সৌন্দর্যের সন্ধান
সুন্দরের সঙ্গে তাবৎ জীবেরই মনে ধরার সম্পর্ক, আর অসুন্দরের সঙ্গে হল মনে না ধরার ঝগড়া। ইমারতে ঘেরা বন্দীশালার মতো এই যে শহরের মধ্যে এখানে ওখানে একটুখানি বাগান, অনেকখানিই যার মরা এবং শ্রীহীন, এদের পাখি প্রজাপতির মনে ধরেছে তবেই না এরা এইসব বাগানে বাসা বেঁধে এই ধুলোমাখা রোদে সকাল সন্ধ্যে ডানা মেলে সুরে ছন্দে ভরে তুলছে শহরের বুকের আবদ্ধ অফুলন্ত স্থানটুকু! আর এইসব বাগানের ধারেই রাস্তায় বসে খেলছে ছেলেরা— শিশুপ্রাণ তাদের মনে ধরেছে বাগানের ফুলকে ছেড়ে রাস্তার ধুলো মাটি, তাই তো খেলছে ওরা ধুলোকে নিয়ে ধুলোখেলা! রথের দিনে রথো সামগ্রী— সোলার ফুল পাতার বাঁশি— তার সুর আর রং আর পরিমল ছড়িয়ে পড়েছে বাদলার দিনে— রথতলার আর খেলাঘরের ছেলে বুড়োর মেলায়, তাই না আজ দেখছি নিজেদের ঘর সাজাচ্ছে মানুষ সোলার ফুলে মাটির খেলনায়! তেমনি সে আমার নিজের কোণটি, দেওয়ালের ফাঁকে ভাঙা কাচের মতো একখণ্ড আকাশ— ময়লা ঝাপ্সা প্রাচীরে ঘেরা চারটিখানি ঘাস চোরকাঁটা আর দোপাটি ফুলের খেলাঘর, সবই মনে ধরেছে আমার, তাই না কোণের দিকে মন থেকে থেকে দৌড় দিচ্ছে, চোরকাঁটার বনে লুকোচুরি খেলছে, নয়তো দোপাটি ফুলের রঙের ছাপ নিয়ে লিখছে ছবি, স্বপন দেখছে রকম রকম, আর থেকে থেকে ঠিক নাকের সামনে মাড়োয়ারিদের আকাশ বাতাস আড়াল-করা চৌতলা পাঁচতলা বাড়িগুলোর সঙ্গে আড়ি দিয়ে বলে চলেছে বিশ্রী বিশ্রী বিশ্রী! মাড়োয়ারি গৃহস্থরা কিন্তু ওদের পায়রার খোপগুলোকে সুন্দর বাসা বলেই বোধ করছে এবং তাদের নাকের সামনে আমাদের সেকেলে বাড়ি আর ভাঙাচোরা বাগানকে অসুন্দর বলছে! কাজেই বলতে হবে আয়নাতে যেমন নিজের নিজের চেহারা তেমনি মনের দর্পণেও আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের মনোমতোকে সুন্দরই দেখি। কারু কাছ থেকে ধার-করা আয়না এনে যে আমরা সুন্দরকে দেখতে পাব তার উপায় নেই। সুন্দরকে ধরবার জন্যে নানা মুনি নানা মতো আরশি আমাদের জন্যে সৃজন করে গেছেন, সেগুলো দিয়ে সুন্দরকে দেখার যদি একটুও সুবিধা হত তো মানুষ কোন কালে এইসব আয়নায় কাচ গালিয়ে মস্ত একটা আতশী কাচের চশমা বানিয়ে চোখে পরে বসে থাকত, সুন্দরের খোঁজে কেউ চলত না; কিন্তু সুন্দরকে নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ঘরকন্না তাই সেখানে অন্যের মনোমতোকে নিয়ে থাকাই চলে না, খুঁজে পাতে আনতে হয় নিজের মনোমতোটি।
জীবের মনস্তত্ত্ব যেমন জটিল যেমন অপার, সুন্দরও তেমনি বিচিত্র তেমনি অপরিমেয়। কেউ কাজকে দেখছে সুন্দর সে দিনরাত কাজের ধান্ধায় ছুটছে, কেউ দেখছে অকাজকে সুন্দর সে সেই দিকেই চলেছে, কিন্তু মনে রয়েছে দু-জনেরই সুন্দর কাজ অথবা সুন্দর রকমের অকাজ! ধনী খুঁজে ফিরছে তার সর্বস্ব আগ্লাবার সুন্দর চাবিকাঠি, বিশ্রী তালাচাবি কেউ খোঁজে না— আর দেখো চোর সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সন্ধি কাটবার সুন্দর সিঁদ! ভক্ত খুঁজছেন ভক্তিকে, শাক্ত খুঁজছেন শক্তিকে আর নর খোঁজে গাড়িজুড়ি, বি. এ. পাসের পরেই বিয়েতে সোনার ঘড়ি এবং তার কিছু পরেই চাকরি এবং এমন সুন্দর একটা বাসাবাড়ি যেখানে সব জিনিস সুন্দর করে উপভোগ করা যায়। হা-হুতাশ কচ্ছেন কবি কল্পনালক্ষ্মীর জন্যে এবং ছবি-লিখিয়ের হা-হুতাস হচ্ছে কলালক্ষ্মীর জন্যে, ধরতে গেলে সব হা-হুতাশ যা চাই সেটা সুন্দরভাবে পাই এইজন্যে, অসুন্দরের জন্যে একেবারেই নয়। সুন্দরের রূপ ও তার লক্ষণাদি সম্বন্ধে জনে-জনে মতভেদ কিন্তু সুন্দরের আকর্ষণ যে প্রকান্ড আকর্ষণ এবং তা আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে জড়ানো সে বিষয়ে দুই মত নেই।
যেভাবেই হোক যা কিছু বা যারই সঙ্গে আমরা পরিচিত হচ্ছি তার দুটো দিক আছে— একটা মনে ধরার দিক যেটাকে বলা যায় বস্তুর ও ভাবের সুন্দর দিক, আর একটা মনে না ধরার দিক যেটাকে বলা চলে অসুন্দর দিক, আমাদের জনে-জনে মনেরও ঐ দু রকম দৃষ্টি— যাকে বলা যায় শুভ আর অশুভ বা সু আর কু দৃষ্টি। কাজেই দেখি, যে দেখছে তার মন আর যাকে দেখছে তার মন— এই দুই মন ভিতরে ভিতরে মিলল তো সুন্দরের স্বাদ পাওয়া গেল, না হলেই গোল। রাধিকা কৃষ্ণকে সুরূপ শ্যামসুন্দর দেখেছিলেন, তারপর অনঙ্গভীমদেব এবং তারপর থেকে আমাদের সবার কাছে রূপকসুন্দরভাবে কৃষ্ণ এলেন, এই দুই মূর্তিই আমাদের শিল্পে ধরা হয়েছে, এখন কোন সমালোচকের সৌন্দর্য সমালোচনার ওপর নির্ভর করে এই দুই মূর্তির বিচার করব? আ-কা-শ এই তিনটি অক্ষরে আকাশ-জ্ঞানটাই রূপকের দল বলবে ভালো, কিন্তু রূপের সেবক তারা বলবে ‘নব-নীরদ-শ্যাম’ যা দেখে চোখ ভুলল মন ঝুলল, যার মোহন ছায়া তমাল গাছে যমুনার জলে এসে পড়ল সেই সুন্দর। সুন্দর-অসুন্দর সম্বন্ধে শেষ কথা যদি কেউ বলতে পারে তো আমাদের নিজের নিজের মন। পণ্ডিতের কাজই হচ্ছে বিচার করা এবং বিচার করে দেখতে হলেই বিষয়কে বিশ্লেষ করে দেখতে হয়, সুত্রাং সুন্দরকেও নানা মুনি নানা ভাবে বিশ্লেষ করে দেখেছেন, তার ফ্লে তিল তিল সৌন্দর্য নিয়ে তিলোত্তমা গড়ে তোলবার একটা পরীক্ষা আমাদের দেশে এবং গ্রীসে হয়ে গেছে, কিন্তু মানুষের মন সেই প্রথাকে সুন্দর বলে স্বীকার করেনি এবং সেই প্রথায় গড়া মূর্তিকেই সৌন্দর্যসৃষ্টির শেষ বলেও গ্রাহ্য করেনি। বিশেষ বিশেষ আর্টের পক্ষপাতী পণ্ডিতেরা ছাড়া কোনো আর্টিস্ট বলেনি অন্য সুন্দর নেই, ঐটেই সুন্দর। আমাদের দেশ যখন বললে— সুন্দর গড়ো কিন্তু সুন্দর মানুষ গড়ো না, সুন্দর করে দেবমূর্তি গড়ো সেই ভালো, ঠিক সেই সময় গ্রীস বললে—না, মানুষকে করে তোলো সুন্দর দেবতার প্রায় কিংবা দেবতাকে করে তোলো প্রায় মানুষ! আবার চীন বললে— খবরদার, দেবভাবাপন্ন মানুষকে গড়ো তো দৈহিক এবং ঐহিক সৌন্দর্যকে একটুও প্রশ্রয় দিও না চিত্রে বা মূর্তিতে। নিগ্রোদের আর্ট, যার আদর এখন ইউরোপের প্রত্যেক আর্টিস্ট করছে তার মধ্যে আশ্চর্য রং-রেখার খেলা এবং ভাস্কর্য দিয়ে আমরা যাকে বলি বেঢপ বেয়ারা তাকেই সুন্দরভাবে দেখানো হচ্ছে।
সুতরাং সুন্দরের স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আদর্শ আর্টিস্টের নিজের নিজের মনে ছাড়া বাইরে নেই, কোনো কালে ছিল না, কোনো কালে থাকবেও না এটা একেবারে নিশ্চয় করে বলা যেতে পারে। সুন্দর যদি খিচুড়ি হত তবে এতদিনে সৌন্দর্যের তিল ও তাল মিলিয়ে কোনো-এক বেরসিক পরম সুন্দর করে সেটা প্রস্তুত করে যেত তথাকথিত কলারসিকদের জন্য, কিন্তু একমাত্র যাঁকে মানুষ বললে ‘রসো বৈ সঃ’ তিনিও সুন্দরের পরিপূর্ণ আদর্শ জনে-জনে মনে-মনে ছাড়া আপনার সৃষ্টিতে একত্র ও সম্পূর্ণভাবে কোথাও রাখেননি। তাঁর সৃষ্টি, এটি সুন্দর অসুন্দর দুই-ই, এবং সব দিক দিয়ে অপূর্ণও নয় পরিপূর্ণও নয় এই কথাই তিনি স্পষ্ট করে যে জানতে চায় তাকেই জানিয়েছেন। শান্তিতে-অশান্তিতে সুখে-দুঃখে সুন্দরে-অসুন্দরে মিলিয়ে হল ছোট এই নীড়, তারি মধ্যে এসে মানুষের জীবনকণা পরম সুন্দরের আলো পেয়ে ক্ষণিকের শিশিরবিন্দুর মতো নতুন নতুন সুন্দর প্রভা সুন্দর স্বপ্ন রচনা করে চলল। এই হল প্রথম শিল্পীর মানস কল্পনা ও এই বিশ্বরচনার নিয়ম, এ নিয়ম অতিক্রম করে কোনো কিছুতে পরিপূর্ণতাকে প্রত্যক্ষ রূপ দিতে পারে এমন আর্টও নেই আর্টিস্টও নেই। যা বিশ্বের মানুষের মনে বিচিত্র পদার্থের মধ্য দিয়ে বিচিত্র হয়ে ফুটতে চাচ্ছে সেই পরম সুন্দরের স্পৃহা জেগেই রইল, মিটল না। যদি পরম সুন্দরের প্রত্যক্ষ উপমান পেয়ে সত্যই কোনো দিন মিটে যায় মানুষের এই স্পৃহা, তবে ফুলের ফুটে ওঠার, নদীর ভরে ওঠার, পাতার ঘন সবুজ হয়ে ওঠার, আগুনের জ্বলে ওঠার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও ছবি আঁকা মূর্তি গড়া কবিতা লেখা গান গাওয়া ইত্যাদির স্পৃহা আর থাকে না। চাঁদ একটুখানি চাঁচ্নী থেকে আরম্ভ করে পূর্ণ সুন্দর হয়ে ওঠবার দিকে গেলেও যেমন শেষে একটুখানি অপরিণতি তার গোলটার মধ্যে থেকেই যায়, তেমনি মানুষের আর্টও কোথাও কখনো পূর্ণ সুন্দর হয়ে ওঠে না। মানুষ জানে সে নিজে অপূর্ণ, তাই পরিপূর্ণতার দিকে যাওয়ার ইচ্ছা তার এতখানি। গ্রিস ভারত চীন ঈজিপ্ট সবাই দেখি পরম সুন্দরের দিকে চলেছে, কিন্তু সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা কেউ পায়নি, কেবল পেতে চাওয়ার দিকেই চলেছে। আজ যেখানে মনে হল আর্ট দিয়ে বুঝি যতটা সুন্দর হতে পারে তাই হল, কাল দেখি সেখানেই এক শিল্পী দাঁড়িয়ে বলছে, হয়নি, আরো এগোতে হবে কিংবা পিছিয়ে অন্য পন্থা ধরতে হবে। পরম সুন্দরের দিকে মানুষের মন ও সঙ্গে সঙ্গে তার আর্টের গতি ঠিক এইভাবেই চলেছে— গতি থেকে গতিতে পৌঁছচ্ছে আর্ট, এবং একটা গতি আর-একটা গতি সৃষ্টি করছে, ঢেউ উঠলো ঠেলে, মনে করলে বুঝি চরম উন্নতিকে পেয়েছি অমনি আর-এক ঢেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ব্ললে্ চলো, আরো বাকি আছে। এইভাবে সামনে আশেপাশে নানা দিক থেকে পরম সুন্দরের টান মানুষের মনকে টানছে বিচিত্র ছন্দে বিচিত্রতার মধ্য দিয়ে, তাই মানুষের সৌন্দর্যের অনুভূতি তার আর্ট দিয়ে এমন বিচিত্র রূপ ধরে আসছে— চিরযৌবনের দেশে ফুল ফুটেই চলেছে নতুন নতুন।
মানুষ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মনে মনে ভাবে, সুন্দর! ঠিক সেই সময় আর একটি সুন্দর মুখের ছায়া আয়নায় পড়ে; যে ভাবছিল সে অবাক হয়ে বলে, তুমি যে আমার চেয়ে সুন্দর, অমনি স্বপ্নের মতো সুন্দর ছায়া হেসে বলে, আমার চোখে তুমি সুন্দর! এইভাবে এক আর্টে আর এক আর্টে, এক সুন্দরে আর এক সুন্দরে পরিচয়ের খেলা চলেছে, জগৎ-জুড়ে সুন্দর মনের সুন্দরের সঙ্গে মনে মনে খেলা। পরিপূর্ণ সৌন্দর্যকে আর্ট দিয়ে ধরতে পারলে এ খেলা কোন কালে শেষ হয়ে যেত। যে মাছ ধরে তার ছিপে যদি মৎস্য-অবতার উঠে আসত তবে সে মানুষ কোনো দিন আর মাছ ধরাধরি খেলা করত না, সে তখনি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে কলম হাতে মাছ বিক্রির হিসেব পরীক্ষা করতে বসত, আর যদি তখনও খেলার আশা তার কিছু থাকত তো এমন জায়গায় গিয়ে বসত যেখানে মাছ ছিপে ধরাই দিতে আসে না, ধরি-ধরি করতে করতে পালায়! পরম সুন্দর যিনি তিনি লুকোচুরি খেলতে জানেন, তাই নিজে লুকিয়ে থেকে বাতাসের মধ্য দিয়ে তাঁর একটু রূপের পরিমল, আলোর মধ্য দিয়ে চকিতের মতো দেখা ইত্যাদি ইঙ্গিত দিয়ে তিনি আর্টিস্টদের খেলিয়ে নিয়ে বেড়ান, আর্টিস্টের মনও সেইজন্যে এই খেলাতে সাড়া দেয়, খেলা চলেও সেই জন্যে। এক-একটা ছেলে আছে খেলতে জানে না খেলার আরম্ভেই হঠাৎ কোণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ধরা পড়ে রস-ভঙ্গ করে দেয় আর সব ছেলেগুলো তার সঙ্গে আড়ি দিয়ে বসে। তেমনি পরম সুন্দরও যদি আর্টিস্টদের সামনে হঠাৎ বেরিয়ে এসে রসভঙ্গ করতে বসেন তবে আর্টিস্টরা তাঁকে নিয়ে বড় গোলে পড়ে যায় নিশ্চয়ই। আর্টিস্টরা ভক্তেরা কবিরা— পরম সুন্দরের সঙ্গে সুন্দর-সুন্দর খেলা খেলেন কিন্তু পণ্ডিতেরা পরম সুন্দরকে অণুবীক্ষণের উপরে চড়িয়ে তাঁর হাড়হদ্দের স্টহিক হিসেব নিতে বসেন। কাজেই দেখি যারা খেলে আর যারা খেলে না সৌন্দর্য সম্বন্ধে এ দুয়ের ধারণা এবং উক্তি সম্পূর্ণ বিভিন্ন ধরনের। পণ্ডিতেরা সৌন্দর্য সম্বন্ধে বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট কথা লিখে ছাপিয়ে গেছেন, সেগুলো পড়ে নেওয়া সহজ কিন্তু পড়ে তার মধ্যে সৌন্দর্যের আবিষ্কার ক্রাই শক্ত। আর্টিস্ট তারা সুন্দরকে নিয়ে খেলা করে সুন্দরকে ধরে আনে চোখের সামনে মনের সামনে অথচ সৌন্দর্য সম্বন্ধে বলতে গেলে সব আগেই তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায় দেখতে পাই। ‘সুন্দর কাকে বলো’ এই প্রশ্নের জবাবে আর্টিস্ট ড্রুরার বললেন, ‘আমি ওসব জানিনে বাপু’ অথচ তাঁর তুলির আগায় সুন্দর বাসা বেঁধেছিল। লিয়োনার্ডো দ্য ভিন্চি যাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর্ট থেকে আরম্ভ করে বিচিত্র জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করে গেছে, তিনি বলেছেন— পরম সুন্দর ও চমৎকার অসুন্দর দুই-ই দুর্লভ, পাঁচপাঁচিই জগতে প্রচুর।
