লম্বকর্ণ পালা
(শ্রীরাজশেখর বসু কর্তৃক রচিত ‘গড্ডলিকা’ পুস্তকের ‘লম্বকর্ণ’ শীর্ষক কাহিনী অবলম্বনে)
প্রথম পর্ব
[স্থান- বর্ষা অয়েল কোম্পানি, কাল- না সকাল না বৈকাল।]
অধিকারী, নটবর, নবীন ও নরহরির প্রবেশ
অধিকারী। কৈ হে, ও লটবর, ও লবিন, লরহরি, মহালয়া এসে যায়; মহালয়ার নাম কর না যে কেউ?
নটবর। অধিকারী মশয়, আমাদের তো সব প্রস্তুত, মহলা দিলেই হয়।
অধিকারী। বলি ও লন্দি, পাঁঠার জোগাড় করলে? পাঁঠা তো চাই একটি পালাগানে।
নটবর। সে জোগাবে ঐ লবীন লিউগী।
নবিন। বেশ কথা কও! লিউগী বিউগিল দেবে আবার পাঁঠাও দেবে-এত করে না।
নটবর। কী হে লবীন, ঘাড় চুলকাও যে? পাঁঠা আনছ না?
নবীন। আহা বলেন কেন দুষ্কের কথা, ঐ খালপাড়ে দেখলাম, যেমনটি চাই তেমনটি পাঁঠাটি,-দিব্বু হিরিষ্টু পুরিষ্টু ছাগল। কুচকুচে কালো নধর দেহ, নম্বা নম্বা নটপটে কানের ওপর কচি পটলের মতো দুটি শৃঙ্গ বয়স বেশি নয়, এখনো অজাত-শ্মশ্রু। আমায় দেখে ডাক দিয়ে চল্ল যেন গীদ গেয়ে করুণ স্বরে ধমকে ডাকছে।
নবীনের গান
ম্যা ও ম্যা কোথা যাই গো ম্যা?
বলো কার দোরে পেট ভরে খেতে পাইব ম্যা?
নটে শাক মুড়োবে কি-
পুঁইডাঁটার পাই না লাগ-ম্যা ও ম্যা দেখ।
আমার পেট বলছে কী খাই কী খাই
পুঁজি কিছু নাই পাঁঠা কিছু নাই
ম্যা ম্যা বলে ডাকতেছি তাই স্থান দাও ঐ ছিরিচরণে!
আমি আদর করে ডাক দিলেম-(সুর দিয়ে) ‘এসো যাদু আমার বাড়ি, তোমায় দেব ভালোবাসা’,-বোকা ছাগলের জাত,-ভালোবাসা বুঝলে না। গলা জাপটে ধরতে ঢুঁসিয়ে আমায় ফেলে মারলে দৌড়।
অধিকারী। বড় ফসকেছে, যাগ্গা! বলি ও লরহরি লাগ,-তুমি দেবা লবমীতে ছাগ, বুঝলে?
নরহরি। আজ্ঞা!
অধিকারী। আর আপত্য তুলো না, লাগ আর ছাগ, ঠিক লাগ মাফিক মিলে গেছে। লাও হে প্রোগ্রম গীদটা ধরো।
নটবরের গীত
বেলেঘাটা যাত্রাসদনের বংশীবদন অধিকারী।
ব্যান্ডমাস্টার লন্দি লটবর, লিউগী বিউগিল ফুলট,
আর ছাগলাগ-লরহরি।
কর্নেট ও কর্তাল, ঢোল, খোল, লবীন, ললিত, ললিন, অধীন;
চপলেট্, কটলেট্, রাধাকান্ত কেবিন।।
পৃষ্ঠপোষক বর্মা অয়েল অ্যান্ড কোং-
পাত্র-পাত্রী পাঁঠা সমেত উনিশ জন।
বেলেঘাটা যাত্রাসদন বাসাবাড়ি
লম্বকর্ণ পালা করিল সদরালা-বিনানুমতি; রেজিস্টারি!
উইথ্ কম্প্লিমেন্টস্ টু গড্ডলিকা প্রিন্টারি।
নটবর। ধরো হে কনসার্ট, ক্রেসিন ব্যান্ড,-আর বিলম্ব নয়!
(নরহরির প্রস্থান)
ছোট কনসার্ট
(নরহরির প্রবেশ)
নরহরি। মশয়রা, আমি এইমাত্র দেখে আসতেছি ছাগল।–
অধিকারী। কোথায়, কী ভাবে দেখে আসতেছ তাই শুনি।
নরহরি। দেখে আলাম ছাগল-বংশলোচনবাবুর জামার প্রান্ত ধরিয়া টানিতেছে এবং বলিতেছে হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ করিয়া।
অধিকারী। রও রও, ছাগল কী বলছে পরে শুনব। বংশলোচনবাবুটি কে তাই কও আগে।
নরহরির গান
রায় বংশলোচন ব্যানার্জি বাহাদুর জমিন্দার,
অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ফুলবেঞ্চ বেলেঘাটার।
বয়ঃক্রম চল্লিশ পার, কিঞ্চিত মুটিয়ে
হয়ে পড়েছেন স্থুলাকার
সেই কারণে কন্সাল্ট করে ডাক্তারগণে
উপদেশ করেছেন-দুই পায়ে হাঁটিবার।
ছেড়ে ভাত ও লুচি পুরি
দুবেলা খান দুই তঙ্কার কচুরি-
লঙ্কামিশানো ঝালতরকারি;
আর খালপাড়ে বৈকালে হাওয়া খেয়ে করেন পায়চারি,
ঘড়ি ধরে এক্সারসাইজ কয়েকবার।
অধিকারী। তারপর কী হলো কও।
নরহরির গান
আরে বংশলোচনবাবু খালপাড়ে চলতে চলতে
বসে পড়লেন
রুমাল পেতে
নিজের ভারে হয়ে কাবু-গিলে মাটিতে
জুতো পাটিতে কেটে গাবু
আরে বংশলোচনবাবু ঘড়ি দেখে চান-
বাড়ি ফিরে যান সাড়ে ছটায়-
এধারে বেলেঘাটার বাতাস হঠাৎ বলে যায়-
ঝড় কী জল হওয়া বিচিত্র নয়;
বংশলোচন হয়ে আনমন বর্মা চুরুট মুখে লন-
এমন সময়…হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ।
নটবর। ঝড় উঠল নাকি, হুঁ হুঁ করে?
নরহরি। নাগো। বাবু ফিরে দেখলেন-ছাগল হু হু করে বলছে তাঁর জামা টেনে।
অধিকারী। কী বলছে, তা বুঝলে কী মতে, তুমি মানুষ হইয়ে।
নরহরি। ভাবে বুঝলেম, ভঙ্গিতে বুঝলেম আলাপচারির!
অধিকারী। আচ্ছা কও তো, কী কইলে ছাগলছানাডা, কীবা কইলেন বংশলোচন।
নরহরি। হঠাৎ পকেটে টান পড়াতে, বংশলোচন সচকিত সশংকিত কয়ে উঠলেন-‘আরে এটা কোথা থিক্যে? কার পাঁঠা? কেটা আছে কাকেও তো দেখছি না’-? ছাগল কোনো উত্তর দিল না। কাছে ঘেঁসিয়া লোলুপ নেত্রে তাঁহাকে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। বংশলোচন তার মাথায় ঠেলা দিয়ে বললেন-‘যাঃ, পালা, ভাগো হিঁয়াসে’।
অধিকারী। গেয়ে বলো হে গেয়ে বলো।
নরহরির গান
পালা, নইলে শিঙে ফোঁকার পালা,-
শুরু করে দেব লোকজন ডাকি।
রোস্তো গর্দান কাটছি, ভাগ্ নয়তো পালা,
বোকা ছাগল পা চালিয়ে পালিয়ে যাবার পালা-
শুরু কে দিয়ে পালা!
অধিকারী। তারপর তারপর? ম্যাজিস্ট্রেটের ধমক খেয়ে কী করল ছাগল?
নরহরি। কান্তি থাকল আর গাইতি থাকল ম্যা ম্যা করে। দুবার কান্তেই বংশলোচনের মন গলে নয়নে জল বইল। তিনি ছাগলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই-ছাগল দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, সামনের দু’পা মুড়ে, ঘাড় না বেঁকিয়ে, রায়বাহাদুরকে এক ঢুঁ-।
অধিকারী। অ্যাঁ! ম্যাজিস্টরকে ঢুঁ, অ্যাঁ! এ যে অয়াসল্ট গো, অ্যাঁ! ফুলবেঞ্চ ফাটক্! রায়বাহাদুর করলেন কী?
নরহরি। ঢুঁ খেয়ে রায়বাহাদুর কৌতুক বোধ করলেন, তিনিও দিলেন এক ঠেলা। ছাগল পূর্ববৎ খাড়া হইল, এবং তাঁর হাত হইতে জ্বলন্ত চুরুটটি কাড়িয়া খাইল, এবং আহারান্তে বলিল অড্-ড্-ড্-ড্? অর্থাৎ, আর আছে?
নবীন। ও ছাগল নয় হে, শাপভেষ্টো, শাপভেষ্টো, বুঝলে? বাগবাজারের তোমার তিনি, সেও আগুনঅসুদ্ধ বিড়ি ফুঁকত।
নরহরি। না হে, অমন কথা বোলো না, আমাদের তিনি গাঁজার দিক দিয়েও যেতেন না। এ তোমাদের বর্মা অয়েল কোম্পানির আড়তের শাপভেষ্টো কেষ্টোবিষ্টুর মধ্যে কেউ একজন হবেন। না হলে জ্বলন্ত বর্মায় পেট ভরায়?
অধিকারী। যাকগে, তারপর কও।
নরহরি। তারপর একে একে একটির পর একটি চুরুট নিঃশেষ করে-ছাগলের মাথা ঘোরা নেই, গা বমি নেই। আবার যখন বললে অড্-অড্-ড্, তখন বংশলোচন বল্লেন-‘আর নেই। তুই এবার যা। আমিও উঠি।’ ছাগল বিশ্বাস করে না, সার্চ করতে চায় হাকিমের পকেট। বংশলোচন নিরুপায়! চামড়ার ছিগার কেসটি ছাগলের সামনে ধরে বল্লেন-‘বিশ্বাস না হয়, এই দেখ বাপু।’ ছাগল এক লম্ফে ছিগার কেস কেড়ে নিয়ে চর্বণ শুরু করে দিলে।
নবীন। আর রায়বাহাদুর?
নরহরি। রাগবেন না হাসবেন ঠিক করতে না পেরে-শ্ শালা বলে ঘরমুখো হলেন। ছাগলও নাছোড়বান্দা, তাড়ালে যায় না-চলল রায়বাহাদুরের সঙ্গে।
অধিকারী। কিছু বলতে বলতে গেল ছাগলটা, না এমনি মুখ বুঁজে গেল?
নরহরি। মুখ বুঁজে যাবার ছেলে কিনা-রাস্তার দুধারে কারু টবের গাঁদা ফুলের গাছ চিবোয় আর চলে। শেষে উড়ের দোকানে ডালমুট, তিলকুট, বিস্কুট-প্রায় এই আমার সাড়ে তিন গ্রাস লুটে-বিচারকের পিছনে পিছনে ঢুকল গিয়ে-তারপর কী ঘটনা ঘটল আন্দাজ করেন।
অধিকারী। রাখো তোমার ভূমিকা, তারপর কিছু জানো তো বলো।
নরহরি। আমি কি রায়বাহাদুরের বাড়িতে ঢুকতে গেছি যে বলব কী হলো? তারপর আর কী। আমার কথাটি এখানে ফুরল নটেশাকটি সেখানে মুড়োল। তোমরা কেউ জান তো কও, নয় আন্দাজ করো।
নটবর। আন্দাজের দরকার নেই, ধরো হে, গান ধরো।
গান
দেখেন দেখেন চেয়ে দেখেন জেগে জেগে বসে দেখেন।
উল্টে দেখেন পা্ল্টে দেখেন লম্বকর্ণ পালা দেখেন।
চিনে রাখেন আসেন কে কে, জেনে রাখেন যান কে কে-
রায়বাহাদুর বংশলোচনবাবুর এই বৈঠকেতে।
ঘুঘু দেখেন ফাঁদও দেখেন-হেসে দেখেন
কেঁদে দেখেন।
কচ্লে আঁখি ঢুলে দেখেন-নেচে দেখেন
কুঁদে দেখেন।
বেলেঘাটায় যাত্রাপার্টির লম্বকর্ণ পালা দেখেন।
দ্বিতীয় পর্ব
(বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানা ঘর-বিনোদ, নগেন ও উদয়ের প্রবেশ)
বিনোদ উকিল। ও চাটুজ্যে, আসতে আসতে গেলে কোথা? বলি ও চাটুজ্যে, হুঁকো বৈঠক রইল এধারে তুমি রইলে ওধারে? চলে এসো, কথাই কও না যে!
(চাটুজ্যে ও মিঞার প্রবেশ)
চাটুজ্যে। এই যে ভাই, মিঞা সাহেব আদাব, বৈসেন। বৈসেন। শ্রূয়তাং-এই হচ্ছে বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানা-যেখানে সান্ধ্য আড্ডায়, নিত্য নিত্য বহুসংখ্যক রাজা উজির বধ হইয়া থাকেন, বুইলেন? ও তোমার লাটছাহেব সুরেন পাল, বিপিন বাঁড়ুজ্যে, মোহনবাগান, পরমার্থতত্ত্ব, প্রতিবেশী অধর বুড়োর ছেরাদ্দ, আলিপুরের নতুন কুমির- কোনো প্রসঙ্গই বাদ যায় না। সম্প্রতি সাতদিন যাবৎ বাগের বিষয় নিয়ে হাতাহাতি চলছে, এ বাড়ির মামাবাবু নগেন আর ভাগনেবাবু উদয়ের মধ্যে, বুইলেন?
মিঞা। বাঘের কথা যদি তুল্লেন তো শোনেন বলি এক কেচ্ছা-
এক রোজ আষাঢ় মাসে বাতাস ছিল ছর্দ
ঘরে ছক্কা পিইতেছিলাম আমি এক মর্দ।
দর্দ ছিল হস্ত পদে টনটন বাতের
দলিজাতে বৈসে ছিলাম বিমারি খাতের।
ভাবতেছিলাম ছোটবিবি থাকত এইখানে
ইত্তিফাঁক বাঘের গর্জন পৌছে গেল কানে।
হুক্কা হাতে গুটি গুটি যাব খিড়কি দ্বারে
লম্ফ দিয়ে কেন্দো বাঘ পড়ল এসে ঘাড়ে।
হলদি-কালা ডোরা কাটা সতরঞ্চখানা
ঝড়ে যেন উড়ে পইল এমনি বাঘের হানা।
তারপর হুড়াহুড়ি বাঁও কষাকষি
যুদ্ধু যেন লেগে গেল বাঘ আর মষি।
বাঘের শক্তি মানুষের বুদ্ধি কেউ কারে না পারি
করি তাগ বাঘের নাক মারলাম হুক্কার বাড়ি।
ভাঙা নাক বাঘ পালায় আঁক আঁক করি
ধীরে সুস্থে পানি নিলাম হুক্কাটায় ভরি।
ভাঙে নাই নলচেটা নছিবে আমার
বখরাটার সেই হইতে খোঁজ পাই না আর।
এইখানে হইল সারা অধীনের কেচ্ছা
চাটুজ্যে মশাই, হুক্কা তোমার বলছে মিচ্ছা মিচ্ছা।।
চাটুজ্যে। ঠিক ঠিক, নাও ভাই মিঞা সাহেব কলকেটা, ও নগেন ফরসিটা দাও না এগিয়ে।
নগেন। লেন লেন।
মিঞা। দ্যেন দ্যেন-
এই মুছলমান আর হিদুঁয়ান ছিল জেতের বিচার
ভেবে দেখো তাম্বাকুতে কইল একাকার।
কেওড়া যেথা তামাক খায় বামনা সেথা এসে
আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে তার নজ্দিকেতে বসে।
আড়ে আড়ে চায় এমনি তামাক খাবার বাই
হাত বাড়িয়ে বলে তোমার কলকেটা দ্যাও ভাই।
উদয়। ঠিক ঠিক, মিঞা সাহেব না হলে কি মজলিস জমে?
