পাহাড়িয়া
জেগে ওঠার কিনারায় কিনারায় সুরের পাড় বোনে পাখি,--
একটি পাখি, না-দেখা পাখি, কানে-শোনা পাখি!
উত্তর-পাহাড়ের নিঃশ্বাস-মন্ত্র আগ্লে রাখে
কুয়াশার জাদু দিয়ে;
পাখিকে চিনতে দেয় না, দেখতে দেয় না।
যেদিকে বেড়া দিয়েছে সূর্যমুখী ফুলের গাছ,
সেদিক থেকে ছাড়া পেয়ে আসে সুর!
যেখানটায় পাথর ভিজিয়ে ঝরে জল
সে পথ বেয়ে আসে ভোরে ভোরে গান!
রূপ থেকে স্বতন্তরা, বুকভরা, ঘুম-ভাঙানো ভোরাই দিয়ে
পাই আমি পাখিকে,
পেয়ে যায় তাকে হিমে-নিথর উত্তর আকাশ,
পায় কতদূরের নিস্পন্দ-নীল পর্বত;
পেয়ে যায় শীত-কাতর একা হরিণ
রাজোদ্যানে ধরা!
আমারি মতো পরদেশি যে,
আর যার মধ্যে কোনো স্বপ্ন, কোন কবিত্ব নেই,
সেই আমার গোবিন্দ খানসামা--
সে শুনেছে ভোরে উঠে
গয়লা-পাড়ায় নেমে-চলার পথে;
রোজই শুধোয় সে পাখির খবর,
ফাঁদ পাতার মতলব দেয় সূর্যমুখী-বেড়ার ফাঁকে!
ঝরনা যেখানে সরু একগাছি আলোর মালা দিয়ে
বেড়ে নিয়েছে একখানি পাথর,
ঊষার এই মনের পাখি উড়ে বসে কি সেইখানে?
রাত থাক্তে পায় কি পায়ের পরশ
তার শিশিরে-মাজা নিকষ পাষাণ?
বরফ-গলা নতুন নদী—উছ্লে পড়ে, উল্সে চলে--
সে কি ধ'রে নিয়ে যায় পিয়াসী পাখির রূপের ছায়া?
যুগান্তরের শীতের সকাল অকাল-বসন্তের ভোর রাতে
পেয়েছিল যাকে
সেদিনের ঝরনা-তলায় নতুন ঝাউবনে,--
কোথা হতে এল সে-পাখি কে জানে তা?
আজকের ভোরাই ধ'রে যে-পাখি করে আসা-যাওয়া
ঘুম-ভাঙানোর বেলায়
অস্বচ্ছ কাচমোড়া আমার এই খোপ্টার বাইরে,
সে কি ঝরনার পাখি, না ঝাউবনের, না উপর পাহাড়ের
না ওই পাহাড়তলার চা-বাগিচার নীচের জঙ্গলের?
সে কি থাকে একলা কোনো পাথরের ফাটলে,
না সে বাসা নিয়েছে আমার সঙ্গে কাচমোড়া ঘরেই?
ঘরের কোণে কাচের বুদ্বুদে ধরা নিভন্ত-বাতি
সে কি জেনেছে পাখিকে?--
কাজল দিয়ে শেষ রাতে কেন লিখেছে সে
দেয়ালের ভিতর-দিকটায়
রাত পোহানো পাখীর কালো পাখ্নার
ইসারা একটু?
রং-মহল
হাল-ফেশানের শিষ্মহ্ল,
শুধু কাচ আর কাঠ আর টিন;--
যেন একটা কাফুন,
দু'চার দিনের হঠাৎ-নবাবীর ফুল্কি-কাচের কাফুন--
উই ধরা, মর্চে পড়া,
পাহাড় জুড়ে প'ড়ে আছে দেবদারুবনে।
দেবদারু আ, বাদল- ছোঁওয়া,
প্রথম যুগের সবুজ দাবানল,
কইচে পুরোনো দিনের বিজ্লি-পাখির কথা;
এরা কি রাখে কোনো খবর এই শিষ্মহলের?
ভাঙা বাগানে দেবদারু রয় রয়, আচম্কা দুলে ওঠে,
পাহাড় সে রঙের নেশায় মেতে ওঠে যেন!
মাতন মেঘে-মেঘে,
মাতামাতি পাথরে-পাথরে,
তুফান তুলে রৌদ্র-ছায়ায়
মাতামাতি মহাবনে।
পাহাড়িয়া-বাসিন্দা, দুর্মদ এরা,
নীল-মদে মত্ত আছে দিন-রাতই।
প্রচন্ড উল্লাস এদের,--
আকাশ ছাড়িয়ে উঠতে চায়,
ঝরনা দিয়ে ব'হে চলে
সাপ-খেলানো ছন্দে রসাতলের দিকে,
বিদ্যুৎ আর বাজ ধ'রে ধ'রে।
জলে-ঝড়ে মেতেই আছে এরা,
গিরি-অরণ্য সবাই;--
অশেষ মাতনে মেতেই আছে--
কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা;
বসন্তের ক্ষণিক স্বপ্ন
দেখে কি দেখে না এরা নিমেষের মতো।
বরফ-ঢালা উত্তর-বাতাস এ--
ইন্দ্রধনুর রঙে রাঙানো,
কুয়াশাতে ভারি;
এরি তলায় এ কাচ-মহল্--
ঠুন্কো, ভারি পল্কা,
একেবারেই হাল্কা--
যেন পরীস্তানের ময়ূর-পঙ্খী পান্সিটি ।--
সায়র-নীল ছায়ার ঘেরে ধরা
বুদ্বুদ্ একটি যেন সাত-রঙা!
পল-তোলা কাচের ঢাক্নি-দেওয়া রঙমহল্--
রঙ্গন ফুলের রেণু-মাখা, কাচ-পাখনা মৌমাছির
ছেড়ে-যাওয়া মৌচাকটির প্রায়
শূন্য প'ড়ে আছে ভাঙা বাগানে।
এক পলকের নির্মিতি--
চিকন-কারি কাচের ঢালাই শিষ্ মহল,--
চিকন গাঁথ্নি এমন,--
যে আলোর ভারে ভাঙলো বুঝি
মিলিয়ে গেল বা হাওয়ায় হাওয়ায়!
ফুল বাগান কাচমহলে ঘিরে,
ভাঙা ফুলদান ঘিরে উজাড় বাগানটা;--
মালাকারের বোনা ফুলের গহনা যেন ছিঁড়ে-পড়া,
এ যেন ধসে যাওয়া সরু লহর, মিঠে জলের!
মায়াতে ঘেরা বেজান্ সহরের বাগান এখানা,--
খোয়াব্ জাগায় দিক ভোলানো।
সুন্দর বুনন সুজনীর মতো আর এক বাগান--
মন মাতিয়ে রূপেতে রঙেতে
পৌঁছে যায় চোখের সামনে।
দেখি আর এক দিনের রঙ্মহল ঘিরে
খুসির জলুস্ সাত্রঙা
দিচ্ছে ঝল্ক্ ফুল বাসরে;
মহলে মহলে দিচ্ছে ঝিলিক্--
দেওয়ালে আরসিতে,
কাচের ফুলদানে, স্ফটিক-ঝালর সামাদানে,
মণি-কাটা পেয়ালাতে, সোনাতে রূপোতে মণিমাণিক্যে বিল্লোরে।
হিল্লোল দিচ্ছে রঙ--
পহল্দার কানের দুলে, মোতির কর্ণফুলে,
কালো চুলে হীরের ঝাপ্টায়,
হাতের পহুঁছায়, কন্ঠমালায়,
নূপুরে গুঞ্জরী-পঞ্চমে, পায়ের তলায় হেনার রঙে
দিচ্ছে ঝলক্, ধ'রচে জলুস জলসার বাতি।
পরীস্তানের খোস্বু হাওয়ার
একটুখানি ছোঁয়াচ পেয়ে
গুলজার যেন বাগিচা এখনো--
বুল্বুলির গানে-গানে, ফুলে-ফুলে গুলেস্তাঁর
সকাল সন্ধ্যায় এখনো মনে হয়
বনের তলায় ব'সে যায় সবুজ দরবার,--
ফুলে ফুলে ফুল-বিছানো মস্নদ্ জুড়ে;
ফুলের বাহার লাগে রোজই--
ফুলদানির ফুলের, তোর্রা বাঁধা ফুলের,
হিমে ফুটন্ত গোলাপফুলের।
বুল্বুলের মন-লোভানো মালঞ্চে এইখানে
সময়ে অসময়ে বসন্তের স্বপ্ন দিয়ে বয় যেন
গুলরুঃ বাতাস পরীস্তানের;
হঠাৎ খোলে যেন দক্ষিণ-দুয়ার শীতের রাত্রে,
ফুল বোনা কিংখাবের পর্দার ভাঁজ সরিয়ে
এসে পৌঁছোয় বাতাস--
সোনার পিঁজরাতে মাণিকে গড়া খেলনা বুল্বুলির কাছে।
—পরীস্তানের বুল্বুল্ সে
ঘুম জানে না, নেচেই চলে;
বলে অবিরত— পিও পিও পিও!
দেখি ফোয়ারা উঠছে গোলাপবাগে--
উঠছে প'ড়ছে তালে তালে,--
মণিমঞ্জীরের ছন্দ ধ'রে;
উল্সে উঠছে গোলাপ-জল ফুহরি দিয়ে,
ঝরনা বইছে উপবনে--
আবীরে চন্দনে মদে আর মেহুন্দিতে রাঙানো।
সন্ধ্যাতারার আলো-ছোঁয়ানো সাহানা সুরে
বেজেই চ'লেছে সারঙ্গী;--
সুরে সুরে আল্সে-টোলে
বিভোল ছন্দে চ'লেছে
রাগ-রাগিনী— গলাগলি সাঁঝি আর ভোরাই;--
আসছে যাচ্ছে ভোরের নেশায় ভরপুর!
নর্তকীর নূপুরের জিঞ্জীর-পরানো
স্বর্ণমৃগী তারা যেন--
ঘুরছে ফিরছে বিহ্বল উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি;
ভেবেই পায় না রঙ্মহলে হ'ল রাত্রি শেষ,
না হচ্ছে রাত্রির আরম্ভ!
সকাল সন্ধ্যার ভ্রম জাগিয়ে
চমক্ ধরে কাচ-কাফুনের ঠুনকো দেওয়াল;
আগুন-হানা রোদে, হিম ছোঁয়ানো চাঁদনীতে
দেখা দেয় একই সঙ্গে--
সেদিনের ও রঙমহল,--
ভাঙা বাগান এদিনের-ও!
কাঁটায় কাঁটায় কাঁটা ফুলে ভর্তি
মালঞ্চ এখন শুকিয়ে-যাওয়া;
এখানে ওখানে দেখছি শুধুই
মালঞ্চের মালিকের মতলবটাই;--
শেওলা-সবুজ সানে-বাঁধানো চৌরাস্তা--
একটু দেখা যায় এখনো;
একটি ধারে পাতা ঝরানো পারিজাত--
আছে উদয়্ অস্ত আবোর-ঘেরা একলাটি;
শ্বেত পাথরের আতসঘড়ি--
ফাট-ধরা তার চক্রটা--
আঙ্গুরী- সরাপের ছোপ লাগানো;
পাথরে গাঁথা নক্সা কাঁটা চবুতরা--
জাল দিয়ে ঘেরা--
হেলে প'ড়েছে অতল একটা ভাঙনের বুকে
রোদ হেলে এদিক্তায় এ-বেলা ও-বেলা;
চাঁদ ঝলে এ-পহর ও-পহর।
সাতরঙা আগুনের রূপটানে মাজা
চিকন কাচের পর্দাখানি
তারই ও পারে রঙ্মহলের অন্দর;--
আঙুর লতায় আড়াল-করা ছোট্ট মহল--
সুন্দর ছোট আপনি-ফোটা বনফুলটি;
বাতাস-ঢালা বে-দাগ কাচের ঝারি একটি--
নিরালাতে ঝাউতলায় ঝিক্মিক্ করে।
হেনার বেড়ায় আগলে-রাখা খিড়কি,
তারই মাঝে ভাঙা ফোয়ারা,--
মোতিয়া ফুলের পাপড়ি মেলানো ছোট্ট ফোয়ারা--
মকরি-সাদা বিল্লোরে ঝল্মল্--
শিশিরের ভারে নুয়ে-পড়া ফুলই যেন পরীস্তানের।
গোলাপ-জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে
খেলাই ছিল এই ফোয়ারার,
শিলের ঘাএ, কি শিশিরের ভারে, না সে রোদের স্পর্শে
ফেটে হয়েছে চুরমার--
ঝড়ে পড়েছে ভেঙে!
রূপের ঝিক্মিক্ ফোয়ারার--
ধুলোতে কাঁকরে আজও রয়েছে ছিটোনো--
ঘাসের উপর শিল-গালানো শিশিরবিন্দু— বিন্দু বিন্দু!
কাঁটাবনে লুটিয়ে পড়া ফোয়ারার
অবশেষটুকু, জড়িয়ে জড়িয়ে শতপাকে,
পড়ে আছে--
নীল ডোরা সোনালি কাচের সাপিনীটা--
ফোয়ারার তলাকার মন্ত্রে মুগ্ধ যেন।
বাগানের এই কোণে একটি ঝরনা--
নেচে চলেছে, বলছে কথা কতই!
আল-ছায়ার মায়া দিয়ে ঘেরা এই কোণে বাগানের
উড়ে এসেছে ভ্রমর একটা,
পেয়েছে হয় তো মধুর সন্ধান এইখানেই;
পাহাড়ি ঘাসের সোনালি দলায়
দুলছে আনমনে ছোট্ট একটা প্রজাপতি,--
হালকা দুটি পাখনা তা'র--
কাচমহলের খিল্-খসা ঝরোকার মতো
খুলছে আর বন্ধে আপনা আপনি!
