শিল্প ও দেহতত্ত্ব
কিছুর নোটিস যে দিচ্ছে, ঘটনা যেমন ঘটেছে তার সঠিক রূপটির প্রতিচ্ছায়া দেওয়া ছাড়া সে বেচারা অনন্যগতি; সে যদি ভাবে সে একটা কিছু রচনা করছে তো সেটা তার মস্ত ভ্রম। ডুবুরি সমুদ্রের তলা ঘেঁটে মুক্তার শুক্তি তুলে আনে, খুবই সুচতর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার, কিন্তু সে কি বলাতে পারে আপনাকে মুক্তাহারের রচয়িতা, না, যে পাহাড় পর্বত দেশে বিদেশে ঘুরে ফটোগ্রাফ তুলে আনছে সে নিজেকে চিত্রকর বলে চালিয়ে দিতে পারে আর্টিস্ট মহলে? একটুখানি বুদ্ধি থাকলেই আর্টের ইতিহাস লেখা চলে, কিন্তু যে জিনিসগুলো নিয়ে আর্টের ইতিহাস তার রচয়িতা ইতিহাসবেত্তা নয় রসবেত্তা— নেপোলিয়ান বীররসের আর্টিস্ট, তার হাতে ইউরোপের ইতিহাস সৃষ্ট হল, সীজার আর্টিস্ট গড়লে রোমের ইতিহাস। যে ড়ুবে তোলে সে তোলে মাত্র বুদ্ধিবলে; আর যে গড়ে তোলে সে ভাঙাকে জোড়া লাগায় না শুধু, সে বেজোড় সামগ্রীও রচনা করে চলে মন থেকে। ইতিহাসের ঘটনাগুলো পাথরের মতো সুনির্দিষ্ট শক্ত জিনিস, একচুল তার চেহারার অদলবদল করার স্বাধীনতা নেই ঐতিহাসিকের, আর ঔপন্যাসিক কবি শিরী এঁদের হাতে পাষাণও রসের দ্বারা সিক্ত হয়ে কাদার মতো নরম হয়ে যায়, রচয়িতা তাকে যথা ইচ্ছা রূপ দিয়ে ছেড়ে দেন। ঘটনার অপলাপ ঐতিহাসিকের কাছে দুর্ঘটনা, কিন্তু আর্টিস্টের কাছে সেটা বড় সুঘটন বা সুগঠনের পক্ষে মস্ত সুযোগ উপস্থিত করে দেয়। ঠিকে যদি ভুল হয়ে যায় তবে অঙ্কটাই ভুল হয়; অঙ্কনের বেলাতেও ঠিক ওই কথা। কিন্তু পাটীগণিতের ঠিক আর খাঁটি গুণীদের ঠিকের প্রথা স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র;— নামতা ঠিক রইল তো অঙ্ককর্তা বললেন, ঠিক হয়েছে, কিন্তু নামেই ছবিটা ঠিক মানুষ হল কি গরু গাধা বা আর-কিছু হল, রসের ঠিকানা হল না ছবির মধ্যে, অঙ্কনকর্তা বলে বসলেন, ভুল! ঐতিহাসিকের কারবার নিছক ঘটনাটি নিয়ে, ডাক্তারের কারবার নিখুঁত হাড়মাসের anatomy নিয়ে, আর আর্টিস্টদের কারবার অনির্বচনীয় অখণ্ড রসটি নিয়। আর্টিস্টদের কাছে ঘটনার ছাঁচ পায় না রস, রসের ছাঁদ পেয়ে বদলে যায় ঘটনা, হাড়মাসের ছাঁচে পায় না শিল্পীর মানস কিন্তু মানসের ছাদ অনুসারে গড়ে ওঠে সমস্ত ছবিটার হাড়হদ্দ, ভিতর বাহির। একটা গাছের বীজ, সে তার নিজের আকৃতি ও প্রকৃতি যেমনটি পেয়েছে সেইভাবেই যখন হাতে পড়ল, তখন সে গোলাকার কি চেপ্টা ইত্যাদি, কিন্তু সে থলি থেকে মাটিতে পড়েই রসের সঞ্চার নিজের মধ্যে যেমনি অনুভব করলে অমনি বদলে চলল নিজের আকৃতি প্রকৃতি সমস্তই; যার বাহু ছিল না চোখ ছিল না, যে লুকিয়ে ছিল মাটির তলায় নীরস কঠিন বীজকোষে বদ্ধ হয়ে, সে উঠল মাটি ঠেলে, মেলিয়ে দিলে হাজার হাজার চোখ আর হাত আলোর দিকে আকাশের দিকে বাতাসের উপরে, নতুন শরীর নতুন ভঙ্গি লাভ করলে সে রসের প্রেরণায়, গোলাকার বীজ ছত্রাকার গাছ হয়ে শোভা পেলে, বীজের anatomy লুকিয়ে পড়ল ফুলের রেণুতে পাকা ফলের শোভার আড়ালে। বীজের হাড়হদ্দ ভেঙে তার anatomy চুরমার করে বেরিয়ে এল গাছের ছবি বীজকে ছাড়িয়ে। গাছ যে রচলে তার রচনায় ছাঁদ ও anatomyর দোষ দেবার সাহস কারু হল না, উল্টে বরং কোনো কোনো মানুষ তারই রচনা চুরি করে গাছপালা আঁকতে বসে গেল— বীজতত্ত্বের বইখানার মধ্যে ফেলে রেখে দিলে যে অস্থিপঞ্জরের মতো শক্ত পিঞ্জরে বদ্ধ ছিল বীজের প্রাণ তার প্রকৃত anatomyর হিসেব। বীজের anatomy দিয়ে গাছের anatomy বিচার করতে যাওয়া, আর মানুষী মূর্তির anatomy দিয়ে মানস মূর্তির anatomyর দোষ ধরতে যাওয়া সমান মূর্খতা। Anatomyর একটা অচল দিকে আছে, যেটা নিয়ে এক রূপের সঙ্গে আর এক রূপের সুনির্দিষ্ট ভেদ, কিন্তু anatomyর একটা সচল দিকও আছে সেটা নিয়ে মানুষে মানুষে বা একইজাতের গাছে গাছে ও জীবে জীবে বাঁধা পার্থক্য একটুখানি ভাঙে— কোনো মানুষ হয় তালগাছের মতো, কেউ হয় ভাঁটার মতো, কোনো গাছ ছড়ায় ময়ুরের মতো পাখা, কেউ বাড়ায় ভূতের মতো হাত! প্রকৃতি-বিজ্ঞানের বইখানাতে দেখবে মেঘের সুনির্দিষ্ট গোটাকতক গড়নের ছবি দেওয়া আছে— বৃষ্টির মেঘ, ঝড়ের মেঘ— সবার বাঁধা গঠন কিন্তু মেঘে যখন বাতাস লাগল রস ভরল তখন শাস্ত্র-ছাড়া সৃষ্টি-ছাড়া মূর্তি সব ফুটতে থাকল, মেঘে মেঘে রঙ লাগল অদ্ভুত অদ্ভুত, সাদা ধোঁয়া ধুমধাম করে সেজে এল লাল নীল হলদে সবুজ বিচিত্র সাজে, দশ অবতারের রঙ ও মূর্তিকে ছাড়িয়ে দশ সহস্র অবতার! সচিত্র প্রকৃতি-বিজ্ঞানের পুঁথি খুলে সে সময় কোন রসিক চেয়ে দেখে মেঘের রূপগুলোর দিকে? এই যে মেঘের গতিবিধির মতো সচল সজল anatomy, একেই বলা হয় artistic anatomy, যার দ্বারায় রচয়িতা রসের আধারকে রসের উপযুক্ত মান পরিমাণ দিয়ে থাকেন। মানুষের তৃষ্ণা ভাঙতে যতটুকু জল দরকার তার পরিমাণ বুঝে জলের ঘটি একরকম হল, মানুষের স্নান করে শীতল হতে যতটা জল দরকার তার হিসেবে প্রস্তুত হল ঘড়া জালা ইত্যাদি; সুতরাং রসের বশে হল আধারের মান পরিমাণ আকৃতি পর্যন্ত। যার কোনো রসজ্ঞান নেই সেই শুধু দেখে পানীয় জলের ঠিক আধারটি হচ্ছে চৌকোণো পুকুর, ফটিকের গেলাস নয়, সোনার ঘটিও নয়। গোয়ালের গরু হয়তো দেখে পুকুরকে তার পানীয় জলের ঠিক আধার, কিন্তু সে যদি মানুষকে এসে বলে, ‘তোমার গঠন সম্বন্ধে মোটেই জ্ঞান নেই, কেননা জলাধার তুমি এমন ভুল রকমে গড়েছ যে পুকুরের সঙ্গে মিলছেই না’, তবে মানুষ কি জবাব দেয়?
ঐতিহাসিকের মাপকাঠি ঘটনামূলক, ডাক্তারের মাপকাঠি কায়ামূলক, আর রচয়িতা যারা তাদের মাপকাঠি অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়ামূলক। ঐতিহাসিককে রচনা করতে হয় না, তাই তার মাপকাঠি ঘটনাকে চুল চিরে ভাগ করে দেখিয়ে দেয়,ডাক্তারকেও জীবন্ত মানুষ রচনা করতে হয় না, কাজেই জীবন্মৃত ও মৃত মানুষের শবচ্ছেদ করার কাজের জন্য চলে তার মাপকাঠি, আর রচয়িতাকে অনেক সময় অবস্তুকে বস্তুজগতে, স্বপ্নকে জাগরণের মধ্যে টেনে আনতে হয়, রূপকে রসে, রসকে রূপে পরিণত করতে হয়, কাজেই তার হাতের মাপকাঠি সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের, রূপকথার সোনার রূপোর কাটির মতো অদ্ভুত শক্তিমান। ঘটনা যাকে কুড়িয়ে ও খুঁড়ে তুলতে হয়, ঠিক ঠিক খোন্তা হল তার পক্ষে মহাস্ত্র, মানুষের ভৌতিক শরীরটার কারখানা নিয়ে যখন কারবার, ঠিক ঠিক মাংসপেশী অস্থিপঞ্জর ইত্যাদির ব্যবচ্ছেদ করার শূল ও শলাকা ইত্যাদি হল তখন মৃত্যুবাণ, কিন্তু রচনা প্রকাশ হবার আগেই এমন একটি জায়গার সৃষ্টি হয়ে বসে যে সেখানে কোদাল, কুড়ুল, শূল, শাল কিছু চলে না, রচয়িতার নিজের অস্থিপঞ্জর এবং ঘটাকাশের ঘটনাসমস্ত থেকে অনেক দূরে রচয়িতার সেই মনোজগৎ বা পটাকাশ যেখানে ছবি ঘনিয়ে আসে মেঘের মতো, রস ফেনিয়ে ওঠে, রঙ ছাপিয়ে পড়ে আপনা আপনি। সেই সমস্ত রসের ও রূপের ছিটেফোঁটা যথোপযুক্ত পাত্র বানিয়ে ধরে দেয় রচয়িতা আমাদের জন্যে। এখন রচয়িতা রস বুঝে রসের পাত্র নির্বাচন করে যখন দিচ্ছে তখন রসের সঙ্গে রসের পাত্রটাও স্বীকার না করে যদি নিজের মনোমতো পাত্রের রসটা ঢেলে নিতে যাই তবে কি ফল হবে? ধর, রৌদ্ররসকে একটা নবতাল বা দশতাল মূর্তির আধার গড়ে ধরে আনলেন রচয়িতা, পাত্র ও তার অন্তর্নিহিত রসের চমৎকার সামঞ্জস্য দিয়ে, এখন সেই রচয়িতার আধারকে ভেঙে রৌদ্ররস যদি মুঠোম হাত পরিমিত anatomy-দোরস্ত আমার একটা ফটোগ্রাফের মধ্যে ধরবার ইচ্ছে করি তো রৌদ্র হয় করুণ নয় হাস্য রসে পরিণত না হয়ে যাবে না; কিংবা ছোট মাপের পাত্রে না ঢুকে রসটা মাটি হবে মাটিতে পড়ে।
