শিলাদিত্য
শিলাদিত্যের যখন জন্ম হয়নি, যে সময়ে বল্লভীপুরে রাজা কনকসেনের বংশের শেষ রাজা রাজত্ব করছিলেন, সেই সময়ে বল্লভীপুরে সূর্যকুণ্ড নামে একটি অতি পবিত্র কুণ্ড ছিল। সেই কুণ্ডের একধারে এক অতিবৃদ্ধ পুরোহিত বাস করতেন। তাঁর একটিও পুত্রকন্যা কিংবা বন্ধুবান্ধব ছিল না । অনন্ত আকাশে সূর্যদেব যেমন একা, তেমনি আকাশের মতো নীল প্রকাণ্ড সূর্যকুণ্ডের তীরে আদিত্য-মন্দিরে সূর্যপুরোহিত তেজস্বী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বড়ই একাকী, বড়ই সঙ্গীহীন ছিলেন । মন্দিরে দীপ-দান, ঘণ্টাধ্বনি, উদয়-অস্ত দুই সন্ধ্যা আরতি, সকল ভারই তাঁর উপর — ভৃত্য নেই, অনুচর নেই, একটি সিস্যও নেই! বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ একাই প্রতিদিন ত্রিশ সের অজনের পিতলের প্রদীপে দুই সন্ধ্যা সূর্যদেবের আরতি করতেন; প্রতিদিনই সেই শীর্ণ হাতে রাক্ষস রাজার রাজমুকুটের মতো মন্দিরের প্রকাণ্ড ঘণ্টা বাজাতেন; আর মনে-মনে ভাবতেন, যদি একটি সঙ্গী পাই, তবে এই বৃদ্ধ বয়সে তার হাতে সমস্ত ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হই।
সূর্যদেব ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করলেন । একদিন পৌষ মাসের প্রথমে ঘন কুয়াশায় চারিদিক অন্ধকার ছিল, সূর্যদেব অস্ত গেছেন, বৃদ্ধ পুরোহিত সন্ধ্যার আরতি শেষ করে ভীমের বুকপাটাখানার মতো প্রকাণ্ড মন্দিরের লোহার কপাট বহুকষ্টে বন্ধ করেছেন, এমন সময় একটি ব্রাহ্মণ-কন্যা তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হল— পরনে ছিন্নবাস কিন্তু অপূর্ব সুন্দরী! বোধ হল যেন শীতের ভয়ে একটি সন্ধ্যাতারা সূর্যমন্দিরে আশ্রয় চায়। ব্রাহ্মণ দেখলেন —কন্যাটি সুলক্ষণা, অথচ তার বিধবার বেশ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন — “কে তুমি?কি চাও?” তখন সেই ব্রাহ্মণবালিকা কমলকলির মতো ছোট দুইখানি হাত জোড় করে বললে —“প্রভু, আমি আশ্রয় চাই; ব্রাহ্মণ-কন্যা, গুর্জর দেশের বেদবিদ ব্রাহ্মণ দেবাদিত্যের একমাত্র কন্যা আমি, নাম সুভাগা; বিয়ের রাতে বিধবা হয়েছি, সেই দোষে দুর্ভাগী বলে সকলে মিলে আমায় আমাদের দেশের বার করেছে।প্রভু, আমার মা ছিলেন, এখন মা-ও নেই, আমায় আশ্রয় দাও।” ব্রাহ্মণ বললেন —“আরে অনাথিনী, এখানে কোন সুখের আশায় আশ্রয় চাস? আমার অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, আমি যে নিতান্ত দরিদ্র, বন্ধুহীন।”
