উত্তরের ঘর
বাড়ির দক্ষিণ জুড়ে ফুলবাগান, পুকুর, গাছপালা, মেহেদির বেড়া ঘেরা সবুজ চক্কর। সেদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য সুষমা ও কল্পনা। চাঁদ ওঠে সেদিকে, সূর্য ওঠে সেদিকে, মস্ত বটগাছের আড়াল দিয়ে। পুকূর জলে দিনরাত পড়ে আলোছায়ার মায়া। দুপুরে ওড়ে প্রজাপতি, ঝোপে ডাকে ঘুঘু আর কাঠ-ঠোকরা খেকে থেকে। ময়ূর বেড়ায় পাখনা মেলিয়ে, রাজহংস দেয় সাঁতার, ফোহারাতে জল ছোটে সকাল বিকেল। সারস ধরে নাচ বাদলার দিনে, ঝড়বাতাসে নারকেল গাছের সারি দোল খায়। গরমের দিনে দুপুরে চিল স্থির ডানা মেলিয়ে ভেসে ঝিম্ সুরে ডাক দিয়ে ঘুরে ঘুরে ক্রমেই ওঠে উপরে। পায়রা থেকে থেকে ঝাঁক বেঁধে বাড়ির ছাতে উড়ে উড়ে বেড়ায় । কাক উড়িয়ে নেয় শুকনো ডাল মাটি থেকে গাছের আগায়। সন্ধ্যায় ওঠে নীল আকাশের তারা। রাতে ডাকে পাপিয়া — কতদূর থেকে কোকিল তার জবাব দেয় —পিউ পিউ, কিউ কিউ। আবার শেয়ালও ডাকে রাতে, ব্যাঙও বলে বর্ষায়। বেজিও বেরোয়, বেড়ালও বেরোয় থেকে থেকে শিকারের সন্ধানে। একটা একটা নেড়ি কূত্তো, সেও ফাঁক বুঝে হঠাৎ ঢোকে বাগানে, চারিদিক দেখে নিয়ে চট্ করে সরেও পড়ে রবাহুত গোছের ভাব দেখিয়ে।
কিন্তু তখনো বাড়ির এই রমণীয় দিকটাতে নেমে যাবার আমার বয়েস হয় নি, উকি দেবারও অবস্থা হয় নি। ওদিকটা ছিল সেকালের নিয়মে বারবাড়ির সামিল। অন্দরে যারা থাকত তারা তেতলার টানা বারান্দার বন্ধ ঝিলমিল দিয়ে ওদিককার একটূ আভাস মাত্র পেতে পারতো। কি ছেলে, কি মেয়ে, কি দাসী, কি বউ, কি গিন্নীবান্নি — সকলের পক্ষেই এই ছিল ব্যবস্থা। বেশি রাত না হলে দক্ষিণের ঝিলমিল দেওয়া জানলা কটা পুরোপুরি খোলা ছিল তখন বেদস্তুর। ওই দিকটা বন্ধ রাখা প্রথা হয়ে গিয়েছিল কতকটা দায়ে পড়ে। এইবাড়িটা বৈঠকখানা হিসেবে প্রস্তুত করা — এটাকে আমাদের বসতবাড়ি হিসেবে করে নিতে এখানে ওখানে নানা পর্দা দিতে হয়েছে, না হলে ঘরের আব্রু থাকে না। বৈঠকখানায় বাস করতে হবে মেয়েছেলে নিয়ে, সেটা একটা দুর্ভাবনা জাগিয়েছিল নিশ্চয়; তাই কতকগুলো পর্দা, ঝিলমিল ও চলাফেরার নিয়ম দিয়ে বাড়ির কতক অংশ, পুরোনো বাড়ি ছেড়ে উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গেই, অন্দর হিসেবে দেওয়াল ঝিলমিল ইত্যাদি দিয়ে ঘিরে নিভে হয়েছিল আব্রুর জন্যেও বটে, বাসঘরের অকূলানের জন্যেও বটে এবং সেটা পর্দা দেওয়াল ইত্যাদি ওঠার সঙ্গে কতকগুলি জানলা-বন্ধ দরজা-বন্ধ নিয়মও সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল আপনা হতেই। যখন আমি হয়েছি তখন বন্ধ থাকত দক্ষিণের ঝিলমিল তিনতলার, ভোর হতে রাত দ্শটা নিয়মমতো। দক্ষিণ বারান্দার তিন হাত পাঁচিল, তার উপর রেমো সবুজ রঙ মাখানো টানা ঝিলমিল বন্ধ। আর আমি তখন মোটে দুই হাত বাড়াই কিনা সন্দেহ। ড্রপ-সিনের সবুজ পর্দার ওপারে কী আছে জানার জন্যে যেমন একটা কৌতূহল থাকে, ভেমনি বাড়ির মনোরম অংশটাকে দেখবার জন্যে একটা কোতূহল থাকে, তেমনি বাড়ির মনোরম অংশটাকে দেখবার জন্যে একটা কৌতূহল ছিল কি ছিল না কিন্তু উত্তর দিকটাতেই টানছে এখন মন — যে দিকটাতে জীবন বিচিত্র হয়ে দেখা দেয় খিড়কির ফাঁকে ফাঁকে।
এই খড়খড়ি দেওয়া বহিরের জগতের খিড়কি, এদিকে সকাল বিকেল, যখন-তখন, বাড়ির সাধারণ দিক দেখে চলতেম। অষ্টপ্রহর কিছু-না-কিছু হচ্ছে সেখানে — চলছে, বলছে, উড়ছে, বসছে ; কত চরিত্রের, কত ঢঙের, কত সাজের মানুষ, গাড়ি, ঘোড়া —কতকী তার ঠিক নেই। মানুষ, জন্তু,কাজকর্ম এখানে সবই এক একটা চরিত্র নিয়ে অবিশ্রান্ত, চলন্ত।
১৫ , ছবির মতো চোখের উপরে এসে পড়ত একটার ঘাড়ে আর-একটা। সব ছবি গুলো নিজেতে নিজেতে সম্পূণ — ছেদ নেই ভেদ নেই, টানা চলেছে চোখের সামনে দিয়ে দৃশ্যের একটা আফুরন্ত স্রোত ঘটনার বিচিত্র অশান্ত লীলা। উত্তরের সারি সারি তিনটে জানলার তলাতে দেড় ফূট করে উচূ সরু দাওয়া—সেইখানে বসে খড়খড়ি টেনে দেখি । পুরোপূরি একখানা ;ছবির মতো চোখে পড়ত না।বাড়ি,ঘর,গাছ—এরই নীচে একটা ময়লা সবুজ টান, তারপর আবার ছবি —ছাগল,মুরগি,হাঁস,খাটিয়া,বিচালির গাদা, খানিকটা চাকার আঁচড়-কাটা রাস্তা — তাঁর উপর আবার সবুজ টান। এমনি একটা করে খড়খড়ির ফাঁক আর একটা করে কাঠের পাটা-এরই উপর সবছবি ও না-ছবিকে দু'ভাগ করে একটা সর দাঁড়ি—। খবরের কাগজের দুটো কলমের মাঝের রেখার মতোই সোজা — যেটা টানলে হয় ছবি, চাপলে হয় বন্ধ ছবি দেখা।
বাড়ির উত্তর আঙিনাটায় একটা গোল চক্কর ছিল তখন-এখন সেখানে মস্ত লালবাড়ি উঠে গেছে। এই চক্করের পুবপাশে আর-একটা আধাগোল গোছের চক্কর; পশ্চিম পাশে আর একটা চৌকোনো পাচিল-ঘেরা বাগান। এই ক'টা ঘিরে আস্তাবল,নহবতখানা, গাড়িখানা। তিনটে বড়ো বড়ো বাদাম আর অনেক কালের পুরোনো তেতুলগাছ একটা।এই গাছ ক'টার ফাঁকে ফাঁকে টানা উচূ-নিচূ সব পাকাবাড়ির ছাত আর চিলে-কোঠা। সরু সরু কাঠের থাম দেওয়া, ঝুঁকে-পড়া বারন্দা দেওয়া রামচাঁদ মুখূজ্যের সাবেক বাড়ি-গরাদে আঁটা ছোটো ছোটো জানলা, ইঁট বার করা ছাতের পাঁচিল আর দেওয়াল। উত্তরের এইটুকুর মধ্যে ধরা তখন বাইরেরে দৃশ্য-জগৎটি আমার, বাকি দিনগুলো শোনা আর কল্পনার মধ্যে ছিল। বহির্জগতের খিড়কী দিয়ে, উঁকি দিয়ে দেখার মতো ছবিগুলো। মানুষ, মুরগি,হাঁস, গাড়িঘোড়া, শীষ, কোচম্যান, ছিরু মেথর,নন্দ ফরাস,গোবিন্দ খোঁড়া, বুড়ো জমাদার, ভিস্তি, মুটে, উড়ে বেহারা, গোমস্তা, মুহরি, চৌকিদার, ডাক-পেয়াদা-সবাই কে নিয়ে মস্ত একটা যাত্রা চলেছে এই উত্তরের আঙিনাটায়। সকাল থেকে ঘুমের ঘড়ি না পড়া পর্যন্ত কত কী মজার মজার ঘটনা ঘটে চলেছে দেখতেম এই দিকটাতে। কতক সুরকির রাস্তায়, কতক গোল চাকলার মধ্যেটায়, কতক বা খোলার ঘর গুলোর ভিতরে এবং বাহিরে, অথবা কোনো বাড়ির ছাতে অনেক দূরে। চলিত-ভাষায় যেন একটা যেন একটা চলনসই নাটক দেখছি। খুব বড়ো ট্র্যাজেডি কি কমেডি নয়, কিন্তু কতক নড়াচড়া,কতক হাবভাব ,কতক বা একটা ছবি—এই দিয়ে ভরতি একটা প্রহসন দেখছি বলতে পারি। সকালে চোখ খোলা থেকে আরম্ভ করে রাত দশটায় চোখের পাতা বন্ধ করা পর্যন্ত একটা বড়ো নাটক দেখার মতো ছুটি নেই এখন, কিন্তু এটুকু অবসর পয়েছিলেম তখন। নিত্য নতুন উত্তরচরিতের এক এক অঙ্কের মতো— এই নাটক শুরু হত এবং শেষ হত যেভাবে তার একটু হিসেব দিই।