হারমোনিয়ামের anatomy, বীণার anatomy, বাঁশির anatomy রকম রকম বলেই সুরও ধরে রকম রকম; তেমনি আকারের বিচিত্রতা দিয়েই রসের বিচিত্রতা বাহিত হয় আর্টের জগতে, আকারের মধ্যে নির্দিষ্টতা সেখানে কিছুই নেই। হাড়ের পঞ্জরের মধ্যে মাংসপেশী দিয়ে বাঁধা আমাদের এতটুকু বুক, প্রকাণ্ড সুখ প্রকাণ্ড দুঃখ প্রকাণ্ড ভয় এতটুকু পাত্রে ধরা মুশকিল। হঠাৎ এক-এক সময়ে বুকটা অতিরিক্ত রসের ধাক্কায় ফেটে যায়; রসটা চাইলে বুককে অপরিমিত রকমে বাড়িয়ে দিতে, কিংবা দমিয়ে দিতে, আমাদের ছোট পিঁজ্রে হাড়ে আর তাঁতে নিরেট করে বাঁধা স্থিতি-স্থাপকতা কিংবা সচলতা তার নেই, অতিরিক্ত স্টিম পেয়ে বয়লারের মতো ফেটে চৌচির হয়ে গেল। রস বুকের মধ্যে এসে পাত্রটায় যে প্রসারণ বা আকুঞ্চন চাইলে, প্রকৃত মানুষের anatony সেটা দিতে পারলে না; কাজেই আর্টিস্ট যে, সে রসের ছাঁদে কমে বাড়ে ছন্দিত হয় এমন একটা সচল তরল anatomy সৃষ্টি করে নিলে যা অন্তর এবং বাইরে সুসঙ্গত ও সুসংহত। রসকে ধরবার উপযুক্ত জিনিস বিচিত্র রঙ ও রেখা-সমস্ত গাছের ডালের মতো, ফুলের বোঁটার মতো, পাতার ঝিলিমিলির মতো তারা জীবনরসে প্রাণবন্ত ও গতিশীল। ফটোগ্রাফারের ওখানে ছবিওঠে— সীসের টাইপ থেকে যেমন ছাপ ওঠে— ছবি ফোটে না। পারিজাতের মতো বাতাসে দাঁড়িয়ে আকাশে ফুল ফোটানো আর্টিস্টের কাজ, সুতরাং তার মন্ত্র মানুষের শরীরযন্ত্রের হিসেবের খাতার লেখার সঙ্গে এমনকি বাস্তব জগতের হাড়হদ্দের খবরের সঙ্গে মেলানো মুশকিল। অভ্রবিজ্ঞানের পুঁথিতে আবর্ত সম্বর্ত ইত্যাদি নামরূপ দিয়ে মেঘগুলো ধরা হয়েছে— কিন্তু কবিতা কি গান রচনার বেলা ওইসব পেঁচাল নামগুলো কি বেশি কাজে আসে? মেঘের ছবি আঁকার বেলাতেও ঠিক পুঁথিগত ঘোরপেঁচ এমনকি মেঘের নিজ মূর্তিগুলোর হুবহু ফটোগ্রাফও কাজে আসে না। রচিত
যা তার মধ্যে বসবাস করলেও রচয়িতা চায় নিজের রচনাকে। সোনার খাঁচার মধ্যে থাকলেও বনের পাখি সে যেমন চায় নিজের রচিত বাসাটি দেখতে, রচয়িতাও ঠিক তেমনি দেখতে চায় নিজের মনোগতটি গিয়ে বসল নিজের মনোমতো করে রচা রঙ রেখা ছন্দোবন্ধ ঘেরা সুন্দর বাসায়। কোকিল সে পরের বাসায় ডিম পাড়ে— নামজাদা মস্ত পাখি। কিন্তু বাবুই সে যে রচয়িতা, দেখতে এতটুকু কিন্তু বাসা বাঁধে বাতাসের কোলে— মস্ত বাসা। আমাদের সঙ্গীতে বাঁধা অনেকগুলো ঠাট আছে, যে লোকটা সেই ঠাটের মধ্যেই সুরকে বেঁধে রাখলে সে গানের রচয়িতা হল না, সে নামে রাজার মতো পূর্বপুরুষের রচিত রাজগীর ঠাটটা মাত্র বজায় রেখে চলল ভীরু, কিন্তু যে রাজত্ব পেয়েও রাজত্ব হারাবার ভয় রাখলে না, নতুন রাজত্ব জিতে নিতে চলল সেই সাহসীই হল রাজ্যের রচয়িতা বা রাজা এবং এই স্বাধীনচেতারাই হয় সুরের ওস্তাদ। সুর লাগাতে পারে তারাই যারা সুরের ঠাট মাত্র ধরে থাকে না, বেসুরকেও সুরে ফেলে।
মানুষের anatomyতেই যদি মানুষ বদ্ধ থাকত, দেবতাগুলোকে ডাকতে যেতে পারতো কে? কার জন্যে আসত নেমে স্বর্গ থেকে ইন্দ্ররথ, পুষ্পক রথে চড়িয়ে লঙ্কা থেকে কে আনত সীতাকে অযোধ্যায়? ভূমিষ্ঠ হয়েই শিশু আপনার anatomy ভাঙতে শুরু করলে, বানরের মতো পিঠের সোজা শিরদাঁড়াকে বাঁকিয়ে সে উঠে দাঁড়াল— দুই পায়ে ভর দিয়ে, গাছে গাছে ঝুলতে থাকল না। প্রথমেই যুদ্ধ হল মানুষের নিজের anatomyর সঙ্গে, সে তাকে আস্তে আস্তে বদলে নিলে আপনার চলন-বলনের উপযুক্ত করে। বীজের anatomy নাশ করে যেমন বার হল গাছ, তেমনি বানরের anatomy পরিত্যাগ করে মানুষের anatomy নিয়ে এল মানুষ; ঠিক এইভাবেই medical anatomy নাশ করে আর্টিস্ট আবিস্কার করলে artistic anatomy, যা রসের বশে কমে বাড়ে, আঁকে বাঁকে, প্রকৃতি সব জিনিসের মতো— গাছের ডালের মতো, বৃন্তের মতো, পাপড়ির মতো, মেঘের ঘটার মতো, জলের ধারার মতো। রসের বাধা জন্মায় যাতে এমন সব বস্তু কবিরা টেনে ফেলে দেন,— নিকঙ্কুশাঃ কবয়ঃ। লয়ে লয়ে না মিললে কবিতা হল না, একথা যার একটু কবিত্ব আছে সে বলবে না; তেমনি আকারে আকারে না মিললে ফটোগ্রাফ হল না বলতে পারি, কিন্তু ছবি হল না একথা বলা চলে না। ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান’ শুনতে বেশ লাগল, ‘ছেলেটি কার্তিকের মতো’ দেখতে বেশ লাগল, কিন্তু কবিতা লিখলেই কি কাশীদাসী সুর ধরতে হবে, না ছেলে আঁকতে হলেই পাড়ার আদুরে ছেলের anatomy কপি করলেই হবে? গণেশের মূর্তিটিতে আমাদের ঘরের ও পরের ছেলের anatomy যেমন করে ভাঙা হয়েছে তেমন আর কিছুতে নয়। হাতি ও মানুষের সমস্তখানি রূপ ও রেখার সামঞ্জস্যের মধ্য দিয়ে একটা নতুন anatomy পেয়ে এল, কাজেই সেটা আমাদের চক্ষে নাড়া দিচ্ছে না, কেননা সেটা ঘটনা নয়, রচনা। আরব্য উপন্যাসের উড়ন্ত সতরঞ্চির কল্পনা বাস্তব-জগতে উড়োজাহাজ দিয়ে সপ্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কি আমাদের কাছে নগণ্য হয়েছিল, না, অবাধ কল্পনার সঙ্গে গল্পের ঠাট মিলছে কিন্তু বিশ্বরচনার সঙ্গে মিলছে না দেখে গালগল্প রচনার বাদশাকে কেউ আমরা দুষেছি? প্রত্যেক রচনা তার নিজের anatomy নিয়ে প্রকাশ হয়; ঠাট বদলায় যেমন প্রত্যেক রাগ-রাগিণীর, তেমনি ছাঁদ বদলায় প্রত্যেক ছবির কবিতার রচনার বেলায়। ধর যদি এমন নিয়ম করা যায় যে কাশীদাসী ছন্দ ছাড়া কবিরা কোনো ছন্দে লিখতে পারবে না— যেমন আমরা চাচ্ছি ডাক্তারি anatomy ছাড়া ছবিতে আর কিছু চলবে না— তবে কাব্যজগতে ভাবের ও ছন্দের কি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়,— সুরের বদলে থাকে শুধু দেশজোড়া কাশি আর রচয়িতার বদলে থাকে কতকগুলি দাস। কাজেই কবিদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ‘কবয়ঃ নিরঙ্কুশাঃ’ বলে, কিন্তু বাস্তবজগৎ থেকে ছাড়া পেয়ে কবির মন উড়তে পারবে যথাসুখে যথাতথা, আর ছবি আটকে থাকবে ফটোগ্রাফারের বাক্সর মধ্যে— জালার মধ্যে বাঁধা আরব্য উপন্যাসের জিন্-পরীর মতো সুলেমানের সীলমোহর আঁটা চিরকালই এ কোনদেশী কথা ? ইউরোপ, যে চিরকাল বাস্তবের মধ্যে আর্টকে বাঁধতে চেয়েছে সে এখন সীলমোহর মায় জালা পর্যন্ত ভেঙে কি সঙ্গীতে, কি চিত্রে, ভাস্কর্যে, কবিতায়, সাহিত্যে বাঁধনের মুক্তি কামনা করছে; আর আমাদের আর্ট যেটা চিরকাল মুক্ত ছিল তাকে ধরে ডানা কেটে পিঁজরের মধ্যে ঠেসে পুরতে চাচ্ছি আমরা। বড় পা’কে ছোট জুতোর মধ্যে ঢ়ুকিয়ে চীনের রাজকন্যার যা ভোগ ভুগতে হয়েছে সেটা কষা জুতোর একটু চাপ পেলেইআমরা অনুভব করি— পা বেরিয়ে পড়তে চায় চট্ করে জুতো ছেড়ে, কিন্তু হায়! ছবি— সে কিনা আমাদের কাছে শুধু কাগজ, সুর— সে কিনা শুধু খানিক গলার শব্দ, কবিতা— সে শুধু কিনা ফর্মাবাঁধা বই; তাই তাদের মুচড়ে মুচড়ে ভেঙে-চুরে চামড়ার থলিতে ভরে দিতে কষ্টও পাইনে ভয়ও পাইনে।
অন্যথা-বৃত্তি হল আর্টের এবং রচনার পক্ষে মস্ত জিনিস, এই অন্যথা-বৃত্তি দিয়েই কালিদাসের মেঘদূতের গোড়া পত্তন হল, অন্যথা-বৃত্তি কবির চিত্ত মানুষের রূপকে দিলে মেঘের সচলতা এবং মেঘের বিস্তারকে দিলে মানুষের বাচালতা। এই অসম্ভব ঘটিয়ে কবি সাফাই গাইলেন যথা—“ধূমজ্যোতিসলিলমরুতাং সন্নিপাতঃ ক্ক মেঘঃ, সন্দেশার্থাঃ ক্ক পটুকরণৈঃ প্রাণিভিঃ প্রাপণীয়াঃ!”(১) ধূম আলো আর জল-বাতাস যার শরীর, তাকে শরীর দাও মানুষের, তবে তো সে প্রিয়ার কানে প্রাণের কথা পৌছে দেবে? বিবেক ও বুদ্ধি মাফিক মেঘকে মেঘ রেখে কিছু রচনা করা কালিদাসও করেননি, .কোন কবিই করেন না। যখন রচনার অনুকূল মেঘের ঠাট কবি তখন মেঘকে হয়তো মেঘই রাখলেন কিন্তু যখন রচনার প্রতিকূল ধূম জ্যোতি জল বাতাস তখন নানা বস্তুতে শক্ত করে, বেঁধে নিলেন কবি। এই অন্যথা-বৃত্তি কবিতার সর্বস্ব, তখনো যেমন এখনো তেমন, রসের বশে ভাবের খাতিরে রূপের অন্যথা হচ্ছে—
“শ্রাবণ মেঘের আধেক দুয়ার ঐ খোলা,
আড়াল থেকে দেয় দেখা কোন পথভোলা
ঐ যে পূরব গগন জুড়ে, উত্তরী তার যায় রে উড়ে
সজল হাওয়ার হিন্দোলাতে দেয় দোলা!