ব্রাহ্মণ মনে-মনে এই কথা বললেন বটে, কিন্তু কে যেন তাঁর মনের ভিতর বলতে লাগল—“হে দরিদ্র, হে বন্ধুহীন, এই বালিকাকে তোমার বন্ধু কর, আশ্রয় দাও।” ব্রাহ্মণ একবার মনে করলেন আশ্রয় দিই; আবার ভাবলেন— যে মন্দিরে আশী বৎসর ধরে একা এই সূর্যদেবের পূজা করলেম আজ শেষ-দশায় আবার কার হাতে তাঁর পূজার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হই। ব্রাহ্মণ ইতস্তত করতে লাগলেন। তখন সহসা সন্ধ্যার সমস্ত অন্ধকার ভেদ করে পৃথিবীর পশ্চিম পার থেকে একবিন্দু সূর্যের আলো সেই দুঃখিনী বালিকার মুখখানিতে এসে পড়ল। ভগবান আদিত্যদেব যেন নিজের হাতে দেখিয়ে দিলেন— এই আমার সেবাদাসী! হে আমার প্রিয় ভক্ত, এই বালিকাকে আশ্রয় দাও, যেন চিরদিন এই দুঃখিনী বিধবা আমার সেবায় নিযুক্ত থাকে। ব্রাহ্মণ জোরহস্তে সূর্যদেবকে প্রণাম করে, দেবাদিত্য ব্রাহ্মণের কন্যা সুভাগাকে সূর্যমন্দিরে আশ্রয় দিলেন।
তারপরে কতদিন কেটে গেল, সুভাগা তখন মন্দিরের সমস্ত কাজই শিখেছেন, কেবল ননীর মতো কোমল হাতে ত্রিশ সের ওজনের সেই আরতির প্রদীপটা কিছুতেই তুলতে পারলেন না বলে আরতির কাজটা বৃদ্ধকেই করতে হত। একদিন সুভাগা দেখলেন,বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের জীর্ণ শরীর যেন ভেঙে পড়েছে—আরতির প্রদীপ শীর্ণ হাতে টলে পড়েছে। সেই দিন সুভাগা বল্লভীপুরের বাজারে গিয়ে এক সের ওজনের একটি ছোট প্রদীপ নিয়ে এসে বললেন— “পিতা, আজ সন্ধ্যার সময় এই প্রদীপে সূর্যদেবের আরতি করুন।” ব্রাহ্মণ একটু হেসে বললেন সকালে যে প্রদীপে দেবতার আরতি আরম্ভ করেছি, সন্ধ্যাতেও সেই প্রদীপে দেবতার আরতি করা চাই! নতুন প্রদীপ তুলে রাখ, কাল নতুন দিনে নতুন প্রদীপে সূর্যদেবের আরতি হবে।” সেই দিন ঠিক দ্বিপ্রহরে সূর্যের আলোয় যখন সমস্ত পৃথিবী আলোময় হয়ে গেছে, সেই সময় ব্রাহ্মণ সুভাগাকে সূর্যমন্ত্র শিক্ষা দিলেন—যে-মন্ত্রের গুণে সূর্যদেব স্বয়ং এসে ভক্তকে দর্শন দেন, যে-মন্ত্র জীবনে একবার ছাড়া দুইবার উচ্চারণে নিশ্চয় মৃত্যু। তারপর সন্ধিক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকারে আরতি শেষে নিভন্ত প্রদীপের মতো ব্রাহ্মণের জীবন-প্রদীপ ধীরে-ধীরে নিভে গেল—সূর্যদেব সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার করে অস্ত গেলেন। সুভাগা একলা পড়লেন।
প্রথম দিনকতক সুভাগা বৃদ্ধের জন্য কেঁদে-কেঁদে কাটালেন।তারপর দিনকতক নিজের হাতে জঙ্গল পরিষ্কার করে মন্দিরের চারিদিকে ফলের গাছ, ফুলের গাছ লাগাতে কেটে গেল। আরও কতদিন মন্দিরের পাথরের দেয়াল মেজে-ঘষে পরিষ্কার করে তার গায়ে লতা, পাতা, ফুল, পাখি, হাতি, ঘোড়া, পুরাণ, ইতিহাসের পট লিখতে চলে গেল। শেষে সুভাগার হাতে আর কোনো কাজ রইল না। তখন তিনি সেই ফলের বাগানে, ফুলের মালঞ্চে একা-একাই ঘুরে বেড়াতেন। ক্রমে যখন সেই নতুন বাগানে দুটি-একটি ফল পাকতে আরম্ভ হল,দুটি-একটি ফুল ফুটতে লাগল, তখন ক্রমে দু-একটি ছোট পাখি, গুটিকতক রঙিন প্রজাপতি, সেই সঙ্গে একপাল ছোট-বড় ছেলে-মেয়ে দেখা দিলে।