এক সময়ে আর্টিস্টদের মনে জায়গা জায়গা থেকে তিল-তিল করে বস্তুর খন্ড খন্ড সুন্দর অংশ নিয়ে একটা পরিপূর্ণ সুন্দর মূর্তি রচনা করার মতলব জেগেছিল। গ্রিসে এক কারিগর এইভাবে হেলেনের চিত্র পাঁচজন গ্রীক সুন্দরীর পঞ্চাশ টুকরো থেকে রচনা করে সমস্ত গ্রিসকে চমকে দিয়েছিল। কিছুদিন ধরে ঐ মূর্তিরই জল্পনা চলল বটে কিন্তু চিরদিন নয়, শেষে এমনও দিন এল যে ঐভাবে তিলোত্তমা গড়ার চেষ্টা ভারি মূর্খতা একথাও আর্টিস্টরা বলে বসল! আমাদের দেশেও ঐ একই ঘটনা— শাস্ত্রসম্মত মূর্তিকেই রম্য বলে পণ্ডিতেরা মত প্রকাশ করলেন, সে শাস্ত্র আর কিছু নয় কতকগুলো মাপজোখ এবং পদ্ম-আঁখি, খঞ্জন-নয়ন, তিলফুল, শুকচঞ্চু, কদলীকাণ্ড, কুক্কুটান্ড, নিম্বপত্র এইসব মিলিয়ে সৌন্দর্যের এবং আধ্যাত্মিকতার একটা পেটেন্ট খাদ্যসামগ্রী! মনের খোরাক এভাবে প্রস্তুত হয় না, কাজেই আমাদের শাস্ত্রসম্মত সুতরাং বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক যে artificiality তা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগলেও সেখানেই আর্ট শেষ হল না একথা খাটল না। একেষাং মতম্ বলে একটা জিনিস সে বলে উঠল ‘তদ্ রম্যং যত্র লগ্নং হি যস্য হৃৎ’, মানে যার যা ধরল সেই হল সুন্দর। এখন তর্ক ওঠে— মনে ধরা না-ধরার উপরে সুন্দর-অসুন্দরের বিচার যদি ছেড়ে দেওয়া যায় তবে কিছু সুন্দর কিছুই অসুন্দর থাকে না সবই সুন্দর সবই অসুন্দর প্রতিপন্ন হয়ে যায়, কোনো কিছুর একটা আদর্শ থাকে না। ভক্ত বলেন ভক্তিরসই সুন্দর আর সব অসুন্দর, যেমন শ্রীচৈতন্য বললেন--
“ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাম্বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ ভক্তিরহৈতুকি ত্বয়ি।।” (১)
আর্টিস্ট বললেন,— কাব্যং যশসে অর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবেতরক্ষতয়ে ইত্যাদি।(২) যার মন যেটাতে টানল তার কাছে সেইটেই হল সুন্দর অন্য সবার চেয়ে। এখন সহজেই আমাদের মনে এই দ্বিধা উপস্থিত হয়— কোন দিকে যাই, ভক্তের ফুলের সাজিতে গিয়ে উঠি, না আর্টিস্টের বাঁশিতে গিয়ে বাজি? কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায়, ঘোরতর বৈরাগী এবং ঘোরতর অনুরাগী দুই জনেই চাইছেন একই জিনিস— ভক্ত ধন চাইছেন না কিন্তু সব ধনের যা সার তাই চাইছেন, জন চাইছেন না কিন্তু সবার যে আপনজন তাকেই চাইছেন, সুন্দরী চান না কিন্তু চান ভক্তি, কবিতা নয় কিন্তু যিনি কবি যিনি স্রষ্টা— সুন্দরের যিনি সুন্দর— তাঁর প্রতি অচলা যে সুন্দরী ভক্তি তার কামনা করেন। আর্টিস্ট ও ভক্ত উভয়ে শেষে গিয়ে মিলেছেন যা চান সেটা সুন্দর করে পেতে চান এই কথাই বলেন। মুখে সুন্দরী চাইনে বললে হবে কেন, মন টানছে বৈরাগীর ও অনুরাগীর মতোই সমান তেজে যেটা সুন্দর সেটার দিকে। মানুষের অন্তর-বাহির দুয়ের উপরেই সুন্দরের যে বিপুল আকর্ষণ রয়েছে তা সহজেই ধরা যাচ্ছে— শুনতে চাই আমরা সুন্দর, বলতে চাই সুন্দর, উঠতে চাই, বসতে চাই, চলতে চাই সুন্দর, সুন্দরের কথা প্রত্যেক পদে পদে আমরা স্মরণ করে চলেছি। পাই না-পাই, পারি না-পারি, সুন্দর বৌ ঘরে আনবার ইচ্ছা নেই এমন লোক কম আছে। যা কিছু ভাল তারি সঙ্গে সুন্দরকে জড়িয়ে দেখা হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। আমরা কথায়-কথায় বলি— গাড়িখানি সুন্দর চলেছে, বাড়িখানি সুন্দর বানিয়েছে, ওষুধ সুন্দর কাজ করছে; এমনকি পরীক্ষার প্রশ্ন আর উত্তরগুলো সুন্দর হয়েছে একথাও বলি। এমনি সব ভালর সঙ্গে সুন্দরকে জড়িয়ে থাকতে যখন আমরা দেখছি তখন এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে সুন্দরের আকর্ষণ আমাদের মনকে ভালর দিকেই নিয়ে চলে, আর যাকে বলি অসুন্দর তারও তো একটা আকর্ষণ আছে, সেও তো যার মন টানে আমার কাছে অসুন্দর হয়েও তার কাছে সুন্দর বলেই ঠেকে, তবে মনে-ধরা এবং মন-টানার দিক থেকে সুন্দরে-অসুন্দরে ভেদ করি কেমন করে? কাজেই সুন্দর-অসুন্দর দুই মিলে চুম্বক পাথরের মতো শক্তিমান একটি জিনিস বলেই আমার কাছে ঠেকছে। সুন্দরের দিকটা হল মনকে টেনে নিয়ে চলার দিক এবং অসুন্দরের দিকও হল মনকে টেনে নিয়ে চলার দিক। এখন এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে চুম্বক যেমন ঘড়ির কাঁটাকে দক্ষিণ থেকে পরে পরে সম্পূর্ণ উত্তরে নিয়ে যায় তেমনি সুন্দরের টান মানুষের মনকে ক্ষনিক ঐহিক নৈতিক এমনি নানা সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে মহাসুন্দরের দিকেই নিয়ে চলে, আর অসুন্দরের প্রভাব সেও মানুষের মনকে আর-এক ভাবে টানতে টানতে নিয়ে চলে কদর্যতার দিকেই। কিন্তু সত্যিকারের একটা কাঁটা আর চুম্বক নিয়ে যদি এই সত্যটা পরীক্ষা করতে বসা যায় তবে দেখব সুন্দরের একটা চিহ্ন দিয়ে তারি কাছে যদি চুম্বকের টানের মুখ রাখা যায় তবে কাঁটা সোজা সুন্দরে গিয়ে ঠেকবে নিজের ঘর থেকে, আবার ঐ চুম্বনের মুখ যদি অসুন্দর চিহ্ন দিয়ে সেখানে রাখা যায় তবে ও কাঁটা উল্টো রাস্তা ধরেই ঠিক অসুন্দরে গিয়ে না ঠেকে পারে না। কিন্তু এমন তো হয় যে, আমি যদি মনে করি তবে অসুন্দরের গ্রাস থেকেও কাঁটাকে আরো খানিক টেনে সুন্দরের কাছে পৌছে দিতে পারি কিংবা সুন্দরের দিক থেকে অসুন্দরে নামিয়ে দিতে পারি ! সুতরাং সুন্দর-অসুন্দরের মধ্যে কোনটাতে আমাদের দৃষ্টি ও সৃষ্টি সমুদয় গিয়ে দাঁড়াবে তার নির্দেশকর্তা হচ্ছে আমাদের মন ও মনের ইচ্ছা। মনে হল তো সুন্দরে গিয়ে লাগলেম, মনে হল তো অসুন্দরে গিয়ে পড়লেম কিংবা সুন্দর থেকে অসুন্দর, অসুন্দর থেকে সুন্দরে দৌড় দিলেম, মন ও মনের শক্তি হল এ বিষয়ে নিয়ন্তা। টানে ধরলে যে চুম্বক ধরেছে তার মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রয়োজন না রেখেই কাঁটা আপনিই তার চরম গতি পায়, কিন্তু এই গতিকে সংযত করে অধোগতি থেকে ঊর্ধ্ব বা ঊর্ধ্ব থেকে অধোভাবের দিকে আনতে হলে আমাদের মনের একটা ইচ্ছাশক্তি একান্ত দরকার। বিল্বমঙ্গল বারবনিতার প্রেমোন্মাদ থেকে বিভূর প্রেমোন্মাদে গিয়ে ঠেকলেন সে শুধু তাঁর মনটি শক্তিমান ছিল বলেই। নিকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টে, অসুন্দর থেকে সুন্দরে যেতে সেই পারে যার মন উৎকৃষ্ট ও সুন্দর, যার মন অসুন্দর সেও এইভাবে চলে ভাল থেকে মন্দে। আর্টিস্ট কবি ভক্ত এদের মন এমনিই শক্তিমান যে অসুন্দরের মধ্য দিয়ে সুন্দরের আবিষ্কার তাঁদের পক্ষে সহজ। ভক্ত কবি আর্টিস্ট সবাই এক ধরনের মানুষ; সবাই আর্টিস্ট, আর্টিস্টের কাছে ভেদ নেই পণ্ডিতের কাছে যেমন সেটা আছে। আর্টিস্টের কাছে রসের ভেদ আছে, মনের অবস্থাভেদে সু হয় কু, কু হয় সু এও আছে, তাছাড়া রূপভেদও আছে; কিন্তু সু কু-এর যে নিদিষ্ট সীমা পণ্ডিত থেকে আরম্ভ করে অপণ্ডিত পর্যস্ত টেনে দিচ্ছে, এ রূপ সে রূপের মাঝে সেই পাকাপোক্ত পাঁচিল নেই আর্টিস্টের কাছে। নীরসেরও স্বাদ পেয়ে আর্টিস্টের মন রসায়িত হয়, এইটুকুই তফাত আর্টিস্টের আর সাধারণের মনে। তুমি আমি যখন খরার দিনে পাখা আর বরফ বলে হাঁক দিচ্ছি আর্টিস্ট তখন সুন্দর করে খরার দিন মনে ধরে কবিতা লিখলে—‘কাল বৈশাখী আগুন ঝরে, কাল বৈশাখী রোদে পোড়ে! গঙ্গা শুকু-শুকু আকাশে ছাই!’ রসের প্রেরণা সুন্দর-অসুন্দরের ধারণাকে মুক্তি দিলে, আর্টিস্টের মধ্যে সুন্দর-অসুন্দরে মিলিয়ে এক রসরূপ সে দেখে চলল। আর্টিস্ট রূপমাত্রকে নির্বিচারে গ্রহণ করলে— কেন সুন্দর কেন অসুন্দর এ প্রশ্ন আর্টিস্ট করলে না, শুধু রসরূপে যখন বস্তুটিকে দেখলে তখন সে সাধারণ মানুষের মতো আহা ওহো বলে ক্ষান্ত থাকল না, দেখার সঙ্গে আর্টিস্টের মন আপনার সৌন্দর্যের অনুভূতিটা প্রত্যক্ষ করবার জন্য সুন্দর উপায় নির্বাচন করতে লাগল সুন্দর রং চং সুন্দর ছন্দোবদ্ধ এমনি নানা সরঞ্জাম নিয়ে আর্টিস্টের সমস্ত মানসিক বৃত্তি ধাবিত হল সুন্দরের স্মৃতিটিকে একটি বাহ্যিক রূপ দিতে, কিংবা সুন্দরের স্মৃতিটিকে নতুন নতুন কল্পনার মধ্যে মিশিয়ে নতুন রচনা প্রকাশ করতে। সুন্দর বা তথাকথিত সুন্দর দুয়েরই যেমন মনকে আকর্ষণ করবার শক্তি আছে তেমনি মনের মধ্যে গভীরভাবে নিজের স্মৃতিটি মুদ্রিত করবারও শক্তি আছে— সুতরাং সুন্দরে-অসুন্দরে এখানেও এক। সুন্দরকেও যেমন ভোলবার জো নেই অসুন্দরকেও তেমনি টেনে ফেলবার উপায় নেই। দুই স্মৃতির মধ্যে শুধু তফাত এই, সুন্দরের স্মৃতিতে আনন্দ, অসুন্দরের স্পর্শে মন ব্যথিত হয়, সুখও যেমন দুঃখও তেমনি মনের একস্থানে গিয়ে সঞ্চিত হয়, শুধু দুঃখকে মানুষ ভোলবারই চেষ্টা করে আর সুখের স্মৃতিকে লতার মতো মানুষের মন জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতেই চায় দিনরাত। সাধারণ মানুষের মনেও যেমন, আর্টিস্ট মানুষের মনেও তেমনি সহজভাবেই সুন্দ্র-অসুন্দরের ক্রিয়া হয়, শুধু সাধারণ মানুষের সঙ্গে আর্টিস্টের তফাত হচ্ছে মনের অনুভূতিকে প্রকাশের ক্ষমতা বা অক্ষমতা নিয়ে। দুঃখ পেলে সাধারণ মানুষ বেজায় রকম কান্নাকাটি শুরু করে, আর্টিস্টও যে কাঁদে না তা নয়, কিন্তু তার মনের কাঁদন আর্টের মধ্যে দিয়ে একটি অপরূপ সুন্দর ছন্দে বেরিয়ে আসে। অসুন্দরের মধ্যে, অ-সুখের মধ্যে আর্টিস্টের কাছ থেকে রস আসে বলেই আর্ট মাত্রকে সুন্দরের প্রকাশ বলে গণ্য করা হয়, এবং সেই কারণে আর্টের চর্চায় ক্রমে সুন্দরের অনুভূতি আমাদের যেমন বৃদ্ধি পায় তেমন সৌন্দর্য সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক পড়ে কিংবা শুনে হয় না। আসলে যা সুন্দর তা কখনও বলে না, আমি এইজন্যে সুন্দর; আমাদের মনেও ঠিক সেইজন্যে সুন্দরকে গ্রহণ করবার বেলায় এ প্রশ্ন ওঠে না যে, কেন এ সুন্দর! আসলে যে সুন্দর নয় সেই কেবল আমাদের সামনে রঙ মেখে অলঙ্কার পরে হাব-ভাব করে এসে বলে আমি এই কারণে সুন্দর, মনও আমাদের তখনি বিচার করে বুঝে নেয় এ রঙের দ্বারা অথবা অলঙ্কারে বা আর কিছুর দ্বারায় সুন্দর দেখাচ্ছে কিনা! আসলে যা সুন্দর তাকে নিয়ে আর্টিস্ট কিংবা সাধারণ মানুষের মন বিচার করতে বসে না, সবাই বলে— সুন্দর ঠেকছে, কেন তা জানি না। কিন্তু সুন্দরের সাজে যে অসুন্দর আসে তাকে নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং আর্টিস্টের মনের তর্কের উদয় হয়। কিন্তু পণ্ডিতের মন দার্শনিকের মনের ঠিক বিপরীত উপায়ে চলে, অসুন্দরের বিচার সেখানে নেই, সব বিচার বিতর্ক সুন্দরকে নিয়ে। যা সুন্দর আমরা দেখেছি তা নিজের সুন্দরতা প্রমানের কোনো দলিল নিয়ে এল না কিন্তু আমাদের মন সহজেই তাতে রত হল, কিন্তু পণ্ডিতের সামনে এসে সুন্দর দায়গ্রস্ত হল— প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠল সুন্দরকে নিয়ে— তুমি কেন সুন্দর, কিসে সুন্দর ইত্যাদি ইত্যাদি! সুন্দর, সে সুন্দর বলেই সুন্দর, মনে ধরল বলেই সুন্দর, এ সহজ কথা সেখানে খাটল না। পণ্ডিত সেই সুন্দরকে বিশ্লেষণ করে দেখবার চেষ্টা করছেন— কি নিয়ে সুন্দরের সৌন্দর্য? সেই বিশ্লেষণের একটা মোটামুটি হিসেব করলে এই দাঁড়ায়— (১) সুখদ বলেই ইনি সুন্দর, (২) কাজের বলেই সুন্দর, (৩) উদ্দেশ্য এবং উপায় দুয়ের সঙ্গতি দেন বলেই সুন্দর, (৪) অপরিমিত বলেই সুন্দর, (৫) সুশৃঙ্খল বলেই সুন্দর, (৬) সুসংহত বলেই সুন্দর, (৭) বিচিত্র-অবিচিত্র স্ম বিষম দুই দিয়ে ইনি সুন্দর।