তখনো বাড়িতে জলের কল বসেনি ।রাস্তার ধারে ধারে টানা নহর বয়ে কলের জল আসে।রোজই দেখি এক ভিস্তি,গায়ে তার হাত-কাটা নীল জামা, কোমরে খানিক লাল শালু জড়ানো, মাথায় পোস্ট অফিসের গম্বুজের মতো উঁচু শাদা টুপি— নহরের পাশে দাঁড়িয়ে চামড়ার মোষোকে জল ভরে। মোষ-কালো চামড়ার মোষোকটা ঘাড় তুলে হাঁ করে জল খায়, যেনএকটা জল-জন্তু; পেটটা তার ক্রমেই ফুলতে ফুলতে চকচক করতে থাকে। মোষোকটা ফাটার উপক্রম হতেই ভিস্তি একটা সরু চামড়ার গলাট দিয়ে বেঁধে নিয়ে গায়ের জল মুছিয়ে একটা চমৎকার চালে মাটির দিকে বুক ঝুঁকিয়ে। বাঁধা কাজে বাঁধা ভিস্তি, তার চাল-চোল সমস্তই এমন বাঁধা ছিল যে মনেই আসত না সে মরতে পারে, বদলাতে পারে। ঘড়ির মতো দস্তুর-মাফিক বাঁধা নিয়মে কাজ বাজিয়ে চলত; দাঁড়াত যেখানকার সেখানে, চলে যেতও যেখানকার সেখানে দিনের পর দিন। তার চেহারা দেখি নি; শুধু তার চলার ভঙ্গি, কাপড়ের রঙ—এই বিশেষত্ব দিয়েই তাকে আমি দেখতে পাই—সেকাল একাল সব কালেই সে একই ভিস্তি। কাকগুলোও যে-ভাবে কালের পরিবর্তন ছাড়িয়েছে, ভিস্তিগুলোও সেইভাবে তখনো যে এখনও সে রয়েছে ভিস্তিই। কৃষ্ণনগরের ভিস্তি পুতুল, যাত্রার সাজা ভিস্তি, বহুরূপীর ভিস্তি, আরব্য উপন্যাসের ভিস্তি—সবগুলোর সঙ্গে মিলে আছে সেই পঞ্চাশ বছর আগেকার ভিস্তি একজন, যে ঘড়ি ধরে জল ভরত মোষোকো। সেই সেকালের ভিস্তির বেশে বা চেহারায় যদি একটু বিশেষত্ব থাকত তবে একালের ভিস্তির সঙ্গে অভিন্ন হতে পারতই না সে— সে যেন একটা সনাতন চিরন্তন জীবের মতো তখনো ছিল এখনো আছে।
ভিস্তি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় ফেটি বেঁধে দু'হাতে দুই ঝাঁটা নিয়ে দেখা দিত একটা মানুষ। জাতে সে ডোম, তার নাম ছিল শ্রীরাম, কিন্তু ডাকত সবাই ছীরে বলে। সে দুই হাত খেলিয়ে চটপট দুটো কলমের মতো করে কাটা ঝাঁটা বুলিয়ে যায়। নিমেষে সব রাস্তাই ঢেউ-খেলানো দুই প্রস্থ রেখায় অতি আশ্চর্য অতি পরিষ্কার ভাবে নকশা টানা হয়ে যায়। চমৎকার চুনোট-করা গেরুয়া কাপড়ে সমস্ত সদর রাস্তাটা যেন মোড়া হয়ে থাকে খানিকক্ষণ ধরে। রাস্তার আর্টিস্ট, ধুলোর আর্টিস্ট, ডবল ঝাঁটার আর্টিস্ট—তার কাজ দেখে চোখ ভুলে থাকত কতক্ষণ! আমরা যেমন ছবির নানা কাজে নানা রকম সরু মোটা ভোঁতা চেটালো তুলি রাখি, আমাদের ছীরে মেথরও কাছে রাখত রকম-বেরকম ঝাঁটা। রাস্তার ঝাঁটা ছিল তার কলমের মতো ডগার একধারে ছোলা; জলের নর্দমা পরিষ্কার করবার জন্যে রাখত সে দাড়ি কামানো বুরুশের মতো ছোটো এবং মুড়ো ঝাঁটা; বাগানের পাতা-লতা কুটো-কাটা ঝাঁটানোর জন্যে ছিল চোঁচের মতো খোঁচা দুফাঁক ঝাঁটা যাতে সামান্য কুটোটিও ঝুড়িতে তুলে নেওয়া চলে অনায়াসে; উঠোন, দালান, বারান্দা ঝাঁটানোর ঝাঁটা ছিল চামরের মতো হালকা ফুরফুরে, বাতাসের মতো হালকা পরশ বুলিয়ে চলত মেঝের উপরে। এই নানারকম ঝাঁটার খেলা খেলিয়ে চলে যেত সে রোজই। আঙিনা, রাস্তা, অলি-গলি, বারান্দা ঝেঁটিয়ে যেত ছীরু যখন তকতকে পরিষ্কার করে, তখন তারই উপরে চলত যাত্রা অভিনয় আবার।
এবারে কেবল চলন্ত ছবি। একটা ছোট্ট টাটু ঘোড়া, তার চেয়ে ছোট্ট একটা পালকি- গাড়ি টানতে টানতে পুরোনো বাড়ির ফটকে এসে দাড়াতেই বাক্সর মতো ছোট্ট গাড়ি থেকে মোটা-সোটা গম্ভীর এক বাবু নেমে পড়েন, মাথার চুল তাঁর কদম ফুলের মতো ছাঁটা। সোয়ারি নামতে না নামতে বোঁ করে গাড়িটা গোল চক্করের পশ্চিম দিকের অশ্বত্থ তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়াটাকে ছেড়ে দেয়। ছোট্ট ঘোড়া অমনি ছোট্ট ফটক ঠেলে কচি ঘাস চোরকাঁটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগে, আর গাড়িখানা কুমির পোকার শুঁড়ের মতো বোম জোড়া আকাশে উঁচিয়ে নৈঋত কোণের দিকে চেয়ে তার বাবুর জন্যে অপেক্ষা করে থাকে।
একটা ছাতি আস্তে আস্তে ফটকের দিকে এগিয়ে চলে, অথচ মানুষ দেখি নে তার নীচে। হঠাৎ দেউড়ির কাছে এসে ছাতিটা বন্ধ হয়ে তলাকার ছোট্ট মানুষটিকে প্রকাশ করে দেয়—মাথায় চকচকে টাক, ছোট্ট যেন একটি মাটির পুতুলের মতো বেঁটেখাটো মানুষটি। ঘণ্টা বাজে এবার সাতবার, তার পর খানিক ঢং ঢং ঢং টান দিয়ে সাড়ে সাত বুঝিয়ে থামে। রোদ এসে পড়ে লাল রাস্তার উপরে একফালি সোনার কাগজের মতো।
চীনেদের থিয়েটার দেখা যেমন খাওয়াদাওয়া গল্পগুজবের সঙ্গে চলে, আমাদের যাত্রা দেখা যেমন—খানিক দেখে উঠে গিয়ে তামাক খেয়ে নিয়ে, কিম্বা হয়তো ঘরে গিয়ে এক ঘুম ঘুমিয়ে এসেও দেখা চলে, তেমনি ভাবের দেখা শোনা চলত এই উত্তর দিকে জানলায় বসে।
হয়তো ঘরের ওধারে একটা কৌচের তলায় ঢুকে রবারের গোলাটা পালায় কোথায় এই সমস্যার মীমাংসা করতে কৌচের তলায় নিজেই একবার ঢুকে পড়তে চলেছি, পা-দুটো আমার হারু শহরের দরজায় গিয়ে ঠেকে ঠেকে, ঠিক সেই সময় খড়খড়ির আসরের দিক থেকে ঘোড়দৌড়ের শব্দ আর সহিসদের হৈ-হৈ রব উঠল। অমনি নিজের রিজার্ভ বক্সে হাজির। দেখি গোল চক্কর ঘিরে ঘোড়দৌড় বেধে গেছে। সহিষ, কোচম্যান, দরোয়ান যে যেখানে ছিল সবাই মিলে ঘোড়া পালানো আর ঘোড়া ধরার অভিনয় করতে লেগে গেছে।
এই অশ্বমেধের ঘোড়া ধরা দিয়ে সকালের উত্তর-কাণ্ডের পালা প্রায়ই বেলা দশটাতে কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ হত। স্নান আহারের জন্যে একটা মস্ত ইণ্টারভাল। যাত্রা নিশ্চয়ই চলত তখনো— কেননা এই উত্তর আঙিনাটা ছিল সাধারন দিক; বাড়ির কাজ-কর্মে লোকের যাতায়াতের অন্ত ছিল না, কামাই ছিল না সেখানে। প্রবেশ আর প্রস্থান—এই ছিল ওদিকের নিত্যকার ঘটনা । দুপুরবেলা নিঝূমের পালা চলেছে এখানটায় দেখি। উত্তরের আঙিনার পশ্চিম কোণে আধখানা তেঁতুল আর আধখানা বাদাম গাছের ছাওয়াতে খোলার ঘরটা—ঘরের চাল ধনুকের মতো বেঁকে প্রায় মাটি ছুঁয়েচে। ঘরের সামনে আধখানা মাটিতে পোঁতা একটা মেটে জালা, তাই থেকে ছীরে মেথর জল তুলে তুলে গা ধুচ্ছে আর ক্রমান্বয়ে ইংরিজিতে নিজের বউকে গাল পাড়ছে, আর বউটা বাংলাতে বকে চলেছে তার সঙ্গে।
আস্তাবলের সামনে খাটিয়া, তার উপরে পাতা কালো কম্বল, তাতেই শুয়ে ঝকঝকে ঘোড়ার সাজ আর শিকলি। ঘরের মধ্যে ছোট্ট টাট্টু ঘোড়ার শেষের পা-দুটো আর চামরের মতো ল্যাজটা দেখা যায়। ল্যাজটা ছপ্ ছপ্ করে মশা তাড়ায়, আর পা দুটো তালে তালে ওঠে পড়ে, কাঠের মেঝেতে খটাস খট্ শব্দ করে।
গোল্ চক্করের পশ্চিমে আর-একটা পাঁচিল-ঘেরা চৌকোনা জায়গা, কখনো কপি কখনো বেগুন এই দুই রঙের পাতায় ভরাই থাকত সেটা। চক্করের পূব ধারে আর একটা ঘেরা জমি, ফটকের দুই ধারের দেওয়ালের চুনবালিতে পরিষ্কার করে তোলা দুটো হাতি নিশেন পিঠে পাহারা দিচ্ছে। টিনের একটা খালি ক্যানেস্তারা কাদায় উলটে, পড়ে আছে; সেইখানটায় হিজিবিজি চাকার দাগ রাস্তায় পড়েছে, তাতে একটু জল বেধে আছে; পাতিহাঁস ক'টা হেলতে দুলতে এসে সেই কাদাজলে নাইতে লেগে যায়। থেকে থেকে মাথা ডোবায় জলে আর তোলে, ল্যাজের পালক কাঁপায়, শেষে এক-পায়ে দাঁড়িয়ে ভিজে মাথা, নিজের পিঠে ঘষে আর ঠোঁট দিয়ে গা চুলকে চলে। একটা বুড়ো রামছাগল ফস্ করে রাস্তা থেকে একটা লেখা কাগজ তুলে গিলে ফেলে চটপট, তার পর গম্ভীর ভাবে এদিক ওদিক চেয়ে চলে যায় সোজা ফটক পেরিরে রাস্তা বেড়াতে দুপুরবেলা।