লুকাবে কি প্রকাশ পাবে কেই জানে,
আকাশে কি ধরায় বাসা কোন্ খানে,
নানা বেশে ক্ষণে ক্ষণে, ঐ ত আমার লাগায় মনে,
পরশখানি নানা সুরের ঢেউ তোলা।”
ভাব ও রসের অন্যান্য বৃত্তি পেয়ে মেঘ এখানে নতুন সচল anatomyতে রূপান্তরিত হল। বলতে পারো মেঘকে তার স্বরূপে রেখে কবিতা লেখা যায় কি না? আমি বলি যায়, কিন্তু অভ্রবিজ্ঞানের হিসেব মেঘের রূপকে যেমন ছন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখায়, সেভাবে লিখলে কবিতা হয় না, রঙের ছন্দ বা ছাঁদ, কথার ছাঁদ দিয়ে মেঘের নিজস্ব ও প্রত্যক্ষ ছাঁদ না বদলালে কবিতা হতে পারে না, যেমন--
“আজি বর্ষা রাতের শেষে
সজল মেঘের কোমল কালোয়
অরুণ আলো মেশে।
বেণু বনের মাথায় মাথায়
রঙ লেগেছে পাতায় পাতায়,
রঙের ধরায় হৃদয় হারায়
কোথা যে যায় ভেসে।”
মনে হবে অপ্রাকৃত কিছু নেই এখানে, কিন্তু কালো শুধু বলা চলল না, কোমল কালো না হলে ভেসে চলতে পারল না আকাশে বাতাসে রঙের স্রোত বেয়ে কবির মানসকমল থেকে খসে-পড়া সুর-বোঝাই পাপড়িগুলি সেই দেশের খবর আনতে যে দেশের বাদল বাউল একতারা বাজাচ্ছে সারা বেলা। সকালের প্রকৃত মূর্তিটা হল মেঘের কালোয় একটু আলো কিন্তু টান-টোনের কোমলতা পাতার হিলিমিলি নানা রঙের ঝিলিমিলির মধ্যে তাকে কবি হারিয়ে দিলেন; মেঘের শরীর আলোর কম্পন পেলে, ফটোগ্রাফের মেঘের মতো চোখের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল না। বর্ষার শেষরাত্রে সত্যিকার মেঘ যেভাবে দেখতে দেখতে হারিয়ে যায়, সকালের মধ্যে মিলিয়ে দেয় তার বাঁধা রূপ, ঠিক সেই ভাবের একটি গতি পেলে কবির রচনা। সকালে মেঘে একটু আলো পড়েছে এই ফটোগ্রাফটি দিলে না কবিতা; আলো মেঘ লতাপাতার গতিমান ছন্দে ধরা পড়ল শেষ বর্ষার চিরন্তন রস এবং মেঘলোকের লীলাহিল্লোল। রচনার মধ্যে এই যে রূপের রসের চলাচল গতাগতি, এই নিয়ে হল তফাত ঘটনার নোটিসের সঙ্গে রচনার প্রকৃতির। নোটিস সে নির্দেশ করেই থামল, রচনা চলে গেল গাইতে গাইতে হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে মনের থেকে মনের দিকে এক কাল থেকে আর এক কালে বিচিত্রভাবে। কবিতায় বা ছবিতে এইভাবে চলায়মান রঙ রেখা রূপ ও ভাব দিয়ে যে রচনা তাকে আলঙ্কারিকেরা গতিচিত্র বলেন— অর্থাৎ গতিচিত্রে রূপ বা ভাব কোন বস্তুবিশেষের অঙ্গবিন্যাস বা রূপসংস্থানকে অবলম্বন করে দাঁড়িয়ে থাকে না কিন্তু রেখার রঙের ও ভাবের গতাগতি দিয়ে রসের সজীবতা প্রাপ্ত হয়ে আসা-যাওয়া করে। বীণার দুই দিকে বাঁধা টানা তারগুলি সোজা লাইনের মতো অবিচিত্র নির্জীব আছে— বলছেও না চলছেও না। সুর এই টানা তারের মধ্যে গতাগতি আরম্ভ করলে অমনি নিশ্চল তার চঞ্চল হল গীতের ছন্দে, ভাবের দ্বারা সজীব হল, গান গাইতে লাগল, নাচতে থাকল তালে তালে। পর্দায় পর্দায় খুলে গেল সুরের অসংখ্য পাপড়ি, সোজা anatomyর টানা পাঁচিল ভেঙে বার হল সুরের সুরধুনী-ধারা, নানা ভঙ্গিতে গতিমান। আকাশ এবং মাটি এরি দুই টানের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষের anatomy-দোরস্ত শরীর। দুই খোঁটায় বাঁধা তারের মতো, এই হল ডাক্তারি anatomyর সঠিক রূপ। আর বাতাসের স্পর্শে আলোর আঘাতে গাছ-ফুল-পাতা-লতা এরা লতিয়ে যাচ্ছে ছড়িয়ে যাচ্ছে শাখা-প্রশাখার আঁকা-বাঁকা নানা ছন্দের ধারায়; এই হচ্ছে artistic anatomyr সঠিক চেহারা। আর্টিস্ট রসের সম্পদ নিয়ে ঐশ্বর্যবান, কাজেই রস বন্টনের বেলায় রসপাত্রের জন্য তাকে খুঁজে বেড়াতে হয় না কুমোরটুলি, সে রসের সঙ্গে রসপাত্রটাও সৃষ্টি করে ধরে দেয় ছোট বড় নানা আকারে ইচ্ছামতো। এই পাত্রসমস্যা শুধু যে ছবি লিখছে তাকেই যে পূরণ করতে হয় তা নয়, রসের পাত্র-পাত্রীর anatomy নিয়ে গণ্ডগোল রঙ্গমঞ্চে খুব বেশি রকম উপস্থিত হয়। নানা পৌরাণিক ও কাল্পনিক সমস্ত দেবতা উপদেবতা পশুপক্ষী যা রয়েছে তার anatomy ও model বাস্তব জগৎ থেকে নিলে তো চলে না। হরেরামপুরের সত্যি রাজার anatomy রাজশরীর হলেও রঙ্গমঞ্চের রাজা হবার কাজে যে লাগে তা নয়, একটা মুটের মধ্যে হয়তো রাম রাজার রসটি ফোটাবার উপযুক্ত anatomy খুঁজে পাওয়া যায়। নারীর anatomy হয়তো সীতা সাজবার কালে লাগল না, একজন ছেলের anatomy দিয়ে দৃশ্যটার মধ্যে উপযুক্ত রসের উপযুক্ত পাত্রটি ধরে দেওয়া গেল। পাখির কি বানরের কি নারদের ও দেবদেবীর ভাব ভঙ্গি চলন বলন প্রভৃতির পক্ষে যেরকম শরীরগঠন উপযুক্ত বোধ হল অধিকারী সেই হিসেবে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন বা সজ্জিত করে নিলে;— যেখানে আসল মানুষের উচ্চতা রচয়িতার ভাবনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলে না সেখানে রণ্পা দিয়ে anatomical মাপ বাড়িয়ে নিতে হল, যেখানে আসল দু’হাতের মানুষ কাজে এল না সেখানে গড়া হাত গড়া ডানা ইত্যাদি নানা খুঁটিনাটি ভাঙাচোরা দিয়ে নানা রসের পাত্র-পাত্রী সৃষ্টি করতে হল বেশ-কারকে,— রচয়িতার রচনার সঙ্গে অভিনেতার রূপের সামঞ্জস্য এইভাবে লাভ করতে হল নাটকে! কল্পনামূলক যা তাকে প্রকৃত ঘটনার নিয়মে গাঁথা চলে না, আর ঘটনামূলক নাটক সেখানেও একেবারে পাত্র-পাত্রীর সঠিক চেহারাটি নিয়ে কাজ চলে না, কেননা যে ভাব যে রস ধরতে চেয়েছেন রচয়িতা, তা রচয়িতার কল্পিত পাত্র-পাত্রীর চেহারার সঙ্গে যতটা পারা যায় মেলাতে হয় বেশ-কারকে। এক-একজন বেশ সুঠাম সুশ্রী, পাঠও করতে পারলে বেশ, কিন্তু তবু নাটকের নায়ক-বিশেষের পার্ট তাকে দেওয়া গেল না, কেননা সেখানে নাটক-রচয়িতার কল্পিতের সঙ্গে বিশ্ব-রচয়িতার কল্পিত মানুষটির anatomy গঠন ইত্যাদি মিলল না। ছবিতেও তেমনি কবিতাতেও তেমনি, ভাবের ছাঁদ অনেক সময়ে মানুষের কি আর কিছুর বাস্তব ও বাঁধা ছাঁদ দিয়ে পুরোপুরিভাবে প্রকাশ করা যায় না, অদল-বদল ঘটাতেই হয়, কতখানি অদল-বদল সয় তা আর্টিস্ট যে রসমূর্তি রচনা করছে সেই ভাল বুঝবে আর কেউ তো নয়। চোখে দেখছি যে মানুষ, যেসব গাছপালা নদ-নদী পাহাড়-পর্বত আকাশ— এরি উপরে আলো-আঁধার ভাব-ভঙ্গি দিয়ে বিচিত্র রস সৃজন করে চললেন যাঁর আমরা রচনা তিনি, আর এই যে নানা রেখা নানা রঙ নানা ছন্দ নানা সুর এদেরই উপরে প্রতিষ্ঠিত করলে মানুষ নিজের কল্পিতটি। মানুষ বিশ্বের আকৃতির প্রতিকৃতি নিজের রচনায় বর্জন করলে বটে, কিন্তু প্রকৃতিটি ধরলে অপূর্ব কৌশলে যার দ্বারা রচনা দ্বিতীয় একটা সৃষ্টির সমান হয়ে উঠল। এই যে অপূর্ব কৌশল যার দ্বারা মানুষের রচনা মুক্তিলাভ করে ঘটিত জগতের ঘটনা সমস্ত থেকে, এটা কিছুতে লাভ করতে পারে না সেই মানুষ যে এই বিশ্বজোড়া রূপের মূর্ত দিকটার খবরই নিয়ে চলেছে, রসের অমূর্ততা মূর্তকে যেখানে মুক্ত করছে সেখানের কোন সন্ধান নিচ্ছে না, শুধু ফটোযন্ত্রের মতো আকার ধরেই রয়েছে, ছবি ওঠাচ্ছে মাত্র ছবি ফোটাচ্ছে না। মানুষের মধ্যে কতক আছে মায়াবাদী কতক কায়াবাদী; এদের মধ্যে বাদ-বিসংবাদ লেগেই আছে। একজন বলছে, কায়ার উপযুক্ত পরিমাণ হোক ছায়া-মায়া সমস্তই, আর-একজন বলছে তা কেন, কায়া যখন ছায়া ফেলে সেটা কি খাপে খাপে মেলে শরীরটার সঙ্গে, না নীল আকাশ রঙের মায়ায় যখন ভরপুর হয় তখন সে থাকে নীল, বনের শিয়রে যখন চাঁদনী মায়াজাল বিস্তার করলে তখন বনের হাড়হদ্দ সব উড়ে গিয়ে শুধু যে দেখ ছায়া, তার কি জবাব দেবে? মায়াকে ধরে রেখেছে কায়া, কায়াকে ঘিরে রয়েছে মায়া; কায়া অতিক্রম করছে মায়া দিয়ে আপনার বাঁধা রূপ, মায়া সে নিরূপিত করছে উপযুক্ত কায়া দ্বারা নিজকে। জাগতিক ব্যাপারে এটা নিত্য ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। জগৎ শুধূ মায়া কি শুধু কায়া নিয়ে চলছে না, এই দুইয়ের সমন্বয় চলেছে; তাই বিশ্বের ছবি এমন চমৎকারভাবে আর্টিস্টের মনটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে! এইযে সমন্বয়ের সূত্রে গাঁথা কায়া-মায়া ফুল আর তার রঙের মতো শোভা পাচ্ছে— anatomyর artistic ও inartistic সব রহস্য এরি মধ্যে লুকোনো আছে। রূপ পাচ্ছে রসের দ্বারা অনির্বচনীয়তা, রস হচ্ছে অনির্বচনীয় যথোপযুক্ত রূপ পেয়ে, রূপ পাচ্ছে প্রসার রসের, রস পাচ্ছে প্রসার রূপের, এই একে-একে মিলনে হচ্ছে দ্বিতীয় সৃজন আর্টে, তারপর সুর, ছব্দ, বর্ণিকাভঙ্গ ইত্যাদি তৃতীয় এসে তাকে করে তুলেছে বিচিত্র ও গতিমান ওদিকে এক রচয়িতা এদিকে এক রচয়িতা, মাঝে রয়েছে নানা রকমের বাঁধা রূপ; সেগুলো