ফুল-বাগিচার রঙ্ মহলের কাফুনটা থেকে
ছাড়া-পাওয়া স্বপ্ন
রঙে-রঙে ঢেউ খেলিয়ে অস্ত যাচ্ছে এই দিকটাতে;
এইখানটায় বাসা বেঁধেছে
বনবাসী শাহ্ বুল্বুল্,
পারদ-সাদা পাখনা তা'র,
নিশা কালো দু'টি চোখ!
ভাঙা বাগানের প্রাণপাখী সে--
করছেই উহুঃ উহুঃ উহুঃ!
নিবাসিন্দা দেশের মানুষ--
কে সে বে-খবরী একজন,
নিয়ে এল ডেকে দলে দলে
খামখেয়ালি উল্লাসীর দল;
পাহাড়ে এসে বাসা বাঁধলো তারা--
কাচে-ঘেরা,
ফুলঝারির ফুল কাটা ফুল্কি-লাগানো
কাচের বাসা,--
ফুল ফোটানো ফুল ঝরানো ফুলবাগানে,--
ভ্রমর আর বুল্বুলির মনোমত উপবনে
বসিয়ে দিলে রঙের মেলা খেলাচ্ছলে!
ক্ষণিক রঙের রঙ্গী কেই বা সে?
উল্লাসীর দল কে বা তারা
ক্ষণিকের উল্লাসে-বিলাসে
বেপরোয়া খেলে গেছে--
উদয়-অস্ত আকাশের তীরে বনে-পাহাড়ে!
মেঘে-বাসা-বাঁধা বিদ্যুতের খেলা খেলে গেছে,--
হাউইয়ের হ্লকা-লাগা সাত তারার খেলা--
খেলেই মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে!
গঙ্গাজলী-ঘন কুয়াশাতে
তলিয়ে যায় থেকে থেকে ভাঙা বাগান;--
বোঝাই যায় না কোথায় গেল,
আছে না আছে মহলঘেরা ফুলবাগান;
জানাই যায় না কোথায় শেষ কোথায় বা আরম্ভ
ঠুন্কো এই বুদ্বুদ্টির!
ফটকের বাইরে এসে পড়ি--
দিনের আলোতে চশমা-চোখে
দেখি লিখন—"শিষ্মহল টু লেট্!"
এখানে ভুটিয়া-মালী ফুলের চান্কায় ক্ষেত দিচ্ছে--
শাক-সব্জি তরি-তরকারির ক্ষেতই খুঁড়ছে মালী;
সামনেই রয়েছে তারও কাফুন্টা ধরা--
মস্ত একটা তালাবন্ধ কাচ্মহল্--
শেওলাতে সবুজ!
তিন-দরিয়া
ধাব্লা পাহাড়ের ঠিক নীচেই
কাঁতি-কালো করাতি পাহাড়,
তারও নীচে তিনমুখে তিনটে চুড়ো--
—মনিয়া-পাহাড়, তুঁতিয়া-পাহাড়, সুর্মি-পাহাড়--
—লাল সবুজ নীল,
রঙ ফেরায় ওরা সকালে বৈকালে দুপুরে।
তিন পাহাড়ের অনেক নীচে,--
ভাঙনের ধারেই, টংসুং বস্তি,
বস্তি পাহাড়ের অনেক উপরে,--
মশানের কাছেই শালবন,--
—চিতার ধুঁয়াতে ঝাপ্সা দিনরাতই--
টংসুং লামার গুম্ফা উঠছে সেখানে।
কথা দিয়েছে বস্তির মেয়েরা
—পাথর তুলে দেবে জনে জনে তিনশো ষাট,
সুরু করেছে সবাই পাথর বহার শক্ত কাজ।
নীচে থেকে উপর পাহাড় অনেকটা পথ,
সেখানে উঠে যায় মেয়েরা রোজই,--
ভারি ভারি পাথর ব'য়ে,
—দেওয়ালের পাথর, দেউলের পাথর
ব'য়ে চলে একে একে,
পিঠে ভার যায় মেয়েরা--
সারি সারি পিপীলিকা যেন।
চড়াই-পথ বিষম সরু--
ঠেকেছে গিয়ে মেঘের গোড়ায়,
—কুন্রী-ঝোপের টাটকা সবুজে আড়াল-করা হাঁটাপথ--
বেগানা পথটা গড়ানে পিছল,
খোঁচা খোঁচা পাথর বিছানো,--
চ'লে গেছে মশান ছাড়িয়ে
কত যে উপরে ঠিক নেই;
মরা ঝরনা কেটে গেছে পথটা কতকাল হ'ল,--
থেকে থেকে ঝাঁপে পথ রঙ-কুয়াসা,
রোদ পড়ে থেকে থেকে এ পথে,--
পায়ের তলায় পাথর ক'খানা
আগুন হয়ে ওঠে।
কতদিন ধরে চ'লেছে এ পথে কত না মেয়ে,--
পাথরের বোঝা নামিয়ে দিয়েছে মশানের ধারেই
সে কত বার তা'র হিসেব নেই।
ব্রতচারিণী বস্তির মেয়েরা,--
ছোটোবড়ো
সবাই করছে কঠোর,--
শোধায় না কেউ পূর্ণ হবে ব্রত কতদিনে,
কথাটি নাই, হাসি হাসি মুখ
ক'রে চলেছে কাজ সমাধা টংসুং গুম্ফার,
আনন্দ পায় এরা ভারি বোঝা বয়ে,--
কুয়াশার উপরে উপরে চলে চলায়,
এরা জানে মশান ছাড়িয়ে উপর বনেতে,
পিয়াশালের নিবিড় ছায়ায়
উঠবে একদিন অটুট গুম্ফা,--
টংসুং বস্তির কাম্না জড়ানো পাথরে পাথরে
আকাশের খুব কাছাকাছি।
বস্তি ছেড়ে একটু তফাতে,
পাইনিয়া বনের ধারেই
দেখা যায় ভিখ্ ঝরনা নেমে এসেছে,--
সে যেন তিন পাহাড়ের আশীর্বাদ
ঝ'রছে দিনরাত ধারা দিয়ে ত্রিধারায়।
এইখানটিতে দিনরাতই
রৌদ্র-ছায়াতে লতায়-পাতায়,--
মনের কথা চালাচালি করে,
ঝরনার জলে অচল পাথরে
কথা হয় যেন কত কি!
তল্লাটের মেয়েরা আসে,
দূর দূর থেকে এইখানে,
মান্সিক দিতে ঝরনা-তলায়,
মান্সা-পুজোর ডালা ব'য়ে
অপরাহ্ণে রোজই আসে
মেয়ে কয়টি একা-দোকা।
ভিখ্ ঝরনার উপরে নীচে, অরণ্যে পাড়ে
আছেন দেবতা একলাটি,
ঝরনার বুকে জমা করা পাষাণ
সেখানে আছেন তিনি চিরদিনই,--
—দাঁড়িয়ে আছেনই সাদা কালো শিল-পাটে পা রেখে--
মানস জানাতে তিনি, মনখানি জানতেও তিনি।
তিনি বনের দেবতা,--
আছেন ঝরনায়, আছেন নদীতে, আছেন সাগরেও;
জন্মমাটির দেবতা তিনি,--
জাগেন স্রোতে-ঘেরা পাথরে,
ঘুমান পদ্মবনের গোড়াতে একলা,
—পক্ষে পক্ষে পূজো নেন তিনি বস্তির মেয়ের।
মন জানিয়ে কত কি লেখা নতুন নিশান,--
এপার গাছের নতুন পাতায়,
ওপার গাছের ফুলের ডালে,--
জল ঝ'রে মাঝে পাথরে পাথরে।
এইখানে দেয় মান্সিক বস্তির মেয়েরা,--
—ধরে বেজোড় ফুল, নতুন পুতুল পিটুলির, বাতিধূপের
— মানস জানিয়ে পূজা করে মনে মনে,--
ফেরে যে যার বস্তিতে একা-দোকা,
জ্বলতে থাকে ঝরনা-তলায় মান্সা-পিদুম--
একটি, দুটি, তিনটি।
বাতাসের মুখেই ধরা
মনের-কথা-জানানো বাতি,--
যত্নে-তোলা বেজোড় ফুল,--
পল্কা পিটুলির খেলার পুতুল,--
কত নেভে, কত থাকে জ্বলে,--
কত ভেসে যায়, কত বা শুধায়,--
কত ভেঙে পড়ে, কত পায় ক্ষয়,--
সংখ্যা নেই তার!
সাঁজ-সেজুতির বেলা শেষে
যখন হিম হ’ল-রোদ,--
ঘুমিয়ে গেল মোনান্ পাখি সোনালি রূপালি,
—আলশে-হেলা পলাশ ডালে
যেন সে ফুলটি জোড়-ভাঙ্গা,--
সন্ধ্যাতারা এল চুপে চুপে,--
পূজার বেলায় মানস-পিদুম্
নামিয়ে রাখলে বনের ধারেই,--
নিরিবিলি এ-সময় ভিখ্-ঝরনাতে
মেয়েদের দেওয়া মানসা পিদুম্
যে-কথা জানায় মানস-দেবতাকে নিরালা পেয়ে,--
বস্তির মেয়ের মনই জানে তা’র সন্ধান।
আকাশ-ধরা তারার পিদুম্
নিত্য জ্বলে, নিত্য নেভে,
ঝরনায়-দেওয়া মান্সা-বাতি
এই জ্বলে, এই জ্বলে না,—
বস্তির মেয়ের মনের কোণে মান্সা নিত্যই
মনে মনে জ্ব’লে, মনেতে মেলায়— তিনসন্ধ্যা।
রাত্রিমুখে পরাহ্ণ-পাখি ডাকাডাকি করে,--
আঁখলি-ফুলের কাঁটার বেড়ায়;
দিন হয় শেষ রঙে রঙে ঝড় উঠিয়ে,
পাহাড়ে পাহাড়ে চম্কায় রঙ,--
পদ্মরাগ নীলকান্ত অয়স্কান্ত,
ইন্দ্রধনুর রঙের টংকার বাজে মেঘে মেঘে,--
ফুটে ওঠে ফুল শিমূল, পলাশ, করবী, কাঞ্চন,--
ঝলক্ দেয় পাতা হরিৎ-পীত, নীল-পীত, নীলারুণ,--
রঙ ফোটায় দিক্ বিদিক
বহুরূপ বহুরঙ।
চক্বাজারে সিনেমা-হাউস
জ্বালে এ সময়ে বিজলি-বাতি,
চলে সবাই বস্তির মেয়েরা,--
চলন্ত-ছবির তামাসা দেখতে,
রঙ্গিনী সব, রঙীন সাজ,
বড়ো রাস্তায় হেলে দুলে চলে,
—হ্র্দী কম্লী শ্যাম্লী সুর্খী--
ঝিলিমিলি রঙ চম্কায় পুঁতির গহনায়,--
ফিরোজী কাঁচের বুকপাটায়,--
ফুলকাটা সাটিনের আঙ্গরাখায়,
সোনার হারে, গালার চুড়ি মখমলে কম্বলে;
নতুন ক’রে সেজেছে সবাই,
রুখু চুলে বেণী দুলিয়ে চ’লেছে পান খেয়ে;--
থিয়েটারে-শেখা বাংলা গান মুখে মুখে সবারই,
—নয়ানবাণ ভুরুধনুর খিচুড়ি পাকানো গান--
সিনেমা-হাউসের সাইনবোর্ডের কাছেই,--
আধা-পরিষ্কার আধা-ঘোলাটে বিজ্লি-বাতির
ফানুস ঘিরে পতঙ্গ যেন ঘোরেফেরে সবাই,
সাপের মতো কুন্ডলি-পাকানো,--
জ্বলন্ত তার বিজুলিটা,--
আলোর ধাঁধা দিয়ে চায় অন্ধকারে;
লামার পাহাড়, ভিখ-ঝরনা
দেখে না আর বস্তির মেয়েরা--
মনের কোণেও!
তিন পাহাড়ের তিনটে রঙ নেভে আস্তে এ সময়,--
ওঠে চাঁদ টোল্-খাওয়া গোল,
—ত্রিশির ভৈরবের মস্ত চোখটা চেয়ে দেখে যেন;--
টুমসু লামার পাথারের স্তূপটা মশানের ধারেই
দেখায় আকাশের গায়ে কালি দিয়ে টানা;
অন্ধকারে সবার উপরে ফুটে ওঠে ধবলাগিরি
—শিলী-সাদা, ফেনি-সাদা, ধুতুরি-সাদা।
দুপুর রাতে বিজ্লি-বাতি
সিনেমা হাউসে নেভে দপ্ করে,--
ঘর ফেরে বস্তির মেয়েরা,--
ছান্দের আলো থান্দা লাগে চোখ,
দোকান-পাট বন্ধ এখন,
কাফিখানা ফেলেছে ঝাঁপ,
রাস্তায় পড়েছে ঘরের ছাওয়া সুর্মি-কালো--
একটা দুটো তিনটে।
মেঘমণ্ডল
মায়ুরী-নীল বনস্থলীর,
ও সেই কুহেলি-কুহর পাহাড়তলার মেঘ;--
পারাবত পায়রা যেন দুই রঙা
দুই দল এরা,--
বসে ওরা এপারে ওপারে ঝরনার,
রোদ ঝিল্মিল্ উত্তর হাওয়ায় ডানা মেলে।
বাসিন্দা-মেঘ ক্সতুরি-কালো ভারি-তানো
নিবাসিন্দা-মেঘ ধুতুরা-সাদা লোটানো-পাখনা্।
শিতের বেলার নতুন পাখি--
জলভরা-মেঘ জলহারা-মেঘ,--
ঝিলিক্-দেওয়া পাখনা মেলিয়ে ঘোরে ফেরে,
বাতাসে লোটানো দানা হেলিয়ে ওঠে নামে;
শূন্যে তোলে ঘূর্ণা,
আলো-ছায়ায় হিলিমিলি হিল্লোল জাগায়।
মেঘে মেঘে যেন পাখ্নার শিহরণ
ফুহরি ফুহরি ওঠে,
ফুহরি দ্রুত-বিদ্রুত বাজে পাখ্না ঝরঝরি;
—দূরে কাছে ঘুরে ফিরে
বাতাসে হেলে পাখা নীল আর শাদা।
মেঘ ওরা পারাবত পায়রা ওড়ে,
ঘোরে ফেরে খেলে খেলা সারাদিনই,
—আকাশে লোটায় বাতাসে লোটায়
লোটায় পাথরে,
—ঝরনার স্রোতে ধরে ছায়া আর ছায়া;
—কায়া আর ছায়া পাশাপাশি
ক্ষণে ক্ষণে আসে যায়।
নিমেষে কাটে রোদের বেলা,
নেমে আসে মেঘ,--
খেলাশেষে ঘর-ভোলা পাখি যেন
খুঁজে খুঁজে চলে
অন্ধকারের পারের বাসা;
শীতের রাতে সেখানে ঝাঁপে ডানা
—দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ
ঝামর কুহর স্তব্ধ আকাশে ভাসে
চাঁদনী-ছোঁয়ানো ঘুমে অলস।
হাটবার
লক্ষ্মীবারের হাট--
খড় আর বাঁশ আর জ্বালানি কাঠ নিয়ে,
ঠাকুর জমিদারের কোঠাবাড়ির ফুল-বাগান--
তারি সামনেই খোলা জমিটা বাজার-ঘেঁষা;
লেগেছে হাট সেখানে ধুমেধামে
পুণ্যের দিনে।
কচুরি পানায় ঢাকা খালের জল,--
তারি ধারে বুড়ো বুড়ো গাছ সব
চারিদিক ঘিরে সবুজের কানাত টেনে দাঁড়িয়ে,
চুপ করে হট্টগোলটা পাহারা দিচ্ছে কেবলি!
