পদ্মদাসী
রাতের অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে সারি সারি পল্-তোলা থাম, এরই ফাঁক দিয়ে দেখা যাছে আমাদের তেতলার উত্তর-পুব কোনের ছোটো ঘরটা; এক কোণে জ্বলছে মিটমিটে একটা তেলের সেজ। হিমের ভয়ে লাল খেরুয়ার পুরু পর্দা দিয়ে সম্পূর্ণ মোড়া ঘরের তিনটে জানলই, ঘরজোড়া উচূ একখানা, খাট—তাতে সবুজ রঙের মোটা দিশি মশারি ফেলা রয়েছ। ঘরে ঢোকবার দরজাটা এত বড়ো যে, তার উপর দিকটাতে বাতির আলো পৌছাতে পারেনি। এইা দরজায় এক পাশে একটা লোহার সিন্দুক, আর তারি ঠিক সমানে কোথা খেকে কাঠের খোটা হঠাৎ মেঝে ফুড়ে হাত তিনেক উঠেই থমকে দাঁড়িয়ে গেছে তো দাঁড়িয়েই আছে । এই খোটা -ঘরের মধ্যে যার দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণ ছিল না-সেটাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেড়হাত প্রমাণ একটা ছেলো খোটার মাথার কাছে এতটূকূ কুলুঙ্গির মতো একটা চৌক গর্ত, তারই মধ্যে উকি দিয়ে দেখবার ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু নাগাল পাচ্ছি নে কুলুঙ্গিটার। আলোর কাছে বসে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পদ্মদাসী মস্ত একটা রপোর ঝিনূক আর গরম দুধের বাটি নিয়ে দুধ জুড়োতে ধসে গেছে-তূলছে আর ঢালছে সে তপ্ত দুধ। দাসীর কালো হাত দুধ জুড়োবার ছন্দে উঠছে নামছে, নামছে উঠছে। চারদিক সুনসান, কেবল দুধের ধারা পড়ার শব্দ শুনছি। আর দাসীর কালো হাত ওঠা- পড়ার দিকে চেয়ে একটা কথা ভাবছি- উঁচু খাটে উঠতে পারা যাবে কিনা। পর্দারওপারে অনেক দুরে আস্তাবলের ফটকের কাছে নন্দ ফরাশের ঘর, সেখানে লোটো খোঁড়া বেহালাতে গৎ ধরেছে-এক দুই তিন চার, ধরেছে-এক দুই তিন চার এক দুই তিন চার জানিয়ে দিলে রাত কত হয়েছে তা-অমনি তাড়াতাড়ি থানিক আধ ঠাণ্ডা দুধ কোনোরকমে আমাকে গিলিয়ে খাটের উপর তিনটে বালিশের মাঝখানটায় কাত করে ফেলে মনে মনে একটা ঘুমপাড়ানো ছড়া আউড়ে চলল আমার দাসী। আর তারই তালে তালে অন্ধকারে তার কালো হাতের রহে -রহে ছোঁয়া ঘুমের তলায় আস্তে আস্তে আমাকে নামিয়ে দিতে থাকল! একেবারে রাতের অন্ধকারের মতো কালো ছিল আমার দাসী —সে কাছে বসেই ঘুম পাড়াত কিন্তু অন্ধকারে মিলিয়ে থাকত সে, দেখতে পেতেম না তাকে, শুধু ছোঁয়া , পেতেম থেকে থেকো কোনো-কোনো দিন অনেক রাতে সে জেগে বসেড়ু চালভাজা কটকট চিবোত আর তালপাতার পাখা নিয়ে মশা তাড়াতা। শুধু শব্দে জানতাম এটা। আমি জেগে আছি জানলে দাসী চুপিচুপি একখানি নারকেল-নাড়ু অন্ধকারেই অমার মুখে গুজে দিত-নিত্য খোরাকের উপরি-পাওনা ছিল এই নাড়ু। খাটে উঠব কেমন করে এই ভয় হয়েছিল কাজেই বোধ হ্যে উচূ পালঙ্কে শোয়া সেই আমার প্রথম। জানি নে তার আগে কোথায় কোন্ ঘরে আমাকে নিয়ে শুইয়ে দিত কোন্ বিছানায় সে। চারদিকে সবুজ মশারির