মিঞা। সাচ্চা বাত বলেছেন-
উয়ো মজলেস তো বিরাম, যাঁরা হুক্কা নাবাসৎ।
আমীর ও ওমরা, গরীব ও গোবরা, সবকা মুনাজৎ হুক্কা।
ছিলম ও ফরসি, নলওয়া নলচি, এ জী খুসীওঁকি এলচি।
বারাম দরবার কি আরাম, বে-আমেরিকা দোস্ত-বাসৎ বাসৎ।
চাটুজ্যে। বলি ও উকিল, ও বিনোদ শুনচো? তোমরা ভাই খবরের কাগজ রাখ। নগেন, মিঞা সাহেবকে সেই বৈঠকখানার বর্ণনাটা শুনিয়ে দাও। ডুগিটা ধরো না হে।
গান
বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানা ঘরটি-
আয়না, আলমারি, চেয়ার ইত্যাদি জিনিসপত্রে ভর্তি
প্রথমেই নজরে পড়ে, কার্পেটে বোনা আসমানি
রঙের বেঁটে বিড়ালের ছবিটি।
যুদ্ধের সময় সাদা পশম রাধাবাজারে ছিল নাই
শুধু সেইজন্য বন-বিড়াল হলো নীল বর্ণ
ছবির নিচে তাই C-A-T ক্যাট লিখা আছে
ইংরাজী অক্ষরে-
তার নিচে হস্তাক্ষরে রচয়িতার নাম-
মানিনী দেবী।
অপর দেওয়ালে ডবল ফুলস্ক্যাপ-
রায়বাহাদুরি সনদের নকল
ঐ জ্যান্ত টিকটিকি করেছে দখল
গিল্টি করা ফ্রেমের কোণটি।
উদয়। এইবার হয়েছে মামাবাবু, ন্যাজ ধরে টিকটিকিটার মাপ করা যায়, না ন্যাজ বাদে?
কিন্তু যাই বল, বাঘের মাপ কখনই ন্যাজসুদ্ধ হতে পারে না। তাহলে মেয়েদের মাপও চুলসুদ্ধ নিতে হয়? আরে আমার বোয়ের বিনুনিটাই তো তিন ফুট হবে, তুমি কি বলতে চাও, বউ আমার আট ফুট লম্বা?
নগেন। দেখ উদো, তোর বোয়ের বর্ণনা আমরা মোটেই শুনতে চাই না। বাঘের কথা বলতে হয় তো বল, নয় তো শুধো মিঞা সাহেবের কাছে-
চাটুজ্যে। আহাঃ, তোমাদের এখানে কি বাঘ ছাড়া অন্য জানোয়ার নেই। (নেপথ্যে- ম্যা ম্যা ম্যা শব্দ) অ্যাঁ। এ যে পাঁঠা ডাকে দেখি ষষ্ঠীতে পাঁঠা! হে মা-ষষ্ঠী, দেখতে হলো তো।
(প্রস্থান)
টেঁপী। (নেপথ্যে)ওমা শিগ্গির এসো পাঁঠা এসেছে।
(বংশলোচন, টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রবেশ)
বংশ। চুপ চুপ টেঁপী।
টেঁপী। বাবা আমি পাঁঠাটা পুষব, একটু লাল ফিতে দাও না।
বংশ। বেশ তো, একটু খাওয়া দাওয়া করুক তারপর নিয়ে খেলা করিস এখন।
টেঁপী। পাঁঠার নাম কী বল না?
বংশ। নামের ভাবনা কী; ভাসুরক, দধিমুখ, মসীপুচ্ছ, লম্বকর্ণ-
ঘেন্টু। ও লম্বকর্ণই ভালো। ও বাবা! আমি পাঁঠা খাব, পাঁঠার মে-মে-মে মেটুলি খাব।
টেঁপী। যাঃ, যাঃ, শুনে শুনে কেবল খাই খাই শিখেছে।
নগেন। ঘেন্টুটা আমার ধাত পেয়েছে, নরাণাং মাতুলক্রম; দিব্যি পাঁঠাটি।
বিনোদ। বেশ পাঁঠাটি; কিন্তু বে-ওয়ারিস মাল, বুঝলে হে রায়বাহাদুর? বেশিক্ষণ ঘরে না রাখাই ভাল। সাবাড় করে ফেলো-কাল বুধবার আছে লাগিয়ে দাও।
(চাটুজ্যের প্রবেশ)
চাটুজ্যে। আমি পেট টিপে দেখলাম দিব্বি পুরুষ্টু পাঁঠা। খাসা কালিয়া হবে।
নগেন। উহু, ইয়া উরুৎ, হাঁড়িকাবাব-একটু বেশি করে আদাবাটা আর প্যাঁজ।
উদয়। ওঃ, আমার বউ অ্যায়সা গুলিকাবাব করতে জানে।
নগেন। উদো আবার-
বংশ। তোমাদের কি জন্তু দেখলেই খেতে ইচ্ছা করে? একটা নিরীহ অনাথ প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে-তা কেবল কালিয়া আর কাবাব।
টেঁপী। এই যে লাল ফিতে পেয়েছি বাবা।
বংশ। আরে এ যে আদালতের নথির ফিতে! তা যাক, শোন তোর মা এখন কী করছে?
টেঁপী। এক্ষুনি কলঘরে গেছে।
বংশ। ঠিক জানিস? তাহলে এখন এক ঘন্টার মত নিশ্চিন্দি। দেখ, ঝিকে বলে, চট করে ঘোড়ার ভেজানো ছোলা চারটি নিয়ে ঐ বাইরের বারান্দায় ছাগলটাকে খেতে দে; খবরদার বাড়ির ভেতরে নে যাসনি যেন-মা রাগ করবে।
(টেঁপীর প্রস্থান)
ঘেন্টু। আমি পাঁঠা খাব, আমি মেটলি খাব। ও দিদি! ও মা আমায় পাঁঠা দিলে না। ও মা বাবা পাঁঠা এনেছে।
(প্রস্থান)
নগেন। তোমার মাথা এনেছে, ঝড় ওঠালে এইবার।
বিনোদ। চলি হে-চাটুজ্যে চলো না? ওঠো মিঞা সাহেব।
বংশ। নগেন যাও কোথা? ও উদয়।
উদয়। মামাতে আমাতে আপিসঘরে রইলেম,আপনি যান অন্দরে।
ঘেন্টু। (নেপথ্যে) দিদি আমি লম্বকর্ণ খাব। ও মা শিগ্গির এসো লম্বকর্ণ দেখবে।
বংশ। চুকন্দর সিং-
চুকন্দর। (নেপথ্যে) হ-জৌ-র।
তৃতীয় পর্ব
কনসার্ট
(মানিনীর প্রবেশ)
মানিনী। আ মর। ওটাকে কে আনলে? দূর দূর-অ ঝি অ বাতাসী, শিগগির ছাগলটাকে বার কর।
(ঘেন্টু ও টেঁপীর প্রবেশ)
টেঁপী। বা রে। ওকে তো বাবা এনেছে-আমি পুষব।
ঘেন্টু। আমি ঘোড়া ঘোড়া খেলব।
মানিনী। খেলা বার করে দিচ্ছি। ভদ্দরলোকে আবার ছাগল পোষে? বেরো বেরো-অ চুকন্দর সিং।
(চুকন্দরের প্রবেশ)
চুকন্দর। হে-জৌর?
মানিনী। কোথায় ছিলি?
চুকন্দর। মায়ী, কলকাত্তামে বড়া চট্টা ঔর ডাকুকা হুজ্জত হোতা, দেউড়ি পর রহাথা।
মানিনী। দেউড়িতে রয়তা। এদিকে ছাগল ঘরে ঢুকে আয়তা, চোর ডাকু সামলায়গা তুমি? ছাগলটাকে এক্ষুনি নিকাল দিয়ে আও-একদম ফটকের বাইরে-নেই তো এক্ষুনি ছিষ্টি নোংরা করেঙ্গা।
চুকন্দর। বহুত আচ্ছা।
(বংশলোচনের প্রবেশ)
বংশ। দেখো চুকন্দর সিং, এই বকরি গেটের বাইরে যাগা তোমার নোকরি ভি যা’গা।
চুকন্দর। বহুত আচ্ছা।
(প্রস্থান)
মানিনী। টেঁপী হতচ্ছাড়ি, রাত্তির হয়ে গেল,গিলতে হবে না? থাকিস তুই ছাগল নিয়ে। কাল যাচ্ছি আমি হাটখোলায় বাপের বাড়ি-পুজো দেখব।
টেঁপী। আমিও যাব মামার বাড়ি
বংশ। ঘেন্টু, ঝিকে বলে দে, এই একতলার ঘরেই আমার শোবার বিছানা করে দেবে, আর দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে পারি না। আর দেখ, ঠাকুরকে বল আমি মাংস খাব না-
ঘেন্টু। তোমার ভাগটা আমি খাব বাবা?
বংশ। তরা খাস, আমার শুধু খানকতক কচুরি, একটু দাল আর পতল ভাজা হলেই চলবে। না হলেও আপত্তি নেই। যা তরা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়গে-আমি এই ঘরেই রইলেম।
মানিনী। ঘেন্টু চলে আয় বলছি-
ঘেন্টু। আমি বাবার সঙ্গে মাংস খাব-রাধাকান্ত কেবিন থেকে আসছে।
মানিনী। তাহলে রইলে তুমি-কাল মামার বাড়ি যাব আমরা সবাই।
(মানিনী ও টেঁপীর প্রস্থান, ঘেন্টুর অনুসরণ)
বংশ। (বসিয়া) আমি কুকুর পুষি, পাঁঠা পুষি,-তাতে কার কী বলবার আছে? আমার কি সখ নেই-না আমি একটা হেঁজিপেঁজি লোক! পঞ্চাশ টাকা জরিমানা ও একমাস জেল দিতে পারি। বাপের বাড়ি যাবেন-যান; কিসের দুঃখু? আমি কারো তোয়াক্কা করি না- বেঁচে থাক রাধাকান্ত কেবিন, দু’বেলা কাটলেট, চপলেট। ভুটের গান, ছাগল নাচ-চুকন্দর সিং-এর ঢোল-এইসব চালাব-দেখি কী করেন। আমার সখ নেই! নিজেও সেদিন-দেখি খেড়োর খাতাটা- হ্যাঁ এই যে, ক’মাসে পনেরোটা জলচৌকি, তেইশটা বঁটি, আড়াই শ’ টাকার খাগড়াই বাসন কেনা হয়েছে। যত দোষ ছাগলের বেলা। দোষ করেছে আমার ভুটে বেচারা। মোট ঘাড়ে চলতে গিয়ে গরমের দিনে হুমড়ি খেয়ে, ফেন্ট হয়ে পড়ল দরজায়-সেই থেকে রেখেছি তাকে নিজের হেপাজতে। বড় অপরাধ তার আর আমার-
(ভুটের মোট কাঁধে প্রবেশ)
বংশ। আরে রাখ রাখ তোকে বইতে বল্লে কে! আর কি লোক ছিল না?বোস বোস, মাইনে কত পেয়েছিস?
ভুটে। সাত আনা এক পাই।
বংশ। বাজারের পয়সা সরিয়েছিলি বুঝি?
ভুটে। না, চারদিন ম্যালোয়ারি ভুগেছিলুম।
বংশ। হুঃ, যতসব-দেখ ভুটে, আজ থেকে তুই আমার ছাগলের হেপাজত করবি-খোরাকি পাবি এক টাকা বুঝলি? ওটাকে নাচ শেখাবি ডুগডুগি বাজিয়ে-ছাগল নাচের পাঁচালি জানিস?
ভুটে। একটা অজামিলের পাঁচালি বটতলা থেকে আনব?
বংশ। তাই কিনে নিস, বুঝলি? আচ্ছা, এখন একটা ঠাকরুণ বিষয়ে গা তো শুনি, ছাগল থাকগে।
ভুটে। একটা আগমনী গাই; পুজোর দিনটা!
গান
মা আইসে আইসে গন্ধবহ মন্দ মন্দ গন্ধ বহিছে।
আর অন্ধকারে পাখিরা কইছে, মা ঐ যে মা ঐ যে-
দয়াময়ী আমাদের মা এইলো।
মানিনী। (নেপথ্যে) এত রাত হলো, ঘুমের নাম নেই মেয়েটার, গান শোনা হচ্ছে ছাদে উঠে। নেমে আয়; খেয়ে দেয়ে ঘুমোতে চল। বাতাসী, বৈঠকখানায় বিছানা দিলি?
বংশ। কানে পৌচেছে এখান থেকে তোর ডাক। যা ভুটে। আমিও শুইগে কিছু খেয়ে। এই যে টাকাটা, বলিস-রোস কী বলবি?
ভুটে। বলব অজামিলের বই, দড়া, আর মাটির কলসী ওই ছাগলটার জন্য।
বংশ। মিছে কথাটা বলবি? বলিস কর্তা গান শুনে বখসিস দিয়েছে। হ্যাঁ, এত ভয়টা কী? আমার কি সখ নেই-না পয়সা তোমারই একলার?
দে গীতাখানা, রাত জেগে পাঠ করি গে। ছাগলটার যে সাড়া শব্দ পাই না। চুকন্দর সিং বকরি ঠিক?
চুকন্দর। (নেপথ্যে) হাঁ হজৌর।
বংশ। ফাটক বন্ধ্?
(নেপথ্যে ফটক বন্ধের শব্দ)
চুকন্দর। হ-জৌ-র।
(ছাগলের ডাক-অন্ধকার স্টেজ)
চতুর্থ পর্ব
গান
রাত্রি আন্দাজ সওয়া একটা, জোরে জোরে
বইতেছে হাওয়া ঠান্ডা;
বারান্দায় নেড়ে ঝাপটায়, ইদিকে মিটমিটে
পিদুমের আলোতে দেখা যায়-
বংশলোচনের বৈঠকী অন্দরটা।
বংশলোচন বিজুলি সুইচ বন্ধ দিয়া গীতাখানি
বুকে নিয়া নিদ্রাগত হলেন-
নাসিকাধ্বনিতে ঘরখানি জুড়ে নিয়া।
বারান্দায় ঘুমায় চুকন্দর সিং,
আঙিনায় ঘুমায় ভুটে মুটিয়া
বরষার স্বপ্ন রোমন্থন করে-লম্বকর্ণ,
দোক্তার নেশায় ঘুম গেছে তার
ঠান্ডাতে চটিয়া।
বিরক্ত হয়ে ছাগ-নন্দন, চিবায়ে রজ্জু-বন্ধন
নিঃসারে প্রবেশ করে-
পাপোষ খেয়ে, দ্বারদেশ খোলা পাইয়া।
(স্টেজ অন্ধকার- রাত্রি আন্দাজ সওয়া একটা। অন্ধকারে বংশলোচনবাবু শুয়ে আছে।)
বংশ। কখন এলে? অন্ধকার যে- ও কি ও? কে ও? এই উই উঃ।
(নেপথ্যে ঝন ঝন শব্দ)
চোর চোর, বাঘ হ্যায়-এই চুকন্দর সিং ডাকু ডাকু-জলদি আও-নগেন, উদো-আলো জ্বাল্-শিগ্গির আয় মেরে ফেল্লে!
(নেপথ্যে ব্যা-ব্যা-ব্যা শব্দ। নানা অস্ত্রে সকলের প্রবেশ-হাতা, বেড়ি, বন্দুক, টেনিস ব্যাট ইত্যাদি)
মানিনী। কী হলো গো?
বংশ। রোসো রোসো মাথা ঘুরছে। উঃ, কিম্ভুত কিমাকার কী একটা গায়ে হাত দিয়েছে আমার।
মানিনী। কেমন দেখলে গো চেহারা-স্বপন না তো?
বংশ। ওষ্ঠ মাস ঠেলি-দন্ত আছে মেলি, দশ দশ আঙ্গুলিতে বজ্রনখ ধরে।
মানিনী। দস্যি মেয়ে, পালিয়ে আয় বলছি?
টেঁপী। (নেপথ্যে) বাবা, এই ঘরে আছে। তোমার গীতার পাতা খাচ্ছে দেখোসে-ও বাবা তোমার সনদ খেল। মা, তোমার পশমের বিড়াল খেল। যাঃ-
(নেপথ্যে ঝন্ ঝন্ শব্দ)
বংশ। কে রে ওখানে-ও টেপু ও বাতাসী কী দেখলি?
চুকন্দর। বাবুকো ঠাকুরজী বাঁচায়া-
মানিনী। তুই থাম্। পালিয়ে আয় ঘেন্টু,
টেঁপী। কথা শুনছিস না? দেখাব কাল মজা-
(ঘেন্টু টেঁপীর প্রবেশ)
ঘেন্টু। খক্কোস্! পিদুমের গরম এড়ির তেল খেয়েছে।
টেঁপী। পালিয়ে গেল জানালা টপকে,-চুকন্দর সিং ফটক বন্ধ করো।
বংশ। না না, গেছে যাক্।
উদয়। কে, কে রে টেঁপী? কে পালাল? দেখলি কাকে-চোর না ডাকাত?
নগেন। কী রকম দেখতে অ্যাঁ-
ঘেন্টু। ঠিক লম্বকর্ণের মতন।
টেঁপী। লম্বকর্ণই তো, মতন কি আবার?
মানিনী। কালই ওটাকে বিদায়। ছাগল নাচানো বার করছি ভুটের। চলে এসো উপরে, চুকন্দর সিং-বৈঠকখানায় তালা বন্ধ করে দে আও।
চুকন্দর। ঠাকুরজী রচ্ছা কিয়া বাবুকো-
বংশ। রচ্ছা কিয়া না তোমার মুন্ডু কিয়া-এর চেয়ে বাঘ ছিল ভালো।–
মানিনী। কেমন হয়েছে তো ঠিক। আর ছাগল পুষবে? কাল সকালেই ভুটেকে আর ছাগলকে একসঙ্গে বিদায়। চলো উপরে-বাইরে আসতে হবে না ।
(বংশ, মানিনী, টেঁপী ও ঘেন্টু ও চুকন্দরের প্রস্থান)
উদয়। মামী ছাগলটা বিলিয়ে দাও তো আমাকে, আমার বউ গুলিকাবাব করবে।
নগেন। ফের উদো-
ভুটে। আমার কী হবে বাবু?