গোল চক্করের পূব গায়ে একটা আধ-গোল আধ-চৌকো চক্কর—মরচে ধরা ফুটো ক্যানেস্তারা, খড়কুটো, ভাঙা গামলা, পুরোনো তক্তপোশের উই-খাওয়া ফর্মা আর একরাশ ছেঁড়া খাতায় ভরতি। সেখানে গোটা কয়েক মুরগি চরে—ছাই রঙ, পাটকেল রঙ। শাদা একটা মস্ত মোরগ, তার লাল টুপি মাথায়, পায়ে হলদে মোজা, গায়ের পালক যেন হাতির দাঁতকে ছুলে কেউ বসিয়েছে, একটির পাশে আর একটি। মোরগটা গোল চক্করের ফটকের একটা পিলপে দখল করে বসে থাকে, নড়ে না চড়ে না।
বেলা চারটে পর্যন্ত এইভাবে নিঝুমের পালা চলে। ঢং ঢং করে আবার ঘড়ি পড়ে। একটার পর একটা ইস্কুল গাড়ি, আফিস গাড়ি পাল্কি এসে দলে দলে সোয়ারি নামিয়ে চলে।
গোবিন্দ খোঁড়া রাজেন্দ্র মল্লিকের ওখানে রোজই ভাত খায় আর আমাদের গোল চক্করটাতে হাওয়া খেতে আসে। কতকালের পুরোনো আঁকাবাঁকা গাছের ডালের মতো শক্ত তার চেহারা, ঠিক যেন বাইবেল কি আরব্য উপন্যাসের একটা ছবির থেকে নেমে এসেছে। গোল বাগানের ফটকের একটা পিলপে ছিল তার পিঠের ঠেস। বৈকালে সেখানটাতে কারো বসবার জো ছিল না। বাদশার মতো গোবিন্দ খোঁড়া তার সিংহাসনে খোঁড়া পা ছড়িয়ে বসে যেত। পাহারাওয়ালা, কাবুলিওয়ালা, জমাদার, সরকার, চাকর, দাসী—সবার সঙ্গেই আলাপ চলে, খাতিরও সকলের কাছে যথেষ্ট তার। শহর-ঘোরা সে যেন একটা চলতি খবরের কাগজ কিংবা কলিকাতা গেজেট! পাঁচিলের উপর বসে সে খবর বিলোত। শুনেছি প্রথমবার প্রিন্স আসবার সময় পুলিশ থেকে তেল বিলিয়ে গরিবদের ঘরেও দেওয়ালি দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গোবিন্দর ঘর-দুয়োর কিছুই নেই— সে ভোজনং যত্র তত্র শয়নং হট্টমন্দিরে গোছের মানুষ, এটা পাহারাওয়ালারা সবাই জানত। তারা গোবিন্দকে ধরে বসল পিদুম জ্বালাতেই হবে —ঘর না থাকে ঘর ভাড়া করেও পিদুম জ্বালানো চাই। গোবিন্দ তখন আমাদের গোল- চক্করে দরবারে বসেছে; পুলিশের রহস্যটা বুঝেও যেন সে বোঝেনি এইভাবে পাহারাওয়ালাকে শুধুলে, 'সরকার থেকে কতটা তেল গরিবদেরা দেওয়ানোর হুকুম হল?' এক-পলা করে তেল বিনামুল্যে দেওয়ানোর কথা যেমন পুলিশম্যান গোবিন্দকে বলা, অমনি জবাব সঙ্গে সঙ্গে—'যাঃ যাঃ, তোর বড়োসায়েবকে বলিস,গোবিন্দ একসের তেল নিজে খেকে খরচ করচে।' ভিক্টোর হিউগোর গল্পের একটা ভিখিরির সর্দারের মতো এই গোবিন্দ খোঁড়ার প্রতাপ আর প্রতিষ্ঠা ছিল তখনকার দিনে। এখন হলে পুলিশের সঙ্গে তকরার, সিডিশান, রাজদ্রোহ, এমনি কিছুতে ধরা পড়ে যেত নিশ্চয় গোবিন্দ।
এদিকে গোবিন্দ খোঁড়ার দরবার গোল চক্করের পাঁচিলে,ওদিকে নহবতখানার ছাতে বসেছে তখন আমাদের সমশের কোচম্যানের মজলিস দড়ির খাটিয়া পেতে। সে যেন দ্বিতীয় টিপু সুলতান বসে গেছে ফরসি হাতে। হাবসির মতো কালো রঙ,মাথার চুল বাবরিকাটা, পরনে শাদা লুঙ্গি, হাতকাটা মেরজাই, চোখে সুর্মা, মেদিতে লাল মোচড়ানো গোঁফ, সিঁথেকাটা দাড়ি। বাবামশায় হাওয়া খেতে যাবার পূর্বে ঠিক সময়ে সে সেজেগুজে বার হত। চুড়িদার পাজামা, রুপোলি বকলস দেওয়া বার্নিশ জুতো, আঙুলে রুপো-বাঁধা ফিরোজার আংটি, গায়ে জরিপাড়ের লাল বনাতের বুককাটা কাবা তকমা আঁটা, কাঁধে ফুল-কাটা রুমাল, মাথায় থালার মতো মস্ত একটা শামলা, কোমরে দুই সহিসে মিলে জড়িয়ে দিয়েছে লম্বা সাপের মতো জরির কোমরবন্ধ। ফিটফাট হয়ে শমশের লাল চক্করের পাঁচিলে চাবুক হাতে দাঁড়াত আর সহিস শাদা জুড়ির ঘোড়া দুটোকে চক্করের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে বাইরে থেকে ফটক বন্ধ করে দিত। তখন শাদা ঘোড়া দুটোকে প্রায় দশ মিনিট সার্কাসের ঘোড়ার মতো চক্কর দিইয়ে তবে গাড়িতে জেতার নিয়ম ছিল। পাছে রাস্তায় ঘোড়া বজ্জাতি করে সেইজন্যে তাদের আগে থাকতে টিট করাই উদ্দেশ্য। এই এই দুর্দান্ত কোচম্যান, ঘোড়াও তার তেমনি, গাড়িখানা থেকে যেন ঝড়ের মতো বেরিয়ে পড়ত। কোচবাক্সের উপরে দেখতেম খাড়া দাঁড়িয়ে সমশের হাঁকড়াচ্ছে চাবুক। ফেটিং-গাড়ি ছিল খুব উঁচু। গাড়িবারান্দার খিলেনের কাছটাতে এসেই ঝপ্ করে সমশের নিজের আসনে বসে পড়ত গম্ভীর হয়ে। তার পর এক সময়ে ঘোড়া গাড়ি কোচম্যান সাজগোজ সব নিয়ে একটা জমজমাট শোভাযাত্রার দৃশ্য রাস্তার উপর খানিক ঝলক টেনে বেরিয়ে যেত গড়ের মাঠে—আতর গোলাপের খোশবুতে যেন উত্তর দিকটা মাত করে দিয়ে।
এরই একটু পরেই নন্দ ফরাশ দু'হাতে আঙুলের ফাঁকে বড়ো বড়ো তেলবাতির সেজ দুটো আদ্ভুত কায়দাতে হাতের তেলোয় অটল ভাবে বসিয়ে উঠে চলত ফরাশখানা থেকে বৈঠকখানায়। তার পর ড্রপ পড়ত রঙ্গমঞ্চে, এবং নোটো খোঁড়া, নন্দ ফরাস দুয়ে মিলে বেহালা বাদন দিয়ে সেদিনের মতো পালা সাঙ্গ হত সন্ধেবেলায়। তখন পিদুমের ধারে বসে রূপকথা শোনা, ইকড়ি মিকড়ি ঘুটি-খেলার সময় আসত।
সেই ঘরের এককোনে বসে রূপকথা বলে একটা দাসী—দাসীটার চেয়ে তার রূপকথাটাকে বেশি মনে পড়ে। এই দাসীটা ছিল আমার ছোটো বোনের। সে বলে তার দাসীর নাম ছিল মঞ্জরী। আর দোয়ারি চাকর এই কবিত্বপূর্ণ মঞ্জরী নামটির নামের ডগাটা বঁটির ঘায়ে উড়িয়ে দিয়েছিল তাও বলে সে, কিন্তু আমি দেখি মঞ্জরীকে শুধু একটা গড়-পরা নাকভাঙা নাম, বসে আছে একটা লাল চামড়ার তোরঙ্গ ঠেস দিয়ে দুই পা ছাড়িয়ে। তোরঙ্গটার সকল গায়ে পিতলের পেরেক মালার মতো করে আঁটা। মঞ্জরী বিামোচ্ছে আর কথা বলছেঃ 'এক ছিল টুনটুনি—সে নিমগাছে বাসা না বেঁধে রাজবাড়ির ছাতের আল্সেতে থাকে, আর রাজপুত্তুরের তোশক থেকে তুলো চুরি করে করে ছোট্ট একটি বাসা বাঁধে।
ছাতে ওঠবার সিঁড়ি বলে একটা কিছু নেই তখনো আমার কাছে, অথচ টুনটুনির বাসার কাছটায়—একেবারে নীল আকাশের গায়ে, ছাতের কার্নিসে উঠে গিয়ে বসি পা ঝলিয়ে।
এমনি দিনের বেলায় রূপকথার সিঁড়ি ধরে পাখির সঙ্গে পেতেম ছাতের উপরের দিকটা। আবার রোজই নিশুতি রাতে মাথার উপরে পেতেম শুনতে হুটোপুটি করছে ছাতটা—ভাট গড়গড় গড়াচ্ছে, দুমদুম লাফাচ্ছে। ছাতটা তখন ঠেকত ঠিক একটা অন্ধকার মহারণ্য বলে —যেখানে সন্ধেবেলা গাছে গাছে ভোঁদড় করে লাফালাফি, আর আকাশ থেকে জুঁই ফুল টিকিতে বেঁধে ব্রহ্মদৈত্য থাকে এ-ছাত ও-ছাত পা মেলে দাঁড়িয়ে ধ্যান করে। এমনি করে গল্প-কথার মধ্যে দিয়ে কত কী দেখেছি তখন। যখন চোখও চলে না বেশিদূর, পাও হাঁটে না। অনেকখানি, তখন কান ছিল সহায়। সে এনে পৌঁছে দিত কাছে ছাত, হাতে এনে দিত কমলাফুলির টিয়ে পাখি, চড়িয়ে দিত আগড়ুম-বাগড়ুম ঘোড়ায়, লাটসাহেবের পালকিতে এবং নিয়ে যেত মাসিপিসির বনের ধারের ঘরটাতে আর মামার বাড়ির দুয়োরেও।