লম্বা লম্বা বাঁশ চিৎ হয়ে ঘুম দিচ্ছে
বিকোতে এসে সারিসারি খোলা মাঠে পড়ে;
বাজারের ধারে গোলা ঘর ক-টা।
টিনের ছাতাগুলো তাদের দেখতে হয়েছে ঠিক যেন
বাদলা দিনের আকাশ এক-এক খন্ড।
আর গাছের রাংতার চাদর যেন এক ফর্দি!
সরু খালের ঘোলা জল কেটে
আসছে নৌকো সারি সারি দাঁড় ফেলে--
জলের বাটে লাগিয়েছে যেন ঘোড়দৌড়,--
ঘাটে এসে বোঝা নামানোর হার-জিত খেলা;
খেলে চলেছে নৌকা, মাঝিমল্লা সবাই ওরা।
জমিদারের বড় বজ্রা--
সে বোঝা বয় না হাটের, দৌড়েও চলে না কোনোদিন,
ঘাট জুড়ে কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে,
খুব খানিক রং-চং মেখে নিয়ে গায়ে
চল্তি নৌকাগুলোকে দেখে বজ্রা গম্ভীর ভাবে!
পুরোনো ঝাউগাছটা ঘাটের ধারেই একলা দাঁড়িয়ে
জমিদারের বড় বজ্রার মাথায় ছাতা ধরে
রোদ আগলাতে, বৃষ্টি ঠেকাতে ব্যস্ত ভাব দেখায়
আর সে কেবলি বলে ‘সর্ সর্’।
রোগা রোগা চল্তি নৌকোর ভিড়,
তারই মাঝে পেটমোটা পিনেস্খানা
মনে হচ্ছে এ যেন চলতি ভাষার মাঝে
মস্ত একটা সমস্কৃত সমাস--
যার মানে পাওয়া যাচ্ছে না একেবারেই।
আতস বাজি
ধুমে ধামে বাজি পোড়ান মহারাজা,
অবেলাতে বোমা দোদমা দেদার ফাটে
—শব্দ দেয় ধু’য়া ছাড়ে অনবরত;--
চম্কি বাজি সে ধু’য়ার উপরে
থেকে থেকে ঝিলিক্ টানে
—মনে হয় বর্ষাকাল এসে গেল
দিন ভুলে দিগ্বিজয়ে;
—শুনি অসময়ে ডাকে যেন মেঘ--
ক্রীড়া-কাননে হরিণ-শিশু ডরিয়ে ওঠে,
—চম্কায় শব্দে চকিত চোখে চায়,
পদ্মবনের কিনারা থেকে
সারস পাখি দেখে ঘাড় তুলে
—আকাশের এপার ওপার ঘন অন্ধকার!
বাজির ধূ’য়া দম বন্ধ করে সন্ধ্যা বাতাসের,
রাজবাড়ির সিংদোরজায় রাজহস্তী
দুই কানে কুলো চালে কেবলি!
রাজদরবারে মহারাজা স্বয়ং
মুঠো মুঠো ফাটান ভুঁই-পটোকা
রাজপুরোহিত ছাড়েন হাউই,--
ধ্রুবলোক লক্ষ্য করে সোজা বাঁকা,
রাজকবি জ্বালান তুবড়ি শতে শতে,--
ফুলকাটা নিজের রচনা,
রাজশ্যালক ছাড়ে ছুঁচোবাজি অগণ্য,--
নগরপালের খোড়ো চাল তাগ্ করে!
পাঠশালার আঙ্গিনাতে
সুয়োরাণীর ছেলেটা
—খেলে চরকি বাজি গুরুর সঙ্গে,
গুরু বলেন শিষ্যকে,--
চরকি চমৎকার ঘুরবে তোমার
সারা ভূমণ্ডল উদয় অস্ত;
পোড়োরা করে কানাকানি,--
জাঁতা-ঘোরানোর ভঙ্গী দিয়ে জানায়,--
কুমারের চরকি গণ্ডির বাইরে জাবেই না
হবে হঠাৎ কপোকাৎ
খানিক আগুন ছিটিয়ে।
রানী-মহলে সুয়োরাণী
দেখেন তারাবাজি ছাতে উঠে,--
শতে শতে পুরাঙ্গনা তারা
ঝরায় ফুলঝরি রানীকে ঘিরে;
কন্ রানী রাজার সাঙ্গাৎনীকে--
বলি সই দুয়োরাণীর ঘরের কাছে
ফুঁসলে উঠছে ওই যেগুলো,--
অগ্নিবাণ কি ওকেই বলে?
সই বলে--
বাণ হলে চলত সোজা
এ যে আগুনের সাপ গো
চলেছে বাঁকা পথ ধরে;
রানী বলেন--
সাপ যদি হবে তো মাণিক কোথায়?
সই বলে--
মাণিক গেছে চুরি,--
হাতড়ায় তাই অন্ধকার,--
চলতে চায় সাত তারার দেশে,--
চুরি করতে সাত রাজার মাণিকটি।
রানী মহলের আর এক ধারে,--
রাজার বৌ আর রাজার মেয়ে
মণিমন্দিরের ঝরোকা খুলে দেখতে পায়,
—উপবনে নাচন-ময়ূর
বাজির শব্দে চম্কে উঠেই
মুখ ফিরিয়ে ঝিমোতে থাকে
ঝুঁটি নামিয়ে!
কন্যা বলে,--
লাগল ঘনঘটা সন্ধ্যাকাশে
ডাকে মেঘ চম্কায় বিদ্যুৎ
—নাচন-ময়ূর পাখ্না মেলে না তবুও
এ কেমন হল!
বৌরানী বলে,--
ও যে ভাই শিখী
সত্যি মেঘকে চিনতে শিখেছে
এই সে দিনে আষাঢ় মাসে!
রাজকুমারী বলে--
বৌরাণী, আকাশ হল কাজল বরণ
দীঘির জলে ফেল্ল আলো মেঘলা-করা,--
কঙ্কপাখি জলের ধারে
বসেই রইল অধোমুখ,
কলহংস সেও থাকল চুপ্, --
এপার-ওপার কমলবন
মুখর হল না ধ্বনিতে ওদের
দীর্ঘিকা আজ শূন্য ঠেকে?
রাজবধূ বলে,--
এপারে-ওপারে দুজনে ওরা জলচেনা পাখি,--
গেল বাদলে পদ্মপত্রে জলের লিখন
দেখেছে ওরা তাই আছে চুপ আজকে,
প্রানে ওদের সুর জাগে না বাজির ঘটায়!
কন্যা বলে,--
মধুবনেতে মালি মালিনী
ফুলঝরি ঝরায় মালঞ্চ আলো,--
মধুকর মধুকরী চলে নে সন্ধানে,
—জোনাকি বারবার ইসারা পাঠায় ওদের--
মধু আনতে নেই তাড়া মৌমাছির!
বৌরানী বলে,--
আগুনের ফুলকির পাশেই যে মাধবীলতা
তারি সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে ম্নটি ওদের দখিন হাওয়া
গোপনে সেই সে গত মধুমাসে!
কন্যা বলে,--
সোনার খাঁচাতে কইচে শুনি যে শুকসারিকা
কাজরী গানের প্রথম ছত্র?
বধূ বলে,--
খাঁচাতে ধরা চিরকালই
—মেঘ দেখেনি বাদলে ভেজেনি--
শুধু মুখের কথা পড়তে শিখেছে--
ভুলে বসে আছে কাজল মেঘের আসল বর্ণ!
কন্যা বলে,--
সোনার শিকলে বাঁধা তো হরিণ;
ও কেন তবে হয়েছে চঞ্চল
রংমশালের রঙেতে রঙীন দিক্প্রান্তে
চাইছে উৎকর্ণ উদ্গ্রীব!
রাজবধূ বলে,--
না না, সে অনেক দূরে--
বাশি বাজে কোথায় শুনছে ও,--
রংমশালের রঙীন মরীচিকার ওপার খুঁজছে
কালো চোখ দুটি বারে বারে।
গাঁয়ের মেয়ে দুয়োরাণী সে
থাকে কুটিরে বসে একা উদাস মনে,
দেখে গৃহ-পারাবত মেলায় ডানা ঝাঁকে ঝাঁক্, --
রংমশালের আলোর দিকে ঊড়ে চলে যায়,
আন্মনে কান পেতে শোনে দুয়োরাণী
—অনেক দূরে চাতক বলছে
রঙিন এ মেঘে আগুনই ঝরায়
জল বর্ষায় না কোনোদিন!
এ কা’র জন্য?
শোভাময় চন্দ্রোদয়ের দিকে চাই
ভাবি—এ শোভা কা’র জন্য
আলোময় প্রভাতের আকাশের দিকে চাই
ভাবি—এ আলো কা’র জন্য
কা’র জন্য বর্ষার এ ঘনচ্ছবি
কা’র জন্য অপরাজিতা ফুলের এ নীল
পাতার লতার এ সবুজ
পাকা ফলের এ সুবর্ণচ্ছবি
বোঝাতে তো কেউ নেই পাশে, কেউ নেই কাছে
মন থাকে স্তব্ধ এ রহস্যের সামনে; থাকে নিরুত্তর
অন্ত খুঁজে পায় না—তল খুঁজে পায় না—!
কার কাছে যাব জানতে--
আমার মনের অগোচর দেশ থেকে কে পাঠাচ্ছে এ-সব,
কার জন্যে? সেই কোন্ কাল থেকে আজ পর্যন্ত অফুরন্ত
এইসব এত সব!!!
এ কা’র জন্য? কে বলে দেয়।
সাঁজ-সেজুতির বেলা শেষে
যখন হিম হ’ল-রোদ,--
ঘুমিয়ে গেল মোনান্ পাখি সোনালি রূপালি,
—আলশে-হেলা পলাশ ডালে
যেন সে ফুলটি জোড়-ভাঙ্গা,--
সন্ধ্যাতারা এল চুপে চুপে,--
পূজার বেলায় মানস-পিদুম্
নামিয়ে রাখলে বনের ধারেই,--
নিরিবিলি এ-সময় ভিখ্-ঝরনাতে
মেয়েদের দেওয়া মানসা পিদুম্
যে-কথা জানায় মানস-দেবতাকে নিরালা পেয়ে,--
বস্তির মেয়ের মনই জানে তা’র সন্ধান।
আকাশ-ধরা তারার পিদুম্
নিত্য জ্বলে, নিত্য নেভে,
ঝরনায়-দেওয়া মান্সা-বাতি
এই জ্বলে, এই জ্বলে না,—
বস্তির মেয়ের মনের কোণে মান্সা নিত্যই
মনে মনে জ্ব’লে, মনেতে মেলায়— তিনসন্ধ্যা।
রাত্রিমুখে পরাহ্ণ-পাখি ডাকাডাকি করে,--
আঁখলি-ফুলের কাঁটার বেড়ায়;
দিন হয় শেষ রঙে রঙে ঝড় উঠিয়ে,
পাহাড়ে পাহাড়ে চম্কায় রঙ,--
পদ্মরাগ নীলকান্ত অয়স্কান্ত,
ইন্দ্রধনুর রঙের টংকার বাজে মেঘে মেঘে,--
ফুটে ওঠে ফুল শিমূল, পলাশ, করবী, কাঞ্চন,--
ঝলক্ দেয় পাতা হরিৎ-পীত, নীল-পীত, নীলারুণ,--
রঙ ফোটায় দিক্ বিদিক
বহুরূপ বহুরঙ।
চক্বাজারে সিনেমা-হাউস
জ্বালে এ সময়ে বিজলি-বাতি,
চলে সবাই বস্তির মেয়েরা,--
চলন্ত-ছবির তামাসা দেখতে,
রঙ্গিনী সব, রঙীন সাজ,
বড়ো রাস্তায় হেলে দুলে চলে,
—হ্র্দী কম্লী শ্যাম্লী সুর্খী--
ঝিলিমিলি রঙ চম্কায় পুঁতির গহনায়,--
ফিরোজী কাঁচের বুকপাটায়,--
ফুলকাটা সাটিনের আঙ্গরাখায়,
সোনার হারে, গালার চুড়ি মখমলে কম্বলে;
নতুন ক’রে সেজেছে সবাই,
রুখু চুলে বেণী দুলিয়ে চ’লেছে পান খেয়ে;--
থিয়েটারে-শেখা বাংলা গান মুখে মুখে সবারই,
—নয়ানবাণ ভুরুধনুর খিচুড়ি পাকানো গান--
সিনেমা-হাউসের সাইনবোর্ডের কাছেই,--
আধা-পরিষ্কার আধা-ঘোলাটে বিজ্লি-বাতির
ফানুস ঘিরে পতঙ্গ যেন ঘোরেফেরে সবাই,
সাপের মতো কুন্ডলি-পাকানো,--
জ্বলন্ত তার বিজুলিটা,--
আলোর ধাঁধা দিয়ে চায় অন্ধকারে;
লামার পাহাড়, ভিখ-ঝরনা
দেখে না আর বস্তির মেয়েরা--
মনের কোণেও!