—এইসব প্রাচীন এবং আধুনিক পণ্ডিতগণের মতামত নিয়ে সৌন্দর্যের সার ধরবার জন্যে সুন্দর একটি জাল বুনে নেওয়া যে চলে না তা নয়, কিন্তু তাতে করে সুন্দরকে ঠিক যে ধরা যায় তার আশা দিতে সাহস করি না; তবে আমি এইটুকু বলি— অন্যের কাছে সুন্দর কি বলে আপনাকে সপ্রমাণিত করছে তা আমাদের দেখায় লাভ কি? আমাদের নিজের নিজের কাছে সুন্দর কি বলে আসছে তাই আমি দেখব। আমি জানি সুন্দর সব সময়ে সুখও দেউ না কাজেও দেয় না— বিদ্যুৎশিখার মতো বিশৃঙ্খল অসংযত উদ্দ্যেশ্যহীন বিদ্রুত বিষম এবং বিচিত্র আবির্ভাব সুন্দরের! সুন্দর, এই কথাই তো বলছে আমাদের— আমি এ নই তা নই, এজন্যে সুন্দর ওজন্যে সুন্দর নই, আমি সুন্দর তাই আমি সুন্দর। আর্টের মধ্যে চক্ষু-জোড়ানো মন-ওড়ানো প্রাণ-ভোলানো ও কাঁদানো গুণ, কিংবা এর যে-কোনো একটা যেমন আর্ট নয়, আর্ট বলেই যেমন সে আর্ট, সুন্দরও তেমনি সুন্দর বলেই সুন্দর। সুন্দর নিত্য ও অমূর্ত, নানা বস্তু নানা ভাবের মধ্যে তার অধিষ্ঠান ও আরোপ হলে তবে মনোরসনা তার স্বাদ অনুভব করে— এমন সুন্দর তেমন সুন্দর সুখদ সুন্দর সুপরিমিত সুন্দর সুশৃঙ্খলিত সুন্দর! আমাদের জিব যেমন চাখে মেঠাই সন্দেশ সরবৎ ইত্যাদি পৃথক পৃথক জিনিসের মধ্য দিয়ে মিষ্টতাকে— ঠিক সেইভাবেই জীব বা জীবাত্মা মনোরসনার সাহায্যে আপনার মধ্যে সুন্দরের জন্য যে প্রকাণ্ড পিপাসা রয়েছে সেটা নানা বস্তু ধরে মেটাতে চলে। অতএব বলতে হয়, মন যার যেমনটা চায় সেইভাবে সুন্দরকে পাওয়াই হল পাওয়া, আর কারু কথা মতো কিংবা অন্য কারু মনের মতো সুন্দরকে পাওয়ার মানে— না-পাওয়াই। মা-বাপের মনের মতো হলেই বৌ সুন্দর হল একথা যে ছেলের একটু মাত্র সৌন্দর্যজ্ঞান হয়েছে সে মনে করে না। বৌ কাজের, বৌ সংসারী, বৌ বেশ সংস্থানসম্পন্না, এবং হয়তো বা ডাকসাইটে সুন্দরীও হতে পারে অন্য সবার কাছে, কিন্তু ছেলের নিজের মনের মধ্যে কাজ কর্ম সংসার সুরূপ কুরূপ ইত্যাদির একটা যে ধারণা তার সঙ্গে অন্যের পছন্দ-করা বৌ মিললো তো গোল নেই, না-হলেই মুশকিল। হিন্দিতে প্রবাদ আছে ‘আপরূচি খানা—পররূচি পহেননা’, খাবারের স্বাদ আমাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্রভাবে নিতে হয় সুতরাং সেখানে আমাদের স্বরাজ, কিন্তু পরনের বেলায় পরে যেটা দেখে সুন্দর বলে সেইটেই মেনে চলতে হয়, না-হলে নিন্দে; সুতরাং সেখানে কেউ জোর করে বলতে পারে না এইটেই পৃ পাঁচজনে যা বলে বলুক, আমরা নিজের বুদ্ধিকেও সেখানে প্রাধান্য দিতে পারিনে, দেশ কাল যে সুন্দর পরিচ্ছদের সম্মান করে তাকেই মেনে নিতে হয়। একটা কথা কিন্তু মনে রাখা চাই, সাজগোজ পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদির সম্বন্ধে কিছু ওলট পালট সময়ে সময়ে যে হয়ে আসছে তা ঐ ব্যক্তিগত স্বাধীন রূচি থেকেই আসছে। সুতরাং সব দিক দিয়ে সুন্দর-অসুন্দরের বোঝা-পড়া আমাদের ব্যক্তিগত রুচির উপরেই নির্ভর করছে। যদি সত্যই এই জগৎ অসুন্দরের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, নিছক সুন্দর জিনিস দিয়ে গড়া পরিপূর্ণ সুখদ সুশৃঙ্খল ও সর্বগুণান্বিত একটা কিছু হত তবে এর মধ্যে এসে সুন্দর অসুন্দরের কোনো প্রশ্নই আমাদের মনে উদয় হত না। আমরা এই জগৎ সংসার চিরসুন্দরের প্রকাশ ইত্যাদি কথা মুখে বললেও চোখে তা দেখিনে অনেক সময় মনেও সেটা ধরতে পারিনে, কাজেই অতৃপ্ত মন সুন্দরের বাসনায় নানা দিকে ধাবিত হয় এবং সুন্দরের একটা সাক্ষাৎ আদর্শ খাড়া করে, দেখার চেষ্টা করে এবং সুন্দরকে অসুন্দরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে আমাদের সৌন্দর্যজগৎ যে খন্ড ও খর্ব হয়ে পড়ে তা আর মনেই থাকে না। সুরূপ কুরূপ দুয়ে মিলে সুন্দরের অখন্ড মূর্তির ধারণা করা শক্ত কিন্তু একেবারে যে অসম্ভব মানুষের পক্ষে তা বলা যায় না। ভক্ত কবি এবং আর্টিস্টএদের কাছে সুন্দর-অসুন্দর বলে দুটো জিনিস নেই, সব জিনিসের ও ভাবের মধ্যে যে নিত্য বস্তুটি সেটিই সুন্দর বলে তারা ধরেন। ইন্ত্রিয়গ্রাহ্য যা কিছু তা অনিত্য, তার সুখ শৃঙ্খলা মান পরিমাণ সমস্তই অনিত্য, সুতরাং সুন্দর যা নিত্য, সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তার সঙ্গে মেলা মানুষের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব বলা যেতে পারে। আমাদের মনই কেবল গ্রহণ করতে পারে সুন্দরের আস্বাদ--
সুতরাং মনোবাসনা রোগ বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার মতো ভীষণ বিপত্তি মানুষের হতে পারে না। আর্টের দিক দিয়ে যৌবনই সুন্দর বার্ধক্য সুন্দর নয়, আলোই সুন্দর অন্ধকার নয়, সুখই সুন্দর দুঃখ নয়, পরিষ্কার দিন বাদলা নয়, বর্ষার নদী শরতের নয়, পূর্ণচন্দ্রই চন্দ্রকলা নয়— কেউ একথা বলতে পারে না। যে একেবারেই আর্টিস্ট নয় শুধু তারি পক্ষে বিচ্ছিন্ন ও খন্ড ভাবের একটা আদর্শ সৌন্দর্যকে কল্পনা করে নেওয়া সম্ভব। কবীর ছিলেন আর্টিস্ট তাই তিনি বলেছিলেন—“সবহি মূরত বীচ অমূরত, মূরতকী বলিহারী।” যে সেরা আর্টিস্ট তারি গড়া যা কিছু তারি মধ্যে এইটে লক্ষ্য করছি— ভালমন্দ সব মূর্তির মধ্যে অমূর্তি বিরাজ করছেন! “ঐসা লো নহিঁ’ তৈসা লো, মৈঁ কেহি বিধি কথৌঁ গম্ভীরা লো”— সুন্দর যে অসুন্দরের মধ্যেও আছে এ গভীর কথা বুঝিয়ে বলা শক্ত তাই কবীর এককথায় সব তর্ক শেষ করলেন। “বিছুড়ি নহিঁ মিলিহো”— বিচ্ছিন্নভাবে তাকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু এই যে সুন্দরের অখন্ড ধারণা কবীর পেলেন তার মূলে কি ভাবের সাধনা ছিল জানতে মন সহজেই উৎসুক হয়; এর উত্তর কবীর যা দিয়েছিলেন তার সঙ্গে সব আর্টিস্টের এক ছাড়া দুই মত নেই দেখা যায়—“সংতো সহজ সমাধ ভলী, সাঁঈসে মিলন ভয়ো জা দিনতে সুরত না অন্তি চলি।। আঁখ ন মুদুঁ কান ন রূংধু, কায়া কষ্ট ন ধারূঁ। খুলে নয়ন মৈ হঁস হঁস দেখুঁ সুন্দর রূপ নিহারূঁ।।” সহজ সমাধিই ভাল, হেসে চাও দেখবে সব সুন্দর, যার মনে হাসি নেই তার চোখে সুন্দরও নেই। যার প্রাণে সুর আছে বিশ্বের সুর বেসুর বিবাদী সংবাদী সবই সুন্দর গান হয়ে মেলে তারি মনে। আর যার কাছে শুধু পুঁথির সুরসপ্তক স্বরলিপি ও তাল-বেতালের বোল মাত্রই আছে, তার বুকের কাছে বিশ্বের সুর এসে তুলোট কাগজের খড়মড়ে শব্দে হঠাৎ পরিণত হয়।
এখন মানুষের ব্যক্তিগত রূচির উপরে সুন্দর-অসুন্দরের বিচারের শেষ নিষ্পত্তিটা যদি ছেড়ে দেওয়া যায় তবে সুন্দর-অসুন্দরের যাচাই করবার আদর্শ কোনখানে পাওয়া যাবে এই আশঙ্কা সবারই মনে উদয় হয়। সুন্দরকে বাহ্যিক উপমান ধরে যাচাই করে নেবার জন্যে এ ব্যস্ততার কারণ আমি খুঁজে পাইনে। ধর, সুন্দরের একটা বাঁধাবাঁধি প্রত্যক্ষ আদর্শ রইল না, প্রত্যেকে আমরা নিজের নিজের মনের কষ্টিপাথরেই বিশ্বটাকে পরীক্ষা করে চললেম— খুব আদিকালে মানুষ আর্টিস্ট যেভাবে সুন্দরকে দেখে চলেছিল— এতে করে মানুষের সৌন্দর্য উপভোগ সৌন্দর্য সৃষ্টির ধারা কি একদিনের জন্যে বন্ধ হল জগতে? বরং আর্টের ইতিহাসে এইটেই দেখতে পাই যে যেমনি কোনো জাতি বা দল আর্টের দিক দিয়ে কিছুকে আদর্শ করে নিয়ে ধরে বসলো পুরুষ-পরম্পরায় অমনি সেখানে রসের ব্যাঘাত হতে আরম্ভ হল, আর্টও ক্রমে অধঃ থেকে অধোগতি পেতে থাকল। আমাদের সঙ্গীতে সেই তানসেন ও আকব্বরী চাল, ছবিতে দিল্লীর চাল বা বিলিতি চাল যে কুকান্ড ঘটাতে পারে, এবং সেই আদর্শকে উল্টে ফেলে চললেও যা হতে পারে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণসমস্ত আমাদের সামনেই ধরা রয়েছে, সুতরাং আমার মনে হয় সুন্দরের একটা আদর্শের অভাব হলে তত ভাবনা নেই, যত ভাবনা আদর্শটা বড় হয়ে আমাদের সৌন্দর্যজ্ঞান ও অনুভবশক্তির বিলুপ্তি যদি ঘটায়। কালিদাসের আমলে ‘তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা’ ছিল সুন্দরীর আদর্শ। অজন্তার এবং তার পূর্বের যুগ থেকেও হয়তো এইআদর্শই চলে আসছিল, মোগলানী এসে অবশেষে আরমানি থেকে আরম্ভ করে ফিরিঙ্গিনী পর্যন্ত এসে সে আদর্শ উল্টে দিলে এবং হয়তো কোন দিন বা চীনইএসে সেটা আবার উল্টে দেয় তারও ঠিক নেই। আদর্শটা এমনিই অস্থায়ী জিনিস যে তাকে নিয়ে চিরকাল কারবার করা মুশকিল। রুচি বদলায় আদর্শও বদলায়, যেটা ছিল এককালের চাল সেটা হয় অন্য কালের বেচাল, ছিল টিকি এল টাই, ছিল খড়ম এল বুট, এমনি কত কি! গাছগুলো অনেককাল ধরে এক অবস্থায় রয়েছে--
সেইজন্যে এইগুলোকেই আদর্শ গাছ ইত্যাদি বলে আমাদের মনে হয় কিন্তু পৃথিবীর পুরাকালের গাছ পাতা ফল ফুলের আদর্শ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা— অথচ তারাও তো ছিল সুন্দর!— সুতরাং পরিবর্তনশীল বাইরেটার মধ্যে সুন্দর আদর্শভাবে থাকে না। শিশু গাছ বড় গাছ এবং বুড়ো গাছ প্রত্যেকেরই মধ্যে যে সুন্দরের ধারা চলছে, পরম সুন্দর হয়ে দেখা দেবার নিত্য এবং সুন্দর প্রাণের স্রোত গোপনে চলেছে তাকেই সুন্দরের আদর্শ বলে ধরতে পারি, আর কিছুকে নয়, এবং সেই আদর্শই সুন্দরকে যাচাই করার যে নিত্য আদর্শ নয় তা জোর করে কে বলতে পারে! সমস্ত পদার্থের সৌন্দর্যের পরিমাপ হল তাদের মধ্যে, অনিত্য রস যা তা নিয়ে বাইরের রঙ রূপ বদলে চলে কিন্তু নিত্য যা তার অদল-বদল নেই। সব শিল্পকে যাচাই করে নেবার জন্যে আমাদের প্রত্যেকের মনে নিত্য সুন্দরের যে একটি আদর্শ ধরা আছে— তার চেয়ে বড় আদর্শ কোথায় আর পাব? যে ভাবেই হোক যে বস্তুই হোক যখন সে নিত্য তার আস্বাদ দিয়ে আমাদের মনে পরম-সুন্দরের স্বল্পাধিক স্পর্শ অনুভব করিয়ে গেল সে সুন্দর বলে আমাদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করলে। আমার কাছে কতকগুলো জিনিস কতকগুলো ভাব সুন্দর ঠেকে কতক ঠেকে অসুন্দর, এই ঠেকল সুন্দর এই অসুন্দর, তোমার কাছেও তাই, আমার মনের সঙ্গে মেলেনা তোমারটি তোমার সঙ্গে মেলেনা আমারটি। সুন্দরের অসুন্দরের অবিচলিত আদর্শ চলায়মান জিবনে কোথাও নেই, সুতরাং জেদিক দিয়েই চল সুন্দর অসুন্দর সম্বন্ধে বিতর্ক মেটবার নয়। কাজেই এই অতৃপ্তিকেই— এই সুখ-দুঃখে আল-আঁধারে সুন্দর, অসুন্দরে মেলা খণ্ড-বিখণ্ড সত্য সুন্দর এবং মঙ্গলকে— সম্পূর্ণভাবে মেনে নিয়ে যে চলতে পারে, সেই সুন্দরকে এক ও বিচিত্র ভাবে অনুভাব করবার সুবিধে পায়। জগৎ যার কাছে তার ছোট লোহার সিন্দুকটিতেই ধরা আর জগৎ যার কাছে লোহার সিন্দুকের বাইরেও অনেকখানি বিস্তৃত ধুলোর মধ্যে কাদার মধ্যে আকাশের মধ্যে বাতাসের মধ্যে, তাদের দু’জনের কাছে সুন্দর ছোট বড় হয়ে দেখা যে দেয় তার সন্দেহ নেই! সিন্দুক খালি হলে যার সিন্দুক তার কাছে কিছুই আর সুন্দর ঠেকে না কিন্তু যার মন সিন্দুকের বাইরের জগৎকে যথার্থ ভাবে বরন করলে তার চোখে সুন্দরের দিকে চলবার অশেষ রাস্তা খুলে গেল, চলে গেল সে সোজা নির্বিচারে নির্ভয়ে। যখন দেখি নৌকা চলেছে ভয়ে ভয়ে, পদে পদে নোঙ্গর আর খোঁটার আদর্শে ঠেকতে ঠেকতে, তখন বলি, নৌকা সুন্দর চলল না, আর যখন দেখলেম নৌকা উল্টো স্রোতের বাধা উল্টো বাতাসের ঠেলাকে স্বীকার করেও গন্তব্য পথে সোজা বেরিয়ে গেল ঘাটের ধারের খোঁটা ছেড়ে নোঙ্গর তুলে নিয়ে, তখন বলি, সুন্দর চলে গেল!
