চলন বিল
মানুষ যেমন, গুগলীও তেমনি হাঁটা-পথে চলে, কাজেই কৈলাস যাবার হাঁটা পথের খবরই গুগলী রাখত। কিন্তু
মাটির উপর দিয়ে হাঁটা-পথ যেমন, তেমনি আকাশের উপর
দিয়ে জলের নিচে দিয়ে সব পথ আছে, সেই রাস্তায়
পাখিরা মাছেরা দূর-দূর দেশে যাতায়াত করে। মানুষ, গরু, গুগলী শামুক –
এরা সব পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে, নদী পেরিয়ে চলে, কাজেই কোথাও যেতে এদের অনেক দিন লাগে। মাছেরা এঁকে-বেঁকে এ-নদী সে-নদী করে যায়,
তাদের ডাঙায় উঠতে হয় না, কাজেই তারা আরো অল্পদিনে ঠিকানায় পৌঁছয়। আর পাখিরা নদী-ডাঙা
দুয়েরই উপর দিয়ে সহজে উড়ে চলে – সব চেয়ে আগে চলে
তারা! কিন্তু তাই বলে পাখিরাও যে পথের কষ্ট একেবারেই পায় না, এমন নয়। আকাশের নানাদিকে নান-রকম নরম-গরম হাওয়া নদীর
স্রোতের মতো বইছে – এই সব স্রোত বুঝে পাখিদের
যাতায়াত করতে হয়। এ ছাড়া বড় পাখিরা যে রাস্তায় চলে, ছোট পাখিরা সে সব রাস্তায় গেলে, তাদের বিপদে পড়তে হয় – হয়তো ঝোড়ো হাওয়াতে কোথায় গিয়ে পড়ল তার ঠিক নেই!
আবার বড় পাখিদের যে-পথে কম বাতাস সে-পথে গেলে ওড়াই মুশকিল – ডানা নাড়তে-নাড়তে কাঁধ ব্যথা হয়ে যায়! বাতাসের এক-একটা পথ এমন ঠান্ডা যে সেখানে খুব শক্ত পাখিরা ছাড়া কেউ যেতে পারে না – শীতে জমে যাবে। কোনো রাস্তায় এমন গরম বাতাসের স্রোত চলেছে যে সেখানে আগুনের ঝলকে পাখা পুড়ে যায়। এ ছাড়া জোয়ারভাটার মতো অনুকূল-প্রতিকূল দু’রকম হাওয়া বইছে – সেটা বুঝেও পাখিদের যাওয়া-আসা করতে হয়। সব পাখি আবার রাতে উড়তে পারে না, সেজন্য যে-দিক দিয়ে গেলে বন পাবে, নদী পাবে, আকাশ থেকে নেমে দুদণ্ড বসে জিরোতে পাবে – এমন সব যাবার রাস্তা তারা বেছে নেয়। এর উপরে আকাশ দিয়ে মেঘ চলাচল করছে; জলে-ধোঁয়ায়-ঝাপসা এই সব মেঘের রাস্তা কাটিয়ে পাখিদের চলতে হয়; না হলে ডানা ভিজে ভারি হয়ে, কুয়াশায়, ধোঁয়ায় দিক ভুল হয়ে, একদিকে যেতে আর-একদিকে গিয়ে পড়বে। এমনি সব নানা ঝনঝাট বাতাসের পথে আছে; কাজেই পাখিদের মধ্যে পাকা মাঝির মতো সব দলপতি-পাখি থাকে। পান্ডারা যেমন দলে-দলে যাত্রী নিয়ে তীর্থ করাতে চলে তেমনি এরাও ভালো-ভালো রাস্তার খবর নিয়ে দলে-দলে নানা পাখি নিয়ে আনাগোনা করে – উত্তর থেকে দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে, পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে পুবে, সমুদ্র থেকে পাহাড়ের দিকে, পাহাড় থেকে সমুদ্রের দিকে, পৃথিবীর একধার থেকে আর-একধারে নানা-দেশে নানা-স্থানে।
মানুষ যখন একদেশ থেকে আর-একদেশে চলে, সে নিজের সঙ্গে খাবার, জিনিস-পত্তর গুছিয়ে নিয়ে চলে। খুব যে গরীব, এমন কি সন্ন্যাসী সেও এক লোটা, এক কম্বল, খানিক ছাতু, ছোলা, আটা, দুটো মোয়া, নয়তো দু’মুঠো মুড়িও সঙ্গে নেয়; কিন্তু পাখিদের এখান থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে, সেখানে নেমে, সেখানে কিছু খেয়ে নিয়ে – এমনি খানিক পথ উড়ে, খানিক আবার ডাঙায় কিম্বা জলায়, কোথাও বা চরে, ঘাটে-ঘাটে জিরিয়ে খেয়ে-দেয়ে না নিলে চলবার উপায় নেই। বাচ্চাদের জন্যে দূর থেকে পাখিরা মুখে করে, গলার থলিতে ভরে খাবার আনে; আর টিয়ে পাখি ঠোঁটে ধানের শিষ, হাঁস পদ্মফুলের ডাঁটা নিয়ে সময়-সময় এদিকে-ওদিকে উড়ে চলে বটে, কিন্তু দল-বেঁধে যখন তারা পান্ডার সঙ্গে দূর-দূর-দেশে যাত্রা করে বেরোয় তখন কুটোটি পর্যন্ত সঙ্গে রাখে না – একেবারে ঝাড়া ঝাপটা হাল্কা হয়ে উড়ে যায়। রেলগাড়ি যেমন দেশ-বিদেশের মধ্য দিয়ে বাঁশি দিতে দিতে স্টেশনে স্টেশনে নতুন-নতুন লোক ওঠাতে ওঠাতে চলে, এই পাখির দলও তেমনি আকাশ দিয়ে ডাক দিতে দিতে চলে; আর এ-গ্রাম সে-গ্রাম এ-দেশ সে-দেশ এ-বন ও-বন থেকে যাত্রী পাখি সব উড়ে গিয়ে ঝাঁকে মিশে আনন্দে মস্ত এক দল বেঁধে চলতে থাকে; আকাশ দিয়ে একটার পর একটা ডাকগাড়ির মতো সারাদিন এমনি দলে-দলে যাতায়াত করে ডাক-হাঁক দিতে-দিতে – হাঁস, বক, সারস, পায়রা, টিয়া, শালিক, ময়না, ডাহুক-ডাহুকী – ছোট-বড় নানা পাখি!