আবছায়া-ঘেরা মস্ত বিছানাটা ভারি নতূন ঠেকছিল সেদিন —একটা যেন কোন দেশে এসেছি-সেখানে বালিশগুলোকে দেখাচ্ছে যেন পাহাড়-পবতি, মশারিটা যেন সবুজ কুয়াশা ঢাকা আকাশ যার ওপারে — এখানে আর মনে করতে হত না, দেখতে পেতেম চিৎপুর রাস্তা খেকে সরু গলিটা! আমাদের ফটকে এসে ধুকছে সেটা একেবারে জনশুন্য । দু নম্বর বাড়ির গায়ে তখনকার মিউনিসিপালিটির দেওয়া একঢা মিটামিটে তেলের বাতি জ্বলছে আর সেই আলো-আধারে পুরোনো ।শিবমান্দিরটার দরজার সামনে দিয়ে একটা -কন্ধ-কাটা দুই হাত মেলে শিকার খুজে চলেছে! -কন্ধ-কাটা বাসাটাও সেইসঙ্গে দেখা দিত একটি মটির নল বেয়ে দু নম্বর বাড়ির ময়লা জল পড়ে পড়ে খানিকটা দেওয়াল সোঁতা আর কালো, ঠিক তারই কাছে আধখানা ভাঙা কপাট চাপানো আড়ই হাত একটা ফোকরে তার বাস—দিনেও তার মধ্যে অন্ধকার জমা হয়ে থাকে।
সব ভুতের মধ্যে ভীষণ ছিল এই -কন্ধ-কাটা, যার পেটটা থেকে থেকে অন্ধকারে হাঁ করে আর ঢোক গেলে; যার চোখ নেই অথচ মস্ত কাঁকড়ার দাড়ার মতো হাত দুটো যার পরিষ্কার দেখতে পায় শিকার! আর-একটা ভয় আসত সময়ে সময়ে! কিন্তু আসত সে অকাতর ঘুমের মধ্যে সে নামত বিরাট একটা আগুনের ভাঁটার মতো বাড়ির ছাদ ফূড়ে আস্তে আস্তে আমার খাটের উপর । যেন আমাকে চেপে মারবে এই ভাব—নামছে তো নামছেই গলাটা, আমার দিকে এগিয়ে আসার তার বিরাম নেই। কখনো আসত সেটা এগিয়ে জ্বলন্ত একটা ন্তনের মতো একেবারে আমার মুখের কাছাকাছি, ঝাঁজ লাগত মুখে চোখে । তার পর আস্তে আস্তে উঠে-যেত গোলতা আমাকে ছেড়ে, হাঁফ ছেড়ে চেয়ে দেখতেম সকাল হয়েছে- কপাল গরম, জ্বর এসে গেছে আমার । দশ-বারো বছর পর্যন্ত এই উপগ্রহটা জ্বরের অগ্রদুত হয়ে এসে আমায় আসুস্থ করে যেত । উপগ্রহকে ঠেকাবার উপায় ছিল না কোনো কিন্তু উপদেবতা আর কন্ধ-কাটার হাত থেকে বাঁচবার উপায় আবিষ্কার করে নিমেছিলেম। লাল শালুর লেপ, তারই উপরে মোড়া থাকত পাতলা ওয়াড়, আমি তারই মধ্যে এক এক-দিন দিন লুকিয়ে পড়তাম এমন যে, দাসী সকালে বিছানায় আমায় না দেখে—''ছেলে কোথা গো বলে শোরগোল বাধিয়ে দিত। শেষে , পদ্মদাসীর পদ্মহস্তের গোটাকয়েক চাপড় খেয়ে জাদুকরের থলি থেকে গোলার মতো ছিটকে বার হতেম আমি সকালের আলোতে।
জীবনের প্রথম অংশটায় সকালের লেপের ওয়াড়খানা গুটিপোকার খোলসের মতো করে ছেড়ে বার হওয়া আর রাতে আবার গিয়ে লুকোনো লেপের তলায়, আর তারই সঙ্গে জড়িয়ে বাটি, ঝিনূক, খাট, সিন্দুক, তেলের সেজ, পদ্মদাসী- এমনি গোটাকতক জিনিস, আর শীভের রতের অন্ধকারে কতকগুলো ভূতের চেহারা, দিনের বেলাতেও অন্ধকারে ঢিল ফেলার মতো কতগুলো চমকে দেওয়া শব্দ। -দরজা পড়ার শব্দ, চাবির গোছার ঝিনঝিন মাত্র আছে আমার কাছে আর কিছু নেই—কেউ নেই।