সুন্দর অসুন্দর— জীবন-নদীর এই দুই টান— একে মেনে নিয়ে যে চলল সেই সুন্দর চলল আর যে এটা মেনে নিতে পারলে না সে রইল যে-কোনো একটা খোঁটায় বাঁধা। ঘাটের ধারে বাঁশের খোঁটা, তাকে অতিক্রম করে চলে যায় নদীর স্রোত নানা ছন্দে এঁকে বেঁকে,— আর্টের স্রোতও চলেছে চিরকাল ঠিক এইভাবেই চিরসুন্দরের দিকে। সুন্দর করে বাঁধা আদর্শের খোঁটাগুলো আর্টের ধাক্কায় এদিক-ওদিক দোলে, তারপর একদিন যখন বান ডাকে খোঁটা সেদিন নিজে এবং নিজের সঙ্গে বাঁধা নৌকাটাকেও নিয়ে ভেসে যায়। আর্ট এবং আর্টিস্ট এদের মনের গতি এমনি করে পণ্ডিতদের বাঁধা এবং মূর্খদের আঁকড়ে ধরা তথাকথিত দড়ি খোঁটা অতিক্রম করে উপড়ে ফেলে চলে যায়। বড় আর্টিস্টরা সুন্দরের আদর্শ গড়তে আসেন না, যেগুলো কালে কালে সুন্দরের বাঁধাবাঁধি আদর্শ হয়ে দাঁড়াবার জোগাড় করে, সেইগুলোকেই ভেঙে দিতে আসেন, ভাসিয়ে দিতে আসেন সুন্দর-অসুন্দরে মিলে যে চলন্ত নদী তারি স্রোতে। যে পারে সে ভেসে চলে মনোমতো স্থানে মনতরী ভেড়াতে ভেড়াতে সুন্দর সূর্যাস্তের মুখে, আর সেটা যে পারে না সে পরের মনোমতো সুন্দর করে বাঁধা ঘাটে আটকা থেকে আদর্শ খোঁটায় মাথা ঠুকে-ঠুকেই মরে, সুন্দর-অসুন্দরের জোয়ার-ভাঁটা তাকে বৃথাই দুলিয়ে যায় সকাল সন্ধ্যে!
বাঁধা নৌকা সে এক ভাবে সুন্দর, ছাড়া নৌকা সে আর-এক ভাবে সুন্দর; তেমনি কোনো একটা কিছু সকরুণ সুন্দর, কেউ নিষ্করুণ সুন্দর, কেউ ভীষণ সুন্দর, আবার কেউ বা এত বড় সুন্দর কি এতটুকু সুন্দর— আর্টিস্টের চোখে এইভাবে বিশ্বজগৎ সুন্দরের বিচিত্র সমাবেশ বলেই ঠেকে; আর্টিস্টের কাছে শুধু তর্ক জিনিসটাই অসুন্দর, কিন্তু তর্কের সভায় যখন ঘাড় নড়ছে হাত নড়ছে ঝড় বইছে তার বীভৎস ছন্দটা সুন্দর। সুতরাং যে আলোয় দোলে অন্ধকারে দোলে কথায় দোলে সুরে দোলে ফুলে দোলে ফলে দোলে বাতাসে দোলে পাতায় দোলে— সে শুকনোই হোক তাজাই হোক সুন্দর হোক অসুন্দর হোক সে যদি মন দোলাল তো সুন্দর হল এইটেই বোধহয় চরম কথা সুন্দর-অসুন্দরের সম্বন্ধে যা আর্টিস্ট বলতে পারেন নিঃসঙ্কোচে। আদর্শকে ভাঙতে বড় বড় আর্টিস্টরা যা আজ রচনা করে গেলেন, আস্তে আস্তে মানুষ সেইগুলোকেই যে আদর্শ ঠাউরে নেয় তার কারণ আর-কিছু নয়, আমাদের সবার মন সত্যিই যে সুন্দর তার স্বাদ পেতে ব্যাকুল থাকে— যে রচনার মধ্যে যে জীবনের মধ্যে তার আস্বাদ পায় তাকেই অন্য সবার চেয়ে বড় করে না বোধ করে সে থাকতে পারে না। এইভাবে একজন, ক্রমে দশজন। এবং এমনো হয়, সৌন্দর্য সম্বন্ধে স্বাধীন মতামত নেই অথচ চেষ্টা রয়েছে সুন্দরকে কাছাকাছি চারিদিকে পেতে, সে, অথবা সুন্দরের কোনো ধারণা সম্ভব নয় শুধু সৌন্দর্যবোধের ভান করছে, সেও, আর্ট বিশেষকে আস্তে আস্তে আদর্শ হওয়ার দিকে ঠেলে তুলে ধরে,— ঠিক যেভাবে বিশেষ বিশেষ জাতি আপনার আপনার এক-একটা জাতীয় পতাকা ধরে তারি নীচে সমবেত হয়; সে পতাকা তখনকার মতো সুন্দর হলেও একদিন তার জায়গায় নতুন মানুষ তোলে নতুন সজ্জায় সাজানো নিজের standard বা সৌন্দর্যবোধের চিহ্ন। এইভাবে একের পর আর এসে নতুন নতুন ভাবে সুন্দরের আদর্শ ভাঙা গড়া হতে হতে চলেছে পরিপূর্ণতার দিকে, কিন্তু পূর্ণ সুন্দর বলে নিজেকে বলাতে পারছে না কেউ। আর্টিস্টের সৌন্দর্যের ধারণা পাকা ফলের পরিণতির রেখাটির মতো সুডৌল ও সুগোল কিন্তু জ্যামিতির গোলের মতো একেবারে নিশ্চল গোল নয়, সচল ঢলঢলে গোল যার একটু খুঁত আছে, পূর্ণচন্দ্রের মতো পরিপূর্ণ কিন্তু সম্পূর্ণ নয়; সেই কারণে অনেক সময় বড় আর্টিস্টের রচনা সাধারণের কাছে ঠেকে যাচ্ছেতাই— কেননা সাধারণ মন জ্যামিতিক গোলের মতো আদর্শ একটা-না-একটা ধরে থাকেই, কাজেই সে সত্য কথাই বলে যখন বলে যাচ্ছেতাই, অর্থাৎ তার ইচ্ছের সঙ্গে মিলছে না আর্টিস্টের ইচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছেতাই শব্দটি বড় চমৎকার, এটিতে বোঝায়— যা ইচ্ছে তাই, সাধুভাষায় বললে বলি, যত্র লগ্নং হি যস্য হৃৎ বা যথাভিরুচি, এই যা ইচ্ছে তাই— যা মন চাচ্ছে তাই, সুতরাং রসিক ও আর্টিস্ট এই শব্দটির যথার্থ অর্থ সুন্দর অর্থ ধরেই চিরকাল চলেছে। মনের স্বাধীনতা সম্পুরনা বজায় রেখে সুন্দরকে মনের টানের উপরে ছেড়ে যা ইচ্ছে তাই বলে পণ্ডিতানাম্ মতম্-এর বাইরে বেরিয়ে পড়েছে; খোঁটা-ছাড়া নৌকা বাঁধনমুক্ত-প্রাণ! তাই দেখছি সুন্দর-অসুন্দরের বাছ-বিচার পরিত্যাগ করে তারি সঙ্গে গিয়ে লাগবার স্বাধীনতা আর্টিস্টের মনকে বড় কম প্রসার দেয় না।
বড় মন বড় সুন্দরকে ধরতে চাইছে যখন, বড় স্বাধীনতার মুক্তি তার একান্ত প্রয়োজন, কিন্তু মন যেখানে ছোট সেখানে আর্টের দিক দিয়ে এই বড় স্বাধীনতা দেওয়ার মানে ছেলের হাতে আগুনের মশালটা ধরে দেওয়া—সে লঙ্কাকাণ্ড করে বসবেই, নিজের সঙ্গে আর্টের মুখ পুড়িয়ে কিংবা ভরাডুবি করে স্রোতের মাঝে। বড় মন সে জানে বড় সুন্দরকে পেতে হলে কতটা সংযম আর বাঁধাবাঁধির মধ্য দিয়ে নিজেকে ও নিজের আর্টকে চালিয়ে নিতে হয়। ছোট সে তো বোঝে না যে পরের অনুসরণে সুন্দরের দিকে চলাতেও আলো থেকে আলোতেই গিয়ে পৌঁছোয় মন; আর নিজের ইচ্ছামতো চলতে চলতে ভুলে হঠাৎ সে অসুন্দরের নেশা ও টানে পড়ে যায়, তখন তার কোনো কারিগরিই তাকে সুন্দরের বিষয়ে প্রকাণ্ড অন্ধতা এবং আর্ট বিষয়ে সংসার-জোড়া সর্বনাশ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। পণ্ডিতরা আর কিছু না হোন পণ্ডিত তো বটে, সৌন্দর্যের এবং আর্টের লক্ষণ নিয়ম ইত্যাদি বেঁধে দিতে তাঁরা যে চেয়েছেন তা এই ছোট মনের উৎপাত থেকে আর্টকে এবং সেই সঙ্গে আর্টিস্টকেও বাঁচাতে। যত্ন লগ্নং হি জস্য হৃৎ—একথা যাঁরা শিল্পবিষয়ে পণ্ডিত তাঁরা স্বীকার করে নিলেও এই যা-ইচ্ছে-তাই শিল্পের উপরে খুব জোর দিয়ে কিছু বললেন না। কেননা তাঁরা জানতেন হৃদয় সবার সমান নয় মহৎ নয় সুন্দর নয়, হৃদয়ে যা ধরে তারও ভেদাভেদ আছে, হৃদয় আমাদের অনেক জিনিসে গিয়ে লগ্ন হয়ে যা অসুন্দর এবং একেবারেই আর্ট নয়, এবং এও দেখা যায় পরম সুন্দর এবং অপূর্ব আর্ট তাতেও গিয়ে হৃদয় লাগল না, মধুকরের মত উড়ে পড়ল না ফুলের দিকে, কাদাখোঁচার মত নদীর ধারে-ধারেই খোঁচা দিয়ে বেড়াতে লাগল পাঁকে।
যখন দেখতে পাওয়া যাছে ব্যক্তিবিশেষের হৃদয় গিয়ে লগ্ন হচ্ছে কুব্জার লাবণ্যে, আর একে পড়েছে চন্দ্রাবলীর প্রেমে অন্যে রাধে রাধে বলেই পাগল, তখন এই তিনে মিলে ঝগড়া চলবেই। এইসব তর্কের ঘূর্ণাজলে আর্টকে না ফেলে সৌন্দর্য ও আর্টের ধারাকে যদি সুনিয়ন্ত্রিত রকমে চালাতে হয় পুরুষ-পরম্পরায়, তবে পণ্ডিত ও রসিকদের কথিত সমস্ত রসের রূপের ধারার সাহায্য না নিলে কেমন করে খণ্ড-বিখণ্ডতা থেকে আর্টে একত্ব দেওয়া যাবে। আমার নিজের মুখে কি ভাল লাগল না-লাগল তা নিয়ে দু-চার সমরুচি বন্ধুকে নিমন্ত্রন করা চলে কিন্তু বিশ্বজোড়া উতসবের মধ্যে শিল্পের স্থান দিতে হলে নিজের মধ্যে যে ছোট সুন্দর বা অসুন্দর তাকে বড় করে সবার করে দেবার উপায় নিছক নিজত্বটুকু নয়; সেখানে individuality-কে universality দিয়ে যদি না ভাঙতে পারা যায়, তবে বীণার প্রত্যেক ঘাট তার পুরো সুরেই তান মারতে থাকলে কিংবা অন্য সুরের সঙ্গে মিলতে চেয়ে মন্দ্র মধ্যম হওয়াকে অস্বীকার করলে সঙ্গীতে যে কাণ্ড ঘটে, আর্টেও সৌন্দর্য সম্বন্ধে সেই যথেচ্ছাচার উপস্থিত হয় যদি সুন্দর অসুন্দর সম্বন্ধে একটা কিছু মীমাংসায় না উপস্থিত হওয়া যায় আর্টিস্ট ও রসিকদের দিক দিয়ে। ধারা ভেঙে নদী যদি চলে শতমুখী ছোটছোট তরঙ্গের লীলা-খেলা শোভা-সৌন্দর্য নিয়ে তবে সে বড় নদী হয়ে উঠতে পারে না। এইজন্যে শিল্পে পূর্বতন ধারার সঙ্গে নতুন ধারাকে মিলিয়ে নতুন নতুন সৌন্দর্যসৃষ্টির মুখে অগ্রসর হতে হয় আর্টের জগতে। সত্যই যে শক্তিমান সে পুরাতন প্রথাকে ঠেলে চলে, আর যে অশক্ত সে এই বাঁধা স্রোত বেয়ে, আস্তে আস্তে বড় শিল্প রচনার ধারা ও সুরে সুর মিলিয়ে নিজের ক্ষুদ্রতা অতিক্রম করে চলে। বাইরে রেখায়-রেখায় বর্ণে-বর্ণে, ভিতরে ভাবে-ভাবে এবং সব শেষে রুপে ও ভাবে সুসঙ্গতি নিয়ে আর্টে সৌন্দর্য বিকাশ লাভ করেছে। যে ছবি লিখেছে, গান গেয়েছে, নৃত্য করেছে সে যেমন এটা সহজে বুঝতে পারবে, তেমন যার শুধু সৌন্দর্য সম্বন্ধে পড়েছে, কি বক্তৃতা করেছে বা বক্তৃতা শুনেছে তারা তা পারবে না। সৌন্দর্যলোকের সিংহদ্বারের ভিতর দিকে চাবি, নিজের ভিতর দিক থেকে সিংহদ্বার খুলল তো বাইরের সৌন্দর্য এসে পৌঁছল মন্দিরে এবং ভিতরের খবর বয়ে চলল বাইরের অবাধ স্রোতে— সুন্দর-অসুন্দরকে বোঝবার উৎকৃষ্ট উপায় প্রত্যেককে নিজে খুঁজে নিতে হয়।
টীকা
১. শিক্ষাষ্টক— চৈতন্যদেব
২. ‘কাব্যং যশসে অর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবেতরক্ষতয়ে’— এই উদ্ধৃতিটিতে (১২) সংখ্যাটি বাদ পড়িয়া গিয়াছে। ইহা ১/২ কাব্যপ্রকাশ মম্মমভট্ট (অমরেশ্বর ঠাকুর সম্পাদিত) হইতে গৃহীত।
সুন্দরের সঙ্গে তাবৎ জীবেরই মনে ধরার সম্পর্ক, আর অসুন্দরের সঙ্গে হল মনে না ধরার ঝগড়া। ইমারতে ঘেরা বন্দীশালার মতো এই যে শহরের মধ্যে এখানে ওখানে একটুখানি বাগান, অনেকখানিই যার মরা এবং শ্রীহীন, এদের পাখি প্রজাপতির মনে ধরেছে তবেই না এরা এইসব বাগানে বাসা বেঁধে এই ধুলোমাখা রোদে সকাল সন্ধ্যে ডানা মেলে সুরে ছন্দে ভরে তুলছে শহরের বুকের আবদ্ধ অফুলন্ত স্থানটুকু! আর এইসব বাগানের ধারেই রাস্তায় বসে খেলছে ছেলেরা— শিশুপ্রাণ তাদের মনে ধরেছে বাগানের ফুলকে ছেড়ে রাস্তার ধুলো মাটি, তাই তো খেলছে ওরা ধুলোকে নিয়ে ধুলোখেলা! রথের দিনে রথো সামগ্রী— সোলার ফুল পাতার বাঁশি— তার সুর আর রং আর পরিমল ছড়িয়ে পড়েছে বাদলার দিনে— রথতলার আর খেলাঘরের ছেলে বুড়োর মেলায়, তাই না আজ দেখছি নিজেদের ঘর সাজাচ্ছে মানুষ সোলার ফুলে মাটির খেলনায়! তেমনি সে আমার নিজের কোণটি, দেওয়ালের ফাঁকে ভাঙা কাচের মতো একখণ্ড আকাশ— ময়লা ঝাপ্সা প্রাচীরে ঘেরা চারটিখানি ঘাস চোরকাঁটা আর দোপাটি ফুলের খেলাঘর, সবই মনে ধরেছে আমার, তাই না কোণের দিকে মন থেকে থেকে দৌড় দিচ্ছে, চোরকাঁটার বনে লুকোচুরি খেলছে, নয়তো দোপাটি ফুলের রঙের ছাপ নিয়ে লিখছে ছবি, স্বপন দেখছে রকম রকম, আর থেকে থেকে ঠিক নাকের সামনে মাড়োয়ারিদের আকাশ বাতাস আড়াল-করা চৌতলা পাঁচতলা বাড়িগুলোর সঙ্গে আড়ি দিয়ে বলে চলেছে বিশ্রী বিশ্রী বিশ্রী! মাড়োয়ারি গৃহস্থরা কিন্তু ওদের পায়রার খোপগুলোকে সুন্দর বাসা বলেই বোধ করছে এবং তাদের নাকের সামনে আমাদের সেকেলে বাড়ি আর ভাঙাচোরা বাগানকে অসুন্দর বলছে! কাজেই বলতে হবে আয়নাতে যেমন নিজের নিজের চেহারা তেমনি মনের দর্পণেও আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের মনোমতোকে সুন্দরই দেখি। কারু কাছ থেকে ধার-করা আয়না এনে যে আমরা সুন্দরকে দেখতে পাব তার উপায় নেই। সুন্দরকে ধরবার জন্যে নানা মুনি নানা মতো আরশি আমাদের জন্যে সৃজন করে গেছেন, সেগুলো দিয়ে সুন্দরকে দেখার যদি একটুও সুবিধা হত তো মানুষ কোন কালে এইসব আয়নায় কাচ গালিয়ে মস্ত একটা আতশী কাচের চশমা বানিয়ে চোখে পরে বসে থাকত, সুন্দরের খোঁজে কেউ চলত না; কিন্তু সুন্দরকে নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ঘরকন্না তাই সেখানে অন্যের মনোমতোকে নিয়ে থাকাই চলে না, খুঁজে পাতে আনতে হয় নিজের মনোমতোটি।