খোঁড়া হাঁসের সঙ্গে মানস-সরোবরে যাবার জন্যে রিদয় ঘর ছেড়ে মাঠে এসে দেখলে নীল আকাশ দিয়ে দলে-দলে বক, সারস, বুনো-হাঁস, পাতি-হাঁস, বালু-হাঁস, রাজহাঁস সারি দিয়ে চলেছে। এই পাখির দল পুবে সন্দ্বীপ থেকে ছেড়ে আমতলির উপর দিয়ে দু’ভাগ হয়ে, এক ভাগ চলেছে – গঙ্গাসাগরের মোহানা ধরে গঙ্গা-যমুনার ধারে-ধারে হরিদ্বারের পথ দিয়ে হিমালয় পেরিয়ে মানস-সরোবর, আর-একদল চলেছে – মেঘনা নদীর মোহানা হয়ে আমতলি, হরিংঘাটা, গঙ্গাসাগর বাঁয়ে ফেলে, আসামের জঙ্গল, গারো-পাহাড়, খাসিয়া-পাহাড় ডাইনে রেখে, ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁকে-বাঁকে ঘুরতে-ঘুরতে হিমালয় পেরিয়ে তিব্বতের উপর দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধবলগিরির উত্তর-গা ঘেঁষে সিধে পশ্চিম-মুখে মানস সরোবরে। সমুদ্রের দিক থেকে গঙ্গাসাগরের পথ পশ্চিম-উত্তর হয়ে হিমালয় পেরিয়ে পুবে ঘুরে পড়েছে মানস-সরোবরে; আর ব্রহ্মপুত্রের পথ উত্তর-পুব হয়ে পশ্চিম ঘুরে শেষ হয়েছে মানস-সরোবরে – যেন বেড়ির দুই মুখ একটি জায়গায় গিয়ে মিলেছে। এই বেড়ির মিলের কাছে রয়েছে সুন্দরবন আর আমতলি, মাঝখানে অন্নপূর্ণার অন্নপাত্র সুজলা সুফলা সোনার বাঙলাদেশ; ডাইনে আসাম; বাঁয়ে বেহার অঞ্চল।
সুবচনীর খোঁড়া-হাঁস রিদয়ের সঙ্গে মাঠে বেরিয়ে প্যাঁক-প্যাঁক করে আপনার মনেই বকতে-বকতে চলল – “ঊঃ বাবারে! আর যে চলতে পারিনে! পা ছিঁড়ে পড়ছে! কেন এলুম গো, মরতে ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলুম! এতদূরে মানস-সরোবর কে জানে গো – অ্যাঁ!” খোঁড়া হাঁস হাঁপাচ্ছে আর চলছে আর বকছে। বাতে বেচারার পা-টি পঙ্গু। সে অনেক কষ্টে খাল-ধারে – যেখানে গোটাকতক বক, গোটাকতক পাতি-হাঁস চরছিল, সেই পর্যন্ত এসে উলু-ঘাসের উপরে খোঁড়া পা রেখে জিরোতে বসল!
রিদয় কি করে? একটা কচু-পাতার নিচে বসে আকাশের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল – দলে-দলে হাঁস উত্তর-মুখে উড়ে চলেছে – নানা কথা বলাবলই করতে-করতে। রিদয় শুনলে শুনলে হাঁসেরা বাজে বকছে না; কাজের কথাই বলতে-বলতে পথ চলেছে।
সেথো-হাঁসেরা বললে – “থাকে-থাকে ফুলের গন্ধ লাগছে নাকে!”
অমনি পান্ডা-হাঁস যে সব আগে চলেছে, জবাব দিলে – “ছুটলে খোসাবো বাদলা রাখে।”
সেথোরা বললে – “নিচে-বাগে নামল তাল-তড়াই!”
পান্ডা উত্তর করলে – “উপরে বড়ই ঠাণ্ডা ভাই!”
সেথোরা বলল – “জাল টেনে মাকড় দিলে চম্পট!”
পান্ডার জবাব হল – “এল বলে বৃষ্টি – চল চটপট!”
সেথোরা বললে – “ফুল সব দিল ঘোমটা টেনে।”
পাণ্ডা বললে – “এল বৃষ্টি এল হেনে!”
“ছুঁচোয় গড়েছে মাটির ঢিপি।”
“বৃষ্টি পড়বে টিপিটিপি।”
“সাগরের পাখি ডাঙায় গেল।”
“ঝড় জল বুঝি এবার এল।”
“কাক যে বাসায় একলা বড়।”
“গতিক খারাপ; নেমে পড়, নেমে পড়।”
অমনি সব হাঁস ঝুপ-ঝুপ করে খালে-বিলে নেমে পড়ে আপনার-আপনার পিঠের পালকগুলো জল দিয়ে বেশ করে ভিজিয়ে নিলে, পাছে পালকগুলো শুকনো থাকলে বৃষ্টির জল বেশি করে চুষে নেয়। দেখতে-দেখতে ঝড়ো-বাতাস ধুলোয় ধুলোয় চারদিক অন্ধকার করে দিয়ে বড়-বড় গাছের আগ দুলিয়ে শুকনো ডাল-পাতা উড়িয়ে হুহু করে করে বেরিয়ে গেল। তারপরই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল – খাল-বিল ভর্তি করে দিয়ে। একটু পরে বৃষ্টি থেমে আবার রোদ উঠল; তখন দলে-দলে হাঁস, বক, সারস আবার চলল – আকাশ-পথে আগের মতো বলাবলি করতে-করতে –
“মাকড় আবার জাল পেতেছে।”
“আর ভয় নেই – রোদ এসেছে।”
“মৌচাক ছেড়ে মাছিরা ছোটে।”
“বাদলের ভয় নাইকো মোটে।”
“বনে-বনে ওঠে পাখির সুর।”
“উড়ে চল, পার যতদূর।”
“আকাশ জুড়িল রামধনুকে!”