দুদিকের রঙ্গ-রসের পাত্র-পাত্রী হয়ে চলেছে— বেশ বদলে বদলে ঠাট বদলে বদলে— অভিনয় করছে নাচছে গাইছে হাসছে কাঁদছে চলাফেরা করছে! রচকের অধিকার আছে রূপকে ভাঙতে রসের ছাঁদে। কেননা রসের খাতিরে রূপের পরিবর্তন প্রকৃতির একটা সাধারণ নিয়ম, দিন চলেছে রাত চলেছে জগৎ চলেছে রূপান্তরিত হতে হতে, ঋতুতে ঋতুতে রসের প্রেরণাটি চলেছে গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত রূপের নিয়ম বদলাতে বদলাতে পাতায় পাতায় ফুলে ফলে ডালে ডালে! শুধূ এই নয়, যখন রস ভরে উঠল তখন এতখানি বিস্তীর্ণ পাত্রেও রস ধরল না— গন্ধ হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল রস, রঙে রঙে ভরে দিলে চোখ, উথলে পড়ল রস মধুকরের ভিক্ষাপাত্রে, এই যে রসজ্ঞানের দাবি এ সত্য দাবি, সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে স্পর্ধার দাবি নয়, সত্যাগ্রহীর দাবি। ডাক্তারের দাবি ঐতিহাসিকের দাবি সাধারণ মানুষের দাবি নিয়ে একে তো অমান্য করে চলে না। আর্টিস্ট যখন কিছুকে যা থেকে তাতে রূপান্তরিত করলে তখন সে যা-তা করলে তা নয়, সে প্রকৃতির নিয়মকে অতিক্রম করলে না, উল্টে বরং বিশ্বপ্রকৃতিতে রূপমুক্তির নিয়মকে স্বীকার করলে, প্রমাণ করে চলল হাতে কলমে। আর যে মাটিতেই হোক বা তেল রঙেতেই হোক রূপের ঠিক-ঠিক নকল করে চলল, সে আঙুরই গড়ুক বা আমই গড়ুক ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু সে দিয়ে যেতে পারলে না, সে অভিশপ্ত হল, কেননা সে বিশ্বের চলাচলের নিয়মকে স্বীকার করলে না প্রমাণও করলে না কোন কিছু দিয়ে, অলঙ্কারশাস্ত্র মতো তার কাজ পুনরাবৃত্তি এবং ভ্রান্তিমৎ দোষে দুষ্ট হল। রক্ত চলাচলের খাদ্য চলাচলের পক্ষে যে ভৌতিক শরীর-গঠন অস্হিসংস্হান তার মধ্যে রসাধার আর-একটি জিনিস আছে যার anatomy ডাক্তার খুঁজে পায়নি এ পর্যন্ত। বাইরের শরীর আমাদের বাঁধা ছাঁচে ঢালা আর অন্তর্দেহটি ছাঁচে ঢালা একেবারেই নয় সুতরাং সে স্বাধীনভাবে রসের সম্পর্কে আসে, এ যেন এতটুকু খাঁচায় ধরা এমন একটি পাখি যার রসমূর্তি বিরাটের সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে, রচনাতীত সুর বর্ণনাতীত বর্ণ তার। এই পাখির মালিক হয়ে এসেছে কেবল মানুষ আর কোনো জীব নয়। বাস্তব জগৎ যেখানে সীমা টানলে রূপের লীলা শেষ করলে সুর থামালে আপনার, সেইখানে মানুষের খাঁচায় ধরা এই মানস পাখি সুর ধরলে, নতুনরূপে ধরে আনলে অরূপের রূপ— জগৎ সংসার নতুন দিকে পা বাড়ালে তবেই মুক্তির আনন্দে। মানুষ তার স্বপ্ন দিয়ে নিজেকেই যে শুধু মুক্তি দিচ্ছে তা নয় যাকে দর্শন করছে যাকে বর্ণন করছে তার জন্যে মুক্তি আনছে। আটঘাট-বাঁধা বীণা আপনাকে ছাড়িয়ে চলেছে এই স্বপ্নে, সুরের মধ্যে গিয়ে বাঁশি তার গাঁঠে-গাঁঠে-বাঁধা ঠাট ছাড়িয়ে বার হচ্ছে, এই স্বপ্নের দুয়ার দিয়ে ছবি অতিক্রম করেছে ছাপকে, এই পথে বিশ্বের হৃদয় দিয়ে মিলছে বিশ্বরূপের হৃদয়ে, এই স্বপ্নের পথ। বীণার সেই anatomyটাই বীণার সত্য anatomy, এ সত্য আর্টিস্টমাত্রকেই গ্রহণ করতে হয় আর্টের জগতে ঢোকার আগেই, না হলে সচরাচরকে ছাড়িয়ে সে উঠতে ভয় পায়। পড়া পাখি যা শুনলে তারই পুনরাবৃত্তি করতে থাকল, রচয়িতার দাবি সে গ্রহণ করতে পারলে কি? মানুষ যা দেখলে তাই এঁকে চলল, রচয়িতার দাবি নিতে পারলে কি সে? নিয়তির নিয়মে যারা ফুল পাতার সাজে সেজে এল, রঙিন ডানা মেলে নেচে চলল গেয়ে চলল, তারা কেউ এই বিশ্বসংসারের রচয়িতার দাবি নিতে পারলে না, এক যারা স্বপন দেখলে স্বপন ধরলে সেই আর্টিস্টরা ছাড়া। পাখি পারলে না রচয়িতার দাবি নিতে কিন্তু আকাশের পাখিকে ধরার ফাঁদ ষে মানুষ রচনা করলে মাটিতে বসে সে এ দাবি গ্রহণ করলে, নিয়তিকৃত নিয়ম রহিতের নিয়ম যারা পদে পদে প্রমাণ করে চলল নিজেদের সমস্ত রচনায়, তারাই দাবি দিতে পারলে রচয়িতার। কবীর তাই বললেন—“ভরম জঞ্জাল দুখ ধন্দ ভারি”— ভ্রান্তির জঞ্জাল দূর করো, তাতে দুঃখ ও দীনতা আর ঘোর সংশয়: “সত্ত দাবী গহো আপ নির্ভয় রহো”— তোমার যে সত্য দাবি তাই গ্রহণ করো, নির্ভয় হও। যে মানুষ রচয়িতার সত্য দাবি নেয়নি কিন্তু স্বপন দেখলে ওড়বার, সে নিজের কাঁধে পাখির ডানা লাগিয়ে উড়তে গেল, পরীর মতো দেখতে হল বটে সে, কিন্তু পরচুলো তার বাতাস কাটলে না, ঝূপ করে পড়ে মরল সে; কিন্তু যে রচয়িতার সত্য দাবি গ্রহণ করলে তার রচনা মাধ্যাকর্ষণের টান ছাড়িয়ে উড়ল তাকে নিয়ে লোহার ডানা বিস্তার করে আকাশে। মানুষ জলে হাঁটবার স্বপন দেখলে, রচয়িতার দাবি গ্রহণ করলে না— ডুবে মরল দু’পা না যেতে, রচয়িতার রচনা পায়ের মতো একেবারেই দেখতে হল না কিন্তু গুরুভাবের দ্বারা সে জলের লঘুতাকে জয় করে স্রোতের বাধাকে তুচ্ছ করে চলে গেল সাত সমুদ্র পার। মানুষ নিমেষে তেপান্তর মাঠ পার হবার স্বপন দেখলে, রচয়িতার দাবি নিতে পারলে না, খানিক পথে দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত হল তার anatomy-দোরস্ত শরীর, তৃষ্ণায় বুক ফেটে মরল সে হরিণের মতো, ঘোড়াও দৌড় অবলম্বন করে যতটা যেতে চায় নির্বিঘ্নে তা পারলে না, রণক্ষেত্রে ঘোড়া মায় সওয়ার পড়ে মরল! রচয়িতা নিয়ে এল লোহার পক্ষীরাজ ঘোড়া— যেটা ঘোড়ার মতো একেবারেই নয় হাড়হদ্দ কোনো দিক দিয়ে,— সৃজন করে উঠে বসল, আপন পর সবাইকে নিয়ে নিমেষে ঘুরে এল যোজন বিস্তীর্ণ পৃথিবী নির্ভয়ে! যা নিয়তির নিয়মে কোথাও নেই তাই হল, জলে শিলা ভাসল আকাশে মানুষ উড়ল, ঘুমোতে ঘূমোতে পৃথিবী ঘুরে এল রচনায় চড়ে মানুষ! প্রকৃতির নিয়মের বিপরীত আচরণে দোষ এখানে তো আমাদের চোখে পড়ে না। মানুষ যখন আয়নার সামনে বসে চুল ছাঁটে, টেরি বাগায়, ছিটের সার্টে বাঙলা anatomyর সৌন্দর্য ঢেকে সাহেবী ঢঙে ভেঙে নেয় নিজের দেহ, কাজল টেনে চোখের টান বাড়িয়ে প্রেয়সী দেখা দিলে বলে বাহবা,— চুলের খোঁপার ঘোরপেঁচ দেখে বাঁধা পড়ে— নিজের কোনো সমালোচনা যে মানে না তার কাছে, তখন সে ছবির সামনে এসে anatomyর কথা পাড়ে কেন সে আমার কাছে এক প্রকান্ড রহস্য!
ঈজিপ্টের লোক এককালে সত্যিই বিশ্বাস করত যে, জীবন কায়া ছেড়ে চলে যায় আবার কিছু দিন পরে সন্ধান করে করে নিজের ছেড়ে ফেলা কামিজের মতো কায়াতেই এসে ঢোকে। এইজন্যে কায়ার মায়া তারা কিছুতে ছাড়তে পারেনি, ভৌতিক শরীরকে ধরে রাখার উপায় সমস্ত আবিষ্কার করেছিল, একদল কারিগরই তৈরি হয়েছিল ঈজিপ্টে, যারা ‘কা’ প্রস্তুত করতো; তাদের কাজই ছিল যেমন মানুষ ঠিক সেই গড়নে পুত্তলিকা প্রস্তুত করা, গোরের মধ্যে ধরে রাখার জন্য; ঠিক এইসব ‘কা’-নির্মাতাদের পাশে বসে ঈজিপ্টের একদল রচয়িতা artistic anatomy বৃহত্ত ও অন্যথা-বৃত্ত দিয়ে পুত্তলিকা বা ‘কা’-নির্মাতাদের ঠিক বিপরীত রাস্তা ধরে গড়েছিল কত কি তার ঠিক নেই, দেবতা মানুষ পশু পক্ষী সবার anatomy ভেঙে-চুরে তারা নতুন মূর্তি দিয়ে অমরত্বের সিংহাসনে বসিয়ে গেল। ঈজিপ্টের এই ঘটনা হাজার হাজার বৎসর আগে ঘটেছিল; কায়া নির্মাতা কারিগর ও ছায়া-মায়ার জাদুকর দুই দলই গড়লে কিন্তু একজনের ভাগ্যে পড়ল মূর্ত--
যা-কিছু তাই, আর-একজনের পাত্রে ঝরল অমূর্ত রস স্বর্গ থেকে,— এ নিয়মের ব্যতিক্রম কোনো যুগের আর্টের ইতিহাসে হয়নি হবার নয়। ঈজিপ্ট তো দূরে, পাঁচ হাজার দশ হাজার বছর আরো দূরে, এই আজকের আমাদের মধ্যে যা ঘটছে, তাই দেখ না কেন; যারা ছাপ নিয়ে চলেছে মর্ত্য জগতের রূপ সমস্তের, তারা মূর্ত জিনিস এত পাচ্ছে দেখে সময়ে সময়ে আমারও লোভ হয়,— টাকা পাচ্ছে হাততালি পাচ্ছে অহংকে খুব বেশি করে পাচ্ছে। আর এরূপ যারা করছে না তারা শুধু আঁকা-বাঁকা ছন্দের আনন্দটুকু, ঝিলিমিলি রঙের সুরটুকু বুকের মধ্যে জমা করছে, লোহার সিন্দুক কিন্তু রয়েছে খালি; বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেই কালে কালে খুব আদবু করে আর্টিস্টদের যা সম্ভাষণ করেছে তা উর্দুতে বলতে গেলে বলতে হয়— খেয়ালী, হিন্দীতে— বাউর বা বাউল, আর সবচেয়ে মিষ্টি হল বাঙলা— পাগল। কিন্তু এই পাগল তো জগতে একটি নেই, উপস্থিত দশ বিশ লক্ষ কিংবা তারও চেয়ে হয়তো বেশি এবং অনুপস্হিত ভবিষ্যতের সব পাগলের সর্দার হয়ে যে রাজত্ব করছে, উল্কার মতো জ্যোতির্ময় সৃষ্টি রচনা সমস্ত সে ছড়িয়ে দিয়ে চলেছে পথে-বিপথে সৃজনের উৎসব করতে করতে। এমন যে খেয়ালের বাউল, জগতের আগত অনাগত সমস্ত খেয়ালী বা আর্টিস্ট হল তার চেলা, তারা পথ চলতে ঢেলাই হোক মাণিকই হোক যাই কুড়িয়ে পেলে অমনি সেটাকে যে খুব বুদ্ধিমানের মতো ঝুলিতে লুকিয়ে রাতারাতি আলো-আঁধারের ভ্রান্তি ধরে চোখে ধুলো দিয়ে বাজারে বেচে এল তা নয়— মাটির ঢেলাকে এমন করে ছেড়ে দিলে যে সেটা উড়ে এসে যখন হাতে পড়ল