জীবের মনস্তত্ত্ব যেমন জটিল যেমন অপার, সুন্দরও তেমনি বিচিত্র তেমনি অপরিমেয়। কেউ কাজকে দেখছে সুন্দর সে দিনরাত কাজের ধান্ধায় ছুটছে, কেউ দেখছে অকাজকে সুন্দর সে সেই দিকেই চলেছে, কিন্তু মনে রয়েছে দু-জনেরই সুন্দর কাজ অথবা সুন্দর রকমের অকাজ! ধনী খুঁজে ফিরছে তার সর্বস্ব আগ্লাবার সুন্দর চাবিকাঠি, বিশ্রী তালাচাবি কেউ খোঁজে না— আর দেখো চোর সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সন্ধি কাটবার সুন্দর সিঁদ! ভক্ত খুঁজছেন ভক্তিকে, শাক্ত খুঁজছেন শক্তিকে আর নর খোঁজে গাড়িজুড়ি, বি. এ. পাসের পরেই বিয়েতে সোনার ঘড়ি এবং তার কিছু পরেই চাকরি এবং এমন সুন্দর একটা বাসাবাড়ি যেখানে সব জিনিস সুন্দর করে উপভোগ করা যায়। হা-হুতাশ কচ্ছেন কবি কল্পনালক্ষ্মীর জন্যে এবং ছবি-লিখিয়ের হা-হুতাস হচ্ছে কলালক্ষ্মীর জন্যে, ধরতে গেলে সব হা-হুতাশ যা চাই সেটা সুন্দরভাবে পাই এইজন্যে, অসুন্দরের জন্যে একেবারেই নয়। সুন্দরের রূপ ও তার লক্ষণাদি সম্বন্ধে জনে-জনে মতভেদ কিন্তু সুন্দরের আকর্ষণ যে প্রকান্ড আকর্ষণ এবং তা আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে জড়ানো সে বিষয়ে দুই মত নেই।
যেভাবেই হোক যা কিছু বা যারই সঙ্গে আমরা পরিচিত হচ্ছি তার দুটো দিক আছে— একটা মনে ধরার দিক যেটাকে বলা যায় বস্তুর ও ভাবের সুন্দর দিক, আর একটা মনে না ধরার দিক যেটাকে বলা চলে অসুন্দর দিক, আমাদের জনে-জনে মনেরও ঐ দু রকম দৃষ্টি— যাকে বলা যায় শুভ আর অশুভ বা সু আর কু দৃষ্টি। কাজেই দেখি, যে দেখছে তার মন আর যাকে দেখছে তার মন— এই দুই মন ভিতরে ভিতরে মিলল তো সুন্দরের স্বাদ পাওয়া গেল, না হলেই গোল। রাধিকা কৃষ্ণকে সুরূপ শ্যামসুন্দর দেখেছিলেন, তারপর অনঙ্গভীমদেব এবং তারপর থেকে আমাদের সবার কাছে রূপকসুন্দরভাবে কৃষ্ণ এলেন, এই দুই মূর্তিই আমাদের শিল্পে ধরা হয়েছে, এখন কোন সমালোচকের সৌন্দর্য সমালোচনার ওপর নির্ভর করে এই দুই মূর্তির বিচার করব? আ-কা-শ এই তিনটি অক্ষরে আকাশ-জ্ঞানটাই রূপকের দল বলবে ভালো, কিন্তু রূপের সেবক তারা বলবে ‘নব-নীরদ-শ্যাম’ যা দেখে চোখ ভুলল মন ঝুলল, যার মোহন ছায়া তমাল গাছে যমুনার জলে এসে পড়ল সেই সুন্দর। সুন্দর-অসুন্দর সম্বন্ধে শেষ কথা যদি কেউ বলতে পারে তো আমাদের নিজের নিজের মন। পণ্ডিতের কাজই হচ্ছে বিচার করা এবং বিচার করে দেখতে হলেই বিষয়কে বিশ্লেষ করে দেখতে হয়, সুত্রাং সুন্দরকেও নানা মুনি নানা ভাবে বিশ্লেষ করে দেখেছেন, তার ফ্লে তিল তিল সৌন্দর্য নিয়ে তিলোত্তমা গড়ে তোলবার একটা পরীক্ষা আমাদের দেশে এবং গ্রীসে হয়ে গেছে, কিন্তু মানুষের মন সেই প্রথাকে সুন্দর বলে স্বীকার করেনি এবং সেই প্রথায় গড়া মূর্তিকেই সৌন্দর্যসৃষ্টির শেষ বলেও গ্রাহ্য করেনি। বিশেষ বিশেষ আর্টের পক্ষপাতী পণ্ডিতেরা ছাড়া কোনো আর্টিস্ট বলেনি অন্য সুন্দর নেই, ঐটেই সুন্দর। আমাদের দেশ যখন বললে— সুন্দর গড়ো কিন্তু সুন্দর মানুষ গড়ো না, সুন্দর করে দেবমূর্তি গড়ো সেই ভালো, ঠিক সেই সময় গ্রীস বললে—না, মানুষকে করে তোলো সুন্দর দেবতার প্রায় কিংবা দেবতাকে করে তোলো প্রায় মানুষ! আবার চীন বললে— খবরদার, দেবভাবাপন্ন মানুষকে গড়ো তো দৈহিক এবং ঐহিক সৌন্দর্যকে একটুও প্রশ্রয় দিও না চিত্রে বা মূর্তিতে। নিগ্রোদের আর্ট, যার আদর এখন ইউরোপের প্রত্যেক আর্টিস্ট করছে তার মধ্যে আশ্চর্য রং-রেখার খেলা এবং ভাস্কর্য দিয়ে আমরা যাকে বলি বেঢপ বেয়ারা তাকেই সুন্দরভাবে দেখানো হচ্ছে।
সুতরাং সুন্দরের স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আদর্শ আর্টিস্টের নিজের নিজের মনে ছাড়া বাইরে নেই, কোনো কালে ছিল না, কোনো কালে থাকবেও না এটা একেবারে নিশ্চয় করে বলা যেতে পারে। সুন্দর যদি খিচুড়ি হত তবে এতদিনে সৌন্দর্যের তিল ও তাল মিলিয়ে কোনো-এক বেরসিক পরম সুন্দর করে সেটা প্রস্তুত করে যেত তথাকথিত কলারসিকদের জন্য, কিন্তু একমাত্র যাঁকে মানুষ বললে ‘রসো বৈ সঃ’ তিনিও সুন্দরের পরিপূর্ণ আদর্শ জনে-জনে মনে-মনে ছাড়া আপনার সৃষ্টিতে একত্র ও সম্পূর্ণভাবে কোথাও রাখেননি। তাঁর সৃষ্টি, এটি সুন্দর অসুন্দর দুই-ই, এবং সব দিক দিয়ে অপূর্ণও নয় পরিপূর্ণও নয় এই কথাই তিনি স্পষ্ট করে যে জানতে চায় তাকেই জানিয়েছেন। শান্তিতে-অশান্তিতে সুখে-দুঃখে সুন্দরে-অসুন্দরে মিলিয়ে হল ছোট এই নীড়, তারি মধ্যে এসে মানুষের জীবনকণা পরম সুন্দরের আলো পেয়ে ক্ষণিকের শিশিরবিন্দুর মতো নতুন নতুন সুন্দর প্রভা সুন্দর স্বপ্ন রচনা করে চলল। এই হল প্রথম শিল্পীর মানস কল্পনা ও এই বিশ্বরচনার নিয়ম, এ নিয়ম অতিক্রম করে কোনো কিছুতে পরিপূর্ণতাকে প্রত্যক্ষ রূপ দিতে পারে এমন আর্টও নেই আর্টিস্টও নেই। যা বিশ্বের মানুষের মনে বিচিত্র পদার্থের মধ্য দিয়ে বিচিত্র হয়ে ফুটতে চাচ্ছে সেই পরম সুন্দরের স্পৃহা জেগেই রইল, মিটল না। যদি পরম সুন্দরের প্রত্যক্ষ উপমান পেয়ে সত্যই কোনো দিন মিটে যায় মানুষের এই স্পৃহা, তবে ফুলের ফুটে ওঠার, নদীর ভরে ওঠার, পাতার ঘন সবুজ হয়ে ওঠার, আগুনের জ্বলে ওঠার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও ছবি আঁকা মূর্তি গড়া কবিতা লেখা গান গাওয়া ইত্যাদির স্পৃহা আর থাকে না। চাঁদ একটুখানি চাঁচ্নী থেকে আরম্ভ করে পূর্ণ সুন্দর হয়ে ওঠবার দিকে গেলেও যেমন শেষে একটুখানি অপরিণতি তার গোলটার মধ্যে থেকেই যায়, তেমনি মানুষের আর্টও কোথাও কখনো পূর্ণ সুন্দর হয়ে ওঠে না। মানুষ জানে সে নিজে অপূর্ণ, তাই পরিপূর্ণতার দিকে যাওয়ার ইচ্ছা তার এতখানি। গ্রিস ভারত চীন ঈজিপ্ট সবাই দেখি পরম সুন্দরের দিকে চলেছে, কিন্তু সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা কেউ পায়নি, কেবল পেতে চাওয়ার দিকেই চলেছে। আজ যেখানে মনে হল আর্ট দিয়ে বুঝি যতটা সুন্দর হতে পারে তাই হল, কাল দেখি সেখানেই এক শিল্পী দাঁড়িয়ে বলছে, হয়নি, আরো এগোতে হবে কিংবা পিছিয়ে অন্য পন্থা ধরতে হবে। পরম সুন্দরের দিকে মানুষের মন ও সঙ্গে সঙ্গে তার আর্টের গতি ঠিক এইভাবেই চলেছে— গতি থেকে গতিতে পৌঁছচ্ছে আর্ট, এবং একটা গতি আর-একটা গতি সৃষ্টি করছে, ঢেউ উঠলো ঠেলে, মনে করলে বুঝি চরম উন্নতিকে পেয়েছি অমনি আর-এক ঢেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ব্ললে্ চলো, আরো বাকি আছে। এইভাবে সামনে আশেপাশে নানা দিক থেকে পরম সুন্দরের টান মানুষের মনকে টানছে বিচিত্র ছন্দে বিচিত্রতার মধ্য দিয়ে, তাই মানুষের সৌন্দর্যের অনুভূতি তার আর্ট দিয়ে এমন বিচিত্র রূপ ধরে আসছে— চিরযৌবনের দেশে ফুল ফুটেই চলেছে নতুন নতুন।
মানুষ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মনে মনে ভাবে, সুন্দর! ঠিক সেই সময় আর একটি সুন্দর মুখের ছায়া আয়নায় পড়ে; যে ভাবছিল সে অবাক হয়ে বলে, তুমি যে আমার চেয়ে সুন্দর, অমনি স্বপ্নের মতো সুন্দর ছায়া হেসে বলে, আমার চোখে তুমি সুন্দর! এইভাবে এক আর্টে আর এক আর্টে, এক সুন্দরে আর এক সুন্দরে পরিচয়ের খেলা চলেছে, জগৎ-জুড়ে সুন্দর মনের সুন্দরের সঙ্গে মনে মনে খেলা। পরিপূর্ণ সৌন্দর্যকে আর্ট দিয়ে ধরতে পারলে এ খেলা কোন কালে শেষ হয়ে যেত। যে মাছ ধরে তার ছিপে যদি মৎস্য-অবতার উঠে আসত তবে সে মানুষ কোনো দিন আর মাছ ধরাধরি খেলা করত না, সে তখনি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে কলম হাতে মাছ বিক্রির হিসেব পরীক্ষা করতে বসত, আর যদি তখনও খেলার আশা তার কিছু থাকত তো এমন জায়গায় গিয়ে বসত যেখানে মাছ ছিপে ধরাই দিতে আসে না, ধরি-ধরি করতে করতে পালায়! পরম সুন্দর যিনি তিনি লুকোচুরি খেলতে জানেন, তাই নিজে লুকিয়ে থেকে বাতাসের মধ্য দিয়ে তাঁর একটু রূপের পরিমল, আলোর মধ্য দিয়ে চকিতের মতো দেখা ইত্যাদি ইঙ্গিত দিয়ে তিনি আর্টিস্টদের খেলিয়ে নিয়ে বেড়ান, আর্টিস্টের মনও সেইজন্যে এই খেলাতে সাড়া দেয়, খেলা চলেও সেই জন্যে। এক-একটা ছেলে আছে খেলতে জানে না খেলার আরম্ভেই হঠাৎ কোণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ধরা পড়ে রস-ভঙ্গ করে দেয় আর সব ছেলেগুলো তার সঙ্গে আড়ি দিয়ে বসে। তেমনি পরম সুন্দরও যদি আর্টিস্টদের সামনে হঠাৎ বেরিয়ে এসে রসভঙ্গ করতে বসেন তবে আর্টিস্টরা তাঁকে নিয়ে বড় গোলে পড়ে যায় নিশ্চয়ই। আর্টিস্টরা ভক্তেরা কবিরা— পরম সুন্দরের সঙ্গে সুন্দর-সুন্দর খেলা খেলেন কিন্তু পণ্ডিতেরা পরম সুন্দরকে অণুবীক্ষণের উপরে চড়িয়ে তাঁর হাড়হদ্দের স্টহিক হিসেব নিতে বসেন। কাজেই দেখি যারা খেলে আর যারা খেলে না সৌন্দর্য সম্বন্ধে এ দুয়ের ধারণা এবং উক্তি সম্পূর্ণ বিভিন্ন ধরনের। পণ্ডিতেরা সৌন্দর্য সম্বন্ধে বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট কথা লিখে ছাপিয়ে গেছেন, সেগুলো পড়ে নেওয়া সহজ কিন্তু পড়ে তার মধ্যে সৌন্দর্যের আবিষ্কার ক্রাই শক্ত। আর্টিস্ট তারা সুন্দরকে নিয়ে খেলা করে সুন্দরকে ধরে আনে চোখের সামনে মনের সামনে অথচ সৌন্দর্য সম্বন্ধে বলতে গেলে সব আগেই তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায় দেখতে পাই। ‘সুন্দর কাকে বলো’ এই প্রশ্নের জবাবে আর্টিস্ট ড্রুরার বললেন, ‘আমি ওসব জানিনে বাপু’ অথচ তাঁর তুলির আগায় সুন্দর বাসা বেঁধেছিল। লিয়োনার্ডো দ্য ভিন্চি যাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর্ট থেকে আরম্ভ করে বিচিত্র জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করে গেছে, তিনি বলেছেন— পরম সুন্দর ও চমৎকার অসুন্দর দুই-ই দুর্লভ, পাঁচপাঁচিই জগতে প্রচুর।