“চল – গেয়ে চল মনেরি সুখে।”
আগে-আগে পান্ডা-হাঁস চলেছে, পিছে-পিছে তীরের ফলার মতো দু’সারি হাঁস ডাক দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছে। অনেক উপর দিয়ে একদল ডাক দিয়ে গেল – “পাহাড়তলি কে যাবে? পাহাড়তলি!” বুনো-হাঁসের ডাক শুনে পোষা-পালা খালের বিলের হাঁস, তারা ঘার তুলে যে যেখানে ছিল জবাব দিলে – “যে যায় যাক, আমরা নয়।” মাটির উপরে যারা, তারা মুখে বলছে – “যাব না” কিন্তু আকাশ এমনি নীল, বাতাস এমনি পরিষ্কার যে মন তাদের চাচ্ছে উড়ে চলি – ঐ আলো-মাখা হাওয়ায় ডানা ছড়িয়ে হুহু করে! যেমন এক-এক দল বুনো হাঁস মাথার উপর দিয়ে ডাক দিয়ে যাচ্ছে, আর অমনি যত পালা-হাঁস তারা চঞ্চল হয়ে পালাই-পালাই করছে। দু’চারটে বা ডানা ঝটপট করে এক-একবার উড়ে পড়তে চেষ্টা করলে, অমনি বুড়ি হাঁস ঘাড় নেড়ে বলে উঠল, “এমন কাজ কর না, আকাশ-পথে চলার কষ্ট ভারি, পাহাড়-দেশে শীত বিষম, কিছু মেলে না গো, কিছু মেলে না!”
বুনো-হাঁসের ডাক শুনে সুবচনীর খোঁড়া-হাঁস উড়ে পড়তে আনচান করতে লাগল – “এইবার একদল হাঁস এলে হয়, ঝপ করে উড়ে পড়ব! আর পারিনে বাপু মাটিতে খুঁড়িয়ে চলতে!”
সন্দ্বীপ থেকে বালু-হাঁসের দল হিমালয় পেরিয়ে একেবারে মানস-সরোবর পর্যন্ত যাবার জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়েছে; এবারে সেই দূর-দূরের যাত্রীরা, আমতলির ঠিক উপর দিয়ে চলতে-চলতে ডাক দিতে থাকল টানা সুরে – “মানস-সরোবর! ধৌলাগিরি!”
খোঁড়া-হাঁস অমনি উলু-ঘাসের ঝোপ ছেড়ে গলা তুলে ডাক দিলে – “আসছি, একটু রও একটু রয়ে ভাই, একটু রয়ে চল!” তারপর সে তার শাদা দু’খানা ডানা মেলে বাতাসে গা ভাসিয়ে দু-চার হাত দিয়ে আবার ঝুপ করে মাটিতে পড়ল – বেচারা কতদিন ওড়েনি, ওড়া প্রায় ভুলে গেছে! খোঁড়া-হাঁসের ডাক বালু-হাঁসেরা শুনেছিল বোধ হয়, তাই মাথার উপরে ঘুরে-ঘুরে তারা দেখতে লাগল যাত্রী আসছে কি না। সুবচনীর হাঁস আবার চেঁচিয়ে বললে – “রও ভাই, একটু রয়ে!” তারপর যেমন সে উড়তে যাবে, অমনি রিদয় লাফ দিয়ে তার গলা জড়িয়ে – “আমিও যাব” বলে ঝুলে পড়ল!
খোঁড়া-হাঁস তখন বাতাসে ডানা ছড়িয়ে উড়তে ব্যস্ত, রিদয়কে নামিয়ে দেবার সময় হল না, দুজনেই মাটি ছেড়ে আকাশে উঠল। রিদয়কে নিয়ে খোঁড়া-হাঁস বাতাস কেটে উপরে উঠছে – এমনি বেগে যে মনে হল ডগায় ঝোলানো একটা টিকটিকি নিয়ে হাউই চলেছে। হঠাৎ সেই খোঁড়া-হাঁস এমন তেজে, মাটি ছেড়ে এত উপরে উঠে পড়বে এটা হাঁসটা নিজেও ভাবেনি; রিদয় তো মনেই আনতে পারেনি – এমনটা হবে! এখন আর নামবার উপায় নেই – পায়ের তলায় মাটি কতদূরে পড়ে আছে তার ঠিক নেই, ডানার বাতাস ক্রমাগত তাকে ঝাপটা দিচ্ছে। রিদয় হাফাঁতে হাফাঁতে অতি-কষ্টে গাছে চড়ার মতো হাঁসের গলা ধরে আস্তে আস্তে তার পিঠে চেপে বসল। কিন্তু এমনি গড়ানো হাঁসের পিঠ যে সেখানেও ঠিক বসে থাকা দায় – রিদয় ক্রমেই পিছনে পড়ে যাচ্ছে! দু’খানা শাদা দুটো সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে সে দুলতে দুলতে চলেছে। প্রাণপণে খোঁড়া হাঁসের পিঠের পালক দুই মুঠোয় ধরে, দু’পায়ে গলা জড়িয়ে রিদয় স্থির হয়ে বসবার চেষ্টা করতে লাগল।
মাটির উপর দিয়ে খোঁড়া-হাঁসের সঙ্গে পায়ে হেঁটে যাওয়া এক, আর এক-কুড়ি-একটা উড়ন্ত হাঁসের হাঁক-ডাক, চলন্ত ডানার ঝাপটার মধ্যে বসে ঝড়ের মত শূন্যে উড়ে চলা আর এক! বাতাস তোলপাড় করে চলেছে হাঁসের দল! কুড়ি-জোড়া দাঁড়ের মতো ঝপা-ঝপ উঠছে-পড়ছে জোরাল ডানা! রিদয় দেখছে কেবল হাঁস আর পালক বিজ-বিজ করছে! শুনছে কেবল বাতাসের ঝপ-ঝপ, সোঁ-সোঁ, আর থেকে থেকে হাঁসেদের হাঁক-ডাক! উপর-আকাশ দিয়ে যাচ্ছে, না মেঘের মধ্যে দিয়ে চলেছে, কি মাটির কাছ দিয়ে উড়ছে, রিদয় কিছুই বুঝতে পারছে না!
