শিল্পশাস্ত্রের ক্রিয়াকান্ড
মানব-শিল্পের শৈশবটা কাটল মানুষের ঘরের এবং বাইরের খুব দরকারি কাজ করতে। পাথর ঘষে তীরের ফলা তৈরি করা, হাঁড়িকুঁড়ি গড়া, কাপড় বোনা, হাড়ের মালা গাঁথা, লোহার বালা গড়া, শীতের কম্বল বসবার আসন— এমনি নানা জিনিসের উপরে শিল্পের ছাপ পড়ল। নানা জিনিস প্রস্তুতের নানা প্রক্রিয়া আস্তে আস্তে দখল হয় মানুষের। মানুষ সভ্যতার দিকে যখন এগোল তখন কতক শিল্পকলা রইল ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে, কতক রইল রাজসভার সঙ্গে জড়িয়ে। প্রধানত এই দুই রাস্তা ধরে শিল্পের ক্রিয়াকাণ্ড চলল সব দেশেই। পুজোর জন্য যেসব মন্দির প্রতিমা ইত্যাদি তাদের প্রস্তুত করার নানা প্রকরণ এবং প্রাসাদ নির্মাণ, হাট বসানো, কুয়ো খোঁড়া ইত্যাদির নানা কথা সংগ্রহ হয়ে পণ্ডিতদের দ্বারা শিল্পশাস্ত্রে ধরা হল, নানা শিল্প বিষয়ে নানা কথা নানা অধ্যায়ে বিভক্ত হয়ে শাস্ত্রের মধ্যগত রইল— এই হল শিল্পশাস্ত্রের গঠনের মোটামুটি হিসেব। তারপর ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ এই চার শাস্ত্রের মধ্যে মধ্যে আনুষঙ্গিকভাবে নানা শিল্পকলার কথাও বলা হল এবং আংশিকভাবে নানা পুরাণেও প্রসঙ্গক্রমে শিল্পের এবং নানা কলাবিদ্যার কথা লেখা রইল।
শিল্পশাস্ত্রের মূল গ্রন্থসব যা ছিল বলেই শুনি, সেইসব প্রাচীন শাস্ত্রের সারসংগ্রহ বলে যেসব পুঁথি নানা কালে এ-দেবতা ও-ঋষি বা অমুক তমুকের কথিত বলে লেখা হল— রাজরাজড়ার পুস্তকাগারে ধরার জন্য সেইগুলোই কতক কতক এখন পাওয়া যাচ্ছে। তা থেকে দেখা যায় যে, ধর্মের সেবায় শিল্পের যেসব দিক জড়িয়ে ছিল তারি বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ হল কিন্তু অন্যান্য কলা যা শৌখিন রাজরাজড়ার সেবায় লাগত তাদের বিস্তারিত বিবরণ লেখাই গেল না। পূজার প্রতিমা কেমন করে করতে হবে তার ঠিকঠাক নিয়ম লক্ষণ সমস্তই পাই, কিন্তু কাপড়-চোপড় নানা গন্ধতৈল নানা মূল্যবান তৈজসপত্র এদের প্রস্তুতের প্রকরণ শিল্পশাস্ত্রে দেখি ক্কচিৎ ধরা হল। এ ধরনের সামগ্রীর মধ্যে এক বজ্রপ্রলেপের কথা লেখা আছে দেখি সব শিল্পশাস্ত্রে, কিন্তু বজ্রমণির বেলায় তার ধারণের কি ণ্ডণাণ্ডণ তার বর্ণ ও মূল্যাদির হিসেব হল ধরা কিন্তু বজ্রমণিটা বিদ্ধ করা যায় কি প্রক্রিয়ায় এবং কত রকম গহনা হয়, কত নাম তাদের,— এসব কিছু নেই শিল্পশাস্ত্রের মধ্যে। প্রতিমা-লক্ষণ, প্রাসাদ-নির্মাণ, কূপ-খনন, ইত্যাদি-ইত্যাদি নানা কথা শিল্পশাস্ত্রে যেমন নানা অধ্যায়ে ভাগ করে লেখা রইল, তেমন করে ভূষণশিল্প যেটা একটা খুব বড় আর্ট প্রাচ্য জগতের— তার হিসেব ধরা দরকারি বোধ হল না।
এই যে সমস্ত শৌখিন শিল্প, তার উদ্ভাবনা ও গঠনের প্রক্রিয়া সমস্ত শিল্পীদের ঘরে অলিখিত অবস্থায় পিতা থেকে পুত্রে অর্সাতে চলল। এইসব বিচিত্র শিল্পের নানা আদর্শ বর্তমান রইল কিন্তু তাদের প্রস্তুতকরণের প্রক্রিয়া সমস্ত কত যে লোপ পেয়ে গেল তার ঠিক নেই। এই কারনে বলতেই হয় আমাদের শিল্পশাস্ত্র, শিল্পশাস্ত্র বলতে যা বোঝায় তা নয়, তাতে অঙ্গবিদ্যা হিসেবে আংশিকভাবে প্রসঙ্গক্রমে কোনো কোনো কলাবিদ্যার কথা বলা হয়েছে, ভারত-শিল্পের প্রায় সাড়ে-পনেরো আনা অংশের কথাই পাড়া হয়নি তাতে। এখন ধর্মের সঙ্গে শিল্পের আগেকার যোগ বিচ্ছিন্ন হতেই চলল, শিল্পের যে অনাদৃত দিক বিচিত্র দিক যা নিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা সুন্দর হয়ে উঠল মধুময় হয়ে উঠল সেই দিকে মানুষের নজর পড়ল; ঘরের শিল্প আবার ঘরেই ফিরেছে পরের কাজ চুকিয়ে।
শিল্পকে ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে না দেখে শিল্পের দিক দিয়ে দেখা খুব অল্পদিন হল ইউরোপে চলিত হয়েছে। প্রাচীনকালেও ভারতবর্ষে এইভাবে শিল্পরসের দিক দিয়ে কলা সমস্তকে দেখা আলঙ্কারিকগণ প্রচলিত করে গেছেন। শুধু কাব্যকলার সঙ্গে জড়িয়ে রাখলে অলঙ্কারশাস্ত্র রসশাস্ত্র ইত্যাদি খুব কাজে আসবে না, অলঙ্কারশাস্ত্রের বিচারপ্রণালী ধরে শিল্পবিদ্যা বুঝতে চললে ঢের বেশি ফল পাব আমরা। শিল্পের পুরাতত্ত্ব হিসেবে শিল্পশাস্ত্র কাজে লাগবে, প্রাচীনের সঙ্গে শিল্পশাস্ত্রের দিক দিয়ে এখনকার শিল্পীদের আংশিকভাবে যোগ ছাড়া বেশি কিছু হবে না; আমরা হাজার বছর আগে কত বড় শিল্পী ছিলেম এই ভাবের একটা ভুয়ো গর্বও লাভ হতে পারে— কিন্তু সে শুধু পড়ে-যাওয়া বিদ্যা হবে শিল্পবোধ তাতে হবে না। রসের ও ভাবের প্রক্রিয়া ধরে কবিতা ছবি মূর্তি এমনকি খেলনাটারও পরিচয় হল ঠিক পরিচয়। বিদেশীয় রসিকেরা এই পথে কাজ করে চলেছেন অনেকেই।
শিল্পী ও শিল্পরসিক কেমন করে হয় তা ঠিক করে বলা কঠিন। হঠাৎ দেখি কেউ রস পেয়ে গেল কেউ বা সারা বছর অলঙ্কার শাস্ত্র পড়ে পড়ে চোখই ক্ষরিয়ে ফেলল। কবি কেমন করে হয় কাব্যপ্রকাশে লেখা আছে দু চরণ শ্লোকে। কলাশাস্ত্রের গোড়ায় ঠিক এই কথা লেখা হলে মানায়— পড়ে পাই বিদ্যা, না-পড়ে পাই কলাবিদ্যা। কিন্তু না পড়ে পেলেও কলাবিদ্যাকে পড়ে পাওয়া শক্ত। হাতে-কলমে কাজ করা হল শিল্পের নানা প্রকরণ, সহজে দখল করার সহজ উপায়। রঙ রেখা এদের টেনে দেখলে এদের রহস্য সহজ হয়ে আসে।
পড়ার দ্বারা নয় ক্রিয়ার দ্বারা শিল্পকর্মে দক্ষতা হয় যদি এই কথাই হল তবে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা পড়াশুনো করছে না অথচ artistও হয়ে উঠছে না। তারা কেউ চাষা হচ্ছে কেউ দোকানি-পসারি মুটে-মজুর হচ্ছে। অবশ্য এদের অনেকের কাজই শিল্পশাস্ত্রের চৌষট্টি কলার কোনোটা-না-কোনোটার মধ্যে পড়ে যায়, কিন্তু হলে কি হয় ! আমরা নিজেদের সব দিক দিয়ে যতই cultured বোধ করি না কেন চাষাকে artist ভাবা মজুরকে artist বলা শক্ত হয়েছে; যারা গাধাবোট টেনেই চলেছে তাদের কেউ এখন artist বলে না কিন্তু যে ছেলেরা বাচ খেলায় মজবুত হল তাদের বলি artist!