প্রজাপতি শুধু একটুখানি ফুলের মধু খেয়ে সন্তুষ্ট ছিল, পাখি শুধু দু-একটা পাকা ফল ঠোকরাত মাত্র; কিন্তু সেই ছেলের পাল ফুল ছিঁড়ে, ফল পেড়ে, ডাল ভেঙে চুরমার করত। সুভাগা কিন্তু কাকেও কিছু বলতেন না, হাসিমুখে সকল উৎপাত সহ্য করতেন। গাছের তলায় সবুজ ঘাসে নানা রঙের কাপড় পরে ছোট- ছোট ছেলে-মেয়ে খেলে বেড়াত, দেখতে দেখতে সুভাগার দিনগুলো আনমনে কেটে যেত। ক্রমে বর্ষা এসে পড়ল—চারিদিকে কালো মেঘের ঘটা, বিদ্যুতের ছটা, আর গুরুগুরু গর্জন— সেই সময় একদিন ক্ষুরের মতো পুবের হাওয়া সুভাগার নতুন বাগানে ফুলের বোঁটা কেটে, গাছের পাতা ঝরিয়ে, তার সাধের মালঞ্চ শূন্যপ্রায় করে শনশন শব্দে চলে গেল। পাখির ঝাঁক হাওয়ার মুখে উড়ে গেল; প্রজাপতির ভাঙা ডানা ফুলের পাপড়ির মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল, ছেলের পাল কোথায় অদৃশ্য হল। সুভাগা তখন সেই ধারা শ্রাবণে একা বসে-বসে বাপমায়ের কথা, শ্বশুর-শাশুড়ীর নিষ্ঠুরতা, আর বিয়ের রাত্রের সুন্দর বরের হাসিমুখের কথা মনে করে কাঁদতে লাগলেন; আর মনে-মনে ভাবতে লাগলেন—“হায় এই নির্জনে সঙ্গীহীন বিদেশে কেমন করে সারাজীবন কাটাব।” হরিণের চোখের মতো সুভাগার কালো-কালো দুটি বড়-বড় চোখ অশ্রুজলে ভরে উঠল। তিনি পুবে দেখলেন অন্ধকার, পশ্চিমে অন্ধকার, উত্তর, দক্ষিণে— চারিদিকে অন্ধকার; মনে পড়ল, এমনি অন্ধকারে একদিন তিনি সেই মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আজও সেদিনের মতো অন্ধকার— সেই বাদলার হাওয়া, সেই নিঃশব্দ প্রকাণ্ড সূর্যমন্দির— কিন্তু হায়, কোথায় আজ সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, যিনি সেই দুর্দিনে অনাথিনী অভাগিনী সুভাগাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন! সুভাগার কালো চোখ থেকে দুটি ফোঁটা জল দুই বিন্দু বৃষ্টির মতো অন্ধকারে ঝরে পড়ল। সুভাগা মন্দিরের সমস্ত দুয়ার বন্ধ করে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের আরতি করলেন। তারপর কি জানি কি মনে করে, সুভাগা সেই সূর্যমূর্তির সম্মুখে ধ্যানে বসলেন।ক্রমে সুভাগার দুটি চক্ষু স্থির হয়ে এল, চারিদিক থেকে ঝড়ের ঝনঝনা, মেঘের কড়মড়ি, ক্রমে যেন দূর হতে বহুদূরে সরে গেল! সুভাগার মনে আর কোনো শোক নেই, কোনো দুঃখ নেই। তাঁর মনের অন্ধকার যেন সূর্যের তেজে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সুভাগা ধীরে-ধীরে, ভয়ে-ভয়ে, বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কাছে