১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দের জষ্মাষ্টমীর দিনের বেলা ১২টা ১১মিনিট থেকে আরম্ভ করে খানিকটা বয়স পর্যন্ত রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের পুঁজি— এক দাসী, একখানি ঘরে একটি খাট, একটি দুধের বাটি, এমনি গোটাকতক সামান্য জিনিসে্র মধ্যেই বদ্ধ রয়েছে। শোওয়া আর খাওয়া এ-ছাড়া আর কোনো ঘটনার সাথে যোগ নেই আমার। অকস্মাৎ একদিন এক ঘটনার সামনে পড়ে গেলেম একলা। ঘটনার প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা সেটা । তখন সকাল দেড় প্রহর হবে, তিনতলার বড়ো সিঁড়ির উপর ধাপের কিনারা—যেখানটায় খাঁচার গরাদের মতো মেটিাসোটা শিক দিয়ে বন্ধ করা—সেইখানটায় দাড়িয়ে দেখছি কাঠের সিড়ির প্রকান্ড প্রকান্ড ধাপ গুলো একটা চৌকোনা যেন কূয়োকে ঘিরে ঘিরে নেমে গেছে কোন্ পাতালে তার ঠিক নেই । এই ধাপে ধাপে ঘুর্ণির মাঝে একটা বড়ো চাতাল। পশ্চিম দিকের একটা খোলা ঘর হয়ে চাতালের উপরটায় এসে পড়েছে চওড়া শাদা আলোর একটি মাত্র টান ঠিক এইখানটায় আমার কালোদাসী আর 'রসো'- বলে একটা মেটাসোটা ফরশা। চাকরানী কথা কইছে শুনছি। অমি তো তাদের কথা বঝি নে—কথার মানেও বুঝি নে— কেবল স্বরের ঝোঁক আর হাত-পা নাড়া দেখে জানছি দাসীতে দাসীতে ঝগড়া বেধেছে। খাঁচার পাখির মতো গরাদের মধ্যে খেকে বইরে চেয়ে দেখছি কী হয়। হুঠাৎ দেখলেম আমার দাসী একটা ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে পড়ল দেওয়ালের উপর । আবার তখনই সে ফিরে দাড়িয়ে অ্যাঁচলটা কোমরে জড়াতে থাকল তখন তার কালো কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। চুলোগুলো উস্কো — চেহারা রাগে ভীষণ হয়ে উঠেছে সিদুর-পরা ষেন কালো পাথরের ভৈরবী মূর্তি সে একটি। আমি চিৎকার করে উঠলেম — 'মারলে, আমার দাসীকে মারলে!' লোকজন ছুটে এল, ডাক্তার এল, একটা ছেঁড়া কাপড়ের শাদা পটি দাসীর কপালে বেঁধে দিয়ে গেল; কিন্তু আমার মনে জেগে রইল সিঁড়ির ধারে সকালের দেখা রক্তমাখা কালো রূপটাই দাসীর! সেই আমার শেষ দেখা দাসীর সঙ্গে। তারপর থেকে দেখি দাসী কাছে নেই কিন্তু তার ভাবনা রয়েছে মনে—দেশ থেকে খেলনা নিয়ে ফিরবে দাসী। সিঁড়ির দরজায় বসে বীরভূমের গালার তৈরি একটা কাছিম নিয়ে খেলি আর রোজই ভাবি দাসী আসবে! কোন গাঁয়ের কোন ঘর ছেড়ে এসেছিলো অন্ধকারের মতো কালো আমার পদ্মদাসী! শুনি সে ভীষণ কালো ছিলো। পদ্ম নামটা মোটেই তাকে মানাতো না। সে তার বেমানান নাম নিয়েই এসেছিলো এ-বাড়িতে। রাগ করে গেছে; ঝগড়া করেছে, কাজও করেছে এবং মানুষ করবার বকশিশ সোনার বিছেহার আর রক্তের টিপ পরে চলেও গেছে বহুদিন। পৃথিবীর কোনোখানে হয়তো আর কোনো মনে ধরা নেই তার কিছুই এক আমার আমার কাছে ছাড়া। হয়তো বা তাই আপনার কথা বলতে গিয়ে সেই নিতান্ত পর এবং একান্ত দূর থেকে তাকেই দেখতে পাচ্ছি—পঞ্চান্ন বছরের ওধারে বসে সে দুধ ঢালছে আর তুলছে আমার জন্যে!....