আজকে আমাদের পক্ষে ‘philosopher জ্ঞানী লোক, cultivator চাষা’, এবং artist তারাই যারা নিত্য জীবনযাত্রার থেকে স্বতন্ত্র অতিরিক্ত কিছু নিয়ে রয়েছে। আগে কিন্তু এ ভাবটা ছিল না, তখন শহরের লোক দেখি চোরের সিঁদ কাটার নানা কায়দা দেখে পুলিস ডাকার কথা ভুলে ফুটো দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন সিঁদটা কাটা হয়েছে এই নিয়ে art lecture আরম্ভ করে দিয়েছে। হয়তো বা চোর সে নিজের কাটা সিঁদের বাহার দেখে খুশিতে রয়েছে এমন সময় পুলিস এসে প্রেপ্তার করলে artistকে। বর্ষাকালে দেখি ক্ষেতের দিকে চেয়ে চাষার গান চলল--
“গগন ঘটা ঘহরাণী সধো
গগন ঘটা ঘহরাণী
পূরব দিস্সে উঠিহৈ বদরিয়া
রিম ঝিম বরষত পানী।
আপন আপন মেড়ঁ সম্হারো
বহ্যো জাত য়হ পানী সুরত নিরত কা বেল নহায়ন
করৈ খেত নির্বাণী।”
—কবীর
ঘনঘটা ঘটিয়ে এল পুবে বাদল উঠল রিমঝিম বরিষ নামল, সামাল ভাই ক্ষেতের আল, ঐযে জল বয়ে চলল। দুটি লতা-অনুরাগের বিরাগের— তাদের আজ এই রসের বৃষ্টিধারায় ভিজিয়ে নাও, এমন ক্ষেত লাগাও যেখানে অবাধ মুক্তির ফসল ফলে, ক্ষেতের ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারে, তাকেই তো বলি কুশল কিষাণ।
সেকালে তাঁরা art কিসে নেই বা কিসে আছে এটা সুনিশ্চিত করে দিতে অথবা নানা রকম কলাবিদ্যার সংখ্যা নির্ধারণ করে চৌষট্টির মধ্যেই artকে ধরে রাখতে চাননি; এইজন্যই শাস্ত্রে বলা হল:
“বিদ্যা হ্যনন্তাশ্চ কলাঃ সংখ্যাতুং নৈব শক্যতে।
বিদ্যা মুখ্যাশ্চ দাত্রিংশচ্চতুঃষষ্টিঃ কলাঃ স্মৃতাঃ।।” (শুক্রনীতিসার)(১)
এইভাবে বিদ্যা এবং কলা দুয়ের প্রভেদটা মাত্র মোটামুটি রকমে শাস্ত্রে ধরা হল:
“যদ্যত্ স্যাদ্ বাচিকং সম্যক্ কর্ম্মবিদ্যাভিসংজ্ঞকম্।
শক্তে মূকোহপি যৎ কর্ত্তুং কলাসংজ্ঞন্তু তৎস্মৃতম্।।” (শুক্রনীতিসার)(২)
আমরা এখন artকে finr, industrial— নানাভাগে ভাগ করে নিয়েছি। আগেও এইরকম ভাগ ছিল শিল্পে— কর্মাশ্রয়া দ্যুতাশ্রয়া উপচারিকা ইত্যাদি হিসেব। সেকালের চৌষট্টি কলার ফর্দটার মধ্যে যাকে বলি fine art, যাকে বলি industrial art এবং যাকে বলি science, সবই এক কোঠায় রাখা গেছে। সেকালের হিসেবে ধরলে আজকালের Football, Billiards ইত্যাদি খেলা art-এর মধ্যে এসে পড়ে; সন্তানপালন একটা art-এর মধ্যে ছিল আগে, এখন ওটা আমরা medical science-এর মধ্যে ফেলে দিয়েছি। এমনকি ছেলেদের খেলার পুতুল গড়া ও কেষ্টনগরের পুতুল গড়া এবং গড়ের মাঠের ধাতুমূর্তি গড়া— তিনটেকে সম্পূর্ণ আলাদা জাতের শিল্প বলে ধরে নিয়েছি। মানুষের উন্নত ও সুন্দর এবং সুকুমার বৃত্তিসমূহ যে শিল্পকাজের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয় তাকে বলি fine art, মানুষের প্রতিদিনের জীবনের নানা সাজসরঞ্জাম যাতে করে শুধু কাজের নয় সঙ্গে সঙ্গে সুদর্শন হয়ে ওঠে তাকে বলি industrial art; এমনি art-এর মোটমাট জাতিবিভাগ সৃষ্টি হয়ে গেছে মানুষের নিজের মধ্যে সমাজবন্ধনের সময়ে নানা বর্ণবিভাগের প্রথায়; artistদের কাছে কিন্তু এরকম একটা বিভাগ নিয়ে art-এর উপভোগের তারতম্য ধরা একেবারেই নেই, সেখানে আর্ট এক কোঠায় না- art অন্য কোঠায়, ইতর বিশেষ, মাঝামাঝি, চলনসই— এসব কথা নেই, art কি art নয় এই বিচার।
শিল্পশাস্ত্র আমাদের যা রয়েছে তাতে ভাস্কর্যের একটা দিক, স্হাপত্যের খানিকটা— যেটা পূজন ও যজন-যাজনের সঙ্গে জোড়া, তারি উপরে বিশেষভাবে মতামতের জোর দেওয়া হয়েছে দেখা যায়। তাছাড়া এটাও দেখি যে শিল্পশাস্ত্রের সংগ্রহকার্যে ভারি একটা ত্বরা রয়েছে— কোনো রকমে একটা প্রাচীনত্বের ছাপ মেরে জিনিসটাকে সাধারণে প্রচার করার ত্বরা— একটা ধর্মবিপ্লবে এবং সেই সময়ের ত্বরা— শিল্পকে নিয়ে টানাটানি এসবই লক্ষ্য করি শিল্পশাস্ত্রের সংগ্রহের ধরন থেকে।
Art-এর মধ্যে একটা অনির্বচনীয়তা আছে যেটা artist-এর অনুভূতির বিষয় এবং অসাধারণ বলেই art-এর অনির্বচনীয় রস যে কি ব্যাপার তা সবাইকে বুঝিয়ে ওঠা কঠিন। রস পেলে তো পেলে, না পেলে তো পেলে না, এসব কথা শিল্পশাস্ত্রকার বিচার করবার সময় পাননি, এসব চিন্তা আলঙ্কারিকদের, রসের দিক দিয়ে তারা বিচার করে দেখেন যে সেদিক দিয়ে এতটুকু বা এত বড় নেই সরস বা নীরস নিয়ে কথা। মাটির খেলনা সরস হল তো মগধের নাড়ুর চেয়ে বড়জিনিস হল এবং মগধ উড়িষ্যা সব শিল্পের বড় বড় ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ ও গণেশের সমতুল্য হয়ে উঠল একটি সুন্দর আরতি-প্রদীপ। আর্টের জগৎ শিল্প কি শিল্প নয় এই নিয়ে,— উচ্চ-নীচ ভাল-মন্দ ভেদাভেদ, দেবতা কি মানুষ কি বানর এ নিয়ে দেখা নয়,— art কি art নয় এই নিয়ে সব জিনিসকে পরীক্ষা করা হল অকাট্য নিয়ম। Art for art এই কথাই হল artist-এর, art ধর্মের জন্য কি জাতীয় গৌরবের ধ্বজা সাজাবার জন্য কি nature-এর সম্মুখে mirror ধরার জন্য অথবা বিপশ্চিতাম্ মতম্-কে বলবৎ রাখার জন্য, এ তর্ক art-এর জগতে উঠতেই পারে না।
Artist যে উদ্দেশ্যেই কাজ করুক আর্টের দিকে চেয়ে করাই হল তার প্রধান কাজ। ময়ূর নিজের আনন্দে তার চিত্র-বিচিত্র কলাপ বিস্তার করে, বাগানের শোভা কি বনের শোভা কি খাঁচার শোভা তাতে হল কি না-হল ময়ূরের মনে একথা উদয়ও হল না; এতটা স্বাধীনতা মানুষ শিল্পে চায় কিন্তু পেলে কই?— ধর্ম বললে তুমি আমার কাজে লাগো, দেশ বললে আমার, এমনি নানা দিক দিয়ে শিকল পড়ে গেল শিল্পের হাতে পায়ে, তারপর একদিন চিরকালের ছাড়া পাখি তার মনিবের পোয মানলে, ইশারাতে পুচ্ছ ওঠালে নামালে যে শুধু তাই নয়, জলযন্ত্র ঘোরালে ঘটিযন্ত্র চালালে কামান দাগলে নিয়মমতো! “ অপি শ্রেয়স্করং নৃণাম্ দেববিম্বমলক্ষণম্।
সলক্ষণং মর্ত্ত্যবিম্বম্ নহি শ্রেয়স্করং সদা।।”