মায়ের অনেকগুলি দাসী ছিল—সৌরভী, মঞ্জরী, কামিনী কত কী তাদের নাম । অনেকদিন অন্তর দেশে যেত এরা সব গাঁয়ের মেয়ে—অনেকদিন পরে ফিরত আবার। কখনো বা এরা দল বেঁধে যেত গঙ্গা নইতে পার্বণে, আর নিয়ে আসত দু'চারটে করে খেলনা, পীরের ঘোড়া, সবজে টিয়ে, কাঠের পাল্কি, মাটির জগন্নাথ, সোনার ময়ূর, আতা গাছে তোতা, ঢেঁকি, বঁটি । এমনি নানা রূপকথার দেশের, ছড়ার দেশের পশু, পক্ষী, ফুল, ফল, তৈজসপত্র সবাইকে পেতেম চোখের কাছেই কিন্তু মাসিপিসির ঘর আর মামার দেখা দিয়েও দিত না—বাড়ির ছাতের মতই অজ্ঞাতবাসে ছিল । মঞ্জরী দাসী এক-একদিন খেয়ালমতো খোলা জানলার ধারে তুলে ধরত আর বলত —ওই দ্যাখ্ মামার বাড়ি। বাড়ির সন্ধানে উত্তর আকাশ হাতড়াত চোখ, দেখত না একখানিও ইঁট, শুধু পড়ত চোখে তখন আমাদের বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণে মস্ত তেঁতুল গাছটার শিয়রে মন্দিরের চূড়োর মতো শাদা শাদা মেঘ স্হির হয়ে আছে। ওইটুকু দেখিয়েই দাসী নামিয়ে দিত কোল থেকে খড়খড়ির তলার মেঝেতে। তারপর সে দরজা-জানলা বন্ধ করে দিয়ে রান্না-বাড়িতে ভাত খেতে যেত একটা বগি-থালা সিন্দুকের পাশ থেকে তুলে নিয়ে।
প্রায় রাতেরই মতো চুপচাপ আর অন্ধকার হয়ে যেত ঘরখানা দিনদুপুরে। সবজে খড়খড়িগুলো সোনালি দাঁড়ি টানা একটা-একটা ডুরে-কাপড়ের পর্দার মতো ঝুলত চৌকাঠ থেকে—কাঠের তৈরি বলে মনেই হত না জানালাণ্ডলো! বাইরের খানিকটা আঁচ পাওয়া যেত খড়খড়ির ফাঁকে ফাঁকে, সুতোর সঞ্চারে পৌঁছত এসে আকাশের দিক থেকে চিলের ডাক। বাতাসেরও ডাক খুব মিহি সুর দিয়ে কানে আসত—ঝড়ের একটা আবছায়া মনে পড়ত—একটা দুটো কোমল টান প্রথমে, তার পর খানিক চড়া সুর, তার পর বেশ একটা ফাঁক, তার ঠিক পরেই একখানা তীব্র সুর বাতাসের। এমনি গোটা দুই-তিন আওয়াজ, আর কিছু নেই যখন তিনতলায়, তখন সেই নিঃসাড়াতে চোখ দুটো দেখতে বার হত—যেন রাতের শিকারী জন্তু খুজত। এটা ওটা সেটা এদিক ওদিক সেদিক সন্ধানে চলত সেদিনের আমিও তক্তার নীচে, সিঁড়ির কোণে, সার্সির ফাঁকে, আয়নার উলটো পিঠে এবং চৌকি বেয়ে আলমারির চালে নানা জিনিস আবিষ্কার করার দিকে। ছাতের কথা ভুলেই যাই—তখন ঘর দেখতেই মশগুল থাকে মন ! এক ছোটো ছেলেমেয়েদের ছাড়া এই সময়টাতে খানিকক্ষণের মতো কাউকে পেত না তিনতলার ঘরগুলো। কাজেই এসময়ে আমাদের সঙ্গে যেন ছাড়া পেয়ে জিনিসগুলোও হঠাৎ বেঁচে উঠত, এবং তারাও বেরিয়েছে দিনদুপুরের অন্ধকারে খেলার চেষ্টায়—এটা ভাবে জানাত।
সারা তিনতলার দেওয়াল, ছবি, সিঁড়ি, তক্তা, আলমারি, ফুলদানি, মায় মেঝেতে পাতা মস্ত জাজিম এবং কড়িতে ঝোলানো পাখাগুলোর সঙ্গে এমনি করে দুপুরে ঘরে ঘরে ফিরে আর উঁকি দিয়ে, সারা তিনতলা কতদিনে পেয়েছিলেম, পুরোপুরি ভাবে তা বলা যায় না। একটা দোলনা-খাট—ছোট্ট, সেটা খাট থাকতে থাকতে হঠাৎ কবে একদিন জাহাজ হয়ে উঠল এবং দুলে দুলে আমাদের নিয়ে সমুদ্রে চালাচল শুরু করলে। মস্ত জাজিম বিছানা ক'জোড়া ছোটো হাতের তাড়ায় যেন ফুলে ফুলে উঠল—যেন ক্ষীর সাগরে ঢেউ তুলে।
২০
দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। ডবল ব্ল্যাকেটের মতো করে কাটা, গোলাপী রঙের ছোপ ধরানো মার্বেল পাথরের একটা টেবিল এক কোণে রয়েছে, তার উপরে পাথরে-কাটা দুটি পায়রা ফল খেতে নেমেছে–সত্যিকার মতো পাখির আর আপেলের রঙ দেখে লোভ জাগে মনে। ঘরের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে বড়ো হল্টাতে উঠে যাবার পাঁচ ধাপ সিঁড়ি—তারই গায়ে অনেক উপরে একটা ব্যাকেট তোলা আছে, চৌকো কাচের ঢাকনা দেওয়া, গোপাল পালের গড়া লক্ষ্মী আর সরস্বতী—ছোট্ট ছোট্ট আসল মানুষর মতো রঙ-করা কাপড় পরানো। দেশী কুমোরের হাতে গড়া এই খেলনা দেবতার কাছেই, দরজার উপর খাটানো চওড়া গিলটির ফ্রেমে বাঁধানো, তেল রঙ-করা বিলিতী একটা মেমের ছবি। চোখ তার কালো, চুল কটা নয় একটুও, মাথায় একটা রাঙা কানঢাকা টুপি, খয়েরী মখমলের জামা হাতকাটা, শাদা ঘাঘরা পরনে। সে বাঁ হাতে একটা ঝুড়ি নিয়েছে, রুমাল ঢাকা চুবড়ির মধ্যে থেকে যেন একটা সত্যিকারের কাচের বোতল গলা বার করেছে। ডান হাত রেখেছে মেয়েটা ঠিক যেন সত্যিকার মস্ত একটা কুকুরের পিঠে। কুকুর চেয়ে আছে ঝুড়ির দিকে, মেয়েটা চেয়ে আছে কুকুরের দিকে। একেবারে জল-জীয়ন্ত মানুষ আর কুকুরের আর মখমল আর ঝুড়ি আর ব্রান্ডির বোতল—কিছুতেই মনে হত না অথচ সেটা ছবি নয়।
মায়ের এই বসবার ঘরের পাশেই পশ্চিম দিকে বাবামশায়ের শোবার ঘরটা নতুন করে সাজানো হচ্ছে তখন। মস্ত একটা চাবি দিয়ে সে ঘরের দরজটা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু জানছি সেখানে সাহেব মিস্ত্রি লাল, শাদা, হলদে, কালো নতুন রকমের বিলিতী টালি কেটে কেটে বসাচ্ছে মেঝেতে-ঠুকঠাক খিটখাট ছেনির শব্দ হচ্ছেই সেখানে সারাদিন। ঘরটা যেদিন খুলল দুয়োর, সেদিন দেখি সেখানে সবক'টা জানলা-দরজার মাথায় মাথায় সোনার জল করা কারনিস বসে গেছে, আর সেগুলো থেকে ফুলকাটা ফিনফিনে পর্দা জোড়া জোড়া ঝুলছে সবজে আর সোনালী রেশম পাকানো মোটা দড়ায় ফাঁসে লটকানো। ঘরজোড়া পালঙ আয়নার মতো বার্নিশ করা। ঘরটার পশ্চিমমুখো জানালাটা খুলে তার ওধারটাতে- বানিয়েছে অক্ষয় সাহা ইঞ্জিনিয়ারবাবু একটা গাছঘর, কাঠ আর টিন আর ঘষা কাচের সার্সি দিয়ে। সেখানে দেওয়াল গুলো আগাগোড়া গাছের ছালের টুকরো দিয়ে মুড়ে ভাগবত মালী লটকে দিয়েছে সব বিলিতী দামী পরগাছা। কোনোটা সাপের ফণার মতো বাঁকা, কোনোটার লম্বা পাতা দুটো সাপের খোলসের মতো ছিট দেওয়া ড়োরাকাটা। কিন্তু এর একটা পরগাছাতেও ফুলফল কিছুই নেই। কোনোটাতে বা পাতাও নেই, কেবল সেটা আর কাঁটা।
এই গাছঘরের মাঝে একটা তিনফকোর দালানের মতো খাঁচা। তারের টেবিল তাতে হলদে রঙের এক জোড়া কেনেরি পাখি ধরা থাকে। শোবার ঘরটা তখনো নিজের সাজ সম্পূর্ণ করে নি ফুলদানি ইত্যাদি দিয়ে। শুধু সরু পাথরের তাকের সঙ্গে আঁটা গোল চুল-বাঁধার আয়নাখানা মায়ের রয়েছে একটা দিকে। এই আয়নাখানাকে ঘিরে মিহি গিল্টির পাড়, তাতে সবজে আর শাদা মিনকারি দিয়ে নকশাকরা জুঁইফুল আর কচি পাতার একগাছি গোড়ে মালা । এরই সামনে স্ফটিক কাটা চৌকোনো একটি ফুলদানি মাঝখানে সোনার বোঁটাতে আটকানো যেন বরফ-কুঁচি দিয়ে গড়া ভুঁইচাপা-সোনার ডাটি তাকে নিয়ে ঝুঁকে পড়েছে। জলের মতো পরিষ্কার আয়নার দিকে চেয়ে ফুল দেখছে ফুলের একখানি ছায়া স্থির হয়ে।