উদয়। তোর আবার ভাবনা কী- যাত্রার দলে ভর্তি হবি। গাইতে জানিস-?
নগেন। আরে না রে না, আমি আছি তোর সঙ্গে-সব ঠান্ডা করে দেব। রাত পুইয়ে এল, এক ছিলিম সেজে আন আমার জন্য।
(সকলের প্রস্থান)
অধিকারী। ওহে সকাল হয়ে এল-এবার গোষ্ট গাও গোষ্ট গাও।
গান
গা’ তোলো গা’ তোলো কাজে চলো কাজে চলো।
কী ফল বিলম্বে, লেট হলে পড়বে গোল,-
তেলকলে চলো, অবিলম্বে চলো।
চিমনির ধোঁয়া রংএ ঐ শোনো বাঁশি বলে,
আপিসের বেলা হলো
গা’ তোলো গা’ তোলো ভোর হলো ভোর হলো।
চোখ মেলো গোল গোল, রাত গেল তবু
আকাশ কাজল।
রাতটা ভুষা না দিনটা ধূষা উষার দিশা
পেতে গন্ডোগোল।
বংশলোচন ঘড়ি দেখে কন,-
‘মানিনী তাড়াই গে’ ছাগল।’
পঞ্চম পর্ব
(ভোরের কনসার্ট)
(বংশ, চুকন্দর ও ভুটের প্রবেশ)
বংশ। চুকন্দর সিং-
চুকন্দর। হজৌর-
বংশ। ছাগল ঠো হ্যায়-না ভাগা?
চুকন্দর। সয়তান হজুর, বড়া নষ্ট্ ভাগা।
ভুটে। সে আবার যাবার ছেলে-! কলতলায় তরকারির খোসা আর মাছের আঁশ গিলছে।
বংশ। চুকন্দর, কোনো ভালো আদমি ছাগল পালতে রাজি আছে কিনা খোঁজ নাও। ভুটে, তুইও দেখ্-যে সে লোককে ছাগল দেব না।
(বিনোদ নগেন ও উদয়ের প্রবেশ)
বিনোদ। দেখি খবরটা?
উদয়। মামাবাবু, নেংড়া আম খুব সস্তা যাচ্ছে-
বংশ। হু, বরং Wanted কলামটা দেখো-কেউ একটা ছাগল চায় তো দিতে পারি-বেশ কচি।
নগেন। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান-কী লিখছে আনন্দবাজার দেখি?
বিনোদ। রও রও হাইকোর্টটা দেখে নিই।
চুকন্দর। (প্রবেশ) লাটুবাবু আয়ে হেঁ-
বংশ। লাটুবাবু কে রে? কোত্থেকে এল। বসাও গে তোমার ঘরে-যাকে তাকে ঢুকতে দিও না চুকন্দর-দিনকাল খারাপ, বন্দুক তৈরি রাখো। আর লিখিয়ে নিয়ে এসো কী চাই।
(চুকন্দরের প্রস্থান)
চাটুজ্যে। (প্রবেশ)-ফটকের বাইরে তিন মূর্তি কে হে?
বংশ। কেমন দেখতে বলেন তো? লাটুবাবু নাম শুনছি।
চাটুজ্যে। লাটু তো লাটু-
(লাটু, নবিন ও নরহরির প্রবেশ, সঙ্গে চুকন্দর)
গান
হাতে হাতঘড়ি পায়ে কেটসু’ মুখে সিগারেট
দিচ্ছে ফুঁ
উড়্নি নাই ধুতির বাহার খদ্দরের সার্ট
তাতেই কলার।
ঘাড়কামানো অ্যালবার্ট টেরি দেবী কি দেবা
চিনতে পারি
অধরে পানের লেগেছে ছোপ কড়ি-পানা চোখ
আধখান গোঁফ।
চুকন্দর। সিলিপ্ লিখ দেও বাবু--
বংশ। আমি এই সর্তে দিতে পারি, ছাগটাকে আপনি যত্ন করে--
নটবর। নিশ্চয় লেবো, খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে, তবে--
বংশ। মানুষ করবেন, বেচতে পারবেন না।
নটবর। বেচতে যাব কোন্ দুঃখে, আমাদের কি খাবার অভাব?
বংশ। মারতে পারবেন না।
নরহরি। আজ্ঞে আমরা তব্লাই পেটাই বটে, কিষ্ণের জীবকে মারপিট! বাপ্রে অ্যাসল্ট হয়ে যাবে। হাতকড়ি, জরিমানা—কিষ্ণো, কিষ্ণো; ওসব মারধোর আমাদের এসেনা মশয়।
বংশ। সে মারের কথা নয়। পাঁঠাটি কেটে খাবেন না, পুষবেন। লিখে দিন ইস্ট্যাম্প্ কাগজে।--
নটবর। এ যে আপনি লতুন কথা কইলেন! ভদ্দরনোকে কখনও পাঁঠা পোষে?
নরহরি। পাঁঠী লয় যে দুধ দেবে। পাখি লয় যে পড়বে। ভেড়া লয় যে কম্বল হবে।
চাটুজ্যে। বাঁড়ুজ্যে, তোমার ভাই ছাগল এ সর্তে কেউ নেবে না। যক্ষ্মাকাশ রোগী তো এর মধ্যে কাউকে দেখছি না যে ছাগল পুষবে। ওকে দাও নবমীতে ব্রাহ্মণসেবায় লাগিয়ে—উদ্ধার হয়ে যাক বেটা।
বংশ। বাজে বোকো না চাটুজ্যে। আপনারা নেন তো নিন—নইলে রইল আমার ব্যাস্, এই এক কথা।
নটবর। কী বলো হে লরহরি?--
নরহরি। লিয়ে লাও হে লাটুবাবু, লিয়েই লাও। ভদ্দরনোক বলছেন এত করে।
বিনোদ। কিন্তু মনে থাকে যেন—বেচতে পারবে না, কাটতে পারবে না।
চাটুজ্যে। টিপসই নিতে নাও হে রায় বাহাদুর।
নরহরি। সে আপনি ভাববেন না, লাটু লন্দীর কথার লড়চড় লেই।
বংশ। ভুটে, যা ছাগলটা দিয়ে আয় বাবুদের।
ভুটে। ওই চুকন্দর যাক্, আমি পারব না বাবু। ও ছাগল লয় ও আমার আপন ভাইয়ের মতো। প্রাণ ধরে ওকে পরের হাতে দিতে পারব না বাবু—মায়া পড়ে গেছে--
(রোদন)
বংশ। এ তো বড়ো বিপদ কল্লে! আরে কাঁদতে থাকলি যে—চুপ চুপ। এই চুকন্দর যাও।
(চুকন্দর, নটবর, নবীন ও নরহরির প্রস্থান)
বিনোদ। যাক, ছাগলের মোসান ডিস্মিস্ হয়ে গেল।
বংশ। ওদের হাতে দিয়ে ভরসা হচ্ছে না যে—সেখানে যদি কিছু উৎপাত করে তো ওরা সহজে ছাড়বে না।
বিনোদ। উচিত ছিল, ছাগলটাকে হয় সলিটারি সেলে—নয় ফাঁসি দেওয়া! দিলে কবে সাফ ডিস্মিস্—কী আর বলব।
বংশ। এ তো ভাবনায় ফেললে, লোকগুলোর চেহারাও ভালো ঠেকল না হে
চাটুজ্যে। ভেবো না ভেবো না, তোমার পাঁঠা গন্ধর্বলোকে বাস করবে। মাঝ থেকে ফাঁকে পড়লুম, আমরা!
বংশ। যাক্ গে, আমি তো সেই ভেবেই দিয়েছি—মারে তো কী করতে পারি। তাছাড়া আমি তো স্বইচ্ছায় ছাগলটাকে বিদায় করিনি—কী বলিস ভুটে?
চাটুজ্যে। তুমি ভেবো না হে বিচারক—‘অজো নিত্যঃ’ তাদের মার নেই, দেখো ফিরে এলো বলে।
বিনোদ। ফিরে আসবে বটে—তবে এখানে নয়। কালীতলা থেকে জবাই হয়ে ঢুকবে প্রথমে লাটুবাবুর রান্নাঘরে। তারপর সেখান থেকে তপঃসিদ্ধ হয়ে—বার হবে পাঁঠার কোর্মা হয়ে—যাত্রাসদনের সকলের সামনে।
বংশ। হয়তো বা তাই হয়েছে এতক্ষণে, কে জানে। দেখো দেখি একটা জীবহত্যা হলো?
চাটুজ্যে। ভুল, ওটা আমার ভুল ধারণা। পাঁঠা থেকে পাঁঠার কোর্মা—একটা অবস্থার ফের। যেমন—ওর নাম কী—আরসোলা থেকে কাঁচপোকা। হত্যার কথাই উঠতে পারে না।
নগেন। যেমন ‘ছ’য়ে আকার ‘গ’ ছাগ, আর বানানের হেরফেরে ‘ব’এ আকার ‘গ’ বাঘ হয়ে পড়ে। ডারউইনি থিওরি মানতে হয় এতেই তো!
বংশ। চাটুজ্যে, তোমার কথাটাই আমার মনে লাগছে—‘অজো নিত্যঃ’—ওর মার নেই। আবার ফিরে আসবে। এই দেখো না—‘নায়ং ভূত্বা ভবিতা ন ভূয়ঃ—’।
উদয়। ওটার মানে কী হলো বলেন তো,—ভুট্টা যখন লিখছে, তখন বোধকরি ভুটের কথা গীতায় লিখবে?
নগেন। আমি সেবার যখন শিমলায় যাই—ভুটিয়া ছাগল--
উদয়। ও ভুটানের ছাগলের কথা বলেছে পুঁথিতে।
নগেন। মিছে কথা বলিসনি উদো, তোর দৌড় আমার জানা আছে। ঐ লিলুয়া অব্দি--
উদয়। বা রে। আমার দাদাশ্বশুর যে শিমলায় থাকতেন—বউ তো সেইখানেই ভুটিয়া ছাগলের দুধ খেয়ে বড়ো হয়—তাই তো অত রং—।
নগেন। খবরদার উদো--
(মিঞার প্রবেশ)
চাটুজ্যে। আরে মিঞা সাহেব যে। আসেন, আসেন। যাক্ গা ছাগল, একটু খোসগল্প করা যাক। মিঞা সাহেব, নেন তাকিয়া ফর্সি।
মিঞা। কিসের কেচ্ছা কইতে কন—বাঘের?
বিনোদ। আজ ছাগের গল্পই জমবে--
বংশ। না, না, বাঘের হোক। ছাগের পালা থাক।
মিঞা। আচ্ছা একটা ছাগ-বাঘের কেচ্ছাই কই। শুনে লেন ; –পয়লা একটা তো রুবাই কইতে হয়, “ ওই ‘ছ’এ আকার ‘গ’ ছাগ—‘ব’ এ আকার ‘গ’ বাগ—ছাগে বাগে এক ঘাটে জল খায় চক্-চ চক্-চ—।” আমাদের মজিলপুরে দোর্দন্ড পর্তাব খুরুম মন্ডলের মৃত বিবির এক ছাগল ছিল। নাম—ভুটে; তার দাদা ছিল ভোট-কম্বল—লামা ছাগল। যারে বাংলাতে কয়—রামছাগলা। ইয়া পঁচাও শৃঙ্গ, ইয়া মান-মনোহর—গালকম্বল দাড়ি—। যেন মুনি ঋষি। ব্যাটা খেয়ে খেয়ে হলো ইয়া লাস। একদিন হয়েছে কী! মন্ডলের ওখানে জিরাফৎ করতি গেলাম—পাঁঠার কালিয়া, কোপ্তা, কোর্মা, কাবাব, কত্তো কবো—। খানাপিনা করে আচাইবার কালে দেখা গেল কিনা—ভুটে পাঁঠার মাংস চপ্চপ্ কড়মড় করি খাতি লেগেছে। সকলে তজ্জব। আমি বললাম—দ্যাখ কী খুরুম মন্ডল, ছাগলটারে আজই বিদায় করো—কাচ্চা বাচ্চা লয়ে ঘর করতেছে, প্রাণের ভয় নাই? মন্ডল শুনল না। তার পরদিনই ভুটে নিরুদ্দেশ! খোঁজ—খোঁজ, আর খোঁজা। খুরম মন্ডল ছোটাছুটি করে গাঁখানা চাষ ফেলায়ে দেখল, ছাগলের চিহ্নও নেই। এক বচ্ছর যায়—খোঁজাখুঁজিতে সোঁদরবনে পাওয়া গেল সেই ছাগলের পাত্তা। দেখা গেল সিং নাই বললেই চলে, পনেরো আনা মাথা হয়েছে পেলেন্। ছাগল-আর নেই, তার স্থানে গজিয়েছে—চৌগাম্পা গাল-পাট্টা। মুখ—একটি কালো হাঁড়ি। বর্ণ হয়েছে যেন কাঁচা হলুদ। সর্বগায়ে দেখা দিয়েছে আঁজি আঁজি ডোরা। খুরম মন্ডল যেমন ডাকা—ভুটে—; ভুটে ডাক ছাড়ে ‘হালুম’। আমি ঐ না দেখে, বন বাদড় ভেঙে—দে দৌড়, দে দৌড়—একদম বেলেঘাটার পুল পার।
(চুকন্দর, নটবর, নবীন ও নরহরির প্রবেশ)
চুকন্দর। লাটুবাবু আয়ে হেঁ—।
বংশ। ব্যান্ড-মাস্টার, কী মনে করে আবার? এ কী লাটুবাবু আপনার হয়েছে কী?
সকলে। এ কী দশা এ কে করলে। এ কী?
নটবর। আর কী, সর্বনাশ হয়েছে, লাটুর কিছু আর রাখেনি—ও হো হো।
(রোদন)
বংশ। এ কী ব্যাপার। জেব কাটলে কে?
চাটুজ্যে। এ যে দশার দশা করেছে। আহা পুজোর বাজারে—কে এমন কাজ করলো? কে সে জেব-কাট্রা, চোর, ডাকাত, বদমাস? কে এমন এ পাড়ায় এলো—কার এ কাজ?
নটবর। ধনেপ্রাণে মেরেছে মশয়। ও হো হো…।
নরহরি। আঃ কী করো লাটুবাবু, একটু থির হও। হুজুর যখন রয়েছেন, তখন একটা বিহিত করবেনই।
বংশ। চুকন্দর— দোত, কলম, কাগজ—হ্যাঁ, বলেন তো কি হয়েছে ব্যাপারটা—কে এমন কাজ করলে? বলেন—।
নটবর। মশাই, ঐ পাঁঠাটা--
বংশ।অ্যাঁ! বলেন কী!
চাটুজ্যে। হুঁ, বলেছিলাম কি না?
নটবর। ঢোলের চামড়া খেয়েছে, ব্যায়ালার তাঁত কেটেছে, হারমোনিয়ার সব ক’টা দাঁত-চাবি—কড়মড়িয়ে চিবিয়ে ফোকলা করে দিয়েছে যন্তরটা। আর, আমার পকেট—লব্বুই টাকার লোট মশায়, ও হো হো--
নরহরি। গিলে ফেলেছে মশয়! পাঁঠা লয় মিঞা সাহেব সাক্ষাৎ শয়তান। সর্বস্ব গেছে লাটুর। প্রাণটি আর ক্রেসিন কনসার্ট আপনাদের ভরসায় এখনও ধুক্পুক্ করছে। দোহাই হুজুর, একটা বেবস্থা না করলে গরিব মারা যায়। দশাটা দেখেন একবার।
বংশ। ফেসাদ হলো তো, কী করা যায়? চাটুজ্যে, মিঞা সাহেব কী কও?
মিঞা। একটা জোল্লাপ দিয়ে দেখলি হয়।
চাটুজ্যে। হ্যাঁ, এ পরামর্শ ভালো।
নটবর। মশাই, এই কি আপনাদের বিবেচনা হলো? মরছি টাকার শোকে, এ সময় বলেন জোলাপ খেতে! কেমন হাকিম তুমি মিঞা সাহেব?
মিঞা। তুমি খাবে কেন! ছাগলটারে দিতে কইছি।
নরহরি। হায়রে কপাল—ছাগলে মুড়লে কি আর রক্ষা আছে! লোট তো লোট—তাঁত, ঢোলক, হারমোনিয়া মায় ইস্টিলের কত্তাল—কোন্ কালে হজম করে ফেলেছে।
গান
খরচা নাই যে দিই কিছু পেটে
জামা আছে জেব নেছে কেটে
বেয়ালার তাঁত নাই কান নাই লোপাট
ফুলুটের চাবি কটাই।
বাঁয়া তবলা জোড়া গেছে ফেটে
ক্রেসিন ব্যান্ড খেয়েছে বেঁটে
ছাগল চিবাল লোহা কর্তাল
বাঘের যাহা সয় না পেটে।
বংশ। যাক্, আর কথায় কাজ নেই। বিনোদ তুমিই একটা খেসারৎ ঠিক করে দিও। বেচারার লোকসান না হয়, আর আমার উপরেও বেশি চাপ না পড়ে—বুঝলে?