উপর-আকাশে এমন পাতলা-বাতাস যে হঠাৎ সেখানে উঠে গেলে দম নিতে কষ্ট বোধ হয়, কাজেই নতুন-সেথো – খোঁড়া হাঁসকে একটু সামলে নেবার জন্যে বালু-হাঁসের দল নিচেকার ঘন হাওয়ার মধ্যে দিয়ে বরং আস্তেই চলেছে, এতেই রিদয়ের মনে হচ্ছে যেন পাশাপাশি দুটো রেলগাড়ি পুরোদমে ছুটেছে আর তারি মাঝে এতটুকু সে দুলতে দুলতে চলেছে! ওড়ার প্রথম চোটটা কমে গেলে রিদয়ের হাঁস ক্রমে টাল সামলে সোজা তালে তালে ডানা ফেলে চলতে শুরু করলে! তখন রিদয় মাটির দিকে চেয়ে দেখবার সময় পেলে। হাঁসের দল তখন সুন্দরবন ছাড়িয়ে বাঙলাদেশের বুকের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে। রিদয় আকাশ থেকে দেখছে যেন সবুজ-হলদে-রাঙা-মেটে-নীল এমনি পাঁচ-রঙের ছক-কাটা চমৎকার একখানি কাঁথা রোদে পাতা রয়েছে। রিদয় ভাবছে এ কোনখানে এলেম? সেই সময় বাখরগঞ্জের ধানক্ষেতের উপর দিয়ে হাঁসেরা চলল। রিদয় দেশটা দেখে ভাবলে প্রকান্ড একটা যেন শতরঞ্জ-খেলার ছক নিচের জমিতে পাতা রয়েছে।
রিদয় ভাবছে – “ব্যস রে? এত বড় খেলার ছক, রাবণে দাবা খেলে নাকি?” অমনি যেন তার কথার উত্তর দিয়ে হাঁসেরা ডাক দিলে – “ক্ষেত আর মাঠ, ক্ষেত আর মাঠ – বাখরগঞ্জ!” তখন রিদয়ের চোখ ফুটল। সে বুঝলে সবুজ ছকগুলো ধান-ক্ষেত – নতুন শিষে ভরে রয়েছে! হলদে ছকগুলো সরষে-ক্ষেত – সোনার ফুলে ভরে গিয়েছে! মেটে ছকগুলো খালি জমি – এখনো সেখানে ফসল গজায়নি। রাঙা ছকগুলো শোন আর পাট। সবুজ পাড়-দেওয়া মেটে-মেটে ছকগুলো খালি জমির ধারে ধারে গাছের সার। মাঝে-মাঝে বড়-বড় সবুজ দাগগুলো সব বন। কোথাও সোনালী, কোথাও লাল, কোথাও ফিকে নীলের ধারে ঘন সবুজ ছককাটা ডোরা-টানা জায়গাগুলো নদীর ধারে গ্রামগুলি – ঘর-ঘর পাড়া-পাড়া ভাগ করা রয়েছে। কতগুলো ছকের মাঝে ঘন সবুজ। ধারে ধারে খয়েরি রঙ – সেগুলো হচ্ছে আম-কাঁঠালের বাগান – মাটির পাঁচিল ঘেরা। নদী, নালা, খালগুলো রিদয় দেখলে যেন রূপোলী ডোরার নক্সা – আলোতে ঝিক-ঝিক করছে! নতুন ফল, নতুন পাতা যেন সবুজ মখমলের উপরে এখানে-ওখানে কারচোপের কাজ! – যতদূর চোখ চলে এমনি! আকাশ থেকে মাটি যেন শতরঞ্চি হয়ে গেছে দেখে রিদয় মজা পেয়েছে; সে হাততালি দিয়ে বলেছে – “বাঃ কি তামাশা।” অমনি হাঁসেরা যেন তাকে ধমকে বলে উঠল – “সেরা দেশ – সোনার দেশ – সবুজ দেশ – ফলন্ত-ফুলন্ত বাঙলাদেশ!”