শেখা সূর্যমন্ত্র উচ্চারণ করলেন; তখন সমস্ত পৃথিবী যেন জেগে উঠল, সুভাগা যেন শুনতে পেলেন, চারিদিকে পাখির গান, বাঁশির তান, আনন্দের কোলাহল! তারপর গুরুগুরু গভীর গর্জনে সমস্ত আকাশ কাঁপিয়ে, চারিদিক আলোয় আলোময় করে সেই মন্দিরে পাথরের দেয়াল, লোহার দরজা যেন আগুনে-আগুনে গলিয়ে দিয়ে সাতটা সবুজ ঘোড়ার-পিঠে আলোর রথে কোটি-কোটি আগুনের সমান জ্যোতির্ময় আলোময় সূর্যদেব দর্শন দিলেন। সে আলো সে জ্যোতি মানুষের চোখে সহ্য হ্য় না। সুভাগা দুহাতে মুখ ঢেকে বললেন— “হে দেব, রক্ষা কর, ক্ষমা কর, সমস্ত পৃথিবী জ্বলে যায়!” সূর্যদেব বললেন — “ভয় নেই, ভয় নেই। বৎসে, বর প্রার্থনা কর।” বলতে-বলতে সূর্যদেবের আলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এলো, একটুখানি রাঙা আভা সধবার সিঁদুরের মতো সুভাগার সিঁথি আলো করে রইল। তখন সুভাগা বললেন—“প্রভু, আমি পতিপুত্রহীনা, বিধবা অনাথিনী, বড়ই একাকিনী, আমাকে এই বর দাও যেন এই পৃথিবীতে আমার আর না থাকতে হয়; সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে আজই তোমার চরণতলে আমার মরণ হোক।” সূর্যদেব বললেন—“ বৎসে, দেবতার বরে মৃত্যু হয় না, দেবতার অভিশাপে মৃত্যু হয়, তুমি বর প্রার্থনা কর!” তখন সুভাগা সূর্যদেবকে প্রণাম করে বললেন—“প্রভু, যদি বর দিলে, তবে আমাকে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে দাও, আমি তাদের মানুষ করি!” ছেলেটি তোমার মতো তেজস্বী হবে, মেয়েটি হবে চাঁদের কণার মতো সুন্দরী!”
সূর্যদেব তথাস্তু বলে অন্তর্ধান করলেন। ধীরে-ধীরে সুভাগার চোখে ঘুম এল, সুভাগা পাষাণের উপর আঁচল পেতে শুয়ে পড়লেন। চারিদিকে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। তখন ভোর হয়ে এসেছে, সুভাগা ঘুমের ঘোরে শুনতে লাগলেন, তাঁর সেই ভাঙা মালঞ্চে দুটি ছোট পাখি কি সুন্দর গান ধরেছে। ক্রমে সকাল বেলার একটুখানি সোনার আলো সুভাগার চোখে পড়ল, তিনি তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন,আঁচলে টান পড়ল, চেয়ে দেখলেন কচি দুটি ছেলেমেয়ে কোলের কাছে ঘুমিয়ে আছে।সূর্যদেবের বর সফল হল—সুভাগা দেবতার মতো সুন্দর সন্তান দুটি কোলে নিলেন। সকল লোকের চোখের আড়ালে নির্জন মন্দিরে জন্ম হল বলে, সুভাগা দুজনের নাম দিলেন, গায়েব, গায়েবী।
সুভাগা গায়েব আর গায়েবীকে বুকে নিয়ে মন্দিরের বাইরে এলেন; তখন পুবে সূর্যদেব উদয় হচ্ছিলেন,পশ্চিমে চাঁদ অস্ত যাচ্ছিলেন। সুভাগা দেখলেন, গায়েবের মুখে সূর্যের আলো ক্রমে ফুটে উঠতে লাগল, আর গায়েবীর কালো চুলে চাঁদের জ্যোৎস্না ধীরে-ধীরে নিভে গেল। তিনি মনে-মনে বুঝলেন, গায়েবীকে এই পৃথিবীতে বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না।