তখন দেখি সোনার চেয়ে সেটা মূল্যবান, আসল ফুলের চেয়ে হয়ে গেছে সুন্দর! বাঙলায় আমাদের মনে আর্টের মধ্যে অস্হিবিদ্যার কোনখানে স্হান, এই প্রশ্নটা ওঠবার কয়েক শত বৎসর আগে এই পাগলের দলের একজন আর্টিস্ট এসেছিল। সে জেগে বসে স্বপন দেখলে— যত মেয়ে শ্বশুর ঘরে রয়েছে আসতে পারছে না বাপের বাড়ি, একটা মূর্তিতে সেই সবারই রূপ ফুটিয়ে যাবে! আর্টিস্ট সে বসে গেল কাদা মাটি খড় বাঁশ রং তুলি নিয়ে, দেখতে দেখতে মাটির প্রতিমা সোনার কমল হয়ে ফুটে উঠল দশ দিকে সোনার পাপড়ি মেলে! এ মূর্তি বাঙলার ঘরে ঘরে দেখবে দু’দিন পরে, কিন্তু এরও উপরে ডাক্তারিশাস্ত্রের হাত কিছু কিছু পড়তে আরম্ভ হয়েছে শহরে। বাঙলার কোনোণৌ অজ্ঞাত পল্লীতে এই মূর্তির মূল ছাঁদ যদি খোঁজ তো দেখবে— তার সমস্তটা artistic anatomyর নিয়মের দ্বারায় নিয়তির নিয়ম অতিক্রম করে শোভা পাচ্ছে ব্যতিক্রম ও অতিক্রমের সিংহাসনে।
টীকা
১. ৪র্থ শ্লোক, পূর্বমেঘ— মেঘদূতম্ (কালিদাসের গ্রন্থাবলী, ২য় ভাগ)
কিছুর নোটিস যে দিচ্ছে, ঘটনা যেমন ঘটেছে তার সঠিক রূপটির প্রতিচ্ছায়া দেওয়া ছাড়া সে বেচারা অনন্যগতি; সে যদি ভাবে সে একটা কিছু রচনা করছে তো সেটা তার মস্ত ভ্রম। ডুবুরি সমুদ্রের তলা ঘেঁটে মুক্তার শুক্তি তুলে আনে, খুবই সুচতর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার, কিন্তু সে কি বলাতে পারে আপনাকে মুক্তাহারের রচয়িতা, না, যে পাহাড় পর্বত দেশে বিদেশে ঘুরে ফটোগ্রাফ তুলে আনছে সে নিজেকে চিত্রকর বলে চালিয়ে দিতে পারে আর্টিস্ট মহলে? একটুখানি বুদ্ধি থাকলেই আর্টের ইতিহাস লেখা চলে, কিন্তু যে জিনিসগুলো নিয়ে আর্টের ইতিহাস তার রচয়িতা ইতিহাসবেত্তা নয় রসবেত্তা— নেপোলিয়ান বীররসের আর্টিস্ট, তার হাতে ইউরোপের ইতিহাস সৃষ্ট হল, সীজার আর্টিস্ট গড়লে রোমের ইতিহাস। যে ড়ুবে তোলে সে তোলে মাত্র বুদ্ধিবলে; আর যে গড়ে তোলে সে ভাঙাকে জোড়া লাগায় না শুধু, সে বেজোড় সামগ্রীও রচনা করে চলে মন থেকে। ইতিহাসের ঘটনাগুলো পাথরের মতো সুনির্দিষ্ট শক্ত জিনিস, একচুল তার চেহারার অদলবদল করার স্বাধীনতা নেই ঐতিহাসিকের, আর ঔপন্যাসিক কবি শিরী এঁদের হাতে পাষাণও রসের দ্বারা সিক্ত হয়ে কাদার মতো নরম হয়ে যায়, রচয়িতা তাকে যথা ইচ্ছা রূপ দিয়ে ছেড়ে দেন। ঘটনার অপলাপ ঐতিহাসিকের কাছে দুর্ঘটনা, কিন্তু আর্টিস্টের কাছে সেটা বড় সুঘটন বা সুগঠনের পক্ষে মস্ত সুযোগ উপস্থিত করে দেয়। ঠিকে যদি ভুল হয়ে যায় তবে অঙ্কটাই ভুল হয়; অঙ্কনের বেলাতেও ঠিক ওই কথা। কিন্তু পাটীগণিতের ঠিক আর খাঁটি গুণীদের ঠিকের প্রথা স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র;— নামতা ঠিক রইল তো অঙ্ককর্তা বললেন, ঠিক হয়েছে, কিন্তু নামেই ছবিটা ঠিক মানুষ হল কি গরু গাধা বা আর-কিছু হল, রসের ঠিকানা হল না ছবির মধ্যে, অঙ্কনকর্তা বলে বসলেন, ভুল! ঐতিহাসিকের কারবার নিছক ঘটনাটি নিয়ে, ডাক্তারের কারবার নিখুঁত হাড়মাসের anatomy নিয়ে, আর আর্টিস্টদের কারবার অনির্বচনীয় অখণ্ড রসটি নিয়। আর্টিস্টদের কাছে ঘটনার ছাঁচ পায় না রস, রসের ছাঁদ পেয়ে বদলে যায় ঘটনা, হাড়মাসের ছাঁচে পায় না শিল্পীর মানস কিন্তু মানসের ছাদ অনুসারে গড়ে ওঠে সমস্ত ছবিটার হাড়হদ্দ, ভিতর বাহির। একটা গাছের বীজ, সে তার নিজের আকৃতি ও প্রকৃতি যেমনটি পেয়েছে সেইভাবেই যখন হাতে পড়ল, তখন সে গোলাকার কি চেপ্টা ইত্যাদি, কিন্তু সে থলি থেকে মাটিতে পড়েই রসের সঞ্চার নিজের মধ্যে যেমনি অনুভব করলে অমনি বদলে চলল নিজের আকৃতি প্রকৃতি সমস্তই; যার বাহু ছিল না চোখ ছিল না, যে লুকিয়ে ছিল মাটির তলায় নীরস কঠিন বীজকোষে বদ্ধ হয়ে, সে উঠল মাটি ঠেলে, মেলিয়ে দিলে হাজার হাজার চোখ আর হাত আলোর দিকে আকাশের দিকে বাতাসের উপরে, নতুন শরীর নতুন ভঙ্গি লাভ করলে সে রসের প্রেরণায়, গোলাকার বীজ ছত্রাকার গাছ হয়ে শোভা পেলে, বীজের anatomy লুকিয়ে পড়ল ফুলের রেণুতে পাকা ফলের শোভার আড়ালে। বীজের হাড়হদ্দ ভেঙে তার anatomy চুরমার করে বেরিয়ে এল গাছের ছবি বীজকে ছাড়িয়ে। গাছ যে রচলে তার রচনায় ছাঁদ ও anatomyর দোষ দেবার সাহস কারু হল না, উল্টে বরং কোনো কোনো মানুষ তারই রচনা চুরি করে গাছপালা আঁকতে বসে গেল— বীজতত্ত্বের বইখানার মধ্যে ফেলে রেখে দিলে যে অস্থিপঞ্জরের মতো শক্ত পিঞ্জরে বদ্ধ ছিল বীজের প্রাণ তার প্রকৃত anatomyর হিসেব। বীজের anatomy দিয়ে গাছের anatomy বিচার করতে যাওয়া, আর মানুষী মূর্তির anatomy দিয়ে মানস মূর্তির anatomyর দোষ ধরতে যাওয়া সমান মূর্খতা। Anatomyর একটা অচল দিকে আছে, যেটা নিয়ে এক রূপের সঙ্গে আর এক রূপের সুনির্দিষ্ট ভেদ, কিন্তু anatomyর একটা সচল দিকও আছে সেটা নিয়ে মানুষে মানুষে বা একইজাতের গাছে গাছে ও জীবে জীবে বাঁধা পার্থক্য একটুখানি ভাঙে— কোনো মানুষ হয় তালগাছের মতো, কেউ হয় ভাঁটার মতো, কোনো গাছ ছড়ায় ময়ুরের মতো পাখা, কেউ বাড়ায় ভূতের মতো হাত! প্রকৃতি-বিজ্ঞানের বইখানাতে দেখবে মেঘের সুনির্দিষ্ট গোটাকতক গড়নের ছবি দেওয়া আছে— বৃষ্টির মেঘ, ঝড়ের মেঘ— সবার বাঁধা গঠন কিন্তু মেঘে যখন বাতাস লাগল রস ভরল তখন শাস্ত্র-ছাড়া সৃষ্টি-ছাড়া মূর্তি সব ফুটতে থাকল, মেঘে মেঘে রঙ লাগল অদ্ভুত অদ্ভুত, সাদা ধোঁয়া ধুমধাম করে সেজে এল লাল নীল হলদে সবুজ বিচিত্র সাজে, দশ অবতারের রঙ ও মূর্তিকে ছাড়িয়ে দশ সহস্র অবতার! সচিত্র প্রকৃতি-বিজ্ঞানের পুঁথি খুলে সে সময় কোন রসিক চেয়ে দেখে মেঘের রূপগুলোর দিকে? এই যে মেঘের গতিবিধির মতো সচল সজল anatomy, একেই বলা হয় artistic anatomy, যার দ্বারায় রচয়িতা রসের আধারকে রসের উপযুক্ত মান পরিমাণ দিয়ে থাকেন। মানুষের তৃষ্ণা ভাঙতে যতটুকু জল দরকার তার পরিমাণ বুঝে জলের ঘটি একরকম হল, মানুষের স্নান করে শীতল হতে যতটা জল দরকার তার হিসেবে প্রস্তুত হল ঘড়া জালা ইত্যাদি; সুতরাং রসের বশে হল আধারের মান পরিমাণ আকৃতি পর্যন্ত। যার কোনো রসজ্ঞান নেই সেই শুধু দেখে পানীয় জলের ঠিক আধারটি হচ্ছে চৌকোণো পুকুর, ফটিকের গেলাস নয়, সোনার ঘটিও নয়। গোয়ালের গরু হয়তো দেখে পুকুরকে তার পানীয় জলের ঠিক আধার, কিন্তু সে যদি মানুষকে এসে বলে, ‘তোমার গঠন সম্বন্ধে মোটেই জ্ঞান নেই, কেননা জলাধার তুমি এমন ভুল রকমে গড়েছ যে পুকুরের সঙ্গে মিলছেই না’, তবে মানুষ কি জবাব দেয়?
ঐতিহাসিকের মাপকাঠি ঘটনামূলক, ডাক্তারের মাপকাঠি কায়ামূলক, আর রচয়িতা যারা তাদের মাপকাঠি অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়ামূলক। ঐতিহাসিককে রচনা করতে হয় না, তাই তার মাপকাঠি ঘটনাকে চুল চিরে ভাগ করে দেখিয়ে দেয়,ডাক্তারকেও জীবন্ত মানুষ রচনা করতে হয় না, কাজেই জীবন্মৃত ও মৃত মানুষের শবচ্ছেদ করার কাজের জন্য চলে তার মাপকাঠি, আর রচয়িতাকে অনেক সময় অবস্তুকে বস্তুজগতে, স্বপ্নকে জাগরণের মধ্যে টেনে আনতে হয়, রূপকে রসে, রসকে রূপে পরিণত করতে হয়, কাজেই তার হাতের মাপকাঠি সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের, রূপকথার সোনার রূপোর কাটির মতো অদ্ভুত শক্তিমান। ঘটনা যাকে কুড়িয়ে ও খুঁড়ে তুলতে হয়, ঠিক ঠিক খোন্তা হল তার পক্ষে মহাস্ত্র, মানুষের ভৌতিক শরীরটার কারখানা নিয়ে যখন কারবার, ঠিক ঠিক মাংসপেশী অস্থিপঞ্জর ইত্যাদির ব্যবচ্ছেদ করার শূল ও শলাকা ইত্যাদি হল তখন মৃত্যুবাণ, কিন্তু রচনা প্রকাশ হবার আগেই এমন একটি জায়গার সৃষ্টি হয়ে বসে যে সেখানে কোদাল, কুড়ুল, শূল, শাল কিছু চলে না, রচয়িতার নিজের অস্থিপঞ্জর এবং ঘটাকাশের ঘটনাসমস্ত থেকে অনেক দূরে রচয়িতার সেই মনোজগৎ বা পটাকাশ যেখানে ছবি ঘনিয়ে আসে মেঘের মতো, রস ফেনিয়ে ওঠে, রঙ ছাপিয়ে পড়ে আপনা আপনি। সেই সমস্ত রসের ও রূপের ছিটেফোঁটা যথোপযুক্ত পাত্র বানিয়ে ধরে দেয় রচয়িতা আমাদের জন্যে। এখন রচয়িতা রস বুঝে রসের পাত্র নির্বাচন করে যখন দিচ্ছে তখন রসের সঙ্গে রসের পাত্রটাও স্বীকার না করে যদি নিজের মনোমতো পাত্রের রসটা ঢেলে নিতে যাই তবে কি ফল হবে? ধর, রৌদ্ররসকে একটা নবতাল বা দশতাল মূর্তির আধার গড়ে ধরে আনলেন রচয়িতা, পাত্র ও তার অন্তর্নিহিত রসের চমৎকার সামঞ্জস্য দিয়ে, এখন সেই রচয়িতার আধারকে ভেঙে রৌদ্ররস যদি মুঠোম হাত পরিমিত anatomy-দোরস্ত আমার একটা ফটোগ্রাফের মধ্যে ধরবার ইচ্ছে করি তো রৌদ্র হয় করুণ নয় হাস্য রসে পরিণত না হয়ে যাবে না; কিংবা ছোট মাপের পাত্রে না ঢুকে রসটা মাটি হবে মাটিতে পড়ে।