আমার কুষ্ঠীখানা লিখেছে দেখি বেশ গুছিয়ে সন তারিখ বছর মাস মিলিয়ে। পরে পরে ঘটনাগুলো ধরে দিয়েছে সেখানে গণৎকার। কিন্তু এ-ভাবে জীবনটা তো আমার চললো না লতার পর লতা পারম্পর্য ধরে। কাজেই কুষ্ঠি অনেকটা ফলে গেলেও আমাদের সেকালের ‘কালী আচিয্যি’কে দ্বিতীয় বিধাতা-পুরুষ বলে স্বীকার চললো না। আচমকা যে-সব ঘটনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে পড়ে আজও সেইগুলোকেই আমি জানি বিধাতার সাটে লেখা বলে—যেটা তিনি ছ’দিনের দিন সব ছেলের একটুখানি মাথার খুলিতে ঘুণাক্ষরের চেয়েও অপাঠ্য অক্ষরে লিখে যান। ঘটনা ঘটলো তো জানলেম কপালে এইভাবে এটা লেখা ছিলো।
একটা বিস্ময়-চিহ্ন কালো কালিতে, তার মাথায় লাল কালির একটা টান—এই সাটটুকুর মধ্যেই ধরা গিয়েছিলো আমার আর দাসীর আদ্যন্ত ইতিহাস। তারপর হয়তো খানিকটা ফাঁকা মাথার খুলি ; তারপর আর একটা অদ্ভুত চিহ্ন, ঘটাকার কি পটাকার, কি একটা পাখি, কি একটা বাঁদর, কি একটা গোলাকার, কত কী যে তার শেষ নেই—সেঁজুতি ব্রতের আলপনার মতো বিধাতার জল্পনা-কল্পনা জানাতে রইলো।
জন্ম থেকে আরম্ভ করে প্রথম বিস্ময়ের চিহ্নটাতে এসে আমার পনেরো মাস কি পঁচিশ মাস কি কতটা বয়স কেটেছিলো টা বলতে পারা শক্ত ; তবে হঠাৎ অসময়ে এসে যে চিহ্নটাতে কপাল ঠুকেছিলেম আমি এবং আমার দাসী দু’জনেই— এটা ঠিক!
রাতের অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে সারি সারি পল্-তোলা থাম, এরই ফাঁক দিয়ে দেখা যাছে আমাদের তেতলার উত্তর-পুব কোনের ছোটো ঘরটা; এক কোণে জ্বলছে মিটমিটে একটা তেলের সেজ। হিমের ভয়ে লাল খেরুয়ার পুরু পর্দা দিয়ে সম্পূর্ণ মোড়া ঘরের তিনটে জানলই, ঘরজোড়া উচূ একখানা, খাট—তাতে সবুজ রঙের মোটা দিশি মশারি ফেলা রয়েছ। ঘরে ঢোকবার দরজাটা এত বড়ো যে, তার উপর দিকটাতে বাতির আলো পৌছাতে পারেনি। এইা দরজায় এক পাশে একটা লোহার সিন্দুক, আর তারি ঠিক সমানে কোথা খেকে কাঠের খোটা হঠাৎ মেঝে ফুড়ে হাত তিনেক উঠেই থমকে দাঁড়িয়ে গেছে তো দাঁড়িয়েই আছে । এই খোটা -ঘরের মধ্যে যার দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণ ছিল না-সেটাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেড়হাত প্রমাণ একটা ছেলো খোটার মাথার কাছে এতটূকূ কুলুঙ্গির মতো একটা চৌক গর্ত, তারই মধ্যে উকি দিয়ে দেখবার ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু নাগাল পাচ্ছি নে কুলুঙ্গিটার। আলোর কাছে বসে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পদ্মদাসী মস্ত একটা রপোর ঝিনূক আর গরম দুধের বাটি নিয়ে দুধ জুড়োতে ধসে গেছে-তূলছে আর ঢালছে সে তপ্ত দুধ। দাসীর কালো হাত দুধ জুড়োবার ছন্দে উঠছে নামছে, নামছে উঠছে। চারদিক সুনসান, কেবল দুধের ধারা পড়ার শব্দ শুনছি। আর দাসীর কালো হাত ওঠা- পড়ার দিকে চেয়ে একটা কথা ভাবছি- উঁচু খাটে উঠতে পারা যাবে কিনা। পর্দারওপারে অনেক দুরে আস্তাবলের ফটকের কাছে নন্দ ফরাশের ঘর, সেখানে লোটো খোঁড়া বেহালাতে গৎ ধরেছে-এক দুই তিন চার, ধরেছে-এক দুই তিন চার এক দুই তিন চার জানিয়ে দিলে রাত কত হয়েছে তা-অমনি তাড়াতাড়ি থানিক আধ ঠাণ্ডা দুধ কোনোরকমে আমাকে গিলিয়ে খাটের উপর তিনটে বালিশের মাঝখানটায় কাত করে ফেলে মনে মনে একটা ঘুমপাড়ানো ছড়া আউড়ে চলল আমার দাসী। আর তারই তালে তালে অন্ধকারে তার কালো হাতের রহে -রহে ছোঁয়া ঘুমের তলায় আস্তে আস্তে আমাকে নামিয়ে দিতে থাকল! একেবারে রাতের অন্ধকারের মতো কালো ছিল আমার দাসী —সে কাছে বসেই ঘুম পাড়াত কিন্তু অন্ধকারে মিলিয়ে থাকত সে, দেখতে পেতেম না তাকে, শুধু ছোঁয়া , পেতেম থেকে থেকো কোনো-কোনো দিন অনেক রাতে সে জেগে বসেড়ু চালভাজা কটকট চিবোত আর তালপাতার পাখা নিয়ে মশা তাড়াতা। শুধু শব্দে জানতাম এটা। আমি জেগে আছি জানলে দাসী চুপিচুপি একখানি নারকেল-নাড়ু অন্ধকারেই অমার মুখে গুজে দিত-নিত্য খোরাকের উপরি-পাওনা ছিল এই নাড়ু। খাটে উঠব কেমন করে এই ভয় হয়েছিল কাজেই বোধ হ্যে উচূ পালঙ্কে শোয়া সেই আমার প্রথম। জানি নে তার আগে কোথায় কোন্ ঘরে আমাকে নিয়ে শুইয়ে দিত কোন্ বিছানায় সে। চারদিকে সবুজ মশারির আবছায়া-ঘেরা মস্ত বিছানাটা ভারি নতূন ঠেকছিল সেদিন —একটা যেন কোন দেশে এসেছি-সেখানে বালিশগুলোকে দেখাচ্ছে যেন পাহাড়-পবতি, মশারিটা যেন সবুজ কুয়াশা ঢাকা আকাশ যার ওপারে — এখানে আর মনে করতে হত না, দেখতে পেতেম চিৎপুর রাস্তা খেকে সরু গলিটা! আমাদের ফটকে এসে ধুকছে সেটা একেবারে জনশুন্য । দু নম্বর বাড়ির গায়ে তখনকার মিউনিসিপালিটির দেওয়া একঢা মিটামিটে তেলের বাতি জ্বলছে আর সেই আলো-আধারে পুরোনো ।শিবমান্দিরটার দরজার সামনে দিয়ে একটা -কন্ধ-কাটা দুই হাত মেলে শিকার খুজে চলেছে! -কন্ধ-কাটা বাসাটাও সেইসঙ্গে দেখা দিত একটি মটির নল বেয়ে দু নম্বর বাড়ির ময়লা জল পড়ে পড়ে খানিকটা দেওয়াল সোঁতা আর কালো, ঠিক তারই কাছে আধখানা ভাঙা কপাট চাপানো আড়ই হাত একটা ফোকরে তার বাস—দিনেও তার মধ্যে অন্ধকার জমা হয়ে থাকে।
সব ভুতের মধ্যে ভীষণ ছিল এই -কন্ধ-কাটা, যার পেটটা থেকে থেকে অন্ধকারে হাঁ করে আর ঢোক গেলে; যার চোখ নেই অথচ মস্ত কাঁকড়ার দাড়ার মতো হাত দুটো যার পরিষ্কার দেখতে পায় শিকার! আর-একটা ভয় আসত সময়ে সময়ে! কিন্তু আসত সে অকাতর ঘুমের মধ্যে সে নামত বিরাট একটা আগুনের ভাঁটার মতো বাড়ির ছাদ ফূড়ে আস্তে আস্তে আমার খাটের উপর । যেন আমাকে চেপে মারবে এই ভাব—নামছে তো নামছেই গলাটা, আমার দিকে এগিয়ে আসার তার বিরাম নেই। কখনো আসত সেটা এগিয়ে জ্বলন্ত একটা ন্তনের মতো