এই হুকুমে এককালে আমাদের শিল্পীরা বাঁধা পড়ে ছিল। পুঁথিকার দেবতা সমস্তের ধ্যান দিলে শিল্পে, সেই ধ্যান মতো গড়ে চলল— এই ঘটনাই যদি পুরোপুরি ঘটতো তবে আমাদের art আর্ট কেবলমাত্র ধ্যানমালার illustration হয়ে যেত কিন্তু এর চেয়ে যে বড় জিনিস হয়ে উঠল বুদ্ধ নটরাজ প্রভৃতি নানা দেবমূর্তি সেটা ধ্যানমালার লিখিত ধ্যানের অতিরিক্ত এবং শিল্পশাস্ত্রের মান-পরিমাণ লক্ষণাদির বাঁধা নিয়মের থেকে স্বতন্ত্র আর-কিছু নিয়ে। প্রাচীন দেবমূর্তিগুলি আমাদের বাঙলার কার্তিকের মতো সম্পূর্ণ কাপ্তেনবাবু বা কলে কাটাছাঁটা মরা জিনিস হয়ে পড়েনি শুধু শিল্পের শিল্পক্রিয়া তাদের অমরত্ত্ব দিলে বলে এবং শুধু সেইটুকুর জন্য art-এর জগতে এইসব দেবতার স্থান হল।
শাস্ত্র বললে শিল্পকে ঘাড়ে ধরে, দেবলোকটাই আছে তোমার কাছে, মর্ত্যলোক নেই, যদি বা থাকে তো সেদিকে দৃকপাত করবে না— তাহলে অন্ধ হবে। কিন্তু artist-এর পথ স্বতন্ত্র কেননা art সে অনন্যপরতন্ত্রা, শিল্পীর কাছে দেবলোকের স্বপ্ন সেও যেমন প্রত্যক্ষ ও সুন্দর, মর্ত্যলোকের ছবি সেও তেমনি অভাবনীয় সুন্দর ও প্রত্যক্ষ ব্যাপার, দুটোই তুল্যমূল্য, যদি art হল এবং রসের স্বাদ দিলে। শাস্ত্রী চাইলেন মর্ত্যকে ছেড়ে শাস্ত্রীয় স্বর্গ, ইহলোককে মুছে দিয়ে পুঁথির পরলোক। কিন্তু শিল্পীর শিল্পবৃত্তি তাকে অন্য পথ দেখালে; মর্ত্যলোকের মাটির দেহে সবখানি সুন্দর হতে সুন্দরতর হয়ে উঠল, শাস্ত্র যে সৃষ্টিছাড়া কান্ড চেয়েছিল তা হতেই পারলে না, অনেকখানি সৃষ্টিরহস্য শিল্পীর মনে ক্রিয়া করে পাগলামির অনাসৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে দিলে এ দেশের প্রতিমাশিল্পকে। শিল্পশাস্ত্রের দেবলোক ও তার অধিবাসী তাঁরা একেবারেই তেত্রিশ কোটি গন্ডীর মধ্যে ঘেরা, নিখুঁত মান-পরিমাণ লক্ষণ দিয়ে সম্পূর্ণভাবে বাঁধা শাস্ত্রীয় দেবলোক ও দেবতা হওয়া ছাড়া সেখানে উপায় নেই, শিল্পীর মনের দেবতা এবং শাস্ত্রের দেবলোকের সঙ্গে শিল্পীর শিল্পলোকের কল্পনায় তফাত থাকতে পারে এইভয় করেই শাস্ত্রকার কষে বেঁধেছেন আপনার নিয়ম জায়গায় জায়গায়— “নান্যেন মার্গেণ প্রত্যক্ষেণাপি বা খলু”; পূজার জন্য যে প্রতিমাতা শাস্ত্রমতো না গড়লে তো চলে না সুতরাং শিল্পীর ওপরে কড়া হুকুম জারি করতেই হল নানা ভয় দিয়ে— “হীনাঙ্গী স্বামিনং হন্তি হ্যধিকাঙ্গীচ শিল্পিনম্।” একচুল এদিক ওদিক হলে একেবারে মৃত্যুদন্ড; বেতের ভয় নয়— “কৃশা দুর্ভিক্ষদা নিত্যং স্থূলা রোগপ্রদা সদা”, অন্ধতা বংশলোপ ইত্যাদি নানা ভয় দিয়ে শিল্পীকে ও শাস্ত্রীয় মূর্তিকে কঠিন নিয়মে বাঁধার চেষ্টা হল, কিন্তু এতে যে কাজ ঠিক চলল তা নয়, এদিক ওদিক হতেই থাকল মাপজোখ ইত্যাদিতে, শিল্পী মানুষ তো কল নয়, সে ক্রিয়াশীল ক্রীড়াশীল দুই-ই, সুতরাং একটু ঢিলে দিতে হল নিয়মের কষনে।
“লেখ্যা লেপ্যা সৈকতী চ মৃন্ময়ী পৈষ্টিকী তথা।
এতাসাং লক্ষণাভাবে ন কশ্চিৎ দোষ ঈরিতঃ ।।
বাণলিঙ্গে স্বয়ম্ভূতে চন্দ্রকান্তসমুদ্ভবে।
রত্নজে গন্ডকোদ্ভূতে মানদোষো ন সর্ব্বথা।।”(৩)
ছবি modeling, plaster cast এমনি অনেক জিনিস এবং স্ফটিক ও নানা রত্নভূষা এবং ছোটখাটো শিল্পদ্রব্য সমস্তই বাঁধনের বাইরে পড়ল, কেবল পাষাণ ও ধাতুজ পূজার জন্য যে মূর্তি রইল শাস্ত্রের মধ্যে বাঁধা কিন্তু এখানেও গোল বাধল ঠিক ঠিক শাস্ত্রমতো গড়ন কে জানে কেন শিল্পীর হাতে এল না, এদিক ওদিক হতেই থাকল কিছু কিছু--
দেশভেদে কালভেদে শিল্পীর কল্পনাভেদে পূজকের অন্তর্দৃষ্টিভেদে, তখন সম্পূর্ণ ছাড়পত্র
দেওয়া হল--
“প্রতিমায়াশ্চ যে দোষা হ্যর্চ্চকস্য তপোবলাৎ।
সর্ব্বত্রেশ্বরচিত্তস্য নাশং যান্তি ক্ষণাৎ কিল।।”(৪)
এই ফাঁক পেয়ে দেশের শিল্প হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, বিচিত্র হয়ে উঠল ম্নদিরে মঠে।
সেকালে শাস্ত্রের নিয়মমতো গড়ার যেসব ব্যাঘাত পরে পরে এসেছিল, একালেও যদি শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসনে আমরা শিল্পীদের বাঁধতে চলি তবে ঠিক সেকালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতেই হবে। অনেকে বলেন ইতিহাসের না হয় পুনরাবৃত্তি হলই, তাতে করে যদি তখনকার art ফিরে পাই তো মন্দকি। এ হবার জো নেই, যা গেছে তা আর ফেরে না; তার নকল হতে পারে, ছোট ছেলে ঠাকুরদাদার হুবহু নকল দেখিয়ে চললে যেমন হাস্যকর অশোভন ব্যাপার হয় তাই হবে, গোলদীঘির অজন্তা-বিহার হবে, গড়ের মাঠের খেলনা তাজমহল হবে। কুঁড়েঘর আর বদলাল না কেননা সে এমন সুন্দর করে সৃষ্টি করা যে তখনো যেমন এখনো তেমনি তাতে স্বচ্ছন্দে বাস চলল। কিন্তু সেকালের প্রাসাদে একালে আমাদের বাস অসম্ভব, আলো বাতাস বিনা হাঁপিয়ে মারা যাব পাথর চাপা পড়ে। পুরাকালে আমাদের যাঁরা শিল্প ও শিল্পরসিক ছিলেন তাঁরা ক্ষুদ্রচেতা ছিলেন না। তাঁরা নিয়ম করতেন নিয়ম ভাঙতেন তাঁদের মধ্যে শিল্পী ও শিল্প দুই ছিল, কাজেই তাঁদের ভয় ছিল না। এখন আমাদের সেই সেকালের কোনো কিছুতে একটু-আধটুও অদল-বদল করতে ভয় হয় কেননা নিজের বলে আমাদের কিছুই নেই, সেকালের উপরে আগাছার মতো আমরা ঝুলছি মাত্র, সেকালই আমাদের সর্বস্ব! কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এক আফ্রিকার মূর্তিশিল্প যেমন ছিল তেমনি নিষ্ক্রিয় অবস্থাতেই আছে, সেকালকে সে ছাড়াতে একেবারেই পারেনি।
সেকাল ছেড়ে কোনো শিল্প নেই এটা ঠিক, কিন্তু একাল ছেড়েও কোনো শিল্প থাকতে পারে না বেঁচে এটা একেবারেই ঠিক। গাছের আগাছা নতুন মুকুল গাছের গোড়ায় অতীতের অন্ধকারে তার প্রথম বীজটির সঙ্গে যেভাবে যুক্ত রয়েছে সেভাবে থাকাই হল ঠিকভাবে থাকা; আমের নতুন মঞ্জরীর সঙ্গে পুরাতন বীজটার চেহারার সাদৃশ্য মোটেই নেই কিন্তু মঞ্জরীর গর্ভে লুকানো রয়েছে সেই পুরাতন বীজ যার মধ্যে সেই একই ক্রিয়া একই শক্তি ধরা রয়েছে, নতুন আবহাওয়াতেও যেটা ঠিকঠাক আমগাছই প্রসব করবে বর্তমানকালে; এই স্বাভাবিক গতি ধরে চলেছে শিল্প, এর উল্টো-পাল্টা হবার জো নেই।