রিদয় একবার গণেশকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে, হাঁসের ধমক শুনে মুখ বুজে গম্ভীর ভালোমানুষটির মতো পিট-পিট করে চারদিকে চাইতে লাগল আর মিট-মিট করে একটু-আধটু হাসতেও থাকল – খুব ঠোঁট চেপে। দলে দলে কত পাখি – কেঊ চলেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে, কেউ উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে পুবে ; আর পথের মাঝে দেখা হলেই এ-দল ও-দললে শুধাচ্ছে – এদিকের খবর, ওদিকের খবর – খবর কি ভাই, খবর কি? অমনি বলাবলি চলল “ওধারে জল হচ্ছে।” “এধারে রোদে পুড়ছে।” “সেধারে ফল ফলেছে।” “এধারে বউল ধরেছে।” রিদয়কে নিয়ে চলতি হাঁসেরা পাহাড় থেকে একদল ফিরতি হাঁসকে শুধিয়ে জানলে – ওধারে এখনো কুয়াশা কাটেনি; শিল পড়ছে; জল হিম; গাছে এখনো ফল ধরেনি! অমনি তারা ঢিমে চালে চলতে আরম্ভ করলে। তাড়াতাড়ি পাহাড়-অঞ্চলে গিয়ে লাভ কি, বলে তারা এ-গ্রাম সে-গ্রাম, নদীর এপার-ওপার করতে করতে ধীরে-সুস্থে এগোতে থাকল।
গ্রামে-গ্রামে ঘরের মটকায় কুঁকড়ো সব পাহারা দিচ্ছে। ঘাটিতে-ঘাটিতে চলন্ত পাখিরা তাদের কাছে খবর পাচ্ছে। “কোন গ্রাম?” “তেঁতুলিয়া, সাবেক তেঁতুলিয়া, হাল তেঁতুলিয়া।” “কোন শহর?” “নোয়াখালি – খটখটে!” “কোন মাঠ?” “তিরপুরণীর মাঠ – জলে থৈ থৈ।”
আবার বড় পাখিদের যে-পথে কম বাতাস সে-পথে গেলে ওড়াই মুশকিল – ডানা নাড়তে-নাড়তে কাঁধ ব্যথা হয়ে যায়! বাতাসের এক-একটা পথ এমন ঠান্ডা যে সেখানে খুব শক্ত পাখিরা ছাড়া কেউ যেতে পারে না – শীতে জমে যাবে। কোনো রাস্তায় এমন গরম বাতাসের স্রোত চলেছে যে সেখানে আগুনের ঝলকে পাখা পুড়ে যায়। এ ছাড়া জোয়ারভাটার মতো অনুকূল-প্রতিকূল দু’রকম হাওয়া বইছে – সেটা বুঝেও পাখিদের যাওয়া-আসা করতে হয়। সব পাখি আবার রাতে উড়তে পারে না, সেজন্য যে-দিক দিয়ে গেলে বন পাবে, নদী পাবে, আকাশ থেকে নেমে দুদণ্ড বসে জিরোতে পাবে – এমন সব যাবার রাস্তা তারা বেছে নেয়। এর উপরে আকাশ দিয়ে মেঘ চলাচল করছে; জলে-ধোঁয়ায়-ঝাপসা এই সব মেঘের রাস্তা কাটিয়ে পাখিদের চলতে হয়; না হলে ডানা ভিজে ভারি হয়ে, কুয়াশায়, ধোঁয়ায় দিক ভুল হয়ে, একদিকে যেতে আর-একদিকে গিয়ে পড়বে। এমনি সব নানা ঝনঝাট বাতাসের পথে আছে; কাজেই পাখিদের মধ্যে পাকা মাঝির মতো সব দলপতি-পাখি থাকে। পান্ডারা যেমন দলে-দলে যাত্রী নিয়ে তীর্থ করাতে চলে তেমনি এরাও ভালো-ভালো রাস্তার খবর নিয়ে দলে-দলে নানা পাখি নিয়ে আনাগোনা করে – উত্তর থেকে দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে, পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে পুবে, সমুদ্র থেকে পাহাড়ের দিকে, পাহাড় থেকে সমুদ্রের দিকে, পৃথিবীর একধার থেকে আর-একধারে নানা-দেশে নানা-স্থানে।
মানুষ যখন একদেশ থেকে আর-একদেশে চলে, সে নিজের সঙ্গে খাবার, জিনিস-পত্তর গুছিয়ে নিয়ে চলে। খুব যে গরীব, এমন কি সন্ন্যাসী সেও এক লোটা, এক কম্বল, খানিক ছাতু, ছোলা, আটা, দুটো মোয়া, নয়তো দু’মুঠো মুড়িও সঙ্গে নেয়; কিন্তু পাখিদের এখান থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে, সেখানে নেমে, সেখানে কিছু খেয়ে নিয়ে – এমনি খানিক পথ উড়ে, খানিক আবার ডাঙায় কিম্বা জলায়, কোথাও বা চরে, ঘাটে-ঘাটে জিরিয়ে খেয়ে-দেয়ে না নিলে চলবার উপায় নেই। বাচ্চাদের জন্যে দূর থেকে পাখিরা মুখে করে, গলার থলিতে ভরে খাবার আনে; আর টিয়ে পাখি ঠোঁটে ধানের শিষ, হাঁস পদ্মফুলের ডাঁটা নিয়ে সময়-সময় এদিকে-ওদিকে উড়ে চলে বটে, কিন্তু দল-বেঁধে যখন তারা পান্ডার সঙ্গে দূর-দূর-দেশে যাত্রা করে বেরোয় তখন কুটোটি পর্যন্ত সঙ্গে রাখে না – একেবারে ঝাড়া ঝাপটা হাল্কা হয়ে উড়ে যায়। রেলগাড়ি যেমন দেশ-বিদেশের মধ্য দিয়ে বাঁশি দিতে দিতে স্টেশনে স্টেশনে নতুন-নতুন লোক ওঠাতে ওঠাতে চলে, এই পাখির দলও তেমনি আকাশ দিয়ে ডাক দিতে দিতে চলে; আর এ-গ্রাম সে-গ্রাম এ-দেশ সে-দেশ এ-বন ও-বন থেকে যাত্রী পাখি সব উড়ে গিয়ে ঝাঁকে মিশে আনন্দে মস্ত এক দল বেঁধে চলতে থাকে; আকাশ দিয়ে একটার পর একটা ডাকগাড়ির মতো সারাদিন এমনি দলে-দলে যাতায়াত করে ডাক-হাঁক দিতে-দিতে – হাঁস, বক, সারস, পায়রা, টিয়া, শালিক, ময়না, ডাহুক-ডাহুকী – ছোট-বড় নানা পাখি!