বাড়ির দক্ষিণ জুড়ে ফুলবাগান, পুকুর, গাছপালা, মেহেদির বেড়া ঘেরা সবুজ চক্কর। সেদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য সুষমা ও কল্পনা। চাঁদ ওঠে সেদিকে, সূর্য ওঠে সেদিকে, মস্ত বটগাছের আড়াল দিয়ে। পুকূর জলে দিনরাত পড়ে আলোছায়ার মায়া। দুপুরে ওড়ে প্রজাপতি, ঝোপে ডাকে ঘুঘু আর কাঠ-ঠোকরা খেকে থেকে। ময়ূর বেড়ায় পাখনা মেলিয়ে, রাজহংস দেয় সাঁতার, ফোহারাতে জল ছোটে সকাল বিকেল। সারস ধরে নাচ বাদলার দিনে, ঝড়বাতাসে নারকেল গাছের সারি দোল খায়। গরমের দিনে দুপুরে চিল স্থির ডানা মেলিয়ে ভেসে ঝিম্ সুরে ডাক দিয়ে ঘুরে ঘুরে ক্রমেই ওঠে উপরে। পায়রা থেকে থেকে ঝাঁক বেঁধে বাড়ির ছাতে উড়ে উড়ে বেড়ায় । কাক উড়িয়ে নেয় শুকনো ডাল মাটি থেকে গাছের আগায়। সন্ধ্যায় ওঠে নীল আকাশের তারা। রাতে ডাকে পাপিয়া — কতদূর থেকে কোকিল তার জবাব দেয় —পিউ পিউ, কিউ কিউ। আবার শেয়ালও ডাকে রাতে, ব্যাঙও বলে বর্ষায়। বেজিও বেরোয়, বেড়ালও বেরোয় থেকে থেকে শিকারের সন্ধানে। একটা একটা নেড়ি কূত্তো, সেও ফাঁক বুঝে হঠাৎ ঢোকে বাগানে, চারিদিক দেখে নিয়ে চট্ করে সরেও পড়ে রবাহুত গোছের ভাব দেখিয়ে।
কিন্তু তখনো বাড়ির এই রমণীয় দিকটাতে নেমে যাবার আমার বয়েস হয় নি, উকি দেবারও অবস্থা হয় নি। ওদিকটা ছিল সেকালের নিয়মে বারবাড়ির সামিল। অন্দরে যারা থাকত তারা তেতলার টানা বারান্দার বন্ধ ঝিলমিল দিয়ে ওদিককার একটূ আভাস মাত্র পেতে পারতো। কি ছেলে, কি মেয়ে, কি দাসী, কি বউ, কি গিন্নীবান্নি — সকলের পক্ষেই এই ছিল ব্যবস্থা। বেশি রাত না হলে দক্ষিণের ঝিলমিল দেওয়া জানলা কটা পুরোপুরি খোলা ছিল তখন বেদস্তুর। ওই দিকটা বন্ধ রাখা প্রথা হয়ে গিয়েছিল কতকটা দায়ে পড়ে। এইবাড়িটা বৈঠকখানা হিসেবে প্রস্তুত করা — এটাকে আমাদের বসতবাড়ি হিসেবে করে নিতে এখানে ওখানে নানা পর্দা দিতে হয়েছে, না হলে ঘরের আব্রু থাকে না। বৈঠকখানায় বাস করতে হবে মেয়েছেলে নিয়ে, সেটা একটা দুর্ভাবনা জাগিয়েছিল নিশ্চয়; তাই কতকগুলো পর্দা, ঝিলমিল ও চলাফেরার নিয়ম দিয়ে বাড়ির কতক অংশ, পুরোনো বাড়ি ছেড়ে উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গেই, অন্দর হিসেবে দেওয়াল ঝিলমিল ইত্যাদি দিয়ে ঘিরে নিভে হয়েছিল আব্রুর জন্যেও বটে, বাসঘরের অকূলানের জন্যেও বটে এবং সেটা পর্দা দেওয়াল ইত্যাদি ওঠার সঙ্গে কতকগুলি জানলা-বন্ধ দরজা-বন্ধ নিয়মও সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল আপনা হতেই। যখন আমি হয়েছি তখন বন্ধ থাকত দক্ষিণের ঝিলমিল তিনতলার, ভোর হতে রাত দ্শটা নিয়মমতো। দক্ষিণ বারান্দার তিন হাত পাঁচিল, তার উপর রেমো সবুজ রঙ মাখানো টানা ঝিলমিল বন্ধ। আর আমি তখন মোটে দুই হাত বাড়াই কিনা সন্দেহ। ড্রপ-সিনের সবুজ পর্দার ওপারে কী আছে জানার জন্যে যেমন একটা কৌতূহল থাকে, ভেমনি বাড়ির মনোরম অংশটাকে দেখবার জন্যে একটা কোতূহল থাকে, তেমনি বাড়ির মনোরম অংশটাকে দেখবার জন্যে একটা কৌতূহল ছিল কি ছিল না কিন্তু উত্তর দিকটাতেই টানছে এখন মন — যে দিকটাতে জীবন বিচিত্র হয়ে দেখা দেয় খিড়কির ফাঁকে ফাঁকে।
এই খড়খড়ি দেওয়া বহিরের জগতের খিড়কি, এদিকে সকাল বিকেল, যখন-তখন, বাড়ির সাধারণ দিক দেখে চলতেম। অষ্টপ্রহর কিছু-না-কিছু হচ্ছে সেখানে — চলছে, বলছে, উড়ছে, বসছে ; কত চরিত্রের, কত ঢঙের, কত সাজের মানুষ, গাড়ি, ঘোড়া —কতকী তার ঠিক নেই। মানুষ, জন্তু,কাজকর্ম এখানে সবই এক একটা চরিত্র নিয়ে অবিশ্রান্ত, চলন্ত।
১৫ , ছবির মতো চোখের উপরে এসে পড়ত একটার ঘাড়ে আর-একটা। সব ছবি গুলো নিজেতে নিজেতে সম্পূণ — ছেদ নেই ভেদ নেই, টানা চলেছে চোখের সামনে দিয়ে দৃশ্যের একটা আফুরন্ত স্রোত ঘটনার বিচিত্র অশান্ত লীলা। উত্তরের সারি সারি তিনটে জানলার তলাতে দেড় ফূট করে উচূ সরু দাওয়া—সেইখানে বসে খড়খড়ি টেনে দেখি । পুরোপূরি একখানা ;ছবির মতো চোখে পড়ত না।বাড়ি,ঘর,গাছ—এরই নীচে একটা ময়লা সবুজ টান, তারপর আবার ছবি —ছাগল,মুরগি,হাঁস,খাটিয়া,বিচালির গাদা, খানিকটা চাকার আঁচড়-কাটা রাস্তা — তাঁর উপর আবার সবুজ টান। এমনি একটা করে খড়খড়ির ফাঁক আর একটা করে কাঠের পাটা-এরই উপর সবছবি ও না-ছবিকে দু'ভাগ করে একটা সর দাঁড়ি—। খবরের কাগজের দুটো কলমের মাঝের রেখার মতোই সোজা — যেটা টানলে হয় ছবি, চাপলে হয় বন্ধ ছবি দেখা।
বাড়ির উত্তর আঙিনাটায় একটা গোল চক্কর ছিল তখন-এখন সেখানে মস্ত লালবাড়ি উঠে গেছে। এই চক্করের পুবপাশে আর-একটা আধাগোল গোছের চক্কর; পশ্চিম পাশে আর একটা চৌকোনো পাচিল-ঘেরা বাগান। এই ক'টা ঘিরে আস্তাবল,নহবতখানা, গাড়িখানা। তিনটে বড়ো বড়ো বাদাম আর অনেক কালের পুরোনো তেতুলগাছ একটা।এই গাছ ক'টার ফাঁকে ফাঁকে টানা উচূ-নিচূ সব পাকাবাড়ির ছাত আর চিলে-কোঠা। সরু সরু কাঠের থাম দেওয়া, ঝুঁকে-পড়া বারন্দা দেওয়া রামচাঁদ মুখূজ্যের সাবেক বাড়ি-গরাদে আঁটা ছোটো ছোটো জানলা, ইঁট বার করা ছাতের পাঁচিল আর দেওয়াল। উত্তরের এইটুকুর মধ্যে ধরা তখন বাইরেরে দৃশ্য-জগৎটি আমার, বাকি দিনগুলো শোনা আর কল্পনার মধ্যে ছিল। বহির্জগতের খিড়কী দিয়ে, উঁকি দিয়ে দেখার মতো ছবিগুলো। মানুষ, মুরগি,হাঁস, গাড়িঘোড়া, শীষ, কোচম্যান, ছিরু মেথর,নন্দ ফরাস,গোবিন্দ খোঁড়া, বুড়ো জমাদার, ভিস্তি, মুটে, উড়ে বেহারা, গোমস্তা, মুহরি, চৌকিদার, ডাক-পেয়াদা-সবাই কে নিয়ে মস্ত একটা যাত্রা চলেছে এই উত্তরের আঙিনাটায়। সকাল থেকে ঘুমের ঘড়ি না পড়া পর্যন্ত কত কী মজার মজার ঘটনা ঘটে চলেছে দেখতেম এই দিকটাতে। কতক সুরকির রাস্তায়, কতক গোল চাকলার মধ্যেটায়, কতক বা খোলার ঘর গুলোর ভিতরে এবং বাহিরে, অথবা কোনো বাড়ির ছাতে অনেক দূরে। চলিত-ভাষায় যেন একটা যেন একটা চলনসই নাটক দেখছি। খুব বড়ো ট্র্যাজেডি কি কমেডি নয়, কিন্তু কতক নড়াচড়া,কতক হাবভাব ,কতক বা একটা ছবি—এই দিয়ে ভরতি একটা প্রহসন দেখছি বলতে পারি। সকালে চোখ খোলা থেকে আরম্ভ করে রাত দশটায় চোখের পাতা বন্ধ করা পর্যন্ত একটা বড়ো নাটক দেখার মতো ছুটি নেই এখন, কিন্তু এটুকু অবসর পয়েছিলেম তখন। নিত্য নতুন উত্তরচরিতের এক এক অঙ্কের মতো— এই নাটক শুরু হত এবং শেষ হত যেভাবে তার একটু হিসেব দিই।