আমাদের দেশের শিল্পমূর্তিকে যে কারণেই হোক এই স্বাভাবিক গতি থেকে বঞ্চিত করে দেওয়া হল এক সময়ে, দেবমূর্তির বাহুল্যের চাপন পেয়ে কিছুদিন গাছ আমাদের মনোমতো পথ ধরে প্রায় কল্পতরু হবার জোগাড় করলে। কিন্তু কালের নিয়মে হঠাৎ পশ্চিমের হাওয়া বইল চাপন পাথর একটুখানি নড়ে গেল, অমনি গাছ আবার স্বাভাবিক রাস্তা ধরে মন্দিরের ছাদ তুলসীমঞ্চের গাঁথনি ফাটিয়ে নানা দিকে আলো বাতাস চেয়ে গতিবিধি শুরু করলে, পশ্চিমে ঝুঁকল কতক ডাল, পুবে বাড়ল কতক ডাল, এইভাবে আলো বাতাসের গতি ধরে বেড়ে চলল গাছ। শুধু ভারতবর্ষ নয়, সব দেশ এইভাবে শিল্পের দিকে বেড়ে চলেছ। মঞ্চে বাঁধা গাছ দেখতে মন্দ নয় কিন্তু দিকে বিদিকে নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে যে বনস্পতি তার মতো সে শক্তিমানও নয় ছায়াশীলও নয় সুন্দরও নয়। আমাদের প্রাচীন শিল্প ও শাস্ত্র সমস্তই বোধিবৃক্ষের কলমের চারার সঙ্গে সোনার গামলায় নীত হয়েছিল দেশ থেকে বিদেশে, কিন্তু সেইসব যবন দেশের হাওয়া আলো নিয়ে তাদের বেড়ে উঠতে অনেকখানি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, ভিক্ষু শিল্পীদের দ্বারা সহজ গতি ব্যাহত হয়নি; তবেই তো এককালের ভারতীয় উপনিবেশের অভারতীয় অন্তরের মধ্যে চলে গিয়েছিল ভারতীয় ভাব ও রস। ভারত-শিল্প যদি কেবলই টবের গাছ হত তো কোনকালে সেটা মরে যেত ঠিক নেই, খালি টব থাকত আর তাতে সিঁদুর দিয়ে পুজো লাগাত দেখতেম আজও পুত্রকামনায় নিষ্ক্রিয় দেশের শিল্পহীন অপুত্রক হতভাগারা।
সেকালের শাস্ত্রমতো ক্রিয়া করে চললে এখনো আমরা সেকালের মতোই সব দিকে বিস্তার লাভ করতে পারি, কিন্তু একালকে বাদ দিয়ে ক্রিয়া করা চলবে না কেননা বর্তমানকাল এবং বর্তমানের উপযোগী অনুপযোগী ক্রিয়া বলে কতকগুলো পদার্থ রয়েছে যেগুলোকে মেনে চলতেই হবে আমাদের, না হলে সেকালটা ভূতের উপদ্রব ছাড়া আর কিছুই দেবে না আমাদের এবং তাবৎ শিল্পজগতের অধিবাসীকে। দাশরথি রায়ের পাঁচালী আমরা অনেকেই পড়ি কতক কতক ভালও লাগে কিন্তু পাঁচালীর ছাঁদে যদি কবিতা ঢালাই করার কড়া আইন করে দেওয়া যায় হঠাৎ তবে বর্তমানের কোনো কবি তাতে ঘাড় পাতবে না, কিংবা আমি যদি আজ বলি আমার ছাঁদেই বাঙলার চিত্রকর যারা এসেছে ও আসছে তাদের ছবি লিখতে হবে এবং গভর্নমেন্টের সাহায্যে এটা হঠাৎ একটা আইনে পরিণত করে নিই তবে কেউ সাটা মানবে না, উল্টে বরং শিল্পীর স্বাধীনতা বিষম ব্যাঘাত দেওয়া হল বলে আমাকে শুদ্ধ তোপে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবে। আমাদের শিল্পশাস্ত্রকারদের কড়া মাস্টার এবং পাহাড়াওলা হিসেবে দেখলে সত্যই আমাদের সেকালের প্রতি অবিচার করা হবে। পূর্বেকার তাঁরা তখনকার কালে যা উপযোগী বা নিয়ম তারই কথা ভেবে গেছেন, একালের আমাদের কি করা না-করা, শাস্ত্রের কোন আইন মানা না-মানা সমস্তই একালের উপরে ছেড়ে দিয়ে গেছেন তাঁরা, শাস্ত্রকে অস্ত্রের মতো একালের উপরে নিক্ষেপ করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত করে যাননি!
তখনকার তাঁরা নানা শিল্পের রীতিনীতি ক্রিয়াকলাপ সংগ্রহ করে গেছেন নানা শাস্ত্রের আকারে--
“স্বয়ম্ভূর্ভগবান্ লোকহিতার্থং সংগ্রহেণ বৈ,
তৎসারন্তু বশিষ্ঠাদ্যৈরস্মাভির্বৃদ্ধিহেতবে।।” (শুক্রনীতিসার) (৫)
শুক্রাচার্য কেন যে নানা শিল্প নানা সামাজিক রীতিনীতি সংগ্রহ করে শুক্রনীতিসার বলে পুঁথিখানা লিখলেন তা নিজেই বলে গেলেন--
“অল্পায়ুর্ভূভৃদাদ্যর্থং সংক্ষিপ্তং তর্কবিস্তৃতম্
ক্রিয়ৈকদেশবোধিনি শাস্ত্রাণ্যন্যানি সন্তি হি।
সর্ব্বোপজীবকং লোকস্থিতিকৃন্নীতিশাস্ত্রকম্
ধর্ম্মার্থকামমূলং হি স্মৃতং মোক্ষপ্রদং যতঃ।।” (৬)
মুক্তি দেবার জন্য শাস্ত্র, অল্পের মধ্যে অল্পায়ুধকে অনেকখানি বোঝাবার জন্য শাস্ত্র, রক্ষার জন্য শাস্ত্র,— হননের জন্য নয়!
পৃথিবীর সেকালের ভিত্তির উপরে একালের প্রতিষ্ঠা হল স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠা, সেকাল একালের ঘাড় চেপে পড়ল— বাড়ির ভিত উঠে এল ছাতের উপরে, এ বড় বিষম প্রতিষ্ঠা! সেকালের বাস্তুশিল্প হিসেবেও এটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা তার মালমশলার জন্য সম্পূর্ণভাবে সেকালের উপর নির্ভর করে চলতে বাধ্য— নতুন প্রথায় কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব চর্চা চলল। শিল্পও তেমনি সেকাল, একাল ও ভবিষ্যকালের যোগাযোগে বর্ধিত হয়ে চলল, কোনোভএককালের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে তাকে ধরে রাখবার উপায় রইল না। প্রাচীন ভারতের শিল্প শুধু নয়— তখনকার আচার-ব্যবহার সমুদয় কি ছিল কেমন ছিল তা প্রাচীন পুঁথির মধ্যে ধরা রইল বলেই শাস্ত্র পুরাণ ইত্যাদি পড়া। কিন্তু পড়ে জানা হল একরকম শিল্পকে না জানাই। অজন্তা চিত্র কেমন এবং তার বর্ণ দেবার লাইন টানার মাপজোখের হিসেবের ফর্দ পড়ে গেলে ছবিটা দেখার কাজ হয় না। প্রাচীন ভারতের শিল্পের যে দিকটা প্রত্যক্ষ হচ্ছে বর্তমানে— মন্দির মঠ মূর্তি ছবি কাপড়-চোপড় তৈজসপত্র ইত্যাদিতে তা থেকেই বেশি শিক্ষা পায় শিল্পী। এ হিসেবে একটা প্রাচীন মূর্তির ফটোগ্রাফও বেশি কাজের হল শিল্পকে বোঝাতে, আসল মূর্তিটা চোখে দেখলে তো কথাই নেই। ব্রজমন্ডলে কি কি আছে ও ছিল, সেটা ব্রজপরিক্রমা পড়ে গেলেও ব্রজমন্ডল দেখা হল না, জানা হল না— যতক্ষণ না তার ফটো দেখছি বা সেখানে তীর্থ দর্শনে যাচ্ছি। না-দেখা ব্রজভূমি যেটা সম্পূর্ণ কল্পনার জিনিস তার মূল্য বড় কম নয়--
Art-এর দিক দিয়ে। কিন্তু শাস্ত্র মতো ব্রজভূমির একটা বর্ণনা বা symbol দুখানা হরি চরণ যদি হয়, তবে সেটা দেখে কি বুঝব ব্রজের শোভা? নিছক প্রতীক নিয়ে তন্ত্রসাধনা চলে,— শিল্পসাধনা তার চেয়ে বেশি কিছু চায়। সাধকের হিতার্থ শাস্ত্রমতো রূপকল্পনা হল অরূপের, যখন তখন একখন্ড শিলা একটা যন্ত্র হলেই কাজ চলে গেল। কিন্তু শিল্প এমন নিছক প্রতীকমাত্র হয়ে বর্তে থাকতে পারেনা। অনেকখানি চোখের দেখার মধ্যে না ধরলে দেবতাকে দেখানোই সম্ভব হয় না। অথচ দেবতাকে মনুষ্যত্বের কিছু বাহুল্য না দিলেও চলে না। এই কারণে নানা মূর্তির নানা মুদ্রা হাত মাথা ইত্যাদির প্রাচুর্য দরকার হয়ে পড়ল। শিল্পশাস্ত্র নিঁখুত করে তার হিসেব দিলেন। কিন্তু এতেও পাথর দেবতা হয়ে না উঠে মনুষ্যেতর কিছু হবার ভয় গেল না,— তখন শিল্পীর শিল্পজ্ঞান যেটা তাঁর নিজস্ব, তার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় রইল না।
এই যে শিল্পজ্ঞান, এ কোথা থেকে আসে শিল্পীর মধ্যে তা কে জানে? তবে শুধু শাস্ত্রকে মেনে চলে কিংবা শাস্ত্র পড়ে সেটা আসে না এটা ঠিক। এইখানে শিল্পীর প্রতিভাকে স্বীকার করা ছাড়া উপায় রইল না— কেননা দেখা গেল শাস্ত্রমতো মান পরিমাণ নিখুঁত করেও— “সর্ব্বাঙ্গৈঃ সর্ব্বরম্যোহি কশ্চিল্লক্ষে প্রজায়তে”,— লাখে একটা মেলে সর্বাঙ্গসুন্দর। অতএব ধরে নেওয়া গেল “শাস্ত্রমানেন যো রম্যঃ স রম্যো নান্য এব হি”। এতে করে শাস্ত্রের মান বাড়ল বটে, কিন্তু শিল্পক্রিয়া খর্ব হল। তাই এক সময়ে একদল বললে— “তদ্ রম্যং লগ্নং যত্র চ যস্য হৃৎ।” অমনি শাস্ত্রের দিক দিয়ে এর উত্তর এল— “শাস্ত্রমানবিহীনং যদ্ সরম্যং তদ্ বিপশ্চিতাম্।” পন্ডিতের মান বজায় করে শাস্ত্রকার ক্ষান্ত হলেন। কিন্তু এতে করে আমাদের দেশের শিল্পীরা শিল্পক্রিয়াতে প্রায় বারো আনা যে অপন্ডিত থেকে যাবে, সেকথা শাস্ত্রকার না ভাবলেও তখনকার শিল্পীরা যে ভাবেনি তা নয়। প্রতিমা-শিল্প সেই এক ছাঁচ ধরে চলল। কিন্তু অন্যান্য শিল্প সমস্ত নতুন নতুন উদ্ভাবনার পথ ধরে নানা কালের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য ধরে অফুরন্ত সৌন্দর্যধারা বইয়ে চলল দেশে।
চিত্রকলার ইতিহাস এদেশে যেমন বিচিত্র তেমন মূর্তি গড়ার ইতিহাস নয়। বাস্তুবিদ্যা তাও নানা নতুন ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মধু দিয়ে চলে অব্যাহত ধারায় বইল নতুন থেকে নতুনতর সমস্তকে ধরে। কিন্তু ঠাকুরঘরের মধ্যে সেই পুরোনো দেবতা বারবার পুনরাবৃত্ত হতে হতে দেবতার একটা মুখোসমাত্রে পর্যবসিত হতে চলল। শাস্ত্রমতো ক্রিয়া করে দেবমূর্তি গড়া প্রায় উঠেই গেছে এখন। ধ্যানগুলো বাহনগুলো কার কি এই নিয়েই কাজ চলেছে ভাস্করপাড়ায় কত দিন থেকে যে তার ঠিকানা নেই। দেবশিল্প বলে যদি কোনো সামগ্রী হয়ে থাকে এককালে দেশে তো সে বহু যুগ আগে। তারপর থেকে সে শিল্পের অধঃপতনই হয়েছে বেশি বাঁধাবাঁধির ফলে। ঘরে যে শিল্প এই বাঁধনে পড়ে মরতে বসল, বাইরে গিয়ে সেই শিল্প বাঁধন শিথিল পেয়ে দিব্যি বেঁচে গেল দেখতে পাই। নতুন নতুন প্রক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষার স্বাধীনতা শিল্পীর থাকল তবেই শিল্পক্রিয়া চলল, না হলে শিল্পের দুর্দশার সূত্রপাত হল— শাস্ত্রের দ্বারায় সে বিপদ ঠেকানো গেল না।
শিল্পশাস্ত্রে আমাদের দেশে এখানে ওখানে যা ছড়ানো রয়েছে তা থেকে সব শিল্পের তালিকা এবং বাস্তু মন্দির মঠ নির্মাণ, নগরস্থাপন, বিচারপদ্ধতি, নাগরিকের চাল-চোলের সম্বন্ধে নানা কথা এবং এইরকম নানা ব্যাপারের মধ্যে পূজার অঙ্গ হিসেবে প্রতিমানির্মাণ, তার বাহন ব্যবস্থা ইত্যাদিরই খুঁটিনাটি মাপজোখের কথা পাই। চিত্র বিষয়ে দু’-একখানা পুঁথিও পাওয়া যায়। কিন্তু এইসব পুঁথিতে কোনো কোনো শিল্পকে অঙ্গবিদ্যা হিসেবে দেখে আংশিকভাবে সেই সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। Art-এর পাঠ্য পুস্তক হিসেবে এগুলো বেশি কাজের হবে না, এই আমার বিশ্বাস। চিত্র যদি শিখতে চাই তবে চিত্রশালাতে যেতেই হবে আমাদের। প্রাচীন চিত্রে কেমন করে রেখাপাত, কেমন করে বর্ণপ্রলেপ, কেমন করে নানা অলঙ্কার বর্ধনা ইত্যাদি দেওয়া হত— তার প্রতিক্রিয়া ছবি দেখেই আমাদের শিখে নিতে হবে। কোনো শিল্পশাস্ত্রে এসমস্ত প্রক্রিয়া নিখুঁতভাবে ধরা নেই। কেমন কাগজে ছবি লেখা হত, কি কি বর্ণ সংযোগ হত, কোথায় কোথায় কেমন ধারা পালিশ দেওয়া হত ছবিতে, কত রকম তুলির টান, কত রকম রঙের খেলা, কত বিচিত্র ভাবভঙ্গি রেখার ও লেখার— এ সমস্ত এক-একখানি ছবি দেখে শেখা ছাড়া উপায় নেই। শাস্ত্রে কুলোয় না এত বিচিত্র প্রক্রিয়ার রহস্য সমস্ত হয়েছে ছবির মধ্যে ধরা মোগল বাদশাদের আমল পর্যন্ত, তারপর এসেছে ইউরোপ জাপান চীন থেকে নতুন নতুন প্রক্রিয়ায় রচনা করা ছবি। এর চেয়ে প্রকান্ড পরিষ্কার সুন্দর শিল্প ব্যাখ্যানের পুঁথি যার পাতায় পাতায় ছবি পাতায় পাতায় উপদেশ এমন আর কি হতে পারে! এই পুঁথির একখানি পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে চলেছে বিদেশের তারা কত অর্থব্যয়ে নিজেদের শিল্পজ্ঞান জাগিয়ে তুলতে। আর আমরা টাকার অভাবে একটা ছোটোখাটো চিত্রশালাও রাখতে পারছিনা দেশে। পাথরগুলো মন্দিরগুলো ভেঙে নেবার উপায় নেই— না হলে ভাস্কর্যশিল্পের নিদর্শন দেখে আর আমাদের কিছু শেখার উপায় বিদেশীরা রাখত না।
ভাবতে পারো original ছবির মূর্তি নাই হল, reproduction দেখেই আমরা শিল্পকাজে পাকা হয়ে উঠব, পুঁথি পড়ে পাকা হয়ে যাব,— এ মতের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলবার নেই। কেননা আফ্রিকার অধিবাসী যারা, কোথায় তাদের art gallery কোথায় বা তাদের শিল্পশাস্ত্র। ছবির দিক দিয়ে মূর্তির দিক দিয়ে দেশটা উজাড় হলে ক্ষতি এমন কিছু নয়। শুধু মরুভূমিকে চষে আমাদেরই আবার সবুজ করে তুলতে হবে, পূর্বপুরুষদের সঞ্চয় ও ঐশ্বর্য অন্যে ভোগ করে বড় হতে থাকবে? দেশের স্হাপত্যরক্ষার আইন তাড়াতাড়ি না হলেও ও-জিনিস সহজে দেশ থেকে নড়ত না, সময় লাগত। কিন্তু এইসব ছোটখাটো শিল্পসামগ্রী,— চমৎকার কাঁথা, চমৎকার শাড়ি, মনভোলানো খেলনা, চোখ-ঠিকরানো গহনাগাঁটি ঘটিবাটি অস্ত্রশস্ত্র এবং রামধনুকের প্রতিদ্বন্দ্বী চিত্রশালা উড়ে চলেছে বিদেশে। যদি এখন থেকে দেশে এদের রাখার চেষ্টা আইনের দ্বারা হোক পয়সার দারা হোক না করা হয় তবে শীঘ্রই শিল্পক্রিয়া আমাদের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাব। থাকবে শুধু বিদেশ যেটুকু ভিক্ষা দেবে, বিনা রোজগারে বিনা খাটুনির পাওনাটা।
শিল্পী হল ক্রিয়াশীল, শিল্প চাই তো ক্রিয়া করা চাই। তার প্রথম ক্রিয়া দেশেরটাকে দেশে ধরে রাখা, দ্বিতীয় ক্রিয়া বিদেশেরটাকে নিজের করে নেওয়া, তৃতীয় ক্রিয়া শিল্প সম্বন্ধে বক্তৃতা নয়,— করে চলা ছবি মূর্তি নাচ গান অভিনয় এমনি নানা ক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা একেবারেই করা নয় সেইটেই আগে শুরু করতে হল—বক্তৃতা দিতে হল। যেগুলো দরকারি প্রথম শিক্ষার পক্ষে— ছবির মূর্তির একটা যথাসম্ভব সংগ্রহ, তা হল না এ পর্যন্ত। ছবি সম্বন্ধে বই যা শেখাবে বক্তৃতা যা বোঝাবে তার চেয়ে ঢের পরিষ্কার ঢের সহজ করে বোঝাবে সত্যিকার ছবি— এটা করে বোঝাতে পারব লোককে তা জানিনে।