খোঁড়া হাঁসের সঙ্গে মানস-সরোবরে যাবার জন্যে রিদয় ঘর ছেড়ে মাঠে এসে দেখলে নীল আকাশ দিয়ে দলে-দলে বক, সারস, বুনো-হাঁস, পাতি-হাঁস, বালু-হাঁস, রাজহাঁস সারি দিয়ে চলেছে। এই পাখির দল পুবে সন্দ্বীপ থেকে ছেড়ে আমতলির উপর দিয়ে দু’ভাগ হয়ে, এক ভাগ চলেছে – গঙ্গাসাগরের মোহানা ধরে গঙ্গা-যমুনার ধারে-ধারে হরিদ্বারের পথ দিয়ে হিমালয় পেরিয়ে মানস-সরোবর, আর-একদল চলেছে – মেঘনা নদীর মোহানা হয়ে আমতলি, হরিংঘাটা, গঙ্গাসাগর বাঁয়ে ফেলে, আসামের জঙ্গল, গারো-পাহাড়, খাসিয়া-পাহাড় ডাইনে রেখে, ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁকে-বাঁকে ঘুরতে-ঘুরতে হিমালয় পেরিয়ে তিব্বতের উপর দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধবলগিরির উত্তর-গা ঘেঁষে সিধে পশ্চিম-মুখে মানস সরোবরে। সমুদ্রের দিক থেকে গঙ্গাসাগরের পথ পশ্চিম-উত্তর হয়ে হিমালয় পেরিয়ে পুবে ঘুরে পড়েছে মানস-সরোবরে; আর ব্রহ্মপুত্রের পথ উত্তর-পুব হয়ে পশ্চিম ঘুরে শেষ হয়েছে মানস-সরোবরে – যেন বেড়ির দুই মুখ একটি জায়গায় গিয়ে মিলেছে। এই বেড়ির মিলের কাছে রয়েছে সুন্দরবন আর আমতলি, মাঝখানে অন্নপূর্ণার অন্নপাত্র সুজলা সুফলা সোনার বাঙলাদেশ; ডাইনে আসাম; বাঁয়ে বেহার অঞ্চল।
সুবচনীর খোঁড়া-হাঁস রিদয়ের সঙ্গে মাঠে বেরিয়ে প্যাঁক-প্যাঁক করে আপনার মনেই বকতে-বকতে চলল – “ঊঃ বাবারে! আর যে চলতে পারিনে! পা ছিঁড়ে পড়ছে! কেন এলুম গো, মরতে ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলুম! এতদূরে মানস-সরোবর কে জানে গো – অ্যাঁ!” খোঁড়া হাঁস হাঁপাচ্ছে আর চলছে আর বকছে। বাতে বেচারার পা-টি পঙ্গু। সে অনেক কষ্টে খাল-ধারে – যেখানে গোটাকতক বক, গোটাকতক পাতি-হাঁস চরছিল, সেই পর্যন্ত এসে উলু-ঘাসের উপরে খোঁড়া পা রেখে জিরোতে বসল!
রিদয় কি করে? একটা কচু-পাতার নিচে বসে আকাশের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল – দলে-দলে হাঁস উত্তর-মুখে উড়ে চলেছে – নানা কথা বলাবলই করতে-করতে। রিদয় শুনলে শুনলে হাঁসেরা বাজে বকছে না; কাজের কথাই বলতে-বলতে পথ চলেছে।
সেথো-হাঁসেরা বললে – “থাকে-থাকে ফুলের গন্ধ লাগছে নাকে!”
অমনি পান্ডা-হাঁস যে সব আগে চলেছে, জবাব দিলে – “ছুটলে খোসাবো বাদলা রাখে।”
সেথোরা বললে – “নিচে-বাগে নামল তাল-তড়াই!”
পান্ডা উত্তর করলে – “উপরে বড়ই ঠাণ্ডা ভাই!”
সেথোরা বলল – “জাল টেনে মাকড় দিলে চম্পট!”
পান্ডার জবাব হল – “এল বলে বৃষ্টি – চল চটপট!”
সেথোরা বললে – “ফুল সব দিল ঘোমটা টেনে।”
পাণ্ডা বললে – “এল বৃষ্টি এল হেনে!”
“ছুঁচোয় গড়েছে মাটির ঢিপি।”
“বৃষ্টি পড়বে টিপিটিপি।”
“সাগরের পাখি ডাঙায় গেল।”
“ঝড় জল বুঝি এবার এল।”
“কাক যে বাসায় একলা বড়।”
“গতিক খারাপ; নেমে পড়, নেমে পড়।”
অমনি সব হাঁস ঝুপ-ঝুপ করে খালে-বিলে নেমে পড়ে আপনার-আপনার পিঠের পালকগুলো জল দিয়ে বেশ করে ভিজিয়ে নিলে, পাছে পালকগুলো শুকনো থাকলে বৃষ্টির জল বেশি করে চুষে নেয়। দেখতে-দেখতে ঝড়ো-বাতাস ধুলোয় ধুলোয় চারদিক অন্ধকার করে দিয়ে বড়-বড় গাছের আগ দুলিয়ে শুকনো ডাল-পাতা উড়িয়ে হুহু করে করে বেরিয়ে গেল। তারপরই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল – খাল-বিল ভর্তি করে দিয়ে। একটু পরে বৃষ্টি থেমে আবার রোদ উঠল; তখন দলে-দলে হাঁস, বক, সারস আবার চলল – আকাশ-পথে আগের মতো বলাবলি করতে-করতে –
“মাকড় আবার জাল পেতেছে।”
“আর ভয় নেই – রোদ এসেছে।”
“মৌচাক ছেড়ে মাছিরা ছোটে।”
“বাদলের ভয় নাইকো মোটে।”
“বনে-বনে ওঠে পাখির সুর।”
“উড়ে চল, পার যতদূর।”
“আকাশ জুড়িল রামধনুকে!”