একেবারে আমার মুখের কাছাকাছি, ঝাঁজ লাগত মুখে চোখে । তার পর আস্তে আস্তে উঠে-যেত গোলতা আমাকে ছেড়ে, হাঁফ ছেড়ে চেয়ে দেখতেম সকাল হয়েছে- কপাল গরম, জ্বর এসে গেছে আমার । দশ-বারো বছর পর্যন্ত এই উপগ্রহটা জ্বরের অগ্রদুত হয়ে এসে আমায় আসুস্থ করে যেত । উপগ্রহকে ঠেকাবার উপায় ছিল না কোনো কিন্তু উপদেবতা আর কন্ধ-কাটার হাত থেকে বাঁচবার উপায় আবিষ্কার করে নিমেছিলেম। লাল শালুর লেপ, তারই উপরে মোড়া থাকত পাতলা ওয়াড়, আমি তারই মধ্যে এক এক-দিন দিন লুকিয়ে পড়তাম এমন যে, দাসী সকালে বিছানায় আমায় না দেখে—''ছেলে কোথা গো বলে শোরগোল বাধিয়ে দিত। শেষে , পদ্মদাসীর পদ্মহস্তের গোটাকয়েক চাপড় খেয়ে জাদুকরের থলি থেকে গোলার মতো ছিটকে বার হতেম আমি সকালের আলোতে।
জীবনের প্রথম অংশটায় সকালের লেপের ওয়াড়খানা গুটিপোকার খোলসের মতো করে ছেড়ে বার হওয়া আর রাতে আবার গিয়ে লুকোনো লেপের তলায়, আর তারই সঙ্গে জড়িয়ে বাটি, ঝিনূক, খাট, সিন্দুক, তেলের সেজ, পদ্মদাসী- এমনি গোটাকতক জিনিস, আর শীভের রতের অন্ধকারে কতকগুলো ভূতের চেহারা, দিনের বেলাতেও অন্ধকারে ঢিল ফেলার মতো কতগুলো চমকে দেওয়া শব্দ। -দরজা পড়ার শব্দ, চাবির গোছার ঝিনঝিন মাত্র আছে আমার কাছে আর কিছু নেই—কেউ নেই।
১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দের জষ্মাষ্টমীর দিনের বেলা ১২টা ১১মিনিট থেকে আরম্ভ করে খানিকটা বয়স পর্যন্ত রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের পুঁজি— এক দাসী, একখানি ঘরে একটি খাট, একটি দুধের বাটি, এমনি গোটাকতক সামান্য জিনিসে্র মধ্যেই বদ্ধ রয়েছে। শোওয়া আর খাওয়া এ-ছাড়া আর কোনো ঘটনার সাথে যোগ নেই আমার। অকস্মাৎ একদিন এক ঘটনার সামনে পড়ে গেলেম একলা। ঘটনার প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা সেটা । তখন সকাল দেড় প্রহর হবে, তিনতলার বড়ো সিঁড়ির উপর ধাপের কিনারা—যেখানটায় খাঁচার গরাদের মতো মেটিাসোটা শিক দিয়ে বন্ধ করা—সেইখানটায় দাড়িয়ে দেখছি কাঠের সিড়ির প্রকান্ড প্রকান্ড ধাপ গুলো একটা চৌকোনা যেন কূয়োকে ঘিরে ঘিরে নেমে গেছে কোন্ পাতালে তার ঠিক নেই । এই ধাপে ধাপে ঘুর্ণির মাঝে একটা বড়ো চাতাল। পশ্চিম দিকের একটা খোলা ঘর হয়ে চাতালের উপরটায় এসে পড়েছে চওড়া শাদা আলোর একটি মাত্র টান ঠিক এইখানটায় আমার কালোদাসী আর 'রসো'- বলে একটা মেটাসোটা ফরশা। চাকরানী কথা কইছে শুনছি। অমি তো তাদের কথা বঝি নে—কথার মানেও বুঝি নে— কেবল স্বরের ঝোঁক আর হাত-পা নাড়া দেখে জানছি দাসীতে দাসীতে ঝগড়া বেধেছে। খাঁচার পাখির মতো গরাদের মধ্যে খেকে বইরে চেয়ে দেখছি কী হয়। হুঠাৎ দেখলেম আমার দাসী একটা ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে পড়ল