তিন পাহাড়ের তিনটে রঙ নেভে আস্তে এ সময়,--
ওঠে চাঁদ টোল্-খাওয়া গোল,
—ত্রিশির ভৈরবের মস্ত চোখটা চেয়ে দেখে যেন;--
টুমসু লামার পাথারের স্তূপটা মশানের ধারেই
দেখায় আকাশের গায়ে কালি দিয়ে টানা;
অন্ধকারে সবার উপরে ফুটে ওঠে ধবলাগিরি
—শিলী-সাদা, ফেনি-সাদা, ধুতুরি-সাদা।
দুপুর রাতে বিজ্লি-বাতি
সিনেমা হাউসে নেভে দপ্ করে,--
ঘর ফেরে বস্তির মেয়েরা,--
ছান্দের আলো থান্দা লাগে চোখ,
দোকান-পাট বন্ধ এখন,
কাফিখানা ফেলেছে ঝাঁপ,
রাস্তায় পড়েছে ঘরের ছাওয়া সুর্মি-কালো--
একটা দুটো তিনটে।
মেঘমণ্ডল
মায়ুরী-নীল বনস্থলীর,
ও সেই কুহেলি-কুহর পাহাড়তলার মেঘ;--
পারাবত পায়রা যেন দুই রঙা
দুই দল এরা,--
বসে ওরা এপারে ওপারে ঝরনার,
রোদ ঝিল্মিল্ উত্তর হাওয়ায় ডানা মেলে।
বাসিন্দা-মেঘ ক্সতুরি-কালো ভারি-তানো
নিবাসিন্দা-মেঘ ধুতুরা-সাদা লোটানো-পাখনা্।
শিতের বেলার নতুন পাখি--
জলভরা-মেঘ জলহারা-মেঘ,--
ঝিলিক্-দেওয়া পাখনা মেলিয়ে ঘোরে ফেরে,
বাতাসে লোটানো দানা হেলিয়ে ওঠে নামে;
শূন্যে তোলে ঘূর্ণা,
আলো-ছায়ায় হিলিমিলি হিল্লোল জাগায়।
মেঘে মেঘে যেন পাখ্নার শিহরণ
ফুহরি ফুহরি ওঠে,
ফুহরি দ্রুত-বিদ্রুত বাজে পাখ্না ঝরঝরি;
—দূরে কাছে ঘুরে ফিরে
বাতাসে হেলে পাখা নীল আর শাদা।
মেঘ ওরা পারাবত পায়রা ওড়ে,
ঘোরে ফেরে খেলে খেলা সারাদিনই,
—আকাশে লোটায় বাতাসে লোটায়
লোটায় পাথরে,
—ঝরনার স্রোতে ধরে ছায়া আর ছায়া;
—কায়া আর ছায়া পাশাপাশি
ক্ষণে ক্ষণে আসে যায়।
নিমেষে কাটে রোদের বেলা,
নেমে আসে মেঘ,--
খেলাশেষে ঘর-ভোলা পাখি যেন
খুঁজে খুঁজে চলে
অন্ধকারের পারের বাসা;
শীতের রাতে সেখানে ঝাঁপে ডানা
—দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ
ঝামর কুহর স্তব্ধ আকাশে ভাসে
চাঁদনী-ছোঁয়ানো ঘুমে অলস।
হাটবার
লক্ষ্মীবারের হাট--
খড় আর বাঁশ আর জ্বালানি কাঠ নিয়ে,
ঠাকুর জমিদারের কোঠাবাড়ির ফুল-বাগান--
তারি সামনেই খোলা জমিটা বাজার-ঘেঁষা;
লেগেছে হাট সেখানে ধুমেধামে
পুণ্যের দিনে।
কচুরি পানায় ঢাকা খালের জল,--
তারি ধারে বুড়ো বুড়ো গাছ সব
চারিদিক ঘিরে সবুজের কানাত টেনে দাঁড়িয়ে,
চুপ করে হট্টগোলটা পাহারা দিচ্ছে কেবলি!
লম্বা লম্বা বাঁশ চিৎ হয়ে ঘুম দিচ্ছে
বিকোতে এসে সারিসারি খোলা মাঠে পড়ে;
বাজারের ধারে গোলা ঘর ক-টা।
টিনের ছাতাগুলো তাদের দেখতে হয়েছে ঠিক যেন
বাদলা দিনের আকাশ এক-এক খন্ড।
আর গাছের রাংতার চাদর যেন এক ফর্দি!
সরু খালের ঘোলা জল কেটে
আসছে নৌকো সারি সারি দাঁড় ফেলে--
জলের বাটে লাগিয়েছে যেন ঘোড়দৌড়,--
ঘাটে এসে বোঝা নামানোর হার-জিত খেলা;
খেলে চলেছে নৌকা, মাঝিমল্লা সবাই ওরা।
জমিদারের বড় বজ্রা--
সে বোঝা বয় না হাটের, দৌড়েও চলে না কোনোদিন,
ঘাট জুড়ে কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে,
খুব খানিক রং-চং মেখে নিয়ে গায়ে
চল্তি নৌকাগুলোকে দেখে বজ্রা গম্ভীর ভাবে!
পুরোনো ঝাউগাছটা ঘাটের ধারেই একলা দাঁড়িয়ে
জমিদারের বড় বজ্রার মাথায় ছাতা ধরে
রোদ আগলাতে, বৃষ্টি ঠেকাতে ব্যস্ত ভাব দেখায়
আর সে কেবলি বলে ‘সর্ সর্’।
রোগা রোগা চল্তি নৌকোর ভিড়,
তারই মাঝে পেটমোটা পিনেস্খানা
মনে হচ্ছে এ যেন চলতি ভাষার মাঝে
মস্ত একটা সমস্কৃত সমাস--
যার মানে পাওয়া যাচ্ছে না একেবারেই।
আতস বাজি
ধুমে ধামে বাজি পোড়ান মহারাজা,
অবেলাতে বোমা দোদমা দেদার ফাটে
—শব্দ দেয় ধু’য়া ছাড়ে অনবরত;--
চম্কি বাজি সে ধু’য়ার উপরে
থেকে থেকে ঝিলিক্ টানে
—মনে হয় বর্ষাকাল এসে গেল
দিন ভুলে দিগ্বিজয়ে;
—শুনি অসময়ে ডাকে যেন মেঘ--
ক্রীড়া-কাননে হরিণ-শিশু ডরিয়ে ওঠে,
—চম্কায় শব্দে চকিত চোখে চায়,
পদ্মবনের কিনারা থেকে
সারস পাখি দেখে ঘাড় তুলে
—আকাশের এপার ওপার ঘন অন্ধকার!
বাজির ধূ’য়া দম বন্ধ করে সন্ধ্যা বাতাসের,
রাজবাড়ির সিংদোরজায় রাজহস্তী
দুই কানে কুলো চালে কেবলি!
রাজদরবারে মহারাজা স্বয়ং
মুঠো মুঠো ফাটান ভুঁই-পটোকা
রাজপুরোহিত ছাড়েন হাউই,--
ধ্রুবলোক লক্ষ্য করে সোজা বাঁকা,
রাজকবি জ্বালান তুবড়ি শতে শতে,--
ফুলকাটা নিজের রচনা,
রাজশ্যালক ছাড়ে ছুঁচোবাজি অগণ্য,--
নগরপালের খোড়ো চাল তাগ্ করে!
পাঠশালার আঙ্গিনাতে
সুয়োরাণীর ছেলেটা
—খেলে চরকি বাজি গুরুর সঙ্গে,
গুরু বলেন শিষ্যকে,--
চরকি চমৎকার ঘুরবে তোমার
সারা ভূমণ্ডল উদয় অস্ত;
পোড়োরা করে কানাকানি,--
জাঁতা-ঘোরানোর ভঙ্গী দিয়ে জানায়,--
কুমারের চরকি গণ্ডির বাইরে জাবেই না
হবে হঠাৎ কপোকাৎ
খানিক আগুন ছিটিয়ে।
রানী-মহলে সুয়োরাণী
দেখেন তারাবাজি ছাতে উঠে,--
শতে শতে পুরাঙ্গনা তারা
ঝরায় ফুলঝরি রানীকে ঘিরে;
কন্ রানী রাজার সাঙ্গাৎনীকে--
বলি সই দুয়োরাণীর ঘরের কাছে
ফুঁসলে উঠছে ওই যেগুলো,--
অগ্নিবাণ কি ওকেই বলে?
সই বলে--
বাণ হলে চলত সোজা
এ যে আগুনের সাপ গো
চলেছে বাঁকা পথ ধরে;
রানী বলেন--
সাপ যদি হবে তো মাণিক কোথায়?
সই বলে--
মাণিক গেছে চুরি,--
হাতড়ায় তাই অন্ধকার,--
চলতে চায় সাত তারার দেশে,--
চুরি করতে সাত রাজার মাণিকটি।
রানী মহলের আর এক ধারে,--
রাজার বৌ আর রাজার মেয়ে
মণিমন্দিরের ঝরোকা খুলে দেখতে পায়,
—উপবনে নাচন-ময়ূর
বাজির শব্দে চম্কে উঠেই
মুখ ফিরিয়ে ঝিমোতে থাকে
ঝুঁটি নামিয়ে!
কন্যা বলে,--
লাগল ঘনঘটা সন্ধ্যাকাশে
ডাকে মেঘ চম্কায় বিদ্যুৎ
—নাচন-ময়ূর পাখ্না মেলে না তবুও
এ কেমন হল!
বৌরানী বলে,--
ও যে ভাই শিখী
সত্যি মেঘকে চিনতে শিখেছে
এই সে দিনে আষাঢ় মাসে!
রাজকুমারী বলে--
বৌরাণী, আকাশ হল কাজল বরণ
দীঘির জলে ফেল্ল আলো মেঘলা-করা,--
কঙ্কপাখি জলের ধারে
বসেই রইল অধোমুখ,
কলহংস সেও থাকল চুপ্, --
এপার-ওপার কমলবন
মুখর হল না ধ্বনিতে ওদের
দীর্ঘিকা আজ শূন্য ঠেকে?
রাজবধূ বলে,--
এপারে-ওপারে দুজনে ওরা জলচেনা পাখি,--
গেল বাদলে পদ্মপত্রে জলের লিখন
দেখেছে ওরা তাই আছে চুপ আজকে,
প্রানে ওদের সুর জাগে না বাজির ঘটায়!
কন্যা বলে,--
মধুবনেতে মালি মালিনী
ফুলঝরি ঝরায় মালঞ্চ আলো,--
মধুকর মধুকরী চলে নে সন্ধানে,
—জোনাকি বারবার ইসারা পাঠায় ওদের--
মধু আনতে নেই তাড়া মৌমাছির!
বৌরানী বলে,--
আগুনের ফুলকির পাশেই যে মাধবীলতা
তারি সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে ম্নটি ওদের দখিন হাওয়া
গোপনে সেই সে গত মধুমাসে!
কন্যা বলে,--
সোনার খাঁচাতে কইচে শুনি যে শুকসারিকা
কাজরী গানের প্রথম ছত্র?
বধূ বলে,--
খাঁচাতে ধরা চিরকালই
—মেঘ দেখেনি বাদলে ভেজেনি--
শুধু মুখের কথা পড়তে শিখেছে--
ভুলে বসে আছে কাজল মেঘের আসল বর্ণ!
কন্যা বলে,--
সোনার শিকলে বাঁধা তো হরিণ;
ও কেন তবে হয়েছে চঞ্চল
রংমশালের রঙেতে রঙীন দিক্প্রান্তে
চাইছে উৎকর্ণ উদ্গ্রীব!
রাজবধূ বলে,--
না না, সে অনেক দূরে--
বাশি বাজে কোথায় শুনছে ও,--
রংমশালের রঙীন মরীচিকার ওপার খুঁজছে
কালো চোখ দুটি বারে বারে।
গাঁয়ের মেয়ে দুয়োরাণী সে
থাকে কুটিরে বসে একা উদাস মনে,
দেখে গৃহ-পারাবত মেলায় ডানা ঝাঁকে ঝাঁক্, --
রংমশালের আলোর দিকে ঊড়ে চলে যায়,
আন্মনে কান পেতে শোনে দুয়োরাণী
—অনেক দূরে চাতক বলছে
রঙিন এ মেঘে আগুনই ঝরায়
জল বর্ষায় না কোনোদিন!
এ কা’র জন্য?
শোভাময় চন্দ্রোদয়ের দিকে চাই
ভাবি—এ শোভা কা’র জন্য
আলোময় প্রভাতের আকাশের দিকে চাই
ভাবি—এ আলো কা’র জন্য
কা’র জন্য বর্ষার এ ঘনচ্ছবি
কা’র জন্য অপরাজিতা ফুলের এ নীল
পাতার লতার এ সবুজ
পাকা ফলের এ সুবর্ণচ্ছবি
বোঝাতে তো কেউ নেই পাশে, কেউ নেই কাছে
মন থাকে স্তব্ধ এ রহস্যের সামনে; থাকে নিরুত্তর
অন্ত খুঁজে পায় না—তল খুঁজে পায় না—!
কার কাছে যাব জানতে--
আমার মনের অগোচর দেশ থেকে কে পাঠাচ্ছে এ-সব,
কার জন্যে? সেই কোন্ কাল থেকে আজ পর্যন্ত অফুরন্ত
এইসব এত সব!!!