“চল – গেয়ে চল মনেরি সুখে।”
আগে-আগে পান্ডা-হাঁস চলেছে, পিছে-পিছে তীরের ফলার মতো দু’সারি হাঁস ডাক দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছে। অনেক উপর দিয়ে একদল ডাক দিয়ে গেল – “পাহাড়তলি কে যাবে? পাহাড়তলি!” বুনো-হাঁসের ডাক শুনে পোষা-পালা খালের বিলের হাঁস, তারা ঘার তুলে যে যেখানে ছিল জবাব দিলে – “যে যায় যাক, আমরা নয়।” মাটির উপরে যারা, তারা মুখে বলছে – “যাব না” কিন্তু আকাশ এমনি নীল, বাতাস এমনি পরিষ্কার যে মন তাদের চাচ্ছে উড়ে চলি – ঐ আলো-মাখা হাওয়ায় ডানা ছড়িয়ে হুহু করে! যেমন এক-এক দল বুনো হাঁস মাথার উপর দিয়ে ডাক দিয়ে যাচ্ছে, আর অমনি যত পালা-হাঁস তারা চঞ্চল হয়ে পালাই-পালাই করছে। দু’চারটে বা ডানা ঝটপট করে এক-একবার উড়ে পড়তে চেষ্টা করলে, অমনি বুড়ি হাঁস ঘাড় নেড়ে বলে উঠল, “এমন কাজ কর না, আকাশ-পথে চলার কষ্ট ভারি, পাহাড়-দেশে শীত বিষম, কিছু মেলে না গো, কিছু মেলে না!”
বুনো-হাঁসের ডাক শুনে সুবচনীর খোঁড়া-হাঁস উড়ে পড়তে আনচান করতে লাগল – “এইবার একদল হাঁস এলে হয়, ঝপ করে উড়ে পড়ব! আর পারিনে বাপু মাটিতে খুঁড়িয়ে চলতে!”
সন্দ্বীপ থেকে বালু-হাঁসের দল হিমালয় পেরিয়ে একেবারে মানস-সরোবর পর্যন্ত যাবার জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়েছে; এবারে সেই দূর-দূরের যাত্রীরা, আমতলির ঠিক উপর দিয়ে চলতে-চলতে ডাক দিতে থাকল টানা সুরে – “মানস-সরোবর! ধৌলাগিরি!”
খোঁড়া-হাঁস অমনি উলু-ঘাসের ঝোপ ছেড়ে গলা তুলে ডাক দিলে – “আসছি, একটু রও একটু রয়ে ভাই, একটু রয়ে চল!” তারপর সে তার শাদা দু’খানা ডানা মেলে বাতাসে গা ভাসিয়ে দু-চার হাত দিয়ে আবার ঝুপ করে মাটিতে পড়ল – বেচারা কতদিন ওড়েনি, ওড়া প্রায় ভুলে গেছে! খোঁড়া-হাঁসের ডাক বালু-হাঁসেরা শুনেছিল বোধ হয়, তাই মাথার উপরে ঘুরে-ঘুরে তারা দেখতে লাগল যাত্রী আসছে কি না। সুবচনীর হাঁস আবার চেঁচিয়ে বললে – “রও ভাই, একটু রয়ে!” তারপর যেমন সে উড়তে যাবে, অমনি রিদয় লাফ দিয়ে তার গলা জড়িয়ে – “আমিও যাব” বলে ঝুলে পড়ল!
খোঁড়া-হাঁস তখন বাতাসে ডানা ছড়িয়ে উড়তে ব্যস্ত, রিদয়কে নামিয়ে দেবার সময় হল না, দুজনেই মাটি ছেড়ে আকাশে উঠল। রিদয়কে নিয়ে খোঁড়া-হাঁস বাতাস কেটে উপরে উঠছে – এমনি বেগে যে মনে হল ডগায় ঝোলানো একটা টিকটিকি নিয়ে হাউই চলেছে। হঠাৎ সেই খোঁড়া-হাঁস এমন তেজে, মাটি ছেড়ে এত উপরে উঠে পড়বে এটা হাঁসটা নিজেও ভাবেনি; রিদয় তো মনেই আনতে পারেনি – এমনটা হবে! এখন আর নামবার উপায় নেই – পায়ের তলায় মাটি কতদূরে পড়ে আছে তার ঠিক নেই, ডানার বাতাস ক্রমাগত তাকে ঝাপটা দিচ্ছে। রিদয় হাফাঁতে হাফাঁতে অতি-কষ্টে গাছে চড়ার মতো হাঁসের গলা ধরে আস্তে আস্তে তার পিঠে চেপে বসল। কিন্তু এমনি গড়ানো হাঁসের পিঠ যে সেখানেও ঠিক বসে থাকা দায় – রিদয় ক্রমেই পিছনে পড়ে যাচ্ছে! দু’খানা শাদা দুটো সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে সে দুলতে দুলতে চলেছে। প্রাণপণে খোঁড়া হাঁসের পিঠের পালক দুই মুঠোয় ধরে, দু’পায়ে গলা জড়িয়ে রিদয় স্থির হয়ে বসবার চেষ্টা করতে লাগল।
মাটির উপর দিয়ে খোঁড়া-হাঁসের সঙ্গে পায়ে হেঁটে যাওয়া এক, আর এক-কুড়ি-একটা উড়ন্ত হাঁসের হাঁক-ডাক, চলন্ত ডানার ঝাপটার মধ্যে বসে ঝড়ের মত শূন্যে উড়ে চলা আর এক! বাতাস তোলপাড় করে চলেছে হাঁসের দল! কুড়ি-জোড়া দাঁড়ের মতো ঝপা-ঝপ উঠছে-পড়ছে জোরাল ডানা! রিদয় দেখছে কেবল হাঁস আর পালক বিজ-বিজ করছে! শুনছে কেবল বাতাসের ঝপ-ঝপ, সোঁ-সোঁ, আর থেকে থেকে হাঁসেদের হাঁক-ডাক! উপর-আকাশ দিয়ে যাচ্ছে, না মেঘের মধ্যে দিয়ে চলেছে, কি মাটির কাছ দিয়ে উড়ছে, রিদয় কিছুই বুঝতে পারছে না!
