; এটা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠবে ব্রত গুলির সম্পূর্ণ চেহারাটি আমরা যখন দেখব। এক দিকে ভারতে প্রবাসী আর্যদের অনুষ্ঠান, আর এক দিকে ভারতের নিবাসীদের ব্রত, এক দল তপোবনের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন, আর এক দল নদীমাতৃক পল্লীগ্রামের নিভৃত নীড়ে বসতি করছেন।এই প্রবাসী এবং নিবাসী দুই দলের মধ্যে রয়েছে হিন্দুজাতি, যারা বেদের দেবতাদের দেখছে বিরাট সব মূর্তিতে এবং তারই বিরাট অনুষ্ঠানের ভার চাপাতে চাচ্ছে আদিম যারা তাদের মনের উপরে, কর্মের উপরে-তাদের সমস্ত চেষ্টা অ চিন্তার স্বাধীনতা ও স্ফূর্তি সবলে নিষ্পেষিত করে দিয়ে। বেদ, পুরাণ ও পুরাণের চেয়েও যা পুরোনো এই-সব লৌকিক ব্রত অনুষ্ঠান, এদের ইতিহাস এইটেই প্রমাণ করেছে-দুই দিকে দুটি বড়ো জাতির প্রাণের কথা, মাঝে একটি দল-বিশেষের স্বপ্ন।
আর্য এবং আর্য-পূর্ব দুজনেরই সম্পর্ক যে-পৃথিবীতে তারা জন্মেছে তাকেই নিয়ে, এবং দুজনেরই কামনা এই পৃথবীতেই অনেকটা বন্ধ-ধন ধনা সৌভাগ্য স্বাস্থ্য দীর্ঘজীবন এমন সব পার্থিব জিনিস; দুজনের ব্রত করছে যা কামনা ক’রে সেটা দেখলে এটা স্পষ্টই বোঝা যাবে, কেবল পুরুষের চাওয়া আর মেয়েদের চাওয়া, বৈদিক অনুষ্ঠান পুরুষদের আর ব্রত-অনুষ্ঠান মেয়েদের, এই যা প্রভেদ। ঋষিরা চাচ্ছেন-ইন্দ্র আমাদের সহায় হোন, তিনি আমাদের বিজয় দিন, শত্রুরা দূরে পলায়ন করুক ইত্যাদি; আর বাঙালি মেয়েরা চাইছে-‘রণে রণে এয়ো হব, জনে জনে সুয়ো হব, আকালে লক্ষ্মী হব, সময়ে পুত্রবতী হব’।এর সঙ্গে পৃথিবী-ব্রতের শাস্ত্রীয় প্রণাম-মন্ত্রটি দেখি-
বসুমাতা দেবী গো। করি নমস্কার।
পৃথিবীতে জন্ম যেন না হয় আমার।
এই যে পৃথিবীর যা-কিছু তাঁর উপরে ঘোর বিতৃষ্ণা এবং ‘গোক’লে গোকুলে বাস, গোরুর মুখে দিয়ে ঘাস, আমার যেন হয় স্বর্গে বাস’ এই অস্বাভাবিক প্রার্থনা ও স্বপ্ন, এটা বেদেরও নয় ব্রতেরও নয়। বৈদিক সূক্তগুলি আর ব্রতের ছড়াগুলিকে আমাদের রুপকথার বিহঙ্গম বিহঙ্গমা দুটির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। দুজনেই পৃথিবীর, কিন্তু বেদসূক্তগুলি ছাড়া ও স্বাধীন, বনে সবুজের উপরে নীল আকাশের গান; আর ব্রতের ছড়াগুলি যেন নীড়ের ধারে বসে ঘন-সবুজের আড়ালে পক্ষীমাতার মধুর কাকলি- কিন্তু দুই গানেই পৃথিবীর সুরে বাঁধা।
খাঁটি ব্রতের অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া এবং শাস্ত্রীয় ব্রত-অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া, দুয়ের মূলত যে ভিন্নতা রয়েছে সেইটে পরিস্কার ধরবার চেষ্টা করলে দেখব যে, শাস্ত্রীয় ব্রতে প্রায় সকলগুলিতে, যে-কামনা করেই ব্রত হোক না, কামনা চরিতার্থ করবার উপায় ও অনুষ্ঠানে বা ক্রিয়া অনেকটা একই, যেমন- আমলকীদ্বাদশী ব্রত, প্রথম স্বস্তিবাচনপূর্বক “ওঁ সূর্যসোমঃ” ইত্যাদি মন্ত্র পাঠ করিয়া সংকল্প করিবে-ওঁ আদ্যেতানি মাঘে মাসি শুক্লে পক্ষে দ্বাদশ্যান্তিথৌ অমুকগোত্রা শ্রীঅমুকী দেবী(বা শূদ্র হ’লে দাসী) পুত্রপৌত্রাদ্যনবচ্ছিন্ন সন্ততিধনধান্যসৌভাগ্যাদি প্রাপ্যন্তি বিষ্ণুলোকগমনকামা অদ্যারভ্য একবর্ষ পর্যন্তং প্রতীমাসীয় শুক্লদ্বাদশ্যাং গণপত্যাদি দেবতাপূজাপূর্বকং বা সলক্ষ্মীকবিষ্ণুপূজা-মলকীযুক্তভোজ্যদানপূর্বকং ব্রক্ষপুরাণোক্ত বিধিনামলকীদ্বাদশীব্রতমহং করিষ্যে-পরে সামান্যার্ঘ্য আসনশুদ্ধি ভূতশুদ্ধি ইত্যাদি সামান্যকাণ্ডের পুরো অনুষ্ঠান করে ব্রতকথা শ্রবন- মোটামুটি সব ব্রতেরই এই প্রক্রিয়া। পুত্রপৌত্র কামনা, তারও চরিতার্থতার যে মন্ত্র, যে ক্রিয়া, অন্য কিছু কামনা করেও সেই-সব ক্রিয়া; কেবল কোনোটা ব্রক্ষপুরাণের মতে একটু-আধটু এদিক-ওদিক ক’রে। সব কামনার এক ক্রিয়া, সব রোগের এক ওষুধ বা সব সিন্ধুকের একই চাবি।
মেয়েলি ব্রত বা খাঁটি ব্রত তা নয়। সেখানে কামনা যত-রকম তাঁর চরিতার্থতার প্রক্রিয়াও ত্ত-রকম। বৈশাখে পুকুরে জল না শুকোয়, গরমে গাছ না মরে, এই কামনা করে পূর্ণিপুকুর; সেখানে ক্রিয়া হচ্ছে পুকুর কাটা, তাঁর মধ্যে বেলের ডাল পোঁতা, পুকুরে জল ঢেলে পূর্ণ করা, তারপর বেলের ডালে ফুলের মালা ও পুকুরের চারি ধারে ফুল সাজানো এবং ছড়া বলে বেলের ডালে ফুলে ধরা-
পূর্ণিপুকুর পুষ্পমালা
কে পূজে রে দুপুরবেলা?
আমি সতী লীলাবতী
ভাইয়ের বোন পুত্রবতী,
হয়ে পূত্র মরেব না
পৃথিবীতে ধরবে না। ইত্যাদি।
আবার যখন বৃষ্টির কামনা ক’রে বাসুধারা ব্রত তখন আলপনায় আটা তাঁরা আঁকতে হচ্ছে, একটি মাটির ঘটে ফুটো ক’রে বৃষ্টির অনুকরণে গাছের মাথায় জল ঢালা হচ্ছে; এমনি নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মানুষ কামনা জানাচ্ছে-
গঙ্গা গঙ্গা ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ বাসুকি
তিন কুলে ভরে দাও ধনে জনে সুখী।
হিন্দুধর্মের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে লৌকিক ব্রতের চেহারা এমন অদলবদল হয়ে গিয়েছে যে, এখন যে ব্রতগুলি খাঁটি অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে তা অতি অল্প, এবং দু-চারটি ছাড়া সেগুলিও খণ্ড অসম্পুর্ণ অবস্থায় আমারা পাই। বাংলার ব্রতগুলি কতক-কতক সংগ্রহ হতে আরম্ভ হয়েছে, সবগুলি সম্পুর্ণ আকারে এখনও সংগ্রহ ও প্রকাশ হবার অনেক দেরি, এবং অন্তঃপুরের জীবনযাত্রার বদলের সঙ্গে সঙ্গে এই সব ব্রত করবার এবং ব্রতগুলির অনুষ্ঠানে ঠিকঠাক মনে রাখবার চেষ্টাও ক্রমে চলে গিয়েছে। এ অবস্থায় যা হচ্ছে তাতে খাঁটি নকল সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ সবই আমরা গ্রহণ করতে চলেছি। ব্রতের আলপনায় মধ্যে আমরা দেখতে পাই খাঁটি নকশার মধ্যে মেকিও চলেছে। তেমনি ছড়াগুলির মধ্যেও হয়তো যেখানকার যা সেগুলো উলটে কোথাও একছত্র নতুন, কোথাও এক ব্রতের ছড়া অন্য ব্রতে-এমনি সন কাণ্ড। এ ছাড়া নানা গ্রামে নানা অনুষ্ঠান, একই ব্রত এখানে এক-রকম ওখানে অন্য। এমনি সব নানা জঞ্জালের মধ্যে থেকে খাঁটি ব্রতের চেহারাটির একটি আদর্শ-বার ক’রে আনতে হলে শুধু এদেশের ব্রতগুলিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে ফল হবে না, পৃথিবীতে সমস্ত আদিমজাতির মধ্যে ব্রত-অনুষ্ঠান কীভাবে চলেছে তাঁর ইতিহাসগুলিও দেখা চাই।
ব্রত হচ্ছে মানুষের সাধারাণ সম্পত্তি, কোনো ধর্মবিশেষের কিংবা বিশেষ দলের মধ্যে সেটা বদ্ধ নয়, এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এটাও বেশ বলা যায় যে, ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের যে দশাবিপর্যয় ঘটত সেইগুলোকে ঠেকাবার ইচ্ছা এবং চেষ্টা থেকেই ব্রতক্রিয়ার উৎপত্তি। বিচিত্র অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মানুষে বিচিত্র কামনা সফল করতে চাচ্ছে, এই হল ব্রত, পুরাণের চেয়ে নিশ্চয়ই পুরোনো বেদের সমসাময়িক কিংবা তাঁরও পূর্বেকার মানুষদের অনুষ্ঠান।
ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসে ভারতবর্ষের মধ্যে আর্যেরা যাদের দেখা পেলেন, তাদের ডাকলেন তাঁরা ‘অন্যব্রত’ বলে। এটা ঠিক যে আর্যরা আসবার আগে এদেশে দলে দলে এই-সব ‘অন্যব্রত’ ছেলেমেয়ে, যুবকযুবতি, বুড়োবুড়ি, দলপতি, গোষ্ঠীপতি, যোদ্ধা, কৃষান- নিজেদের আচার আনুষ্ঠান দেবতা-অপদেবতা কলাকৌশল ভয়ভরসা হাসিকান্না নিয়ে বাস করছিল এবং এটাও ঠিক যে ভারতবর্ষের বাইরে থেকে যারা এলেন এবং এদেশের মধ্যে যারা ছিলেন সেই আর্য এবং না-আর্য বা ‘অন্যব্রত’দের মধ্যে সব দিক দিয়ে, এমন কী, বিয়েতে এবং ভোজেতেও আদানপ্রদান চলেছিল। পুরাণের দেবদেবীদের উৎপত্তির ইতিহাস এই আদানপ্রদানের ইতিহাস; ধর্মানুষ্ঠানের দিক দিয়ে শাস্ত্রীয় ব্রতগুলির ইতিহাসও তাই, কেবল এই মেয়েলি ব্রতগুলির মধ্যে দিয়ে আমরা সেই-সব দিনের মধ্যে গিয়ে পড়ি যেখানে আমাদের পূর্বতন-পুরুষ অন্যব্রতরা তাদের ঘরের মধ্যে রয়েছেন দেখি। সব উপরের হিন্দু-অনুষ্ঠানের অনেকটা গঙ্গামৃত্তিকা,গৈরিক-এমনি সব মাটির একটি খুব মোটা রকমে স্তর ; তারপর, বৈদিক আমলের মূল্যবান ধাতুস্তর; তারও তলায় অন্যব্রতদের এই-সব ব্রত -একেবারে মাটির বুকের মধ্যেকার গোপন গোপন-ভাণ্ডার।
এই-সব অতি পুরাতন ব্রত এখনও কেমন ক’রে বাঙালির ঘরে ঘরে করা হয়, এর উত্তরে বলা চলে আমাদের সদর অংশটা যতটা বদলে গেছে , আমাদের অন্তঃপুরটা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তো বদলে যায়নি। সেটা কাল, তাঁর পূর্বে, এবং তার-তার-তারও পূর্বে আজও তা। অন্তত বেশির ভাগ মেয়েলি কাণ্ডই এইরুপ। সেখানে ঠাকুরমার সঙ্গে নাতনির এবং ঠাকুরমাতে ও তাঁর ঠাকুরমাতে খুব তফাত নেই। শিবের বিয়ে যাভাবে হয়েছিল বার-আট-ল-র বিয়েও ঠিক সেইভাবেই এখনও ঘটছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, ইউরোপেও এমনি রোমান ল-র মতো অনেক জিনিসই এখনও অটুটভাবে কাজ করছে দেখা যায়। কাজেই এই ব্রতগুলি মেয়েদের মধ্যে পুরুষানুক্রমে এতকাল চলে আসা আশ্চর্য নয়। বাংলার এই ব্রতগুলি আমাদের মায়েদের দিয়ে তখনকার অন্যব্রতচারিণীদের জীবন্ত বর্ণনা – কখনো আলপনার শিল্পে, কখনো কবিতা নাটক ও সাহিত্যকলার মধ্যে দিয়ে, কখনো বা ধর্মানুষ্ঠানের দিক দিয়ে। এই ছবির উপরে কালে কালে যে-সব নানামুনির আঁচড়, নানা দিকথেকে নানা জঞ্জাল পড়েছে, সেগুলি আস্তে আস্তে না সরিয়ে দেখলে আমরা কিছু যে দেখতে পাব তা তো বোধ হয় না ।
মেয়েদের মধ্যে ব্রতগুলি এখন যেভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাঁকেই ব্রত অনুষ্ঠানের আদর্শ বলে নিতে পারিকিনা প্রথমে সেটা দেখা যাক; এবং সেটা যদি আদর্শ ব্রত না হয় তবে ব্রতের আদর্শটা পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাই কিনা দেখি। মানুষের এবং সব জীবেরই, বিচিত্র কামনা চরিতার্থ হবার পূর্বে বিচিত্র চেষ্টায় আপনাকে ব্যক্ত করে। তৃষ্ণা জাগল, জলপান, ক্রিয়াটি করলেম, তৃষ্ণার শান্তি হলো।ক্ষুধা বা খাবার কামনা জাগল, আহার্য-সংগ্রহ, রন্ধন-ব্যাপার, পরিবেশন ও ভোজন-ক্রিয়া করলেম, ক্ষুদার শান্তি হলো। ধনের কামনা জাগল, কাজ করতে দেশবিদেশে চললেম- এইভাবে মানুষ আজীবন কামনা ও তাঁর চরিতার্থতার নানা ক্রিয়া করে চলেছে। কী অনুষ্ঠান করলে যে কী হবে তাঁর কতক মানুষ আপনা হতেই আবিষ্কার করে, কতক দেখে শিখে নেয় কতক ঠেকে শিখে নেয়-এমনি। জীবনের কামনা যতক্ষণ না মরণে গিয়ে থামছে ততক্ষন, ধরতে গেলে, সমস্ত জীবজন্তুতে মিলে বিশ্বব্যাপী একটা ব্রত অনুষ্ঠান করছে। জলের কামনা করেছি কিন্তু উঠেগিয়ে জলের ঘটিটা না ধরে, ঘরে বসে জলখাবার ভঙ্গিটা অনুষ্ঠান করছি। কিংবা, জলের কামনায় চলেছি উনুনের ধারে- এ হলে কামনা চরিতার্থ হলো না, কাজেই য়ে অনুষ্ঠানা করলেম স্বগুলি ভুল অনুষ্ঠান হলো। ব্রতে জলের কামনা জলরুপে এবং পানক্রিয়া হয়ে ফোটা চাই। এবনফ যখন এটা হল তখনই কামনায় ক্রিয়া যোগ হয়ে ঠিক ফলটি পাওয়া গেল। মানুষের এই সহজ বিবেচনার ছাঁচেই কতটা তাদের আদিকালের ব্রতগুলি ঢালা হয়েছে দেখা যায়।
একজন মানুষের কামনা এবং তাঁর চরিতার্থতার ক্রিয়া ব্রত-অনুষ্ঠান বলে ধরা যায় না যদিও ব্রতের মূলে কামনা এবং চরিতার্থতার জন্য ক্রিয়া, কিন্তু ব্রত তখন, যখন দশে মিলে এক কাজ এক উদ্দেশে করছে। ব্রতের মোটামুটি আদর্শ এই হলো- একের কামনা দশের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে একটা অনুষ্ঠান হয়ে উঠছে। একের সঙ্গে অন্য দশজনে কেন যে মিলছে, কেন যে একের অনুকরণ দশে করছে, সেটা দেখবার বিষয় হলেও আমরা সে-সব জটিল প্রশ্নে এখন যাব না। একজনকে নিয়ে নাচ চলে কিন্তু নাটক চলে না।, তেমনি একজনকে দিয়ে উপাস্য দেবতার উপাসনা চলে কিন্তু ব্রত-অনুষ্ঠান চলেনা। ব্রত ও উপাসনা দইই ক্রিয়া-কামনার চরিতার্থতার জন্য; কিন্তু একটি একের মধ্যে বদ্ধ এবং উপাসনাই তাঁর চরম, আর একটি দশের মধ্যে পরিব্যাপ্ত-কামনার সফলতাই তাঁর শেষ- তাই তফাত।
ব্রত যে কী ও ব্রত যে কেন তা এদেশের এবং অন্য দেশের দুটি ব্রত পাশাপাশি রাখলেই আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে উঠবে।
আমেরিকার ‘হুইচল’ জাতির মধ্যে বৃষ্টি কামনা করে একটি ব্রত ঃ একটি মাটির চাকতি বা সরা; তাঁর একপিঠে আলপনা দিয়ে সূর্য চারিদিকে গতিবিধি বোঝাতে ক্রুশের মতো একটি চিহ্নঃ সেই চিহ্নের মাঝে একটি গোল ফোঁটা- মধ্যদিনের সূর্যকে বুঝিয়ে; এরই চারি দিকে সরার কিনারায় সব পর্বতের চূরা, এবং চুড়াগুলির ধারে ধারে ধানখেত বোঝাবার জন্যে লাল ও হলুদের সব বিন্দু; তারই ধারে বৃষ্টি বুঝিয়ে কতকগুলি বাঁকা বাঁকা টান সবার জন্য পিঠে লাল-নীল-হলুদে রঙের বাণে-ঘেরা চক্রাকার সূর্যমূর্তির আলপনা লিখে পূজাবাড়িতে রেখে ব্রত করা। হয়তো এই আলপনা দিয়েই ব্রত শেষ, হয়তো বা ছড়াও কিছু বলা হয়।