এ কা’র জন্য? কে বলে দেয়।
জেগে ওঠার কিনারায় কিনারায় সুরের পাড় বোনে পাখি,--
একটি পাখি, না-দেখা পাখি, কানে-শোনা পাখি!
উত্তর-পাহাড়ের নিঃশ্বাস-মন্ত্র আগ্লে রাখে
কুয়াশার জাদু দিয়ে;
পাখিকে চিনতে দেয় না, দেখতে দেয় না।
যেদিকে বেড়া দিয়েছে সূর্যমুখী ফুলের গাছ,
সেদিক থেকে ছাড়া পেয়ে আসে সুর!
যেখানটায় পাথর ভিজিয়ে ঝরে জল
সে পথ বেয়ে আসে ভোরে ভোরে গান!
রূপ থেকে স্বতন্তরা, বুকভরা, ঘুম-ভাঙানো ভোরাই দিয়ে
পাই আমি পাখিকে,
পেয়ে যায় তাকে হিমে-নিথর উত্তর আকাশ,
পায় কতদূরের নিস্পন্দ-নীল পর্বত;
পেয়ে যায় শীত-কাতর একা হরিণ
রাজোদ্যানে ধরা!
আমারি মতো পরদেশি যে,
আর যার মধ্যে কোনো স্বপ্ন, কোন কবিত্ব নেই,
সেই আমার গোবিন্দ খানসামা--
সে শুনেছে ভোরে উঠে
গয়লা-পাড়ায় নেমে-চলার পথে;
রোজই শুধোয় সে পাখির খবর,
ফাঁদ পাতার মতলব দেয় সূর্যমুখী-বেড়ার ফাঁকে!
ঝরনা যেখানে সরু একগাছি আলোর মালা দিয়ে
বেড়ে নিয়েছে একখানি পাথর,
ঊষার এই মনের পাখি উড়ে বসে কি সেইখানে?
রাত থাক্তে পায় কি পায়ের পরশ
তার শিশিরে-মাজা নিকষ পাষাণ?
বরফ-গলা নতুন নদী—উছ্লে পড়ে, উল্সে চলে--
সে কি ধ'রে নিয়ে যায় পিয়াসী পাখির রূপের ছায়া?
যুগান্তরের শীতের সকাল অকাল-বসন্তের ভোর রাতে
পেয়েছিল যাকে
সেদিনের ঝরনা-তলায় নতুন ঝাউবনে,--
কোথা হতে এল সে-পাখি কে জানে তা?
আজকের ভোরাই ধ'রে যে-পাখি করে আসা-যাওয়া
ঘুম-ভাঙানোর বেলায়
অস্বচ্ছ কাচমোড়া আমার এই খোপ্টার বাইরে,
সে কি ঝরনার পাখি, না ঝাউবনের, না উপর পাহাড়ের
না ওই পাহাড়তলার চা-বাগিচার নীচের জঙ্গলের?
সে কি থাকে একলা কোনো পাথরের ফাটলে,
না সে বাসা নিয়েছে আমার সঙ্গে কাচমোড়া ঘরেই?
ঘরের কোণে কাচের বুদ্বুদে ধরা নিভন্ত-বাতি
সে কি জেনেছে পাখিকে?--
কাজল দিয়ে শেষ রাতে কেন লিখেছে সে
দেয়ালের ভিতর-দিকটায়
রাত পোহানো পাখীর কালো পাখ্নার
ইসারা একটু?
রং-মহল
হাল-ফেশানের শিষ্মহ্ল,
শুধু কাচ আর কাঠ আর টিন;--
যেন একটা কাফুন,
দু'চার দিনের হঠাৎ-নবাবীর ফুল্কি-কাচের কাফুন--
উই ধরা, মর্চে পড়া,
পাহাড় জুড়ে প'ড়ে আছে দেবদারুবনে।
দেবদারু আ, বাদল- ছোঁওয়া,
প্রথম যুগের সবুজ দাবানল,
কইচে পুরোনো দিনের বিজ্লি-পাখির কথা;
এরা কি রাখে কোনো খবর এই শিষ্মহলের?
ভাঙা বাগানে দেবদারু রয় রয়, আচম্কা দুলে ওঠে,
পাহাড় সে রঙের নেশায় মেতে ওঠে যেন!
মাতন মেঘে-মেঘে,
মাতামাতি পাথরে-পাথরে,
তুফান তুলে রৌদ্র-ছায়ায়
মাতামাতি মহাবনে।
পাহাড়িয়া-বাসিন্দা, দুর্মদ এরা,
নীল-মদে মত্ত আছে দিন-রাতই।
প্রচন্ড উল্লাস এদের,--
আকাশ ছাড়িয়ে উঠতে চায়,
ঝরনা দিয়ে ব'হে চলে
সাপ-খেলানো ছন্দে রসাতলের দিকে,
বিদ্যুৎ আর বাজ ধ'রে ধ'রে।
জলে-ঝড়ে মেতেই আছে এরা,
গিরি-অরণ্য সবাই;--
অশেষ মাতনে মেতেই আছে--
কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা;
বসন্তের ক্ষণিক স্বপ্ন
দেখে কি দেখে না এরা নিমেষের মতো।
বরফ-ঢালা উত্তর-বাতাস এ--
ইন্দ্রধনুর রঙে রাঙানো,
কুয়াশাতে ভারি;
এরি তলায় এ কাচ-মহল্--
ঠুন্কো, ভারি পল্কা,
একেবারেই হাল্কা--
যেন পরীস্তানের ময়ূর-পঙ্খী পান্সিটি ।--
সায়র-নীল ছায়ার ঘেরে ধরা
বুদ্বুদ্ একটি যেন সাত-রঙা!
পল-তোলা কাচের ঢাক্নি-দেওয়া রঙমহল্--
রঙ্গন ফুলের রেণু-মাখা, কাচ-পাখনা মৌমাছির
ছেড়ে-যাওয়া মৌচাকটির প্রায়
শূন্য প'ড়ে আছে ভাঙা বাগানে।
এক পলকের নির্মিতি--
চিকন-কারি কাচের ঢালাই শিষ্ মহল,--
চিকন গাঁথ্নি এমন,--
যে আলোর ভারে ভাঙলো বুঝি
মিলিয়ে গেল বা হাওয়ায় হাওয়ায়!
ফুল বাগান কাচমহলে ঘিরে,
ভাঙা ফুলদান ঘিরে উজাড় বাগানটা;--
মালাকারের বোনা ফুলের গহনা যেন ছিঁড়ে-পড়া,
এ যেন ধসে যাওয়া সরু লহর, মিঠে জলের!
মায়াতে ঘেরা বেজান্ সহরের বাগান এখানা,--
খোয়াব্ জাগায় দিক ভোলানো।
সুন্দর বুনন সুজনীর মতো আর এক বাগান--
মন মাতিয়ে রূপেতে রঙেতে
পৌঁছে যায় চোখের সামনে।
দেখি আর এক দিনের রঙ্মহল ঘিরে
খুসির জলুস্ সাত্রঙা
দিচ্ছে ঝল্ক্ ফুল বাসরে;
মহলে মহলে দিচ্ছে ঝিলিক্--
দেওয়ালে আরসিতে,
কাচের ফুলদানে, স্ফটিক-ঝালর সামাদানে,
মণি-কাটা পেয়ালাতে, সোনাতে রূপোতে মণিমাণিক্যে বিল্লোরে।
হিল্লোল দিচ্ছে রঙ--
পহল্দার কানের দুলে, মোতির কর্ণফুলে,
কালো চুলে হীরের ঝাপ্টায়,
হাতের পহুঁছায়, কন্ঠমালায়,
নূপুরে গুঞ্জরী-পঞ্চমে, পায়ের তলায় হেনার রঙে
দিচ্ছে ঝলক্, ধ'রচে জলুস জলসার বাতি।
পরীস্তানের খোস্বু হাওয়ার
একটুখানি ছোঁয়াচ পেয়ে
গুলজার যেন বাগিচা এখনো--
বুল্বুলির গানে-গানে, ফুলে-ফুলে গুলেস্তাঁর
সকাল সন্ধ্যায় এখনো মনে হয়
বনের তলায় ব'সে যায় সবুজ দরবার,--
ফুলে ফুলে ফুল-বিছানো মস্নদ্ জুড়ে;
ফুলের বাহার লাগে রোজই--
ফুলদানির ফুলের, তোর্রা বাঁধা ফুলের,
হিমে ফুটন্ত গোলাপফুলের।
বুল্বুলের মন-লোভানো মালঞ্চে এইখানে
সময়ে অসময়ে বসন্তের স্বপ্ন দিয়ে বয় যেন
গুলরুঃ বাতাস পরীস্তানের;
হঠাৎ খোলে যেন দক্ষিণ-দুয়ার শীতের রাত্রে,
ফুল বোনা কিংখাবের পর্দার ভাঁজ সরিয়ে
এসে পৌঁছোয় বাতাস--
সোনার পিঁজরাতে মাণিকে গড়া খেলনা বুল্বুলির কাছে।
—পরীস্তানের বুল্বুল্ সে
ঘুম জানে না, নেচেই চলে;
বলে অবিরত— পিও পিও পিও!
দেখি ফোয়ারা উঠছে গোলাপবাগে--
উঠছে প'ড়ছে তালে তালে,--
মণিমঞ্জীরের ছন্দ ধ'রে;
উল্সে উঠছে গোলাপ-জল ফুহরি দিয়ে,
ঝরনা বইছে উপবনে--
আবীরে চন্দনে মদে আর মেহুন্দিতে রাঙানো।
সন্ধ্যাতারার আলো-ছোঁয়ানো সাহানা সুরে
বেজেই চ'লেছে সারঙ্গী;--
সুরে সুরে আল্সে-টোলে
বিভোল ছন্দে চ'লেছে
রাগ-রাগিনী— গলাগলি সাঁঝি আর ভোরাই;--
আসছে যাচ্ছে ভোরের নেশায় ভরপুর!
নর্তকীর নূপুরের জিঞ্জীর-পরানো
স্বর্ণমৃগী তারা যেন--
ঘুরছে ফিরছে বিহ্বল উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি;
ভেবেই পায় না রঙ্মহলে হ'ল রাত্রি শেষ,
না হচ্ছে রাত্রির আরম্ভ!
সকাল সন্ধ্যার ভ্রম জাগিয়ে
চমক্ ধরে কাচ-কাফুনের ঠুনকো দেওয়াল;
আগুন-হানা রোদে, হিম ছোঁয়ানো চাঁদনীতে
দেখা দেয় একই সঙ্গে--
সেদিনের ও রঙমহল,--
ভাঙা বাগান এদিনের-ও!
কাঁটায় কাঁটায় কাঁটা ফুলে ভর্তি
মালঞ্চ এখন শুকিয়ে-যাওয়া;
এখানে ওখানে দেখছি শুধুই
মালঞ্চের মালিকের মতলবটাই;--
শেওলা-সবুজ সানে-বাঁধানো চৌরাস্তা--
একটু দেখা যায় এখনো;
একটি ধারে পাতা ঝরানো পারিজাত--
আছে উদয়্ অস্ত আবোর-ঘেরা একলাটি;
শ্বেত পাথরের আতসঘড়ি--
ফাট-ধরা তার চক্রটা--
আঙ্গুরী- সরাপের ছোপ লাগানো;
পাথরে গাঁথা নক্সা কাঁটা চবুতরা--
জাল দিয়ে ঘেরা--
হেলে প'ড়েছে অতল একটা ভাঙনের বুকে
রোদ হেলে এদিক্তায় এ-বেলা ও-বেলা;
চাঁদ ঝলে এ-পহর ও-পহর।
সাতরঙা আগুনের রূপটানে মাজা
চিকন কাচের পর্দাখানি
তারই ও পারে রঙ্মহলের অন্দর;--
আঙুর লতায় আড়াল-করা ছোট্ট মহল--
সুন্দর ছোট আপনি-ফোটা বনফুলটি;
বাতাস-ঢালা বে-দাগ কাচের ঝারি একটি--
নিরালাতে ঝাউতলায় ঝিক্মিক্ করে।
হেনার বেড়ায় আগলে-রাখা খিড়কি,
তারই মাঝে ভাঙা ফোয়ারা,--
মোতিয়া ফুলের পাপড়ি মেলানো ছোট্ট ফোয়ারা--
মকরি-সাদা বিল্লোরে ঝল্মল্--
শিশিরের ভারে নুয়ে-পড়া ফুলই যেন পরীস্তানের।
গোলাপ-জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে
খেলাই ছিল এই ফোয়ারার,
শিলের ঘাএ, কি শিশিরের ভারে, না সে রোদের স্পর্শে
ফেটে হয়েছে চুরমার--
ঝড়ে পড়েছে ভেঙে!
রূপের ঝিক্মিক্ ফোয়ারার--
ধুলোতে কাঁকরে আজও রয়েছে ছিটোনো--
ঘাসের উপর শিল-গালানো শিশিরবিন্দু— বিন্দু বিন্দু!
কাঁটাবনে লুটিয়ে পড়া ফোয়ারার
অবশেষটুকু, জড়িয়ে জড়িয়ে শতপাকে,
পড়ে আছে--
নীল ডোরা সোনালি কাচের সাপিনীটা--
ফোয়ারার তলাকার মন্ত্রে মুগ্ধ যেন।
বাগানের এই কোণে একটি ঝরনা--
নেচে চলেছে, বলছে কথা কতই!
আল-ছায়ার মায়া দিয়ে ঘেরা এই কোণে বাগানের
উড়ে এসেছে ভ্রমর একটা,
পেয়েছে হয় তো মধুর সন্ধান এইখানেই;
পাহাড়ি ঘাসের সোনালি দলায়
দুলছে আনমনে ছোট্ট একটা প্রজাপতি,--
হালকা দুটি পাখনা তা'র--
কাচমহলের খিল্-খসা ঝরোকার মতো
খুলছে আর বন্ধে আপনা আপনি!