নটবর। ছাগল এইখানেই রইল, ও আমি আর লেবো না।
বিনোদ। বেশ বেশ, আজ যাও, কাল যা হয় করা যাবে।
নরহরি। একশো টাকার ওপোরে লোকসান হয়েছে—উকিলবাবু দেখবেন বিবেচনা করে।
বিনোদ।এ-ক শো’ টা-কা!! আচ্ছা, দেখি কাল যা হয় হবে।
(লাটু, নবীন ও নরহরির প্রস্থান)
(টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রবেশ)
টেঁপী। তোমার লম্বকর্ণ ফিরে এসেছে বাবা। বেশ পোষা হয়ে গেছে। উঠানের কোণে তুলসী পাতা খাচ্ছে।
ঘেন্টু। আর কামড়ায় না, লক্ষ্মী হয়ে গেছে।
চাটুজ্যে। ও টেঁপুরানী, শিগ্গির গিয়ে মা কে বল, কাল আমরা এখানে খাব—লুচি, মাংস, পোলাও--
উদয়। আর গুলিকাবাব—বুঝলি?
ঘেন্টু। বাবা আর মাংস খায় না।
চাটুজ্যে। কী শুনি হে বংশু! প্রেমটা একটা পাঁঠা থেকে বিশ্ব-পাঁঠায় পৌঁছেচে না কি?
উদয়। মামা না খান, আমরা আছি। যাও তো টেঁপু, মাকে বলো সব জোগাড় করতে।
গান
আমরা আছি আমরা আছি তুমিও আছ আমিও আছি
গুকিকাবাব আলুবোখরার কেন্দালুতে আছিই আছি।
ওরে ভাই পাচ্ছি যে রে গন্ধ।
(সুর করে)
ঘেন্টু। (সুর করে) ‘বাবার সঙ্গে মাথার কথা বন্ধ।’…সে এখন হচ্ছে না, মা-বাবার ঝগড়া হয়ে গেছে—।
টেঁপী। মুখ দেখা-দেখি বন্ধ হয়ে গেছে—কথাটি নেই।
বংশ। যা যাঃ, ভারি জ্যাঠা হয়েছিস, ‘কথাটি নেই’—সব জানিস, যত সব--
টেঁপী। বা রে! আমি বুঝি জানিনে? মা যে আমাকে খালি খালি বলে—‘টেঁপী পাখাটা মেরামত করতে হবে—দু’শো টাকা চাই’--
বংশ। থাম্ থাম্। বকিস নে, মার খাবি, ফের জ্যাঠামো?
(ঘেন্টু ও টেঁপীর প্রস্থান)
বিনোদ। ওহে রায় বাহাদুর, ঘেন্টুকে আর ঘাঁটিও না, সব ফাঁস করে দেবে।
মিঞা। হাকিমের ছাওয়াল তো বটে!
চাটুজ্যে। অবস্থাটা সঙ্গিন হয়েছে বলো?
বংশ। এত দিনে সব মিটে যেত, মাঝে থেকে ঐ ছাগলটাই—।
চাটুজ্যে। ব্যাটা ঘর-ভেদী বিভীষণ—তোমারই বা অত মায়া কেন ওটার ওপর। কেটে খেতে না চাও—বিদায় করে দাও। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করো না দাদা।
বংশ। দেখি, কাল যা হয় করা যাবে।
বিনোদ। রায় বাহাদুর, কালবিলম্ব করবেন না। মিটমাট করতে হয়—লাটুর খেসরতের সঙ্গে সঙ্গে আজই--
চাটুজ্যে। চলো এখন।
(মিঞা ছাড়া সকলের প্রস্থান)
বংশ। ওঁরা যান, তুমি বোসো, কটা পরামর্শ নিই তোমার কাছে। দু’ নৌকোয় পা দেওয়া ভাল নয়, কী বল মুন্সী সাহেব? আজ সন্ধ্যা বেলায় যথাবিহিত করবই—যা থাকে কপালে। দুষমন ছাগলটাকে নিয়ে কী করা যায় বলো তো—শুনেছ তো সব কাহিনী?
মিঞা। বলেন তো বকরীটারে নেই কোরবানী করে, নয় তো পাঠায়ে দেন আপনার কালীঘাটে—চুকে যাক ল্যাঠা।
বংশ। তুমি যদি ঠেকতে আমার অবস্থায় তো কি করতে? ছাগলটাকে রেখে কিছু উপায় হয় তো বলো?
মিঞা। গর্দানি দিয়ে নিক্লে দেন,—না, তাও হয় না—সবার সামনে নিজের ছাগল বলে স্বীকার খেয়েছেন— হ্যাঁ। ছাগলটার গলায় লম্বরি চাক্তি দিয়ে ছেড়ে দেন, আর এইরকমভাবে হুলিয়া দেন— ‘এই ছাগল, বেলেঘাটা খালের কাছে কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম। প্রতিপালন করিতে না পারা গতিকে পুনরায় সেই স্থানে ছাড়িয়া দিলাম। আল্লা, কালী ও যিশুর দিব্য—ইহাকে কেহ মারিবেন না। উঁকি দায় দোষে আমি খালাস।’ ইতি মাফ্ করুন বেয়াদপি। আদাব।
(টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রবেশ)
বংশ। টেঁপী নাকি? শোন, তোর মা কি করছে রে?
টেঁপী। ষষ্ঠীর দিনে ঝগড়া হলো কিনা, তাই পাঁজি দেখিয়ে আচার্যিকে দিয়ে ইষ্টি কাটাবার হিসেব করছে।
বংশ। ঝগড়া হয়েছে, ভাব করলেই ইষ্টি কেটে গেল—আবার পাঁজি দেখিয়ে খরচ করা কেন? যা তোর মাকে বলগে যা,—যত্তো সব--
টেঁপী। মা যদি রাগ করে—?
ঘেন্টু। বলব বাবা শিখিয়ে দিয়েছে।
বংশ। ও টেঁপী যা বোঝে করবে। তুই যা ছাগল চড় গিয়ে। আর ঐ ভুটেকে বল—চুকন্দরের বেল্টের চাকতিখানা—আচ্ছা থাক্, আমিই দেখছি—। যা টেঁপী, লক্ষ্মী আমার, মার কাছে যা।
(টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রস্থান)
(ভুটের প্রবেশ)
এই ভুটে শোন এধারে।
চট্ করে এক ঠোঙা জিলিপি আন তো। আমি ততক্ষণ চিরকুটটা লিখে ফেলি, হুলিয়া দিতে হবে—বুঝলি? হ্যাঁ, একগাছা শক্ত দড়ি আর একটা হুমোপাথি ওষুধের খালি শিশি—যেখান থেকে পাস জোগাড় করে আমার এই জায়গায় রাখিস। বেলাবেলি বেরোব বুঝলি—, ভাবছিস কী—ছাগলটাকে ঘরের কাছে এনে রাখ। দৌড়ে যা, আমি চললেম আর সময় নেই।
(ভুটের প্রস্থান)
ষষ্ঠ পর্ব
কনসার্ট
(বংশলোচনের প্রবেশ)
বংশ। সবাই পুজোবাড়ি, ঠিক সারছি চুপিচুপি! শিশির মুখ গালা দিয়ে বন্ধ কাগজটুকুও রইল এর মধ্যে, লাল ফিতে জড়ান। ছাগলটার জন্য দড়ি-গাছটাও মজুত আছে। সাড়ে হলো আর না। ব্যাটা জিলিপির ঠোঙা ছেড়ে আবার পশ্চদ্ধাবন করবে না তো? আকাশের গতিক খারাপ? সরি পায়ে পায়ে--
[ঝড়ের কনসার্ট] এ কী! এ যে কোন্নগরে মেঘ—ঘনঘটা! [অকস্মাৎ বজ্রপাত] বাবাঃ স্বঃ পলায়তি করা যাক তেঁতুলতলার দিকে! দৌড় দৌড়!
(প্রস্থান)
গান
দ্রুম দুদ্দুড় দড় দদ্দড়
আকাশে কে ঢেন্টরি পেটায় চড় চড় গড় গড়।
অন্তরীক্ষে বৃক্ষের মাথায় নীলের গম্বুজে
সিসা রঙের পুরু গোচ মাখানো কে-অস্তর
কেশরে বিদ্যুৎ কড়াৎ কড় কড় চিড় খেয়ে
আকাশ জুড়ে যায় বেমালুম চড়াত চড়াস
কড়কড়।
ঈশান কোণ হতে ঝাপসা পর্দা ঐ এল ঐ এল
করে তাড়া গাছপালা শিহরিল
লম্বা লম্বা তালগাছগুলি প্রবল বেগে মাথা নাড়িল
ঝাপ্টা খেয়ে গাছের ডাল পটাস মটাস মড় মড় মড়।
গেল মান ইজ্জত কাপড়চোপড় কান্ড দেখে
প্রাণ বাঁচাতে--
বংশলোচনের হার্ট করে ধড়ফড়।
(বংশের পুনঃপ্রবেশ)
বংশ—বাপ্, গেলেম বাপ্। ‘এধারে মেঘের ডাক্, ওধারে বিজলি,—সর্ষেফুল দেখিতেছে চক্ষের পুতলী।’ বিশ লক্ষ Volt Electricity! জগৎ লুপ্ত! তুমি নাই, আমি নাই!
(পতন ও মূর্চ্ছা)
চুকন্দর। (নেপথ্যে) হ-জৌ-র।
(ঝড়ের শব্দ চলিতেছে)
বংশ। (চৈতন্য) কে আমি—রায়বাহাদুর? কোথায়? খালপার! ও কিসের শব্দ? কোলাব্যাঙ? ছাগলটা?
(নেপথ্যে) মামা আছেন?—জামাইবাবু?—বংশু আছ?—বাবা সাড়া দাও! বাবুজী কাঁহা চলা গিয়া?
বংশ। যাচ্ছি ভয় নেই--
মিঞা। আর্তনাদ শুনি যে…?
(ছাতা, কম্বল মুড়ি, টর্চ হাতে প্রবেশ)
বংশ। পশ্চাদ্ধাবন করেছে ছাগল। আরে যাঃ খেলে যাঃ। গেছি চুকন্দর সিং।
ভুটে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ পেয়েছি, পেয়েছি, এই যে, এই যে বাবা অন্ধকারে ঘুপটি মেরে--
(মিঞাকে চেপে ধরল)
বিনোদ। (প্রবেশ ও বংশ’র হাত ধরে) পালাও কোথায়? চলো গাড়িতে ওঠো—বাপ কী ঝড়—চুকন্দর সিং লন্ঠন…।
(লন্ঠন হস্তে প্রবেশ)
চুকন্দর। ঠাকুরজী রচ্ছা কিয়া, চলিয়ে গাড়ি পর।
মিঞা। দ্যাখছেন কী? মুস্কিল আসান—মুস্কিল আসান—।
(ঝড় থামল, বংশকে লইয়া সকলের প্রস্থান)
চাটুজ্যে।(প্রবেশ) রায়বাহাদুরের বাড়ি তো নয়—রাবণের পুরী। কেউ কোথাও নেই আজ, সব যেন থম্থমো! হাওয়াটা দিয়েছে বিশী—গা’টা ছম্ছম্ করছে। কী দুর্দৈব ঘটে কে জানে। ও ভুটে, ভুটে—একছিলুম তামাক দিতে পারিস? গলাটা কেমন শুকোচ্ছে।
(নেপথ্যে মানিনীর রোদন)
মানিনী। (নেপথ্যে) আমার সে কোথায় গেল বিলাসী? আমি কেন মরতে ছাগল নিয়ে ঝগড়া করতে গেলাম? আর বুঝি এল না! কাউকে দেখি নে যে—সব যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে—।
(ভুটের প্রবেশ)
চাটুজ্যে। কোনো ভাবনা নেই মা। তুমি স্থির হও। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি, কিসের ভয়? এ সবই ভগবানের হাত। ছাগলটা যখন—ভুটে কী হলো, হুকোটা পেলিনে?—থাকগে। বাবু যে গেল, তার খবর কেউ রাখলিনে?
(মানিনীর প্রবেশ)
শেষ কেমন দেখেছিলি; বল তো শুনি। দেখি, ব্যাপারটা বুঝে মা, তুমি বসো, আমাকে লজ্জা কী? শুনি কান্ডটা।
ভুটে। আপনারা তো মাঠাক্রুনের মান ভঞ্জন করতিই বসে গেলে, আমারে ডেকে বাবু বললেন,—ভুটে, এক ঠোঙা গরম জিলিপি, আর এক গাছা শক্ত দড়ি—’
চাটুজ্যে। অ্যাঁ: ওই মনের অবস্থা,—ও সময় দড়ি এনে দড়ি এনে দিতে হয়! খালি জিলিপি এনে বলতে হয়, দড়ি পেলাম না।
ভুটে। আমি কেমন করে জানব। আমি জানি বাবু মুশুরি খাটাবে।
চাটুজ্যে। আর কী এনেছিলি বল—ছুরি, কাটারি, কাস্তে—?
ভুটে। কিছু লয়, শুধু একটু খালি লাল ফিতে, আর একটা হমোপাতি শিশি।
চাটুজ্যে। অ্যাঁ! শিশি! তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে--
মানিনী। শিশিতে আফিং না কুকিন্— কী ছিল তাই বল্না? ওরে সর্বনাশ হয়েছে আমার।
চাটুজ্যে। ভুটেকে বলতে দাও মা, ব্যস্ত হয়ো না।
ভুটে। বাবু শিশি আনতে বলে, আমাকে বললে,—‘তুই যা—সময় নেই। হুইল লিখে নিই।’
চাটুজ্যে। অ্যাঁ! উইল—চুপচুপ! দেখো দেখি, ফটকে গাড়ির শব্দ পাচ্ছি—। মা,তুমি কেঁদো না। আমি রইলেম এখানে,—যতক্ষণ একটা হেস্তনেস্ত না হচ্ছে। বিধাতার কান্ড দেখো। হে হরি! কেঁদো না মা।
(ভুটের প্রস্থান)
মানিনী। ওগো তুমি কোথায়?
বংশ। (নেপথ্যে) এই যে আমি, ঠিক আছি, ভয় নেই।
ভুটে। (প্রবেশ) বাবু জলঘরে গেছেন।
মানিনী। আঃ। চাটুজ্যে মিন্সে যে নড়ে না! দেখো শিগগির জলঘরে কেন?
চাটুজ্যে। দেখি একবার আমি। হঠাৎ মাথা ঘুরল,—না, কী হলো কে জানে!
মানিনী। ও বিলাসী, দেখ না, তোয়ালে গামছা দিতে বল। টেঁপী গেল কোথায়?
(টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রবেশ)
টেঁপী। এই যে, আমি আছি মা।
ঘেন্টু। বাবা মাথা মুছে আসছে।
(মাথা মুছতে মুছতে বংশ’র প্রবেশ)
মানিনী। ও কী। ভিজে যে ঢোল হয়েছ! শিগ্গির চা খাবে চলো। তোমার সেই বোতলের ওষুধ আছে,—সর্দির—একটু চায়ে মিশিয়ে দেব ও টেঁপী, আজ আর ওপরে ওঠা নয়।
(নেপথ্যে ম্যাঁ ম্যাঁ ম্যাঁ)
বংশ। আবার ওটা এসেছে—চুকন্দর, ভুটে, লাঠি—গাছ কোথায় গেল।
চাটুজ্যে। আ-হা, কী করো, মেরো না। বৃষ্টি থামতেই বেচারা এসে ছুটে তোমার খবর দিয়েছে। তাই তো তোমায় খুঁজতে পাঠান গেল, ফিরেও পাওয়া গেল।
মানিনী। ও থাক, ভুটের জিম্মেয়। তোমার আর ভয় নেই। চাটুজ্যে মিন্সে যে নড়ে না,—বল্ না ভুটে।
ভুটে। চাটুজ্যে মশাই, একবার চলেন না রান্নাঘরে লুচি ক’খানা—।
চাটুজ্যে। ওঃ ভুলেই গিয়েছিলাম। চল্ চল্।
মানিনী। চলো বৈঠকখানায় আর কাজ নেই। কিছু খেয়ে ঘুমুবে।
বংশ। আজ আর খিদে নেই তেমন।
মানিনী। ও কী! সে হবে না। গরম লুচি ক’খানা,—আর মোহনভোগ খেতেই হবে। নইলে মাথা খাও—।
(সকলের প্রস্থান)
(নেপথ্যে ছাগলের ডাক)
অধিকারী। একতা লাস্ সং দাও হে—একটা লাস্ সং দাও।
গান
পাঁঠা তুই বড়ই ভাগ্যবান
পাঁঠা তোমায় করলে খাসী
মাংস হবে রাশি রাশি
একসঙ্গে খাব বসে হিন্দু-মুছলমান।
পাঁঠা খেতে বড়ই মজা
কোথা লাগে জিভে-গজা
রসগোল্লা হার মেনে যায় রেখে তাহার মান।
(ভুটের ছাগল নিয়ে নৃত্য)
(শ্রীরাজশেখর বসু কর্তৃক রচিত ‘গড্ডলিকা’ পুস্তকের ‘লম্বকর্ণ’ শীর্ষক কাহিনী অবলম্বনে)
প্রথম পর্ব
[স্থান- বর্ষা অয়েল কোম্পানি, কাল- না সকাল না বৈকাল।]
অধিকারী, নটবর, নবীন ও নরহরির প্রবেশ
অধিকারী। কৈ হে, ও লটবর, ও লবিন, লরহরি, মহালয়া এসে যায়; মহালয়ার নাম কর না যে কেউ?