আমাদের দেশের একটি ব্রত ‘ভাদুলি’। এটি বৃষ্টির পরে আত্মীয়স্বজনের বিদেশ থেকে, সমুদ্রযাত্রা থেকে, জলপথে স্থলপথে নিরাপদে ফিরে আসার কামনায়। ভাদুলির মূর্তি, জোড়াছত্র মাথায়, জোনানৌকায় লিখে, চারিদিকে নদী সমুদ্র কাঁটাবন নানা হিংস্র জন্তু নৌকো ইত্যাদি আলপনা দিয়ে, এই ব্রত করা হয়। এক-একটি আলপনার চিত্রে ফুল ধ’রে, এবং সেই আলপনা যে কামনার প্রতিচ্ছবি একটি পর একটি ছড়ায় সেই কামনাটি উচ্চারণ ক’রে-যেমন নদীর আলপনায় ফুল ধ’রে বলা “নদী, নদী! কোথায় যাও? বাপ-ভায়ের বার্তা দাও!’- এমনি প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্ন আলপনাতে রকম-রকম ছড়া ব’লে ফুল ধ’রে ভাদুলিকে প্রণাম করে ব্রত শেষ। যেমন এই ব্রতে তেমন অন্য অন্য ব্রতেও কখনো ফুল, কখনো সিঁদুরের ফোঁটা, এমনি নানা জিনিস এক-একটি আলপনার উপরে রেখে ছড়া-কাটা ও শেষে ব্রতকথা শোনা হচ্ছে এদেশের ব্রত করা। ব্রতের ফুল ধরায় আর পূজার ফুল দেবতার চরণে দেওয়ায় একটু তফাত রয়েছে। ব্রতে ফুল ধরার অর্থ এ নয় যে নদীকে কি বাঘ মোষ ইত্যাদির চিত্রমর্তিকে ফল দিয়ে উপাসনা; নদীর কামনা শেষ, বনের কামনা শেষ, এইটে মনা রাখবার জন্যেই ফুলটা-কতকটা হিসাবের খাতায় লাল পেনসিলের দাগ, গণনা ঠিক রাখতে। যার উপর ফুল পড়ল তিনি সাক্ষী রইলেন যে ব্রতী তাঁর কামনা জানিয়েছে; যেমন বসুধারা ব্রতের ছড়াটিতে স্পষ্ট বলা হয়-
অষ্টবসু অষ্টতারা তোমরা হলে সাক্ষী
আট দিকে আট ফুল আমরা রাখি।
অষ্টবসু অষ্টতারা তোমরা হলে সাক্ষী,
আট দিকে আট ফুল আমরা রাখি।
দুই দেশের দুটি ব্রতের মধ্যে একই জিনিস কতকগুলি রয়েছে। কিছু কামনা করে দুটোই করা হচ্ছে। কামনার প্রতিচ্ছবি আলপনায়; যেমন জলপথে নিরাপদে আসার কামনা নদীর আলপনায় ব্যক্ত হচ্ছে। তেমন কামনার প্রতিধ্বনিটি দিচ্ছে ছড়া; যেমন-নদী নদী! কোথায় যাও?বাপভায়ের বার্তা দাও’। এই হলো- জলযাত্রীর খবর যখন জলপথে ছাড়া বিনা-তাঁর সাহায্যে আকাশ দিয়ে আসবার সম্ভাবনা ছিলনা। ব্রতের পর সকল ব্রতীরা মিলে ব্রতকথা শোনা। ব্রতের এ অংশটার সঙ্গে কামনার যোগা্যোগ এবং অনুষ্ঠানেরও যোগাযোগ ততটা নেই। কেননা দেখি, কোনো ব্রতের কথা আছে, কোনো ব্রতে নেই; এটা কতকটা ক্রিয়াকর্ম শেষ করে গল্পগুজব করা- গ্রামের পাঁচজনে মিলে। ব্রতে এই-সবই রয়েছে- কবিতা চিত্র উপাখ্যান গদ্য এবং মন্ডনশিল্প। এর মধ্যে ছড়াগুলি সব এক-রকম নয়; কোথাও দেখব সেগুলি নাটকের মতো পাত্রপাত্রী এবং নানা দৃশ্য ও অঙ্ক-ভেদে সাজানো। যদিও খুব ছোটো কিন্তু এই-সব ছড়াকে অভিনয় করার উদ্দেশ্যেই যে গাঁথা হয়েছে, সেটা বেশ বোঝা যায়। ব্রতগুলিকে সম্পূর্ণ আকারে যখন দেখব তখন পরিষ্কার বোঝা যাবে সেটা নাটক কি ছড়া। ব্রতের মধ্যে পুরাকালের ধর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে চিত্রকলা নাট্যকলা নৃত্যকলা গীতকলা উপন্যাস উপাখ্যান পর্যন্ত পাচ্ছি। কাজেই ব্রতগুলি আমাদের কাছে তুচ্ছ জিনিস
নয় এবং শিল্প ও আর-আর সভ্যতার লক্ষণ যাদের মধ্যে পাওয়া শক্ত এমন কোনো বর্বর জাতির অন্ধবিশ্বাসের নিদর্শন বলেও এগুলিকে ধরব না।
আর্য্রা যাঁদের অন্যব্রত অর্কমা দস্যু দাস ইত্যাদি বলেছেন, এই-সব ব্রতে এবং ভারতবর্ষের শিল্পকলার ইতিহাসর মধ্যে দিয়ে সেই-সব অন্যব্রতদের সম্বন্ধে অন্য রকম সাক্ষ্য আমারা পাচ্ছি। যেমন বাস্তবিদ্যা, ময়শাস্ত্র, এবং ময় ছিলেন দানব। আর্্যেরা যখন ইন্দ্রকে হোম করে যুদ্ধ-বিজয়কামনা করছেন, ততক্ষণ অন্যব্রতরা তাদের পুরীসকল অস্ত্রশস্ত্রে, পাষাণপ্রাচীরে সুদৃঢ় করে তুলেছে-ইন্দ্রকে খুশি করতে বসে না থেকে। এবং সে সময় তাদের মেয়েরা যা কী ব্রত করছে তারও কতকটা আভাস ‘রণে এয়ো’ ব্রতের এই ছড়াটি থেকে আমরা পাচ্ছিঃ রণে রণে এয়ো রব, জনে জনে সুয়ো হব, অকালে লক্ষ্মী হব, সময়ে পুত্রবতী হব।এ কামনা যাদের মেয়েরা করতে পারে তারা অন্যব্রত হলেও আর্যদের চেয়েও যে সভ্যতায় নীচে ছিল তা তো বলা যায়না। রণচণ্ডীর যে মূর্তীখানি এই ছড়ার মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই, মেয়েদের হৃদয়ের যে একটি সংযত সুশোভন আদর্শ আমাদের কাছে উপস্থিত হয়, তাতে করে তাদের অন্যব্রত ছাড়া অকর্মা অমন্ত এ-সব উপাধি দেওয়া চলে না ।
ধর্মানুষ্ঠানের দিক দিয়েও আর্্যজাতি এই-সব অন্যজাতির চেয়েও বেশি দূর অগ্রসর হননি। জগৎ-সংসারের এক নিয়ন্তাকে স্বীকার বৈদিক আর্যদেরও মধ্যে অনেক দেরিতে ঘটেছে। তাঁর পূর্বে জলের এক দেবতা, আগুনের দেবতা, বৃষ্টির দেবতা, এমন-কী মণ্ডূক পর্যন্ত।অন্যব্রতদের মধ্যেও এই-সব দেবতা পৃথিবীর নানা স্থানে উপাসিত হচ্ছেন-কেবল ভিন্ন ভিন্ননামে দেখি। যেমন বেদের ‘সূর্য’ ইজিপ্তে ‘রা’ অথবা ‘রাআ’, মেস্কিকোতে ‘রায়মী’ বাংলায় ‘রায়’ বা ‘রাঈ’। বেদের অনেক দেবতাকেই আমরা অন্যব্রতদের মধ্যে আমরা খুঁজে পাব। নানা ঋতুর মধ্যে দিয়ে নানা সব ঘটনা মানুষের চিন্তাকে আকর্ষণ করেছে এবং এই-সকল ঘটনার মূলে দেবতা অপদেবতা নানারকম কল্পনা করে নিয়ে তারা শস্যকামনায়, সৌভাগ্যকামনায়- এমনি নানা কামনা চরিতার্থ করবার জন্য ব্রত করছে কী আর্য কী অন্যব্রত সব দলেই, এইটেই হলো ব্রতের উৎপত্তির ইতিহাস।
শাস্ত্রীয় ব্রতগুলির মধ্যে ভারতবর্ষের ব্রত-অনুষ্ঠানের, আর-এক পরিচ্ছেদ আমরা পড়তে পাই।লোকে আর্যধর্মের চরম এক-নিয়ন্তার নিষ্কাম উপাসনায় পৌছে হিন্দুধর্মের নানা দেবদেবী আবার সৃষ্টি করতে আরম্ভ করেছে, সেই প্রাচীন অবস্থায়, সেই আন্যব্রতদের সমান অবস্থায় আর-বার ফিরে যাচ্ছে মনের গতি। কেবল এইটুকু তফাৎ যে, এখন অন্যব্রতদের দেবতাকে এবং সেই সেই দেবতার ব্রত-অনুষ্ঠানকে আর্যদের মত সম্পূর্ণ উপেখা না করে তাদের সম্পূর্ণ রুপান্তে ঘটাবার চেষ্টা চলেছে। হিন্দুধর্মের এই উদারতার পিছনে রয়েছে সম্পূর্ণ অনুদার ভাবটি-সবাই নিজের নিজের ধর্মাচরণ করতে থাকে এটা নয়, সবাই আসুক এক হিন্দু ধর্মের মধ্যে ব্রাহ্মণপুরোহিতদের কবলে; এবং এরই জন্য শাস্ত্রের ছাঁচ সবটার উপরে বেড়াজালের মতো দেওয়া হচ্ছে। শাস্ত্র এবং শাস্ত্রকারেরাই এর সাক্ষ্য দিচ্ছেন; যেমন ব্যাসদেব বলছেন –‘দেশানুশিষ্টং কুলধর্মমগ্রং, সগোত্রধর্মং নহি সংত্যেজেচ্চ’।অর্থাৎ, ধর্মশাস্ত্র অবিরোধী; যে দেশব্যবহার সেইটেই প্রথম পালনীয়, কিন্তু সগোত্র ধর্মও পরিত্যাগ করা উচিত নয়।স্মার্ত রঘুনন্দন শুদ্ধিতত্ত্বে স্ত্রীলোকদের হিন্দু-অনুষ্ঠেয় কার্যে অর্থাৎ যে যে কার্য তারা ধর্মবোধে করে আসছে অথচ মুনিপ্রণীত কোনো বচন-প্রমাণে যে-সকল ব্যবহার ও ক্রিয়ার উলেখ পাওয়া যায় না তা ‘যোষিৎব্যবহারসিদ্ধা’ বলে ধরেছেন।
পশ্চিম-দেশ হোলির উৎসব একটি অতি প্রাচীন অনিষ্ঠান। এই হোলি-উৎসব বা বসন্তের ব্রতকে শাস্ত্রসিদ্ধ বলে জন্যে মীমাংসা-দর্শনে হোলিকাধিকরণ বলে একটা অধ্যায় লিখতে হয়েছে। এবং এই অধ্যায়ে যে-সমস্ত হিন্দুর ধর্মকর্মের বা ব্যবহারের বেদাদিশাস্ত্র প্রমাণ পাওয়া যায় না, সে-সমস্তই হোলিকাধিকরণন্যায়মূলক-সিদ্ধ বলা হয়েছে। এটিকে হিন্দুশাস্ত্রকার মেনে নিলেন এবং এর সঙ্গে সমস্ত লৌকিক ব্রতকে হিন্দুর বলে স্বীকার করেও নিলেন দেখছি; কিন্তু শুধু এইখানে শাস্ত্রকারদের কর্ম শেষ হলো না, পুরোনো বা অশাস্ত্রীয় ব্রতগুলোর রুপান্তর
করে শাস্ত্রীয় বলে চালাবার চুষ্টাও হয়েছে দেখি। আবার নতুন নতুন ব্রত, নিজেদের মনগড়া, তাও সৃষ্টি হয়েছে দেখা যায়। যেমন অক্ষয়তৃতীয়া অঘোরচতুর্দশী, ভূতচতুর্দশী নৃসিংহচতুর্দশী, এমন কতকগুলি ব্রত তিথিমাহাত্ম প্রচারের জন্য। জ্ঞানত বা অজ্ঞানত বিশেষ তিথিতে যদি কোনো পুণ্যকার্য করা যায় তবে তার দ্বারা মানুষের পুন্য অর্জন এবং সৌভাগ্য ঘটে-এই হল ব্রতগুলির মোট কথা। আর কতগুলিব্রত হিন্দুদের দেবদেবীর মাহাত্ম্যপ্রচারের জন্য। যেমন অনন্তব্রত ইত্যাদি। কতকগুলি গ্রাম্যদেবতার ব্রত-পুত্রকামনা, সর্পভয়নিবারণ, এমনি সব কামনা ক’রে; এগুলি মেয়েরাই করে। যেমন অরণ্যষষ্ঠী, নাগপঞ্চমী, নিত্যষ্যষ্ঠী, সুবচনী, শীতলা, বুড়োঠাকরুণ, ঘেঁটু, কুলাই, মুলাই ইত্যাদি।
এই-সব গ্রাম্যদেবতার প্রতিদ্বন্দ্বীস্বরূপ কতকগুলি শাস্ত্রীয় দেবতা এবং তাঁদের ব্রত রয়েছে ; যেমন কার্তিকের ব্রত। ষষ্ঠীদেবী পূত্রদান করেন, কার্তিকও তাই। তাঁর পর ক কতকগুলি ব্রহ্মণদের মনগড়া ব্রত- যেমন দধিসংক্রান্তি, কলাছড়া, গুপ্তধন, ঘৃতসংক্রান্তি, দাড়িম্বসংক্রান্তি, ধন-গোছানো এগুলি কেবল নৈবেদ্য ও দক্ষিণার লোভ থেকে পূজারিরা সৃষ্টি করেছে। কলাছাড়ায় ব্রাহ্মণকে কলা দান, সন্দেশের ভিতর পয়সা দিয়ে গুপ্তধন, ঘৃত দাড়িম্ব এইসব জিনিস বিশেষ-বিশেষ তিথিতে ব্রাহ্মণকে দিলে ভালো হয়-এই ব্রতগুলির মূলকথাটা এ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর পর কতকগুলি ব্রত সম্পূর্ণ মেয়েদের সৃষ্টি; যেমন আদরসিংহাসন-স্বামীর আদর কামনা করে একটি স্বামীসোহাগনী সাজীয়ে-গুছিয়ে আদর-আপ্যায়নে খুশি করা-এবং আরও অনেক অশাস্ত্রীয় ব্রত, ঋতুর উৎসব, এর মধ্যে আসছে। এই যাগুলি সম্পূর্ণ মেয়েদের ব্রত, এইগুলি হলো লৌকিক বা লোকপরম্পরায় পুরাকাল থেকে দেশে চলে আসছে। এর মধ্যে শাস্ত্র এবং ব্রাহ্মণ দুয়েরই জায়গা নেই। যদিও এই-সব ব্রত অনেক শাস্ত্রের মধ্যে রূপান্তরিত করে নেওয়া হয়েছে তবু এখনও অনেকগুলি খাঁটি অবস্থায় পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণেরা লৌকিক ব্রতের স্থান কেমন করে দখল করতে চাচ্ছে নতুন নতুন ব্রত এবং নিজেদের শাস্ত্র ও দেবদেবীকে এনে, সেটাকে খুঁটিয়ে দেখতে হলে আর-একটা প্রকাণ্ড ইতিহাস লিখতে হয়; সুতরাং দু-একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে সেটা বোঝাব।
আদরসিংহাসন ব্রত, একটি সম্পূর্ণ মেয়েলি ব্রত; মহাবিষুব সংক্রান্তিতে এক স্বামীসোহাগিনী সধবা স্ত্রীকে যত্নপূর্বক নিজগৃহে ডাকিয়া আনিয়া পিঠালির দ্বারা বিচিত্র সিংহাসন রচনা করিয়া তাহাকে উপবেশন করাইবে, নাপিতাঙ্গনা দ্বারা হস্তপদের নখাদি ছেদন করাইয়া অলক্তরাগে চরণদ্বয় রঞ্জিত করাইয়া দিবে এবনফ তৈল হরিদ্রা ও করবীবন্ধনকরত সীমন্তদেশ সিন্দুররাগে রঞ্জিত করিবে এবং পুষ্পমালা প্রদানপূর্বক সুগন্ধদ্রব্য গাত্রে লেপন করিবে, পরে মনোহর দ্রব্যজাত সমাদরপূর্বক ভোজন করাইয়া বিদায় করিবে। এইরূপে সমস্ত বৈশাখ মাস-প্রতিদিবস এক এক জন অথবা একজনকেই আদর-অভ্যর্থনা ও অর্চনা, বর্ষ-চতুষ্টয় পূর্ণ হইলে উদযাপন । স্বামীর সোহাগ কামনা ক’রে এই মানুষ-পূজা মেয়েদের মধ্যে খুব চলছে দেখে পূজারি ব্রাহ্মণদের লোভ হলো; অমনি তারা এক ব্রত সৃষ্টি করলেন ব্রাহ্মণাদর ঃ মহাবিষুব সংক্রান্তিতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত বৈশাখ মাস প্রতিদিন এক এক অথবা একই ব্রাহ্মণকে নানা উপকরণে ভোজন করাইয়া দক্ষিণা দিবে; চারি বৎসরে উদযাপন। এমনি মধুসংক্রান্তি, মিষ্টসংক্রান্তি- নিজের কথা মিষ্ট হবে এবং শাশুড়ি-ননদের বাক্যযন্ত্রণা সইতে হবে না এই কামনা করে মেয়েরা যেমন নিজেদের মধ্যে ব্রত করেছে অমনি মধু আর মিষ্টান্নের চারি দিকে ব্রাহ্মণ-মাছি আস্তে আস্তে এসেছে দেখি—‘ব্রাহ্মণকে যজ্ঞোপবীতসহ লাড্ডুক দান করো’ ব’লে।
তারপর গ্রাম্যদেবতার পূজোগুলি, যেমন মনসা, শীতলা, সত্যপীর এগুলিকে শাস্ত্রীয় করে নিয়ে ব্রাহ্মণেরা কিছু সুবিধা করে নিলেন। মুসলমানের পীরকে লোকে যেমনি পুজো দিতে আরম্ভ (করল) অমনি তাঁকে সত্যনারায়ণ ব’লে প্রচার ক’রে ব্রতটির উপর হিন্দুধর্ম দখল বসালেন । কিন্তু বাংলায় সত্যনারায়ণের যে পাঁচালি তাতে পীরকে মুসলমানি পোশাকেই দেওয়া হয়েছে। কথা পর্যন্ত উর্দু, যেমন—জয় জয় সত্যপির সনাতন দস্তগির ইত্যাদি। এই
মুসলমান পীরের উপাসনা ও শিরনি ভট্টাচার্যদেরও ঘরে এসেছে ও চলেছে, কিন্তু এরই মধ্যে বাংলায় আজকাল ভাটপাড়ার পণ্ডিতেরা এই ব্রতে মুসলমানি অংশটাকে একেবারে চেপে দেবার চেষ্টায় রয়েছেন। ‘ব্রতমালাবিধান’ এর ভূমিকায় ভাটপাড়ার শ্রীবীরেশানাথ শর্মা লিখছেন ‘সত্য-নারায়ণের বাংলার পাঁচালি বহু পুরোহিতের অসস্মত বলিয়া ইচ্ছাসত্ত্বেও তাহা সন্নিবেশিত করিলাম না’ পিরের শিরনি বা ভোগটা ইচ্ছে সুজি বাতাসা, হিন্দুয়ানিতে বাঁধে না এমন-সব জিনিস; এবং পায়েসের দলে সেটা প্রায় চলে গেছে। এখন বাংলা পাঁচালি, যেটা থেকে মেয়েরা পর্যন্ত সহজে বুঝতে পারে যে পীর তিনি পীরই-বিষ্ণও নন সত্যনারায়ণও নন, সেই পাঁচালিটাকে লোপ করে দিতে পারলেই সত্যনারায়ণে হিন্দুত্ব নিষ্কণ্টক হয়ে যাবে।