গায়েব ক্রমশ যখন বড় হয়ে পাঠশালায় যেতে আরম্ভ করলেন, সেই সময় গায়েবী মায়ের কাছে বসে মন্দিরের কাজকর্ম শিখতে লাগলেন।গায়েব যেমন দুরন্ত দুর্দান্ত, গায়েবী তেমনি শিষ্ট শান্ত। গায়েবীর সঙ্গে কত ছোট-ছোট মেয়ে সেধে-সেধে খেলা করতে আসত, কিন্তু গায়েবের উৎপাতে পাঠশালার সকল ছেলে অস্থির হয়ে উঠেছিল। শেষে তারা সকলে মিলে একদিন পরামর্শ করলে— গায়েব আমাদের চেয়ে লেখায়, পড়ায়, গায়ের জোরে সকল বিষয়ে বড়; এস আমরা তার প্রজা হই; তাহলে গায়েব আর আমাদের উপর অত্যাচার করতে পারবে না। এই বলে সকলে মিলে গায়েবকে রাজা বলে কাঁধে করে নৃত্য আরম্ভ করলে। গায়েব হাসিখুশিতে সেই সকল ছোট-ছোট ছেলের কাঁধে বসে আছেন, এমন সময়ে একটি খুব ছোট ছেলে বলে উঠল—“আমি রাজার পূজারী। মন্ত্র পড়ে গায়েবকে রাজটীকা দেব।” তখন সেই ছেলের পাল গায়েবকে একটা মাটির ঢিবির উপর বসিয়ে দিলে। গায়েব সত্যি রাজার মতো সেই মাটির সিংহাসনে বসে আছেন, এমন সময় সেই ছোট ছেলেটি তাঁর কপালে তিলক টেনে দিয়ে বললে—“গায়েব, তোমার নাম জানি, বল তোমার মায়ের নাম কি? বাপের নাম কি?” গায়েব বললেন—“ আমার নাম গায়েব, আমার বোনের নাম গায়েবী— মায়ের নাম সুভাগা। আমার বাপের নাম—কি?” গায়েব জানেন না যে তিনি সূর্যদেবের বরপুত্র। নাম বলতে পারলেন না, লজ্জায় অধোবদন হলেন, চারিদিকে ছেলের পাল হো-হো করে হাততালি দিতে লাগল, লজ্জায় গায়েবের মুখ লাল হয়ে উঠল। তখন এক পদাঘাতে সেই মাটির সিংহাসন চূর্ণ করে চড়-চাপড়ে ছোট ছেলেদের ফোলা গাল বেশি করে ফুলিয়ে, রাগে কাঁপতে-কাঁপতে গায়েব একেবারে দেবমন্দিরে উপস্থিত হলেন। সুভাগা গায়েবীর হাতে পিতলের একটি ছোট প্রদীপ দিয়ে কেমন করে সূর্যদেবের আরতি করতে হয় শিখিয়ে দিচ্ছিলেন; এমন সময় ঝড়ের মতো গায়েব এসে পিতলের প্রদীপটা কেড়ে নিয়ে টান মেরে ফেলে দিলেন। নীরেট পিতলের প্রদীপ পাথরের দেয়ালে লেগে ঝনঝন শব্দে চুরমার হয়ে গেল, সেই সঙ্গে সূর্যদেবের মূর্তি-আঁকা একখানা কালো পাথর সেই দেয়াল থেকে খসে পড়ল। সুভাগা বললেন—“আরে উন্মাদ কি করলি? সূর্যদেবের মঙ্গল-আরতি ছারখার করে দেবতার অপমান করলি?” গায়েব বললেন—“দেবতাও বুঝিনে, সূর্যও বুঝিনে; বল, আমি কার ছেলে? না হলে আজ তোমার সূর্যমূর্তি কুণ্ডের জলে ডুবিয়ে দেব।” যদিও সেই প্রকাণ্ড সূর্যমূর্তি ভীম এলেও তুলতে পারতেন না তবু গায়েবের বীরদর্প দেখে সুভাগার মনে হল—কি জানি কি করে! তিনি তাড়াতাড়ি গায়েবের দুটি হাত ধরে বললেন,—“বাছা শান্ত হ, স্থির হ, আর সূর্যদেবের অপমান করিসনে; পিতার নামে কি কাজ? আমি তোর মা