নটবর। অধিকারী মশয়, আমাদের তো সব প্রস্তুত, মহলা দিলেই হয়।
অধিকারী। বলি ও লন্দি, পাঁঠার জোগাড় করলে? পাঁঠা তো চাই একটি পালাগানে।
নটবর। সে জোগাবে ঐ লবীন লিউগী।
নবিন। বেশ কথা কও! লিউগী বিউগিল দেবে আবার পাঁঠাও দেবে-এত করে না।
নটবর। কী হে লবীন, ঘাড় চুলকাও যে? পাঁঠা আনছ না?
নবীন। আহা বলেন কেন দুষ্কের কথা, ঐ খালপাড়ে দেখলাম, যেমনটি চাই তেমনটি পাঁঠাটি,-দিব্বু হিরিষ্টু পুরিষ্টু ছাগল। কুচকুচে কালো নধর দেহ, নম্বা নম্বা নটপটে কানের ওপর কচি পটলের মতো দুটি শৃঙ্গ বয়স বেশি নয়, এখনো অজাত-শ্মশ্রু। আমায় দেখে ডাক দিয়ে চল্ল যেন গীদ গেয়ে করুণ স্বরে ধমকে ডাকছে।
নবীনের গান
ম্যা ও ম্যা কোথা যাই গো ম্যা?
বলো কার দোরে পেট ভরে খেতে পাইব ম্যা?
নটে শাক মুড়োবে কি-
পুঁইডাঁটার পাই না লাগ-ম্যা ও ম্যা দেখ।
আমার পেট বলছে কী খাই কী খাই
পুঁজি কিছু নাই পাঁঠা কিছু নাই
ম্যা ম্যা বলে ডাকতেছি তাই স্থান দাও ঐ ছিরিচরণে!
আমি আদর করে ডাক দিলেম-(সুর দিয়ে) ‘এসো যাদু আমার বাড়ি, তোমায় দেব ভালোবাসা’,-বোকা ছাগলের জাত,-ভালোবাসা বুঝলে না। গলা জাপটে ধরতে ঢুঁসিয়ে আমায় ফেলে মারলে দৌড়।
অধিকারী। বড় ফসকেছে, যাগ্গা! বলি ও লরহরি লাগ,-তুমি দেবা লবমীতে ছাগ, বুঝলে?
নরহরি। আজ্ঞা!
অধিকারী। আর আপত্য তুলো না, লাগ আর ছাগ, ঠিক লাগ মাফিক মিলে গেছে। লাও হে প্রোগ্রম গীদটা ধরো।
নটবরের গীত
বেলেঘাটা যাত্রাসদনের বংশীবদন অধিকারী।
ব্যান্ডমাস্টার লন্দি লটবর, লিউগী বিউগিল ফুলট,
আর ছাগলাগ-লরহরি।
কর্নেট ও কর্তাল, ঢোল, খোল, লবীন, ললিত, ললিন, অধীন;
চপলেট্, কটলেট্, রাধাকান্ত কেবিন।।
পৃষ্ঠপোষক বর্মা অয়েল অ্যান্ড কোং-
পাত্র-পাত্রী পাঁঠা সমেত উনিশ জন।
বেলেঘাটা যাত্রাসদন বাসাবাড়ি
লম্বকর্ণ পালা করিল সদরালা-বিনানুমতি; রেজিস্টারি!
উইথ্ কম্প্লিমেন্টস্ টু গড্ডলিকা প্রিন্টারি।
নটবর। ধরো হে কনসার্ট, ক্রেসিন ব্যান্ড,-আর বিলম্ব নয়!
(নরহরির প্রস্থান)
ছোট কনসার্ট
(নরহরির প্রবেশ)
নরহরি। মশয়রা, আমি এইমাত্র দেখে আসতেছি ছাগল।–
অধিকারী। কোথায়, কী ভাবে দেখে আসতেছ তাই শুনি।
নরহরি। দেখে আলাম ছাগল-বংশলোচনবাবুর জামার প্রান্ত ধরিয়া টানিতেছে এবং বলিতেছে হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ করিয়া।
অধিকারী। রও রও, ছাগল কী বলছে পরে শুনব। বংশলোচনবাবুটি কে তাই কও আগে।
নরহরির গান
রায় বংশলোচন ব্যানার্জি বাহাদুর জমিন্দার,
অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ফুলবেঞ্চ বেলেঘাটার।
বয়ঃক্রম চল্লিশ পার, কিঞ্চিত মুটিয়ে
হয়ে পড়েছেন স্থুলাকার
সেই কারণে কন্সাল্ট করে ডাক্তারগণে
উপদেশ করেছেন-দুই পায়ে হাঁটিবার।
ছেড়ে ভাত ও লুচি পুরি
দুবেলা খান দুই তঙ্কার কচুরি-
লঙ্কামিশানো ঝালতরকারি;
আর খালপাড়ে বৈকালে হাওয়া খেয়ে করেন পায়চারি,
ঘড়ি ধরে এক্সারসাইজ কয়েকবার।
অধিকারী। তারপর কী হলো কও।
নরহরির গান
আরে বংশলোচনবাবু খালপাড়ে চলতে চলতে
বসে পড়লেন
রুমাল পেতে
নিজের ভারে হয়ে কাবু-গিলে মাটিতে
জুতো পাটিতে কেটে গাবু
আরে বংশলোচনবাবু ঘড়ি দেখে চান-
বাড়ি ফিরে যান সাড়ে ছটায়-
এধারে বেলেঘাটার বাতাস হঠাৎ বলে যায়-
ঝড় কী জল হওয়া বিচিত্র নয়;
বংশলোচন হয়ে আনমন বর্মা চুরুট মুখে লন-
এমন সময়…হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ।
নটবর। ঝড় উঠল নাকি, হুঁ হুঁ করে?
নরহরি। নাগো। বাবু ফিরে দেখলেন-ছাগল হু হু করে বলছে তাঁর জামা টেনে।
অধিকারী। কী বলছে, তা বুঝলে কী মতে, তুমি মানুষ হইয়ে।
নরহরি। ভাবে বুঝলেম, ভঙ্গিতে বুঝলেম আলাপচারির!
অধিকারী। আচ্ছা কও তো, কী কইলে ছাগলছানাডা, কীবা কইলেন বংশলোচন।
নরহরি। হঠাৎ পকেটে টান পড়াতে, বংশলোচন সচকিত সশংকিত কয়ে উঠলেন-‘আরে এটা কোথা থিক্যে? কার পাঁঠা? কেটা আছে কাকেও তো দেখছি না’-? ছাগল কোনো উত্তর দিল না। কাছে ঘেঁসিয়া লোলুপ নেত্রে তাঁহাকে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। বংশলোচন তার মাথায় ঠেলা দিয়ে বললেন-‘যাঃ, পালা, ভাগো হিঁয়াসে’।
অধিকারী। গেয়ে বলো হে গেয়ে বলো।
নরহরির গান
পালা, নইলে শিঙে ফোঁকার পালা,-
শুরু করে দেব লোকজন ডাকি।
রোস্তো গর্দান কাটছি, ভাগ্ নয়তো পালা,
বোকা ছাগল পা চালিয়ে পালিয়ে যাবার পালা-
শুরু কে দিয়ে পালা!
অধিকারী। তারপর তারপর? ম্যাজিস্ট্রেটের ধমক খেয়ে কী করল ছাগল?
নরহরি। কান্তি থাকল আর গাইতি থাকল ম্যা ম্যা করে। দুবার কান্তেই বংশলোচনের মন গলে নয়নে জল বইল। তিনি ছাগলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই-ছাগল দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, সামনের দু’পা মুড়ে, ঘাড় না বেঁকিয়ে, রায়বাহাদুরকে এক ঢুঁ-।
অধিকারী। অ্যাঁ! ম্যাজিস্টরকে ঢুঁ, অ্যাঁ! এ যে অয়াসল্ট গো, অ্যাঁ! ফুলবেঞ্চ ফাটক্! রায়বাহাদুর করলেন কী?
নরহরি। ঢুঁ খেয়ে রায়বাহাদুর কৌতুক বোধ করলেন, তিনিও দিলেন এক ঠেলা। ছাগল পূর্ববৎ খাড়া হইল, এবং তাঁর হাত হইতে জ্বলন্ত চুরুটটি কাড়িয়া খাইল, এবং আহারান্তে বলিল অড্-ড্-ড্-ড্? অর্থাৎ, আর আছে?
নবীন। ও ছাগল নয় হে, শাপভেষ্টো, শাপভেষ্টো, বুঝলে? বাগবাজারের তোমার তিনি, সেও আগুনঅসুদ্ধ বিড়ি ফুঁকত।
নরহরি। না হে, অমন কথা বোলো না, আমাদের তিনি গাঁজার দিক দিয়েও যেতেন না। এ তোমাদের বর্মা অয়েল কোম্পানির আড়তের শাপভেষ্টো কেষ্টোবিষ্টুর মধ্যে কেউ একজন হবেন। না হলে জ্বলন্ত বর্মায় পেট ভরায়?
অধিকারী। যাকগে, তারপর কও।
নরহরি। তারপর একে একে একটির পর একটি চুরুট নিঃশেষ করে-ছাগলের মাথা ঘোরা নেই, গা বমি নেই। আবার যখন বললে অড্-অড্-ড্, তখন বংশলোচন বল্লেন-‘আর নেই। তুই এবার যা। আমিও উঠি।’ ছাগল বিশ্বাস করে না, সার্চ করতে চায় হাকিমের পকেট। বংশলোচন নিরুপায়! চামড়ার ছিগার কেসটি ছাগলের সামনে ধরে বল্লেন-‘বিশ্বাস না হয়, এই দেখ বাপু।’ ছাগল এক লম্ফে ছিগার কেস কেড়ে নিয়ে চর্বণ শুরু করে দিলে।
নবীন। আর রায়বাহাদুর?
নরহরি। রাগবেন না হাসবেন ঠিক করতে না পেরে-শ্ শালা বলে ঘরমুখো হলেন। ছাগলও নাছোড়বান্দা, তাড়ালে যায় না-চলল রায়বাহাদুরের সঙ্গে।
অধিকারী। কিছু বলতে বলতে গেল ছাগলটা, না এমনি মুখ বুঁজে গেল?
নরহরি। মুখ বুঁজে যাবার ছেলে কিনা-রাস্তার দুধারে কারু টবের গাঁদা ফুলের গাছ চিবোয় আর চলে। শেষে উড়ের দোকানে ডালমুট, তিলকুট, বিস্কুট-প্রায় এই আমার সাড়ে তিন গ্রাস লুটে-বিচারকের পিছনে পিছনে ঢুকল গিয়ে-তারপর কী ঘটনা ঘটল আন্দাজ করেন।
অধিকারী। রাখো তোমার ভূমিকা, তারপর কিছু জানো তো বলো।
নরহরি। আমি কি রায়বাহাদুরের বাড়িতে ঢুকতে গেছি যে বলব কী হলো? তারপর আর কী। আমার কথাটি এখানে ফুরল নটেশাকটি সেখানে মুড়োল। তোমরা কেউ জান তো কও, নয় আন্দাজ করো।
নটবর। আন্দাজের দরকার নেই, ধরো হে, গান ধরো।
গান
দেখেন দেখেন চেয়ে দেখেন জেগে জেগে বসে দেখেন।
উল্টে দেখেন পা্ল্টে দেখেন লম্বকর্ণ পালা দেখেন।
চিনে রাখেন আসেন কে কে, জেনে রাখেন যান কে কে-
রায়বাহাদুর বংশলোচনবাবুর এই বৈঠকেতে।
ঘুঘু দেখেন ফাঁদও দেখেন-হেসে দেখেন
কেঁদে দেখেন।
কচ্লে আঁখি ঢুলে দেখেন-নেচে দেখেন
কুঁদে দেখেন।
বেলেঘাটায় যাত্রাপার্টির লম্বকর্ণ পালা দেখেন।
দ্বিতীয় পর্ব
(বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানা ঘর-বিনোদ, নগেন ও উদয়ের প্রবেশ)
বিনোদ উকিল। ও চাটুজ্যে, আসতে আসতে গেলে কোথা? বলি ও চাটুজ্যে, হুঁকো বৈঠক রইল এধারে তুমি রইলে ওধারে? চলে এসো, কথাই কও না যে!
(চাটুজ্যে ও মিঞার প্রবেশ)
চাটুজ্যে। এই যে ভাই, মিঞা সাহেব আদাব, বৈসেন। বৈসেন। শ্রূয়তাং-এই হচ্ছে বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানা-যেখানে সান্ধ্য আড্ডায়, নিত্য নিত্য বহুসংখ্যক রাজা উজির বধ হইয়া থাকেন, বুইলেন? ও তোমার লাটছাহেব সুরেন পাল, বিপিন বাঁড়ুজ্যে, মোহনবাগান, পরমার্থতত্ত্ব, প্রতিবেশী অধর বুড়োর ছেরাদ্দ, আলিপুরের নতুন কুমির- কোনো প্রসঙ্গই বাদ যায় না। সম্প্রতি সাতদিন যাবৎ বাগের বিষয় নিয়ে হাতাহাতি চলছে, এ বাড়ির মামাবাবু নগেন আর ভাগনেবাবু উদয়ের মধ্যে, বুইলেন?
মিঞা। বাঘের কথা যদি তুল্লেন তো শোনেন বলি এক কেচ্ছা-
এক রোজ আষাঢ় মাসে বাতাস ছিল ছর্দ
ঘরে ছক্কা পিইতেছিলাম আমি এক মর্দ।
দর্দ ছিল হস্ত পদে টনটন বাতের
দলিজাতে বৈসে ছিলাম বিমারি খাতের।
ভাবতেছিলাম ছোটবিবি থাকত এইখানে
ইত্তিফাঁক বাঘের গর্জন পৌছে গেল কানে।
হুক্কা হাতে গুটি গুটি যাব খিড়কি দ্বারে
লম্ফ দিয়ে কেন্দো বাঘ পড়ল এসে ঘাড়ে।
হলদি-কালা ডোরা কাটা সতরঞ্চখানা
ঝড়ে যেন উড়ে পইল এমনি বাঘের হানা।
তারপর হুড়াহুড়ি বাঁও কষাকষি
যুদ্ধু যেন লেগে গেল বাঘ আর মষি।
বাঘের শক্তি মানুষের বুদ্ধি কেউ কারে না পারি
করি তাগ বাঘের নাক মারলাম হুক্কার বাড়ি।
ভাঙা নাক বাঘ পালায় আঁক আঁক করি
ধীরে সুস্থে পানি নিলাম হুক্কাটায় ভরি।
ভাঙে নাই নলচেটা নছিবে আমার
বখরাটার সেই হইতে খোঁজ পাই না আর।
এইখানে হইল সারা অধীনের কেচ্ছা
চাটুজ্যে মশাই, হুক্কা তোমার বলছে মিচ্ছা মিচ্ছা।।
চাটুজ্যে। ঠিক ঠিক, নাও ভাই মিঞা সাহেব কলকেটা, ও নগেন ফরসিটা দাও না এগিয়ে।
নগেন। লেন লেন।
মিঞা। দ্যেন দ্যেন-
এই মুছলমান আর হিদুঁয়ান ছিল জেতের বিচার
ভেবে দেখো তাম্বাকুতে কইল একাকার।
কেওড়া যেথা তামাক খায় বামনা সেথা এসে
আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে তার নজ্দিকেতে বসে।
আড়ে আড়ে চায় এমনি তামাক খাবার বাই
হাত বাড়িয়ে বলে তোমার কলকেটা দ্যাও ভাই।
উদয়। ঠিক ঠিক, মিঞা সাহেব না হলে কি মজলিস জমে?