আর-কতকগুলি ব্রত; যার নামটা রয়েছে পুরোনো কিন্তু ভিতরের মালমশলা সমস্তই নতুন-যেভাবে পেটেণ্ট ওষুধের নকল হয়ে থাকে কতকটা সেইরূপে কুক্কটীব্রতটি নামে অহিন্দু এবং বাস্তবিকই ছোটোনাগপুরের পার্বত্যজাতির এ ব্রতটি; কুক্কটী হলেন তাদের দেবী। এবং যেমন নানা অহিন্দু দেবতাকে, তেমনি কুক্কটী দেবীকেও এককালে লোকে পুজো দিতে আরম্ভ করেছিল। মৃতবৎসা-দোষনিবারন এবং তেজস্বী বহু সন্তান-লাভ হচ্ছে কুক্কুটীব্রতের ফল। আমাদের শাস্ত্র এটিকে যেমন করে গড়ে নিয়েছে তাতে ব্রতকথার সঙ্গে অনুষ্ঠানের যোগ নেই এবং অনুষ্ঠানের যে সংকল্প তাঁর সঙ্গে ব্রতকথার যে কামনা তারও মিল নেই। সংস্কৃত অনুষ্ঠানপদ্ধতি অনুসারে সংকল্প হলো, যথা-আদ্যেত্যাদি ভাদ্রে মাসি শুক্লে পক্ষে সপ্তম্যান্তিথাবরভ্য যাবজ্জীবপর্যন্তম অমুকগোত্রা শ্রীঅমুকী দেবী পাষণ্ডধর্মরাহিত্যপুত্রপৌত্র-ধনধান্যাতুলসর্বসম্পত্তিপ্রাপ্তিপূর্বকং শিবলোকপ্রাপ্তিকামা যথাশক্তি যথাজ্ঞানং ভবিষ্যপুরাণোক্ত-কুক্কুটীব্রতমহং করিষ্যে। পাছে কুক্কুটীব্রত করে অহিন্দুপুত্রসন্তান হয়, সেজন্য আগেই সাবধান হওয়া হচ্ছে—‘পাষণ্ডধর্মরহিত পুত্র’ যেন হয়। তারপর ‘শিবালোক প্রাপ্তি’। সেখানে কুক্কুটের আদিপুরুষ যে ময়ূরের ছানা, তর্কের বেলায় চাই কি তাঁকে হাজির করা যেতে পারে।অনুষ্ঠানের মধ্যে এই ভাবে আটঘাট বেঁধে পণ্ডিতেরা ব্রতকথাটিকে কাঁটাছেঁটা করতে বসলেন। ব্রতকথাগুলি হচ্ছে ব্রতটির উৎপত্তির ইতিহাস। সেটাকে ঠিক রাখলে তো ধরা পড়বার সম্ভাবনা এবং ব্রতকথাটা চলতি বাষায় বলা চাই, কাজেই ব্রতীর কামনা ও ব্রতের ফলাফল সেখানে ঠিকঠাক বজায় রাখা দরকার। শাস্ত্রে এই সমস্যা যেভ ভাবে মীমাংসা করলেন তা এইঃ ফলটি পরিষ্কার রইল-মৃতবৎসাদোষনিবারণ হয়, দীর্ঘজীবী পুত্র হয় এবং সুখে কালাতিপাত ও অন্তে শিবলোক। এ কটা বেশ সহজে মিলিয়ে দিয়ে পণ্ডিত ব্রতের উৎপত্তি নিয়ে পড়লেন। রাজা নহুষের রানী চন্দ্রমুখী এবং পুরোহিত-পত্নী মালিকা দেখলেন সরযূতটে উর্বশী, মেনকা এঁরা হাতে আঁটটি সুতোর আটপাত-দেওয়া ডোরা বেঁধে শিবপুজো করছেন। রানী প্রশ্নে অপ্সরাসকল উত্তর দিলেন, তারা কুক্কুটীব্রত করছেন। রানী স্বচক্ষে দেখলেন শিবপুজো হচ্ছে কিন্তু শুনলেন যে সেটা কুক্কুটীব্রত। গল্পের বাঁধুনিতে মস্ত একটা ফাঁকি রয়ে গেল। তাঁর পরে মালিকা আর চন্দ্রমুখী ব্রতের অনুষ্ঠান-প্রণালী জেনে নিলেন। এখানে শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানটাই দেওয়া হলো। তাঁর পর ব্রতের নামটা কেন যে কুক্কুটীব্রত হলো তার একটা মীমাংসা পণ্ডিতেরা আবিষ্কার করলেন-রানী চন্দ্রমুখী ব্রত করতে ভুললেন এবং মালিকা ভুললেন না। সেই ফলে চন্দ্রমুখীসুন্দরী হলেন বানরী, এবং মালিকা হলেন কুক্কুটীব্রতের ফলে জাতিস্মরা কুক্কুটী। তাঁর পর জন্মে জন্মে মালিকা ব্রত করে সুখে থাকেন, চন্দ্রমুখী দুঃখ পান; শেষে একদিন মালিকা দয়া করে চন্দ্রমুখীকে আবার ব্রত করতে শেখালেন। কুক্কুটীজন্মেও মালিকা ব্রত করেছিলেন, সেইজন্য ব্রতের নাম হল কুক্কুটীব্রত। ব্রতকথা ও অনুষ্ঠানের মধ্যে যে-সব ফাঁকি সেগুলো যে পণ্ডিতরা ধরতে পারেন নি তা নয়। ফসকা-গেরোকে আরও গেরো দিয়ে তারা কষে কিক্কুটীব্রতের সবটাকে ভবিষ্যপরাণের সঙ্গে বাঁধলেন; ব্রতকথা আরম্ভ হলো-শ্রীকৃষ্ণ উবাচ – বার বার পুত্রশোকে দেবকী রোদন করছেন দেখে লোমশ মুনি তাঁকে এই কিক্কুটীব্রতকথা বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন।
৮০৬
এ এক-রকম প্রক্রিয়া, যেখানে ব্রতের নাম হুবহু বজায় রেখে তাঁর অনুষ্ঠান ও উৎপত্তির ইতিহাস একেবারে বদলে ফেলা। আর-এক রকমের কারিগরি হচ্ছে নামটা পুরো নয়তো আধাআধি বদলে দেওয়া-অনষ্ঠান অনেকটা বজায় রেখে। প্রাচীন দেবতা আর হিন্দুর দেবতায় একটা মিটমাটের চেষ্টা এই রা’লদুর্গা ব্রতটি।হরপার্বতী পাশা খেলেছিলেন; হঠাৎ শীব পাশা ফেলে বললেন, ‘কার জিৎ?’ দুর্গা বললেন, ‘কার জিৎ?’ বডুর বাহ্মণ ছিলেন পাশে, বলে উঠলেন, ‘মা’র জিৎ?’ অমনি শিবের অভিসম্পাতে ব্রাহ্মণের কুষ্ঠব্যাধি। দুর্গার দয়া হলো।তন তাঁকে সূর্য-অর্ঘ দিয়ে রা’ল-দুর্গার ব্রতকরতে শিখিয়ে দিলেন। এখানে সূর্যও রইলেন, দুর্গাও রইলেন। সূর্যের প্রাচীন নাম রা’ বা রা’ল, বোঝালে এটি সূর্যপূজা; কিন্তু ‘রা’লদুর্গা’ বললে এটি দুর্গা ব্রত। এইভাবে ‘অথ ব্রতোৎপত্তি’ বিবরণ লেখা হল দুই দেবতারই মান বজায় রেখে, যেমন--
নমঃ নমঃ সদাশিবি তুম প্রানেশ্বর।
ভক্তিবাহনে প্রভু দেব দিবাকর।
হরগৌরীর চরণে করিয়া নমস্কার।
যাহার প্রচারে হল দেবীর প্রচার।
শুন সবে সর্বলোক হয়ে হরষিত।
বড়োই অশ্চর্য কথা সূর্যের চরিত। ইত্যাদি
শাস্ত্রীয় ব্রতগুলি কী কী প্রক্রিয়ার ফল তাঁর কতকটা আভাস পাওয়া গেল। স্ব ব্রতগুলিকে সমগ্রভাবে দেখার কাজ বড়ো সহজ নয়। প্রকান্ড একটা ব্রতপ্রকরণ না লিখলে শাস্ত্রপুরাণের জট ছাড়িয়ে আমাদের দেশের হিন্দুধর্মের পুরাণের পূর্বেকারও ব্রতগুলির নিঁখুত চেহারা বার ক’রে আনা কঠিন। তবে ব্রতগুলি যে আর্যগৃহের এবং আর্যহৃদয়ের ছবি নয়, সেটা ঠিক। আর্যের চেয়ে বরং অনার্যের— অন্যব্রতদের গৃহলক্ষ্মীর পদাঞ্চ এই-সব ব্রতের আলপনায়, ছড়ার ব্রতকথায় সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনার্য-অংশ শাস্ত্রীয় ব্রতগুলির মধ্যেও যথেষ্ট রয়েছে এবং সেই অংশগুলোকে হিন্দুপুরাণ ও তন্ত্রমন্ত্রের আবরণে ঢাকবার চেষ্টাও হয়েছে।কিন্তু সব সময় সে চেষ্টা সফল হয় নি দেখি।
লক্ষ্মীব্রতটি মেয়েদের একটি খুব বড়ো ব্রত। আশ্বিনপূর্ণিমায় যখন হৈমন্তিক শস্য ঘরে আসবে, তখনকার ব্রত এটি। সন্ধ্যার সময় লক্ষ্মীপূজা। সকাল থেকে মেয়েরা ঘরগুলি আলপনায় বিচিত্র পদ্ম, লতাপাতা এঁকে সাজিয়ে তোলে। লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, লক্ষ্মীপেঁচা এবং ধানছড়া হল আলপনায় প্রধান অঙ্গ। বড়ো ঘর, যেখানে ধানচাল, জিনিসপত্র রাখা হয়,সেই ঘরের মাঝের খুঁটির—মধুম খামের গোড়ায় নানা আলপনা- দেওয়া লক্ষ্মীর সম্পূর্ণ মূর্তি না লিখে কেবল মুকুট আর দুখানি পা কিংবা পদ্মের উপরে পা—এমনি নানারকম চিত্র দেওয়া হয়। খুঁটির গায়ে লক্ষ্মীনারায়ণ আর লক্ষ্মীপেঁচা বা পদ্ম, ধানছড়া, কলমিলতা, দোপাটিলতা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকা থাকে। চৌকির ডোল ও বেড়—ডালা ও বিঁড়ে। বেড়ের মধ্যে শুয়োরের দাঁত ও সিঁদুরের কৌটা এবং তাঁর উপরে নানারকম ফল ইত্যাদিতে পূর্ণ চেতনার পাতিল বা ভাঁড় রাখা হয়। রচনার পাতিলখানির গায়ে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন ও ধানছড়া; রচনার পাতিলটির উপরে লক্ষ্মীর সরা; সরার পিঠে লাল নীল সবুজ হলদে কালো এই কয় রঙে লক্ষ্মীনারায়ণ, লক্ষ্মীপেঁচা ইত্যাদির আলপনা। লক্ষ্মীর কাপড়ে সবুজ রঙ, গায়ে হলুদবর্ণ, কালীর পরিরেখ, এবং অধর ও পায়ের এবং করতলের জন্য লাল; নীলবর্ণ পটভূমিকার কারুকার্যে দেওয়া হয়। লক্ষ্মীসরার উর্ধে আধখানা নারিকেলের মালই—মেয়েরা এই মালইকে কুবেরের মাথা বা মাথার খুলি বলে। যশোর অঞ্চলে সবার পশ্চাতে একটি শীষ সমেত আস্ত ডাব—সেটিকে ঘোমটা দিয়ে, গহন ইত্যাদি দিয়ে অনেকটা একটি ছোটো মেয়ের মতো করে সাজানো হয়। এবং কলার খালুই নিয়ে ধানের গোলার অনুরূপ কতকগুলি ডোলা, তাতে নানাবিধ শস্য পূর্ণ করে আর একটি কাঠের খেলার নৌকোর প্রত্যেক গলুয়ে
নানাবিধ শস্য—ধান, তিল, মুগ, মুসুরি, মটর ইত্যাদি দিয়ে লক্ষ্মীর চৌকির সম্মুখে রাখার প্রথাও আছে। পূজা শেষ হওয়া পর্যন্ত ব্রতীর উপবাস। দেশভেদের কোনো গ্রামে লক্ষ্মী, নারায়ণ ও কুবের—এই তিনটিকে তিন রঙের পিটুলির আকারে গড়ে দেওয়া হয়। এমনি নানা গ্রামে অনুষ্ঠানের একীউ অদলবদল আছে।
মোটামুটি হিসেবে দেখা যায়, এই কোজাগরপূর্ণিমার ব্রতটির মধ্যে অনেকখানি অনার্য অংশ রয়েছে। শুইয়োরের দাত—যার উপরে ফলমূল মিষ্টান্নের রচনার পাতিল; কুবেরের মাথা—যেটা সব-উপরে রয়েছে দেখি; কিংবা সরার পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে একটি ঘোমটা-দেওয়া মেয়ের মতো ডাব—হলুদ-সিঁদুর মাখানো; আর পেঁচা ও ধানছড়া—এক লক্ষ্মীর বাহন, আর এক লক্ষ্মীর শস্যমূর্তি—এ কয়টিই অহিন্দু ও অনার্য বা অন্যব্রতদের। আমার এই কথা সমর্থন করার জন্য হিন্দুস্থানেই যদি প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয় তবে একটু মুশকিল। কেননা, শুয়োরের দাত—সে বরাহ-অবতারে যগে বেদ উদ্ধার করে পবিত্র হয়ে গেছে মড়ার মাথা—সেও তন্ত্রের মধ্যে দিয়ে মহাদেবের হাতে উঠেছে; বাকি থাকেন পেঁচা ও ধানছড়া; হয়তো গরুড়ের বংশাবলিতে পেঁচাকেও পাব, এবং ধানই যে লক্ষ্মী, সেটা তো লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে লুকোনো আছে। কিন্তু ভারত-সমুদ্র ছাড়িয়ে বহুদূর প্রশান্ত-মহাসাগরের পারেও যখন দেখি, ধানছড়া মূর্তিতে পুজা পাচ্ছেন ঠিক এমনি আর-এক মা-লক্ষ্মী বা ‘ছড়া-মা’ মেক্রিকো পেরু প্রভৃতি দেশের অনার্যদের মধ্যে, তখন কী বলা যাবে? শস্যসংগ্রহের কালে পেরুতে লোকেরা ভুট্টার ছড়গুলি দিয়ে তাদের মা-লক্ষ্মীর মূর্তিটি গড়ে। পূজার পূর্বে তিন রাত্রি জাগরণ করে ছড়ামাম্মা বা সরামাম্মাকে নজরে-নজরে রাখা নিয়ম। একে পূর্ণিমা-জাগারণ বা কোজাগর বলা যেতে পারে। পুজোর দিনে এরা ভুট্টাছড় বা এদের লক্ষ্মীমূর্তি সামনে রচনার পালিতে নানারকম খাবার সাজিয়ে একটি সিদ্ধ-করা ব্যাঙ সকলের উপরে রেখে; এবং সেই ব্যাঙর পিঠে একটি জনারের শীষের মধ্যে নানা শস্য—ভুট্টা, মুগ মুসুরি ইত্যাদি চূর্ণ করে ভরে গুঁজে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের মধ্যে মেয়েরা এলোচুলে নৃত্য
৮০৯
অনুষ্ঠানের মধ্যে মেরেরা এলোচুলে নৃত্য করতে করতে একটা কুমারীকে হলুদে-সিঁদুরে অলকা-তিলকা দিয়ে মুখটি সাজিয়ে—কতকটা আমাদের লক্ষ্মীপুজোর ডাবটির মতো—এবং নানা অলংকার ও ভালো কাপড় পরিয়ে পূজারির সামনে উপস্থিত করে। পূজারি কুমারীকে পূজা দেন ও সকলের একসঙ্গে নরবলির নাচ শুরু হয়। তাঁর পরে সেই কুমারীকে বলি দিয়ে তাঁর সদ্যছিন্ন রক্তমাখা হৃদপিণ্ডটি রচনার পাতালে রেখে পুরোহিত ছড়ামাম্মাকে প্রশ্ন করেন—মা, তুমি তুষ্ট হয়ে রইলে তো? যদি পুরোহিতের প্রতি আদেশ হয়—রইলুম, তবে জনারের ছড় তারা পূজার ঘরে তুলে রাখে, আর যদি আদেশ হয়—রইভ না, তবে জনারের ছড় পুড়িয়ে নতুন ছড়ামাম্মার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হয়।
লক্ষ্মীপূজার এদেশে আর-একটি অনুষ্ঠান রয়েছে, যেটা নজর করে দেখলে শাস্ত্রীয় লক্ষ্মীপূজা-পদ্ধতি যে অনার্য এবং প্রাচিন লৌকিক একটি ব্রতের স্থান পরে অধিকার করেছে, তা বেশ বোঝা যায়। গৃস্থের বড়ো-ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীপূজার পূর্বে, ঘরের বাহিরে একটি পূজা চলে; তাঁকে বলা হয় ‘অলক্ষ্মী বিদায়।’ একটি শাস্ত্রোক্ত দীপান্বিতা। লক্ষ্মীপূজার একাটি অনুষ্ঠান, যথা; প্রদোষসময়ে বহিদ্বারে গোময়নির্মিতঅলক্ষ্মীকে বামহস্ত দ্বারা পূজা করিবে। আচমানন্তে সামানার্ঘ্য ও আসনশুদ্ধি করিয়া অলক্ষ্মীর ধ্যান যথা—ওঁ অলক্ষ্মীং কৃষ্ণবর্নাং কৃষ্ণবস্ত্রপরিধানাং কৃষ্ণগন্ধানুলেপপনাং তৈলভ্যক্তশরীরাং মুক্তকেশীং দ্বিভুজাং বামহস্তে গৃহিত ভস্মনীং দক্ষিণহস্তে সম্মার্জনীং গর্দ্ভারূঢ়াং লৌহাচরণভূষিতাং বিকৃতদ্রংষ্টাং কলহপ্রিয়াম—এই বলিয়া ধ্যান করিয়া আবাহাপূর্বক অলক্ষ্মীঢ় পূজা; পুজান্তে পাঠ্য মন্ত্র যথা—ওঁ অলক্ষ্মী ত্বং কুরূপাসি কুৎসিতস্থানবাসিনী সুখরাত্রৌ ময়া দত্তাং গৃহ্ণ পূজ্যঞ্চ শাশ্বতীম। পরে গৃহমধ্যে গিয়া লক্ষ্মীপূজা যথাবিধি আরম্ভ—গৌরবর্ণাং সুরূপাঞ্চ সর্বালংকারভূষিতাম ইত্যাদি।
পাড়াগাঁয়ে মেয়েরা অলক্ষ্মী-বিদায় নিজারা করেনা; পূজারিকে দিয়ে এ-কাজ সারা হয়। এই অলক্ষ্মীই হলেন অন্যব্রতদের লক্ষ্মী বা শস্যদেবতা। শাস্ত্রে নিজেদের মা-লক্ষ্মীকে এও প্রাচীনা লক্ষ্মীর স্থানে বসিয়ে অলক্ষ্মী নাম দিয়ে কুরূপা-কুৎসিতা বলে একে ছেঁড়া চুল ও ঘরের আবর্জনার সঙ্গে বদায় দিতে চাইলেন। মেয়েরাও ব্রহ্মকোপের ভয়ে অলক্ষ্মীর পূজা জায়গা বাইরেই করলেন; এবং যথাবিধি পূজা করা না-করার দায়-দোষ সমস্তই পূজারিরাই নিতে হলো এবং এখানকার হিন্দু পরিবারে ব্রাহ্মধর্মের শালগ্রাম-ফেলার মতো তখনও একটু যে গোলযোগ না হলো তা নয়। মেয়েরা পূজারির কথা শুনে প্রাচীনা লক্ষ্মীকে বেশিরকম অপমান করতে ইতস্তত করলেন। এখন অলক্ষ্মী বলি আর যাই বলি, এক সময় তিনি তো লক্ষ্মী বলেই চলেছিলেন, কাজই তাঁর কতকটা সম্মান ধূর্ত পূজারি বজায় রেখে মেয়েদের মন রাখলেন ঃ নিজেরও মনে অলক্ষ্মী কোপের ভয় না-হচ্ছিল তা নয়; ঘরের বাইরে হলেও মা-লক্ষ্মী আগে অলক্ষ্মীর পূজা হবে,স্থির হলো।
লক্ষ্মীপূজোর সঙ্গে কলার পেটোর উপরে তিনটি পিটুলির পুতুল সবুজ হলুদ লাল তিন রঙ্গে প্রস্তুত করে রাখা হয়। এই পুতুলগুলির অনার্য লক্ষ্মীপূজার নিদর্শন। এই তিন পুতুলকে বলা হয়—লক্ষ্মী, নারায়ণ আর কুবের। কিন্তু এরা আসলে কি তা আমারা দেখব। সবুজ হলদে লাল পুতুল, আর অলক্ষ্মী-বিদায়ের ছেঁড়া খানিক মাথার চুল—এইগুলির কোনো অর্থ অন্যদেশের ধর্মানুষ্ঠানে পাই কিনা দেখি। মেক্রিকোতে কোজাগর লক্ষ্মীপূজোর মেয়েরা এলোকেশী হয়—শস্য যেন এই এলোকেশের মতো গোছা-গোছা লম্বা হয়ে ওঠে, এই কামনায়--
The women of the village wore their hair unbound, and shook and tossed it, so that by sympathetic magic the maize might take the hint and grow correspondingly long.
মেক্রিকোর পুরাণে আরও দেখা যাচ্ছে, শস্যে রক্ষয়িত্রী তিন বর্নের তিন দেবতা।
৮১০
একজন অপক্ক হরিৎ শস্যের সবুজ, এক ফলন্ত স্বর্ণশস্যের, এবং আর-এক আতপতপ্ত সুপক্ক শস্যের সিন্দুরবর্ণ।
মেস্কিকোতেও শস্যের নানা অবস্থায় এক-এক দেবী রক্ষা করেন। তাদের নাম হচ্ছে centeotl এবং তাদের একজন Xilonen সবুজ-অপক্ক-শস্যের অধিষ্ঠাত্রী--
A special group of deities called centeotl presided over the agriculture of Mexico, each of whom personified one or other of the various aspects of the Maize plant…Xilomen-the typified the xilote or green ear of the Maize.