এক সময়ে আর্টিস্টদের মনে জায়গা জায়গা থেকে তিল-তিল করে বস্তুর খন্ড খন্ড সুন্দর অংশ নিয়ে একটা পরিপূর্ণ সুন্দর মূর্তি রচনা করার মতলব জেগেছিল। গ্রিসে এক কারিগর এইভাবে হেলেনের চিত্র পাঁচজন গ্রীক সুন্দরীর পঞ্চাশ টুকরো থেকে রচনা করে সমস্ত গ্রিসকে চমকে দিয়েছিল। কিছুদিন ধরে ঐ মূর্তিরই জল্পনা চলল বটে কিন্তু চিরদিন নয়, শেষে এমনও দিন এল যে ঐভাবে তিলোত্তমা গড়ার চেষ্টা ভারি মূর্খতা একথাও আর্টিস্টরা বলে বসল! আমাদের দেশেও ঐ একই ঘটনা— শাস্ত্রসম্মত মূর্তিকেই রম্য বলে পণ্ডিতেরা মত প্রকাশ করলেন, সে শাস্ত্র আর কিছু নয় কতকগুলো মাপজোখ এবং পদ্ম-আঁখি, খঞ্জন-নয়ন, তিলফুল, শুকচঞ্চু, কদলীকাণ্ড, কুক্কুটান্ড, নিম্বপত্র এইসব মিলিয়ে সৌন্দর্যের এবং আধ্যাত্মিকতার একটা পেটেন্ট খাদ্যসামগ্রী! মনের খোরাক এভাবে প্রস্তুত হয় না, কাজেই আমাদের শাস্ত্রসম্মত সুতরাং বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক যে artificiality তা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগলেও সেখানেই আর্ট শেষ হল না একথা খাটল না। একেষাং মতম্ বলে একটা জিনিস সে বলে উঠল ‘তদ্ রম্যং যত্র লগ্নং হি যস্য হৃৎ’, মানে যার যা ধরল সেই হল সুন্দর। এখন তর্ক ওঠে— মনে ধরা না-ধরার উপরে সুন্দর-অসুন্দরের বিচার যদি ছেড়ে দেওয়া যায় তবে কিছু সুন্দর কিছুই অসুন্দর থাকে না সবই সুন্দর সবই অসুন্দর প্রতিপন্ন হয়ে যায়, কোনো কিছুর একটা আদর্শ থাকে না। ভক্ত বলেন ভক্তিরসই সুন্দর আর সব অসুন্দর, যেমন শ্রীচৈতন্য বললেন--
“ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাম্বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ ভক্তিরহৈতুকি ত্বয়ি।।” (১)
আর্টিস্ট বললেন,— কাব্যং যশসে অর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবেতরক্ষতয়ে ইত্যাদি।(২) যার মন যেটাতে টানল তার কাছে সেইটেই হল সুন্দর অন্য সবার চেয়ে। এখন সহজেই আমাদের মনে এই দ্বিধা উপস্থিত হয়— কোন দিকে যাই, ভক্তের ফুলের সাজিতে গিয়ে উঠি, না আর্টিস্টের বাঁশিতে গিয়ে বাজি? কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায়, ঘোরতর বৈরাগী এবং ঘোরতর অনুরাগী দুই জনেই চাইছেন একই জিনিস— ভক্ত ধন চাইছেন না কিন্তু সব ধনের যা সার তাই চাইছেন, জন চাইছেন না কিন্তু সবার যে আপনজন তাকেই চাইছেন, সুন্দরী চান না কিন্তু চান ভক্তি, কবিতা নয় কিন্তু যিনি কবি যিনি স্রষ্টা— সুন্দরের যিনি সুন্দর— তাঁর প্রতি অচলা যে সুন্দরী ভক্তি তার কামনা করেন। আর্টিস্ট ও ভক্ত উভয়ে শেষে গিয়ে মিলেছেন যা চান সেটা সুন্দর করে পেতে চান এই কথাই বলেন। মুখে সুন্দরী চাইনে বললে হবে কেন, মন টানছে বৈরাগীর ও অনুরাগীর মতোই সমান তেজে যেটা সুন্দর সেটার দিকে। মানুষের অন্তর-বাহির দুয়ের উপরেই সুন্দরের যে বিপুল আকর্ষণ রয়েছে তা সহজেই ধরা যাচ্ছে— শুনতে চাই আমরা সুন্দর, বলতে চাই সুন্দর, উঠতে চাই, বসতে চাই, চলতে চাই সুন্দর, সুন্দরের কথা প্রত্যেক পদে পদে আমরা স্মরণ করে চলেছি। পাই না-পাই, পারি না-পারি, সুন্দর বৌ ঘরে আনবার ইচ্ছা নেই এমন লোক কম আছে। যা কিছু ভাল তারি সঙ্গে সুন্দরকে জড়িয়ে দেখা হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। আমরা কথায়-কথায় বলি— গাড়িখানি সুন্দর চলেছে, বাড়িখানি সুন্দর বানিয়েছে, ওষুধ সুন্দর কাজ করছে; এমনকি পরীক্ষার প্রশ্ন আর উত্তরগুলো সুন্দর হয়েছে একথাও বলি। এমনি সব ভালর সঙ্গে সুন্দরকে জড়িয়ে থাকতে যখন আমরা দেখছি তখন এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে সুন্দরের আকর্ষণ আমাদের মনকে ভালর দিকেই নিয়ে চলে, আর যাকে বলি অসুন্দর তারও তো একটা আকর্ষণ আছে, সেও তো যার মন টানে আমার কাছে অসুন্দর হয়েও তার কাছে সুন্দর বলেই ঠেকে, তবে মনে-ধরা এবং মন-টানার দিক থেকে সুন্দরে-অসুন্দরে ভেদ করি কেমন করে? কাজেই সুন্দর-অসুন্দর দুই মিলে চুম্বক পাথরের মতো শক্তিমান একটি জিনিস বলেই আমার কাছে ঠেকছে। সুন্দরের দিকটা হল মনকে টেনে নিয়ে চলার দিক এবং অসুন্দরের দিকও হল মনকে টেনে নিয়ে চলার দিক। এখন এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে চুম্বক যেমন ঘড়ির কাঁটাকে দক্ষিণ থেকে পরে পরে সম্পূর্ণ উত্তরে নিয়ে যায় তেমনি সুন্দরের টান মানুষের মনকে ক্ষনিক ঐহিক নৈতিক এমনি নানা সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে মহাসুন্দরের দিকেই নিয়ে চলে, আর অসুন্দরের প্রভাব সেও মানুষের মনকে আর-এক ভাবে টানতে টানতে নিয়ে চলে কদর্যতার দিকেই। কিন্তু সত্যিকারের একটা কাঁটা আর চুম্বক নিয়ে যদি এই সত্যটা পরীক্ষা করতে বসা যায় তবে দেখব সুন্দরের একটা চিহ্ন দিয়ে তারি কাছে যদি চুম্বকের টানের মুখ রাখা যায় তবে কাঁটা সোজা সুন্দরে গিয়ে ঠেকবে নিজের ঘর থেকে, আবার ঐ চুম্বনের মুখ যদি অসুন্দর চিহ্ন দিয়ে সেখানে রাখা যায় তবে ও কাঁটা উল্টো রাস্তা ধরেই ঠিক অসুন্দরে গিয়ে না ঠেকে পারে না। কিন্তু এমন তো হয় যে, আমি যদি মনে করি তবে অসুন্দরের গ্রাস থেকেও কাঁটাকে আরো খানিক টেনে সুন্দরের কাছে পৌছে দিতে পারি কিংবা সুন্দরের দিক থেকে অসুন্দরে নামিয়ে দিতে পারি ! সুতরাং সুন্দর-অসুন্দরের মধ্যে কোনটাতে আমাদের দৃষ্টি ও সৃষ্টি সমুদয় গিয়ে দাঁড়াবে তার নির্দেশকর্তা হচ্ছে আমাদের মন ও মনের ইচ্ছা। মনে হল তো সুন্দরে গিয়ে লাগলেম, মনে হল তো অসুন্দরে গিয়ে পড়লেম কিংবা সুন্দর থেকে অসুন্দর, অসুন্দর থেকে সুন্দরে দৌড় দিলেম, মন ও মনের শক্তি হল এ বিষয়ে নিয়ন্তা। টানে ধরলে যে চুম্বক ধরেছে তার মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রয়োজন না রেখেই কাঁটা আপনিই তার চরম গতি পায়, কিন্তু এই গতিকে সংযত করে অধোগতি থেকে ঊর্ধ্ব বা ঊর্ধ্ব থেকে অধোভাবের দিকে আনতে হলে আমাদের মনের একটা ইচ্ছাশক্তি একান্ত দরকার। বিল্বমঙ্গল বারবনিতার প্রেমোন্মাদ থেকে বিভূর প্রেমোন্মাদে গিয়ে ঠেকলেন সে শুধু তাঁর মনটি শক্তিমান ছিল বলেই। নিকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টে, অসুন্দর থেকে সুন্দরে যেতে সেই পারে যার মন উৎকৃষ্ট ও সুন্দর, যার মন অসুন্দর সেও এইভাবে চলে ভাল থেকে মন্দে। আর্টিস্ট কবি ভক্ত এদের মন এমনিই শক্তিমান যে অসুন্দরের মধ্য দিয়ে সুন্দরের আবিষ্কার তাঁদের পক্ষে সহজ। ভক্ত কবি আর্টিস্ট সবাই এক ধরনের মানুষ; সবাই আর্টিস্ট, আর্টিস্টের কাছে ভেদ নেই পণ্ডিতের কাছে যেমন সেটা আছে। আর্টিস্টের কাছে রসের ভেদ আছে, মনের অবস্থাভেদে সু হয় কু, কু হয় সু এও আছে, তাছাড়া রূপভেদও আছে; কিন্তু সু কু-এর যে নিদিষ্ট সীমা পণ্ডিত থেকে আরম্ভ করে অপণ্ডিত পর্যস্ত টেনে দিচ্ছে, এ রূপ সে রূপের মাঝে সেই পাকাপোক্ত পাঁচিল নেই আর্টিস্টের কাছে। নীরসেরও স্বাদ পেয়ে আর্টিস্টের মন রসায়িত হয়, এইটুকুই তফাত আর্টিস্টের আর সাধারণের মনে। তুমি আমি যখন খরার দিনে পাখা আর বরফ বলে হাঁক দিচ্ছি আর্টিস্ট তখন সুন্দর করে খরার দিন মনে ধরে কবিতা লিখলে—‘কাল বৈশাখী আগুন ঝরে, কাল বৈশাখী রোদে পোড়ে! গঙ্গা শুকু-শুকু আকাশে ছাই!’ রসের প্রেরণা সুন্দর-অসুন্দরের ধারণাকে মুক্তি দিলে, আর্টিস্টের মধ্যে সুন্দর-অসুন্দরে মিলিয়ে এক রসরূপ সে দেখে চলল। আর্টিস্ট রূপমাত্রকে নির্বিচারে গ্রহণ করলে— কেন সুন্দর কেন অসুন্দর এ প্রশ্ন আর্টিস্ট করলে না, শুধু রসরূপে যখন বস্তুটিকে দেখলে তখন সে সাধারণ মানুষের মতো আহা ওহো বলে ক্ষান্ত থাকল না, দেখার সঙ্গে আর্টিস্টের মন আপনার সৌন্দর্যের অনুভূতিটা প্রত্যক্ষ করবার জন্য সুন্দর উপায় নির্বাচন করতে লাগল সুন্দর রং চং সুন্দর ছন্দোবদ্ধ এমনি নানা সরঞ্জাম নিয়ে আর্টিস্টের সমস্ত মানসিক বৃত্তি ধাবিত হল সুন্দরের স্মৃতিটিকে একটি বাহ্যিক রূপ দিতে, কিংবা সুন্দরের স্মৃতিটিকে নতুন নতুন কল্পনার মধ্যে মিশিয়ে নতুন রচনা প্রকাশ করতে। সুন্দর বা তথাকথিত সুন্দর দুয়েরই যেমন মনকে আকর্ষণ করবার শক্তি আছে তেমনি মনের মধ্যে গভীরভাবে নিজের স্মৃতিটি মুদ্রিত করবারও শক্তি আছে— সুতরাং সুন্দরে-অসুন্দরে এখানেও এক। সুন্দরকেও যেমন ভোলবার জো নেই অসুন্দরকেও তেমনি টেনে ফেলবার উপায় নেই। দুই স্মৃতির মধ্যে শুধু তফাত এই, সুন্দরের স্মৃতিতে আনন্দ, অসুন্দরের স্পর্শে মন ব্যথিত হয়, সুখও যেমন দুঃখও তেমনি মনের একস্থানে গিয়ে সঞ্চিত হয়, শুধু দুঃখকে মানুষ ভোলবারই চেষ্টা করে আর সুখের স্মৃতিকে লতার মতো মানুষের মন জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতেই চায় দিনরাত। সাধারণ মানুষের মনেও যেমন, আর্টিস্ট মানুষের মনেও তেমনি সহজভাবেই সুন্দ্র-অসুন্দরের ক্রিয়া হয়, শুধু সাধারণ মানুষের সঙ্গে আর্টিস্টের তফাত হচ্ছে মনের অনুভূতিকে প্রকাশের ক্ষমতা বা অক্ষমতা নিয়ে। দুঃখ পেলে সাধারণ মানুষ বেজায় রকম কান্নাকাটি শুরু করে, আর্টিস্টও যে কাঁদে না তা নয়, কিন্তু তার মনের কাঁদন আর্টের মধ্যে দিয়ে একটি অপরূপ সুন্দর ছন্দে বেরিয়ে আসে। অসুন্দরের মধ্যে, অ-সুখের মধ্যে আর্টিস্টের কাছ থেকে রস আসে বলেই আর্ট মাত্রকে সুন্দরের প্রকাশ বলে গণ্য করা হয়, এবং সেই কারণে আর্টের চর্চায় ক্রমে সুন্দরের অনুভূতি আমাদের যেমন বৃদ্ধি পায় তেমন সৌন্দর্য সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক পড়ে কিংবা শুনে হয় না। আসলে যা সুন্দর তা কখনও বলে না, আমি এইজন্যে সুন্দর; আমাদের মনেও ঠিক সেইজন্যে সুন্দরকে গ্রহণ করবার বেলায় এ প্রশ্ন ওঠে না যে, কেন এ সুন্দর! আসলে যে সুন্দর নয় সেই কেবল আমাদের সামনে রঙ মেখে অলঙ্কার পরে হাব-ভাব করে এসে বলে আমি এই কারণে সুন্দর, মনও আমাদের তখনি বিচার করে বুঝে নেয় এ রঙের দ্বারা অথবা অলঙ্কারে বা আর কিছুর দ্বারায় সুন্দর দেখাচ্ছে কিনা! আসলে যা সুন্দর তাকে নিয়ে আর্টিস্ট কিংবা সাধারণ মানুষের মন বিচার করতে বসে না, সবাই বলে— সুন্দর ঠেকছে, কেন তা জানি না। কিন্তু সুন্দরের সাজে যে অসুন্দর আসে তাকে নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং আর্টিস্টের মনের তর্কের উদয় হয়। কিন্তু পণ্ডিতের মন দার্শনিকের মনের ঠিক বিপরীত উপায়ে চলে, অসুন্দরের বিচার সেখানে নেই, সব বিচার বিতর্ক সুন্দরকে নিয়ে। যা সুন্দর আমরা দেখেছি তা নিজের সুন্দরতা প্রমানের কোনো দলিল নিয়ে এল না কিন্তু আমাদের মন সহজেই তাতে রত হল, কিন্তু পণ্ডিতের সামনে এসে সুন্দর দায়গ্রস্ত হল— প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠল সুন্দরকে নিয়ে— তুমি কেন সুন্দর, কিসে সুন্দর ইত্যাদি ইত্যাদি! সুন্দর, সে সুন্দর বলেই সুন্দর, মনে ধরল বলেই সুন্দর, এ সহজ কথা সেখানে খাটল না। পণ্ডিত সেই সুন্দরকে বিশ্লেষণ করে দেখবার চেষ্টা করছেন— কি নিয়ে সুন্দরের সৌন্দর্য? সেই বিশ্লেষণের একটা মোটামুটি হিসেব করলে এই দাঁড়ায়— (১) সুখদ বলেই ইনি সুন্দর, (২) কাজের বলেই সুন্দর, (৩) উদ্দেশ্য এবং উপায় দুয়ের সঙ্গতি দেন বলেই সুন্দর, (৪) অপরিমিত বলেই সুন্দর, (৫) সুশৃঙ্খল বলেই সুন্দর, (৬) সুসংহত বলেই সুন্দর, (৭) বিচিত্র-অবিচিত্র স্ম বিষম দুই দিয়ে ইনি সুন্দর।