মিঞা। সাচ্চা বাত বলেছেন-
উয়ো মজলেস তো বিরাম, যাঁরা হুক্কা নাবাসৎ।
আমীর ও ওমরা, গরীব ও গোবরা, সবকা মুনাজৎ হুক্কা।
ছিলম ও ফরসি, নলওয়া নলচি, এ জী খুসীওঁকি এলচি।
বারাম দরবার কি আরাম, বে-আমেরিকা দোস্ত-বাসৎ বাসৎ।
চাটুজ্যে। বলি ও উকিল, ও বিনোদ শুনচো? তোমরা ভাই খবরের কাগজ রাখ। নগেন, মিঞা সাহেবকে সেই বৈঠকখানার বর্ণনাটা শুনিয়ে দাও। ডুগিটা ধরো না হে।
গান
বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানা ঘরটি-
আয়না, আলমারি, চেয়ার ইত্যাদি জিনিসপত্রে ভর্তি
প্রথমেই নজরে পড়ে, কার্পেটে বোনা আসমানি
রঙের বেঁটে বিড়ালের ছবিটি।
যুদ্ধের সময় সাদা পশম রাধাবাজারে ছিল নাই
শুধু সেইজন্য বন-বিড়াল হলো নীল বর্ণ
ছবির নিচে তাই C-A-T ক্যাট লিখা আছে
ইংরাজী অক্ষরে-
তার নিচে হস্তাক্ষরে রচয়িতার নাম-
মানিনী দেবী।
অপর দেওয়ালে ডবল ফুলস্ক্যাপ-
রায়বাহাদুরি সনদের নকল
ঐ জ্যান্ত টিকটিকি করেছে দখল
গিল্টি করা ফ্রেমের কোণটি।
উদয়। এইবার হয়েছে মামাবাবু, ন্যাজ ধরে টিকটিকিটার মাপ করা যায়, না ন্যাজ বাদে?
কিন্তু যাই বল, বাঘের মাপ কখনই ন্যাজসুদ্ধ হতে পারে না। তাহলে মেয়েদের মাপও চুলসুদ্ধ নিতে হয়? আরে আমার বোয়ের বিনুনিটাই তো তিন ফুট হবে, তুমি কি বলতে চাও, বউ আমার আট ফুট লম্বা?
নগেন। দেখ উদো, তোর বোয়ের বর্ণনা আমরা মোটেই শুনতে চাই না। বাঘের কথা বলতে হয় তো বল, নয় তো শুধো মিঞা সাহেবের কাছে-
চাটুজ্যে। আহাঃ, তোমাদের এখানে কি বাঘ ছাড়া অন্য জানোয়ার নেই। (নেপথ্যে- ম্যা ম্যা ম্যা শব্দ) অ্যাঁ। এ যে পাঁঠা ডাকে দেখি ষষ্ঠীতে পাঁঠা! হে মা-ষষ্ঠী, দেখতে হলো তো।
(প্রস্থান)
টেঁপী। (নেপথ্যে)ওমা শিগ্গির এসো পাঁঠা এসেছে।
(বংশলোচন, টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রবেশ)
বংশ। চুপ চুপ টেঁপী।
টেঁপী। বাবা আমি পাঁঠাটা পুষব, একটু লাল ফিতে দাও না।
বংশ। বেশ তো, একটু খাওয়া দাওয়া করুক তারপর নিয়ে খেলা করিস এখন।
টেঁপী। পাঁঠার নাম কী বল না?
বংশ। নামের ভাবনা কী; ভাসুরক, দধিমুখ, মসীপুচ্ছ, লম্বকর্ণ-
ঘেন্টু। ও লম্বকর্ণই ভালো। ও বাবা! আমি পাঁঠা খাব, পাঁঠার মে-মে-মে মেটুলি খাব।
টেঁপী। যাঃ, যাঃ, শুনে শুনে কেবল খাই খাই শিখেছে।
নগেন। ঘেন্টুটা আমার ধাত পেয়েছে, নরাণাং মাতুলক্রম; দিব্যি পাঁঠাটি।
বিনোদ। বেশ পাঁঠাটি; কিন্তু বে-ওয়ারিস মাল, বুঝলে হে রায়বাহাদুর? বেশিক্ষণ ঘরে না রাখাই ভাল। সাবাড় করে ফেলো-কাল বুধবার আছে লাগিয়ে দাও।
(চাটুজ্যের প্রবেশ)
চাটুজ্যে। আমি পেট টিপে দেখলাম দিব্বি পুরুষ্টু পাঁঠা। খাসা কালিয়া হবে।
নগেন। উহু, ইয়া উরুৎ, হাঁড়িকাবাব-একটু বেশি করে আদাবাটা আর প্যাঁজ।
উদয়। ওঃ, আমার বউ অ্যায়সা গুলিকাবাব করতে জানে।
নগেন। উদো আবার-
বংশ। তোমাদের কি জন্তু দেখলেই খেতে ইচ্ছা করে? একটা নিরীহ অনাথ প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে-তা কেবল কালিয়া আর কাবাব।
টেঁপী। এই যে লাল ফিতে পেয়েছি বাবা।
বংশ। আরে এ যে আদালতের নথির ফিতে! তা যাক, শোন তোর মা এখন কী করছে?
টেঁপী। এক্ষুনি কলঘরে গেছে।
বংশ। ঠিক জানিস? তাহলে এখন এক ঘন্টার মত নিশ্চিন্দি। দেখ, ঝিকে বলে, চট করে ঘোড়ার ভেজানো ছোলা চারটি নিয়ে ঐ বাইরের বারান্দায় ছাগলটাকে খেতে দে; খবরদার বাড়ির ভেতরে নে যাসনি যেন-মা রাগ করবে।
(টেঁপীর প্রস্থান)
ঘেন্টু। আমি পাঁঠা খাব, আমি মেটলি খাব। ও দিদি! ও মা আমায় পাঁঠা দিলে না। ও মা বাবা পাঁঠা এনেছে।
(প্রস্থান)
নগেন। তোমার মাথা এনেছে, ঝড় ওঠালে এইবার।
বিনোদ। চলি হে-চাটুজ্যে চলো না? ওঠো মিঞা সাহেব।
বংশ। নগেন যাও কোথা? ও উদয়।
উদয়। মামাতে আমাতে আপিসঘরে রইলেম,আপনি যান অন্দরে।
ঘেন্টু। (নেপথ্যে) দিদি আমি লম্বকর্ণ খাব। ও মা শিগ্গির এসো লম্বকর্ণ দেখবে।
বংশ। চুকন্দর সিং-
চুকন্দর। (নেপথ্যে) হ-জৌ-র।
তৃতীয় পর্ব
কনসার্ট
(মানিনীর প্রবেশ)
মানিনী। আ মর। ওটাকে কে আনলে? দূর দূর-অ ঝি অ বাতাসী, শিগগির ছাগলটাকে বার কর।
(ঘেন্টু ও টেঁপীর প্রবেশ)
টেঁপী। বা রে। ওকে তো বাবা এনেছে-আমি পুষব।
ঘেন্টু। আমি ঘোড়া ঘোড়া খেলব।
মানিনী। খেলা বার করে দিচ্ছি। ভদ্দরলোকে আবার ছাগল পোষে? বেরো বেরো-অ চুকন্দর সিং।
(চুকন্দরের প্রবেশ)
চুকন্দর। হে-জৌর?
মানিনী। কোথায় ছিলি?
চুকন্দর। মায়ী, কলকাত্তামে বড়া চট্টা ঔর ডাকুকা হুজ্জত হোতা, দেউড়ি পর রহাথা।
মানিনী। দেউড়িতে রয়তা। এদিকে ছাগল ঘরে ঢুকে আয়তা, চোর ডাকু সামলায়গা তুমি? ছাগলটাকে এক্ষুনি নিকাল দিয়ে আও-একদম ফটকের বাইরে-নেই তো এক্ষুনি ছিষ্টি নোংরা করেঙ্গা।
চুকন্দর। বহুত আচ্ছা।
(বংশলোচনের প্রবেশ)
বংশ। দেখো চুকন্দর সিং, এই বকরি গেটের বাইরে যাগা তোমার নোকরি ভি যা’গা।
চুকন্দর। বহুত আচ্ছা।
(প্রস্থান)
মানিনী। টেঁপী হতচ্ছাড়ি, রাত্তির হয়ে গেল,গিলতে হবে না? থাকিস তুই ছাগল নিয়ে। কাল যাচ্ছি আমি হাটখোলায় বাপের বাড়ি-পুজো দেখব।
টেঁপী। আমিও যাব মামার বাড়ি
বংশ। ঘেন্টু, ঝিকে বলে দে, এই একতলার ঘরেই আমার শোবার বিছানা করে দেবে, আর দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে পারি না। আর দেখ, ঠাকুরকে বল আমি মাংস খাব না-
ঘেন্টু। তোমার ভাগটা আমি খাব বাবা?
বংশ। তরা খাস, আমার শুধু খানকতক কচুরি, একটু দাল আর পতল ভাজা হলেই চলবে। না হলেও আপত্তি নেই। যা তরা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়গে-আমি এই ঘরেই রইলেম।
মানিনী। ঘেন্টু চলে আয় বলছি-
ঘেন্টু। আমি বাবার সঙ্গে মাংস খাব-রাধাকান্ত কেবিন থেকে আসছে।
মানিনী। তাহলে রইলে তুমি-কাল মামার বাড়ি যাব আমরা সবাই।
(মানিনী ও টেঁপীর প্রস্থান, ঘেন্টুর অনুসরণ)
বংশ। (বসিয়া) আমি কুকুর পুষি, পাঁঠা পুষি,-তাতে কার কী বলবার আছে? আমার কি সখ নেই-না আমি একটা হেঁজিপেঁজি লোক! পঞ্চাশ টাকা জরিমানা ও একমাস জেল দিতে পারি। বাপের বাড়ি যাবেন-যান; কিসের দুঃখু? আমি কারো তোয়াক্কা করি না- বেঁচে থাক রাধাকান্ত কেবিন, দু’বেলা কাটলেট, চপলেট। ভুটের গান, ছাগল নাচ-চুকন্দর সিং-এর ঢোল-এইসব চালাব-দেখি কী করেন। আমার সখ নেই! নিজেও সেদিন-দেখি খেড়োর খাতাটা- হ্যাঁ এই যে, ক’মাসে পনেরোটা জলচৌকি, তেইশটা বঁটি, আড়াই শ’ টাকার খাগড়াই বাসন কেনা হয়েছে। যত দোষ ছাগলের বেলা। দোষ করেছে আমার ভুটে বেচারা। মোট ঘাড়ে চলতে গিয়ে গরমের দিনে হুমড়ি খেয়ে, ফেন্ট হয়ে পড়ল দরজায়-সেই থেকে রেখেছি তাকে নিজের হেপাজতে। বড় অপরাধ তার আর আমার-
(ভুটের মোট কাঁধে প্রবেশ)
বংশ। আরে রাখ রাখ তোকে বইতে বল্লে কে! আর কি লোক ছিল না?বোস বোস, মাইনে কত পেয়েছিস?
ভুটে। সাত আনা এক পাই।
বংশ। বাজারের পয়সা সরিয়েছিলি বুঝি?
ভুটে। না, চারদিন ম্যালোয়ারি ভুগেছিলুম।
বংশ। হুঃ, যতসব-দেখ ভুটে, আজ থেকে তুই আমার ছাগলের হেপাজত করবি-খোরাকি পাবি এক টাকা বুঝলি? ওটাকে নাচ শেখাবি ডুগডুগি বাজিয়ে-ছাগল নাচের পাঁচালি জানিস?
ভুটে। একটা অজামিলের পাঁচালি বটতলা থেকে আনব?
বংশ। তাই কিনে নিস, বুঝলি? আচ্ছা, এখন একটা ঠাকরুণ বিষয়ে গা তো শুনি, ছাগল থাকগে।
ভুটে। একটা আগমনী গাই; পুজোর দিনটা!
গান
মা আইসে আইসে গন্ধবহ মন্দ মন্দ গন্ধ বহিছে।
আর অন্ধকারে পাখিরা কইছে, মা ঐ যে মা ঐ যে-
দয়াময়ী আমাদের মা এইলো।
মানিনী। (নেপথ্যে) এত রাত হলো, ঘুমের নাম নেই মেয়েটার, গান শোনা হচ্ছে ছাদে উঠে। নেমে আয়; খেয়ে দেয়ে ঘুমোতে চল। বাতাসী, বৈঠকখানায় বিছানা দিলি?
বংশ। কানে পৌচেছে এখান থেকে তোর ডাক। যা ভুটে। আমিও শুইগে কিছু খেয়ে। এই যে টাকাটা, বলিস-রোস কী বলবি?
ভুটে। বলব অজামিলের বই, দড়া, আর মাটির কলসী ওই ছাগলটার জন্য।
বংশ। মিছে কথাটা বলবি? বলিস কর্তা গান শুনে বখসিস দিয়েছে। হ্যাঁ, এত ভয়টা কী? আমার কি সখ নেই-না পয়সা তোমারই একলার?
দে গীতাখানা, রাত জেগে পাঠ করি গে। ছাগলটার যে সাড়া শব্দ পাই না। চুকন্দর সিং বকরি ঠিক?
চুকন্দর। (নেপথ্যে) হাঁ হজৌর।
বংশ। ফাটক বন্ধ্?
(নেপথ্যে ফটক বন্ধের শব্দ)
চুকন্দর। হ-জৌ-র।
(ছাগলের ডাক-অন্ধকার স্টেজ)
চতুর্থ পর্ব
গান
রাত্রি আন্দাজ সওয়া একটা, জোরে জোরে
বইতেছে হাওয়া ঠান্ডা;
বারান্দায় নেড়ে ঝাপটায়, ইদিকে মিটমিটে
পিদুমের আলোতে দেখা যায়-
বংশলোচনের বৈঠকী অন্দরটা।
বংশলোচন বিজুলি সুইচ বন্ধ দিয়া গীতাখানি
বুকে নিয়া নিদ্রাগত হলেন-
নাসিকাধ্বনিতে ঘরখানি জুড়ে নিয়া।
বারান্দায় ঘুমায় চুকন্দর সিং,
আঙিনায় ঘুমায় ভুটে মুটিয়া
বরষার স্বপ্ন রোমন্থন করে-লম্বকর্ণ,
দোক্তার নেশায় ঘুম গেছে তার
ঠান্ডাতে চটিয়া।
বিরক্ত হয়ে ছাগ-নন্দন, চিবায়ে রজ্জু-বন্ধন
নিঃসারে প্রবেশ করে-
পাপোষ খেয়ে, দ্বারদেশ খোলা পাইয়া।
(স্টেজ অন্ধকার- রাত্রি আন্দাজ সওয়া একটা। অন্ধকারে বংশলোচনবাবু শুয়ে আছে।)
বংশ। কখন এলে? অন্ধকার যে- ও কি ও? কে ও? এই উই উঃ।
(নেপথ্যে ঝন ঝন শব্দ)
চোর চোর, বাঘ হ্যায়-এই চুকন্দর সিং ডাকু ডাকু-জলদি আও-নগেন, উদো-আলো জ্বাল্-শিগ্গির আয় মেরে ফেল্লে!
(নেপথ্যে ব্যা-ব্যা-ব্যা শব্দ। নানা অস্ত্রে সকলের প্রবেশ-হাতা, বেড়ি, বন্দুক, টেনিস ব্যাট ইত্যাদি)
মানিনী। কী হলো গো?
বংশ। রোসো রোসো মাথা ঘুরছে। উঃ, কিম্ভুত কিমাকার কী একটা গায়ে হাত দিয়েছে আমার।
মানিনী। কেমন দেখলে গো চেহারা-স্বপন না তো?
বংশ। ওষ্ঠ মাস ঠেলি-দন্ত আছে মেলি, দশ দশ আঙ্গুলিতে বজ্রনখ ধরে।
মানিনী। দস্যি মেয়ে, পালিয়ে আয় বলছি?
টেঁপী। (নেপথ্যে) বাবা, এই ঘরে আছে। তোমার গীতার পাতা খাচ্ছে দেখোসে-ও বাবা তোমার সনদ খেল। মা, তোমার পশমের বিড়াল খেল। যাঃ-
(নেপথ্যে ঝন্ ঝন্ শব্দ)
বংশ। কে রে ওখানে-ও টেপু ও বাতাসী কী দেখলি?
চুকন্দর। বাবুকো ঠাকুরজী বাঁচায়া-
মানিনী। তুই থাম্। পালিয়ে আয় ঘেন্টু,
টেঁপী। কথা শুনছিস না? দেখাব কাল মজা-
(ঘেন্টু টেঁপীর প্রবেশ)
ঘেন্টু। খক্কোস্! পিদুমের গরম এড়ির তেল খেয়েছে।
টেঁপী। পালিয়ে গেল জানালা টপকে,-চুকন্দর সিং ফটক বন্ধ করো।
বংশ। না না, গেছে যাক্।
উদয়। কে, কে রে টেঁপী? কে পালাল? দেখলি কাকে-চোর না ডাকাত?
নগেন। কী রকম দেখতে অ্যাঁ-
ঘেন্টু। ঠিক লম্বকর্ণের মতন।
টেঁপী। লম্বকর্ণই তো, মতন কি আবার?
মানিনী। কালই ওটাকে বিদায়। ছাগল নাচানো বার করছি ভুটের। চলে এসো উপরে, চুকন্দর সিং-বৈঠকখানায় তালা বন্ধ করে দে আও।
চুকন্দর। ঠাকুরজী রচ্ছা কিয়া বাবুকো-
বংশ। রচ্ছা কিয়া না তোমার মুন্ডু কিয়া-এর চেয়ে বাঘ ছিল ভালো।–
মানিনী। কেমন হয়েছে তো ঠিক। আর ছাগল পুষবে? কাল সকালেই ভুটেকে আর ছাগলকে একসঙ্গে বিদায়। চলো উপরে-বাইরে আসতে হবে না ।
(বংশ, মানিনী, টেঁপী ও ঘেন্টু ও চুকন্দরের প্রস্থান)
উদয়। মামী ছাগলটা বিলিয়ে দাও তো আমাকে, আমার বউ গুলিকাবাব করবে।
নগেন। ফের উদো-
ভুটে। আমার কী হবে বাবু?