আমাদের দেশে মেয়েরা প্রধানত তিনটি বড়ো লক্ষ্মীব্রত করে থাকেন প্রথম ফাল্গুন মাসে বীজ বপনের পূর্বে। চাষিরাই বেশি এ ব্রত করে—রবিবারে আর বৃহস্পতিবারে। একে বলা যেতে পারে হরিতা-দেবী—সবুজবর্ণ। এই পূজা ক’রে তবে ঘর থেকে বপনের বীজ বার করা হয় ।দ্বিতীয় লক্ষ্মীব্রত হচ্ছে আশ্বিনে কোজাগর পূর্ণিমায় যখন সোনার ফসল দেখা দিয়েছে। ইনি হলেন স্বর্নলক্ষ্মী, হলুদবর্ণ। তৃতীয় লক্ষ্মীব্রত হলো অঘ্রানে, যখন পাকা ধান ঘরে এসেছে—ইনি অরুণা লক্ষ্মী। মেয়েরা বছরে আরও কয়েকবার লক্ষ্মী ব্রত করেন, যেমন ভাদ্রে, কার্তিকে ও চৈত্রে। কিন্তু সেগুলি ঐ তিন লক্ষ্মীব্রতেরই ছাঁচে ঢালা। দেখা গেল, প্রাচীন লক্ষ্মীব্রতের অনার্য কতকগুলি গেল ঘরের বাইরে, যেমন অলক্ষ্মী;কতক রইল ঘরের মধ্যে, যেমন কুবেরের মাথা ও তিম পুতুল ইত্যাদি। সব চেয়ে বড়ো লক্ষ্মীপূজো কজাগরপুর্ণিমায়। তারই ব্রতকথা থেকে বেশ বোঝা যায়, অলক্ষ্মী আর লক্ষ্মী দুই দেবতার পূজা নিয়ে দেশের মধ্যে একসময় বেশ-একটু গোলযোগ চলেছে। কথাটি এই ঃ
এক দেশের রাজার নিয়ম ছিল হাটে কেউ কিছু যদি বিক্রি করে উঠতে না পারত, তবে তিনি রাজভাণ্ডার থেকে হাট শেষ হলে হতাশকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ঝড়তিপড়তি সবই নিজের জন্যে কনে রাখতেন। এমনি একদিন এক লোহার দেবীমূর্তি এক কামারের কাছ থেকে হাট শেষে রাজা কিনলেন, কামার যখন রাজবাড়ির সামনে দিয়ে হেঁকে যাচ্ছিল। রাজা সত্যপালনের জন্যে সেই লহার দেবী কিনলেন এবং ঘরে আনলেন । লোহার মূর্তি ছিল অলক্ষ্মী; লক্ষ্মী অমনি সেই রাত্রেই বিদায় হয়ে যান; রাজা বললেন, আমি সত্যপালন করেছি এতে দোষ কী? লক্ষ্মী রাজাকে বর দিলেন, তিনি পশুপক্ষীর কথা বিঝবেন কিন্তু লক্ষ্মী আর রাজ্যে রইলেন না। এমনি-এমনি প্রথমে রাজলক্ষ্মী তার
৮১১
পর ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, সবাই একে-একে গেলেন; তাঁর পর ধর্ম আর কুললক্ষ্মী চলেছেন। রাজা ধর্মকে বললেন—কুললক্ষ্মী যেতে চান তো যান, কিন্তু ধর্ম, আপনিতো যেতে পারেন না, কেননা আমি সত্যধর্ম পালন করতেই এ কাজ করেছি। ধর্মরাজ বাড়িতেই রইলেন।
এর পরের কথাটুকুন মর্ম ঃ রানী দেখেন রাজা পিঁপড়েদের দিকে চেয়ে একদিকে ভোজনের সময় হেসে উঠলেন। পিঁপড়েগুলো রাজার পাতে খাবার সময় ঘি না দেখে, রাজাটা যে গরিব এই বলাবলি করছিল। রাজা হঠাৎ হাসলেন কেন, এই কথা রানী জানতে চাইলে, অনেক পেড়াপিড়িতে রাজা সম্মত হয়ে—কথাটা প্রকাশ করলে তাঁর মৃত্যু জেনেও—গঙ্গাতীরে রানীকে নিয়ে গিয়ে একটা ছাগল আর ছাগলির ঝগড়া শুনলেন। নদীর মধ্যে একবোঝা ঘাস দেখা ছাগলি সেটা চাচ্ছে আর ছাগল তাঁকে বলছে, আমি কি রাজার মতো বোকা যে তাঁর কথায় প্রান হারাতে যাব। রাজা তখন রানীকে তাড়িয়ে দিলেন। তাঁর পর রানী অনেক কষ্টে লক্ষ্মীপূজো ক’রে তবে রাজা রাজ্য সব ফিরিয়ে আনলেন। দুই ধর্ম, দুই দেবী, দূই দল মানুষের যে দুই পূজো নিয়ে একটি বেশ গোলযোগ চলছিল এবং শেষে নতুন লক্ষ্মীই যে দেশের প্রাচীন লক্ষ্মীর পূজা দখল করেছিলেন এবং হাটে যে পূর্বকালে প্রাচীনা লক্ষ্মী মূর্তি বিক্রি হতে আসত এবং সেটা রাজা কিনে ধর্মলোপের ভয় করেন নি, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
মেয়েরা যে মাসে লক্ষ্মীব্রত করছে এবং অন্য দেশের লক্ষ্মীপূজোর সঙ্গে আমাদের পূজাটি মিলিয়ে দেখলে দেখি যে, লক্ষ্মীব্রত হচ্ছে দেশের তিন প্রধান শস্য উৎসব। কিন্তু পুজারিরা লক্ষ্মীব্রতের মাহাত্ম্য বর্ণন করে যে শ্লোকটি মেয়েদের শুনিয়ে দেন, সেটা থেকে কিছুতে বোঝা যাবে না যে এই ব্রত অফলন্ত, ফলন্ত এবং সুপক্ক শস্যের উৎসব-অনুষ্ঠান। শাস্ত্রীয় শ্লোক বলছে--
লক্ষ্মীনারায়ণ ব্রত সর্বব্রত সার
এ ব্রত করিলে ঘোচে ভবের আঁধার।
বন্ধ্যা নারী পুত্র পায়, যায় সর্ব দুখ,
নির্ধনের ধন হয়, নিত্য বাড়ে সুখ।
ধানের কি কোনো শস্যের নামগন্ধ এতে পাওয়া গেলনা। প্রাচীন কালের প্রধান উৎসব এবং শস্য-দেবতারা খুবই প্রসিদ্ধ বলে এই ব্রতকে হিঁদুয়ানির চেহারা দেবার জন্য এর উপর এত জোড়াতাড়ার কাজ চলেছে যে আসল ব্রতটি কেমন ছিল, তা আর এখন কতকটা কল্পনা করে দেখা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু যে ব্রতগুলি ছোটো এবং অপ্রধান বলে শাস্ত্রের
৮১২
হাত থেকে বেঁচে গিয়ে অনেকটা অটুট অবস্থায় রয়ে গিয়েছে তাঁর থেকে ব্রতের খাঁটি ও নিখুঁত চেহারাটি পাওয়া সহজ। যেমন এই ‘তোষলা’ ব্রতটি। কোথাও একে বলে ‘তুঁষতুষলি’। পূর্ববঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে দু জায়গায় এই ব্রতের চলন আছে।ন প্রতিদিন পৌষ মাসের সকালে মেয়েরা এই ব্রতটি করে। ব্রতের বিধি এই; অঘ্রানের সংক্রান্তি থেকে পৌষের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি সকালে স্নান করে গোবরের ছ-বুড়ি ছ-গণ্ডা বা ১৪৪টি গুলি পাকিয়ে, কালো দাগশূন্য নতুন সরাতে বেগুনপাতা বিছিয়ে তাঁর উপরে গুলি ক’টি রাখতে হয়। প্রত্যেক গুলিতে একটি করে সিঁদুরের ফোঁটা এবং পাঁচগাছিকরে দূর্বাঘাস গুঁজে দিতে হয়। তাঁর উপরে নতুন আলোচালের তুঁষ ও কুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে, সরসে শিম মূলো ইত্যাদি ফুল দিয়র ছড়া বলা হয়। ব্রতের নাম এবং উপকরণগুলি থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এটি সারমাটি দিয়ে ক্ষেত উর্বর করে তলায় ব্রত।ব্রতের ছড়াগুলি পূর্ববঙ্গে এক, পশ্চিমবঙ্গে আর-এক হলেও ছড়াগুলি পড়তে পড়তে পল্লীগ্রামের সহজ জীবনযাত্রার এমন একটি পরিষ্কার ছবি মনে জাগিয়ে তোলে, যেটা কোনো শাস্ত্রীয় ব্রতে আমরা পাই না। পৌষমাসে এদেশে বেশ একটু শীত, এবং সকালবেলার ব্রত এটি, কাজেই আমরা অনায়াসে কল্পনা করতে পারি, বহুযুগ আগেকার বাংলাদেশের একখানি গ্রামের উপর রাত্রির যবনিকা আস্তে সরে গেল; সঙ্গে সঙ্গে আমারা দেখাছি শীতের হাওয়া বইছে—গ্রামের উপর বড়ো গাছের আগায় এখনও কুয়াশা পাতলা চাদরের মতো লেগে রয়েছে; শিশিরে সকালটি একটু ভিজে-ভিজে; বেড়ার ধারে আর চালে চালে শিমপাতার সবুজ; খেতে খেতে মুলোর ফুল, সরষে ফুল—দুধ আর হলুদের ফেনার মতো দেখা যাচ্ছে নতুন সরায় বেগুনপাতা চাপা দিয়ে, সারমাটি নিয়ে মেয়েরা দলে দলে তোষলা ব্রত করতে ক্ষেতের দিকে চলল এবং সেখানে মূলোর ফুল, শিমের ফুল, সরষের ফুল দিয়ে ব্রত আরম্ভ হলো।
প্রথম, তোষলার স্ততি--
তুঁষ-তুঁষলি,তুমি কে।
তোমার পূজা করে যে--
ধনে ধানে বাড়ন্ত,
সুখে থাকে আদি অন্ত।।
তোষলা লো তুঁষকুন্তি।
ধনে ধানে গাঁয়ে গুন্তি,
ঘরে ঘরে গাই বিঊন্তি।।
তাঁর পর অনষ্ঠান-উপকরণের বর্ণনা, যেমন--
গাইয়ের গোবর, সরষের ফুল,
আসনপিঁড়ি, এলোচুল,
গেয়ের গোবরে সরষের ফুল
ঐ ক’রে পূজিন আমার মা-বাপের কুল।
‘আসনপিঁড়ি, এলোচুল’। এখানে আমারা সেই মেক্রিকোর মেয়েদের এলোচুলে ব্রত করার প্রতিচ্ছবিটি পাচ্ছি। এর পরে মেয়েরা তোষলা ব্রতের কামনা জানাচ্ছে--
কোদাল-কাটা ধন পাব,
গোহাল-আলো গোরু পাব,
দরবার-আলো বেটা পাব,
সভা-আলো জামাই পাব,
সেঁজ-আলো ঝি পাব,
ঘর করব নগরে,
মরব গিয়ে সাগরে,
জন্মাব উত্তম কুলে,
৮১৩
তোমার কাছে মাগি এই বর--
স্বামী পুত্র নিয়ে যেন সুখে করি ঘর।
তাঁরপর পৌষের সংক্রান্তির দিনে মেয়েরা সূর্যোদয়ের পূর্বে ব্রত সাঙ্গ করে একটি সরায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সেগুলি মাথায় নিয়ে সারি বেঁধে নদীতে স্নান করে তোষলা ভাসাতে চলেছে। পায়ের তলার মাটি ঠাণ্ডা; হিম বাতাস নদীর শীতল জলের পরশ পেয়ে কনকনে বইছে। এই শীতের জল-স্থল-আকাশের প্রতিধ্বনি দিচ্ছে মেয়েরা নদীতে যাবার পথে--
কুলকুলনি এয়ো রানী,
মাঘ মাসে শীতল পানি,
শীতল শীতল ধইলো,
বড়ো গঙ্গা নাইলো।
এর পর নিথর শীতের মধ্যে সূর্য্র ও পৃথিবীর মিলনের একটু আশা আকাঙ্ক্ষা জাগল--
শীতল শীতল জাগে,
রাই বিয়ে মাগে।
এর পর গঙ্গাতীরে জলের কলধ্বনি, পাখিদের কাকলির সঙ্গে সূর্য্র বরযাত্রার বাদ্য বাজছে--
আমাদের রায়ের বিয়ে
ঝাম-কুর-কুর দিয়ে।
তখনও রাত্রের শিশিরে -ভেজা শাকসবজির পাতাগুলি ঘুমিয়ে রয়েছে; সেই সময় বরবেশে সূর্য আসছেন; তারই সূচনা একটু ঝিকমিকে সোনার আলো।
বেগুনপাতা ঢোলা-ঢোলা
রায়ের কানে সোনার তোলা।
এইখানে নদীতে তোষলার সার ভাসিয়ে, তোষলার সারমাটি আর সূর্য, চাষের দুই প্রধান সহায়কে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মেয়েদের জলে ঝাঁপাঝাঁপি বালিখেলা--
তোষলা গো রাই, তোমর দৌলতে আমার ছ_বুড়ি পিঠে খাই
ছ-বুড়ি ন-বুড়ি, গাঙসিনানে যাই, গাঙের বালিগুলি দুহাতে মোড়াই,
গাঙের ভিতর লাডুকলা ডবডবাতে খাই।
তুষলি গো রাঙ্গ,তুষলি গো ভাই,
তোমার ব্রতে কিবা পাই?
ছ-বুড়ি ছ-গণ্ডা গুলি খাই,
তোমাকে নিয়ে জলে যাই,
তুষ-তুষলি গেল ভেসে বাপ-মার ধন এলে হেসে
তুষ-তুষলি গেল ভেসে আমার সোয়ামির ধন এল হেসে।
এর পর, সূর্যর উদয় দর্শন করে, স্নান করে, ব্রতশেষে নদীতীরে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় বর্ণন করে ছড়া--
রায় উঠছেন রায় উঠছেন বড়ো-গঙ্গার ঘাটে।
কার হাতে রে তেল-গামছা?দাওগো রেয়ের হাতে।
রায় উঠছেন রায় উঠছেন মেজো-গঙ্গার ঘাটে।
কার হাতে রে শাখা সিঁদুর দাওগো রেয়ের হাতে।
রায় উঠছেন রায় উঠছেন ছোটো-গঙ্গার ঘাটে।
রায় উঠছেন অন্নে, তামার হাঁড়ির বর্ণে,
তোমার হাঁড়ি, তোমার বেড়ি--
এর শেষটুকুতে হিঁদুয়ানি আপনার নাম দস্তখত করে এক আঁচড় দিয়েছে—‘উঠ উঠ মা-গৌরী নিবেদন করি’। হঠাৎ মা-গৌরী এসে কেন যে বেড়ি ধরেন তা বোঝা গেল
৮১৪
না। ঝকঝকে আয়নায় উপরে পেরেকের আঁচড়ের মতো এই শেষ লাইনটা; বা যেন মিশনারি-স্কুলে-পড়া মেয়ের মুখে—‘বড়ো মেম নমস্কার’—খাপছাড়া, শ্রুতিকটু, অর্থহীন। এর পরে মেয়েরা ঘরে এসে পোষমাসের পিঠে খাবার আয়োজন করে যে ছড়া বলেছে—সেটাও এ-লাইনটার চেয়ে সহজ আর সুন্দর।–
আখা জ্বলন্তি, পাখা চলন্তি,
চন্দন-কাষ্ঠে রন্ধনঘরে,
জিরার আগে তুষ পোড়ে,
খড়িকার আগে ভোজন করে,
প্রান স্বচ্ছন্দে নতুন বসতে
কাল কাটাব মোরা জন্মায়স্তে।
তোষলা ব্রতের অনুষ্ঠানে, এই শীতের প্রভাতের দৃশ্যপটগুলি, আর সদ্যস্নাত মেয়েদের মুখে সিন্দুর এবং মার্জিত তামার বর্ণ রক্তবাস সূর্যের উজ্জ্বল বর্ণনা—আমাদের সহজেই সেইকালের মধ্যে দিয়ে যায় যেখানে দেখি মানুষে আর বিশ্বচরাচরের মধ্যে সরস একটি নিগূঢ় সম্বন্ধ রয়েছে; গড়াপেটা শাস্ত্রীয় ব্রতের এবং হিন্দুয়ানির আচার-অনুষ্ঠানের চাপনে মানুষের মন যেখানে সব দিক দিয়ে অনুর্বর , নিরানন্দ এবং প্রাণহীন হয়ে পড়ে নি। এই তোষলা ব্রতের জীবন্ত দৃশ্যকাব্যটির সঙ্গে ছোটো একটি শাস্ত্রীর ব্রত মিলিয়ে দুয়ের মধ্যে কী নিয়ে যে পার্থক্য তা স্পষ্ট ধরা পড়বে। হরিচরণ ব্রত—বছরের প্রথম মাসে, খুব ছোটো মেয়েরা এই ব্রত করছে চন্দন দিয়ে তামার টাটে হরিপাদপদ্ম লিখে। কিন্তু এই ব্রতে ছোটো মেয়ের মুখের কথা বা প্রানের আনন্দ, এমন কি ছোটো খাটো আশাটুকু পর্যন্ত নেই। পাকা- পাকা কথা এবং জ্যাঠামিতে ভরা এই শাস্ত্রীয় ব্রতটি অত্যন্ত নীরস। হরির পাদপদ্মের পুজো দিয়ে পাঁচ-ছয় বছরের ছোটো মেয়েগুলি বর চাইছে—গিরিরাজ বাপ, মেনকার মতো মা,রাজা সোয়ামি, সভা-উজ্জ্বল জামাই গুণবতী বউ, রূপবতী ঝি, লক্ষ্মণ দেবর, দুর্গার আদর—‘দাস চান, দাসী চান, রুপার খাটে পা মেলতে চান, সিঁথে সিঁদুর, মুখে পান, বছর-বছর পুত্র চান’।আর চান—‘পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে একগলা গঙ্গাজলে মরণ’ এবং “উষোতে পারলে ইন্দ্রের শচীপনা, না পারলে কৃষ্ণের দাসীগিরি’।
হরিচরণ ব্রত করছে এই যে মেয়েগুলি বৈশাখের সকালবেলায়, আর শীতের সকালে শীর্ণধারা নদীতীরে, তোষলা ব্রতের দিনে, সরষে শিম এমনি নানা ফুলে সাজনো সরা ভাসিয়ে স্রোতের জলে নেমে, সূর্যের উদয়কে এবং শস্যের উদগমকে কামনা যা মেয়েগুলি—এই দলে কী পার্থক্য, দুই অনুষ্ঠানেই বা কী না তফাৎ। একদল একগলা গঙ্গাজলে আত্মহত্যায় উদ্যত; অন্যদল বিশ্বচরাচরের সঙ্গে সূর্যের আলোতে হলুদ, আর সাদা ফুলে-ফুলে-রা ক্ষেতের মতো জেগে ওঠবার জন্যে আনন্দে উদগ্রীব।
প্রত্যেক ঋতুর ফুলপাতা, আকাশ-বাতাসের সঙ্গে এই-সব অশাস্ত্রীয় অথচ একেবারে খাঁটি ও আশ্চর্যরকম সৌন্দর্যে রসে অ শিল্পে পরিপূর্ণ বাঙালির সম্পূর্ণ নিজের ব্রতগুলির যে গভীর যোগ দেখা যাচ্ছে, তাতে করে এগুলিকে ধর্মানুষ্ঠান বলব কি ষড়ঋতুর এক-একটি উৎসব বলব ঠিক করা শক্ত চৈত্রের এই অশত্থপাতার ব্রত—যার সমস্ত অনুষ্ঠানের অর্থ হচ্ছে কিশলয় থেকে ঝরে-পড়া পর্যন্ত কচি কাঁচা পাকা এবং শুকনো পাতার একটুখানি ইতিহাস তাঁকে কী বলব।
বসন্তের বাতাস লেগে গত শিতের শুকনো পাতা গাছের তলায় ঝরে পড়েছে; নদীর ধারে অশত্থ, কুঞ্জলতা, চাঁপাসুন্দরী আর শ্যাম পণ্ডিতের ঝি—কেউ পাকা পাতায় তামাটে লাল, কেউ কাঁচা পাতায় সতেজ সোনালি সবুজ, কেউ কচি পাতার কোমল শ্যাম, কেউ শুকপ্নো পাতায় তপ্ত সোনা, কাউ বা ঝরা পাতায় পাণ্ডুর রঙে সেজেছে। অশত্থপাতা, কুঞ্জলতা, চমকাসুন্দরী; আর এই তিন বনসুন্দরী সঙ্গে সেজেগুজে ব্রত করতে বেরিয়েছেন শ্যাম পণ্ডিতের ঝি। শ্যাম পণ্ডিতের সাত-সাত বউ, জোয়ান সাত বেটা, পণ্ডিতের গিন্নি,
৮১৫
আর বুড়ো পণ্ডিত নিজে—ছোটো-বড়ো আরো -বড়ো একেবারে বুড়ো—কচি মেয়েটি, কাঁচা বয়সের বউ-বেটা, পাকা গিন্নি আর বিষম শুকনো কর্তা।
অশত্থপাতা কিঞ্জলতা চমকাসুন্দরী
গঙ্গাস্নান করতে গেলেন শ্যামপণ্ডিতের ঝি;
সাত বউ যায় সাত দোলায়, সাত বেটা যায় সাত ঘোড়ায়,
কর্তা যান গজহস্তীতে, গিন্নি যান রত্নসিংহাসনে,
ঠাকুর ঠাকরুন দোলেন যান।
এই ছড়াটি পরিষ্কার বোঝাচ্ছে, বসন্তের দিনে নদীর ধারে চাঁপা কুঞ্জলতা অশত্থ এদের একটা উৎসব চলেছে—সবুজ পাঙাশে নতুন ফুটে-ওঠা থেকে আস্তে ঝরে পড়ায়; দলে দলে বুড়োবুড়ি ছেলেমেয়ে যুবক-যুবতী এই-সব উৎসব দেখতে আসছে—কেউ হেলতে দুলতে, কেউ নাচতে নাচতে, কেউবা গজেন্দ্র গমনে। এর পরেই ঠাকুর ঠাকুরুন। এঁরা যে কোন দেবতা তা বলা যায় না—শিব-দূর্গা হতে পারেন, লক্ষ্মী-নারায়ণ হতে পারেন, পিতৃপুরুষদেরও কেউ হতে পারেন। এঁদের দুজনে কথা হচ্ছে--
ঠাকুর জিজ্ঞাসেন। ঠাকুরুন। নরলোকে গঙ্গার ঘাটে কী ব্রত করে?
উত্তর। অশত্থপাতার ব্রত করে।
প্রশ্ন। এ ব্রত করলে কী হয়?
উত্তর। সুখ হয়,সহায় হয়,সোয়াস্তি হয়।
এর পর ঠাকুর দেখলেন ছেলেবুড়ো সবাই মিলে একটি করে পাতা মাথায় রেখেছে আর জলে ডুব দিচ্ছে আর পাতাগুলি জলের স্রোতে ভেসে চলেছে। ঠাকুর ভেবেপান না মানুষরা সব করে কী? এই বসন্তকালে, লোকে এ কী পাগলামি করতে লাগল। তখন ঠাকরুন তাঁর কৌতুহল চরিতার্থ করে বলছেন, এরা গাছে আর মানুষে মিলে এক-এক পাতার কামনা জানয়ে ব্রত করেছে।
এরা—পাকা পাতাটি মাথায় দিয়ে পাকা চুলে সিঁদুর পরে।
কাঁচা পাতাটি মাথায় দিয়ে কাঁচা সোনার বর্ণ হয়।
শুকনো পাতাটি মাথায় দিয়ে সুখ-সম্পত্তি বৃদ্ধি করে।
ঝরা পাতাটি মাথায় দিয়ে মণিমুক্তোর ঝুরি পরে।
কচি পাতাটি মাথায় দিয়ে কোলে কমল পুত্র ধরে।
এই ব্রতটিতে বসন্তদিনে মানুষে আর গাছপালায় মিলিয়ে একটুখানি রূপক—ছোটো একটু নাটকের মতো করে গাঁথা হয়েছে ছাড়া আর কী বলা যাবে? এই তো একটু খানি ব্রত, কিন্তু তবু এর মধ্যে বসন্তের দিনে নতুন এবং পুরনোর, মানুষের এবং বনের নিশ্বাসটুকু যখন এক তালে উঠছে পড়ছে দেখি তখন এটিকে ছোটো বলতে ইচ্ছা হয় না; এইটুকুর মধ্যে কতখানির ইঙ্গিতব কতখানি রস না পাচ্ছি।
খাঁটি মেয়েলি ব্রতগুলি ঠিক কোনো দেবতার পূজো নয়; এর মধ্যে ধর্মাচরণ কতক, কতক উৎসব; কতক চিত্রকলা নাট্যকলা গীতকলা ইত্যাদিতে মিলে একটুখানি কামনার প্রতিচ্ছবি, কামনার প্রতিধ্বনি, কামনার প্রতিক্রিয়া। মানুষের ইচ্ছাকে হাতের লেখায় গলার সুরে এবং নাট্য নৃত্য এমন নানা চেষ্টায় প্রত্যক্ষ করে তুলে ধর্মাচরণ করেছ, এই হল ব্রতের নিঁখুত চেহারা। অন্তত এই প্রণালীতে সমস্ত প্রাচীন জাতিই ব্রত করছে দেখতে পাই।
‘আদর-সিংহাসন’ ব্রতে মানুষেরভ আদর চেয়ে মিষ্টি কথা পাবার কামনা ক’রে তো শাস্ত্রীয় হরিচরন-ব্রতের মতো তামার টাটে দেবতা পাদপদ্ম লিখে পূজা ক’রে বরপ্রার্থনা করছে না। সে যে-আদরটি কামনা করছে সেটা একটি জীবন্ত প্রতিমার মধ্যে ধরে দেখবার আয়োজন করছে। সত্যি এক সবামী-সোহাগিনীকে সমানে বসিয়ে বসনভূষণে সাজিয়ে যেমন্ন আদর সে নিজে কামনা করছে তেমনি আদর তাঁর মূর্তিমতী কামনাকে অর্পন করছে এবং জানছে যে এতেই তাঁর আদর পাওয়ার কামনা চরিতার্থ হবে নিশ্চয়। এইখানে ব্রত আর পুজোতে
৮১৬
তফাত।
মেয়েলি ব্রতগুলির সব-কটি খাঁটি অবস্থায় পাওয়া যায় না। কালে কালে তাদের এত ভাঙচুর অদলবদল উলটোপালটা হয়ে গেছে যে, কোনটা পুজো কোনটা পুজো কোনটা ব্রত ধরতে হলে আদর্শ বেরের লক্ষণগুলির সঙ্গে মিলিয়ে না দেখলে গোলে পড়তে হয়। খাঁটি ব্রতের লক্ষণ মোটামুটি এই বলে নির্দেশ করা যেতে পারে; প্রথমত, খাঁটি ব্রতে ব্রতীর কামনার সঙ্গে ব্রতের সমস্তটার পরিষ্কার সাদৃশ্য থাকা চাই; দ্বিতীয়ত, ব্রত হতে হলে একের কামনা অথবা একের মনের দোলা দশকে দুলিয়ে একটা ব্যাপার হয়ে নাচে গানে ভোজে ইত্যাদিতে অনুষ্ঠাত হয়া দরকার।
কামনা এবং তাঁর চরিতার্থতার জন্য ক্রিয়া যখন একেরই মধ্যে কিংবা অসংহতভাবে দশের মধ্যে ছাড়াছাড়ি অবস্থায় রইল তখন এই একেরই সঙ্গে বা একে-একে দশের সঙ্গে তাঁর লোপ হয়ে গেল। কিন্তু এক ভাবে এক ক্রিয়া যখন সমস্ত জাতিকে প্রেরণা দিলে তখন সেটা ব্রত হল, এবং বেঁচেও রইল দেখি।
আমাদের একটি ভুল ধারণা ব্রত সম্বন্ধে আছে। আমরা মনে করি যে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধর্ম ও নীতি শেখাতে মেয়েদের জন্যে আধুনিক কিণ্ডারগার্টেন প্রণালীর মতো ব্রত-অনষ্ঠানগুলি আবিষ্কার করে গেছেন। শাস্ত্রীয় ব্রতগুলি কতকটা তাই বটে, কিন্তু আসল মেয়েলি ব্রত মোটেই তা নয়। এগুলি আমাদের পূর্বপুরুষের পূর্বেকার পুরুষদের—তখনকার, যখন শাস্ত্র হয়নি, হিন্দুধর্ম বলে একটা ধর্মও ছিল না এবং যখন ছিল লোকেদের মধ্যে কতকগুলি অনুষ্ঠান, যেগুলির নাম ব্রত।
এই-সব ব্রতের মূলে কীসের প্রেরণা রয়েছে বলা শক্ত। মানুষের ধর্ম প্রবৃত্তি না মানিষের শিল্পসৃষ্টির বেদনা থেকে জন্মলাভ করেছে এই ব্রতগুলি, সেটা পরিষ্কার করে দেখার পূর্বে ব্রতগুলির সঙ্গে পরিচয় আরও একটু ঘনিষ্ঠ করে নেওয়া দরকার।
প্রথমে দেখি কতকগুলি ব্রত যাতে কামনা এবং আলপনা ও ছড়া একটি অন্যকে অনুকরণ করে প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন , কামনা হল সোনার চিরুনি, সোনার কৌটো, আয়না, পালকি। সেখানে পিটুলির আলপনা দিয়ে একটা চিরুনি, একটা কৌটো, পালকি একটা, আয়না একটা আঁকা হলো এবং তাতে ফুল ধরে ধরে বলা হলো--
আমরা পূজা করি পিঠালির চিরুনি,
আমাগো হয় যেন সোনার চিরুনি।
আমারা পূজা করি পিঠালির কুটুই,
আমাগো হয় যেন সোনার কুটুই।
আমরা পূজা করি পিঠালির পালকি,
আমাগো হয় যেন সোনার পালকি।
এখানে, চিরুনি-দেবতা কৌটো দেবতা পালকি-দেবতা ইত্যাদিকে পূজা করে বর চাওয়া। একেবারে কাজের কথা, একং যতটুকু কাজের কেবল ততটুকু, একটু বাজে কিছু নেই। যা চাই তারই অনুরূপ অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে কল্পনা করে বরপ্রার্থনা।
আর-এক রকম, তাতে কামনার অনুরূপ ছড়া, কিন্তু আলপনাটি ভিন্নরূপ। মাদার গাছ এঁকে বলা হচ্ছে--
আমরা পূজা করি চিত্রের মান্দার,
আমাগো হয় যেন ধান চাউলের ভাণ্ডার।
আমরা পূজা করি পিঠালির মান্দার,
সোনার রুপার আমাগো ঘর আন্ধার।
মাদারগাছের সঙ্গে ধানচাল সোনা-রুপোর পরিষ্কার যোগ নেই অথচ তাতে ফুল দিয়ে বর চাওয়া হলো এবং এখানেও কাজের জন্য যতটুকু ততটুকু হলো আলাপন, এবং ততটুকু হলো ছড়া। গদ্যসাহিত্য আধুনিক, সুতরাং কথায় এখন যা বলি, পূর্বে যখন পদ্যই সাহিত্যের
৮১৭
ভাষা তখন ছড়াগুলি গদ্যেই বলা হতো। কিন্তু এই ধরনের ছড়াকে কবিতা কিংবা গান কি নাটক কিছুই বলা যায় না। এরা কেবল পদ্যে মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করছে, এই মাত্র। ‘জল দে বাবা’ না বলে বলছি ‘দে জল, দে জল বাবা!’ এতে জল আছে স্পষ্ট বোঝাল কিন্তু কাব্যরস তো নেই। এই ধরনের ছড়া কিংবা এই ছাঁচের ব্রতগুলিতে পদ্য, আলপনা ও নানা চলাবলা থাকলেও এগুলিকে কোনোদিন চিত্রকলা কি কাব্য বা নাট্য-কলা বলে ধরা সম্ভব নয়। কিন্তু পরে যে দু-একটি ব্রতের ছড়া প্রকাশ করছি সেগুলি গঠনের এবং বাঁধনির প্রণালী দেখলেই বঝা যাবে তাঁর মধ্যে নাট্যকলার লক্ষণ কেমন পরিস্ফুট।
আলপনার অংশটাকে দৃশ্যপটের হিসাব নিয়ে, ছড়া ও ক্রিয়া থেকে ভাদুলি ব্রতের অনুষ্ঠানের যে মূর্তিটি পাওয়া যায় তাই এই--
ক্রিয়া আরম্ভ হলো। ভাদ্র মাসের ভরা নদী, কলসি-কাঁখে জল তুলতে চলেছে একটি ছোটো মেয়ে এবং তাঁর চেয়ে একটুও বড়ো নয় এমন একটি ঘোমটা-দেওয়া নতুন বউ এবং সঙ্গিনীগণ।
জল তোলার গান বা ছড়া
এ-নদী সে-নদী একখানে মুখ,
ভাদুলিঠাকুরানি ঘুচাবেন দুখ।
এ-নদী সে-নদী একখানে মুখ
দিবেন ভাদুলি তিনকুলে সুখ।
একে একে নদীর জলে ফুল দিয়া
ছোটো মেয়ে। নদী, নদী। কোথায় যাও?