আমাদের ছবি মূর্তি ইত্যাদির একটা মস্ত সংগ্রহ চৌরঙ্গীতে রয়েছে। কিন্তু সেটার নাম আমরা দিয়েছি জাদুঘর। কোন দিন সেটা ফুঁয়ে উড়ে যাবে পুব থেকে পশ্চিমে তার ঠিক নেই। তখন আমাদের ঘর শূন্য। এই ভেবেই ছবি মূর্তি সাধ্যাতীত ব্যয় করেও ধরে রাখলেম, দু-চার জন শিল্পী তা দেখে শিখলে, কাজে এলো দু-চার দিন, তারপর এল দুঃসময়, চলল সব উড়ে বিদেশে— রূপো সোনার কাঠির স্পর্শে। এ আমি দেখতে পাচ্ছি— রইল না, দেশের শিল্প দেশে রইল না। বিদেশী এল, চোখে ধুলো দিয়ে নিয়ে গেল রাতারাতি ভাণ্ডার লুঠ করে। সকালে দেখি আমাদের ঘর শূন্য ভান্ডার খালি শুধু শিল্পী বসে একটা ভুয়ো কৌলীন্য মর্যাদা নিয়ে অথর্ব। আমরা বসে রয়েছি বাইরের দিকে চেয়ে। বাইরেটাও যে কত সুন্দর তার নীল আকাশ সবুজ বন আলো-আঁধার পশু-পক্ষী কীট-পতঙ্গ ফুল-ফল নিয়ে, তাও বুঝতে পারছিনে। মন ভাবছে না, হাত পা চলছে না, নিষ্ক্রিয় অবস্হায় হাত পেতেই বসে আছি। হঠাৎ কোনো একটা সুযোগ যদি এসে পড়ে এই আশায়। এই হল জাতীয় জীবনের সব দিক দিয়ে অতি ভয়ঙ্কর পক্ষাঘাতের প্রথম লক্ষণ— বাইরেটা রইল ঠিক কিন্তু ভিতরটা নিঃসার শিল্পের দিক দিয়ে। এই মানসিক এবং বাইরেও হাত-পায়ের পক্ষাঘাত নিবারণ কেবল শিল্পক্রিয়ার দ্বারা হতে পারে, বহুকাল ধরে হয়েও এসেছে। রাজ্য গেল রাজা গেল এমনকি ধর্মও অনেকখানি গেল যখন, তখন বাঁচবার রাস্তা হল মানুষের পক্ষে শিল্প। আপৎকালে শিল্পের উপর নির্ভর এটা শাস্ত্রের কথা। কেননা শাস্ত্রকাররা জানতেন ক্রিয়াশীলতা এবং ক্রীড়াশীলতা দুটোই শিল্পের এবং জীবনেরও লক্ষণ তাই ক্রিয়াভেদে তাঁরা কলাভেদ নির্ণয় করে গেলেন। “পৃথক পৃথক ক্রিয়াভির্হি কলাভেদস্তু জায়তে।”— (শুক্রনীতিসার)
টীকা
১. ৪/২৬৪ শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
২. ৪/২৬৫ শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
৩. ৪র্থ অধ্যায়, ৪৭২-৭৩ শ্লোক, শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
৪. ৪র্থ অধ্যায়, ৪৮০ শ্লোক, শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
৫. ১/৩ ৪র্থ অধ্যায়, শ্লোক, শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
৬. ১/৩ ৪র্থ অধ্যায়, শ্লোক, শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
মানব-শিল্পের শৈশবটা কাটল মানুষের ঘরের এবং বাইরের খুব দরকারি কাজ করতে। পাথর ঘষে তীরের ফলা তৈরি করা, হাঁড়িকুঁড়ি গড়া, কাপড় বোনা, হাড়ের মালা গাঁথা, লোহার বালা গড়া, শীতের কম্বল বসবার আসন— এমনি নানা জিনিসের উপরে শিল্পের ছাপ পড়ল। নানা জিনিস প্রস্তুতের নানা প্রক্রিয়া আস্তে আস্তে দখল হয় মানুষের। মানুষ সভ্যতার দিকে যখন এগোল তখন কতক শিল্পকলা রইল ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে, কতক রইল রাজসভার সঙ্গে জড়িয়ে। প্রধানত এই দুই রাস্তা ধরে শিল্পের ক্রিয়াকাণ্ড চলল সব দেশেই। পুজোর জন্য যেসব মন্দির প্রতিমা ইত্যাদি তাদের প্রস্তুত করার নানা প্রকরণ এবং প্রাসাদ নির্মাণ, হাট বসানো, কুয়ো খোঁড়া ইত্যাদির নানা কথা সংগ্রহ হয়ে পণ্ডিতদের দ্বারা শিল্পশাস্ত্রে ধরা হল, নানা শিল্প বিষয়ে নানা কথা নানা অধ্যায়ে বিভক্ত হয়ে শাস্ত্রের মধ্যগত রইল— এই হল শিল্পশাস্ত্রের গঠনের মোটামুটি হিসেব। তারপর ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ এই চার শাস্ত্রের মধ্যে মধ্যে আনুষঙ্গিকভাবে নানা শিল্পকলার কথাও বলা হল এবং আংশিকভাবে নানা পুরাণেও প্রসঙ্গক্রমে শিল্পের এবং নানা কলাবিদ্যার কথা লেখা রইল।
শিল্পশাস্ত্রের মূল গ্রন্থসব যা ছিল বলেই শুনি, সেইসব প্রাচীন শাস্ত্রের সারসংগ্রহ বলে যেসব পুঁথি নানা কালে এ-দেবতা ও-ঋষি বা অমুক তমুকের কথিত বলে লেখা হল— রাজরাজড়ার পুস্তকাগারে ধরার জন্য সেইগুলোই কতক কতক এখন পাওয়া যাচ্ছে। তা থেকে দেখা যায় যে, ধর্মের সেবায় শিল্পের যেসব দিক জড়িয়ে ছিল তারি বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ হল কিন্তু অন্যান্য কলা যা শৌখিন রাজরাজড়ার সেবায় লাগত তাদের বিস্তারিত বিবরণ লেখাই গেল না। পূজার প্রতিমা কেমন করে করতে হবে তার ঠিকঠাক নিয়ম লক্ষণ সমস্তই পাই, কিন্তু কাপড়-চোপড় নানা গন্ধতৈল নানা মূল্যবান তৈজসপত্র এদের প্রস্তুতের প্রকরণ শিল্পশাস্ত্রে দেখি ক্কচিৎ ধরা হল। এ ধরনের সামগ্রীর মধ্যে এক বজ্রপ্রলেপের কথা লেখা আছে দেখি সব শিল্পশাস্ত্রে, কিন্তু বজ্রমণির বেলায় তার ধারণের কি ণ্ডণাণ্ডণ তার বর্ণ ও মূল্যাদির হিসেব হল ধরা কিন্তু বজ্রমণিটা বিদ্ধ করা যায় কি প্রক্রিয়ায় এবং কত রকম গহনা হয়, কত নাম তাদের,— এসব কিছু নেই শিল্পশাস্ত্রের মধ্যে। প্রতিমা-লক্ষণ, প্রাসাদ-নির্মাণ, কূপ-খনন, ইত্যাদি-ইত্যাদি নানা কথা শিল্পশাস্ত্রে যেমন নানা অধ্যায়ে ভাগ করে লেখা রইল, তেমন করে ভূষণশিল্প যেটা একটা খুব বড় আর্ট প্রাচ্য জগতের— তার হিসেব ধরা দরকারি বোধ হল না।
এই যে সমস্ত শৌখিন শিল্প, তার উদ্ভাবনা ও গঠনের প্রক্রিয়া সমস্ত শিল্পীদের ঘরে অলিখিত অবস্থায় পিতা থেকে পুত্রে অর্সাতে চলল। এইসব বিচিত্র শিল্পের নানা আদর্শ বর্তমান রইল কিন্তু তাদের প্রস্তুতকরণের প্রক্রিয়া সমস্ত কত যে লোপ পেয়ে গেল তার ঠিক নেই। এই কারনে বলতেই হয় আমাদের শিল্পশাস্ত্র, শিল্পশাস্ত্র বলতে যা বোঝায় তা নয়, তাতে অঙ্গবিদ্যা হিসেবে আংশিকভাবে প্রসঙ্গক্রমে কোনো কোনো কলাবিদ্যার কথা বলা হয়েছে, ভারত-শিল্পের প্রায় সাড়ে-পনেরো আনা অংশের কথাই পাড়া হয়নি তাতে। এখন ধর্মের সঙ্গে শিল্পের আগেকার যোগ বিচ্ছিন্ন হতেই চলল, শিল্পের যে অনাদৃত দিক বিচিত্র দিক যা নিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা সুন্দর হয়ে উঠল মধুময় হয়ে উঠল সেই দিকে মানুষের নজর পড়ল; ঘরের শিল্প আবার ঘরেই ফিরেছে পরের কাজ চুকিয়ে।