—এইসব প্রাচীন এবং আধুনিক পণ্ডিতগণের মতামত নিয়ে সৌন্দর্যের সার ধরবার জন্যে সুন্দর একটি জাল বুনে নেওয়া যে চলে না তা নয়, কিন্তু তাতে করে সুন্দরকে ঠিক যে ধরা যায় তার আশা দিতে সাহস করি না; তবে আমি এইটুকু বলি— অন্যের কাছে সুন্দর কি বলে আপনাকে সপ্রমাণিত করছে তা আমাদের দেখায় লাভ কি? আমাদের নিজের নিজের কাছে সুন্দর কি বলে আসছে তাই আমি দেখব। আমি জানি সুন্দর সব সময়ে সুখও দেউ না কাজেও দেয় না— বিদ্যুৎশিখার মতো বিশৃঙ্খল অসংযত উদ্দ্যেশ্যহীন বিদ্রুত বিষম এবং বিচিত্র আবির্ভাব সুন্দরের! সুন্দর, এই কথাই তো বলছে আমাদের— আমি এ নই তা নই, এজন্যে সুন্দর ওজন্যে সুন্দর নই, আমি সুন্দর তাই আমি সুন্দর। আর্টের মধ্যে চক্ষু-জোড়ানো মন-ওড়ানো প্রাণ-ভোলানো ও কাঁদানো গুণ, কিংবা এর যে-কোনো একটা যেমন আর্ট নয়, আর্ট বলেই যেমন সে আর্ট, সুন্দরও তেমনি সুন্দর বলেই সুন্দর। সুন্দর নিত্য ও অমূর্ত, নানা বস্তু নানা ভাবের মধ্যে তার অধিষ্ঠান ও আরোপ হলে তবে মনোরসনা তার স্বাদ অনুভব করে— এমন সুন্দর তেমন সুন্দর সুখদ সুন্দর সুপরিমিত সুন্দর সুশৃঙ্খলিত সুন্দর! আমাদের জিব যেমন চাখে মেঠাই সন্দেশ সরবৎ ইত্যাদি পৃথক পৃথক জিনিসের মধ্য দিয়ে মিষ্টতাকে— ঠিক সেইভাবেই জীব বা জীবাত্মা মনোরসনার সাহায্যে আপনার মধ্যে সুন্দরের জন্য যে প্রকাণ্ড পিপাসা রয়েছে সেটা নানা বস্তু ধরে মেটাতে চলে। অতএব বলতে হয়, মন যার যেমনটা চায় সেইভাবে সুন্দরকে পাওয়াই হল পাওয়া, আর কারু কথা মতো কিংবা অন্য কারু মনের মতো সুন্দরকে পাওয়ার মানে— না-পাওয়াই। মা-বাপের মনের মতো হলেই বৌ সুন্দর হল একথা যে ছেলের একটু মাত্র সৌন্দর্যজ্ঞান হয়েছে সে মনে করে না। বৌ কাজের, বৌ সংসারী, বৌ বেশ সংস্থানসম্পন্না, এবং হয়তো বা ডাকসাইটে সুন্দরীও হতে পারে অন্য সবার কাছে, কিন্তু ছেলের নিজের মনের মধ্যে কাজ কর্ম সংসার সুরূপ কুরূপ ইত্যাদির একটা যে ধারণা তার সঙ্গে অন্যের পছন্দ-করা বৌ মিললো তো গোল নেই, না-হলেই মুশকিল। হিন্দিতে প্রবাদ আছে ‘আপরূচি খানা—পররূচি পহেননা’, খাবারের স্বাদ আমাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্রভাবে নিতে হয় সুতরাং সেখানে আমাদের স্বরাজ, কিন্তু পরনের বেলায় পরে যেটা দেখে সুন্দর বলে সেইটেই মেনে চলতে হয়, না-হলে নিন্দে; সুতরাং সেখানে কেউ জোর করে বলতে পারে না এইটেই পৃ পাঁচজনে যা বলে বলুক, আমরা নিজের বুদ্ধিকেও সেখানে প্রাধান্য দিতে পারিনে, দেশ কাল যে সুন্দর পরিচ্ছদের সম্মান করে তাকেই মেনে নিতে হয়। একটা কথা কিন্তু মনে রাখা চাই, সাজগোজ পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদির সম্বন্ধে কিছু ওলট পালট সময়ে সময়ে যে হয়ে আসছে তা ঐ ব্যক্তিগত স্বাধীন রূচি থেকেই আসছে। সুতরাং সব দিক দিয়ে সুন্দর-অসুন্দরের বোঝা-পড়া আমাদের ব্যক্তিগত রুচির উপরেই নির্ভর করছে। যদি সত্যই এই জগৎ অসুন্দরের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, নিছক সুন্দর জিনিস দিয়ে গড়া পরিপূর্ণ সুখদ সুশৃঙ্খল ও সর্বগুণান্বিত একটা কিছু হত তবে এর মধ্যে এসে সুন্দর অসুন্দরের কোনো প্রশ্নই আমাদের মনে উদয় হত না। আমরা এই জগৎ সংসার চিরসুন্দরের প্রকাশ ইত্যাদি কথা মুখে বললেও চোখে তা দেখিনে অনেক সময় মনেও সেটা ধরতে পারিনে, কাজেই অতৃপ্ত মন সুন্দরের বাসনায় নানা দিকে ধাবিত হয় এবং সুন্দরের একটা সাক্ষাৎ আদর্শ খাড়া করে, দেখার চেষ্টা করে এবং সুন্দরকে অসুন্দরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে আমাদের সৌন্দর্যজগৎ যে খন্ড ও খর্ব হয়ে পড়ে তা আর মনেই থাকে না। সুরূপ কুরূপ দুয়ে মিলে সুন্দরের অখন্ড মূর্তির ধারণা করা শক্ত কিন্তু একেবারে যে অসম্ভব মানুষের পক্ষে তা বলা যায় না। ভক্ত কবি এবং আর্টিস্টএদের কাছে সুন্দর-অসুন্দর বলে দুটো জিনিস নেই, সব জিনিসের ও ভাবের মধ্যে যে নিত্য বস্তুটি সেটিই সুন্দর বলে তারা ধরেন। ইন্ত্রিয়গ্রাহ্য যা কিছু তা অনিত্য, তার সুখ শৃঙ্খলা মান পরিমাণ সমস্তই অনিত্য, সুতরাং সুন্দর যা নিত্য, সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তার সঙ্গে মেলা মানুষের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব বলা যেতে পারে। আমাদের মনই কেবল গ্রহণ করতে পারে সুন্দরের আস্বাদ--
সুতরাং মনোবাসনা রোগ বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার মতো ভীষণ বিপত্তি মানুষের হতে পারে না। আর্টের দিক দিয়ে যৌবনই সুন্দর বার্ধক্য সুন্দর নয়, আলোই সুন্দর অন্ধকার নয়, সুখই সুন্দর দুঃখ নয়, পরিষ্কার দিন বাদলা নয়, বর্ষার নদী শরতের নয়, পূর্ণচন্দ্রই চন্দ্রকলা নয়— কেউ একথা বলতে পারে না। যে একেবারেই আর্টিস্ট নয় শুধু তারি পক্ষে বিচ্ছিন্ন ও খন্ড ভাবের একটা আদর্শ সৌন্দর্যকে কল্পনা করে নেওয়া সম্ভব। কবীর ছিলেন আর্টিস্ট তাই তিনি বলেছিলেন—“সবহি মূরত বীচ অমূরত, মূরতকী বলিহারী।” যে সেরা আর্টিস্ট তারি গড়া যা কিছু তারি মধ্যে এইটে লক্ষ্য করছি— ভালমন্দ সব মূর্তির মধ্যে অমূর্তি বিরাজ করছেন! “ঐসা লো নহিঁ’ তৈসা লো, মৈঁ কেহি বিধি কথৌঁ গম্ভীরা লো”— সুন্দর যে অসুন্দরের মধ্যেও আছে এ গভীর কথা বুঝিয়ে বলা শক্ত তাই কবীর এককথায় সব তর্ক শেষ করলেন। “বিছুড়ি নহিঁ মিলিহো”— বিচ্ছিন্নভাবে তাকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু এই যে সুন্দরের অখন্ড ধারণা কবীর পেলেন তার মূলে কি ভাবের সাধনা ছিল জানতে মন সহজেই উৎসুক হয়; এর উত্তর কবীর যা দিয়েছিলেন তার সঙ্গে সব আর্টিস্টের এক ছাড়া দুই মত নেই দেখা যায়—“সংতো সহজ সমাধ ভলী, সাঁঈসে মিলন ভয়ো জা দিনতে সুরত না অন্তি চলি।। আঁখ ন মুদুঁ কান ন রূংধু, কায়া কষ্ট ন ধারূঁ। খুলে নয়ন মৈ হঁস হঁস দেখুঁ সুন্দর রূপ নিহারূঁ।।” সহজ সমাধিই ভাল, হেসে চাও দেখবে সব সুন্দর, যার মনে হাসি নেই তার চোখে সুন্দরও নেই। যার প্রাণে সুর আছে বিশ্বের সুর বেসুর বিবাদী সংবাদী সবই সুন্দর গান হয়ে মেলে তারি মনে। আর যার কাছে শুধু পুঁথির সুরসপ্তক স্বরলিপি ও তাল-বেতালের বোল মাত্রই আছে, তার বুকের কাছে বিশ্বের সুর এসে তুলোট কাগজের খড়মড়ে শব্দে হঠাৎ পরিণত হয়।
এখন মানুষের ব্যক্তিগত রূচির উপরে সুন্দর-অসুন্দরের বিচারের শেষ নিষ্পত্তিটা যদি ছেড়ে দেওয়া যায় তবে সুন্দর-অসুন্দরের যাচাই করবার আদর্শ কোনখানে পাওয়া যাবে এই আশঙ্কা সবারই মনে উদয় হয়। সুন্দরকে বাহ্যিক উপমান ধরে যাচাই করে নেবার জন্যে এ ব্যস্ততার কারণ আমি খুঁজে পাইনে। ধর, সুন্দরের একটা বাঁধাবাঁধি প্রত্যক্ষ আদর্শ রইল না, প্রত্যেকে আমরা নিজের নিজের মনের কষ্টিপাথরেই বিশ্বটাকে পরীক্ষা করে চললেম— খুব আদিকালে মানুষ আর্টিস্ট যেভাবে সুন্দরকে দেখে চলেছিল— এতে করে মানুষের সৌন্দর্য উপভোগ সৌন্দর্য সৃষ্টির ধারা কি একদিনের জন্যে বন্ধ হল জগতে? বরং আর্টের ইতিহাসে এইটেই দেখতে পাই যে যেমনি কোনো জাতি বা দল আর্টের দিক দিয়ে কিছুকে আদর্শ করে নিয়ে ধরে বসলো পুরুষ-পরম্পরায় অমনি সেখানে রসের ব্যাঘাত হতে আরম্ভ হল, আর্টও ক্রমে অধঃ থেকে অধোগতি পেতে থাকল। আমাদের সঙ্গীতে সেই তানসেন ও আকব্বরী চাল, ছবিতে দিল্লীর চাল বা বিলিতি চাল যে কুকান্ড ঘটাতে পারে, এবং সেই আদর্শকে উল্টে ফেলে চললেও যা হতে পারে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণসমস্ত আমাদের সামনেই ধরা রয়েছে, সুতরাং আমার মনে হয় সুন্দরের একটা আদর্শের অভাব হলে তত ভাবনা নেই, যত ভাবনা আদর্শটা বড় হয়ে আমাদের সৌন্দর্যজ্ঞান ও অনুভবশক্তির বিলুপ্তি যদি ঘটায়। কালিদাসের আমলে ‘তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা’ ছিল সুন্দরীর আদর্শ। অজন্তার এবং তার পূর্বের যুগ থেকেও হয়তো এইআদর্শই চলে আসছিল, মোগলানী এসে অবশেষে আরমানি থেকে আরম্ভ করে ফিরিঙ্গিনী পর্যন্ত এসে সে আদর্শ উল্টে দিলে এবং হয়তো কোন দিন বা চীনইএসে সেটা আবার উল্টে দেয় তারও ঠিক নেই। আদর্শটা এমনিই অস্থায়ী জিনিস যে তাকে নিয়ে চিরকাল কারবার করা মুশকিল। রুচি বদলায় আদর্শও বদলায়, যেটা ছিল এককালের চাল সেটা হয় অন্য কালের বেচাল, ছিল টিকি এল টাই, ছিল খড়ম এল বুট, এমনি কত কি! গাছগুলো অনেককাল ধরে এক অবস্থায় রয়েছে--
সেইজন্যে এইগুলোকেই আদর্শ গাছ ইত্যাদি বলে আমাদের মনে হয় কিন্তু পৃথিবীর পুরাকালের গাছ পাতা ফল ফুলের আদর্শ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা— অথচ তারাও তো ছিল সুন্দর!— সুতরাং পরিবর্তনশীল বাইরেটার মধ্যে সুন্দর আদর্শভাবে থাকে না। শিশু গাছ বড় গাছ এবং বুড়ো গাছ প্রত্যেকেরই মধ্যে যে সুন্দরের ধারা চলছে, পরম সুন্দর হয়ে দেখা দেবার নিত্য এবং সুন্দর প্রাণের স্রোত গোপনে চলেছে তাকেই সুন্দরের আদর্শ বলে ধরতে পারি, আর কিছুকে নয়, এবং সেই আদর্শই সুন্দরকে যাচাই করার যে নিত্য আদর্শ নয় তা জোর করে কে বলতে পারে! সমস্ত পদার্থের সৌন্দর্যের পরিমাপ হল তাদের মধ্যে, অনিত্য রস যা তা নিয়ে বাইরের রঙ রূপ বদলে চলে কিন্তু নিত্য যা তার অদল-বদল নেই। সব শিল্পকে যাচাই করে নেবার জন্যে আমাদের প্রত্যেকের মনে নিত্য সুন্দরের যে একটি আদর্শ ধরা আছে— তার চেয়ে বড় আদর্শ কোথায় আর পাব? যে ভাবেই হোক যে বস্তুই হোক যখন সে নিত্য তার আস্বাদ দিয়ে আমাদের মনে পরম-সুন্দরের স্বল্পাধিক স্পর্শ অনুভব করিয়ে গেল সে সুন্দর বলে আমাদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করলে। আমার কাছে কতকগুলো জিনিস কতকগুলো ভাব সুন্দর ঠেকে কতক ঠেকে অসুন্দর, এই ঠেকল সুন্দর এই অসুন্দর, তোমার কাছেও তাই, আমার মনের সঙ্গে মেলেনা তোমারটি তোমার সঙ্গে মেলেনা আমারটি। সুন্দরের অসুন্দরের অবিচলিত আদর্শ চলায়মান জিবনে কোথাও নেই, সুতরাং জেদিক দিয়েই চল সুন্দর অসুন্দর সম্বন্ধে বিতর্ক মেটবার নয়। কাজেই এই অতৃপ্তিকেই— এই সুখ-দুঃখে আল-আঁধারে সুন্দর, অসুন্দরে মেলা খণ্ড-বিখণ্ড সত্য সুন্দর এবং মঙ্গলকে— সম্পূর্ণভাবে মেনে নিয়ে যে চলতে পারে, সেই সুন্দরকে এক ও বিচিত্র ভাবে অনুভাব করবার সুবিধে পায়। জগৎ যার কাছে তার ছোট লোহার সিন্দুকটিতেই ধরা আর জগৎ যার কাছে লোহার সিন্দুকের বাইরেও অনেকখানি বিস্তৃত ধুলোর মধ্যে কাদার মধ্যে আকাশের মধ্যে বাতাসের মধ্যে, তাদের দু’জনের কাছে সুন্দর ছোট বড় হয়ে দেখা যে দেয় তার সন্দেহ নেই! সিন্দুক খালি হলে যার সিন্দুক তার কাছে কিছুই আর সুন্দর ঠেকে না কিন্তু যার মন সিন্দুকের বাইরের জগৎকে যথার্থ ভাবে বরন করলে তার চোখে সুন্দরের দিকে চলবার অশেষ রাস্তা খুলে গেল, চলে গেল সে সোজা নির্বিচারে নির্ভয়ে। যখন দেখি নৌকা চলেছে ভয়ে ভয়ে, পদে পদে নোঙ্গর আর খোঁটার আদর্শে ঠেকতে ঠেকতে, তখন বলি, নৌকা সুন্দর চলল না, আর যখন দেখলেম নৌকা উল্টো স্রোতের বাধা উল্টো বাতাসের ঠেলাকে স্বীকার করেও গন্তব্য পথে সোজা বেরিয়ে গেল ঘাটের ধারের খোঁটা ছেড়ে নোঙ্গর তুলে নিয়ে, তখন বলি, সুন্দর চলে গেল!