উপর-আকাশে এমন পাতলা-বাতাস যে হঠাৎ সেখানে উঠে গেলে দম নিতে কষ্ট বোধ হয়, কাজেই নতুন-সেথো – খোঁড়া হাঁসকে একটু সামলে নেবার জন্যে বালু-হাঁসের দল নিচেকার ঘন হাওয়ার মধ্যে দিয়ে বরং আস্তেই চলেছে, এতেই রিদয়ের মনে হচ্ছে যেন পাশাপাশি দুটো রেলগাড়ি পুরোদমে ছুটেছে আর তারি মাঝে এতটুকু সে দুলতে দুলতে চলেছে! ওড়ার প্রথম চোটটা কমে গেলে রিদয়ের হাঁস ক্রমে টাল সামলে সোজা তালে তালে ডানা ফেলে চলতে শুরু করলে! তখন রিদয় মাটির দিকে চেয়ে দেখবার সময় পেলে। হাঁসের দল তখন সুন্দরবন ছাড়িয়ে বাঙলাদেশের বুকের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে। রিদয় আকাশ থেকে দেখছে যেন সবুজ-হলদে-রাঙা-মেটে-নীল এমনি পাঁচ-রঙের ছক-কাটা চমৎকার একখানি কাঁথা রোদে পাতা রয়েছে। রিদয় ভাবছে এ কোনখানে এলেম? সেই সময় বাখরগঞ্জের ধানক্ষেতের উপর দিয়ে হাঁসেরা চলল। রিদয় দেশটা দেখে ভাবলে প্রকান্ড একটা যেন শতরঞ্জ-খেলার ছক নিচের জমিতে পাতা রয়েছে।
রিদয় ভাবছে – “ব্যস রে? এত বড় খেলার ছক, রাবণে দাবা খেলে নাকি?” অমনি যেন তার কথার উত্তর দিয়ে হাঁসেরা ডাক দিলে – “ক্ষেত আর মাঠ, ক্ষেত আর মাঠ – বাখরগঞ্জ!” তখন রিদয়ের চোখ ফুটল। সে বুঝলে সবুজ ছকগুলো ধান-ক্ষেত – নতুন শিষে ভরে রয়েছে! হলদে ছকগুলো সরষে-ক্ষেত – সোনার ফুলে ভরে গিয়েছে! মেটে ছকগুলো খালি জমি – এখনো সেখানে ফসল গজায়নি। রাঙা ছকগুলো শোন আর পাট। সবুজ পাড়-দেওয়া মেটে-মেটে ছকগুলো খালি জমির ধারে ধারে গাছের সার। মাঝে-মাঝে বড়-বড় সবুজ দাগগুলো সব বন। কোথাও সোনালী, কোথাও লাল, কোথাও ফিকে নীলের ধারে ঘন সবুজ ছককাটা ডোরা-টানা জায়গাগুলো নদীর ধারে গ্রামগুলি – ঘর-ঘর পাড়া-পাড়া ভাগ করা রয়েছে। কতগুলো ছকের মাঝে ঘন সবুজ। ধারে ধারে খয়েরি রঙ – সেগুলো হচ্ছে আম-কাঁঠালের বাগান – মাটির পাঁচিল ঘেরা। নদী, নালা, খালগুলো রিদয় দেখলে যেন রূপোলী ডোরার নক্সা – আলোতে ঝিক-ঝিক করছে! নতুন ফল, নতুন পাতা যেন সবুজ মখমলের উপরে এখানে-ওখানে কারচোপের কাজ! – যতদূর চোখ চলে এমনি! আকাশ থেকে মাটি যেন শতরঞ্চি হয়ে গেছে দেখে রিদয় মজা পেয়েছে; সে হাততালি দিয়ে বলেছে – “বাঃ কি তামাশা।” অমনি হাঁসেরা যেন তাকে ধমকে বলে উঠল – “সেরা দেশ – সোনার দেশ – সবুজ দেশ – ফলন্ত-ফুলন্ত বাঙলাদেশ!”
রিদয় একবার গণেশকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে, হাঁসের ধমক শুনে মুখ বুজে গম্ভীর ভালোমানুষটির মতো পিট-পিট করে চারদিকে চাইতে লাগল আর মিট-মিট করে একটু-আধটু হাসতেও থাকল – খুব ঠোঁট চেপে। দলে দলে কত পাখি – কেঊ চলেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে, কেউ উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে পুবে ; আর পথের মাঝে দেখা হলেই এ-দল ও-দললে শুধাচ্ছে – এদিকের খবর, ওদিকের খবর – খবর কি ভাই, খবর কি? অমনি বলাবলি চলল “ওধারে জল হচ্ছে।” “এধারে রোদে পুড়ছে।” “সেধারে ফল ফলেছে।” “এধারে বউল ধরেছে।” রিদয়কে নিয়ে চলতি হাঁসেরা পাহাড় থেকে একদল ফিরতি হাঁসকে শুধিয়ে জানলে – ওধারে এখনো কুয়াশা কাটেনি; শিল পড়ছে; জল হিম; গাছে এখনো ফল ধরেনি! অমনি তারা ঢিমে চালে চলতে আরম্ভ করলে। তাড়াতাড়ি পাহাড়-অঞ্চলে গিয়ে লাভ কি, বলে তারা এ-গ্রাম সে-গ্রাম, নদীর এপার-ওপার করতে করতে ধীরে-সুস্থে এগোতে থাকল।
গ্রামে-গ্রামে ঘরের মটকায় কুঁকড়ো সব পাহারা দিচ্ছে। ঘাটিতে-ঘাটিতে চলন্ত পাখিরা তাদের কাছে খবর পাচ্ছে। “কোন গ্রাম?” “তেঁতুলিয়া, সাবেক তেঁতুলিয়া, হাল তেঁতুলিয়া।” “কোন শহর?” “নোয়াখালি – খটখটে!” “কোন মাঠ?” “তিরপুরণীর মাঠ – জলে থৈ থৈ।”