হারমোনিয়ামের anatomy, বীণার anatomy, বাঁশির anatomy রকম রকম বলেই সুরও ধরে রকম রকম; তেমনি আকারের বিচিত্রতা দিয়েই রসের বিচিত্রতা বাহিত হয় আর্টের জগতে, আকারের মধ্যে নির্দিষ্টতা সেখানে কিছুই নেই। হাড়ের পঞ্জরের মধ্যে মাংসপেশী দিয়ে বাঁধা আমাদের এতটুকু বুক, প্রকাণ্ড সুখ প্রকাণ্ড দুঃখ প্রকাণ্ড ভয় এতটুকু পাত্রে ধরা মুশকিল। হঠাৎ এক-এক সময়ে বুকটা অতিরিক্ত রসের ধাক্কায় ফেটে যায়; রসটা চাইলে বুককে অপরিমিত রকমে বাড়িয়ে দিতে, কিংবা দমিয়ে দিতে, আমাদের ছোট পিঁজ্রে হাড়ে আর তাঁতে নিরেট করে বাঁধা স্থিতি-স্থাপকতা কিংবা সচলতা তার নেই, অতিরিক্ত স্টিম পেয়ে বয়লারের মতো ফেটে চৌচির হয়ে গেল। রস বুকের মধ্যে এসে পাত্রটায় যে প্রসারণ বা আকুঞ্চন চাইলে, প্রকৃত মানুষের anatony সেটা দিতে পারলে না; কাজেই আর্টিস্ট যে, সে রসের ছাঁদে কমে বাড়ে ছন্দিত হয় এমন একটা সচল তরল anatomy সৃষ্টি করে নিলে যা অন্তর এবং বাইরে সুসঙ্গত ও সুসংহত। রসকে ধরবার উপযুক্ত জিনিস বিচিত্র রঙ ও রেখা-সমস্ত গাছের ডালের মতো, ফুলের বোঁটার মতো, পাতার ঝিলিমিলির মতো তারা জীবনরসে প্রাণবন্ত ও গতিশীল। ফটোগ্রাফারের ওখানে ছবিওঠে— সীসের টাইপ থেকে যেমন ছাপ ওঠে— ছবি ফোটে না। পারিজাতের মতো বাতাসে দাঁড়িয়ে আকাশে ফুল ফোটানো আর্টিস্টের কাজ, সুতরাং তার মন্ত্র মানুষের শরীরযন্ত্রের হিসেবের খাতার লেখার সঙ্গে এমনকি বাস্তব জগতের হাড়হদ্দের খবরের সঙ্গে মেলানো মুশকিল। অভ্রবিজ্ঞানের পুঁথিতে আবর্ত সম্বর্ত ইত্যাদি নামরূপ দিয়ে মেঘগুলো ধরা হয়েছে— কিন্তু কবিতা কি গান রচনার বেলা ওইসব পেঁচাল নামগুলো কি বেশি কাজে আসে? মেঘের ছবি আঁকার বেলাতেও ঠিক পুঁথিগত ঘোরপেঁচ এমনকি মেঘের নিজ মূর্তিগুলোর হুবহু ফটোগ্রাফও কাজে আসে না। রচিত
যা তার মধ্যে বসবাস করলেও রচয়িতা চায় নিজের রচনাকে। সোনার খাঁচার মধ্যে থাকলেও বনের পাখি সে যেমন চায় নিজের রচিত বাসাটি দেখতে, রচয়িতাও ঠিক তেমনি দেখতে চায় নিজের মনোগতটি গিয়ে বসল নিজের মনোমতো করে রচা রঙ রেখা ছন্দোবন্ধ ঘেরা সুন্দর বাসায়। কোকিল সে পরের বাসায় ডিম পাড়ে— নামজাদা মস্ত পাখি। কিন্তু বাবুই সে যে রচয়িতা, দেখতে এতটুকু কিন্তু বাসা বাঁধে বাতাসের কোলে— মস্ত বাসা। আমাদের সঙ্গীতে বাঁধা অনেকগুলো ঠাট আছে, যে লোকটা সেই ঠাটের মধ্যেই সুরকে বেঁধে রাখলে সে গানের রচয়িতা হল না, সে নামে রাজার মতো পূর্বপুরুষের রচিত রাজগীর ঠাটটা মাত্র বজায় রেখে চলল ভীরু, কিন্তু যে রাজত্ব পেয়েও রাজত্ব হারাবার ভয় রাখলে না, নতুন রাজত্ব জিতে নিতে চলল সেই সাহসীই হল রাজ্যের রচয়িতা বা রাজা এবং এই স্বাধীনচেতারাই হয় সুরের ওস্তাদ। সুর লাগাতে পারে তারাই যারা সুরের ঠাট মাত্র ধরে থাকে না, বেসুরকেও সুরে ফেলে।
মানুষের anatomyতেই যদি মানুষ বদ্ধ থাকত, দেবতাগুলোকে ডাকতে যেতে পারতো কে? কার জন্যে আসত নেমে স্বর্গ থেকে ইন্দ্ররথ, পুষ্পক রথে চড়িয়ে লঙ্কা থেকে কে আনত সীতাকে অযোধ্যায়? ভূমিষ্ঠ হয়েই শিশু আপনার anatomy ভাঙতে শুরু করলে, বানরের মতো পিঠের সোজা শিরদাঁড়াকে বাঁকিয়ে সে উঠে দাঁড়াল— দুই পায়ে ভর দিয়ে, গাছে গাছে ঝুলতে থাকল না। প্রথমেই যুদ্ধ হল মানুষের নিজের anatomyর সঙ্গে, সে তাকে আস্তে আস্তে বদলে নিলে আপনার চলন-বলনের উপযুক্ত করে। বীজের anatomy নাশ করে যেমন বার হল গাছ, তেমনি বানরের anatomy পরিত্যাগ করে মানুষের anatomy নিয়ে এল মানুষ; ঠিক এইভাবেই medical anatomy নাশ করে আর্টিস্ট আবিস্কার করলে artistic anatomy, যা রসের বশে কমে বাড়ে, আঁকে বাঁকে, প্রকৃতি সব জিনিসের মতো— গাছের ডালের মতো, বৃন্তের মতো, পাপড়ির মতো, মেঘের ঘটার মতো, জলের ধারার মতো। রসের বাধা জন্মায় যাতে এমন সব বস্তু কবিরা টেনে ফেলে দেন,— নিকঙ্কুশাঃ কবয়ঃ। লয়ে লয়ে না মিললে কবিতা হল না, একথা যার একটু কবিত্ব আছে সে বলবে না; তেমনি আকারে আকারে না মিললে ফটোগ্রাফ হল না বলতে পারি, কিন্তু ছবি হল না একথা বলা চলে না। ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান’ শুনতে বেশ লাগল, ‘ছেলেটি কার্তিকের মতো’ দেখতে বেশ লাগল, কিন্তু কবিতা লিখলেই কি কাশীদাসী সুর ধরতে হবে, না ছেলে আঁকতে হলেই পাড়ার আদুরে ছেলের anatomy কপি করলেই হবে? গণেশের মূর্তিটিতে আমাদের ঘরের ও পরের ছেলের anatomy যেমন করে ভাঙা হয়েছে তেমন আর কিছুতে নয়। হাতি ও মানুষের সমস্তখানি রূপ ও রেখার সামঞ্জস্যের মধ্য দিয়ে একটা নতুন anatomy পেয়ে এল, কাজেই সেটা আমাদের চক্ষে নাড়া দিচ্ছে না, কেননা সেটা ঘটনা নয়, রচনা। আরব্য উপন্যাসের উড়ন্ত সতরঞ্চির কল্পনা বাস্তব-জগতে উড়োজাহাজ দিয়ে সপ্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কি আমাদের কাছে নগণ্য হয়েছিল, না, অবাধ কল্পনার সঙ্গে গল্পের ঠাট মিলছে কিন্তু বিশ্বরচনার সঙ্গে মিলছে না দেখে গালগল্প রচনার বাদশাকে কেউ আমরা দুষেছি? প্রত্যেক রচনা তার নিজের anatomy নিয়ে প্রকাশ হয়; ঠাট বদলায় যেমন প্রত্যেক রাগ-রাগিণীর, তেমনি ছাঁদ বদলায় প্রত্যেক ছবির কবিতার রচনার বেলায়। ধর যদি এমন নিয়ম করা যায় যে কাশীদাসী ছন্দ ছাড়া কবিরা কোনো ছন্দে লিখতে পারবে না— যেমন আমরা চাচ্ছি ডাক্তারি anatomy ছাড়া ছবিতে আর কিছু চলবে না— তবে কাব্যজগতে ভাবের ও ছন্দের কি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়,— সুরের বদলে থাকে শুধু দেশজোড়া কাশি আর রচয়িতার বদলে থাকে কতকগুলি দাস। কাজেই কবিদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ‘কবয়ঃ নিরঙ্কুশাঃ’ বলে, কিন্তু বাস্তবজগৎ থেকে ছাড়া পেয়ে কবির মন উড়তে পারবে যথাসুখে যথাতথা, আর ছবি আটকে থাকবে ফটোগ্রাফারের বাক্সর মধ্যে— জালার মধ্যে বাঁধা আরব্য উপন্যাসের জিন্-পরীর মতো সুলেমানের সীলমোহর আঁটা চিরকালই এ কোনদেশী কথা ? ইউরোপ, যে চিরকাল বাস্তবের মধ্যে আর্টকে বাঁধতে চেয়েছে সে এখন সীলমোহর মায় জালা পর্যন্ত ভেঙে কি সঙ্গীতে, কি চিত্রে, ভাস্কর্যে, কবিতায়, সাহিত্যে বাঁধনের মুক্তি কামনা করছে; আর আমাদের আর্ট যেটা চিরকাল মুক্ত ছিল তাকে ধরে ডানা কেটে পিঁজরের মধ্যে ঠেসে পুরতে চাচ্ছি আমরা। বড় পা’কে ছোট জুতোর মধ্যে ঢ়ুকিয়ে চীনের রাজকন্যার যা ভোগ ভুগতে হয়েছে সেটা কষা জুতোর একটু চাপ পেলেইআমরা অনুভব করি— পা বেরিয়ে পড়তে চায় চট্ করে জুতো ছেড়ে, কিন্তু হায়! ছবি— সে কিনা আমাদের কাছে শুধু কাগজ, সুর— সে কিনা শুধু খানিক গলার শব্দ, কবিতা— সে শুধু কিনা ফর্মাবাঁধা বই; তাই তাদের মুচড়ে মুচড়ে ভেঙে-চুরে চামড়ার থলিতে ভরে দিতে কষ্টও পাইনে ভয়ও পাইনে।
অন্যথা-বৃত্তি হল আর্টের এবং রচনার পক্ষে মস্ত জিনিস, এই অন্যথা-বৃত্তি দিয়েই কালিদাসের মেঘদূতের গোড়া পত্তন হল, অন্যথা-বৃত্তি কবির চিত্ত মানুষের রূপকে দিলে মেঘের সচলতা এবং মেঘের বিস্তারকে দিলে মানুষের বাচালতা। এই অসম্ভব ঘটিয়ে কবি সাফাই গাইলেন যথা—“ধূমজ্যোতিসলিলমরুতাং সন্নিপাতঃ ক্ক মেঘঃ, সন্দেশার্থাঃ ক্ক পটুকরণৈঃ প্রাণিভিঃ প্রাপণীয়াঃ!”(১) ধূম আলো আর জল-বাতাস যার শরীর, তাকে শরীর দাও মানুষের, তবে তো সে প্রিয়ার কানে প্রাণের কথা পৌছে দেবে? বিবেক ও বুদ্ধি মাফিক মেঘকে মেঘ রেখে কিছু রচনা করা কালিদাসও করেননি, .কোন কবিই করেন না। যখন রচনার অনুকূল মেঘের ঠাট কবি তখন মেঘকে হয়তো মেঘই রাখলেন কিন্তু যখন রচনার প্রতিকূল ধূম জ্যোতি জল বাতাস তখন নানা বস্তুতে শক্ত করে, বেঁধে নিলেন কবি। এই অন্যথা-বৃত্তি কবিতার সর্বস্ব, তখনো যেমন এখনো তেমন, রসের বশে ভাবের খাতিরে রূপের অন্যথা হচ্ছে—
“শ্রাবণ মেঘের আধেক দুয়ার ঐ খোলা,
আড়াল থেকে দেয় দেখা কোন পথভোলা
ঐ যে পূরব গগন জুড়ে, উত্তরী তার যায় রে উড়ে
সজল হাওয়ার হিন্দোলাতে দেয় দোলা!