তখনো বাড়িতে জলের কল বসেনি ।রাস্তার ধারে ধারে টানা নহর বয়ে কলের জল আসে।রোজই দেখি এক ভিস্তি,গায়ে তার হাত-কাটা নীল জামা, কোমরে খানিক লাল শালু জড়ানো, মাথায় পোস্ট অফিসের গম্বুজের মতো উঁচু শাদা টুপি— নহরের পাশে দাঁড়িয়ে চামড়ার মোষোকে জল ভরে। মোষ-কালো চামড়ার মোষোকটা ঘাড় তুলে হাঁ করে জল খায়, যেনএকটা জল-জন্তু; পেটটা তার ক্রমেই ফুলতে ফুলতে চকচক করতে থাকে। মোষোকটা ফাটার উপক্রম হতেই ভিস্তি একটা সরু চামড়ার গলাট দিয়ে বেঁধে নিয়ে গায়ের জল মুছিয়ে একটা চমৎকার চালে মাটির দিকে বুক ঝুঁকিয়ে। বাঁধা কাজে বাঁধা ভিস্তি, তার চাল-চোল সমস্তই এমন বাঁধা ছিল যে মনেই আসত না সে মরতে পারে, বদলাতে পারে। ঘড়ির মতো দস্তুর-মাফিক বাঁধা নিয়মে কাজ বাজিয়ে চলত; দাঁড়াত যেখানকার সেখানে, চলে যেতও যেখানকার সেখানে দিনের পর দিন। তার চেহারা দেখি নি; শুধু তার চলার ভঙ্গি, কাপড়ের রঙ—এই বিশেষত্ব দিয়েই তাকে আমি দেখতে পাই—সেকাল একাল সব কালেই সে একই ভিস্তি। কাকগুলোও যে-ভাবে কালের পরিবর্তন ছাড়িয়েছে, ভিস্তিগুলোও সেইভাবে তখনো যে এখনও সে রয়েছে ভিস্তিই। কৃষ্ণনগরের ভিস্তি পুতুল, যাত্রার সাজা ভিস্তি, বহুরূপীর ভিস্তি, আরব্য উপন্যাসের ভিস্তি—সবগুলোর সঙ্গে মিলে আছে সেই পঞ্চাশ বছর আগেকার ভিস্তি একজন, যে ঘড়ি ধরে জল ভরত মোষোকো। সেই সেকালের ভিস্তির বেশে বা চেহারায় যদি একটু বিশেষত্ব থাকত তবে একালের ভিস্তির সঙ্গে অভিন্ন হতে পারতই না সে— সে যেন একটা সনাতন চিরন্তন জীবের মতো তখনো ছিল এখনো আছে।
ভিস্তি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় ফেটি বেঁধে দু'হাতে দুই ঝাঁটা নিয়ে দেখা দিত একটা মানুষ। জাতে সে ডোম, তার নাম ছিল শ্রীরাম, কিন্তু ডাকত সবাই ছীরে বলে। সে দুই হাত খেলিয়ে চটপট দুটো কলমের মতো করে কাটা ঝাঁটা বুলিয়ে যায়। নিমেষে সব রাস্তাই ঢেউ-খেলানো দুই প্রস্থ রেখায় অতি আশ্চর্য অতি পরিষ্কার ভাবে নকশা টানা হয়ে যায়। চমৎকার চুনোট-করা গেরুয়া কাপড়ে সমস্ত সদর রাস্তাটা যেন মোড়া হয়ে থাকে খানিকক্ষণ ধরে। রাস্তার আর্টিস্ট, ধুলোর আর্টিস্ট, ডবল ঝাঁটার আর্টিস্ট—তার কাজ দেখে চোখ ভুলে থাকত কতক্ষণ! আমরা যেমন ছবির নানা কাজে নানা রকম সরু মোটা ভোঁতা চেটালো তুলি রাখি, আমাদের ছীরে মেথরও কাছে রাখত রকম-বেরকম ঝাঁটা। রাস্তার ঝাঁটা ছিল তার কলমের মতো ডগার একধারে ছোলা; জলের নর্দমা পরিষ্কার করবার জন্যে রাখত সে দাড়ি কামানো বুরুশের মতো ছোটো এবং মুড়ো ঝাঁটা; বাগানের পাতা-লতা কুটো-কাটা ঝাঁটানোর জন্যে ছিল চোঁচের মতো খোঁচা দুফাঁক ঝাঁটা যাতে সামান্য কুটোটিও ঝুড়িতে তুলে নেওয়া চলে অনায়াসে; উঠোন, দালান, বারান্দা ঝাঁটানোর ঝাঁটা ছিল চামরের মতো হালকা ফুরফুরে, বাতাসের মতো হালকা পরশ বুলিয়ে চলত মেঝের উপরে। এই নানারকম ঝাঁটার খেলা খেলিয়ে চলে যেত সে রোজই। আঙিনা, রাস্তা, অলি-গলি, বারান্দা ঝেঁটিয়ে যেত ছীরু যখন তকতকে পরিষ্কার করে, তখন তারই উপরে চলত যাত্রা অভিনয় আবার।
এবারে কেবল চলন্ত ছবি। একটা ছোট্ট টাটু ঘোড়া, তার চেয়ে ছোট্ট একটা পালকি- গাড়ি টানতে টানতে পুরোনো বাড়ির ফটকে এসে দাড়াতেই বাক্সর মতো ছোট্ট গাড়ি থেকে মোটা-সোটা গম্ভীর এক বাবু নেমে পড়েন, মাথার চুল তাঁর কদম ফুলের মতো ছাঁটা। সোয়ারি নামতে না নামতে বোঁ করে গাড়িটা গোল চক্করের পশ্চিম দিকের অশ্বত্থ তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়াটাকে ছেড়ে দেয়। ছোট্ট ঘোড়া অমনি ছোট্ট ফটক ঠেলে কচি ঘাস চোরকাঁটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগে, আর গাড়িখানা কুমির পোকার শুঁড়ের মতো বোম জোড়া আকাশে উঁচিয়ে নৈঋত কোণের দিকে চেয়ে তার বাবুর জন্যে অপেক্ষা করে থাকে।
একটা ছাতি আস্তে আস্তে ফটকের দিকে এগিয়ে চলে, অথচ মানুষ দেখি নে তার নীচে। হঠাৎ দেউড়ির কাছে এসে ছাতিটা বন্ধ হয়ে তলাকার ছোট্ট মানুষটিকে প্রকাশ করে দেয়—মাথায় চকচকে টাক, ছোট্ট যেন একটি মাটির পুতুলের মতো বেঁটেখাটো মানুষটি। ঘণ্টা বাজে এবার সাতবার, তার পর খানিক ঢং ঢং ঢং টান দিয়ে সাড়ে সাত বুঝিয়ে থামে। রোদ এসে পড়ে লাল রাস্তার উপরে একফালি সোনার কাগজের মতো।
চীনেদের থিয়েটার দেখা যেমন খাওয়াদাওয়া গল্পগুজবের সঙ্গে চলে, আমাদের যাত্রা দেখা যেমন—খানিক দেখে উঠে গিয়ে তামাক খেয়ে নিয়ে, কিম্বা হয়তো ঘরে গিয়ে এক ঘুম ঘুমিয়ে এসেও দেখা চলে, তেমনি ভাবের দেখা শোনা চলত এই উত্তর দিকে জানলায় বসে।
হয়তো ঘরের ওধারে একটা কৌচের তলায় ঢুকে রবারের গোলাটা পালায় কোথায় এই সমস্যার মীমাংসা করতে কৌচের তলায় নিজেই একবার ঢুকে পড়তে চলেছি, পা-দুটো আমার হারু শহরের দরজায় গিয়ে ঠেকে ঠেকে, ঠিক সেই সময় খড়খড়ির আসরের দিক থেকে ঘোড়দৌড়ের শব্দ আর সহিসদের হৈ-হৈ রব উঠল। অমনি নিজের রিজার্ভ বক্সে হাজির। দেখি গোল চক্কর ঘিরে ঘোড়দৌড় বেধে গেছে। সহিষ, কোচম্যান, দরোয়ান যে যেখানে ছিল সবাই মিলে ঘোড়া পালানো আর ঘোড়া ধরার অভিনয় করতে লেগে গেছে।
এই অশ্বমেধের ঘোড়া ধরা দিয়ে সকালের উত্তর-কাণ্ডের পালা প্রায়ই বেলা দশটাতে কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ হত। স্নান আহারের জন্যে একটা মস্ত ইণ্টারভাল। যাত্রা নিশ্চয়ই চলত তখনো— কেননা এই উত্তর আঙিনাটা ছিল সাধারন দিক; বাড়ির কাজ-কর্মে লোকের যাতায়াতের অন্ত ছিল না, কামাই ছিল না সেখানে। প্রবেশ আর প্রস্থান—এই ছিল ওদিকের নিত্যকার ঘটনা । দুপুরবেলা নিঝূমের পালা চলেছে এখানটায় দেখি। উত্তরের আঙিনার পশ্চিম কোণে আধখানা তেঁতুল আর আধখানা বাদাম গাছের ছাওয়াতে খোলার ঘরটা—ঘরের চাল ধনুকের মতো বেঁকে প্রায় মাটি ছুঁয়েচে। ঘরের সামনে আধখানা মাটিতে পোঁতা একটা মেটে জালা, তাই থেকে ছীরে মেথর জল তুলে তুলে গা ধুচ্ছে আর ক্রমান্বয়ে ইংরিজিতে নিজের বউকে গাল পাড়ছে, আর বউটা বাংলাতে বকে চলেছে তার সঙ্গে।
আস্তাবলের সামনে খাটিয়া, তার উপরে পাতা কালো কম্বল, তাতেই শুয়ে ঝকঝকে ঘোড়ার সাজ আর শিকলি। ঘরের মধ্যে ছোট্ট টাট্টু ঘোড়ার শেষের পা-দুটো আর চামরের মতো ল্যাজটা দেখা যায়। ল্যাজটা ছপ্ ছপ্ করে মশা তাড়ায়, আর পা দুটো তালে তালে ওঠে পড়ে, কাঠের মেঝেতে খটাস খট্ শব্দ করে।
গোল্ চক্করের পশ্চিমে আর-একটা পাঁচিল-ঘেরা চৌকোনা জায়গা, কখনো কপি কখনো বেগুন এই দুই রঙের পাতায় ভরাই থাকত সেটা। চক্করের পূব ধারে আর একটা ঘেরা জমি, ফটকের দুই ধারের দেওয়ালের চুনবালিতে পরিষ্কার করে তোলা দুটো হাতি নিশেন পিঠে পাহারা দিচ্ছে। টিনের একটা খালি ক্যানেস্তারা কাদায় উলটে, পড়ে আছে; সেইখানটায় হিজিবিজি চাকার দাগ রাস্তায় পড়েছে, তাতে একটু জল বেধে আছে; পাতিহাঁস ক'টা হেলতে দুলতে এসে সেই কাদাজলে নাইতে লেগে যায়। থেকে থেকে মাথা ডোবায় জলে আর তোলে, ল্যাজের পালক কাঁপায়, শেষে এক-পায়ে দাঁড়িয়ে ভিজে মাথা, নিজের পিঠে ঘষে আর ঠোঁট দিয়ে গা চুলকে চলে। একটা বুড়ো রামছাগল ফস্ করে রাস্তা থেকে একটা লেখা কাগজ তুলে গিলে ফেলে চটপট, তার পর গম্ভীর ভাবে এদিক ওদিক চেয়ে চলে যায় সোজা ফটক পেরিরে রাস্তা বেড়াতে দুপুরবেলা।