ফুল-বাগিচার রঙ্ মহলের কাফুনটা থেকে
ছাড়া-পাওয়া স্বপ্ন
রঙে-রঙে ঢেউ খেলিয়ে অস্ত যাচ্ছে এই দিকটাতে;
এইখানটায় বাসা বেঁধেছে
বনবাসী শাহ্ বুল্বুল্,
পারদ-সাদা পাখনা তা'র,
নিশা কালো দু'টি চোখ!
ভাঙা বাগানের প্রাণপাখী সে--
করছেই উহুঃ উহুঃ উহুঃ!
নিবাসিন্দা দেশের মানুষ--
কে সে বে-খবরী একজন,
নিয়ে এল ডেকে দলে দলে
খামখেয়ালি উল্লাসীর দল;
পাহাড়ে এসে বাসা বাঁধলো তারা--
কাচে-ঘেরা,
ফুলঝারির ফুল কাটা ফুল্কি-লাগানো
কাচের বাসা,--
ফুল ফোটানো ফুল ঝরানো ফুলবাগানে,--
ভ্রমর আর বুল্বুলির মনোমত উপবনে
বসিয়ে দিলে রঙের মেলা খেলাচ্ছলে!
ক্ষণিক রঙের রঙ্গী কেই বা সে?
উল্লাসীর দল কে বা তারা
ক্ষণিকের উল্লাসে-বিলাসে
বেপরোয়া খেলে গেছে--
উদয়-অস্ত আকাশের তীরে বনে-পাহাড়ে!
মেঘে-বাসা-বাঁধা বিদ্যুতের খেলা খেলে গেছে,--
হাউইয়ের হ্লকা-লাগা সাত তারার খেলা--
খেলেই মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে!
গঙ্গাজলী-ঘন কুয়াশাতে
তলিয়ে যায় থেকে থেকে ভাঙা বাগান;--
বোঝাই যায় না কোথায় গেল,
আছে না আছে মহলঘেরা ফুলবাগান;
জানাই যায় না কোথায় শেষ কোথায় বা আরম্ভ
ঠুন্কো এই বুদ্বুদ্টির!
ফটকের বাইরে এসে পড়ি--
দিনের আলোতে চশমা-চোখে
দেখি লিখন—"শিষ্মহল টু লেট্!"
এখানে ভুটিয়া-মালী ফুলের চান্কায় ক্ষেত দিচ্ছে--
শাক-সব্জি তরি-তরকারির ক্ষেতই খুঁড়ছে মালী;
সামনেই রয়েছে তারও কাফুন্টা ধরা--
মস্ত একটা তালাবন্ধ কাচ্মহল্--
শেওলাতে সবুজ!
তিন-দরিয়া
ধাব্লা পাহাড়ের ঠিক নীচেই
কাঁতি-কালো করাতি পাহাড়,
তারও নীচে তিনমুখে তিনটে চুড়ো--
—মনিয়া-পাহাড়, তুঁতিয়া-পাহাড়, সুর্মি-পাহাড়--
—লাল সবুজ নীল,
রঙ ফেরায় ওরা সকালে বৈকালে দুপুরে।
তিন পাহাড়ের অনেক নীচে,--
ভাঙনের ধারেই, টংসুং বস্তি,
বস্তি পাহাড়ের অনেক উপরে,--
মশানের কাছেই শালবন,--
—চিতার ধুঁয়াতে ঝাপ্সা দিনরাতই--
টংসুং লামার গুম্ফা উঠছে সেখানে।
কথা দিয়েছে বস্তির মেয়েরা
—পাথর তুলে দেবে জনে জনে তিনশো ষাট,
সুরু করেছে সবাই পাথর বহার শক্ত কাজ।
নীচে থেকে উপর পাহাড় অনেকটা পথ,
সেখানে উঠে যায় মেয়েরা রোজই,--
ভারি ভারি পাথর ব'য়ে,
—দেওয়ালের পাথর, দেউলের পাথর
ব'য়ে চলে একে একে,
পিঠে ভার যায় মেয়েরা--
সারি সারি পিপীলিকা যেন।
চড়াই-পথ বিষম সরু--
ঠেকেছে গিয়ে মেঘের গোড়ায়,
—কুন্রী-ঝোপের টাটকা সবুজে আড়াল-করা হাঁটাপথ--
বেগানা পথটা গড়ানে পিছল,
খোঁচা খোঁচা পাথর বিছানো,--
চ'লে গেছে মশান ছাড়িয়ে
কত যে উপরে ঠিক নেই;
মরা ঝরনা কেটে গেছে পথটা কতকাল হ'ল,--
থেকে থেকে ঝাঁপে পথ রঙ-কুয়াসা,
রোদ পড়ে থেকে থেকে এ পথে,--
পায়ের তলায় পাথর ক'খানা
আগুন হয়ে ওঠে।
কতদিন ধরে চ'লেছে এ পথে কত না মেয়ে,--
পাথরের বোঝা নামিয়ে দিয়েছে মশানের ধারেই
সে কত বার তা'র হিসেব নেই।
ব্রতচারিণী বস্তির মেয়েরা,--
ছোটোবড়ো
সবাই করছে কঠোর,--
শোধায় না কেউ পূর্ণ হবে ব্রত কতদিনে,
কথাটি নাই, হাসি হাসি মুখ
ক'রে চলেছে কাজ সমাধা টংসুং গুম্ফার,
আনন্দ পায় এরা ভারি বোঝা বয়ে,--
কুয়াশার উপরে উপরে চলে চলায়,
এরা জানে মশান ছাড়িয়ে উপর বনেতে,
পিয়াশালের নিবিড় ছায়ায়
উঠবে একদিন অটুট গুম্ফা,--
টংসুং বস্তির কাম্না জড়ানো পাথরে পাথরে
আকাশের খুব কাছাকাছি।
বস্তি ছেড়ে একটু তফাতে,
পাইনিয়া বনের ধারেই
দেখা যায় ভিখ্ ঝরনা নেমে এসেছে,--
সে যেন তিন পাহাড়ের আশীর্বাদ
ঝ'রছে দিনরাত ধারা দিয়ে ত্রিধারায়।
এইখানটিতে দিনরাতই
রৌদ্র-ছায়াতে লতায়-পাতায়,--
মনের কথা চালাচালি করে,
ঝরনার জলে অচল পাথরে
কথা হয় যেন কত কি!
তল্লাটের মেয়েরা আসে,
দূর দূর থেকে এইখানে,
মান্সিক দিতে ঝরনা-তলায়,
মান্সা-পুজোর ডালা ব'য়ে
অপরাহ্ণে রোজই আসে
মেয়ে কয়টি একা-দোকা।
ভিখ্ ঝরনার উপরে নীচে, অরণ্যে পাড়ে
আছেন দেবতা একলাটি,
ঝরনার বুকে জমা করা পাষাণ
সেখানে আছেন তিনি চিরদিনই,--
—দাঁড়িয়ে আছেনই সাদা কালো শিল-পাটে পা রেখে--
মানস জানাতে তিনি, মনখানি জানতেও তিনি।
তিনি বনের দেবতা,--
আছেন ঝরনায়, আছেন নদীতে, আছেন সাগরেও;
জন্মমাটির দেবতা তিনি,--
জাগেন স্রোতে-ঘেরা পাথরে,
ঘুমান পদ্মবনের গোড়াতে একলা,
—পক্ষে পক্ষে পূজো নেন তিনি বস্তির মেয়ের।
মন জানিয়ে কত কি লেখা নতুন নিশান,--
এপার গাছের নতুন পাতায়,
ওপার গাছের ফুলের ডালে,--
জল ঝ'রে মাঝে পাথরে পাথরে।
এইখানে দেয় মান্সিক বস্তির মেয়েরা,--
—ধরে বেজোড় ফুল, নতুন পুতুল পিটুলির, বাতিধূপের
— মানস জানিয়ে পূজা করে মনে মনে,--
ফেরে যে যার বস্তিতে একা-দোকা,
জ্বলতে থাকে ঝরনা-তলায় মান্সা-পিদুম--
একটি, দুটি, তিনটি।
বাতাসের মুখেই ধরা
মনের-কথা-জানানো বাতি,--
যত্নে-তোলা বেজোড় ফুল,--
পল্কা পিটুলির খেলার পুতুল,--
কত নেভে, কত থাকে জ্বলে,--
কত ভেসে যায়, কত বা শুধায়,--
কত ভেঙে পড়ে, কত পায় ক্ষয়,--
সংখ্যা নেই তার!
সাঁজ-সেজুতির বেলা শেষে
যখন হিম হ’ল-রোদ,--
ঘুমিয়ে গেল মোনান্ পাখি সোনালি রূপালি,
—আলশে-হেলা পলাশ ডালে
যেন সে ফুলটি জোড়-ভাঙ্গা,--
সন্ধ্যাতারা এল চুপে চুপে,--
পূজার বেলায় মানস-পিদুম্
নামিয়ে রাখলে বনের ধারেই,--
নিরিবিলি এ-সময় ভিখ্-ঝরনাতে
মেয়েদের দেওয়া মানসা পিদুম্
যে-কথা জানায় মানস-দেবতাকে নিরালা পেয়ে,--
বস্তির মেয়ের মনই জানে তা’র সন্ধান।
আকাশ-ধরা তারার পিদুম্
নিত্য জ্বলে, নিত্য নেভে,
ঝরনায়-দেওয়া মান্সা-বাতি
এই জ্বলে, এই জ্বলে না,—
বস্তির মেয়ের মনের কোণে মান্সা নিত্যই
মনে মনে জ্ব’লে, মনেতে মেলায়— তিনসন্ধ্যা।
রাত্রিমুখে পরাহ্ণ-পাখি ডাকাডাকি করে,--
আঁখলি-ফুলের কাঁটার বেড়ায়;
দিন হয় শেষ রঙে রঙে ঝড় উঠিয়ে,
পাহাড়ে পাহাড়ে চম্কায় রঙ,--
পদ্মরাগ নীলকান্ত অয়স্কান্ত,
ইন্দ্রধনুর রঙের টংকার বাজে মেঘে মেঘে,--
ফুটে ওঠে ফুল শিমূল, পলাশ, করবী, কাঞ্চন,--
ঝলক্ দেয় পাতা হরিৎ-পীত, নীল-পীত, নীলারুণ,--
রঙ ফোটায় দিক্ বিদিক
বহুরূপ বহুরঙ।
চক্বাজারে সিনেমা-হাউস
জ্বালে এ সময়ে বিজলি-বাতি,
চলে সবাই বস্তির মেয়েরা,--
চলন্ত-ছবির তামাসা দেখতে,
রঙ্গিনী সব, রঙীন সাজ,
বড়ো রাস্তায় হেলে দুলে চলে,
—হ্র্দী কম্লী শ্যাম্লী সুর্খী--
ঝিলিমিলি রঙ চম্কায় পুঁতির গহনায়,--
ফিরোজী কাঁচের বুকপাটায়,--
ফুলকাটা সাটিনের আঙ্গরাখায়,
সোনার হারে, গালার চুড়ি মখমলে কম্বলে;
নতুন ক’রে সেজেছে সবাই,
রুখু চুলে বেণী দুলিয়ে চ’লেছে পান খেয়ে;--
থিয়েটারে-শেখা বাংলা গান মুখে মুখে সবারই,
—নয়ানবাণ ভুরুধনুর খিচুড়ি পাকানো গান--
সিনেমা-হাউসের সাইনবোর্ডের কাছেই,--
আধা-পরিষ্কার আধা-ঘোলাটে বিজ্লি-বাতির
ফানুস ঘিরে পতঙ্গ যেন ঘোরেফেরে সবাই,
সাপের মতো কুন্ডলি-পাকানো,--
জ্বলন্ত তার বিজুলিটা,--
আলোর ধাঁধা দিয়ে চায় অন্ধকারে;
লামার পাহাড়, ভিখ-ঝরনা
দেখে না আর বস্তির মেয়েরা--
মনের কোণেও!
তিন পাহাড়ের তিনটে রঙ নেভে আস্তে এ সময়,--
ওঠে চাঁদ টোল্-খাওয়া গোল,
—ত্রিশির ভৈরবের মস্ত চোখটা চেয়ে দেখে যেন;--
টুমসু লামার পাথারের স্তূপটা মশানের ধারেই
দেখায় আকাশের গায়ে কালি দিয়ে টানা;
অন্ধকারে সবার উপরে ফুটে ওঠে ধবলাগিরি
—শিলী-সাদা, ফেনি-সাদা, ধুতুরি-সাদা।
দুপুর রাতে বিজ্লি-বাতি
সিনেমা হাউসে নেভে দপ্ করে,--
ঘর ফেরে বস্তির মেয়েরা,--
ছান্দের আলো থান্দা লাগে চোখ,
দোকান-পাট বন্ধ এখন,
কাফিখানা ফেলেছে ঝাঁপ,
রাস্তায় পড়েছে ঘরের ছাওয়া সুর্মি-কালো--
একটা দুটো তিনটে।
মেঘমণ্ডল
মায়ুরী-নীল বনস্থলীর,
ও সেই কুহেলি-কুহর পাহাড়তলার মেঘ;--
পারাবত পায়রা যেন দুই রঙা
দুই দল এরা,--
বসে ওরা এপারে ওপারে ঝরনার,
রোদ ঝিল্মিল্ উত্তর হাওয়ায় ডানা মেলে।
বাসিন্দা-মেঘ ক্সতুরি-কালো ভারি-তানো
নিবাসিন্দা-মেঘ ধুতুরা-সাদা লোটানো-পাখনা্।
শিতের বেলার নতুন পাখি--
জলভরা-মেঘ জলহারা-মেঘ,--
ঝিলিক্-দেওয়া পাখনা মেলিয়ে ঘোরে ফেরে,
বাতাসে লোটানো দানা হেলিয়ে ওঠে নামে;
শূন্যে তোলে ঘূর্ণা,
আলো-ছায়ায় হিলিমিলি হিল্লোল জাগায়।
মেঘে মেঘে যেন পাখ্নার শিহরণ
ফুহরি ফুহরি ওঠে,
ফুহরি দ্রুত-বিদ্রুত বাজে পাখ্না ঝরঝরি;
—দূরে কাছে ঘুরে ফিরে
বাতাসে হেলে পাখা নীল আর শাদা।
মেঘ ওরা পারাবত পায়রা ওড়ে,
ঘোরে ফেরে খেলে খেলা সারাদিনই,
—আকাশে লোটায় বাতাসে লোটায়
লোটায় পাথরে,
—ঝরনার স্রোতে ধরে ছায়া আর ছায়া;
—কায়া আর ছায়া পাশাপাশি
ক্ষণে ক্ষণে আসে যায়।
নিমেষে কাটে রোদের বেলা,
নেমে আসে মেঘ,--
খেলাশেষে ঘর-ভোলা পাখি যেন
খুঁজে খুঁজে চলে
অন্ধকারের পারের বাসা;
শীতের রাতে সেখানে ঝাঁপে ডানা
—দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ
ঝামর কুহর স্তব্ধ আকাশে ভাসে
চাঁদনী-ছোঁয়ানো ঘুমে অলস।
হাটবার
লক্ষ্মীবারের হাট--
খড় আর বাঁশ আর জ্বালানি কাঠ নিয়ে,
ঠাকুর জমিদারের কোঠাবাড়ির ফুল-বাগান--
তারি সামনেই খোলা জমিটা বাজার-ঘেঁষা;
লেগেছে হাট সেখানে ধুমেধামে
পুণ্যের দিনে।
কচুরি পানায় ঢাকা খালের জল,--
তারি ধারে বুড়ো বুড়ো গাছ সব
চারিদিক ঘিরে সবুজের কানাত টেনে দাঁড়িয়ে,
চুপ করে হট্টগোলটা পাহারা দিচ্ছে কেবলি!