শিল্পকে ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে না দেখে শিল্পের দিক দিয়ে দেখা খুব অল্পদিন হল ইউরোপে চলিত হয়েছে। প্রাচীনকালেও ভারতবর্ষে এইভাবে শিল্পরসের দিক দিয়ে কলা সমস্তকে দেখা আলঙ্কারিকগণ প্রচলিত করে গেছেন। শুধু কাব্যকলার সঙ্গে জড়িয়ে রাখলে অলঙ্কারশাস্ত্র রসশাস্ত্র ইত্যাদি খুব কাজে আসবে না, অলঙ্কারশাস্ত্রের বিচারপ্রণালী ধরে শিল্পবিদ্যা বুঝতে চললে ঢের বেশি ফল পাব আমরা। শিল্পের পুরাতত্ত্ব হিসেবে শিল্পশাস্ত্র কাজে লাগবে, প্রাচীনের সঙ্গে শিল্পশাস্ত্রের দিক দিয়ে এখনকার শিল্পীদের আংশিকভাবে যোগ ছাড়া বেশি কিছু হবে না; আমরা হাজার বছর আগে কত বড় শিল্পী ছিলেম এই ভাবের একটা ভুয়ো গর্বও লাভ হতে পারে— কিন্তু সে শুধু পড়ে-যাওয়া বিদ্যা হবে শিল্পবোধ তাতে হবে না। রসের ও ভাবের প্রক্রিয়া ধরে কবিতা ছবি মূর্তি এমনকি খেলনাটারও পরিচয় হল ঠিক পরিচয়। বিদেশীয় রসিকেরা এই পথে কাজ করে চলেছেন অনেকেই।
শিল্পী ও শিল্পরসিক কেমন করে হয় তা ঠিক করে বলা কঠিন। হঠাৎ দেখি কেউ রস পেয়ে গেল কেউ বা সারা বছর অলঙ্কার শাস্ত্র পড়ে পড়ে চোখই ক্ষরিয়ে ফেলল। কবি কেমন করে হয় কাব্যপ্রকাশে লেখা আছে দু চরণ শ্লোকে। কলাশাস্ত্রের গোড়ায় ঠিক এই কথা লেখা হলে মানায়— পড়ে পাই বিদ্যা, না-পড়ে পাই কলাবিদ্যা। কিন্তু না পড়ে পেলেও কলাবিদ্যাকে পড়ে পাওয়া শক্ত। হাতে-কলমে কাজ করা হল শিল্পের নানা প্রকরণ, সহজে দখল করার সহজ উপায়। রঙ রেখা এদের টেনে দেখলে এদের রহস্য সহজ হয়ে আসে।
পড়ার দ্বারা নয় ক্রিয়ার দ্বারা শিল্পকর্মে দক্ষতা হয় যদি এই কথাই হল তবে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা পড়াশুনো করছে না অথচ artistও হয়ে উঠছে না। তারা কেউ চাষা হচ্ছে কেউ দোকানি-পসারি মুটে-মজুর হচ্ছে। অবশ্য এদের অনেকের কাজই শিল্পশাস্ত্রের চৌষট্টি কলার কোনোটা-না-কোনোটার মধ্যে পড়ে যায়, কিন্তু হলে কি হয় ! আমরা নিজেদের সব দিক দিয়ে যতই cultured বোধ করি না কেন চাষাকে artist ভাবা মজুরকে artist বলা শক্ত হয়েছে; যারা গাধাবোট টেনেই চলেছে তাদের কেউ এখন artist বলে না কিন্তু যে ছেলেরা বাচ খেলায় মজবুত হল তাদের বলি artist!
আজকে আমাদের পক্ষে ‘philosopher জ্ঞানী লোক, cultivator চাষা’, এবং artist তারাই যারা নিত্য জীবনযাত্রার থেকে স্বতন্ত্র অতিরিক্ত কিছু নিয়ে রয়েছে। আগে কিন্তু এ ভাবটা ছিল না, তখন শহরের লোক দেখি চোরের সিঁদ কাটার নানা কায়দা দেখে পুলিস ডাকার কথা ভুলে ফুটো দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন সিঁদটা কাটা হয়েছে এই নিয়ে art lecture আরম্ভ করে দিয়েছে। হয়তো বা চোর সে নিজের কাটা সিঁদের বাহার দেখে খুশিতে রয়েছে এমন সময় পুলিস এসে প্রেপ্তার করলে artistকে। বর্ষাকালে দেখি ক্ষেতের দিকে চেয়ে চাষার গান চলল--
“গগন ঘটা ঘহরাণী সধো
গগন ঘটা ঘহরাণী
পূরব দিস্সে উঠিহৈ বদরিয়া
রিম ঝিম বরষত পানী।
আপন আপন মেড়ঁ সম্হারো
বহ্যো জাত য়হ পানী সুরত নিরত কা বেল নহায়ন
করৈ খেত নির্বাণী।”
—কবীর
ঘনঘটা ঘটিয়ে এল পুবে বাদল উঠল রিমঝিম বরিষ নামল, সামাল ভাই ক্ষেতের আল, ঐযে জল বয়ে চলল। দুটি লতা-অনুরাগের বিরাগের— তাদের আজ এই রসের বৃষ্টিধারায় ভিজিয়ে নাও, এমন ক্ষেত লাগাও যেখানে অবাধ মুক্তির ফসল ফলে, ক্ষেতের ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারে, তাকেই তো বলি কুশল কিষাণ।
সেকালে তাঁরা art কিসে নেই বা কিসে আছে এটা সুনিশ্চিত করে দিতে অথবা নানা রকম কলাবিদ্যার সংখ্যা নির্ধারণ করে চৌষট্টির মধ্যেই artকে ধরে রাখতে চাননি; এইজন্যই শাস্ত্রে বলা হল:
“বিদ্যা হ্যনন্তাশ্চ কলাঃ সংখ্যাতুং নৈব শক্যতে।
বিদ্যা মুখ্যাশ্চ দাত্রিংশচ্চতুঃষষ্টিঃ কলাঃ স্মৃতাঃ।।” (শুক্রনীতিসার)(১)
এইভাবে বিদ্যা এবং কলা দুয়ের প্রভেদটা মাত্র মোটামুটি রকমে শাস্ত্রে ধরা হল:
“যদ্যত্ স্যাদ্ বাচিকং সম্যক্ কর্ম্মবিদ্যাভিসংজ্ঞকম্।
শক্তে মূকোহপি যৎ কর্ত্তুং কলাসংজ্ঞন্তু তৎস্মৃতম্।।” (শুক্রনীতিসার)(২)
আমরা এখন artকে finr, industrial— নানাভাগে ভাগ করে নিয়েছি। আগেও এইরকম ভাগ ছিল শিল্পে— কর্মাশ্রয়া দ্যুতাশ্রয়া উপচারিকা ইত্যাদি হিসেব। সেকালের চৌষট্টি কলার ফর্দটার মধ্যে যাকে বলি fine art, যাকে বলি industrial art এবং যাকে বলি science, সবই এক কোঠায় রাখা গেছে। সেকালের হিসেবে ধরলে আজকালের Football, Billiards ইত্যাদি খেলা art-এর মধ্যে এসে পড়ে; সন্তানপালন একটা art-এর মধ্যে ছিল আগে, এখন ওটা আমরা medical science-এর মধ্যে ফেলে দিয়েছি। এমনকি ছেলেদের খেলার পুতুল গড়া ও কেষ্টনগরের পুতুল গড়া এবং গড়ের মাঠের ধাতুমূর্তি গড়া— তিনটেকে সম্পূর্ণ আলাদা জাতের শিল্প বলে ধরে নিয়েছি। মানুষের উন্নত ও সুন্দর এবং সুকুমার বৃত্তিসমূহ যে শিল্পকাজের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয় তাকে বলি fine art, মানুষের প্রতিদিনের জীবনের নানা সাজসরঞ্জাম যাতে করে শুধু কাজের নয় সঙ্গে সঙ্গে সুদর্শন হয়ে ওঠে তাকে বলি industrial art; এমনি art-এর মোটমাট জাতিবিভাগ সৃষ্টি হয়ে গেছে মানুষের নিজের মধ্যে সমাজবন্ধনের সময়ে নানা বর্ণবিভাগের প্রথায়; artistদের কাছে কিন্তু এরকম একটা বিভাগ নিয়ে art-এর উপভোগের তারতম্য ধরা একেবারেই নেই, সেখানে আর্ট এক কোঠায় না- art অন্য কোঠায়, ইতর বিশেষ, মাঝামাঝি, চলনসই— এসব কথা নেই, art কি art নয় এই বিচার।
শিল্পশাস্ত্র আমাদের যা রয়েছে তাতে ভাস্কর্যের একটা দিক, স্হাপত্যের খানিকটা— যেটা পূজন ও যজন-যাজনের সঙ্গে জোড়া, তারি উপরে বিশেষভাবে মতামতের জোর দেওয়া হয়েছে দেখা যায়। তাছাড়া এটাও দেখি যে শিল্পশাস্ত্রের সংগ্রহকার্যে ভারি একটা ত্বরা রয়েছে— কোনো রকমে একটা প্রাচীনত্বের ছাপ মেরে জিনিসটাকে সাধারণে প্রচার করার ত্বরা— একটা ধর্মবিপ্লবে এবং সেই সময়ের ত্বরা— শিল্পকে নিয়ে টানাটানি এসবই লক্ষ্য করি শিল্পশাস্ত্রের সংগ্রহের ধরন থেকে।