গোল চক্করের পূব গায়ে একটা আধ-গোল আধ-চৌকো চক্কর—মরচে ধরা ফুটো ক্যানেস্তারা, খড়কুটো, ভাঙা গামলা, পুরোনো তক্তপোশের উই-খাওয়া ফর্মা আর একরাশ ছেঁড়া খাতায় ভরতি। সেখানে গোটা কয়েক মুরগি চরে—ছাই রঙ, পাটকেল রঙ। শাদা একটা মস্ত মোরগ, তার লাল টুপি মাথায়, পায়ে হলদে মোজা, গায়ের পালক যেন হাতির দাঁতকে ছুলে কেউ বসিয়েছে, একটির পাশে আর একটি। মোরগটা গোল চক্করের ফটকের একটা পিলপে দখল করে বসে থাকে, নড়ে না চড়ে না।
বেলা চারটে পর্যন্ত এইভাবে নিঝুমের পালা চলে। ঢং ঢং করে আবার ঘড়ি পড়ে। একটার পর একটা ইস্কুল গাড়ি, আফিস গাড়ি পাল্কি এসে দলে দলে সোয়ারি নামিয়ে চলে।
গোবিন্দ খোঁড়া রাজেন্দ্র মল্লিকের ওখানে রোজই ভাত খায় আর আমাদের গোল চক্করটাতে হাওয়া খেতে আসে। কতকালের পুরোনো আঁকাবাঁকা গাছের ডালের মতো শক্ত তার চেহারা, ঠিক যেন বাইবেল কি আরব্য উপন্যাসের একটা ছবির থেকে নেমে এসেছে। গোল বাগানের ফটকের একটা পিলপে ছিল তার পিঠের ঠেস। বৈকালে সেখানটাতে কারো বসবার জো ছিল না। বাদশার মতো গোবিন্দ খোঁড়া তার সিংহাসনে খোঁড়া পা ছড়িয়ে বসে যেত। পাহারাওয়ালা, কাবুলিওয়ালা, জমাদার, সরকার, চাকর, দাসী—সবার সঙ্গেই আলাপ চলে, খাতিরও সকলের কাছে যথেষ্ট তার। শহর-ঘোরা সে যেন একটা চলতি খবরের কাগজ কিংবা কলিকাতা গেজেট! পাঁচিলের উপর বসে সে খবর বিলোত। শুনেছি প্রথমবার প্রিন্স আসবার সময় পুলিশ থেকে তেল বিলিয়ে গরিবদের ঘরেও দেওয়ালি দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গোবিন্দর ঘর-দুয়োর কিছুই নেই— সে ভোজনং যত্র তত্র শয়নং হট্টমন্দিরে গোছের মানুষ, এটা পাহারাওয়ালারা সবাই জানত। তারা গোবিন্দকে ধরে বসল পিদুম জ্বালাতেই হবে —ঘর না থাকে ঘর ভাড়া করেও পিদুম জ্বালানো চাই। গোবিন্দ তখন আমাদের গোল- চক্করে দরবারে বসেছে; পুলিশের রহস্যটা বুঝেও যেন সে বোঝেনি এইভাবে পাহারাওয়ালাকে শুধুলে, 'সরকার থেকে কতটা তেল গরিবদেরা দেওয়ানোর হুকুম হল?' এক-পলা করে তেল বিনামুল্যে দেওয়ানোর কথা যেমন পুলিশম্যান গোবিন্দকে বলা, অমনি জবাব সঙ্গে সঙ্গে—'যাঃ যাঃ, তোর বড়োসায়েবকে বলিস,গোবিন্দ একসের তেল নিজে খেকে খরচ করচে।' ভিক্টোর হিউগোর গল্পের একটা ভিখিরির সর্দারের মতো এই গোবিন্দ খোঁড়ার প্রতাপ আর প্রতিষ্ঠা ছিল তখনকার দিনে। এখন হলে পুলিশের সঙ্গে তকরার, সিডিশান, রাজদ্রোহ, এমনি কিছুতে ধরা পড়ে যেত নিশ্চয় গোবিন্দ।
এদিকে গোবিন্দ খোঁড়ার দরবার গোল চক্করের পাঁচিলে,ওদিকে নহবতখানার ছাতে বসেছে তখন আমাদের সমশের কোচম্যানের মজলিস দড়ির খাটিয়া পেতে। সে যেন দ্বিতীয় টিপু সুলতান বসে গেছে ফরসি হাতে। হাবসির মতো কালো রঙ,মাথার চুল বাবরিকাটা, পরনে শাদা লুঙ্গি, হাতকাটা মেরজাই, চোখে সুর্মা, মেদিতে লাল মোচড়ানো গোঁফ, সিঁথেকাটা দাড়ি। বাবামশায় হাওয়া খেতে যাবার পূর্বে ঠিক সময়ে সে সেজেগুজে বার হত। চুড়িদার পাজামা, রুপোলি বকলস দেওয়া বার্নিশ জুতো, আঙুলে রুপো-বাঁধা ফিরোজার আংটি, গায়ে জরিপাড়ের লাল বনাতের বুককাটা কাবা তকমা আঁটা, কাঁধে ফুল-কাটা রুমাল, মাথায় থালার মতো মস্ত একটা শামলা, কোমরে দুই সহিসে মিলে জড়িয়ে দিয়েছে লম্বা সাপের মতো জরির কোমরবন্ধ। ফিটফাট হয়ে শমশের লাল চক্করের পাঁচিলে চাবুক হাতে দাঁড়াত আর সহিস শাদা জুড়ির ঘোড়া দুটোকে চক্করের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে বাইরে থেকে ফটক বন্ধ করে দিত। তখন শাদা ঘোড়া দুটোকে প্রায় দশ মিনিট সার্কাসের ঘোড়ার মতো চক্কর দিইয়ে তবে গাড়িতে জেতার নিয়ম ছিল। পাছে রাস্তায় ঘোড়া বজ্জাতি করে সেইজন্যে তাদের আগে থাকতে টিট করাই উদ্দেশ্য। এই এই দুর্দান্ত কোচম্যান, ঘোড়াও তার তেমনি, গাড়িখানা থেকে যেন ঝড়ের মতো বেরিয়ে পড়ত। কোচবাক্সের উপরে দেখতেম খাড়া দাঁড়িয়ে সমশের হাঁকড়াচ্ছে চাবুক। ফেটিং-গাড়ি ছিল খুব উঁচু। গাড়িবারান্দার খিলেনের কাছটাতে এসেই ঝপ্ করে সমশের নিজের আসনে বসে পড়ত গম্ভীর হয়ে। তার পর এক সময়ে ঘোড়া গাড়ি কোচম্যান সাজগোজ সব নিয়ে একটা জমজমাট শোভাযাত্রার দৃশ্য রাস্তার উপর খানিক ঝলক টেনে বেরিয়ে যেত গড়ের মাঠে—আতর গোলাপের খোশবুতে যেন উত্তর দিকটা মাত করে দিয়ে।
এরই একটু পরেই নন্দ ফরাশ দু'হাতে আঙুলের ফাঁকে বড়ো বড়ো তেলবাতির সেজ দুটো আদ্ভুত কায়দাতে হাতের তেলোয় অটল ভাবে বসিয়ে উঠে চলত ফরাশখানা থেকে বৈঠকখানায়। তার পর ড্রপ পড়ত রঙ্গমঞ্চে, এবং নোটো খোঁড়া, নন্দ ফরাস দুয়ে মিলে বেহালা বাদন দিয়ে সেদিনের মতো পালা সাঙ্গ হত সন্ধেবেলায়। তখন পিদুমের ধারে বসে রূপকথা শোনা, ইকড়ি মিকড়ি ঘুটি-খেলার সময় আসত।
সেই ঘরের এককোনে বসে রূপকথা বলে একটা দাসী—দাসীটার চেয়ে তার রূপকথাটাকে বেশি মনে পড়ে। এই দাসীটা ছিল আমার ছোটো বোনের। সে বলে তার দাসীর নাম ছিল মঞ্জরী। আর দোয়ারি চাকর এই কবিত্বপূর্ণ মঞ্জরী নামটির নামের ডগাটা বঁটির ঘায়ে উড়িয়ে দিয়েছিল তাও বলে সে, কিন্তু আমি দেখি মঞ্জরীকে শুধু একটা গড়-পরা নাকভাঙা নাম, বসে আছে একটা লাল চামড়ার তোরঙ্গ ঠেস দিয়ে দুই পা ছাড়িয়ে। তোরঙ্গটার সকল গায়ে পিতলের পেরেক মালার মতো করে আঁটা। মঞ্জরী বিামোচ্ছে আর কথা বলছেঃ 'এক ছিল টুনটুনি—সে নিমগাছে বাসা না বেঁধে রাজবাড়ির ছাতের আল্সেতে থাকে, আর রাজপুত্তুরের তোশক থেকে তুলো চুরি করে করে ছোট্ট একটি বাসা বাঁধে।
ছাতে ওঠবার সিঁড়ি বলে একটা কিছু নেই তখনো আমার কাছে, অথচ টুনটুনির বাসার কাছটায়—একেবারে নীল আকাশের গায়ে, ছাতের কার্নিসে উঠে গিয়ে বসি পা ঝলিয়ে।
এমনি দিনের বেলায় রূপকথার সিঁড়ি ধরে পাখির সঙ্গে পেতেম ছাতের উপরের দিকটা। আবার রোজই নিশুতি রাতে মাথার উপরে পেতেম শুনতে হুটোপুটি করছে ছাতটা—ভাট গড়গড় গড়াচ্ছে, দুমদুম লাফাচ্ছে। ছাতটা তখন ঠেকত ঠিক একটা অন্ধকার মহারণ্য বলে —যেখানে সন্ধেবেলা গাছে গাছে ভোঁদড় করে লাফালাফি, আর আকাশ থেকে জুঁই ফুল টিকিতে বেঁধে ব্রহ্মদৈত্য থাকে এ-ছাত ও-ছাত পা মেলে দাঁড়িয়ে ধ্যান করে। এমনি করে গল্প-কথার মধ্যে দিয়ে কত কী দেখেছি তখন। যখন চোখও চলে না বেশিদূর, পাও হাঁটে না। অনেকখানি, তখন কান ছিল সহায়। সে এনে পৌঁছে দিত কাছে ছাত, হাতে এনে দিত কমলাফুলির টিয়ে পাখি, চড়িয়ে দিত আগড়ুম-বাগড়ুম ঘোড়ায়, লাটসাহেবের পালকিতে এবং নিয়ে যেত মাসিপিসির বনের ধারের ঘরটাতে আর মামার বাড়ির দুয়োরেও।