আছি, গায়েবী তোর বোন, আর তোর কিসের অভাব?” গায়েব তখন কাঁদতে-কাঁদতে বললেন—“তবে কি মা, আমি নীচ, জঘন্য, অপবিত্র পথের ধুলো, ভিখারীর অধম?” কথাগুলো তীরের মতো সুভাগার বুকে বাজল,তিনি দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন; মনে-মনে ভাবলেন— হায় ভগবান, কি করলে? এ দুরন্ত ছেলেকে কেমন করে বোঝাই, কি বলে প্রবোধ দিই? গায়েব গায়েবী নীচ নয়, অপবিত্র নয়, সূর্যের সন্তান, সকলের চেয়ে পবিত্র, এ কথায় কে বিশ্বাস করবে?সুভাগার সূর্যমন্ত্রের কথা একবার স্মরণ হল, কিন্তু যখন ভাবলেন যে দুইবার মন্ত্র উচ্চারণ করলে নিশ্চয় মৃত্যু—এই কচি বয়সে গায়েব গায়েবীকে একা ফেলে পৃথিবী ছেড়ে চিরকালের মতো চলে যেতে হবে—তখন তাঁর মায়ের প্রাণ কেঁদে উঠল। সুভাগা বললেন—“বাছা কথা রাখ, ক্ষান্ত দে, চল আমরা অন্য দেশে চলে যাই,সূর্যদেবকেই তোদের পিতা বলে জেনে রাখ।” গায়েব ঘাড় নাড়লেন, বিশ্বাস হয় না। তখন সুভাগা বললেন—“তবে মন্দিরের সমস্ত দরজা বন্ধ কর, এখনি তোদের পিতাকে দেখতে পাবি, কিন্তু হায়, আমাকে আর ফিরে পাবি না।” সুভাগার দুই চক্ষে জল পড়তে লাগল। গায়েবী বললে—“ভাই, মাকে কেন কষ্ট দাও?” গায়েব উত্তর না দিয়ে মন্দিরের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিলেন। সুভাগা দুজনের হাত ধরে সূর্যমূর্তির সম্মুখে গিয়ে ধ্যানে বসলেন। এই মন্দিরে একাকিনী সুভাগা একদিন মৃত্যু ইচ্ছা করে যে মন্ত্র নির্ভয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, কালসর্পের মতো সেই সূর্যমন্ত্র আজ উচ্চারণ করতে তাঁর মায়ের প্রাণে কতই ভয়, কতই ব্যথা!সূর্যদেব দর্শন দিলেন—সমস্ত মন্দির যেন রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে প্রচণ্ড মূর্তিতে দর্শন দিলেন। সুভাগা বললেন—“প্রভু গায়েব গায়েবী কার সন্তান?” সূর্যদেব একটি কথা কইলেন না। দেখতে-দেখতে সূর্যের প্রচণ্ড তেজে ভিখারিনী সুভাগার সুন্দর শরীর জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেল।গায়েবী কেঁদে উঠল— “মা,মা!” গায়েব জিজ্ঞাসা করলেন—“মা কোথায়?” সূর্যদেব কোনোই উত্তর করলেন না, কেবল পাষাণের উপর রাশীকৃত ছাই দেখিয়ে দিলেন!গায়েব বুঝলেন মা আর নেই। রাগে দুঃখে তাঁর চোখে আগুন ছুটল। গায়েব মন্দিরের কোণ থেকে সূর্যমূর্তি-আঁকা সেই পাথরখানা কুড়িয়ে সূর্যদেবকে ছুঁড়ে মারলেন। যমরাজের মহিষের মাথাটার মতো সেই কালো পাথর সূর্যদেবের মুকুটে লেগে জ্বলন্ত কয়লার মতো একদিকে ঠিকরে পড়ল— সঙ্গে-সঙ্গে গায়েব মূর্ছিত হলেন।