দেওয়ালের উপর । আবার তখনই সে ফিরে দাড়িয়ে অ্যাঁচলটা কোমরে জড়াতে থাকল তখন তার কালো কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। চুলোগুলো উস্কো — চেহারা রাগে ভীষণ হয়ে উঠেছে সিদুর-পরা ষেন কালো পাথরের ভৈরবী মূর্তি সে একটি। আমি চিৎকার করে উঠলেম — 'মারলে, আমার দাসীকে মারলে!' লোকজন ছুটে এল, ডাক্তার এল, একটা ছেঁড়া কাপড়ের শাদা পটি দাসীর কপালে বেঁধে দিয়ে গেল; কিন্তু আমার মনে জেগে রইল সিঁড়ির ধারে সকালের দেখা রক্তমাখা কালো রূপটাই দাসীর! সেই আমার শেষ দেখা দাসীর সঙ্গে। তারপর থেকে দেখি দাসী কাছে নেই কিন্তু তার ভাবনা রয়েছে মনে—দেশ থেকে খেলনা নিয়ে ফিরবে দাসী। সিঁড়ির দরজায় বসে বীরভূমের গালার তৈরি একটা কাছিম নিয়ে খেলি আর রোজই ভাবি দাসী আসবে! কোন গাঁয়ের কোন ঘর ছেড়ে এসেছিলো অন্ধকারের মতো কালো আমার পদ্মদাসী! শুনি সে ভীষণ কালো ছিলো। পদ্ম নামটা মোটেই তাকে মানাতো না। সে তার বেমানান নাম নিয়েই এসেছিলো এ-বাড়িতে। রাগ করে গেছে; ঝগড়া করেছে, কাজও করেছে এবং মানুষ করবার বকশিশ সোনার বিছেহার আর রক্তের টিপ পরে চলেও গেছে বহুদিন। পৃথিবীর কোনোখানে হয়তো আর কোনো মনে ধরা নেই তার কিছুই এক আমার আমার কাছে ছাড়া। হয়তো বা তাই আপনার কথা বলতে গিয়ে সেই নিতান্ত পর এবং একান্ত দূর থেকে তাকেই দেখতে পাচ্ছি—পঞ্চান্ন বছরের ওধারে বসে সে দুধ ঢালছে আর তুলছে আমার জন্যে!....
আমার কুষ্ঠীখানা লিখেছে দেখি বেশ গুছিয়ে সন তারিখ বছর মাস মিলিয়ে। পরে পরে ঘটনাগুলো ধরে দিয়েছে সেখানে গণৎকার। কিন্তু এ-ভাবে জীবনটা তো আমার চললো না লতার পর লতা পারম্পর্য ধরে। কাজেই কুষ্ঠি অনেকটা ফলে গেলেও আমাদের সেকালের ‘কালী আচিয্যি’কে দ্বিতীয় বিধাতা-পুরুষ বলে স্বীকার চললো না। আচমকা যে-সব ঘটনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে পড়ে আজও সেইগুলোকেই আমি জানি বিধাতার সাটে লেখা বলে—যেটা তিনি ছ’দিনের দিন সব ছেলের একটুখানি মাথার খুলিতে ঘুণাক্ষরের চেয়েও অপাঠ্য অক্ষরে লিখে যান। ঘটনা ঘটলো তো জানলেম কপালে এইভাবে এটা লেখা ছিলো।
একটা বিস্ময়-চিহ্ন কালো কালিতে, তার মাথায় লাল কালির একটা টান—এই সাটটুকুর মধ্যেই ধরা গিয়েছিলো আমার আর দাসীর আদ্যন্ত ইতিহাস। তারপর হয়তো খানিকটা ফাঁকা মাথার খুলি ; তারপর আর একটা অদ্ভুত চিহ্ন, ঘটাকার কি পটাকার, কি একটা পাখি, কি একটা বাঁদর, কি একটা গোলাকার, কত কী যে তার শেষ নেই—সেঁজুতি ব্রতের আলপনার মতো বিধাতার জল্পনা-কল্পনা জানাতে রইলো।
জন্ম থেকে আরম্ভ করে প্রথম বিস্ময়ের চিহ্নটাতে এসে আমার পনেরো মাস কি পঁচিশ মাস কি কতটা বয়স কেটেছিলো টা বলতে পারা শক্ত ; তবে হঠাৎ অসময়ে এসে যে চিহ্নটাতে কপাল ঠুকেছিলেম আমি এবং আমার দাসী দু’জনেই— এটা ঠিক!