উদয়। তোর আবার ভাবনা কী- যাত্রার দলে ভর্তি হবি। গাইতে জানিস-?
নগেন। আরে না রে না, আমি আছি তোর সঙ্গে-সব ঠান্ডা করে দেব। রাত পুইয়ে এল, এক ছিলিম সেজে আন আমার জন্য।
(সকলের প্রস্থান)
অধিকারী। ওহে সকাল হয়ে এল-এবার গোষ্ট গাও গোষ্ট গাও।
গান
গা’ তোলো গা’ তোলো কাজে চলো কাজে চলো।
কী ফল বিলম্বে, লেট হলে পড়বে গোল,-
তেলকলে চলো, অবিলম্বে চলো।
চিমনির ধোঁয়া রংএ ঐ শোনো বাঁশি বলে,
আপিসের বেলা হলো
গা’ তোলো গা’ তোলো ভোর হলো ভোর হলো।
চোখ মেলো গোল গোল, রাত গেল তবু
আকাশ কাজল।
রাতটা ভুষা না দিনটা ধূষা উষার দিশা
পেতে গন্ডোগোল।
বংশলোচন ঘড়ি দেখে কন,-
‘মানিনী তাড়াই গে’ ছাগল।’
পঞ্চম পর্ব
(ভোরের কনসার্ট)
(বংশ, চুকন্দর ও ভুটের প্রবেশ)
বংশ। চুকন্দর সিং-
চুকন্দর। হজৌর-
বংশ। ছাগল ঠো হ্যায়-না ভাগা?
চুকন্দর। সয়তান হজুর, বড়া নষ্ট্ ভাগা।
ভুটে। সে আবার যাবার ছেলে-! কলতলায় তরকারির খোসা আর মাছের আঁশ গিলছে।
বংশ। চুকন্দর, কোনো ভালো আদমি ছাগল পালতে রাজি আছে কিনা খোঁজ নাও। ভুটে, তুইও দেখ্-যে সে লোককে ছাগল দেব না।
(বিনোদ নগেন ও উদয়ের প্রবেশ)
বিনোদ। দেখি খবরটা?
উদয়। মামাবাবু, নেংড়া আম খুব সস্তা যাচ্ছে-
বংশ। হু, বরং Wanted কলামটা দেখো-কেউ একটা ছাগল চায় তো দিতে পারি-বেশ কচি।
নগেন। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান-কী লিখছে আনন্দবাজার দেখি?
বিনোদ। রও রও হাইকোর্টটা দেখে নিই।
চুকন্দর। (প্রবেশ) লাটুবাবু আয়ে হেঁ-
বংশ। লাটুবাবু কে রে? কোত্থেকে এল। বসাও গে তোমার ঘরে-যাকে তাকে ঢুকতে দিও না চুকন্দর-দিনকাল খারাপ, বন্দুক তৈরি রাখো। আর লিখিয়ে নিয়ে এসো কী চাই।
(চুকন্দরের প্রস্থান)
চাটুজ্যে। (প্রবেশ)-ফটকের বাইরে তিন মূর্তি কে হে?
বংশ। কেমন দেখতে বলেন তো? লাটুবাবু নাম শুনছি।
চাটুজ্যে। লাটু তো লাটু-
(লাটু, নবিন ও নরহরির প্রবেশ, সঙ্গে চুকন্দর)
গান
হাতে হাতঘড়ি পায়ে কেটসু’ মুখে সিগারেট
দিচ্ছে ফুঁ
উড়্নি নাই ধুতির বাহার খদ্দরের সার্ট
তাতেই কলার।
ঘাড়কামানো অ্যালবার্ট টেরি দেবী কি দেবা
চিনতে পারি
অধরে পানের লেগেছে ছোপ কড়ি-পানা চোখ
আধখান গোঁফ।
চুকন্দর। সিলিপ্ লিখ দেও বাবু--
বংশ। আমি এই সর্তে দিতে পারি, ছাগটাকে আপনি যত্ন করে--
নটবর। নিশ্চয় লেবো, খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে, তবে--
বংশ। মানুষ করবেন, বেচতে পারবেন না।
নটবর। বেচতে যাব কোন্ দুঃখে, আমাদের কি খাবার অভাব?
বংশ। মারতে পারবেন না।
নরহরি। আজ্ঞে আমরা তব্লাই পেটাই বটে, কিষ্ণের জীবকে মারপিট! বাপ্রে অ্যাসল্ট হয়ে যাবে। হাতকড়ি, জরিমানা—কিষ্ণো, কিষ্ণো; ওসব মারধোর আমাদের এসেনা মশয়।
বংশ। সে মারের কথা নয়। পাঁঠাটি কেটে খাবেন না, পুষবেন। লিখে দিন ইস্ট্যাম্প্ কাগজে।--
নটবর। এ যে আপনি লতুন কথা কইলেন! ভদ্দরনোকে কখনও পাঁঠা পোষে?
নরহরি। পাঁঠী লয় যে দুধ দেবে। পাখি লয় যে পড়বে। ভেড়া লয় যে কম্বল হবে।
চাটুজ্যে। বাঁড়ুজ্যে, তোমার ভাই ছাগল এ সর্তে কেউ নেবে না। যক্ষ্মাকাশ রোগী তো এর মধ্যে কাউকে দেখছি না যে ছাগল পুষবে। ওকে দাও নবমীতে ব্রাহ্মণসেবায় লাগিয়ে—উদ্ধার হয়ে যাক বেটা।
বংশ। বাজে বোকো না চাটুজ্যে। আপনারা নেন তো নিন—নইলে রইল আমার ব্যাস্, এই এক কথা।
নটবর। কী বলো হে লরহরি?--
নরহরি। লিয়ে লাও হে লাটুবাবু, লিয়েই লাও। ভদ্দরনোক বলছেন এত করে।
বিনোদ। কিন্তু মনে থাকে যেন—বেচতে পারবে না, কাটতে পারবে না।
চাটুজ্যে। টিপসই নিতে নাও হে রায় বাহাদুর।
নরহরি। সে আপনি ভাববেন না, লাটু লন্দীর কথার লড়চড় লেই।
বংশ। ভুটে, যা ছাগলটা দিয়ে আয় বাবুদের।
ভুটে। ওই চুকন্দর যাক্, আমি পারব না বাবু। ও ছাগল লয় ও আমার আপন ভাইয়ের মতো। প্রাণ ধরে ওকে পরের হাতে দিতে পারব না বাবু—মায়া পড়ে গেছে--
(রোদন)
বংশ। এ তো বড়ো বিপদ কল্লে! আরে কাঁদতে থাকলি যে—চুপ চুপ। এই চুকন্দর যাও।
(চুকন্দর, নটবর, নবীন ও নরহরির প্রস্থান)
বিনোদ। যাক, ছাগলের মোসান ডিস্মিস্ হয়ে গেল।
বংশ। ওদের হাতে দিয়ে ভরসা হচ্ছে না যে—সেখানে যদি কিছু উৎপাত করে তো ওরা সহজে ছাড়বে না।
বিনোদ। উচিত ছিল, ছাগলটাকে হয় সলিটারি সেলে—নয় ফাঁসি দেওয়া! দিলে কবে সাফ ডিস্মিস্—কী আর বলব।
বংশ। এ তো ভাবনায় ফেললে, লোকগুলোর চেহারাও ভালো ঠেকল না হে
চাটুজ্যে। ভেবো না ভেবো না, তোমার পাঁঠা গন্ধর্বলোকে বাস করবে। মাঝ থেকে ফাঁকে পড়লুম, আমরা!
বংশ। যাক্ গে, আমি তো সেই ভেবেই দিয়েছি—মারে তো কী করতে পারি। তাছাড়া আমি তো স্বইচ্ছায় ছাগলটাকে বিদায় করিনি—কী বলিস ভুটে?
চাটুজ্যে। তুমি ভেবো না হে বিচারক—‘অজো নিত্যঃ’ তাদের মার নেই, দেখো ফিরে এলো বলে।
বিনোদ। ফিরে আসবে বটে—তবে এখানে নয়। কালীতলা থেকে জবাই হয়ে ঢুকবে প্রথমে লাটুবাবুর রান্নাঘরে। তারপর সেখান থেকে তপঃসিদ্ধ হয়ে—বার হবে পাঁঠার কোর্মা হয়ে—যাত্রাসদনের সকলের সামনে।
বংশ। হয়তো বা তাই হয়েছে এতক্ষণে, কে জানে। দেখো দেখি একটা জীবহত্যা হলো?
চাটুজ্যে। ভুল, ওটা আমার ভুল ধারণা। পাঁঠা থেকে পাঁঠার কোর্মা—একটা অবস্থার ফের। যেমন—ওর নাম কী—আরসোলা থেকে কাঁচপোকা। হত্যার কথাই উঠতে পারে না।
নগেন। যেমন ‘ছ’য়ে আকার ‘গ’ ছাগ, আর বানানের হেরফেরে ‘ব’এ আকার ‘গ’ বাঘ হয়ে পড়ে। ডারউইনি থিওরি মানতে হয় এতেই তো!
বংশ। চাটুজ্যে, তোমার কথাটাই আমার মনে লাগছে—‘অজো নিত্যঃ’—ওর মার নেই। আবার ফিরে আসবে। এই দেখো না—‘নায়ং ভূত্বা ভবিতা ন ভূয়ঃ—’।
উদয়। ওটার মানে কী হলো বলেন তো,—ভুট্টা যখন লিখছে, তখন বোধকরি ভুটের কথা গীতায় লিখবে?
নগেন। আমি সেবার যখন শিমলায় যাই—ভুটিয়া ছাগল--
উদয়। ও ভুটানের ছাগলের কথা বলেছে পুঁথিতে।
নগেন। মিছে কথা বলিসনি উদো, তোর দৌড় আমার জানা আছে। ঐ লিলুয়া অব্দি--
উদয়। বা রে। আমার দাদাশ্বশুর যে শিমলায় থাকতেন—বউ তো সেইখানেই ভুটিয়া ছাগলের দুধ খেয়ে বড়ো হয়—তাই তো অত রং—।
নগেন। খবরদার উদো--
(মিঞার প্রবেশ)
চাটুজ্যে। আরে মিঞা সাহেব যে। আসেন, আসেন। যাক্ গা ছাগল, একটু খোসগল্প করা যাক। মিঞা সাহেব, নেন তাকিয়া ফর্সি।
মিঞা। কিসের কেচ্ছা কইতে কন—বাঘের?
বিনোদ। আজ ছাগের গল্পই জমবে--
বংশ। না, না, বাঘের হোক। ছাগের পালা থাক।
মিঞা। আচ্ছা একটা ছাগ-বাঘের কেচ্ছাই কই। শুনে লেন ; –পয়লা একটা তো রুবাই কইতে হয়, “ ওই ‘ছ’এ আকার ‘গ’ ছাগ—‘ব’ এ আকার ‘গ’ বাগ—ছাগে বাগে এক ঘাটে জল খায় চক্-চ চক্-চ—।” আমাদের মজিলপুরে দোর্দন্ড পর্তাব খুরুম মন্ডলের মৃত বিবির এক ছাগল ছিল। নাম—ভুটে; তার দাদা ছিল ভোট-কম্বল—লামা ছাগল। যারে বাংলাতে কয়—রামছাগলা। ইয়া পঁচাও শৃঙ্গ, ইয়া মান-মনোহর—গালকম্বল দাড়ি—। যেন মুনি ঋষি। ব্যাটা খেয়ে খেয়ে হলো ইয়া লাস। একদিন হয়েছে কী! মন্ডলের ওখানে জিরাফৎ করতি গেলাম—পাঁঠার কালিয়া, কোপ্তা, কোর্মা, কাবাব, কত্তো কবো—। খানাপিনা করে আচাইবার কালে দেখা গেল কিনা—ভুটে পাঁঠার মাংস চপ্চপ্ কড়মড় করি খাতি লেগেছে। সকলে তজ্জব। আমি বললাম—দ্যাখ কী খুরুম মন্ডল, ছাগলটারে আজই বিদায় করো—কাচ্চা বাচ্চা লয়ে ঘর করতেছে, প্রাণের ভয় নাই? মন্ডল শুনল না। তার পরদিনই ভুটে নিরুদ্দেশ! খোঁজ—খোঁজ, আর খোঁজা। খুরম মন্ডল ছোটাছুটি করে গাঁখানা চাষ ফেলায়ে দেখল, ছাগলের চিহ্নও নেই। এক বচ্ছর যায়—খোঁজাখুঁজিতে সোঁদরবনে পাওয়া গেল সেই ছাগলের পাত্তা। দেখা গেল সিং নাই বললেই চলে, পনেরো আনা মাথা হয়েছে পেলেন্। ছাগল-আর নেই, তার স্থানে গজিয়েছে—চৌগাম্পা গাল-পাট্টা। মুখ—একটি কালো হাঁড়ি। বর্ণ হয়েছে যেন কাঁচা হলুদ। সর্বগায়ে দেখা দিয়েছে আঁজি আঁজি ডোরা। খুরম মন্ডল যেমন ডাকা—ভুটে—; ভুটে ডাক ছাড়ে ‘হালুম’। আমি ঐ না দেখে, বন বাদড় ভেঙে—দে দৌড়, দে দৌড়—একদম বেলেঘাটার পুল পার।
(চুকন্দর, নটবর, নবীন ও নরহরির প্রবেশ)
চুকন্দর। লাটুবাবু আয়ে হেঁ—।
বংশ। ব্যান্ড-মাস্টার, কী মনে করে আবার? এ কী লাটুবাবু আপনার হয়েছে কী?
সকলে। এ কী দশা এ কে করলে। এ কী?
নটবর। আর কী, সর্বনাশ হয়েছে, লাটুর কিছু আর রাখেনি—ও হো হো।
(রোদন)
বংশ। এ কী ব্যাপার। জেব কাটলে কে?
চাটুজ্যে। এ যে দশার দশা করেছে। আহা পুজোর বাজারে—কে এমন কাজ করলো? কে সে জেব-কাট্রা, চোর, ডাকাত, বদমাস? কে এমন এ পাড়ায় এলো—কার এ কাজ?
নটবর। ধনেপ্রাণে মেরেছে মশয়। ও হো হো…।
নরহরি। আঃ কী করো লাটুবাবু, একটু থির হও। হুজুর যখন রয়েছেন, তখন একটা বিহিত করবেনই।
বংশ। চুকন্দর— দোত, কলম, কাগজ—হ্যাঁ, বলেন তো কি হয়েছে ব্যাপারটা—কে এমন কাজ করলে? বলেন—।
নটবর। মশাই, ঐ পাঁঠাটা--
বংশ।অ্যাঁ! বলেন কী!
চাটুজ্যে। হুঁ, বলেছিলাম কি না?
নটবর। ঢোলের চামড়া খেয়েছে, ব্যায়ালার তাঁত কেটেছে, হারমোনিয়ার সব ক’টা দাঁত-চাবি—কড়মড়িয়ে চিবিয়ে ফোকলা করে দিয়েছে যন্তরটা। আর, আমার পকেট—লব্বুই টাকার লোট মশায়, ও হো হো--
নরহরি। গিলে ফেলেছে মশয়! পাঁঠা লয় মিঞা সাহেব সাক্ষাৎ শয়তান। সর্বস্ব গেছে লাটুর। প্রাণটি আর ক্রেসিন কনসার্ট আপনাদের ভরসায় এখনও ধুক্পুক্ করছে। দোহাই হুজুর, একটা বেবস্থা না করলে গরিব মারা যায়। দশাটা দেখেন একবার।
বংশ। ফেসাদ হলো তো, কী করা যায়? চাটুজ্যে, মিঞা সাহেব কী কও?
মিঞা। একটা জোল্লাপ দিয়ে দেখলি হয়।
চাটুজ্যে। হ্যাঁ, এ পরামর্শ ভালো।
নটবর। মশাই, এই কি আপনাদের বিবেচনা হলো? মরছি টাকার শোকে, এ সময় বলেন জোলাপ খেতে! কেমন হাকিম তুমি মিঞা সাহেব?
মিঞা। তুমি খাবে কেন! ছাগলটারে দিতে কইছি।
নরহরি। হায়রে কপাল—ছাগলে মুড়লে কি আর রক্ষা আছে! লোট তো লোট—তাঁত, ঢোলক, হারমোনিয়া মায় ইস্টিলের কত্তাল—কোন্ কালে হজম করে ফেলেছে।
গান
খরচা নাই যে দিই কিছু পেটে
জামা আছে জেব নেছে কেটে
বেয়ালার তাঁত নাই কান নাই লোপাট
ফুলুটের চাবি কটাই।
বাঁয়া তবলা জোড়া গেছে ফেটে
ক্রেসিন ব্যান্ড খেয়েছে বেঁটে
ছাগল চিবাল লোহা কর্তাল
বাঘের যাহা সয় না পেটে।
বংশ। যাক্, আর কথায় কাজ নেই। বিনোদ তুমিই একটা খেসারৎ ঠিক করে দিও। বেচারার লোকসান না হয়, আর আমার উপরেও বেশি চাপ না পড়ে—বুঝলে?