মায়ের অনেকগুলি দাসী ছিল—সৌরভী, মঞ্জরী, কামিনী কত কী তাদের নাম । অনেকদিন অন্তর দেশে যেত এরা সব গাঁয়ের মেয়ে—অনেকদিন পরে ফিরত আবার। কখনো বা এরা দল বেঁধে যেত গঙ্গা নইতে পার্বণে, আর নিয়ে আসত দু'চারটে করে খেলনা, পীরের ঘোড়া, সবজে টিয়ে, কাঠের পাল্কি, মাটির জগন্নাথ, সোনার ময়ূর, আতা গাছে তোতা, ঢেঁকি, বঁটি । এমনি নানা রূপকথার দেশের, ছড়ার দেশের পশু, পক্ষী, ফুল, ফল, তৈজসপত্র সবাইকে পেতেম চোখের কাছেই কিন্তু মাসিপিসির ঘর আর মামার দেখা দিয়েও দিত না—বাড়ির ছাতের মতই অজ্ঞাতবাসে ছিল । মঞ্জরী দাসী এক-একদিন খেয়ালমতো খোলা জানলার ধারে তুলে ধরত আর বলত —ওই দ্যাখ্ মামার বাড়ি। বাড়ির সন্ধানে উত্তর আকাশ হাতড়াত চোখ, দেখত না একখানিও ইঁট, শুধু পড়ত চোখে তখন আমাদের বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণে মস্ত তেঁতুল গাছটার শিয়রে মন্দিরের চূড়োর মতো শাদা শাদা মেঘ স্হির হয়ে আছে। ওইটুকু দেখিয়েই দাসী নামিয়ে দিত কোল থেকে খড়খড়ির তলার মেঝেতে। তারপর সে দরজা-জানলা বন্ধ করে দিয়ে রান্না-বাড়িতে ভাত খেতে যেত একটা বগি-থালা সিন্দুকের পাশ থেকে তুলে নিয়ে।
প্রায় রাতেরই মতো চুপচাপ আর অন্ধকার হয়ে যেত ঘরখানা দিনদুপুরে। সবজে খড়খড়িগুলো সোনালি দাঁড়ি টানা একটা-একটা ডুরে-কাপড়ের পর্দার মতো ঝুলত চৌকাঠ থেকে—কাঠের তৈরি বলে মনেই হত না জানালাণ্ডলো! বাইরের খানিকটা আঁচ পাওয়া যেত খড়খড়ির ফাঁকে ফাঁকে, সুতোর সঞ্চারে পৌঁছত এসে আকাশের দিক থেকে চিলের ডাক। বাতাসেরও ডাক খুব মিহি সুর দিয়ে কানে আসত—ঝড়ের একটা আবছায়া মনে পড়ত—একটা দুটো কোমল টান প্রথমে, তার পর খানিক চড়া সুর, তার পর বেশ একটা ফাঁক, তার ঠিক পরেই একখানা তীব্র সুর বাতাসের। এমনি গোটা দুই-তিন আওয়াজ, আর কিছু নেই যখন তিনতলায়, তখন সেই নিঃসাড়াতে চোখ দুটো দেখতে বার হত—যেন রাতের শিকারী জন্তু খুজত। এটা ওটা সেটা এদিক ওদিক সেদিক সন্ধানে চলত সেদিনের আমিও তক্তার নীচে, সিঁড়ির কোণে, সার্সির ফাঁকে, আয়নার উলটো পিঠে এবং চৌকি বেয়ে আলমারির চালে নানা জিনিস আবিষ্কার করার দিকে। ছাতের কথা ভুলেই যাই—তখন ঘর দেখতেই মশগুল থাকে মন ! এক ছোটো ছেলেমেয়েদের ছাড়া এই সময়টাতে খানিকক্ষণের মতো কাউকে পেত না তিনতলার ঘরগুলো। কাজেই এসময়ে আমাদের সঙ্গে যেন ছাড়া পেয়ে জিনিসগুলোও হঠাৎ বেঁচে উঠত, এবং তারাও বেরিয়েছে দিনদুপুরের অন্ধকারে খেলার চেষ্টায়—এটা ভাবে জানাত।
সারা তিনতলার দেওয়াল, ছবি, সিঁড়ি, তক্তা, আলমারি, ফুলদানি, মায় মেঝেতে পাতা মস্ত জাজিম এবং কড়িতে ঝোলানো পাখাগুলোর সঙ্গে এমনি করে দুপুরে ঘরে ঘরে ফিরে আর উঁকি দিয়ে, সারা তিনতলা কতদিনে পেয়েছিলেম, পুরোপুরি ভাবে তা বলা যায় না। একটা দোলনা-খাট—ছোট্ট, সেটা খাট থাকতে থাকতে হঠাৎ কবে একদিন জাহাজ হয়ে উঠল এবং দুলে দুলে আমাদের নিয়ে সমুদ্রে চালাচল শুরু করলে। মস্ত জাজিম বিছানা ক'জোড়া ছোটো হাতের তাড়ায় যেন ফুলে ফুলে উঠল—যেন ক্ষীর সাগরে ঢেউ তুলে।
২০
দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। ডবল ব্ল্যাকেটের মতো করে কাটা, গোলাপী রঙের ছোপ ধরানো মার্বেল পাথরের একটা টেবিল এক কোণে রয়েছে, তার উপরে পাথরে-কাটা দুটি পায়রা ফল খেতে নেমেছে–সত্যিকার মতো পাখির আর আপেলের রঙ দেখে লোভ জাগে মনে। ঘরের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে বড়ো হল্টাতে উঠে যাবার পাঁচ ধাপ সিঁড়ি—তারই গায়ে অনেক উপরে একটা ব্যাকেট তোলা আছে, চৌকো কাচের ঢাকনা দেওয়া, গোপাল পালের গড়া লক্ষ্মী আর সরস্বতী—ছোট্ট ছোট্ট আসল মানুষর মতো রঙ-করা কাপড় পরানো। দেশী কুমোরের হাতে গড়া এই খেলনা দেবতার কাছেই, দরজার উপর খাটানো চওড়া গিলটির ফ্রেমে বাঁধানো, তেল রঙ-করা বিলিতী একটা মেমের ছবি। চোখ তার কালো, চুল কটা নয় একটুও, মাথায় একটা রাঙা কানঢাকা টুপি, খয়েরী মখমলের জামা হাতকাটা, শাদা ঘাঘরা পরনে। সে বাঁ হাতে একটা ঝুড়ি নিয়েছে, রুমাল ঢাকা চুবড়ির মধ্যে থেকে যেন একটা সত্যিকারের কাচের বোতল গলা বার করেছে। ডান হাত রেখেছে মেয়েটা ঠিক যেন সত্যিকার মস্ত একটা কুকুরের পিঠে। কুকুর চেয়ে আছে ঝুড়ির দিকে, মেয়েটা চেয়ে আছে কুকুরের দিকে। একেবারে জল-জীয়ন্ত মানুষ আর কুকুরের আর মখমল আর ঝুড়ি আর ব্রান্ডির বোতল—কিছুতেই মনে হত না অথচ সেটা ছবি নয়।
মায়ের এই বসবার ঘরের পাশেই পশ্চিম দিকে বাবামশায়ের শোবার ঘরটা নতুন করে সাজানো হচ্ছে তখন। মস্ত একটা চাবি দিয়ে সে ঘরের দরজটা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু জানছি সেখানে সাহেব মিস্ত্রি লাল, শাদা, হলদে, কালো নতুন রকমের বিলিতী টালি কেটে কেটে বসাচ্ছে মেঝেতে-ঠুকঠাক খিটখাট ছেনির শব্দ হচ্ছেই সেখানে সারাদিন। ঘরটা যেদিন খুলল দুয়োর, সেদিন দেখি সেখানে সবক'টা জানলা-দরজার মাথায় মাথায় সোনার জল করা কারনিস বসে গেছে, আর সেগুলো থেকে ফুলকাটা ফিনফিনে পর্দা জোড়া জোড়া ঝুলছে সবজে আর সোনালী রেশম পাকানো মোটা দড়ায় ফাঁসে লটকানো। ঘরজোড়া পালঙ আয়নার মতো বার্নিশ করা। ঘরটার পশ্চিমমুখো জানালাটা খুলে তার ওধারটাতে- বানিয়েছে অক্ষয় সাহা ইঞ্জিনিয়ারবাবু একটা গাছঘর, কাঠ আর টিন আর ঘষা কাচের সার্সি দিয়ে। সেখানে দেওয়াল গুলো আগাগোড়া গাছের ছালের টুকরো দিয়ে মুড়ে ভাগবত মালী লটকে দিয়েছে সব বিলিতী দামী পরগাছা। কোনোটা সাপের ফণার মতো বাঁকা, কোনোটার লম্বা পাতা দুটো সাপের খোলসের মতো ছিট দেওয়া ড়োরাকাটা। কিন্তু এর একটা পরগাছাতেও ফুলফল কিছুই নেই। কোনোটাতে বা পাতাও নেই, কেবল সেটা আর কাঁটা।
এই গাছঘরের মাঝে একটা তিনফকোর দালানের মতো খাঁচা। তারের টেবিল তাতে হলদে রঙের এক জোড়া কেনেরি পাখি ধরা থাকে। শোবার ঘরটা তখনো নিজের সাজ সম্পূর্ণ করে নি ফুলদানি ইত্যাদি দিয়ে। শুধু সরু পাথরের তাকের সঙ্গে আঁটা গোল চুল-বাঁধার আয়নাখানা মায়ের রয়েছে একটা দিকে। এই আয়নাখানাকে ঘিরে মিহি গিল্টির পাড়, তাতে সবজে আর শাদা মিনকারি দিয়ে নকশাকরা জুঁইফুল আর কচি পাতার একগাছি গোড়ে মালা । এরই সামনে স্ফটিক কাটা চৌকোনো একটি ফুলদানি মাঝখানে সোনার বোঁটাতে আটকানো যেন বরফ-কুঁচি দিয়ে গড়া ভুঁইচাপা-সোনার ডাটি তাকে নিয়ে ঝুঁকে পড়েছে। জলের মতো পরিষ্কার আয়নার দিকে চেয়ে ফুল দেখছে ফুলের একখানি ছায়া স্থির হয়ে।