অনেকক্ষণ পরে গায়েব জেগে উঠলেন, তখন সূর্যদেব অন্তর্ধান করেছেন, মাথার কাছে শুধু গায়েবী বসে আছে। গায়েব জিজ্ঞাসা করলেন— “সূর্যদেব কোথায়?” গায়েবী তখন সেই কালো পাথরখানা দেখিয়ে বললে—“ওই নাও ভাই আদিত্যশীলা। এই পাথর তুমি যার উপর ফেলবে তার নিশ্চয় মৃত্যু। সূর্যদেব এটি তোমায় দিয়ে গেছেন আর বলেছেন তুমি তাঁরই ছেলে, আজ থেকে তোমার নাম হল শিলাদিত্য। তোমার বংশ সূর্যবংশ নাম দিয়ে পৃথিবী শাসন করবে, আর তুমি মনে-মনে ডাকলেই ওই সূর্যকুণ্ড থেকে সাতটা ঘোড়ার পিঠে সূর্যের রথ তোমার জন্য উঠে আসবে!রথের নাম সপ্তাশ্বরথ! যাও ভাই, সপ্তাশ্বরথে আদিত্যশিলা হাতে পৃথিবী জয় করে এস।” গায়েব বললেন—“তোকে কোথা রেখে যাব বোন?” গায়েবী বলল—“ভাই আমাকে এই মন্দিরে বন্ধ রেখে যাও, আমি বাগানের ফল, কুণ্ডের জল খেয়ে জীবন কাটাব। তারপর তুমি যখন রাজা হবে, আমায় এই মন্দির থেকে রাজবাড়িতে নিয়ে যেও।”
গায়েব মহা আনন্দে গায়েবীকে সেই মন্দিরে বন্ধ রেখে সাত ঘোড়ার রথে পৃথিবী জয় করতে চলে গেলেন। আর গায়েবী সেই রাশীকৃত ছাই সূর্যকুণ্ডের জলে ঢেলে দিয়ে “মারে! ভাইরে!” বলে পাষাণের উপর আছাড় খেয়ে পড়ল।
সেদিন গভীর রাত্রে যখন আকাশে তারা ছিল না, পৃথিবীতে আলো ছিল না, সেই সময় হঠাৎ সূর্যমন্দির ঝনঝন শব্দে একবার কেঁপে উঠল। তারপর আশি-মণ কালো পাথরের প্রকাণ্ড সূর্যমূর্তিকে নিয়ে আর ননীর পুতুলের মতো সুন্দরী গায়েবীকে নিয়ে, আধখানা মন্দির ক্রমে মাটির নিচে চলে যেতে লাগল! গায়েবী প্রাণভয়ে পালাবার চেষ্টা করলে, পাথরের দেয়ালে পা রাখা যায় না—কাচের সমান। তখন গায়েবী “ভাইরে!” বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। তারপর সব শেষ, সব অন্ধকার।
কতদিন চলে গেছে, গায়েব সেই সপ্তাশ্বরথে পৃথিবী ঘুরে দেশবিদেশ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে রাজ্যের পরে রাজ্য জয় করে, শেষে বল্লভীপুরের রাজাকে সেই আদিত্যশিলা দিয়ে সম্মুখযুদ্ধে সংহার করে শিলাদিত্য নাম নিয়ে, রাজসিংহাসনে বসে, পাঠশালার সঙ্গীদের কাউকে মন্ত্রী, কাউকে বা সেনাপতি করে, যত নিষ্কর্মা বুড়ো কর্মচারীদের তাড়িয়ে দিলেন। তারপর হুলুধ্বনি শঙ্খধ্বনির মাঝখানে শিলাদিত্য চন্দ্রাবতী নগরের রাজকন্যা পুষ্পবতীকে বিয়ে করে, শ্বেতপাথরের শয়ন মন্দিরে বিশ্রাম করতে গেলেন। ক্রমে রাত্রি যখন গভীর হল, কোনো দিকে সাড়া শব্দ নেই, পায়ের ধারে চামরধারিণী চামর হাতে ঢুলে পড়েছে, মাথার শিয়রে সোনার প্রদীপ নিভ-নিভ হয়েছে, সেই সময় শিলাদিত্য তাঁর ছোট বোন গায়েবীর কচি মুখখানি স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর মনে হল যেন অনেক, অনেক দূর থেকে সেই মুখখানি তাঁর দিকে চেয়ে আছে; আর সেই সূর্যমন্দিরের দিক থেকে কে ডাকছে— “ভাইরে,ভাইরে,ভাইরে!”