বাপ-ভায়ের বার্তা দাও।
ছোটো বউ। নদী, নদী, কোথায় যাও।
সোয়ামি-শ্বশুরের বার্তা দাও।
ইতিমধ্যে এক পশলা বৃষ্টি এল; সকলে জলে-স্থলে ফুল ছিটাইয়া;
নদীর জল, বৃষ্টির জল, যে জল হও
আমার বাপ-বায়ের সম্বাদ কও।
বৃষ্টির শেষে, মেঘে-কালো আকাশ দিয়ে একঝাঁক শাদা বক উড়তে উড়তে চলে গেল;একদল কাক কা-কা করতে করতে বড়ো একটা বকুল গাছ ছেড়া গ্রামের দিকে উড়ে পালাল; আকাশ একটু পরিষ্কার হচ্ছে।
মেয়ে! কাগা রে! বগা রে। কার কপালে খাও?
আমাদের বাপ-ভাই গেছেন বানিজ্যে, কোথায় দেখলে নাও?
মেঘ-ফাটা রৌদ্র ভরা নদীর বুকে বালুচরের একটু মরীচিকার মতো ঝিকমিক করেই মিলিয়ে গেল।
মেয়ে!চড়া! চড়া! চেয়ে থেকো,
আমার বাপ-ভাইকে দেখে হেসো।
কোন গ্রামের একটা দড়ি-ছেঁড়া ভেলা স্রোতের টানে হু হু করে বেরিয়ে গেল।
মেয়ে। ভেল! ভেলা! সমুদ্রে থেকো,
আমার বাপ-ভাইকে মনে রেখো!
দ্বিতীয় দৃশ্য
ব্রতক্রিয়ার দ্বিতীয় পালা বা দ্বিতীয় দৃশ্য আরম্ভ হল; বনজঙ্গলে ঘেরা কাঁটা-পর্বত, অন্ধকার রাত্রি, দূরে নানা জন্তু ও সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে।
মেয়ে সভয়ে! বনের বাঘ!বনের মোষ!
৮১৮
তোমার নিও না আমার বাপ-ভায়ের দোষ।
সকলে কাঁদিতে কাঁদিতে। বাপ ভাই গেছেন কোন ব্রজে?
সোয়ামি-শ্বশুর গেছেন কোন ব্রজে?
বনদেবী আশ্বাস দিয়া। তারা গেছেন এক পথে,
ফিরে আসবেন আর পথে।
উদয়গিরিশিখরে সূর্যোদয়ের আভা লাগল; উদয়গিরিকে ফুল দিয়ে পুজো করে সকলে।
কাঁটার পর্বত! সোনার চুড়া! উদয়গিরি!
তোমারে যে পূজলাম সুমিঙ্গলে, আসুন তাঁর আপন বাড়ী।
বনদেবীর প্রতি সকলে। তোমার হোক সোনার পিঁড়ি।
সূর্যদয়ের আলোর মধ্যে জোড়া ছত্র মাথায়, দিনরাত্রি শরৎ-বর্ষার দুই নৌকায় পা রেখে, সমুদ্রের উপরে ভাদুলির আবির্ভাব।
সাগরের গান। সাত-সমুদ্রে বাতাস ঘেলে, কোন সমুদ্রে ঢেউ তুলে!
বনদেবী সাগরের প্রতি। সাগর! সাগর! বন্দি।
মেয়ে! তোমার সঙ্গে সন্ধি
সাগরকে ঘিরিয়া সকলে। ভাই গেছেন বানিজ্যে,
বাপ গেছেন বানিজ্যে
সোয়ামি গেছেন বাণিজ্যে।
আকাশবাণী ফিরে আসবেন আজ,
ফিরে আসবেন আজ,
ফিরে আসবেন আজ।
সকলের নমস্কার। জোড়-জোর-জোর সোনার ছওর জোড়নৌকায় পা।
আসতে-যেতে কুশল করবেন ভাদুলি মা।
তৃতীয় দৃশ্য
গ্রামের মধ্যে ভাদুলি-অনুষ্ঠানের তৃতীয় দৃশ্য বা পালা শুরু হল; ভাদ্রের শেষদিন, নতুন শরতের সকাল ঘুমন্ত গ্রামখানির উপরে এসে পড়েছে, মেয়েদের খিড়কির পুকুর কানায় কানায় পরিপূর্ণ, তারি উপরে সোনার রোদ ঝিকমিক করছে, পুকুরের পাড়ে জোড়া তালগাছ। তাতে বাবুইপাখি বাসা। বাবুইপাখি গাইছে।–
পুঁটি! পুঁটি! উঠে চা।
ভাদুলি মায়ে বর দিল।
ঘাটে এল সপ্ত না’।
কুটিরের ঝাঁপ খুলে নৌকো-বরণের ডালা হাতে সব মেয়ে-বউ একে একে বাহির হচ্ছে।বুড়ি পড়শি। পড়শি লো পড়শি!--
তাল-তাল পরমায়ু, তালের আগ্র চোক!
ঘাটে এসে ডঙ্কা দেয় কীন বাড়ির নোক!
মেয়েরা, বউরা। আমার বাড়ির নোক, আমার বাড়ির নোক।
দূরে ডঙ্কা পড়লে একদল বাবুই কিচমিচ করে বাসা ছেড়ে উড়ল।–
মেয়েরা সকলে। বাবুই-বাসা দল দল।
নোকা ব’রতে ঘাটে চল, ঘাটে চল (প্রস্থান)
চতুর্থ দৃশ্য
সকালবেলার নদীতীরে ভাদুলির পালা সাঙ্গ হচ্ছে; গঙ্গার অনেক দূরে দূরে ঘরমুখো নৌকো, শাদা শাদা পালগুলি দেখা দিয়েছে। কতকগুলি নৌকো পরের পর এসে ঘাটে লাগলো, যাত্রী ওঠানামার, নৌকো ভেদাবার কোলাহল; প্রবাসীরা সব পৌটলাপুঁটলি নিয়ে ডাঙায় নামছে।
৮১৯
মেয়েরা নৌকোবরণ ক’রে
এ-গলুয়ে ও-গলুয়ে চন্দন দিলাম,
বাপ পেলাম, বাপেড় ণপণ্ডণ পেলাম।
এ-গলুয়ে ও-গলুয়ে সিন্দুর দিলাম,
বাপ ভায়ের দর্শন পেলাম।
বউরা জলে কলাবউ ও ফুল ইত্যাদি ভাসাইয়া
কলার কাঁদি! কলার কাঁদি।
তোমাকে দিলাম গঙ্গায়, আমারা গিয়া বাঁদি।
যাত্রী ও নাবিকদলের গান
একূল ওকূল উজান ভাটি,
নামলাম এসে আপন মাটি।
এক নৌকো চড়ায় লাগালাম,
এক নৌকো ছাড়লাম।
ব্রজে যাই, বাণিজ্যে যাই, সকল নৌকো পেলাম।
সুতো ধরিয়া সকলকে ঘিরিয়া মেয়েরা
দিক দিক সকল দিক সকল দিকেই বামুন।
ব্রজে হোক বাণিজ্যে হোক দেবতায় বেঁধে রাখুন।
গায়ে নামাবলি কোশাকুশি হাতে গ্রামের আচার্যের প্রবেশ
আচার্যি। নম নম ভাদুলিদেবী ইন্দ্রের শাশুড়ি,
বছর বছর রক্ষা কোরো ব্রতীর পুরী।
যার যে কথাটি এবং ক্রিয়াটি কেবল সেইটুকু নির্দিষ্ট করা এবং প্রত্যেক দৃশ্যের গোড়ায় যা-যা আলপনা দেওয়া হয় সেইগুলি একটু বর্ণনা করে দেওয়া ছাড়া, ছড়াগুলির সংস্থানে আমি কিছুমাত্র উলটোপালটা করি নি; অথচ কেমন সহজে আপনি এর নাট্য-অংশটা বেরিয়ে এল। এই ব্রতের প্রত্যেক ছড়া, ঘটনা-স্থান-কাল-পাত্র-ভেদে আপুনিও এক-এক অঙ্কে ভাগ হয়ে রয়েছে দেখি। প্রথম ও দ্বিতীয় দৃশ্য ঘরে লোকরা সন্ধান করছে, যারা বাইরে গেছে তাদের নিরাপদে দেশে আসার প্রতীক্ষা করছে, কামনা করছে। এটি প্রতীক্ষা ও বিরহের অঙ্ক। তৃতীয় চতুর্থ দৃশ্য হলো মিলনের; নৌকো এসে ঘাটে ভিড়ছে, পথে ঘাটে আনন্দ। এটাকে একটা মহানাটক বলা চলে না, কিন্তু নাট্যকলার অঙ্কুর যে এখানে দেখছি সেটা নিশ্চয়।
ছেলেভুলোনো ছড়া একটি মাত্র ভাব দৃশ্য বা ঘটনা নিয়ে যেমন ক’রে সেটা বর্ণনা করে, ভাদুলিব্রতের ছড়াগুলি তো জিনিসটাকে আমাদের সামনে তেমন ক’রে উপস্থিত করছে না!_ছেলেভুলোনো ছড়া, যেমন--
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি ঘুমের বাড়ি এসো,
সেঁজ নেই, মাদুর নেই, পুঁটঁর চোখে বসো।
ডিবে ভরে পান দেব, গাল ভরে খেয়ো
খিড়কি-দুয়োর খুলে দেব, ফুড়ুত করে যেয়ো।
কিম্বা যেমন—ইকড়িমিকড়ি চামচিকড়ি
চামকাটা মজুমদার,
ধেয়ে এল দামুদার,
দামুদার ছুতোরের পো
হিঙুল গাছে বেঁধে থো।
এগুলির মধ্যে ওঠাবসা, চলাফেরা, মাসি, পিসি, মুজুমদার, দামুদার, ছুতোরের পো— এমন নানা ঘটনা, নানা পাত্রপাত্রী যথেষ্ট রয়েছে; কিন্তু এদের নিয়ে অভিনয় বা নাটক
৮২০
করা চলে না। কিন্তু ভাদুলির অনুষ্ঠান গাছপালার মধ্যে, নয় তো স্টেজে সিন খাটিয়ে একদিন লোককে দেখিয়ে দেওয়া চলে।
ভাদুলিব্রতের মতো আরও ব্রত রয়েছে যার ছড়াগুলি আলাদা আলাদা টুকরো টুকরো জিনিস নয়, কিন্তু সমগ্র পদার্থ, পুরো একটি নাটিকা—যদিও খুব ছোটো!—ছবি ও ছড়া আঁকায় ও অভিনয়ে একটুখানি। এই-সব ছড়ায় নানা রসের সমাবেশ দেখা যায়, শুধু কামনাটুকু জানানো এই-সব ছড়ার উদ্দেশ্যও নয়। দুই রকমের দুটি ব্রত পাশাপাশ্ত রাখলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে।একশ্রেনীর ছড়া কামনাকে স্বর দিচ্ছে, সুর দিচ্ছে না, কিংবা মনের আবেগের অনুরণনও তাঁর মধ্যে নেই। এই ভাবে ছড়া দিয়ে মেয়েদের এই সেঁজুতি ব্রতটি গাঁথা হয়েছে। সেঁজুতি খুব একটি বড়ো ব্রত। ‘সকল ব্রত করলেন ধনী, বাকি রইল সাঁজ-সূঁজনী’। এই ব্রতটিতে প্রায় চল্লিশ রকমের জিনিস আলপনা দিয়ে লিখতে হয় এবং তাঁর প্রত্যেকটিতে ফুল ধ’রে, এক-একটি ছড়া বলতে হয়। কিন্তু ছড়াগুলি সব টুকরো-টুকরো। কেবল কামনা জানানো ছাড়া আর কিছুই পাই নে, যেমন--
সাঁজপূজন সেঁজুতি দোলায় ফুল ধ’রে
ষোলো ঘরে ষোলো ব্রতী; বাপের বাড়ির দোলাখানি
তাঁর এক ঘরে আমি ব্রতী শ্বশুর বাড়ি যায়।
ব্রতী হয়ে মগলাম বর— আসতে-যেতে দুই জনে
ধনে পুত্রে পুরুক বাপ-মার ঘর। ঘৃত মধু খায়।
বেগুনপাতায় ফুল ধরে কুলগাছ, কুলগাছ,কেকুঁড়ি।
বেগুনপাতা ঢোলা-ঢোলা সতিন বেটি মেকুড়ি।
মার কোলে সোনার তোলা ময়না, ময়না, ময়না!
সতিন যেন হয় না।
প্রত্যেক জিনিসে ফুল ধরে হাতা, হাতা, হাতা!
মাকড়সা, মাকড়সা, চিত্র ফোঁটা! খা সতিনের মাথা।
মা যেন বিয়োর চাঁদপানা বেটা! বেড়ি, বেড়ি, বেড়ি!
গুয়ো গাছ! কাঁকুনি গাছ! সতিন মাগি টেরি!
মুঠে ধরি মাজা। পাখি, পাখি, পাখি।
বাপ হয়েছেন রাজ্যেশ্বর, সতিন মাগি মরতে যাচ্ছে
ভাই হয়েছেন রাজা। ছাদে উঠে দেখি।
শর, শর, শর! বঁটি, বঁটি, বঁটি!
আমার ভাই গাঁইয়ের বর সতিনের শ্রাদ্ধে কুটনো কুটি।
বেণা, বেণা, বেণা! অসৎ কেটে বসত করি,
আমার ভাই চাঁদের কোণা। সতিন কেটে আলতা পরি।
আম-কাঁঠালের পিঁড়িখান চড়া রে, চড়া রে এবার বড়ো বান,
তেল-কুচকুচ করে, উঁচু করে বাঁধব মাচা,
আমার ভাই অমুক যে বসে দেখবে ধান।
সেই বসতে পারে। অই আসছে টাকার ছালা,
বাঁশের কোঁড়া। শালের কোঁড়া। তাই গুণতে গেল বেলা।
কোড়ার মাথায় ঢালি ঘি, ওই আসছে ধানের ছালা,
আমি যেন হই রাজার ঝি। তাই মাপতে গেল বেলা
কোঁড়ার মাথায় ঢালি মউ, কেন রে নাতি, এত রাতি?
আমি যে হই রাজার বউ। কাদায় পড়িল ছাতি,
কোঁড়ার মাথায় ঢালি পানি, তাই তুলতে এত রাতি?
আমি যেন হই রাজার রানি। এসো নাতি, বসো খাটে,
৮২১
পা ধোওগে গড়ের মাঠ। চন্দ্রসূর্য পূজ্যন,
সোনার ভেঁটা দেব হাতে, সোনার থালিম্ন ভূজ্যন!
খেল করবে পথে পথে। সোনার থালে ক্ষীরের লাড়ু,
গঙ্গা-যমুনা জুড়ি হয়ে, শঙ্খের উপর সুবর্ণের খাড়ু।
সাত-ভেয়ের বোন হয়ে, অরুণঠাকুর বরণে।
সাবিত্রীসমান হয়ে, ফুল ফুটেছে চরণে।
গঙ্গাযমুনা পূজ্যন যখন ঠাকুর বর দেন,
সোনার থালে ভুজ্যন। আপনার ফুল কুরিয়ে নেন। ইত্যাদি
এইবার মাঘমণ্ডল ব্রতটি কেমন তা দেখি। পৌষের সংক্রান্তি থেকে আরম্ভ হয়ে মাঘের সংক্রান্তি পর্যন্ত ব্রত চলে। এই ব্রতের ছড়া দেখি তিন অঙ্কে চাগ করা রয়েছে। প্রথম, শীতের কুয়াশা ভেঙে সুর্যের উদয় বা শীতের পরাজয় ও সূর্যের অভ্যুদয়। দ্বিতীয় অংশ রয়েছে মধুমাসের চন্দ্রকলার সঙ্গে, সূর্যের বিয়ে, শেষ অংশ বসন্তের জন্ম ও মাটির সঙ্গে তাঁর পরিণয়। প্রথম দৃশ্যপট উঠল--
প্রথম দৃশ্য
শীতের শেষরাত্রি, কুয়াশা তখনো ঘন হয়ে চারিদিক ঢেকে রয়েছে, রাত্রে ফুলদুটি শিশিরের ভারে একেবারে জলের ধারে ঝুঁকে পড়েছে,একটুখানি বাতাসে ঘাসের শীষগুলি দুলে দুলে সেই ফুলদুটির সঙ্গে দেঘির জল থেকে-থেকে স্পর্শ করতে লেগেছে। মালীর বাগানে ছোটো ছোটো ফুলবালারা আর গ্রামের ব্রতীরা পুকুর পাড়ে সব পা মেলে ফুলের আগায় পুকুরের জল নিয়ে খেলা করতে লেগেছে।
ফুলবালার। চোখে-মুখে জল দিতে কী কী ফুল লাগে?
ফুলরা। ইতল বেতল সরুয়া মরুয়া দুটি ফুল লাগে।
দিঘির ওপার থেকে নাগেশ্বরের মন্দিরের মালি প্রশ্ন করছে, ‘ওপার থেকে জিজ্ঞাসেন মালী’—বালী, কী কী ফুলে মুখ পাখালি?
ফুলেরা। ইতল বেতল দুই ফুলে।
সরুয়া মরুয়া দুই ফুলে।
মালি। সেই ফুলে খান কি?
ফুল। নল ভেঙে জল খান।
ফুলবালার, ফুলেরা, ঘাসেরা, এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে--
যে জল ছোঁয় না লো কাকে বগে,
সে জল ছুঁই মোরা দুর্বার আগে!
ব্রতীরা, ফুলবালারা, ফুলেরে সকলে আছোঁয়া প্পুকুরের পুরিষ্কার জল মুখে-চোখে দিচ্ছে; সাজি হাতে মালিনীর প্রবেশ এবং এই কাণ্ড দেখে মালিনীর রঙ্গভঙ্গ ও উচ্চহাস্য।
ফুলের গন্ধজল পুকুরেতেই ভাসে ,
তাই দেখে মালেনিটা খটখটাইয়া হাসে।
হেসে যে মালিনী কী বলছে তা পরের উত্তর-প্রত্যুত্তর থেকে বেশ এঁচে নেওয়া যায়। মালিনী বলছে যেন—একি? একি? আজ যে বড়ো ‘ফুলের গন্ধজল পুকুরেতে ভাসে’। ওমা এই শীতের রাত না পোহাতে গেরস্তর মেয়ে তোমরা এই আঘাটায় কেন গো?