নটবর। ছাগল এইখানেই রইল, ও আমি আর লেবো না।
বিনোদ। বেশ বেশ, আজ যাও, কাল যা হয় করা যাবে।
নরহরি। একশো টাকার ওপোরে লোকসান হয়েছে—উকিলবাবু দেখবেন বিবেচনা করে।
বিনোদ।এ-ক শো’ টা-কা!! আচ্ছা, দেখি কাল যা হয় হবে।
(লাটু, নবীন ও নরহরির প্রস্থান)
(টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রবেশ)
টেঁপী। তোমার লম্বকর্ণ ফিরে এসেছে বাবা। বেশ পোষা হয়ে গেছে। উঠানের কোণে তুলসী পাতা খাচ্ছে।
ঘেন্টু। আর কামড়ায় না, লক্ষ্মী হয়ে গেছে।
চাটুজ্যে। ও টেঁপুরানী, শিগ্গির গিয়ে মা কে বল, কাল আমরা এখানে খাব—লুচি, মাংস, পোলাও--
উদয়। আর গুলিকাবাব—বুঝলি?
ঘেন্টু। বাবা আর মাংস খায় না।
চাটুজ্যে। কী শুনি হে বংশু! প্রেমটা একটা পাঁঠা থেকে বিশ্ব-পাঁঠায় পৌঁছেচে না কি?
উদয়। মামা না খান, আমরা আছি। যাও তো টেঁপু, মাকে বলো সব জোগাড় করতে।
গান
আমরা আছি আমরা আছি তুমিও আছ আমিও আছি
গুকিকাবাব আলুবোখরার কেন্দালুতে আছিই আছি।
ওরে ভাই পাচ্ছি যে রে গন্ধ।
(সুর করে)
ঘেন্টু। (সুর করে) ‘বাবার সঙ্গে মাথার কথা বন্ধ।’…সে এখন হচ্ছে না, মা-বাবার ঝগড়া হয়ে গেছে—।
টেঁপী। মুখ দেখা-দেখি বন্ধ হয়ে গেছে—কথাটি নেই।
বংশ। যা যাঃ, ভারি জ্যাঠা হয়েছিস, ‘কথাটি নেই’—সব জানিস, যত সব--
টেঁপী। বা রে! আমি বুঝি জানিনে? মা যে আমাকে খালি খালি বলে—‘টেঁপী পাখাটা মেরামত করতে হবে—দু’শো টাকা চাই’--
বংশ। থাম্ থাম্। বকিস নে, মার খাবি, ফের জ্যাঠামো?
(ঘেন্টু ও টেঁপীর প্রস্থান)
বিনোদ। ওহে রায় বাহাদুর, ঘেন্টুকে আর ঘাঁটিও না, সব ফাঁস করে দেবে।
মিঞা। হাকিমের ছাওয়াল তো বটে!
চাটুজ্যে। অবস্থাটা সঙ্গিন হয়েছে বলো?
বংশ। এত দিনে সব মিটে যেত, মাঝে থেকে ঐ ছাগলটাই—।
চাটুজ্যে। ব্যাটা ঘর-ভেদী বিভীষণ—তোমারই বা অত মায়া কেন ওটার ওপর। কেটে খেতে না চাও—বিদায় করে দাও। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করো না দাদা।
বংশ। দেখি, কাল যা হয় করা যাবে।
বিনোদ। রায় বাহাদুর, কালবিলম্ব করবেন না। মিটমাট করতে হয়—লাটুর খেসরতের সঙ্গে সঙ্গে আজই--
চাটুজ্যে। চলো এখন।
(মিঞা ছাড়া সকলের প্রস্থান)
বংশ। ওঁরা যান, তুমি বোসো, কটা পরামর্শ নিই তোমার কাছে। দু’ নৌকোয় পা দেওয়া ভাল নয়, কী বল মুন্সী সাহেব? আজ সন্ধ্যা বেলায় যথাবিহিত করবই—যা থাকে কপালে। দুষমন ছাগলটাকে নিয়ে কী করা যায় বলো তো—শুনেছ তো সব কাহিনী?
মিঞা। বলেন তো বকরীটারে নেই কোরবানী করে, নয় তো পাঠায়ে দেন আপনার কালীঘাটে—চুকে যাক ল্যাঠা।
বংশ। তুমি যদি ঠেকতে আমার অবস্থায় তো কি করতে? ছাগলটাকে রেখে কিছু উপায় হয় তো বলো?
মিঞা। গর্দানি দিয়ে নিক্লে দেন,—না, তাও হয় না—সবার সামনে নিজের ছাগল বলে স্বীকার খেয়েছেন— হ্যাঁ। ছাগলটার গলায় লম্বরি চাক্তি দিয়ে ছেড়ে দেন, আর এইরকমভাবে হুলিয়া দেন— ‘এই ছাগল, বেলেঘাটা খালের কাছে কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম। প্রতিপালন করিতে না পারা গতিকে পুনরায় সেই স্থানে ছাড়িয়া দিলাম। আল্লা, কালী ও যিশুর দিব্য—ইহাকে কেহ মারিবেন না। উঁকি দায় দোষে আমি খালাস।’ ইতি মাফ্ করুন বেয়াদপি। আদাব।
(টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রবেশ)
বংশ। টেঁপী নাকি? শোন, তোর মা কি করছে রে?
টেঁপী। ষষ্ঠীর দিনে ঝগড়া হলো কিনা, তাই পাঁজি দেখিয়ে আচার্যিকে দিয়ে ইষ্টি কাটাবার হিসেব করছে।
বংশ। ঝগড়া হয়েছে, ভাব করলেই ইষ্টি কেটে গেল—আবার পাঁজি দেখিয়ে খরচ করা কেন? যা তোর মাকে বলগে যা,—যত্তো সব--
টেঁপী। মা যদি রাগ করে—?
ঘেন্টু। বলব বাবা শিখিয়ে দিয়েছে।
বংশ। ও টেঁপী যা বোঝে করবে। তুই যা ছাগল চড় গিয়ে। আর ঐ ভুটেকে বল—চুকন্দরের বেল্টের চাকতিখানা—আচ্ছা থাক্, আমিই দেখছি—। যা টেঁপী, লক্ষ্মী আমার, মার কাছে যা।
(টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রস্থান)
(ভুটের প্রবেশ)
এই ভুটে শোন এধারে।
চট্ করে এক ঠোঙা জিলিপি আন তো। আমি ততক্ষণ চিরকুটটা লিখে ফেলি, হুলিয়া দিতে হবে—বুঝলি? হ্যাঁ, একগাছা শক্ত দড়ি আর একটা হুমোপাথি ওষুধের খালি শিশি—যেখান থেকে পাস জোগাড় করে আমার এই জায়গায় রাখিস। বেলাবেলি বেরোব বুঝলি—, ভাবছিস কী—ছাগলটাকে ঘরের কাছে এনে রাখ। দৌড়ে যা, আমি চললেম আর সময় নেই।
(ভুটের প্রস্থান)
ষষ্ঠ পর্ব
কনসার্ট
(বংশলোচনের প্রবেশ)
বংশ। সবাই পুজোবাড়ি, ঠিক সারছি চুপিচুপি! শিশির মুখ গালা দিয়ে বন্ধ কাগজটুকুও রইল এর মধ্যে, লাল ফিতে জড়ান। ছাগলটার জন্য দড়ি-গাছটাও মজুত আছে। সাড়ে হলো আর না। ব্যাটা জিলিপির ঠোঙা ছেড়ে আবার পশ্চদ্ধাবন করবে না তো? আকাশের গতিক খারাপ? সরি পায়ে পায়ে--
[ঝড়ের কনসার্ট] এ কী! এ যে কোন্নগরে মেঘ—ঘনঘটা! [অকস্মাৎ বজ্রপাত] বাবাঃ স্বঃ পলায়তি করা যাক তেঁতুলতলার দিকে! দৌড় দৌড়!
(প্রস্থান)
গান
দ্রুম দুদ্দুড় দড় দদ্দড়
আকাশে কে ঢেন্টরি পেটায় চড় চড় গড় গড়।
অন্তরীক্ষে বৃক্ষের মাথায় নীলের গম্বুজে
সিসা রঙের পুরু গোচ মাখানো কে-অস্তর
কেশরে বিদ্যুৎ কড়াৎ কড় কড় চিড় খেয়ে
আকাশ জুড়ে যায় বেমালুম চড়াত চড়াস
কড়কড়।
ঈশান কোণ হতে ঝাপসা পর্দা ঐ এল ঐ এল
করে তাড়া গাছপালা শিহরিল
লম্বা লম্বা তালগাছগুলি প্রবল বেগে মাথা নাড়িল
ঝাপ্টা খেয়ে গাছের ডাল পটাস মটাস মড় মড় মড়।
গেল মান ইজ্জত কাপড়চোপড় কান্ড দেখে
প্রাণ বাঁচাতে--
বংশলোচনের হার্ট করে ধড়ফড়।
(বংশের পুনঃপ্রবেশ)
বংশ—বাপ্, গেলেম বাপ্। ‘এধারে মেঘের ডাক্, ওধারে বিজলি,—সর্ষেফুল দেখিতেছে চক্ষের পুতলী।’ বিশ লক্ষ Volt Electricity! জগৎ লুপ্ত! তুমি নাই, আমি নাই!
(পতন ও মূর্চ্ছা)
চুকন্দর। (নেপথ্যে) হ-জৌ-র।
(ঝড়ের শব্দ চলিতেছে)
বংশ। (চৈতন্য) কে আমি—রায়বাহাদুর? কোথায়? খালপার! ও কিসের শব্দ? কোলাব্যাঙ? ছাগলটা?
(নেপথ্যে) মামা আছেন?—জামাইবাবু?—বংশু আছ?—বাবা সাড়া দাও! বাবুজী কাঁহা চলা গিয়া?
বংশ। যাচ্ছি ভয় নেই--
মিঞা। আর্তনাদ শুনি যে…?
(ছাতা, কম্বল মুড়ি, টর্চ হাতে প্রবেশ)
বংশ। পশ্চাদ্ধাবন করেছে ছাগল। আরে যাঃ খেলে যাঃ। গেছি চুকন্দর সিং।
ভুটে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ পেয়েছি, পেয়েছি, এই যে, এই যে বাবা অন্ধকারে ঘুপটি মেরে--
(মিঞাকে চেপে ধরল)
বিনোদ। (প্রবেশ ও বংশ’র হাত ধরে) পালাও কোথায়? চলো গাড়িতে ওঠো—বাপ কী ঝড়—চুকন্দর সিং লন্ঠন…।
(লন্ঠন হস্তে প্রবেশ)
চুকন্দর। ঠাকুরজী রচ্ছা কিয়া, চলিয়ে গাড়ি পর।
মিঞা। দ্যাখছেন কী? মুস্কিল আসান—মুস্কিল আসান—।
(ঝড় থামল, বংশকে লইয়া সকলের প্রস্থান)
চাটুজ্যে।(প্রবেশ) রায়বাহাদুরের বাড়ি তো নয়—রাবণের পুরী। কেউ কোথাও নেই আজ, সব যেন থম্থমো! হাওয়াটা দিয়েছে বিশী—গা’টা ছম্ছম্ করছে। কী দুর্দৈব ঘটে কে জানে। ও ভুটে, ভুটে—একছিলুম তামাক দিতে পারিস? গলাটা কেমন শুকোচ্ছে।
(নেপথ্যে মানিনীর রোদন)
মানিনী। (নেপথ্যে) আমার সে কোথায় গেল বিলাসী? আমি কেন মরতে ছাগল নিয়ে ঝগড়া করতে গেলাম? আর বুঝি এল না! কাউকে দেখি নে যে—সব যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে—।
(ভুটের প্রবেশ)
চাটুজ্যে। কোনো ভাবনা নেই মা। তুমি স্থির হও। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি, কিসের ভয়? এ সবই ভগবানের হাত। ছাগলটা যখন—ভুটে কী হলো, হুকোটা পেলিনে?—থাকগে। বাবু যে গেল, তার খবর কেউ রাখলিনে?
(মানিনীর প্রবেশ)
শেষ কেমন দেখেছিলি; বল তো শুনি। দেখি, ব্যাপারটা বুঝে মা, তুমি বসো, আমাকে লজ্জা কী? শুনি কান্ডটা।
ভুটে। আপনারা তো মাঠাক্রুনের মান ভঞ্জন করতিই বসে গেলে, আমারে ডেকে বাবু বললেন,—ভুটে, এক ঠোঙা গরম জিলিপি, আর এক গাছা শক্ত দড়ি—’
চাটুজ্যে। অ্যাঁ: ওই মনের অবস্থা,—ও সময় দড়ি এনে দড়ি এনে দিতে হয়! খালি জিলিপি এনে বলতে হয়, দড়ি পেলাম না।
ভুটে। আমি কেমন করে জানব। আমি জানি বাবু মুশুরি খাটাবে।
চাটুজ্যে। আর কী এনেছিলি বল—ছুরি, কাটারি, কাস্তে—?
ভুটে। কিছু লয়, শুধু একটু খালি লাল ফিতে, আর একটা হমোপাতি শিশি।
চাটুজ্যে। অ্যাঁ! শিশি! তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে--
মানিনী। শিশিতে আফিং না কুকিন্— কী ছিল তাই বল্না? ওরে সর্বনাশ হয়েছে আমার।
চাটুজ্যে। ভুটেকে বলতে দাও মা, ব্যস্ত হয়ো না।
ভুটে। বাবু শিশি আনতে বলে, আমাকে বললে,—‘তুই যা—সময় নেই। হুইল লিখে নিই।’
চাটুজ্যে। অ্যাঁ! উইল—চুপচুপ! দেখো দেখি, ফটকে গাড়ির শব্দ পাচ্ছি—। মা,তুমি কেঁদো না। আমি রইলেম এখানে,—যতক্ষণ একটা হেস্তনেস্ত না হচ্ছে। বিধাতার কান্ড দেখো। হে হরি! কেঁদো না মা।
(ভুটের প্রস্থান)
মানিনী। ওগো তুমি কোথায়?
বংশ। (নেপথ্যে) এই যে আমি, ঠিক আছি, ভয় নেই।
ভুটে। (প্রবেশ) বাবু জলঘরে গেছেন।
মানিনী। আঃ। চাটুজ্যে মিন্সে যে নড়ে না! দেখো শিগগির জলঘরে কেন?
চাটুজ্যে। দেখি একবার আমি। হঠাৎ মাথা ঘুরল,—না, কী হলো কে জানে!
মানিনী। ও বিলাসী, দেখ না, তোয়ালে গামছা দিতে বল। টেঁপী গেল কোথায়?
(টেঁপী ও ঘেন্টুর প্রবেশ)
টেঁপী। এই যে, আমি আছি মা।
ঘেন্টু। বাবা মাথা মুছে আসছে।
(মাথা মুছতে মুছতে বংশ’র প্রবেশ)
মানিনী। ও কী। ভিজে যে ঢোল হয়েছ! শিগ্গির চা খাবে চলো। তোমার সেই বোতলের ওষুধ আছে,—সর্দির—একটু চায়ে মিশিয়ে দেব ও টেঁপী, আজ আর ওপরে ওঠা নয়।
(নেপথ্যে ম্যাঁ ম্যাঁ ম্যাঁ)
বংশ। আবার ওটা এসেছে—চুকন্দর, ভুটে, লাঠি—গাছ কোথায় গেল।
চাটুজ্যে। আ-হা, কী করো, মেরো না। বৃষ্টি থামতেই বেচারা এসে ছুটে তোমার খবর দিয়েছে। তাই তো তোমায় খুঁজতে পাঠান গেল, ফিরেও পাওয়া গেল।
মানিনী। ও থাক, ভুটের জিম্মেয়। তোমার আর ভয় নেই। চাটুজ্যে মিন্সে যে নড়ে না,—বল্ না ভুটে।
ভুটে। চাটুজ্যে মশাই, একবার চলেন না রান্নাঘরে লুচি ক’খানা—।
চাটুজ্যে। ওঃ ভুলেই গিয়েছিলাম। চল্ চল্।
মানিনী। চলো বৈঠকখানায় আর কাজ নেই। কিছু খেয়ে ঘুমুবে।
বংশ। আজ আর খিদে নেই তেমন।
মানিনী। ও কী! সে হবে না। গরম লুচি ক’খানা,—আর মোহনভোগ খেতেই হবে। নইলে মাথা খাও—।
(সকলের প্রস্থান)
(নেপথ্যে ছাগলের ডাক)
অধিকারী। একতা লাস্ সং দাও হে—একটা লাস্ সং দাও।
গান
পাঁঠা তুই বড়ই ভাগ্যবান
পাঁঠা তোমায় করলে খাসী
মাংস হবে রাশি রাশি
একসঙ্গে খাব বসে হিন্দু-মুছলমান।
পাঁঠা খেতে বড়ই মজা
কোথা লাগে জিভে-গজা
রসগোল্লা হার মেনে যায় রেখে তাহার মান।
(ভুটের ছাগল নিয়ে নৃত্য)