লম্বা লম্বা বাঁশ চিৎ হয়ে ঘুম দিচ্ছে
বিকোতে এসে সারিসারি খোলা মাঠে পড়ে;
বাজারের ধারে গোলা ঘর ক-টা।
টিনের ছাতাগুলো তাদের দেখতে হয়েছে ঠিক যেন
বাদলা দিনের আকাশ এক-এক খন্ড।
আর গাছের রাংতার চাদর যেন এক ফর্দি!
সরু খালের ঘোলা জল কেটে
আসছে নৌকো সারি সারি দাঁড় ফেলে--
জলের বাটে লাগিয়েছে যেন ঘোড়দৌড়,--
ঘাটে এসে বোঝা নামানোর হার-জিত খেলা;
খেলে চলেছে নৌকা, মাঝিমল্লা সবাই ওরা।
জমিদারের বড় বজ্রা--
সে বোঝা বয় না হাটের, দৌড়েও চলে না কোনোদিন,
ঘাট জুড়ে কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে,
খুব খানিক রং-চং মেখে নিয়ে গায়ে
চল্তি নৌকাগুলোকে দেখে বজ্রা গম্ভীর ভাবে!
পুরোনো ঝাউগাছটা ঘাটের ধারেই একলা দাঁড়িয়ে
জমিদারের বড় বজ্রার মাথায় ছাতা ধরে
রোদ আগলাতে, বৃষ্টি ঠেকাতে ব্যস্ত ভাব দেখায়
আর সে কেবলি বলে ‘সর্ সর্’।
রোগা রোগা চল্তি নৌকোর ভিড়,
তারই মাঝে পেটমোটা পিনেস্খানা
মনে হচ্ছে এ যেন চলতি ভাষার মাঝে
মস্ত একটা সমস্কৃত সমাস--
যার মানে পাওয়া যাচ্ছে না একেবারেই।
আতস বাজি
ধুমে ধামে বাজি পোড়ান মহারাজা,
অবেলাতে বোমা দোদমা দেদার ফাটে
—শব্দ দেয় ধু’য়া ছাড়ে অনবরত;--
চম্কি বাজি সে ধু’য়ার উপরে
থেকে থেকে ঝিলিক্ টানে
—মনে হয় বর্ষাকাল এসে গেল
দিন ভুলে দিগ্বিজয়ে;
—শুনি অসময়ে ডাকে যেন মেঘ--
ক্রীড়া-কাননে হরিণ-শিশু ডরিয়ে ওঠে,
—চম্কায় শব্দে চকিত চোখে চায়,
পদ্মবনের কিনারা থেকে
সারস পাখি দেখে ঘাড় তুলে
—আকাশের এপার ওপার ঘন অন্ধকার!
বাজির ধূ’য়া দম বন্ধ করে সন্ধ্যা বাতাসের,
রাজবাড়ির সিংদোরজায় রাজহস্তী
দুই কানে কুলো চালে কেবলি!
রাজদরবারে মহারাজা স্বয়ং
মুঠো মুঠো ফাটান ভুঁই-পটোকা
রাজপুরোহিত ছাড়েন হাউই,--
ধ্রুবলোক লক্ষ্য করে সোজা বাঁকা,
রাজকবি জ্বালান তুবড়ি শতে শতে,--
ফুলকাটা নিজের রচনা,
রাজশ্যালক ছাড়ে ছুঁচোবাজি অগণ্য,--
নগরপালের খোড়ো চাল তাগ্ করে!
পাঠশালার আঙ্গিনাতে
সুয়োরাণীর ছেলেটা
—খেলে চরকি বাজি গুরুর সঙ্গে,
গুরু বলেন শিষ্যকে,--
চরকি চমৎকার ঘুরবে তোমার
সারা ভূমণ্ডল উদয় অস্ত;
পোড়োরা করে কানাকানি,--
জাঁতা-ঘোরানোর ভঙ্গী দিয়ে জানায়,--
কুমারের চরকি গণ্ডির বাইরে জাবেই না
হবে হঠাৎ কপোকাৎ
খানিক আগুন ছিটিয়ে।
রানী-মহলে সুয়োরাণী
দেখেন তারাবাজি ছাতে উঠে,--
শতে শতে পুরাঙ্গনা তারা
ঝরায় ফুলঝরি রানীকে ঘিরে;
কন্ রানী রাজার সাঙ্গাৎনীকে--
বলি সই দুয়োরাণীর ঘরের কাছে
ফুঁসলে উঠছে ওই যেগুলো,--
অগ্নিবাণ কি ওকেই বলে?
সই বলে--
বাণ হলে চলত সোজা
এ যে আগুনের সাপ গো
চলেছে বাঁকা পথ ধরে;
রানী বলেন--
সাপ যদি হবে তো মাণিক কোথায়?
সই বলে--
মাণিক গেছে চুরি,--
হাতড়ায় তাই অন্ধকার,--
চলতে চায় সাত তারার দেশে,--
চুরি করতে সাত রাজার মাণিকটি।
রানী মহলের আর এক ধারে,--
রাজার বৌ আর রাজার মেয়ে
মণিমন্দিরের ঝরোকা খুলে দেখতে পায়,
—উপবনে নাচন-ময়ূর
বাজির শব্দে চম্কে উঠেই
মুখ ফিরিয়ে ঝিমোতে থাকে
ঝুঁটি নামিয়ে!
কন্যা বলে,--
লাগল ঘনঘটা সন্ধ্যাকাশে
ডাকে মেঘ চম্কায় বিদ্যুৎ
—নাচন-ময়ূর পাখ্না মেলে না তবুও
এ কেমন হল!
বৌরানী বলে,--
ও যে ভাই শিখী
সত্যি মেঘকে চিনতে শিখেছে
এই সে দিনে আষাঢ় মাসে!
রাজকুমারী বলে--
বৌরাণী, আকাশ হল কাজল বরণ
দীঘির জলে ফেল্ল আলো মেঘলা-করা,--
কঙ্কপাখি জলের ধারে
বসেই রইল অধোমুখ,
কলহংস সেও থাকল চুপ্, --
এপার-ওপার কমলবন
মুখর হল না ধ্বনিতে ওদের
দীর্ঘিকা আজ শূন্য ঠেকে?
রাজবধূ বলে,--
এপারে-ওপারে দুজনে ওরা জলচেনা পাখি,--
গেল বাদলে পদ্মপত্রে জলের লিখন
দেখেছে ওরা তাই আছে চুপ আজকে,
প্রানে ওদের সুর জাগে না বাজির ঘটায়!
কন্যা বলে,--
মধুবনেতে মালি মালিনী
ফুলঝরি ঝরায় মালঞ্চ আলো,--
মধুকর মধুকরী চলে নে সন্ধানে,
—জোনাকি বারবার ইসারা পাঠায় ওদের--
মধু আনতে নেই তাড়া মৌমাছির!
বৌরানী বলে,--
আগুনের ফুলকির পাশেই যে মাধবীলতা
তারি সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে ম্নটি ওদের দখিন হাওয়া
গোপনে সেই সে গত মধুমাসে!
কন্যা বলে,--
সোনার খাঁচাতে কইচে শুনি যে শুকসারিকা
কাজরী গানের প্রথম ছত্র?
বধূ বলে,--
খাঁচাতে ধরা চিরকালই
—মেঘ দেখেনি বাদলে ভেজেনি--
শুধু মুখের কথা পড়তে শিখেছে--
ভুলে বসে আছে কাজল মেঘের আসল বর্ণ!
কন্যা বলে,--
সোনার শিকলে বাঁধা তো হরিণ;
ও কেন তবে হয়েছে চঞ্চল
রংমশালের রঙেতে রঙীন দিক্প্রান্তে
চাইছে উৎকর্ণ উদ্গ্রীব!
রাজবধূ বলে,--
না না, সে অনেক দূরে--
বাশি বাজে কোথায় শুনছে ও,--
রংমশালের রঙীন মরীচিকার ওপার খুঁজছে
কালো চোখ দুটি বারে বারে।
গাঁয়ের মেয়ে দুয়োরাণী সে
থাকে কুটিরে বসে একা উদাস মনে,
দেখে গৃহ-পারাবত মেলায় ডানা ঝাঁকে ঝাঁক্, --
রংমশালের আলোর দিকে ঊড়ে চলে যায়,
আন্মনে কান পেতে শোনে দুয়োরাণী
—অনেক দূরে চাতক বলছে
রঙিন এ মেঘে আগুনই ঝরায়
জল বর্ষায় না কোনোদিন!
এ কা’র জন্য?
শোভাময় চন্দ্রোদয়ের দিকে চাই
ভাবি—এ শোভা কা’র জন্য
আলোময় প্রভাতের আকাশের দিকে চাই
ভাবি—এ আলো কা’র জন্য
কা’র জন্য বর্ষার এ ঘনচ্ছবি
কা’র জন্য অপরাজিতা ফুলের এ নীল
পাতার লতার এ সবুজ
পাকা ফলের এ সুবর্ণচ্ছবি
বোঝাতে তো কেউ নেই পাশে, কেউ নেই কাছে
মন থাকে স্তব্ধ এ রহস্যের সামনে; থাকে নিরুত্তর
অন্ত খুঁজে পায় না—তল খুঁজে পায় না—!
কার কাছে যাব জানতে--
আমার মনের অগোচর দেশ থেকে কে পাঠাচ্ছে এ-সব,
কার জন্যে? সেই কোন্ কাল থেকে আজ পর্যন্ত অফুরন্ত
এইসব এত সব!!!
এ কা’র জন্য? কে বলে দেয়।
সাঁজ-সেজুতির বেলা শেষে
যখন হিম হ’ল-রোদ,--
ঘুমিয়ে গেল মোনান্ পাখি সোনালি রূপালি,
—আলশে-হেলা পলাশ ডালে
যেন সে ফুলটি জোড়-ভাঙ্গা,--
সন্ধ্যাতারা এল চুপে চুপে,--
পূজার বেলায় মানস-পিদুম্
নামিয়ে রাখলে বনের ধারেই,--
নিরিবিলি এ-সময় ভিখ্-ঝরনাতে
মেয়েদের দেওয়া মানসা পিদুম্
যে-কথা জানায় মানস-দেবতাকে নিরালা পেয়ে,--
বস্তির মেয়ের মনই জানে তা’র সন্ধান।
আকাশ-ধরা তারার পিদুম্
নিত্য জ্বলে, নিত্য নেভে,
ঝরনায়-দেওয়া মান্সা-বাতি
এই জ্বলে, এই জ্বলে না,—
বস্তির মেয়ের মনের কোণে মান্সা নিত্যই
মনে মনে জ্ব’লে, মনেতে মেলায়— তিনসন্ধ্যা।
রাত্রিমুখে পরাহ্ণ-পাখি ডাকাডাকি করে,--
আঁখলি-ফুলের কাঁটার বেড়ায়;
দিন হয় শেষ রঙে রঙে ঝড় উঠিয়ে,
পাহাড়ে পাহাড়ে চম্কায় রঙ,--
পদ্মরাগ নীলকান্ত অয়স্কান্ত,
ইন্দ্রধনুর রঙের টংকার বাজে মেঘে মেঘে,--
ফুটে ওঠে ফুল শিমূল, পলাশ, করবী, কাঞ্চন,--
ঝলক্ দেয় পাতা হরিৎ-পীত, নীল-পীত, নীলারুণ,--
রঙ ফোটায় দিক্ বিদিক
বহুরূপ বহুরঙ।
চক্বাজারে সিনেমা-হাউস
জ্বালে এ সময়ে বিজলি-বাতি,
চলে সবাই বস্তির মেয়েরা,--
চলন্ত-ছবির তামাসা দেখতে,
রঙ্গিনী সব, রঙীন সাজ,
বড়ো রাস্তায় হেলে দুলে চলে,
—হ্র্দী কম্লী শ্যাম্লী সুর্খী--
ঝিলিমিলি রঙ চম্কায় পুঁতির গহনায়,--
ফিরোজী কাঁচের বুকপাটায়,--
ফুলকাটা সাটিনের আঙ্গরাখায়,
সোনার হারে, গালার চুড়ি মখমলে কম্বলে;
নতুন ক’রে সেজেছে সবাই,
রুখু চুলে বেণী দুলিয়ে চ’লেছে পান খেয়ে;--
থিয়েটারে-শেখা বাংলা গান মুখে মুখে সবারই,
—নয়ানবাণ ভুরুধনুর খিচুড়ি পাকানো গান--
সিনেমা-হাউসের সাইনবোর্ডের কাছেই,--
আধা-পরিষ্কার আধা-ঘোলাটে বিজ্লি-বাতির
ফানুস ঘিরে পতঙ্গ যেন ঘোরেফেরে সবাই,
সাপের মতো কুন্ডলি-পাকানো,--
জ্বলন্ত তার বিজুলিটা,--
আলোর ধাঁধা দিয়ে চায় অন্ধকারে;
লামার পাহাড়, ভিখ-ঝরনা
দেখে না আর বস্তির মেয়েরা--
মনের কোণেও!