মেয়েরা। হাসিস না লো, খুশিস না লো, তুই তো আমার সই!
মাঘমণ্ডলের বর্ত করুম, ঘাট পামু কই?
মালীনী। আছে আছে লো ঘাট, বামুনবাড়ির ঘাট।
মেয়েরা। রাত পোহালে বামুনগো পৈতে ধোওনের ঠাট।
৮২২
সেখান আমরা যাব না মালিনী, জল ভালো নয়—‘পৈতা-কচালানো জল পুকুরেতে ভাসে’।
মালিনী। আছে আছে লো ঘাট, গোয়ালবাড়ির ঘাট!
মেয়েরা। গয়লাগো দই-ক্ষীরের হাঁড়ি ধোওনের ঠাট।
মালিনী। নাপিতবাড়ির ঘাট?
মেয়েরা। নাপিতগো খুর ধোওনের ঠাট।
মালিনী। ধোপাবাড়ির ঘাট?
মেয়েরা। ধোপাগো কাপড় ধোওনের ঠাট।
মালিনী। ভুঁইমালির ঘাট?
মেয়েরা। ভুঁইমালিগো কোদাল ধোওনের ঠাট।
মালিনী হাসিয়া। মেলেনি বুড়ির ঘাট?
মেয়েরা। মেলেনি, বুড়ির ফুল ধোওনের ঠাট।
গান
মালি। আধাগাঙ্গে ঝড়বিষ্টি, আধাগাঙ্গে মালি,
মধ্যখানে পড়ে রয়েছে জৈৎ ফুলের ডালি।
মেয়েরা। কৈ যাস লো মালিনী ফুলের সাজি লৈয়া?
মালিনী। ফুল ফুটেছে নানা রকম ডাল পড়েছে নাইয়া!
সকলে। আগের ফুল তুলিস না লো বালি-বালি
মালিনী। মধ্যের ফুল তুইলা আনিস নাগেশ্বরের মাল।
নাগেশ্বরের মালি রে।
কোন কোন ডালে রাঁধিলি বাড়িলি?
কোন কোন ডালে খাইলি লইলি?
কোন কোন ডালে নিশি পোহাইলি?
মালি। জইতের ডালে রাঁধিলাম বাড়িলাম,
অতসীর ডালে খাইলাম লইলাম,
গাঁদার ডালে নিশি পোহাইলাম।
সকলে। জইত গাছে কে, ডাল নামাইয়া দে,
সূর্যি ঠাকুর চাইছেন ফুল, সাজি ভরিয়া দে।
এইখানে ফুল তোলার পালা সাঙ্গ হয়ে দ্বিতীয় পালা আরম্ভ হলো, কুয়াশার মধ্যে একটি ফুলগাছের সামনে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
মেয়েরা বেত্রলতা হাতে
কুয়া ভাঙ্গুম, কুয়া ভাঙ্গুম, বেৎলার আগে।
সকল কুয়া গেল ওই বরই গাছটির আগে।
ওরে রে বরই গাছ, ঝুল্লন দে।
বেত্রলতার আগে জল ছিটাইয়ে কুয়াশা ভাঙার অভিনয়
সকলে মিলিয়া তাঁর পরে সূর্যের স্তব
মেয়েরা। উঠ উঠ সূর্যঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া।
৮২৩
সূর্য। না উঠিতে পারি আমি ইয়লের লাগিয়া।
মেয়েরা পরস্প্রে। ইয়লের পঞ্চকাটি শিয়রে থুইয়া
উঠিবেন সূর্য কোনখান দিয়া?
মালিনী। উঠিবেন সূর্য বামুনবাড়ির ঘাটখান দিয়া।
মেয়েরা। উঠ উঠ সূর্যঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া।
সূর্য। না উঠিতে পারি আমি ইয়লের লাগিয়া।
মেয়েরা। উঠিবেন সূর্য কোনখান দিয়া?
মালিনী। গোয়াল বাড়ির ঘাটখান দিয়া।
এমন কত ঘাটেরই নাম হলো, কিন্তু কোনো ঘাটেই সূর্য উদয় হলেন না । শেষে বুড়ি মালিনীর ঘাট, যেখানে ফুলের গন্ধজল পুকুরেতে ভাসছে সেইখানে সূর্যোদয় হলো কিয়াশ ভেঙে। এইবারে মধুমাসের চন্দ্রকলার সঙ্গে সূর্যের বিয়ের পালা আরম্ভ হলো।
প্রথম দৃশ্য
বসর ঘরে চন্দ্রকলা ও সূর্য। কুঞ্জের মধ্যে সকাল হচ্ছে
চন্দ্রকলা সনিশ্বাসে। কাউয়ায় করে কলমল। কোকিলে করে ধ্বনি।
তোমার দেশে যাব সূর্য, মা বলিব কারে?
সূর্য। আমার মা তোমার শাশুড়ি, মা বলিয়ো তারে।
চন্দ্রকলা। তোমার দেশে যাব সূর্য, বাপ বলিব কারে?
সূর্য। আমার বাপ তোমার শ্বশুর, বাপ বলিয়ো তারে।
চন্দ্রকলা। তোমার দেশে যাব সূর্য, বইন বলিবো কারে?
সূর্য। আমার বোন তোমার ননদ, বইন বলিয়ো তারে।
চন্দ্রকলা । তোমার দেশে যাব সূর্য, ভাই বলিব কারে?
সূর্য। আমার ভাই তোমার দেওর, ভাই বলিয়ো তারে।
চন্দ্রকলা সনিশ্বাসে। কাউয়ায় করে কলমল। কোকিল করে ধ্বনি।
দ্বিতীয় দৃশ্য
সূর্যর বাড়ি সম্মুখ, বৈতালিকের গান
চন্দ্রকলা মাধবের কন্যা মেলিয়া দিছেন কেশ,
তাই দেখিয়া সূর্যঠাকুর ফিরেন নানা দেশ।
চন্দ্রকলা মাধবের কন্যা মেলিয়া দিছেন শাড়ি,
তাই দেখিয়া সূর্যঠাকুর ফিরেন বাড়ি-বাড়ি।
চন্দ্রকলার মাধবের কন্যা গোল খাড়ুয়া পায়,
তাই দেখিয়া সূর্যঠাকুর বিয়া করতে চায়।
পড়শি। বিয়া করলেন সূর্যঠাকুর, দানে পাইলেন কী?
বৈতালিক। হাতিও পাইলেন, ঘোড়াও পাইলেন, আর মাধবের ঝি।
খাট পাইলেন, জাজিম পাইলেন, আর মাধবের ঝি।
লেপ পাইলেন, তোশক পাইলেন,
ঘটি পাইলেন, বাটি পাইলেন,
থালা পাইলেন, খোরা পাইলেন, আর মাধবের ঝি।
পড়শি। মায়ের জন্য আনছে কী?
৮২৪
বৈতালক। শাঁখা সিঁদুর।
পড়শিং। বাপের জন্য আনছেন কী?
বৈতালিক। হাতি ঘোড়া।
পড়শি। বইনের জন্য আনছেন কী?
বৈতালিক। খেলানের সাজি।
গৌরী বা সন্ধ্যা, সূর্যের আগে স্ত্রীকে দেখিয়া চুপি চুপি
পড়শি। সতের জন্য আনছেন কী?
বৈতালিক। কুঁইয়া পুঁটি।
গৌরী। খামুনা লো খামু না লো, শিয়রে থুমু।
রাতখান পোহাইলে কাউয়ারে দিমু।
শাঁখ বাজাইয়া, উলু দিয়া, কনে বরণের ডালা ইত্যাদি লইয়া
একদল মেয়ের প্রবেশ
মেয়েরা। উরু উরু দেখা যায় বড়ো বড়ো বাড়ি।
ঐ যে দেখা যায় সূর্যের মার বাড়ি
সূর্যের মার বাড়ির দরজায় গিয়ে
সূর্যের মা লো কি কর দুয়ারে বসিয়া?
তোমার সূর্য আসতেছেন জোড় ঘোড়ায় চাপিয়া।
সূর্্যের মা। আসবেন সূর্য বসবেন ঘাটে,
নাইবেন ধুইবেন গঙ্গার ঘাটে,
গা হেলাবেন সোনার খাটে,
পা মেলাবেন রুপার পাটে,
ভাত খাইবেন সোনার থালে,
বেন্নন খাইবেন রুপার বাটিতে,
আঁচাইবেন ডাবর ভরা,
পাই খাইবেন বিড়া বিড়া,
সুপারি খাইবেন ছড়া ছড়া,
খয়ের খাইবেন চাক্কা চাক্কা,
চুনি খাইবেন খুটরি ভরা,
পিক ফেলাইবেন লাদা লাদা।
বরবেশে সূর্য চন্দ্রকলা-বধুকে লইয়া জাঁকজমকে আপনার পুরীতে প্রবেশ করলেন।
নট-নটীর নৃত্যগীত
নট। সোনার বাটি ঝুমুর ঝুমুর বাটির তৈল।
তাই লইয়া সূর্যঠাকুর নাইত গেলেন কৈলো।
নাইয়া ধুইয়া বাটি থুইলেন কৈলো।।
নটি। বাটি বাটি কুমার আটি, সক্কল পুড়িয়া গেল।
লক্ষ টাকা নাটি আমার হারাইয়া গেল।
নট। গেছে গেছে ইহ বাটি আপদ বালাই নিয়া,
আরেক বাটি গড়াম-নে চাক্কা সোনা দিয়া।
উভয়ে। সোনার বাটি ঝুমুর ঝুমুর মিষ্টি বাটির তৈল।
৮২৫
সূর্যের অন্তঃপুর। সূর্যের বাপ মা এবং ভাই ভাগিনী খুড়ি ও ভাণ্ডারী সিকদার যে যার কাজে। কেউ শুয়ে, কেউ ব’সে। এদিকে ওদিকে বিয়ের দানসামগ্রী ছড়ানো। চন্দ্রকলার দেশ থেকে সবার জন্য উপহার এসেছে, কেবল সূর্যেত বড়ো স্ত্রী গৌরী বা সন্ধ্যা কিছু না পেয়ে চোখ মুছতে মুছতে সূর্যের ধাইমার কাছে গিয়ে বাপের বাড়ি যাবার জন্য বলেছেন
গৌরী। আগা’টনি পানবাটনি ধাই-শাশুড়ি গো।
আমাদের নি নাইয়র দিবা? আমারে নি নাইয়র দিবা?
ধাই। কি জানি, কি জানি বউ গো,
জান গিয়া তোমার শ্বশুরের ঠাঁই।
গৌরী। বাড়ির কর্তা শ্বশুরঠাকুর গো!
আমারে কি নাইয়র দিবা? আমারে নি নাইয়র দিবা?
শ্বশুর। কি জানি, কি জানি বউ গো, জান গিয়া তোমার শাশুড়ির ঠাঁই।
গৌরী। বাড়ির গিন্নি শাশুড়ি-ঠাকুরানি গো, আমার নি নাইয়র দিবা?
শাশুড়ি। কি জানি, জান ননাসের ঠাঁই!
গৌরী। আনাজ-তরকারি-কুটনি ননাস-ঠাকুরানি গো--
ননাস। কি জানি, জান দেওরের ঠাঁই।
গৌরী। আনাজ-তরকারি-কুটনি ননাস-ঠাকুরানি গো--
দেওর। জান সিকদারের ঠাঁই।
গৌরী। আড়লের ভাঁড়লের কর্তা সিকদার হে--
সিকদার। (টাকে হাত বুলাইয়া) জ্ঞান তোমার সোয়ামির ঠাঁই।
গৌরী। (সূর্যের কাছে গিয়া) ঘরগৃহস্থী সোয়ামি হে।
আমারে নি নাইয়র দিবা? আমার নি নাইয়র দিবা?
সূর্য রাগিয়া। আনিব চিকন চাটিলের চটা
ভাঙিব গৌড়া নাইয়রের ঘটা।
এইখানে সূর্যের পুত্র লাউলের পালা আরম্ভ হল—‘রাওল বা সূর্যপুত্র ঋতুরাজের বিয়ে’। রাতুল থেলেও লাউল কথাটি আসা সম্ভব।
প্রথম দৃশ্য
ঋতুরাজ রাওলের সঙ্গে মাটির কন্যা হালামালার বিয়ের আয়োজন চলছে। সকলে নানা আয়োজনে ব্যস্ত; সূর্যের বাপ হুঁকো-হাতে চালা বাঁধতে ব্যস্ত। বাঁশ দড়ি খড় ইত্যাদি চারি দিকে ছরানো। লোকজন ঘরামিরা কাজে একটু অবসরে হাঁড়ি বাজিয়ে গান ধরেছে ঃ
গান
কাউয়া বলে কা,
রাত পোহাইয়া যা!
হাঁড়ি পাতিল ঠুকুর-ঠুকুর কলসির কাঁধা,
আজ লাউলের বড়ো বাড়ি বাঁধা।
হাঁড়ি পাতিল ঠুকুর-ঠুকুর কলসির কাঁধা, আজ লাউলের কলাবাগান বাঁধা।
৮২৬
হাঁড়ি পাতি ঠুকুর-ঠুকুর কলসির কাঁধা,
বড়ো বাড়ি বাঁধা।
কলাবাগান বাঁধা।
কাউয়া বলে কা,
রাত পোহাইয়া যা।
কাদামাটির ঝুড়ি মাথায়
একদল মাল-মালিনীর প্রবেশ
কাদামাটির তলে লো কাদামাটি,
তাতে ফেলাইলাম কাঁঠালখানি,
কাঁঠাকের আগে লো তুলাখনি,
তাতে বসাইলাম বামুনহাটি।
ঘটক ব্রাহ্মণের প্রবেশ
ব্রাহ্মণকে হুঁকা দিয়ে সূর্যের বাপ
বামুন ভাইয়া, বামুন ভাইয়া, ভাদুলা তামুক খাইয়া।
আমার লাউলের বিয়ার সময়, ফুল মন্ত্র পড়িয়ো।
হাঁড়ি পাতিল লইয়া কুমোরের প্রবেশ
সূর্যের বাপ। কুমার ভাইয়া, কুমার ভাইয়া , ভাদুলা তামাক খাইয়ো।
আমার লাউলের বিয়ার সময় হাঁড়ি পাতিল দিয়ো।
ধোপা, নাপিত, গোয়ালা প্রভৃতির প্রবেশ
সূর্যের বাপ। ভাদুলা তামুক খাইয়, ভায়া, ভাদুলা তামুক খাইয়ো!
লাউলের বিয়ের ভোজ। অন্দরবাড়িতে সূর্য ঘুরে ঘুরে তদারক করছেন, গামছা মাথায়। জেলে সঙ্গে সিকদারের প্রবেশ।
সিকদার। সূর্য গো, পুকুরে ফেলাইলাম জাল, তাতে উঠিল না কিছু মাছ।
জেলেনিদের মাছ লইয়া প্রবেশ
মাছ লইয়া প্রবেশ
জেলেনিরা। উঠল লো, উঠল মাছ।
সিকদার। নিবে কে?
জেলেনি। ওই আসছে বামুন মেয়ে খালুই হাতে ক’রে।
মেয়েরা খালুই ভরিয়া মাছ লইল
সিকদার। নিলাম লো, নিলাম লো! মাছ কোটে কে?
ব্রাহ্মণী। ওই আসছে মাছকুটুনি বঁটি হাতে ক’রে।
মাছকুটুনি মাছ কুটিতে বসিয়া গেল
সিকদার। কুটলাম লো কুটলাম। মাছ ধোয় কে?
মাছকুটুনি। ওই যে আসে ধোয়ানি ঘটি হাতে ক’রে।
ধোয়ানি মাছ ধুইতে লাগিল
সিকদার। ধুলাম লো ধুলাম। মাছ রাঁধে কে।
মাছধোয়ানি। অই আসে রাঁধুনি আগুন হাতে ক’রে।
রাঁধুনির রাঁধা আরম্ভ
সেকদার রান্নার ধোয়াতে চোখ মুছিয়া নাক সিটকাইয়া। খাইবে কে?
৮২৭
রাঁধুনি। অই আসছে খাউনি থালা হাতে ক’রে।
সকলে খাইতে বসিয়া গেল
সেকদার সনিশ্বাসে।এঁটো নেবে কে?
খাউনিয়া। ওই আসছে এঁটো-নেওনি গোবর হাতে ক’রে
সিকদার চাটিয়া সকলকে ধাক্কাধোক্কা দিয়া। যা নেওনি, মাছকুটুনি, আঁশ-ধোঁয়নি, মাছরাঁধুনি, ভাতখাওনি, পাতকুড়োনি, যা।
সিকদারনি। আমার নিমো, ধুমো, রাঁধমো, কুটমো, খামো, ফেলমো, যেমন-তেমন কৈর্যা।
ব্যস্ত হইয়া সূর্যের বাপের প্রবেশ
বাপ। পান দিবে কে?
সিকদার। ওই আছে পান-খাওয়ানি ডিবা হাতে ক’রে।
বাপ। বিছানা পাতিবে কে?
সিকদার। ওই আছে বিছানা-পাতুনি তোশক হাতে ক’রে।
সিকদারনি। শুইবে কে?
বাপ। ওই আসছে শুয়নি বালিশ হাতে ক’রে।
সিকদার। রাত পোহাইবে কে?
বাপ। ওই আসছে রাতপোহানি কাউয়া হাতে।
বাপ। ওই আসছে রাতপোহানি কাউয়া হাতে।
গান
কাউয়া বলে কা।
রাত পোয়াইয়া যা।
তৃতীয় দৃশ্য
হালামালার বাড়ি, ছাদনাতলায় একদল স্ত্রী ও পুরুষ বরবেশী লাউওলকে আর হালামালাকে লইয়া। সকলকে ফুল ছিটাইতে ছিটাইতে ঃ
এপারে লাউল, ওপারে লাউল, কিসের বাদ্য বাজে?
রাজার বেটা সওদাগর বিয়ে করতে সাজে।
সাজ সাজন্তি লাউল মাথায় মুকুট দিয়া।
ঘরে আছে রাজকন্যা তুইলা দিব বিয়া।
সাজ সাজন্তি লাউল পায়ে নেপুর দিয়া।
ঘরে আছে সুন্দরী কন্যা তুইলা দেব বিয়া
ফুল ছিটাইয়া গান
আমের বইল আসে লো লোচা লোচা,
আমের বইল আসে লো বাড়ি বাড়ি।
মালী-মালিনীর গান
ফুল রুইলাম গাঁয় গাঁয়,
সে ফুল গেল দখিন গাঁয়।
মালিনী। দখিন গাঁইয়া মালি রে।
মালী। ফুলের ডালা লবি রে?
মালিনী। হাতে কলসি, কাঁখে পোলা
কেমন লব ফুলের ডালা রে।
এইখানে মাটির সঙ্গে রায় বা সূর্যের ছেলে রাওলের (লাউলের) বিবাহের ও মিলনের পালা শেষ হলো। এর পরে ঋতুরাজ পৃথিবীকে ফলে-ফুলে উর্বরা করে বিদায় হচ্ছেন। মেয়েদের লাউলকে ধরে রাখবার চেষ্টা।–
৮২৮
কই যাও রে লাউল গামছা মুড়ি দিয়া?
তোমার ঘরে ছেইলা হইছে বাজনা জানাও গিয়া।
ধোপা জানাও গিয়া, নাপিত জানাও গিয়া, পরুইত জানাও গিয়া।
কিন্তু ঋতুরাজের তো থাকবার জো নেই, তাঁকে একলা যেতেই হবে। আবার শীতের মধ্যে দিয়ে তিনি ফিরবেন, এই আশ্বাস দিলেন এবং মেয়েরা বিদায়ভোজের আয়োজন করে লাউলের ভাই শিবাইকে পাত কেটে আনতে ব’লে চাল ধুতে বসল।–
চাউল ধুমু, চাউল ধুমু, চাউলের মালো পানি,
চাউল ধুইতে পড়ল চাউল,
পাটি বিছাইয়া ধলো চাউল যত বর্তিয়ে জানি।
তাঁরপর আলোচাল দুধের জলে লাউলের স্নান
আলোচাল কাঁচা দুধে লাউল ছান করে,
স্বশুরবাড়ি বউ থুইয়া লাউল ভাতে মারে।
এদের শিবাই কলাপাতা কাটছেন
মালি। লাউলের বাগানে কে রে কাটে পাত।
শিবাই। লাউলের ছোটো হাই শিবাই কাটে পাত।
মালী। শিবাই যে শিবাই রে, না কাটিও পাত।
শিবাই। বাইছা বাইছা কাটুমনে সবরি কলার পাত।
মালী। সবরি কলার পাতে নাকি লাউলে খায় ভাত?
বাইছা বাইছা কাটো গিয়া চিনিচম্পা কলার পাত।
এদিকে লাউলের বউ ছেলেকে ঘুম পাড়াতে বসেছেন
লাউলের ঘরে ছেইলা হইছে, কী কী নাম থুমু?
আম দিয়া হাতে রাম নাম থুমু। বরই দিয়া হাতে বলাই নাম থুমু।
কমলা দিয়া কমল নাম থুমু। জল দিয়া জয় নাম থুমু।
রাজার বেটা রাজার ছেইলা রাজ নাম থুমু।
লাউলের ঘরে ছেইলারে কী কী গয়না দিমু?
হাতজোখা বলয়া দিমু, গলাজোখা হার দিমু,
বুকজোখা পাটা দিমু, কোমরজোখা টোড়া দিমু ,
পাঁওজোখা গুজরি দিমু, দুই চরণে নেপুর দিমু,
লাউলের ছেইলা নাচবে, রাজার রাজ্য হাসবে।১।।
লাউলের ঘরে ছেইলা লো দুধ খাইবে কীসে?
রাজার বেটা পাশা খাইলা বাটি জিনিয়া নিছে।
পাশা ফেলিয়া জিনিলাম কড়ি,
কিনে আনলাম কপিলেশ্বরী।
কপিলেশ্বরী কিবা খায়?
পুকুরপাড়ে দূর্বা খায়।
দূর্বা খাইয়া লো সই, শুকাইল দুধ;
কি দিয়া পালব মোরা লাউলের ঘরে পুত?