লুকাবে কি প্রকাশ পাবে কেই জানে,
আকাশে কি ধরায় বাসা কোন্ খানে,
নানা বেশে ক্ষণে ক্ষণে, ঐ ত আমার লাগায় মনে,
পরশখানি নানা সুরের ঢেউ তোলা।”
ভাব ও রসের অন্যান্য বৃত্তি পেয়ে মেঘ এখানে নতুন সচল anatomyতে রূপান্তরিত হল। বলতে পারো মেঘকে তার স্বরূপে রেখে কবিতা লেখা যায় কি না? আমি বলি যায়, কিন্তু অভ্রবিজ্ঞানের হিসেব মেঘের রূপকে যেমন ছন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখায়, সেভাবে লিখলে কবিতা হয় না, রঙের ছন্দ বা ছাঁদ, কথার ছাঁদ দিয়ে মেঘের নিজস্ব ও প্রত্যক্ষ ছাঁদ না বদলালে কবিতা হতে পারে না, যেমন--
“আজি বর্ষা রাতের শেষে
সজল মেঘের কোমল কালোয়
অরুণ আলো মেশে।
বেণু বনের মাথায় মাথায়
রঙ লেগেছে পাতায় পাতায়,
রঙের ধরায় হৃদয় হারায়
কোথা যে যায় ভেসে।”
মনে হবে অপ্রাকৃত কিছু নেই এখানে, কিন্তু কালো শুধু বলা চলল না, কোমল কালো না হলে ভেসে চলতে পারল না আকাশে বাতাসে রঙের স্রোত বেয়ে কবির মানসকমল থেকে খসে-পড়া সুর-বোঝাই পাপড়িগুলি সেই দেশের খবর আনতে যে দেশের বাদল বাউল একতারা বাজাচ্ছে সারা বেলা। সকালের প্রকৃত মূর্তিটা হল মেঘের কালোয় একটু আলো কিন্তু টান-টোনের কোমলতা পাতার হিলিমিলি নানা রঙের ঝিলিমিলির মধ্যে তাকে কবি হারিয়ে দিলেন; মেঘের শরীর আলোর কম্পন পেলে, ফটোগ্রাফের মেঘের মতো চোখের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল না। বর্ষার শেষরাত্রে সত্যিকার মেঘ যেভাবে দেখতে দেখতে হারিয়ে যায়, সকালের মধ্যে মিলিয়ে দেয় তার বাঁধা রূপ, ঠিক সেই ভাবের একটি গতি পেলে কবির রচনা। সকালে মেঘে একটু আলো পড়েছে এই ফটোগ্রাফটি দিলে না কবিতা; আলো মেঘ লতাপাতার গতিমান ছন্দে ধরা পড়ল শেষ বর্ষার চিরন্তন রস এবং মেঘলোকের লীলাহিল্লোল। রচনার মধ্যে এই যে রূপের রসের চলাচল গতাগতি, এই নিয়ে হল তফাত ঘটনার নোটিসের সঙ্গে রচনার প্রকৃতির। নোটিস সে নির্দেশ করেই থামল, রচনা চলে গেল গাইতে গাইতে হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে মনের থেকে মনের দিকে এক কাল থেকে আর এক কালে বিচিত্রভাবে। কবিতায় বা ছবিতে এইভাবে চলায়মান রঙ রেখা রূপ ও ভাব দিয়ে যে রচনা তাকে আলঙ্কারিকেরা গতিচিত্র বলেন— অর্থাৎ গতিচিত্রে রূপ বা ভাব কোন বস্তুবিশেষের অঙ্গবিন্যাস বা রূপসংস্থানকে অবলম্বন করে দাঁড়িয়ে থাকে না কিন্তু রেখার রঙের ও ভাবের গতাগতি দিয়ে রসের সজীবতা প্রাপ্ত হয়ে আসা-যাওয়া করে। বীণার দুই দিকে বাঁধা টানা তারগুলি সোজা লাইনের মতো অবিচিত্র নির্জীব আছে— বলছেও না চলছেও না। সুর এই টানা তারের মধ্যে গতাগতি আরম্ভ করলে অমনি নিশ্চল তার চঞ্চল হল গীতের ছন্দে, ভাবের দ্বারা সজীব হল, গান গাইতে লাগল, নাচতে থাকল তালে তালে। পর্দায় পর্দায় খুলে গেল সুরের অসংখ্য পাপড়ি, সোজা anatomyর টানা পাঁচিল ভেঙে বার হল সুরের সুরধুনী-ধারা, নানা ভঙ্গিতে গতিমান। আকাশ এবং মাটি এরি দুই টানের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষের anatomy-দোরস্ত শরীর। দুই খোঁটায় বাঁধা তারের মতো, এই হল ডাক্তারি anatomyর সঠিক রূপ। আর বাতাসের স্পর্শে আলোর আঘাতে গাছ-ফুল-পাতা-লতা এরা লতিয়ে যাচ্ছে ছড়িয়ে যাচ্ছে শাখা-প্রশাখার আঁকা-বাঁকা নানা ছন্দের ধারায়; এই হচ্ছে artistic anatomyr সঠিক চেহারা। আর্টিস্ট রসের সম্পদ নিয়ে ঐশ্বর্যবান, কাজেই রস বন্টনের বেলায় রসপাত্রের জন্য তাকে খুঁজে বেড়াতে হয় না কুমোরটুলি, সে রসের সঙ্গে রসপাত্রটাও সৃষ্টি করে ধরে দেয় ছোট বড় নানা আকারে ইচ্ছামতো। এই পাত্রসমস্যা শুধু যে ছবি লিখছে তাকেই যে পূরণ করতে হয় তা নয়, রসের পাত্র-পাত্রীর anatomy নিয়ে গণ্ডগোল রঙ্গমঞ্চে খুব বেশি রকম উপস্থিত হয়। নানা পৌরাণিক ও কাল্পনিক সমস্ত দেবতা উপদেবতা পশুপক্ষী যা রয়েছে তার anatomy ও model বাস্তব জগৎ থেকে নিলে তো চলে না। হরেরামপুরের সত্যি রাজার anatomy রাজশরীর হলেও রঙ্গমঞ্চের রাজা হবার কাজে যে লাগে তা নয়, একটা মুটের মধ্যে হয়তো রাম রাজার রসটি ফোটাবার উপযুক্ত anatomy খুঁজে পাওয়া যায়। নারীর anatomy হয়তো সীতা সাজবার কালে লাগল না, একজন ছেলের anatomy দিয়ে দৃশ্যটার মধ্যে উপযুক্ত রসের উপযুক্ত পাত্রটি ধরে দেওয়া গেল। পাখির কি বানরের কি নারদের ও দেবদেবীর ভাব ভঙ্গি চলন বলন প্রভৃতির পক্ষে যেরকম শরীরগঠন উপযুক্ত বোধ হল অধিকারী সেই হিসেবে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন বা সজ্জিত করে নিলে;— যেখানে আসল মানুষের উচ্চতা রচয়িতার ভাবনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলে না সেখানে রণ্পা দিয়ে anatomical মাপ বাড়িয়ে নিতে হল, যেখানে আসল দু’হাতের মানুষ কাজে এল না সেখানে গড়া হাত গড়া ডানা ইত্যাদি নানা খুঁটিনাটি ভাঙাচোরা দিয়ে নানা রসের পাত্র-পাত্রী সৃষ্টি করতে হল বেশ-কারকে,— রচয়িতার রচনার সঙ্গে অভিনেতার রূপের সামঞ্জস্য এইভাবে লাভ করতে হল নাটকে! কল্পনামূলক যা তাকে প্রকৃত ঘটনার নিয়মে গাঁথা চলে না, আর ঘটনামূলক নাটক সেখানেও একেবারে পাত্র-পাত্রীর সঠিক চেহারাটি নিয়ে কাজ চলে না, কেননা যে ভাব যে রস ধরতে চেয়েছেন রচয়িতা, তা রচয়িতার কল্পিত পাত্র-পাত্রীর চেহারার সঙ্গে যতটা পারা যায় মেলাতে হয় বেশ-কারকে। এক-একজন বেশ সুঠাম সুশ্রী, পাঠও করতে পারলে বেশ, কিন্তু তবু নাটকের নায়ক-বিশেষের পার্ট তাকে দেওয়া গেল না, কেননা সেখানে নাটক-রচয়িতার কল্পিতের সঙ্গে বিশ্ব-রচয়িতার কল্পিত মানুষটির anatomy গঠন ইত্যাদি মিলল না। ছবিতেও তেমনি কবিতাতেও তেমনি, ভাবের ছাঁদ অনেক সময়ে মানুষের কি আর কিছুর বাস্তব ও বাঁধা ছাঁদ দিয়ে পুরোপুরিভাবে প্রকাশ করা যায় না, অদল-বদল ঘটাতেই হয়, কতখানি অদল-বদল সয় তা আর্টিস্ট যে রসমূর্তি রচনা করছে সেই ভাল বুঝবে আর কেউ তো নয়। চোখে দেখছি যে মানুষ, যেসব গাছপালা নদ-নদী পাহাড়-পর্বত আকাশ— এরি উপরে আলো-আঁধার ভাব-ভঙ্গি দিয়ে বিচিত্র রস সৃজন করে চললেন যাঁর আমরা রচনা তিনি, আর এই যে নানা রেখা নানা রঙ নানা ছন্দ নানা সুর এদেরই উপরে প্রতিষ্ঠিত করলে মানুষ নিজের কল্পিতটি। মানুষ বিশ্বের আকৃতির প্রতিকৃতি নিজের রচনায় বর্জন করলে বটে, কিন্তু প্রকৃতিটি ধরলে অপূর্ব কৌশলে যার দ্বারা রচনা দ্বিতীয় একটা সৃষ্টির সমান হয়ে উঠল। এই যে অপূর্ব কৌশল যার দ্বারা মানুষের রচনা মুক্তিলাভ করে ঘটিত জগতের ঘটনা সমস্ত থেকে, এটা কিছুতে লাভ করতে পারে না সেই মানুষ যে এই বিশ্বজোড়া রূপের মূর্ত দিকটার খবরই নিয়ে চলেছে, রসের অমূর্ততা মূর্তকে যেখানে মুক্ত করছে সেখানের কোন সন্ধান নিচ্ছে না, শুধু ফটোযন্ত্রের মতো আকার ধরেই রয়েছে, ছবি ওঠাচ্ছে মাত্র ছবি ফোটাচ্ছে না। মানুষের মধ্যে কতক আছে মায়াবাদী কতক কায়াবাদী; এদের মধ্যে বাদ-বিসংবাদ লেগেই আছে। একজন বলছে, কায়ার উপযুক্ত পরিমাণ হোক ছায়া-মায়া সমস্তই, আর-একজন বলছে তা কেন, কায়া যখন ছায়া ফেলে সেটা কি খাপে খাপে মেলে শরীরটার সঙ্গে, না নীল আকাশ রঙের মায়ায় যখন ভরপুর হয় তখন সে থাকে নীল, বনের শিয়রে যখন চাঁদনী মায়াজাল বিস্তার করলে তখন বনের হাড়হদ্দ সব উড়ে গিয়ে শুধু যে দেখ ছায়া, তার কি জবাব দেবে? মায়াকে ধরে রেখেছে কায়া, কায়াকে ঘিরে রয়েছে মায়া; কায়া অতিক্রম করছে মায়া দিয়ে আপনার বাঁধা রূপ, মায়া সে নিরূপিত করছে উপযুক্ত কায়া দ্বারা নিজকে। জাগতিক ব্যাপারে এটা নিত্য ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। জগৎ শুধূ মায়া কি শুধু কায়া নিয়ে চলছে না, এই দুইয়ের সমন্বয় চলেছে; তাই বিশ্বের ছবি এমন চমৎকারভাবে আর্টিস্টের মনটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে! এইযে সমন্বয়ের সূত্রে গাঁথা কায়া-মায়া ফুল আর তার রঙের মতো শোভা পাচ্ছে— anatomyর artistic ও inartistic সব রহস্য এরি মধ্যে লুকোনো আছে। রূপ পাচ্ছে রসের দ্বারা অনির্বচনীয়তা, রস হচ্ছে অনির্বচনীয় যথোপযুক্ত রূপ পেয়ে, রূপ পাচ্ছে প্রসার রসের, রস পাচ্ছে প্রসার রূপের, এই একে-একে মিলনে হচ্ছে দ্বিতীয় সৃজন আর্টে, তারপর সুর, ছব্দ, বর্ণিকাভঙ্গ ইত্যাদি তৃতীয় এসে তাকে করে তুলেছে বিচিত্র ও গতিমান ওদিকে এক রচয়িতা এদিকে এক রচয়িতা, মাঝে রয়েছে নানা রকমের বাঁধা রূপ; সেগুলো দুদিকের রঙ্গ-রসের পাত্র-পাত্রী হয়ে চলেছে— বেশ বদলে বদলে ঠাট বদলে বদলে— অভিনয় করছে নাচছে গাইছে হাসছে কাঁদছে চলাফেরা করছে! রচকের অধিকার আছে রূপকে ভাঙতে রসের ছাঁদে। কেননা রসের খাতিরে রূপের পরিবর্তন প্রকৃতির একটা সাধারণ নিয়ম, দিন চলেছে রাত চলেছে জগৎ চলেছে রূপান্তরিত হতে হতে, ঋতুতে ঋতুতে রসের প্রেরণাটি চলেছে গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত রূপের নিয়ম বদলাতে বদলাতে পাতায় পাতায় ফুলে ফলে ডালে ডালে! শুধূ এই নয়, যখন রস ভরে উঠল তখন এতখানি বিস্তীর্ণ পাত্রেও রস ধরল না— গন্ধ হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল রস, রঙে রঙে ভরে দিলে চোখ, উথলে পড়ল রস মধুকরের ভিক্ষাপাত্রে, এই যে রসজ্ঞানের দাবি এ সত্য দাবি, সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে স্পর্ধার দাবি নয়, সত্যাগ্রহীর দাবি। ডাক্তারের দাবি ঐতিহাসিকের দাবি সাধারণ মানুষের দাবি নিয়ে একে তো অমান্য করে চলে না। আর্টিস্ট যখন কিছুকে যা থেকে তাতে রূপান্তরিত করলে তখন সে যা-তা করলে তা নয়, সে প্রকৃতির নিয়মকে অতিক্রম করলে না, উল্টে বরং বিশ্বপ্রকৃতিতে রূপমুক্তির নিয়মকে স্বীকার করলে, প্রমাণ করে চলল হাতে কলমে। আর যে মাটিতেই হোক বা তেল রঙেতেই হোক রূপের ঠিক-ঠিক নকল করে চলল, সে আঙুরই গড়ুক বা আমই গড়ুক ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু সে দিয়ে যেতে পারলে না, সে অভিশপ্ত হল, কেননা সে বিশ্বের চলাচলের নিয়মকে স্বীকার করলে না প্রমাণও করলে না কোন কিছু দিয়ে, অলঙ্কারশাস্ত্র মতো তার কাজ পুনরাবৃত্তি এবং ভ্রান্তিমৎ দোষে দুষ্ট হল। রক্ত চলাচলের খাদ্য চলাচলের পক্ষে যে ভৌতিক শরীর-গঠন অস্হিসংস্হান তার মধ্যে রসাধার আর-একটি জিনিস আছে যার anatomy ডাক্তার খুঁজে পায়নি এ পর্যন্ত। বাইরের শরীর আমাদের বাঁধা ছাঁচে ঢালা আর অন্তর্দেহটি ছাঁচে ঢালা একেবারেই নয় সুতরাং সে স্বাধীনভাবে রসের সম্পর্কে আসে, এ যেন এতটুকু খাঁচায় ধরা এমন একটি পাখি যার রসমূর্তি বিরাটের সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে, রচনাতীত সুর বর্ণনাতীত বর্ণ তার। এই পাখির মালিক হয়ে এসেছে কেবল মানুষ আর কোনো জীব নয়। বাস্তব জগৎ যেখানে সীমা টানলে রূপের লীলা শেষ করলে সুর থামালে আপনার, সেইখানে মানুষের খাঁচায় ধরা এই মানস পাখি সুর ধরলে, নতুনরূপে ধরে আনলে অরূপের রূপ— জগৎ সংসার নতুন দিকে পা বাড়ালে তবেই মুক্তির আনন্দে। মানুষ তার স্বপ্ন দিয়ে নিজেকেই যে শুধু মুক্তি দিচ্ছে তা নয় যাকে দর্শন করছে যাকে বর্ণন করছে তার জন্যে মুক্তি আনছে। আটঘাট-বাঁধা বীণা আপনাকে ছাড়িয়ে চলেছে এই স্বপ্নে, সুরের মধ্যে গিয়ে বাঁশি তার গাঁঠে-গাঁঠে-বাঁধা ঠাট ছাড়িয়ে বার হচ্ছে, এই স্বপ্নের দুয়ার দিয়ে ছবি অতিক্রম করেছে ছাপকে, এই পথে বিশ্বের হৃদয় দিয়ে মিলছে বিশ্বরূপের হৃদয়ে, এই স্বপ্নের পথ। বীণার সেই anatomyটাই বীণার সত্য anatomy, এ সত্য আর্টিস্টমাত্রকেই গ্রহণ করতে হয় আর্টের জগতে ঢোকার আগেই, না হলে সচরাচরকে ছাড়িয়ে সে উঠতে ভয় পায়। পড়া পাখি যা শুনলে তারই পুনরাবৃত্তি করতে থাকল, রচয়িতার দাবি সে গ্রহণ করতে পারলে কি? মানুষ যা দেখলে তাই এঁকে চলল, রচয়িতার দাবি নিতে পারলে কি সে? নিয়তির নিয়মে যারা ফুল পাতার সাজে সেজে এল, রঙিন ডানা মেলে নেচে চলল গেয়ে চলল, তারা কেউ এই বিশ্বসংসারের রচয়িতার দাবি নিতে পারলে না, এক যারা স্বপন দেখলে স্বপন ধরলে সেই আর্টিস্টরা ছাড়া। পাখি পারলে না রচয়িতার দাবি নিতে কিন্তু আকাশের পাখিকে ধরার ফাঁদ ষে মানুষ রচনা করলে মাটিতে বসে সে এ দাবি গ্রহণ করলে, নিয়তিকৃত নিয়ম রহিতের নিয়ম যারা পদে পদে প্রমাণ করে চলল নিজেদের সমস্ত রচনায়, তারাই দাবি দিতে পারলে রচয়িতার। কবীর তাই বললেন—“ভরম জঞ্জাল দুখ ধন্দ ভারি”— ভ্রান্তির জঞ্জাল দূর করো, তাতে দুঃখ ও দীনতা আর ঘোর সংশয়: “সত্ত দাবী গহো আপ নির্ভয় রহো”— তোমার যে সত্য দাবি তাই গ্রহণ করো, নির্ভয় হও। যে মানুষ রচয়িতার সত্য দাবি নেয়নি কিন্তু স্বপন দেখলে ওড়বার, সে নিজের কাঁধে পাখির ডানা লাগিয়ে উড়তে গেল, পরীর মতো দেখতে হল বটে সে, কিন্তু পরচুলো তার বাতাস কাটলে না, ঝূপ করে পড়ে মরল সে; কিন্তু যে রচয়িতার সত্য দাবি গ্রহণ করলে তার রচনা মাধ্যাকর্ষণের টান ছাড়িয়ে উড়ল তাকে নিয়ে লোহার ডানা বিস্তার করে আকাশে। মানুষ জলে হাঁটবার স্বপন দেখলে, রচয়িতার দাবি গ্রহণ করলে না— ডুবে মরল দু’পা না যেতে, রচয়িতার রচনা পায়ের মতো একেবারেই দেখতে হল না কিন্তু গুরুভাবের দ্বারা সে জলের লঘুতাকে জয় করে স্রোতের বাধাকে তুচ্ছ করে চলে গেল সাত সমুদ্র পার। মানুষ নিমেষে তেপান্তর মাঠ পার হবার স্বপন দেখলে, রচয়িতার দাবি নিতে পারলে না, খানিক পথে দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত হল তার anatomy-দোরস্ত শরীর, তৃষ্ণায় বুক ফেটে মরল সে হরিণের মতো, ঘোড়াও দৌড় অবলম্বন করে যতটা যেতে চায় নির্বিঘ্নে তা পারলে না, রণক্ষেত্রে ঘোড়া মায় সওয়ার পড়ে মরল! রচয়িতা নিয়ে এল লোহার পক্ষীরাজ ঘোড়া— যেটা ঘোড়ার মতো একেবারেই নয় হাড়হদ্দ কোনো দিক দিয়ে,— সৃজন করে উঠে বসল, আপন পর সবাইকে নিয়ে নিমেষে ঘুরে এল যোজন বিস্তীর্ণ পৃথিবী নির্ভয়ে! যা নিয়তির নিয়মে কোথাও নেই তাই হল, জলে শিলা ভাসল আকাশে মানুষ উড়ল, ঘুমোতে ঘূমোতে পৃথিবী ঘুরে এল রচনায় চড়ে মানুষ! প্রকৃতির নিয়মের বিপরীত আচরণে দোষ এখানে তো আমাদের চোখে পড়ে না। মানুষ যখন আয়নার সামনে বসে চুল ছাঁটে, টেরি বাগায়, ছিটের সার্টে বাঙলা anatomyর সৌন্দর্য ঢেকে সাহেবী ঢঙে ভেঙে নেয় নিজের দেহ, কাজল টেনে চোখের টান বাড়িয়ে প্রেয়সী দেখা দিলে বলে বাহবা,— চুলের খোঁপার ঘোরপেঁচ দেখে বাঁধা পড়ে— নিজের কোনো সমালোচনা যে মানে না তার কাছে, তখন সে ছবির সামনে এসে anatomyর কথা পাড়ে কেন সে আমার কাছে এক প্রকান্ড রহস্য!
ঈজিপ্টের লোক এককালে সত্যিই বিশ্বাস করত যে, জীবন কায়া ছেড়ে চলে যায় আবার কিছু দিন পরে সন্ধান করে করে নিজের ছেড়ে ফেলা কামিজের মতো কায়াতেই এসে ঢোকে। এইজন্যে কায়ার মায়া তারা কিছুতে ছাড়তে পারেনি, ভৌতিক শরীরকে ধরে রাখার উপায় সমস্ত আবিষ্কার করেছিল, একদল কারিগরই তৈরি হয়েছিল ঈজিপ্টে, যারা ‘কা’ প্রস্তুত করতো; তাদের কাজই ছিল যেমন মানুষ ঠিক সেই গড়নে পুত্তলিকা প্রস্তুত করা, গোরের মধ্যে ধরে রাখার জন্য; ঠিক এইসব ‘কা’-নির্মাতাদের পাশে বসে ঈজিপ্টের একদল রচয়িতা artistic anatomy বৃহত্ত ও অন্যথা-বৃত্ত দিয়ে পুত্তলিকা বা ‘কা’-নির্মাতাদের ঠিক বিপরীত রাস্তা ধরে গড়েছিল কত কি তার ঠিক নেই, দেবতা মানুষ পশু পক্ষী সবার anatomy ভেঙে-চুরে তারা নতুন মূর্তি দিয়ে অমরত্বের সিংহাসনে বসিয়ে গেল। ঈজিপ্টের এই ঘটনা হাজার হাজার বৎসর আগে ঘটেছিল; কায়া নির্মাতা কারিগর ও ছায়া-মায়ার জাদুকর দুই দলই গড়লে কিন্তু একজনের ভাগ্যে পড়ল মূর্ত--
যা-কিছু তাই, আর-একজনের পাত্রে ঝরল অমূর্ত রস স্বর্গ থেকে,— এ নিয়মের ব্যতিক্রম কোনো যুগের আর্টের ইতিহাসে হয়নি হবার নয়। ঈজিপ্ট তো দূরে, পাঁচ হাজার দশ হাজার বছর আরো দূরে, এই আজকের আমাদের মধ্যে যা ঘটছে, তাই দেখ না কেন; যারা ছাপ নিয়ে চলেছে মর্ত্য জগতের রূপ সমস্তের, তারা মূর্ত জিনিস এত পাচ্ছে দেখে সময়ে সময়ে আমারও লোভ হয়,— টাকা পাচ্ছে হাততালি পাচ্ছে অহংকে খুব বেশি করে পাচ্ছে। আর এরূপ যারা করছে না তারা শুধু আঁকা-বাঁকা ছন্দের আনন্দটুকু, ঝিলিমিলি রঙের সুরটুকু বুকের মধ্যে জমা করছে, লোহার সিন্দুক কিন্তু রয়েছে খালি; বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেই কালে কালে খুব আদবু করে আর্টিস্টদের যা সম্ভাষণ করেছে তা উর্দুতে বলতে গেলে বলতে হয়— খেয়ালী, হিন্দীতে— বাউর বা বাউল, আর সবচেয়ে মিষ্টি হল বাঙলা— পাগল। কিন্তু এই পাগল তো জগতে একটি নেই, উপস্থিত দশ বিশ লক্ষ কিংবা তারও চেয়ে হয়তো বেশি এবং অনুপস্হিত ভবিষ্যতের সব পাগলের সর্দার হয়ে যে রাজত্ব করছে, উল্কার মতো জ্যোতির্ময় সৃষ্টি রচনা সমস্ত সে ছড়িয়ে দিয়ে চলেছে পথে-বিপথে সৃজনের উৎসব করতে করতে। এমন যে খেয়ালের বাউল, জগতের আগত অনাগত সমস্ত খেয়ালী বা আর্টিস্ট হল তার চেলা, তারা পথ চলতে ঢেলাই হোক মাণিকই হোক যাই কুড়িয়ে পেলে অমনি সেটাকে যে খুব বুদ্ধিমানের মতো ঝুলিতে লুকিয়ে রাতারাতি আলো-আঁধারের ভ্রান্তি ধরে চোখে ধুলো দিয়ে বাজারে বেচে এল তা নয়— মাটির ঢেলাকে এমন করে ছেড়ে দিলে যে সেটা উড়ে এসে যখন হাতে পড়ল
তখন দেখি সোনার চেয়ে সেটা মূল্যবান, আসল ফুলের চেয়ে হয়ে গেছে সুন্দর! বাঙলায় আমাদের মনে আর্টের মধ্যে অস্হিবিদ্যার কোনখানে স্হান, এই প্রশ্নটা ওঠবার কয়েক শত বৎসর আগে এই পাগলের দলের একজন আর্টিস্ট এসেছিল। সে জেগে বসে স্বপন দেখলে— যত মেয়ে শ্বশুর ঘরে রয়েছে আসতে পারছে না বাপের বাড়ি, একটা মূর্তিতে সেই সবারই রূপ ফুটিয়ে যাবে! আর্টিস্ট সে বসে গেল কাদা মাটি খড় বাঁশ রং তুলি নিয়ে, দেখতে দেখতে মাটির প্রতিমা সোনার কমল হয়ে ফুটে উঠল দশ দিকে সোনার পাপড়ি মেলে! এ মূর্তি বাঙলার ঘরে ঘরে দেখবে দু’দিন পরে, কিন্তু এরও উপরে ডাক্তারিশাস্ত্রের হাত কিছু কিছু পড়তে আরম্ভ হয়েছে শহরে। বাঙলার কোনোণৌ অজ্ঞাত পল্লীতে এই মূর্তির মূল ছাঁদ যদি খোঁজ তো দেখবে— তার সমস্তটা artistic anatomyর নিয়মের দ্বারায় নিয়তির নিয়ম অতিক্রম করে শোভা পাচ্ছে ব্যতিক্রম ও অতিক্রমের সিংহাসনে।
টীকা
১. ৪র্থ শ্লোক, পূর্বমেঘ— মেঘদূতম্ (কালিদাসের গ্রন্থাবলী, ২য় ভাগ)