সুন্দর অসুন্দর— জীবন-নদীর এই দুই টান— একে মেনে নিয়ে যে চলল সেই সুন্দর চলল আর যে এটা মেনে নিতে পারলে না সে রইল যে-কোনো একটা খোঁটায় বাঁধা। ঘাটের ধারে বাঁশের খোঁটা, তাকে অতিক্রম করে চলে যায় নদীর স্রোত নানা ছন্দে এঁকে বেঁকে,— আর্টের স্রোতও চলেছে চিরকাল ঠিক এইভাবেই চিরসুন্দরের দিকে। সুন্দর করে বাঁধা আদর্শের খোঁটাগুলো আর্টের ধাক্কায় এদিক-ওদিক দোলে, তারপর একদিন যখন বান ডাকে খোঁটা সেদিন নিজে এবং নিজের সঙ্গে বাঁধা নৌকাটাকেও নিয়ে ভেসে যায়। আর্ট এবং আর্টিস্ট এদের মনের গতি এমনি করে পণ্ডিতদের বাঁধা এবং মূর্খদের আঁকড়ে ধরা তথাকথিত দড়ি খোঁটা অতিক্রম করে উপড়ে ফেলে চলে যায়। বড় আর্টিস্টরা সুন্দরের আদর্শ গড়তে আসেন না, যেগুলো কালে কালে সুন্দরের বাঁধাবাঁধি আদর্শ হয়ে দাঁড়াবার জোগাড় করে, সেইগুলোকেই ভেঙে দিতে আসেন, ভাসিয়ে দিতে আসেন সুন্দর-অসুন্দরে মিলে যে চলন্ত নদী তারি স্রোতে। যে পারে সে ভেসে চলে মনোমতো স্থানে মনতরী ভেড়াতে ভেড়াতে সুন্দর সূর্যাস্তের মুখে, আর সেটা যে পারে না সে পরের মনোমতো সুন্দর করে বাঁধা ঘাটে আটকা থেকে আদর্শ খোঁটায় মাথা ঠুকে-ঠুকেই মরে, সুন্দর-অসুন্দরের জোয়ার-ভাঁটা তাকে বৃথাই দুলিয়ে যায় সকাল সন্ধ্যে!
বাঁধা নৌকা সে এক ভাবে সুন্দর, ছাড়া নৌকা সে আর-এক ভাবে সুন্দর; তেমনি কোনো একটা কিছু সকরুণ সুন্দর, কেউ নিষ্করুণ সুন্দর, কেউ ভীষণ সুন্দর, আবার কেউ বা এত বড় সুন্দর কি এতটুকু সুন্দর— আর্টিস্টের চোখে এইভাবে বিশ্বজগৎ সুন্দরের বিচিত্র সমাবেশ বলেই ঠেকে; আর্টিস্টের কাছে শুধু তর্ক জিনিসটাই অসুন্দর, কিন্তু তর্কের সভায় যখন ঘাড় নড়ছে হাত নড়ছে ঝড় বইছে তার বীভৎস ছন্দটা সুন্দর। সুতরাং যে আলোয় দোলে অন্ধকারে দোলে কথায় দোলে সুরে দোলে ফুলে দোলে ফলে দোলে বাতাসে দোলে পাতায় দোলে— সে শুকনোই হোক তাজাই হোক সুন্দর হোক অসুন্দর হোক সে যদি মন দোলাল তো সুন্দর হল এইটেই বোধহয় চরম কথা সুন্দর-অসুন্দরের সম্বন্ধে যা আর্টিস্ট বলতে পারেন নিঃসঙ্কোচে। আদর্শকে ভাঙতে বড় বড় আর্টিস্টরা যা আজ রচনা করে গেলেন, আস্তে আস্তে মানুষ সেইগুলোকেই যে আদর্শ ঠাউরে নেয় তার কারণ আর-কিছু নয়, আমাদের সবার মন সত্যিই যে সুন্দর তার স্বাদ পেতে ব্যাকুল থাকে— যে রচনার মধ্যে যে জীবনের মধ্যে তার আস্বাদ পায় তাকেই অন্য সবার চেয়ে বড় করে না বোধ করে সে থাকতে পারে না। এইভাবে একজন, ক্রমে দশজন। এবং এমনো হয়, সৌন্দর্য সম্বন্ধে স্বাধীন মতামত নেই অথচ চেষ্টা রয়েছে সুন্দরকে কাছাকাছি চারিদিকে পেতে, সে, অথবা সুন্দরের কোনো ধারণা সম্ভব নয় শুধু সৌন্দর্যবোধের ভান করছে, সেও, আর্ট বিশেষকে আস্তে আস্তে আদর্শ হওয়ার দিকে ঠেলে তুলে ধরে,— ঠিক যেভাবে বিশেষ বিশেষ জাতি আপনার আপনার এক-একটা জাতীয় পতাকা ধরে তারি নীচে সমবেত হয়; সে পতাকা তখনকার মতো সুন্দর হলেও একদিন তার জায়গায় নতুন মানুষ তোলে নতুন সজ্জায় সাজানো নিজের standard বা সৌন্দর্যবোধের চিহ্ন। এইভাবে একের পর আর এসে নতুন নতুন ভাবে সুন্দরের আদর্শ ভাঙা গড়া হতে হতে চলেছে পরিপূর্ণতার দিকে, কিন্তু পূর্ণ সুন্দর বলে নিজেকে বলাতে পারছে না কেউ। আর্টিস্টের সৌন্দর্যের ধারণা পাকা ফলের পরিণতির রেখাটির মতো সুডৌল ও সুগোল কিন্তু জ্যামিতির গোলের মতো একেবারে নিশ্চল গোল নয়, সচল ঢলঢলে গোল যার একটু খুঁত আছে, পূর্ণচন্দ্রের মতো পরিপূর্ণ কিন্তু সম্পূর্ণ নয়; সেই কারণে অনেক সময় বড় আর্টিস্টের রচনা সাধারণের কাছে ঠেকে যাচ্ছেতাই— কেননা সাধারণ মন জ্যামিতিক গোলের মতো আদর্শ একটা-না-একটা ধরে থাকেই, কাজেই সে সত্য কথাই বলে যখন বলে যাচ্ছেতাই, অর্থাৎ তার ইচ্ছের সঙ্গে মিলছে না আর্টিস্টের ইচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছেতাই শব্দটি বড় চমৎকার, এটিতে বোঝায়— যা ইচ্ছে তাই, সাধুভাষায় বললে বলি, যত্র লগ্নং হি যস্য হৃৎ বা যথাভিরুচি, এই যা ইচ্ছে তাই— যা মন চাচ্ছে তাই, সুতরাং রসিক ও আর্টিস্ট এই শব্দটির যথার্থ অর্থ সুন্দর অর্থ ধরেই চিরকাল চলেছে। মনের স্বাধীনতা সম্পুরনা বজায় রেখে সুন্দরকে মনের টানের উপরে ছেড়ে যা ইচ্ছে তাই বলে পণ্ডিতানাম্ মতম্-এর বাইরে বেরিয়ে পড়েছে; খোঁটা-ছাড়া নৌকা বাঁধনমুক্ত-প্রাণ! তাই দেখছি সুন্দর-অসুন্দরের বাছ-বিচার পরিত্যাগ করে তারি সঙ্গে গিয়ে লাগবার স্বাধীনতা আর্টিস্টের মনকে বড় কম প্রসার দেয় না।
বড় মন বড় সুন্দরকে ধরতে চাইছে যখন, বড় স্বাধীনতার মুক্তি তার একান্ত প্রয়োজন, কিন্তু মন যেখানে ছোট সেখানে আর্টের দিক দিয়ে এই বড় স্বাধীনতা দেওয়ার মানে ছেলের হাতে আগুনের মশালটা ধরে দেওয়া—সে লঙ্কাকাণ্ড করে বসবেই, নিজের সঙ্গে আর্টের মুখ পুড়িয়ে কিংবা ভরাডুবি করে স্রোতের মাঝে। বড় মন সে জানে বড় সুন্দরকে পেতে হলে কতটা সংযম আর বাঁধাবাঁধির মধ্য দিয়ে নিজেকে ও নিজের আর্টকে চালিয়ে নিতে হয়। ছোট সে তো বোঝে না যে পরের অনুসরণে সুন্দরের দিকে চলাতেও আলো থেকে আলোতেই গিয়ে পৌঁছোয় মন; আর নিজের ইচ্ছামতো চলতে চলতে ভুলে হঠাৎ সে অসুন্দরের নেশা ও টানে পড়ে যায়, তখন তার কোনো কারিগরিই তাকে সুন্দরের বিষয়ে প্রকাণ্ড অন্ধতা এবং আর্ট বিষয়ে সংসার-জোড়া সর্বনাশ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। পণ্ডিতরা আর কিছু না হোন পণ্ডিত তো বটে, সৌন্দর্যের এবং আর্টের লক্ষণ নিয়ম ইত্যাদি বেঁধে দিতে তাঁরা যে চেয়েছেন তা এই ছোট মনের উৎপাত থেকে আর্টকে এবং সেই সঙ্গে আর্টিস্টকেও বাঁচাতে। যত্ন লগ্নং হি জস্য হৃৎ—একথা যাঁরা শিল্পবিষয়ে পণ্ডিত তাঁরা স্বীকার করে নিলেও এই যা-ইচ্ছে-তাই শিল্পের উপরে খুব জোর দিয়ে কিছু বললেন না। কেননা তাঁরা জানতেন হৃদয় সবার সমান নয় মহৎ নয় সুন্দর নয়, হৃদয়ে যা ধরে তারও ভেদাভেদ আছে, হৃদয় আমাদের অনেক জিনিসে গিয়ে লগ্ন হয়ে যা অসুন্দর এবং একেবারেই আর্ট নয়, এবং এও দেখা যায় পরম সুন্দর এবং অপূর্ব আর্ট তাতেও গিয়ে হৃদয় লাগল না, মধুকরের মত উড়ে পড়ল না ফুলের দিকে, কাদাখোঁচার মত নদীর ধারে-ধারেই খোঁচা দিয়ে বেড়াতে লাগল পাঁকে।
যখন দেখতে পাওয়া যাছে ব্যক্তিবিশেষের হৃদয় গিয়ে লগ্ন হচ্ছে কুব্জার লাবণ্যে, আর একে পড়েছে চন্দ্রাবলীর প্রেমে অন্যে রাধে রাধে বলেই পাগল, তখন এই তিনে মিলে ঝগড়া চলবেই। এইসব তর্কের ঘূর্ণাজলে আর্টকে না ফেলে সৌন্দর্য ও আর্টের ধারাকে যদি সুনিয়ন্ত্রিত রকমে চালাতে হয় পুরুষ-পরম্পরায়, তবে পণ্ডিত ও রসিকদের কথিত সমস্ত রসের রূপের ধারার সাহায্য না নিলে কেমন করে খণ্ড-বিখণ্ডতা থেকে আর্টে একত্ব দেওয়া যাবে। আমার নিজের মুখে কি ভাল লাগল না-লাগল তা নিয়ে দু-চার সমরুচি বন্ধুকে নিমন্ত্রন করা চলে কিন্তু বিশ্বজোড়া উতসবের মধ্যে শিল্পের স্থান দিতে হলে নিজের মধ্যে যে ছোট সুন্দর বা অসুন্দর তাকে বড় করে সবার করে দেবার উপায় নিছক নিজত্বটুকু নয়; সেখানে individuality-কে universality দিয়ে যদি না ভাঙতে পারা যায়, তবে বীণার প্রত্যেক ঘাট তার পুরো সুরেই তান মারতে থাকলে কিংবা অন্য সুরের সঙ্গে মিলতে চেয়ে মন্দ্র মধ্যম হওয়াকে অস্বীকার করলে সঙ্গীতে যে কাণ্ড ঘটে, আর্টেও সৌন্দর্য সম্বন্ধে সেই যথেচ্ছাচার উপস্থিত হয় যদি সুন্দর অসুন্দর সম্বন্ধে একটা কিছু মীমাংসায় না উপস্থিত হওয়া যায় আর্টিস্ট ও রসিকদের দিক দিয়ে। ধারা ভেঙে নদী যদি চলে শতমুখী ছোটছোট তরঙ্গের লীলা-খেলা শোভা-সৌন্দর্য নিয়ে তবে সে বড় নদী হয়ে উঠতে পারে না। এইজন্যে শিল্পে পূর্বতন ধারার সঙ্গে নতুন ধারাকে মিলিয়ে নতুন নতুন সৌন্দর্যসৃষ্টির মুখে অগ্রসর হতে হয় আর্টের জগতে। সত্যই যে শক্তিমান সে পুরাতন প্রথাকে ঠেলে চলে, আর যে অশক্ত সে এই বাঁধা স্রোত বেয়ে, আস্তে আস্তে বড় শিল্প রচনার ধারা ও সুরে সুর মিলিয়ে নিজের ক্ষুদ্রতা অতিক্রম করে চলে। বাইরে রেখায়-রেখায় বর্ণে-বর্ণে, ভিতরে ভাবে-ভাবে এবং সব শেষে রুপে ও ভাবে সুসঙ্গতি নিয়ে আর্টে সৌন্দর্য বিকাশ লাভ করেছে। যে ছবি লিখেছে, গান গেয়েছে, নৃত্য করেছে সে যেমন এটা সহজে বুঝতে পারবে, তেমন যার শুধু সৌন্দর্য সম্বন্ধে পড়েছে, কি বক্তৃতা করেছে বা বক্তৃতা শুনেছে তারা তা পারবে না। সৌন্দর্যলোকের সিংহদ্বারের ভিতর দিকে চাবি, নিজের ভিতর দিক থেকে সিংহদ্বার খুলল তো বাইরের সৌন্দর্য এসে পৌঁছল মন্দিরে এবং ভিতরের খবর বয়ে চলল বাইরের অবাধ স্রোতে— সুন্দর-অসুন্দরকে বোঝবার উৎকৃষ্ট উপায় প্রত্যেককে নিজে খুঁজে নিতে হয়।
টীকা
১. শিক্ষাষ্টক— চৈতন্যদেব
২. ‘কাব্যং যশসে অর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবেতরক্ষতয়ে’— এই উদ্ধৃতিটিতে (১২) সংখ্যাটি বাদ পড়িয়া গিয়াছে। ইহা ১/২ কাব্যপ্রকাশ মম্মমভট্ট (অমরেশ্বর ঠাকুর সম্পাদিত) হইতে গৃহীত।