লালের ঘরে পুত না লো শক্ত বেড়ার মাটি,
বর্তি গো ভাই, যেন লোহার কাটি।২।।
লাউলের ছেলেকে ঘুম পাড়িয়া হালামালা একশত বহিন সঙ্গে জলে নাইতে চললেন।–
আয় লো শত বইন জলে রে যাই;
জলে রে যাইয়া লো ঝাপ্পাটি খেলাই।
৮২৯
হাতের শাঁখা, টাকাকড়ি, পায়ের নূপূর এমনি সব নানা জিনিস ফেলে-ফেলে কুড়িয়ে খেলা।
খেলতে খেলতে না লো দুপ্পুরবেলা।
যখন জল থেকে উঠে এসে লাউলকে তারা ডাকছে তখন মধুমাস শেষ ঋতুরাজের যাবার সময় উপস্থিত হয়েছে, তিনি চলেছেন। বৈশাখের মেঘ দেখা দিয়েছে। ঝড়বাতাসে লাউলের আসন যেখানে মেয়েরা দেখেছে সেখানে ফুলে-ভরা জইতের একটি ডাল ভেঙে পড়েছে--
জইতের মটকা ডাল ভাইঙ্গা পড়ল ঘরে,
লাউলের দুধভাত ছচি হইয়া পড়ে।
তখন মেয়েরা লাউলকে একটু অপেক্ষা ক’রে কিছু খেয়ে যেতে মিনতি করছে--
খাও খাও লাউল, গোটা চারিন ভাত;
আমরা শত বইনে ফ্যালাম-নে পাত।
বৈশাখের মেঘ গর্জন করে উঠল, ঝড় হু হু বইল, উৎসবের সাজসরুঞ্জাম লণ্ডভণ্ডকরে গরম বাতাসে ধুলো উড়ল, মলিন মুখে মেয়েরা ঋতুরাজকে বিদায় দিলেন।
আজ যাও লাউল, কাল আইবো।
নিত্য নিত্য দেখা দিও।
বছর বছর দেখা দিও।
পালা সাঙ্গ
এই মাঘমণ্ডল ব্রতের প্রথম অংশে দেখা যাচ্ছে যে সূর্য যা, তাঁকে সেই রূপেই মানুষে দেখছে এবং বিশ্বাস করছে যে। জলের ছিটায় কুয়াশা ভেঙে দিলে সূর্য উদয়ের সাহায্য করা হবে। এখানে কামনা হল সূর্যের অভ্যুদয়। ক্রিয়াটিও হলো কুয়াশা ভেঙে দেওয়া ও সূর্যকে আহ্বান। দ্বিতীয় অংশ চন্দ্রকলাকে দীর্ঘকেশী গোল-খাড়ুয়া-পায়ে একটি মেয়ে এবং সূর্যকে রাজা-বর এবং সেই সঙ্গে সূর্যর মা ও চন্দ্রকলার বাপ কল্পনা ক’রে মানুষের নিজের মনের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি বাপের যে-সব ছবি আছে, সূর্যের রূপকের ছলে সেইগুলোকে মূর্তি দিয়ে দেখছে। তৃতীয় অংশে সূর্য-পুত্র বা রায়ের পুত্র রাউল বা লাউল , এক কথায় বসন্তদেব—টোপরের আকারে এঁর একটু মূর্তি মানুষে গড়েছে এবং সেটাকে ফুলে সাজিয়ে মাটির পুতুল হালামালার সঙ্গে বিয়ে খেলা খেলছে। এখানে কল্পনার রাজ্য থেকে একেবারে বাস্তবের রাজ্য বসন্তকে টেনে এনে মাটির সঙ্গে ঘরের নিত্যকাজের এবং খুঁটিনাটির মধ্যে ধরে রাখা হলো; তাঁকে জামাইয়ের আদরে খাওয়ানো-দাওয়ানো হলো; তাঁর ছেলেকে ঘুম পাড়ানো দুধ খাওয়ানো, মানুষ করে তোলার নানা কাজ। এই পুতুলখেলা আর-একটু অগ্রসর হলেই মা-যশোদার নীলমণিকে ক্ষীর সর ননী খাওয়ানো—‘খাওয়াব সর, মাখাব ননী’ এবং জগন্নাথকে খিচুড়িভোগ রাজভোগ দিয়ে, তাঁর রাজবেশ হস্তীবেশে এমনি নানা বেশ ও রুক্মিণীহরণ চন্দনযাত্রা এমনি তাঁর নানা লীলা গড়ে নিয়ে মূর্তি-পূজার পুরো অনুষ্ঠানে দাঁড়ায়।
ভাদুলি ব্রতটি আমরা দেখলেম—বর্ষা দেশ জলে ভাসিয়ে দিয়ে বিদায় হচ্ছে আর শরৎ আসছে, এরই একটা উৎসব। মেঘমণ্ডল ব্রতে—শীতের কুয়াশা কেটে সূর্যের আলোতে ঝলমল বসন্তদিনগুলি আসছে, তারই উৎসব দু-জায়গাতেই মানুষের মনে কামনা নাট্যক্রিয়ায় আপনাকে ব্যাক্ত করলে। এমনি শসপাতার ব্রত। সেখানে আমরা দেখি মানুষ শস্যের কামনা করছে; কিন্তু সেই কামনা সফল করবার জন্যে সে যে নিশ্চেষ্টভাবে কোনো দেবতার কাছে জোড়হাতে ‘দাও দাও’ করছে তা নয়; সে যে-ক্রিয়াটা করছে তাতে সত্যিই ফসল ফলিয়ে যাচ্ছে এবং ফসল ফলার যে আনন্দ সেটা নাচ গান এমনি নানা ক্রিয়ায় প্রকাশ করছে বর্ধ্মান অঞ্চলের মেয়েদের মধ্যে এই শসপাতার ব্রত বা ভাঁজো, ভাদ্র মাসের মন্থনষষ্ঠী থেকে আরম্ভ হয়ে পরবর্তী শুক্লাদ্বাদশীতে শেষ হয়। মন্থনষষ্ঠীর পূর্বদিন পঞ্চমী তিথিতে পাঁচ রকমের শস্য—মটর, মুগ, অড়হর, কলাই ছোলা—একটা পাত্রে ভিজিয়ে রাখা হয়;
৮৩০
পরদিন ষষ্ঠীপূজায় এইগুলি নৈবেদ্য দিয়ে, বাকি শস্য সরষে এবং ইঁদুরমাটির সঙ্গে মেখে একটি নতুন সরাতে রাখা হয়; দ্বাদশী পর্যন্ত মেয়েরা স্নান ক’রে প্রতিদিন এই সরাতে অল্প অল্প জল দয়ে চলে; চার-পাঁচদিন পরে যখন শস্য সব অঙ্কুরিত হতে থাকে তখন জানা যায় এ-বৎসর প্রচুর হবে এবং মেয়েরা তখন শস্য-উৎসবের আয়োজন্ করে। ইন্দ্রদ্বাদশীতে এই উৎসব; চাঁদের আলোতে উঠানের মাঝখানে এই অনুষ্ঠান। নিকোনো বেদির উপর ইন্দ্রের বজ্রচিহ্ন-দেওয়া আলপনা; কোথাও মাটির ইন্দ্রমূর্তিও থাকে। এই বেদির চারিদিকে, পাড়ার মেয়েরা সকলে আপন-আপন শসপাতার সরাগুলি সাজিয়ে দেয়, তাঁর পর সাত-আট থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছরের মেয়েরা হাত-ধরাধরি করে বেদির চার দিক ঘিরে নাচগান শুরু করে। উঠানের এক অংশে পর্দার আড়ালে বাদ্যকর তাল দিতে থাকে।
ভাঁজো লো কলকলানি, মাটির লো সরা,
ভাঁজোর গলায় দেব আমারা পঞ্চফুলের মালা।
এক কলসি গঙ্গাজল, এক কলসি ঘি,
বছরান্তে একবার ভাঁজো, নাচব না তো কি?
এর পর দুও দলে ভাগ হয়ে মুখে-মুখে ছড়াকাটাকাটি করে ঃ
পুর্ণিমার চাঁদ হেরে তেঁতুল হলেন বঙ্ক।
গড়ের গুগ্লি বলে, আমি হব শঙ্খ!
ওগো ভাঁজো, তুমি কিসের গরব কর?
আইবুড়ো বেটাছেলের বিয়ে দিতে নারো।
সমস্ত রাত্রি দুই দলের নাচগান ছড়া-কাটাকাটির উপরে চাঁদের আলো, তারার ঝিকিমিকি—এই ছবির একটি সুন্দর বর্ননা পূর্ববঙ্গের তারাব্রত একটি ছড়ায় আমরা পাই ঃ
ষোলো ষোলো বর্তির হাতে ষোলো সরা দিয়া,
মোরা যাই ইন্দ্রপুরীর নাটুয়া হইয়া।
এর পরে রাত্রি শেষ; মেয়েরা আপন-আপন শসপাতার সরা মাথায় নিয়ে পুকুর কিংবা নদিতে বিসর্জন দয়ে ঘরে আসে। এখানে শস্যের উদগমের কামনা সরাতে শস্যবপন-ক্রিয়া থেকে আরম্ভ হল এবং অনুষ্ঠান শেষ হল উৎসবের নৃত্যগীতে। কিন্তু দুঃখের দিনেও বছরের মধ্যে আসে যখন পাতা ঝরে যায়, মাটি তেতে ওঠে জল ফুরিয়ে যায়। সেই-সব দিনে মনের বিষন্নতার ছবিও ব্রতে ফুটেছে দেখি। সেদিনের বসুধারা ব্রতের ছড়ায় কেবল ‘জল আর জল’!
কালবৈশাখী আগুন ঝরে!
কালবৈশাখী রোদে পোড়ে!
গঙ্গা শুকু-শুকু, আকাশে ছাই!
উৎসাহ নেই, স্ফূর্তি নেই, কেবল দীর্ঘশ্বাসের মতো ছড়াটুকু হুতাশ জানাচ্ছে। অনাবৃষ্টি আশঙ্কা আমাদের যদিই বা এখন কোনোদিন চঞ্চল করে তবে হয়তো ‘হরি হে রক্ষা করো’ বলি মাত্র; কিন্তু ঋতুবিপর্যয়ের মানে যাদের কাছে ছিল প্রাণসংশয়, সেই তখনকার মানুষরা কোনো অনির্দিষ্ট দেবতাকে প্রার্থনা কেবল মুখে জানিয়ে তৃপ্ত হতে বা নিশ্চিন্ত হতে পারত না; সে ‘বৃষ্টি দাও’ বলে ক্ষান্ত হচ্ছে না; সে বৃষ্টি সৃষ্টি করতে, ফসল ফলিয়ে দেখতে চলছে। এবং সে নিশ্চিয় জানছে, বৃষ্টি কামনা করে দল বেঁধেতারা মাটির ঘটকে মেঘরূপে কল্পনা করে শিকেয় খোঁচায় ফুটো করে বট পাকুড় ইত্যাদি গাছের মাথায় জলধারা দিয়ে বসুধারা ব্রতটি করছে, তাতে করে বৃষ্টির দাতা যে দেবতা তিনি তুষ্ট হচ্ছেন এবং এই প্রক্রিয়ার বলে মেঘও জল দিতে বাধ্য। এখানকার মানুষ এ-রকম বিশ্বাস করে না, ব্রত করে না। কিন্তু তখনকার লোকে যে-বিশ্বাসে ব্রত করত তাঁর মূলে য়ে কামনা এখনী পূজায় বা প্রার্থনাতে সেই কামনা, কেবল অনুষ্ঠানটা ভিন্ন রকমের; ব্রতে কামনার সঙ্গে অনুষ্ঠানের স্পষ্ট সম্পর্ক দেখি, যেমন—
৮৩১
বত আছেন, পাকুড় আছেন, তুলসী আছেন পাটে।
বসুধারা ব্রত করলাম তিন বৃক্ষের মাঝে।
মায়ের কুলে ফুল, বাপের কুলে ফল, শ্বশুরের কুলে তারা
তিন কুলে পড়বে জলগঙ্গার ধারা।
পৃথিবী জলে ভাসবে, অষ্টদিকে ঝঁপুই ফেলবে।
ব্রত হলো মনস্কমনার স্বরূপটি। আলপনায় তাঁর প্রতিচ্ছবি, গীতে বা ছড়ায় তাঁর প্রতিধ্বনি; এবং প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাঁর নাট্যে নৃত্য; এক কথায়, ব্রতগুলি মানুষের গীত কামনা, চিত্রিত বা গঠিত কামনা, সচল জীবন্ত কামনা।
বেশির ভাগ ব্রতে ছড়া হয় গীত কিংবা নাট্য আকারে, আলপনা হয় প্রতিচ্ছবি নয় মণ্ডনরূপে, থাকেই থাকে কামনাকে সুব্যক্ত সুশোভন রূপে ব্যাখ্যা করতে। নাট্য নাচ গান এবং ছবি আঁকা বলতে মানুষের স্বাধীন চেষ্টা ব’লে আমরা এখন বুঝি, তখন কিন্তু সেগুলো ব্রতের অঙ্গ বলেই ধরা হতো। ব্রতের ছড়াগুলি যেখানে ছোটো-ছোটো যাত্রা পালার মতো গাঁথা হয়েছে, সেখানে নাট্য নৃত্য ও গীত-কলার যথেষ্ট অবসর রয়েছে দেখি
আমের বইল আসে লো লোচা লোচা,
আমের বইল আসে লো বাড়ি বাড়ি।
আবার যেমন ঃ ফুলরুইয়াম গাঁয় গাঁছ, সে ফুল গেল দখিন গাঁয়।
দেখিন-গাঁইয়া নালী রে! ফুলের ডালা লবি রে?
কাঁখে কলসি, হাতে পোলা, ক্যামনে লব ফলের ডালা রে!
এই-সব ছড়াকে গান ছাড়া কী বলব? ছরা গুলিকে বাঁধুনি আর সাজানোর ভঙ্গি এমন তালে তালে য্র এগুলিতে সুর এবং নাচ দুয়েরই টান স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে। এমনি মাঘমণ্ডল ব্রতে কুয়াশা ভেঙে সূর্য ওঠবার ছড়া এবং ভাদুলিব্রতের ছড়াগুলিতেও গীত নাট্য দুইই রয়েছে। দুই ব্রতেই পাত্রপাত্রী-স্থানকালভেদে ছড়াগুলি নাটকাকারে গাঁথা । এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এক-সময়ে এগুলি মন্ত্রের মতো করে বলা হতো না, অভিনীত হতো।
ব্রতের অনুষ্ঠান দেখা যাচ্ছে, এখন যাকে বলি আমরা ধর্মানুষ্ঠান তা নয়; এখন যাকে বলি আমরা কলাকৌশল তাও নয়। ধর্ম এবং শিল্প দুইই এখানে স্বাধীনভাবে আপনাদের দুটো দিক অবলম্বন করে চলছে না। ব্রতের মূলে কতখানি ধর্মপ্রেরণা, কতখানি বা শিল্পকলার সৃষ্টি বেদান রয়েছে তা বোঝা শক্ত।
এখনও পাড়াগাঁয়ে রাখালেরা কুলাই ঠাকুরের ব্রত বলে একটা অনুষ্ঠান করে। সেটা থেকে ধর্ম আর শিল্প ক্রমে কেমন করে স্ব-স্বপ্রধান হয়ে উঠেছে, তাঁর একটু আভাস পাব। পৌষসংক্রান্তির এক পক্ষ পূর্ব থেকে রাখালেরা একজনকে বাঘ সাজিয়ে গৃহস্থের বাড়ি-বাড়ি সন্ধ্যার সময় এই গানটি গেয়ে পূজার চাল ভিক্ষে করে বেড়ায়--
সকলে। ঠাকুর কুলাই ভোঁ।
হ্যাটা চল রে।।ধ্রু।।
হ্যাটা চল পাঁচিল-পার।
বাঘ। ঝপৎ গিরি রে।। ধ্রু।।
ঝপাৎ গিরি সজাগ হয়।
সজাগ হয়্যা না করে রব।।
সকলে। সুন্দৈর বনে রে।।ধ্রু।।
বাঘ। সুন্দৈর বনে বাঘের ছাও।
হাম্বুর হাম্বুর করে রব।
য়্যাক বাঘ রে।। ধ্রু।।
৮৩২
সকলে। ঠাকুর কুকাই ভোঁ। ইত্যাদি
এই ছড়া তো শুধু আউড়ে যাবার নয়; এতে বাঘ হতে হবে, জোরে জোরে হাঁটা, ঝপাৎ করে পড়া, সজাগ হয়ে এদিকে ওদিকে দেখা এবং হাম্বুর হাম্বুর গর্জন। নাট্যকলার অনেকখানিই পাওয়া গেল। গানে কোরাস পর্যন্ত। এর সঙ্গে পাড়াগাঁয়ের রাত্রি , অন্ধকার গাছপালা, মশাল জেলে রাখাল ছেলেরা এবন ছেলে মেয়ে বুড়ো নানা দর্শকের নানা ভাবভঙ্গি, খড়ের ঘর, প্রদীপের আলো ইত্যাদি জুড়ে দেখলে একপক্ষব্যাপী যাত্রার অনেকখানিই আমরা পাব। বাঘের ভয় থেকে গোরুবাছুর যাতে রক্ষা পায় সেই কামনা করে রাখালেরা বাঘ সাজিয়ে এই বাঘের ছড়া প’ড়ে ব্রত করবে, এইটেই আশা করা যায়। কিন্তু এখানে দেখছি চাল প্রার্থনা করে রাখালেরা এই বাঘের গান গেয়ে গেয়ে রোজগার করছে। এখানে দেখছি অনুষ্ঠানের গীত-কলার অংশ ব্রতের বাকি টুকু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে মানুষ স্বাধীনভাবে গান নাচ দুই ষদৃচ্ছা করছে এবং ব্রতের দিন কেবল বাঘের মূর্তিকে পুজো দিয়েই কাজ সারছে; এইখানে ধর্মাচরণ আর শিল্পকলা দুটি ছাড়াছাড়ি হলো। ব্রতের ধর্মাচরণের অংশ মূর্তিপূজার দিকে এগিয়ে গেলে এবং শিল্প-অংশ ক্রমে বহুরূপীর বাঘের অনুকৃতি থেকে আরম্ভ হয়ে শিল্পের উচ্চতর একটি স্থানে পৌঁছতে চলল। পূজার দিকে পড়ল পূজ্য মূর্তি আর পূজক, আর শিল্পের দিকে এল দর্শক আর প্রদর্শক, এবং ব্রতকথা স্বাধীনভাবে কবিরা গাইতে লাগল—যেমন চণ্ডীর গান, শীতলার গান। এর থেকে রামযাত্রা, কৃষ্ণযাত্রা, পাঁচালি, কবি। এমনি পরে ব্রতের সম্পর্ক থেকে দূরে যেতে যেতে নিছক যাত্রা নাটক থিয়েটারে এসে দাঁড়াল সেইসব শিল্পকলা যার গোড়াপত্তন হয়েছিল ব্রতীর কামনাকে ব্যক্ত করবার চেষ্টায়। খাঁটি অবস্থায় দেখি ব্রতের দর্শক-প্রদর্শক নেই, যে নট সেই ব্রতী বা সেই চিত্রকর এবং গায়ক; কিন্তু ব্রত থেকে যখন শিল্প বিচ্ছিন্ন তখন যে আলপনা দেচ্ছে, চিত্র করছে, অভিনয় করছে বা ছড়া বলছে কিংবা বাঘ সেজে কি আর-কিছু সেজে নৃত্য করছে সে যে ব্রতী হয়ে ধর্মকামনায় সেটা করছে—এ হতেও পারে, না হতে পারে, বাঁধাবাঁধা কিছু নেই। ব্রতের বাঘ বহুরূপীর বাঘে যেমন দাঁড়াল অমনি সেখানে থেকে লাটসাহেবের ফটকের উপরের বাঘ পর্যন্ত হাতে তাঁর আর কোনো বাঁধা রইল না। মাঘমণ্ডলের সূর্যদেব যেদিন ফুলের টোপর মাথায় রায়ল বা লাউল মূর্তিতে ধরা পড়লেন, সেইদিন থেকে গ্রিক অ্যাপোলো থেকে কৃষ্ণনগরের পুতুল, পুরীর জগন্নাথ পর্যন্ত সব রাস্তা খোলসা হয়ে গেল। কল্পব্রত ও পুণ্যিপুকুরের বেলের দাল—পাথরে গড়া হয়ে বুদ্ধ-যুগের কল্পদ্রুম এবং আজকালের অসলার কোম্পানির ইলেকট্রিক বাতির ঝাড় হয়ে দাঁড়াতে চলল, প্রতি পদক্ষেপে ব্রতের ধর্মানুষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে। ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য সমস্তি একান্নবর্তী পরিবারের অন্তর্গত রয়েছে এবং তারাই বড়ো হয়ে ক্রমে স্ব-স্ব-প্রধান স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে—ধর্ম ও শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসের মূলে এই কথা রয়েছে দেখি। এই স্বতন্ত্রতা শিল্প-সাহিত্য এবং ধর্মের প্রচারের পক্ষে দরকার হয় কি না এবং এই পার্থক থাকা ভালো কি মন্দ, সেটা বিচার করতে বসা কেবল তর্ক করা মাত্র। এইটে ঘটেছে। একসময়ে দেবমন্দিরের সঙ্গে নাটমন্দির এবং পূজাপার্বণের সঙ্গে দেবতার চরিত্র বর্ণন করে চন্দনযাত্রা রাসযাত্রা রুক্মিণীহরণ এমনি নানা অভিনয় ও চিত্রকার্য ইত্যাদি জড়িয়ে ছিল; এখন তারা সে সম্পর্ক সে গলাগলি ভালো ছেড়েছ; ধর্মমন্দির, নাটকের রঙ্গ মঞ্চে ও শিল্পপ্রদর্শনীতে সুনির্দিষ্ট ভাগ হয়ে গিয়েছে। এখন আর থিয়েটারে কি গানের মজলিশে কিংবা চিত্রপ্রদর্শনীতে গিয়ে বলা চলে না যে, আমরা ব্রতী, ব্রত করতে বসেছি।
ব্রতের ছড়াগুলির সঙ্গে ব্রতীর কামনার যে যোগ, ব্রতের আলপনাগুলির সঙ্গেও ঠিক সেই যোগটিই দেখা যায়। কতকগুলি ছড়া রয়েছে কেবল কামনা উচ্চারণ করাই যার কাজ ঃ
বাঁশের কোঁড়া, শালের কোঁড়া,
৮৩৩
কোঁড়ার মাথায় ঢালি ঘি;
আমি যেন হই রাজাই ঝি।
কিংবা ঃ আমরা পূজা করি পিটালির চিরুনি।
আমাগো হয় যেন সোনার চিরুনি। ইত্যাদি