তিন পাহাড়ের তিনটে রঙ নেভে আস্তে এ সময়,--
ওঠে চাঁদ টোল্-খাওয়া গোল,
—ত্রিশির ভৈরবের মস্ত চোখটা চেয়ে দেখে যেন;--
টুমসু লামার পাথারের স্তূপটা মশানের ধারেই
দেখায় আকাশের গায়ে কালি দিয়ে টানা;
অন্ধকারে সবার উপরে ফুটে ওঠে ধবলাগিরি
—শিলী-সাদা, ফেনি-সাদা, ধুতুরি-সাদা।
দুপুর রাতে বিজ্লি-বাতি
সিনেমা হাউসে নেভে দপ্ করে,--
ঘর ফেরে বস্তির মেয়েরা,--
ছান্দের আলো থান্দা লাগে চোখ,
দোকান-পাট বন্ধ এখন,
কাফিখানা ফেলেছে ঝাঁপ,
রাস্তায় পড়েছে ঘরের ছাওয়া সুর্মি-কালো--
একটা দুটো তিনটে।
মেঘমণ্ডল
মায়ুরী-নীল বনস্থলীর,
ও সেই কুহেলি-কুহর পাহাড়তলার মেঘ;--
পারাবত পায়রা যেন দুই রঙা
দুই দল এরা,--
বসে ওরা এপারে ওপারে ঝরনার,
রোদ ঝিল্মিল্ উত্তর হাওয়ায় ডানা মেলে।
বাসিন্দা-মেঘ ক্সতুরি-কালো ভারি-তানো
নিবাসিন্দা-মেঘ ধুতুরা-সাদা লোটানো-পাখনা্।
শিতের বেলার নতুন পাখি--
জলভরা-মেঘ জলহারা-মেঘ,--
ঝিলিক্-দেওয়া পাখনা মেলিয়ে ঘোরে ফেরে,
বাতাসে লোটানো দানা হেলিয়ে ওঠে নামে;
শূন্যে তোলে ঘূর্ণা,
আলো-ছায়ায় হিলিমিলি হিল্লোল জাগায়।
মেঘে মেঘে যেন পাখ্নার শিহরণ
ফুহরি ফুহরি ওঠে,
ফুহরি দ্রুত-বিদ্রুত বাজে পাখ্না ঝরঝরি;
—দূরে কাছে ঘুরে ফিরে
বাতাসে হেলে পাখা নীল আর শাদা।
মেঘ ওরা পারাবত পায়রা ওড়ে,
ঘোরে ফেরে খেলে খেলা সারাদিনই,
—আকাশে লোটায় বাতাসে লোটায়
লোটায় পাথরে,
—ঝরনার স্রোতে ধরে ছায়া আর ছায়া;
—কায়া আর ছায়া পাশাপাশি
ক্ষণে ক্ষণে আসে যায়।
নিমেষে কাটে রোদের বেলা,
নেমে আসে মেঘ,--
খেলাশেষে ঘর-ভোলা পাখি যেন
খুঁজে খুঁজে চলে
অন্ধকারের পারের বাসা;
শীতের রাতে সেখানে ঝাঁপে ডানা
—দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ
ঝামর কুহর স্তব্ধ আকাশে ভাসে
চাঁদনী-ছোঁয়ানো ঘুমে অলস।
হাটবার
লক্ষ্মীবারের হাট--
খড় আর বাঁশ আর জ্বালানি কাঠ নিয়ে,
ঠাকুর জমিদারের কোঠাবাড়ির ফুল-বাগান--
তারি সামনেই খোলা জমিটা বাজার-ঘেঁষা;
লেগেছে হাট সেখানে ধুমেধামে
পুণ্যের দিনে।
কচুরি পানায় ঢাকা খালের জল,--
তারি ধারে বুড়ো বুড়ো গাছ সব
চারিদিক ঘিরে সবুজের কানাত টেনে দাঁড়িয়ে,
চুপ করে হট্টগোলটা পাহারা দিচ্ছে কেবলি!
লম্বা লম্বা বাঁশ চিৎ হয়ে ঘুম দিচ্ছে
বিকোতে এসে সারিসারি খোলা মাঠে পড়ে;
বাজারের ধারে গোলা ঘর ক-টা।
টিনের ছাতাগুলো তাদের দেখতে হয়েছে ঠিক যেন
বাদলা দিনের আকাশ এক-এক খন্ড।
আর গাছের রাংতার চাদর যেন এক ফর্দি!
সরু খালের ঘোলা জল কেটে
আসছে নৌকো সারি সারি দাঁড় ফেলে--
জলের বাটে লাগিয়েছে যেন ঘোড়দৌড়,--
ঘাটে এসে বোঝা নামানোর হার-জিত খেলা;
খেলে চলেছে নৌকা, মাঝিমল্লা সবাই ওরা।
জমিদারের বড় বজ্রা--
সে বোঝা বয় না হাটের, দৌড়েও চলে না কোনোদিন,
ঘাট জুড়ে কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে,
খুব খানিক রং-চং মেখে নিয়ে গায়ে
চল্তি নৌকাগুলোকে দেখে বজ্রা গম্ভীর ভাবে!
পুরোনো ঝাউগাছটা ঘাটের ধারেই একলা দাঁড়িয়ে
জমিদারের বড় বজ্রার মাথায় ছাতা ধরে
রোদ আগলাতে, বৃষ্টি ঠেকাতে ব্যস্ত ভাব দেখায়
আর সে কেবলি বলে ‘সর্ সর্’।
রোগা রোগা চল্তি নৌকোর ভিড়,
তারই মাঝে পেটমোটা পিনেস্খানা
মনে হচ্ছে এ যেন চলতি ভাষার মাঝে
মস্ত একটা সমস্কৃত সমাস--
যার মানে পাওয়া যাচ্ছে না একেবারেই।
আতস বাজি
ধুমে ধামে বাজি পোড়ান মহারাজা,
অবেলাতে বোমা দোদমা দেদার ফাটে
—শব্দ দেয় ধু’য়া ছাড়ে অনবরত;--
চম্কি বাজি সে ধু’য়ার উপরে
থেকে থেকে ঝিলিক্ টানে
—মনে হয় বর্ষাকাল এসে গেল
দিন ভুলে দিগ্বিজয়ে;
—শুনি অসময়ে ডাকে যেন মেঘ--
ক্রীড়া-কাননে হরিণ-শিশু ডরিয়ে ওঠে,
—চম্কায় শব্দে চকিত চোখে চায়,
পদ্মবনের কিনারা থেকে
সারস পাখি দেখে ঘাড় তুলে
—আকাশের এপার ওপার ঘন অন্ধকার!
বাজির ধূ’য়া দম বন্ধ করে সন্ধ্যা বাতাসের,
রাজবাড়ির সিংদোরজায় রাজহস্তী
দুই কানে কুলো চালে কেবলি!
রাজদরবারে মহারাজা স্বয়ং
মুঠো মুঠো ফাটান ভুঁই-পটোকা
রাজপুরোহিত ছাড়েন হাউই,--
ধ্রুবলোক লক্ষ্য করে সোজা বাঁকা,
রাজকবি জ্বালান তুবড়ি শতে শতে,--
ফুলকাটা নিজের রচনা,
রাজশ্যালক ছাড়ে ছুঁচোবাজি অগণ্য,--
নগরপালের খোড়ো চাল তাগ্ করে!
পাঠশালার আঙ্গিনাতে
সুয়োরাণীর ছেলেটা
—খেলে চরকি বাজি গুরুর সঙ্গে,
গুরু বলেন শিষ্যকে,--
চরকি চমৎকার ঘুরবে তোমার
সারা ভূমণ্ডল উদয় অস্ত;
পোড়োরা করে কানাকানি,--
জাঁতা-ঘোরানোর ভঙ্গী দিয়ে জানায়,--
কুমারের চরকি গণ্ডির বাইরে জাবেই না
হবে হঠাৎ কপোকাৎ
খানিক আগুন ছিটিয়ে।
রানী-মহলে সুয়োরাণী
দেখেন তারাবাজি ছাতে উঠে,--
শতে শতে পুরাঙ্গনা তারা
ঝরায় ফুলঝরি রানীকে ঘিরে;
কন্ রানী রাজার সাঙ্গাৎনীকে--
বলি সই দুয়োরাণীর ঘরের কাছে
ফুঁসলে উঠছে ওই যেগুলো,--
অগ্নিবাণ কি ওকেই বলে?
সই বলে--
বাণ হলে চলত সোজা
এ যে আগুনের সাপ গো
চলেছে বাঁকা পথ ধরে;
রানী বলেন--
সাপ যদি হবে তো মাণিক কোথায়?
সই বলে--
মাণিক গেছে চুরি,--
হাতড়ায় তাই অন্ধকার,--
চলতে চায় সাত তারার দেশে,--
চুরি করতে সাত রাজার মাণিকটি।
রানী মহলের আর এক ধারে,--
রাজার বৌ আর রাজার মেয়ে
মণিমন্দিরের ঝরোকা খুলে দেখতে পায়,
—উপবনে নাচন-ময়ূর
বাজির শব্দে চম্কে উঠেই
মুখ ফিরিয়ে ঝিমোতে থাকে
ঝুঁটি নামিয়ে!
কন্যা বলে,--
লাগল ঘনঘটা সন্ধ্যাকাশে
ডাকে মেঘ চম্কায় বিদ্যুৎ
—নাচন-ময়ূর পাখ্না মেলে না তবুও
এ কেমন হল!
বৌরানী বলে,--
ও যে ভাই শিখী
সত্যি মেঘকে চিনতে শিখেছে
এই সে দিনে আষাঢ় মাসে!
রাজকুমারী বলে--
বৌরাণী, আকাশ হল কাজল বরণ
দীঘির জলে ফেল্ল আলো মেঘলা-করা,--
কঙ্কপাখি জলের ধারে
বসেই রইল অধোমুখ,
কলহংস সেও থাকল চুপ্, --
এপার-ওপার কমলবন
মুখর হল না ধ্বনিতে ওদের
দীর্ঘিকা আজ শূন্য ঠেকে?
রাজবধূ বলে,--
এপারে-ওপারে দুজনে ওরা জলচেনা পাখি,--
গেল বাদলে পদ্মপত্রে জলের লিখন
দেখেছে ওরা তাই আছে চুপ আজকে,
প্রানে ওদের সুর জাগে না বাজির ঘটায়!
কন্যা বলে,--
মধুবনেতে মালি মালিনী
ফুলঝরি ঝরায় মালঞ্চ আলো,--
মধুকর মধুকরী চলে নে সন্ধানে,
—জোনাকি বারবার ইসারা পাঠায় ওদের--
মধু আনতে নেই তাড়া মৌমাছির!
বৌরানী বলে,--
আগুনের ফুলকির পাশেই যে মাধবীলতা
তারি সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে ম্নটি ওদের দখিন হাওয়া
গোপনে সেই সে গত মধুমাসে!
কন্যা বলে,--
সোনার খাঁচাতে কইচে শুনি যে শুকসারিকা
কাজরী গানের প্রথম ছত্র?
বধূ বলে,--
খাঁচাতে ধরা চিরকালই
—মেঘ দেখেনি বাদলে ভেজেনি--
শুধু মুখের কথা পড়তে শিখেছে--
ভুলে বসে আছে কাজল মেঘের আসল বর্ণ!
কন্যা বলে,--
সোনার শিকলে বাঁধা তো হরিণ;
ও কেন তবে হয়েছে চঞ্চল
রংমশালের রঙেতে রঙীন দিক্প্রান্তে
চাইছে উৎকর্ণ উদ্গ্রীব!
রাজবধূ বলে,--
না না, সে অনেক দূরে--
বাশি বাজে কোথায় শুনছে ও,--
রংমশালের রঙীন মরীচিকার ওপার খুঁজছে
কালো চোখ দুটি বারে বারে।
গাঁয়ের মেয়ে দুয়োরাণী সে
থাকে কুটিরে বসে একা উদাস মনে,
দেখে গৃহ-পারাবত মেলায় ডানা ঝাঁকে ঝাঁক্, --
রংমশালের আলোর দিকে ঊড়ে চলে যায়,
আন্মনে কান পেতে শোনে দুয়োরাণী
—অনেক দূরে চাতক বলছে
রঙিন এ মেঘে আগুনই ঝরায়
জল বর্ষায় না কোনোদিন!
এ কা’র জন্য?
শোভাময় চন্দ্রোদয়ের দিকে চাই
ভাবি—এ শোভা কা’র জন্য
আলোময় প্রভাতের আকাশের দিকে চাই
ভাবি—এ আলো কা’র জন্য
কা’র জন্য বর্ষার এ ঘনচ্ছবি
কা’র জন্য অপরাজিতা ফুলের এ নীল
পাতার লতার এ সবুজ
পাকা ফলের এ সুবর্ণচ্ছবি
বোঝাতে তো কেউ নেই পাশে, কেউ নেই কাছে
মন থাকে স্তব্ধ এ রহস্যের সামনে; থাকে নিরুত্তর
অন্ত খুঁজে পায় না—তল খুঁজে পায় না—!
কার কাছে যাব জানতে--
আমার মনের অগোচর দেশ থেকে কে পাঠাচ্ছে এ-সব,
কার জন্যে? সেই কোন্ কাল থেকে আজ পর্যন্ত অফুরন্ত
এইসব এত সব!!!
এ কা’র জন্য? কে বলে দেয়।