শিলাদিত্য চীৎকার করে জেগে উঠলেন। তখন ভোর হয়েছে, তিনি তৎক্ষণাৎ রথে চড়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে সূর্যমন্দিরে উপস্থিত হলেন; দেখলেন ভীমের বর্ম-দুখানার মতো মন্দিরের দুখানা কপাট একেবারে বন্ধ— কতকালের লতাপাতা সেই মন্দিরের দুয়ার যেন লোহার শিকলে বেঁধে রেখেছে।শিলাদিত্য নিজের হাতে সেই লতাপাতা সরিয়ে মন্দিরের দুয়ার খুলে ফেললেন—দিনের আলো পেয়ে এক ঝাঁক বাদুড় ঝটাপট করে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। শিলাদিত্য মন্দিরে প্রবেশ করলেন; চেয়ে দেখলেন, যেখানে সূর্যদেবের মূর্তি ছিল, সেখানে প্রকাণ্ড একখানা অন্ধকার, কালো পর্দার মতো সমস্ত ঢেকে রেখেছে!শিলাদিত্য ডাকলেন— “গায়েবী!গায়েবী!কোথায় গায়েবী?” অন্ধকার থেকে উত্তর এল—“হায় গায়েবী! কোথা গায়েবী!” শিলাদিত্য মশাল আনতে হুকুম দিলেন; সেই মশালের আলোয় শিলাদিত্য দেখলেন— উত্তর-দিকটা শূন্য করে সূর্যমূর্তির সঙ্গে-সঙ্গে মন্দিরের আধখানা যেন পাতালে চলে গেছে; কেবল কালো পাথরের সাতটা ঘোড়ার মুণ্ডু বাসুকির ফণার মতো মাটির উপরে জেগে আছে। যে-ঘরে শিলাদিত্য গায়েবীর সঙ্গে খেলা করেছেন, যে-ঘরে সারাদিন খেলার পর দুটি ভাই-বোন গুর্জর দেশের গল্প শুনতে-শুনতে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়তেন, যেখানে দেবদারু গাছের মতো পিতলের সেই আরতি-প্রদীপ ছিল, সে সকল ঘরের চিহ্নমাত্র নেই।শিলাদিত্য সেই প্রকাণ্ড গহ্বরের মুখে দাঁড়িয়ে ডাকলেন— “গায়েবী! গায়েবী!” তাঁর সেই করুণ সুর, সেই অন্ধকার গহ্বরে ঘুরে-ফিরে ক্রমে দূর থেকে দূরে, পাতালের মুখে চলে গেল। গায়েব নিঃশ্বাস ফেলে রাজমন্দিরে ফিরে এলেন।
সেইদিন রাজ-আজ্ঞায় রাজ-কর্মকারেরা পুরু সোনার পাত দিয়ে সেই প্রকাণ্ড মন্দির আগাগোড়া মুড়ে দিতে লাগল। শিলাদিত্য সে-মন্দিরে আর অন্যমূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন না। সেই অন্ধকার গহ্বর থেকে সূর্যের ঘোড়াগুলি যেমন আধখানা জেগেছিল, তেমনি রইল। তারপর শিলাদিত্য পাহাড় কেটে শ্বেতপাথর আনিয়ে, সূর্যকুণ্ডের চারিদিক সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিলেন। যখনি কোনো যুদ্ধ উপস্থিত হয়,শিলাদিত্য সেই সূর্যকুণ্ডের তীরে সূর্যের উপাসনা করতেন; তখনি তাঁর জন্য সপ্তাশ্বরথ জল থেকে উঠে আসত। শেষে একজন বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রী যাকে তিনি সবচেয়ে বিশ্বাস করতেন, সবচেয়ে ভালবাসতেন, সে-ই তাঁর সর্বনাশ করলে। সেই মন্ত্রী ছাড়া পৃথিবীতে কেউ জানত না যে, শিলাদিত্যের জন্য সূর্যকুণ্ড থেকে সপ্তাশ্বরথ উঠে আসে।
সিন্ধুপারে শ্যামনগর থেকে পারদ নামে অসভ্য একদল যবন যখন বল্লভীপুর আক্রমণ করলে, তখন সেই বিশ্বাসঘাতক, তুচ্ছ পয়সার লোভে সেই অসভ্যদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে, গো-রক্তে সেই পবিত্র কুণ্ড অপবিত্র করলে। শিলাদিত্য যুদ্ধের দিন যখন সেই সূর্যকুণ্ডের তীরে সূর্যের উপাসনা করতে লাগলেন, তখন আগেকার মতো নীল জল ভেদ করে দেবরথ উঠে এল না; শিলাদিত্য সাতটা ঘোড়ার সাতটা নাম ধরে বার-বার ডাকলেন, কিন্তু হায়, কুণ্ডের জল যেমন স্থির তেমনি রইল! শিলাদিত্য হতাশ হয়ে রাজ-রথে শত্রুর সম্মুখে উপস্থিত হলেন,কিন্তু সেই যুদ্ধেই তাঁর প্রাণ গেল। সমস্ত দিন যুদ্ধের পর সূর্যদেবের সঙ্গে-সঙ্গে সূর্যের বরপুত্র শিলাদিত্য অস্ত গেলেন। বিধর্মী শত্রু সোনার মন্দির চূর্ণ করে বল্লভীপুর ছারখার করে চলে গেল।
< >