আর-কতকগুলি ছড়া, যার উদ্দেশ্য শুধু কামনাটা উচ্চারণ নয়, কাজের জন্য যেটুকু তাঁর চেয়ে অনেকটা বাজে সুর-সার চলা-বলা রয়েছে—যেমন দেখা গেল মাঘমণ্ডল ব্রতের সূর্যের বিয়ের ছড়াগুলিতে। আলপনাগুলি তেমনি দেখি দুই শ্রেণীর। একরকম আলপনা—সেগুলি কেবল অক্ষর বা চিত্রমূর্তি—কতকটা ইজিপ্তের চিত্রাক্ষরের মতো। এই-সব আলপনার মানষ নানা অলংকারের কামনা করে পিটুলির সব গহনা এঁকেছে। সেঁজুতি-ব্রতের আলপনায় ঘরবাড়ি, চন্দ্রসূর্য, সুপুরিগাছ, রান্নাঘর, গোয়ালঘর সবই মানুষ এঁকেছে, কিন্তু এদের তো শিল্পকার্য বলে ধরা যায় না—এগুলি মন যা চায় তারই মোটামূটি মানচিত্র। কিন্তু এই যে নানারকমের পদ্ম মানুষ কল্পনা থেকে সৃষ্টি করেছে কিংবা এই যে কলালতা, খুন্তিলতা, শঙ্খলতা, চালতালতা প্রভৃতি লতামণ্ডল, এই যে নানা রকম আসনের পিঁড়িচিত্র—এগুলি মণ্ডনশিল্প, মানচিত্র নয়। যেখানে অন্নপ্রাশনে পিঁড়ি সেখানে শুধু অন্নের বাটিগুলি যেমন-তেমন করে এঁকে দিলেই কামনা সফল হতে পারত। কিন্তু তা নয়ঃ মানুষ সেখানে দেখছি অনেক লতাপাতা এঁকে পিঁড়িখানিকে সুন্দর করতে চেয়েছে—কাজের অতিরিক্ত অনেকখানি লেখা তাতে রয়েছে। তাঁর পরে এই তারাব্রতের সূর্য চন্দ্র তারা এরা কিছুর অনুকরণ নয়; শিল্পির কল্পনা থেকে এদের সৃষ্টি হয়েছে। পিঁড়িগুলিতে কামনার প্রতিচ্ছবি দেওয়ার চেয়ে কারিগিরি করবার ইচ্ছাটাই প্রবল দেখা যাচ্ছে। আর বছরের শেষে পৃথিবীকে নমষ্কার দিয়ে পৃথিবী ব্রতের এই যে আলপ্নাখানি—নরনারীর জীবনের ক্ষণিক ইতিহাস নিয়ে পদ্মপাতার উপরে একবিন্দুর মতো এই যে টলটল একটি সৃষ্টি—এটিকে তো কি পরিকল্পনার দিক দিয়ে কি কারিগরির দিকে দিয়ে মানচিত্র কিছুতে বলা যায় না। পূর্বকালে মানুষ যে-কোনো কারণে হোক মনে করত, যে-জিনিস সে কামনা করছে তাঁর প্রতিচ্ছবি লিখে কিংবা তাঁর প্রতিমূর্তি গড়ে তাতে ফুল ধরে কামনা জানালে সিদ্ধিলাভ করবে। সে হিসেবে আলপনার জিনিসটির প্রতিরূপ দিলেই তো কাজ চলে; কিন্তু দেখছি, মানুষ শুধু সেইটুকু করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না; এবং তাঁর মনও তৃপ্তি মানছে মনা যতক্ষণ না। শিল্পসৌন্দর্যে সেগুলি ভূষিত করতে পারছে। অথচ কামনা-পরিতৃপ্তির পক্ষে আলপনা সুন্দর হলো কি না হলো তাতে বড়ো আসে যায় না।
৮৩৪
এই যে লক্ষ্মীপূজার আলপনাতে মানুষ বিচিত্র রকমের পদ্মফুল এঁকেছে একটির সঙ্গে যার আর-একটির মিল নেই—এমন-কী, আসল পদ্মফুলের সঙ্গে নয়, এরই বা উদ্দেশ্য কী? মানুষের মনে কোথায় একটি গোপন উৎস রয়েছে, যেখান থেকে এই-সব আলপনা নতুন নতুন এক-একটি সৃষ্টি বিন্দুর মতো বেরিয়ে আসছে। ব্রতের আলপনাগুলি থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মানুষের অন্তরের কামনার সঙ্গে বাহিরের চেষ্টার যোগ থাকলেই যে সব সময়ে শিল্প-আকারে কাজটি দেখা দিচ্ছে তা তো নয়, বরং দেখি কামনা আর তাঁর সিদ্ধি চেষ্টার মধ্যে যত কম অবসর এবং বাঁধা ততই মানুষের ক্রিয়া সুন্দর হয়ে দেখা দেবার সুবিধা পাচ্ছে না।
শিল্পের সৃষ্টির মূলে মানুষের মনের তীব্র আবেগ আছে সত্য, কিন্তু আবেগের বশে যাই করি অই তো শিল্প হয় না। অনেকদিনের পরে বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা, আন্দন্দের উচ্ছ্বাসে তাঁর গাল জড়িয়ে কত কথাই বলা হলো, কিন্তু সেটা কাব্যকলা কি নৃত্যকলা দুয়ের একটাও হল না। কিন্তু বন্ধুর আসবার আশায় ভাবে ডগমগ হয়ে যেন মন নৃত্য করছে, তাঁর জন্যে ফুলের মালা গাঁথছি, নিজে সাজছি, ঘর সাজাচ্ছি—নিজের আনন্দ নান খঁটিনাটি কাজে এটা-ওটা জিনিসে ছড়িয়ে যাচ্ছে—এই শিল্পের দেখা দেবার অবসর । অতৃপ্তির মাঝে মন দুলছে—এই দোলাতেই শিল্পের উৎপত্তি। কামনার তীব্র আবেগ এবং তাঁর
৮৩৫
চরিতার্থতা—এ দুয়ের মাঝে যে একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদ, সেই বিচ্ছেদের শূন্য ভরে উঠছে নানা কল্পনায়, নানা ক্রিয়ায় নানা ভাবে ,নানা রসে, মনের আবেগ সেখানে ঘনীভূত হয়ে প্রতীক্ষা করছে প্রকাশকে। মনের এই, উন্মুখ অথচ উৎক্ষিপ্ত নয়, অবস্থাটিই হচ্ছে শিল্পের জন্মাবার অনুকূল অবস্থা। এ সময় মানু ষসুন্দর-অসুন্দর বেছে নেবার সময় পায়, যেমন-তেমন করে একটা-কিছু করবার চেষ্টাই থাকে না। হঠাৎ যদি বাঘ এসে সামনে পড়ে তবে তাঁর গায়ের চিত্রবিচিত্র ছাপ, তাঁর গঠনের সৌন্দর্য, এ-সব কিছুই চোখে পড়ে না; ভয় এবং পালানো তখন এতই কাছাকাছি আসে যে সৌন্দর্য বোধ করবার অবসর মন পায় না বললেই হয় কিন্তু খাঁচার ওদিকে বাঘ এদিকে আমি, কিংবা দূরে বাঘ লাফিয়ে চলেছে, তখন আবেগ আর ক্রিয়ার মাঝে অনেকটা অবসর; সেখানে বাঘের নানা সৌন্দর্য চোখে পড়ে।
ব্রতের অনুষ্ঠান, শিল্পের উৎপত্তির অবসর কেমন করে এনে দিচ্ছে সেটা দেখা যাক। ব্রত-আচরণ আর শিল্পক্রিয়া—দুয়ের যে নৈকট্য দেখা যায় তাতে করে দুয়েরই উৎপত্তি যে মানব-মনের একই প্রবৃত্তি থেকে, তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকছে না। দুয়েরই মধ্যে দেখছি একটা জিনিস রয়েছে যা দুটোকেই চালাচ্ছে। সেটা হলো কামনার আবেগ । যা কামনা হলো তাই পেলেম তখনি, এ হলে ব্রত হলো না আবেগ থাকা চাই—যেটা নানা ক্রিয়ার মধ্যে পেয়ে পরিসমাপ্ত পাচ্ছে। এ হলো ব্রতের ময়ল কথা।
ব্রতগুলির মধ্যে এই আবেগটির অবসর কোনখানে রয়েছে দেখব। এটা বেশ দেখা যাচ্ছে যে , মানুষ যখনকার যা তখনকার জন্যে ব্রত করছে না। ভবিষ্যতের একটা কিছু পাবার জন্যই ব্রতগুলির অনুষ্ঠান হচ্ছে দেখি।–‘গঙ্গা শুকুশুকু, আকাশে ছাই”। সেই সময় বর্ষার জলধারা কল্পনা করে বসুধারা ব্রতের অনুষ্ঠান। এই যে জ্যৈষ্ঠের সারা মাস আষাঢ়ের ছবি মনে জাগিয়ে মানুষ প্রতীক্ষা করছে, এটা বড়ো কম অবসর নয় আবেগ ঘনীভূত হয়ে
৮৩৬
নানা শিল্পক্রিয়ায় প্রকাশ হবার জন্য। এমন যখন খুব জল, আষাঢ় শ্রাবণ মাস , তখন কুমারী ব্রত নেই। এর পরে ভাদ্র মাস পড়তেই শরতের দিনগুলির জন্যে ব্রত শুরু হলো। শস্য হবে, যারা বানিজ্যে গেছে তারা ফিরবে—এমনি-সব নানা কামনা ভাদুলি ব্রতটির মধ্যে নাট্যকাব্য হয়ে দেখা দিলে এবং আশ্বিনের শস্য-উৎসবে তাঁর পরিসমাপ্তি হলো। এমনি প্রায় প্রত্যেক ব্রতেই দেখি, কামনা অনেকদিন পর্যন্ত—কোথাও এক মাস, কোথাও বা দু মাস—অতৃপ্ত থাকছে চরিতার্থতার পূর্বে। শস্য ফলবার আগেই শস্য-উদগমের ব্রত আরম্ভ হল এবং শস্যের প্রকৃত উদগমের ও কামনার মাঝের দিনগুলো মনের আবেগের নানা কল্পনায় নানা ক্রিয়ায় ভরে উঠে নাট্য, নৃত্য, আলেখ্য এমনি-সব নানা শিল্পের জন্ম দিতে লাগল। চিত্র করতে হলে বড়ো শিল্পী তো যেমন দেখলেন তেমনিটি আঁকলেন না। দেখলেন, দেখে সেটা মনে রাখলেন, এবং হয়তো দেখার থেকে অনেক পরে সেটাকে মন থেকে প্রকাশ
৮৩৭
করে দিলেন; দেখাব ও প্রকাশ করার মাঝে যে-সময়টা সেই হলো যথার্থ শিল্প-কাজের অনুকূল। দেখলেম, কল টিপলেম, ফোটো উঠল, এ হলে জিনিসটা ঠিক অনুকরণ করা গেল বুটে কিন্তু শিল্প বলতে অনুকরণের চেয়ে বড়ো যে-জিনিস্টা তা হলো না। ব্রতের আলপনাতেও তেমনি। সোনার চিরুনি চাই, পিটুলির চিরুনি এঁকে ব্রত করলুম। এখানে আলপনার অনুকৃতি পর্যন্ত রইল। কিন্তু আশ্বিন মাসে লক্ষ্মী ধানের ক্ষেতের মধ্যে দেখা দেবেন কিংবা বসন্তে ফুল ফুটবে, সূর্য উঠবে—এই আকাঙ্ক্ষার অতৃপ্তি যখন মনকে তোলাপড়া ক’রে রয়ে-বসে প্রকাশ হতে চলল তখনই দেখি বিচিত্র আলপনায় পদ্ম , লতা , পাতা, সূর্যোদয়ের নানা রূপক ও ছড়া এবং ফুলের ডালার গান, আমের মুকুলের গান, নানা রঙ্গরস।
আলপনা যে কত রকমের তাঁর হিসেব নিলে দেখা যায়, এখানকার আর্টস্কুলের ছাত্রদের চেয়ে ঢের বেশি জিনিস মেয়েরা না-শিখেই লিখছেন এবং সৃষ্টিও করছে। শ্রেণীবিভাগ করলে আলপনার ফর্দটা এই-রকম দাঁড়ায় । প্রথম, পদ্মগুলি। দ্বিতীয়, নানা লতামণ্ডল বা পাড়। তৃতীয়, গাছ, ফুলপাতা ইত্যাদি। চতুর্থ নদনদী ও পল্লীজীবনের দৃশ্য। পঞ্চম, পশুপক্ষী, মাছ ও নানা জন্তু। ষষ্ঠ, চন্দ্রসূর্য, গ্রহনক্ষত্র। সপ্তম, আভরণ ও নানাপ্রকার আসবাব। অষ্টম, পিঁড়িচিত্র।
৮৩৮
আলপনার শিল্প হচ্ছে সমতল ভিত্তিকে চিত্রণ, এবং যা আঁকছি তাঁর পরিস্কার চেহারাটি দেওয়া। হাতা হাতার মতো না হয়ে হাতের মতো হলে চলে না ব্রতের কাজে। একটা জিনিসের ঠিক চেহারাটি দু-চার টানে আঁকা যে কতখানি ক্ষমতার কাজ, তা চিত্রকরমাত্রেই জানেন । একজন এম এ ক্লাসের ছাত্রকে তাঁর হাতের কলমটা আঁকাতে বললে সে মাথায় হাত দিয়ে বসবে, কিন্তু তারই হয়তো পাঁচবছরের ভগিনীটি এই আলপনার সব কখানা অনায়াসে এঁকে যাবে নির্ভুল—হাতা বেড়ি গহনা ফুল পাতা সবই। মানুষ আর জানোয়ারদের বেলায় মেয়েরা একটু গোলে পড়েছে। কিন্তু এ ছাড়া যেখানে কল্পনা পাঠানো চলে এমন-সব বড়ো- বড়ো আলপনা এবং নানা লতা ও পাড়ের আবিষ্কারে তারা সিদ্ধহস্ত।
সুবচনী-পুজোর আলপনাটিকে আমরা-সুবচনী ব্রতকথার প্রতিরূপ-চিত্র বলে ধরতে পারি। রাজার পুকুরে অনেক হাঁস। তাঁর সর্দার ছিল এক খোঁড়া হাঁস। এক ব্রাহ্মণকুমার সেই খোঁড়া হাঁস মেরে খেয়েছিল এবং সুবচনীর কৃপায় তাঁর মা সেই হাঁসকে বাঁচিয়ে তবে রাজার কোপ থেকে নিস্তার পেয়েছিল।এই গল্পটাকে দেখাচ্ছে এই সুবচনীর আলপনা। সেঁজুতির আলপনা, ভাদুলি ব্রতের নদী ও তালগাছ—এ দুটির মধ্যে নিছক কামনা জানানোর চেয়েও একটু বেশিকাজ মানুষে করেছে। কোঁচফা দুলিয়ে সুপুরিবাগানে কর্তা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, জোড়া-বাংলার দরজায় দুই সেপাই পাহারা দিচ্ছে। এই সুপুরিবাগানের কর্তার সঙ্গে হাতে-পো-কাঁখে-পো মানুষের প্রতীকটির অনেক তফাৎ। যদিও খুব কাঁচা হাতের কিন্তু কর্তার ছবিতে বাস্তবিকটা অন্যটির চেয়ে ঢের বেশি রয়েছে। এমনি নদীর আলপনা। এখানে গ্রামের মাঝ দিয়ে যে নদীটি বয়ে চলেছে, তাঁর বাস্তবিক চেহারাটা দেবার চেষ্টাই নেই; সমস্ত দৃশ্যটি একটি সুন্দর সুন্দর মণ্ডন হিসেবে চিত্রকারিণী দিয়েছেন। এর পর, বাঁশের কোঁড়া, শালের কাজের মতো। তাঁর পর নানা মন্দিরের আলপনাগুলি; এগুলিকে খাঁটি মণ্ডনচিত্র বলা যেতে পারে, যদিও এগুলির সঙ্গে ব্রতীর কামনার খুব যোগ। কিন্তু তাই বলে এগুলি যেমন-যেমন করে মানুষে আঁকে নি। মন্দিরের কারুকার্য, তাঁর গঠনের তারতম্য, চিত্রকারিনী প্রত্যেক দিন নজর ক’রে দেখে দেখে তবে মন থেকে এগুলি প্রকাশ করেছেন, বেশ বোধ হয়।
পদ্মের আলপনাগুলির সঙ্গে ব্রতীর কামনার খুব কমই যোগ দেখা যায়। দু-রকমের পদ্ম দেখা যাচ্ছে।প্রথম শ্রেণীর পদ্মগুলিতে পদ্মের বাস্তব আকৃতি কতকটা দেওয়া হয়েছে এবং জ্যামিতির ঘরগুলিকে পদ্মের আকারে বাঁধা হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় পদ্মের সঙ্গে শঙ্খ জুড়ে
৮৩৯
সেটিকে লক্ষ্মী আসন বলে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু আন্য যে-সব অষ্টদল এবং সেই-সব পদ্মকে ঘিরে যে-সব নানা লতামণ্ডন, সেগুলিকে মণ্ডন ছাড়া আর কী বলা যাবে? কন্যার বাড়িতেও এই-রকম একটি বৌছত্র দেবার নিয়ম। এগুলো ব্রতের নয়। বোম্বাই অঞ্চলে অতিথির সম্মানের জন্যে ভোজনের জায়গাটি রঙ্গোলি (আলপনা) দিয়ে সুন্দর করে দেওয়া প্রথা। উৎসবের দিনে বিশেষ ব্যক্তির সম্মানের জন্যে যে সাজানো-গোছানো করতে হয়, এই আলপনাগুলির সেই কোঠায় ফেলাই ঠিক। বোম্বায়ে অতিথি অভ্যর্থনার জন্য যে আলপনা তারই কতকটা প্রতিরূপ হচ্ছে আমাদের নববধূ আগমনের পানসূপারি-লেখা আলপনাটি। এই ধরনের আলপনাগুলির সঙ্গে মনের নানা ভাবের যোগ থাকলেও এগুলি ব্রতীর কামনা জানাচ্ছে না। লক্ষ্মীর আসনে শঙ্খ, ইন্দ্রের আসনে বজ্র, আবার অন্নপ্রাশনের পিঁড়িতে নানা ব্যঞ্জনের বাটি, আর বর-কনের পিঁড়িতে ‘একবৃন্তে দুই ফুল’, এগুলো প্রধানত জানাচ্ছে আসনের পার্থক্যঃ এটি দেবীর, এটি দেবতার, এটি নবকুমারের, এটি বরবধূর।
৮৪০
এবং ব্যাক্তিবিশেষের রুচি-অনুসারে এই-সব আলপনার অদলবদল হয়। যেমন বিয়ের পিঁড়িতে লদ্ম ও ভ্রমর ইত্যাদিও চলে। এবং এই অদলবদলে বিবাহাদি ক্রিয়ার অনুষ্ঠানে কোনো ব্যাঘাত হয় না। এমন-কি, পিঁড়িতে খানিক পিটুলিগোলা মাখিয়েও কাজ চলে। কিন্তু ব্রতের আলপনা ব্রতীর কামনার পরিষ্কার প্রতিচ্ছবি না হলে ব্রত করা অসম্ভব। প্রথমে কামনা মনে উঠল, তাঁর পর সেটা আলপনায় অথবা পিটুলি দয়ে চিত্রিত গঠিত এবং সজ্জিত হলো, শেষে ছড়ায় মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হলো। আগে কামনা, তাঁর পর আলপনা, তাঁর পর ছড়া, শেশগে ব্রতের কথা বা ইতিহাস—এই কটা মিলে ব্রত পূর্ণতা পেলে।
আপনার শঙ্খলতামণ্ডনটির বিষয়ে একটু ব্বিচার করে দেখা প্রয়োজন। আলপনার সমস্ত লতামণ্ডনগুলিতে একটি বিশেষত্ব দেখা যায় এই যে, এগুলি মেয়েরা নিজে থেকেই আবিষ্কার করেছে, এবং এক বাংলার আলপনা ছাড়া, কি মান্দ্রাজে, কি বোম্বায়ে, কোথাও এত সুন্দর এই ধরনের লতামণ্ডন দেখি নি। মান্দ্রাজের ‘দড়ির জাঁস’ এবং বিন্দুই আলপনা-চিত্রের ভিত্তি।
কিন্তু বাংলার মেয়েরা প্রকৃতির মধ্যে যে-সব লতাপাতা তাকেই ভিত্তি করে আলপনা কলালতা, কলমিলতা, খুন্তিলতা, চালতালতা, চাঁপালতা, শঙ্খলতা সৃষ্টি করেছে দেখি। শঙ্খের ঘোরপেঁচগুলি প্রাচীন গ্রিস ও ক্রিটদেশের একটি প্রধান মণ্ডন। কিন্তু এই বাংলাদেশের শঙ্খলতায় শঙ্খের স্বরূপটি যেমন সুস্পষ্ট এমন আর কোনো দেশেই নয়। এইব শঙ্খলতার ঘোরপেঁচ শঙ্খ থেকে কি জলের আবর্ত থেকে, সেটা ইউরোপের মণ্ডনগুলি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় না এবং এ নিয়ে সেখানকার পণ্ডিতে অনেক তর্কবিতর্ক চলেছিল। কোনো পণ্ডিতে বলেন এই লতামণ্ডন প্রথম ইজিপ্তে, কেউ বলেন ক্রিটদেশে—আবার কেউ বলেন ইউরোপখণ্ডে গ্রিসদেশেরই এরভ প্রথম উৎপত্তি। কিন্তু কোথাও বাংলার মতো শঙ্খলতার নিঁখুত চেহারাটি আমরা পাই নে। ক্রিট , ইজিপ্ত এবং গ্রিস—সব থেকে দূরে এ বাংলাদেশ’ এবং ওইসব প্রাচীন সভ্যতা থেকে কতদূরে এখনও রয়েছে বাংলার এককোণে যশোর। সেখানকার মেয়েদের হাতে এই শঙ্খলতাটি। এই লতামণ্ডন যে খুবই প্রাচীন, আধুনিক কোনো-কিছু থেকে নকল নয়, তা নিশ্চয়ই বলা যায়। বাঙালির মেয়ের সব চেয়ে পুরনো
৮৪১
এবং সব চেয়ে সুন্দর ও যত্নের অলংকার শাঁখা। শাঁখ লক্ষ্মীর চিহ্ন এবং কড়ি ছিল এককালে এদেশের পয়সা। কাজই শাঁখ এবং তা থেকে শঙ্খলতা আবিষ্কার এদেশে যে ক্কেন খুব প্রাচিঙ্কালে হবে না, বুঝে নে । তা ছাড়া বাঙালি জাতিও বড়ো কম দিনের নয়। ইজিপ্তের রানিরা এবং গ্রিসের সুন্দরীরা ঢাকার মসলিন পরতেন যখন তখন যে বাংলাদেশ ও বাঙালি বর্তমান ছিল, অন্তত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না; এবং পূর্বকালে কোনো ঢাকাই শাড়ির পাড়ে লুকিয়ে এই শঙ্খলতা গ্রিসে ও ইজিপ্তে চালান যায় নি, তাই বা কে বলতে পারে । একই চিন্তা, একই শিল্প , একই মণ্ডন পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অংশে স্বাধীনভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে—এটা মানুষের ইতিহাসের একটা সাধারণ ঘটণা; কাজেই এ বিষয় নিয়ে তর্ক করা চলে না।