Art-এর মধ্যে একটা অনির্বচনীয়তা আছে যেটা artist-এর অনুভূতির বিষয় এবং অসাধারণ বলেই art-এর অনির্বচনীয় রস যে কি ব্যাপার তা সবাইকে বুঝিয়ে ওঠা কঠিন। রস পেলে তো পেলে, না পেলে তো পেলে না, এসব কথা শিল্পশাস্ত্রকার বিচার করবার সময় পাননি, এসব চিন্তা আলঙ্কারিকদের, রসের দিক দিয়ে তারা বিচার করে দেখেন যে সেদিক দিয়ে এতটুকু বা এত বড় নেই সরস বা নীরস নিয়ে কথা। মাটির খেলনা সরস হল তো মগধের নাড়ুর চেয়ে বড়জিনিস হল এবং মগধ উড়িষ্যা সব শিল্পের বড় বড় ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ ও গণেশের সমতুল্য হয়ে উঠল একটি সুন্দর আরতি-প্রদীপ। আর্টের জগৎ শিল্প কি শিল্প নয় এই নিয়ে,— উচ্চ-নীচ ভাল-মন্দ ভেদাভেদ, দেবতা কি মানুষ কি বানর এ নিয়ে দেখা নয়,— art কি art নয় এই নিয়ে সব জিনিসকে পরীক্ষা করা হল অকাট্য নিয়ম। Art for art এই কথাই হল artist-এর, art ধর্মের জন্য কি জাতীয় গৌরবের ধ্বজা সাজাবার জন্য কি nature-এর সম্মুখে mirror ধরার জন্য অথবা বিপশ্চিতাম্ মতম্-কে বলবৎ রাখার জন্য, এ তর্ক art-এর জগতে উঠতেই পারে না।
Artist যে উদ্দেশ্যেই কাজ করুক আর্টের দিকে চেয়ে করাই হল তার প্রধান কাজ। ময়ূর নিজের আনন্দে তার চিত্র-বিচিত্র কলাপ বিস্তার করে, বাগানের শোভা কি বনের শোভা কি খাঁচার শোভা তাতে হল কি না-হল ময়ূরের মনে একথা উদয়ও হল না; এতটা স্বাধীনতা মানুষ শিল্পে চায় কিন্তু পেলে কই?— ধর্ম বললে তুমি আমার কাজে লাগো, দেশ বললে আমার, এমনি নানা দিক দিয়ে শিকল পড়ে গেল শিল্পের হাতে পায়ে, তারপর একদিন চিরকালের ছাড়া পাখি তার মনিবের পোয মানলে, ইশারাতে পুচ্ছ ওঠালে নামালে যে শুধু তাই নয়, জলযন্ত্র ঘোরালে ঘটিযন্ত্র চালালে কামান দাগলে নিয়মমতো! “ অপি শ্রেয়স্করং নৃণাম্ দেববিম্বমলক্ষণম্।
সলক্ষণং মর্ত্ত্যবিম্বম্ নহি শ্রেয়স্করং সদা।।”
এই হুকুমে এককালে আমাদের শিল্পীরা বাঁধা পড়ে ছিল। পুঁথিকার দেবতা সমস্তের ধ্যান দিলে শিল্পে, সেই ধ্যান মতো গড়ে চলল— এই ঘটনাই যদি পুরোপুরি ঘটতো তবে আমাদের art আর্ট কেবলমাত্র ধ্যানমালার illustration হয়ে যেত কিন্তু এর চেয়ে যে বড় জিনিস হয়ে উঠল বুদ্ধ নটরাজ প্রভৃতি নানা দেবমূর্তি সেটা ধ্যানমালার লিখিত ধ্যানের অতিরিক্ত এবং শিল্পশাস্ত্রের মান-পরিমাণ লক্ষণাদির বাঁধা নিয়মের থেকে স্বতন্ত্র আর-কিছু নিয়ে। প্রাচীন দেবমূর্তিগুলি আমাদের বাঙলার কার্তিকের মতো সম্পূর্ণ কাপ্তেনবাবু বা কলে কাটাছাঁটা মরা জিনিস হয়ে পড়েনি শুধু শিল্পের শিল্পক্রিয়া তাদের অমরত্ত্ব দিলে বলে এবং শুধু সেইটুকুর জন্য art-এর জগতে এইসব দেবতার স্থান হল।
শাস্ত্র বললে শিল্পকে ঘাড়ে ধরে, দেবলোকটাই আছে তোমার কাছে, মর্ত্যলোক নেই, যদি বা থাকে তো সেদিকে দৃকপাত করবে না— তাহলে অন্ধ হবে। কিন্তু artist-এর পথ স্বতন্ত্র কেননা art সে অনন্যপরতন্ত্রা, শিল্পীর কাছে দেবলোকের স্বপ্ন সেও যেমন প্রত্যক্ষ ও সুন্দর, মর্ত্যলোকের ছবি সেও তেমনি অভাবনীয় সুন্দর ও প্রত্যক্ষ ব্যাপার, দুটোই তুল্যমূল্য, যদি art হল এবং রসের স্বাদ দিলে। শাস্ত্রী চাইলেন মর্ত্যকে ছেড়ে শাস্ত্রীয় স্বর্গ, ইহলোককে মুছে দিয়ে পুঁথির পরলোক। কিন্তু শিল্পীর শিল্পবৃত্তি তাকে অন্য পথ দেখালে; মর্ত্যলোকের মাটির দেহে সবখানি সুন্দর হতে সুন্দরতর হয়ে উঠল, শাস্ত্র যে সৃষ্টিছাড়া কান্ড চেয়েছিল তা হতেই পারলে না, অনেকখানি সৃষ্টিরহস্য শিল্পীর মনে ক্রিয়া করে পাগলামির অনাসৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে দিলে এ দেশের প্রতিমাশিল্পকে। শিল্পশাস্ত্রের দেবলোক ও তার অধিবাসী তাঁরা একেবারেই তেত্রিশ কোটি গন্ডীর মধ্যে ঘেরা, নিখুঁত মান-পরিমাণ লক্ষণ দিয়ে সম্পূর্ণভাবে বাঁধা শাস্ত্রীয় দেবলোক ও দেবতা হওয়া ছাড়া সেখানে উপায় নেই, শিল্পীর মনের দেবতা এবং শাস্ত্রের দেবলোকের সঙ্গে শিল্পীর শিল্পলোকের কল্পনায় তফাত থাকতে পারে এইভয় করেই শাস্ত্রকার কষে বেঁধেছেন আপনার নিয়ম জায়গায় জায়গায়— “নান্যেন মার্গেণ প্রত্যক্ষেণাপি বা খলু”; পূজার জন্য যে প্রতিমাতা শাস্ত্রমতো না গড়লে তো চলে না সুতরাং শিল্পীর ওপরে কড়া হুকুম জারি করতেই হল নানা ভয় দিয়ে— “হীনাঙ্গী স্বামিনং হন্তি হ্যধিকাঙ্গীচ শিল্পিনম্।” একচুল এদিক ওদিক হলে একেবারে মৃত্যুদন্ড; বেতের ভয় নয়— “কৃশা দুর্ভিক্ষদা নিত্যং স্থূলা রোগপ্রদা সদা”, অন্ধতা বংশলোপ ইত্যাদি নানা ভয় দিয়ে শিল্পীকে ও শাস্ত্রীয় মূর্তিকে কঠিন নিয়মে বাঁধার চেষ্টা হল, কিন্তু এতে যে কাজ ঠিক চলল তা নয়, এদিক ওদিক হতেই থাকল মাপজোখ ইত্যাদিতে, শিল্পী মানুষ তো কল নয়, সে ক্রিয়াশীল ক্রীড়াশীল দুই-ই, সুতরাং একটু ঢিলে দিতে হল নিয়মের কষনে।
“লেখ্যা লেপ্যা সৈকতী চ মৃন্ময়ী পৈষ্টিকী তথা।
এতাসাং লক্ষণাভাবে ন কশ্চিৎ দোষ ঈরিতঃ ।।
বাণলিঙ্গে স্বয়ম্ভূতে চন্দ্রকান্তসমুদ্ভবে।
রত্নজে গন্ডকোদ্ভূতে মানদোষো ন সর্ব্বথা।।”(৩)
ছবি modeling, plaster cast এমনি অনেক জিনিস এবং স্ফটিক ও নানা রত্নভূষা এবং ছোটখাটো শিল্পদ্রব্য সমস্তই বাঁধনের বাইরে পড়ল, কেবল পাষাণ ও ধাতুজ পূজার জন্য যে মূর্তি রইল শাস্ত্রের মধ্যে বাঁধা কিন্তু এখানেও গোল বাধল ঠিক ঠিক শাস্ত্রমতো গড়ন কে জানে কেন শিল্পীর হাতে এল না, এদিক ওদিক হতেই থাকল কিছু কিছু--
দেশভেদে কালভেদে শিল্পীর কল্পনাভেদে পূজকের অন্তর্দৃষ্টিভেদে, তখন সম্পূর্ণ ছাড়পত্র
দেওয়া হল--
“প্রতিমায়াশ্চ যে দোষা হ্যর্চ্চকস্য তপোবলাৎ।
সর্ব্বত্রেশ্বরচিত্তস্য নাশং যান্তি ক্ষণাৎ কিল।।”(৪)
এই ফাঁক পেয়ে দেশের শিল্প হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, বিচিত্র হয়ে উঠল ম্নদিরে মঠে।
সেকালে শাস্ত্রের নিয়মমতো গড়ার যেসব ব্যাঘাত পরে পরে এসেছিল, একালেও যদি শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসনে আমরা শিল্পীদের বাঁধতে চলি তবে ঠিক সেকালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতেই হবে। অনেকে বলেন ইতিহাসের না হয় পুনরাবৃত্তি হলই, তাতে করে যদি তখনকার art ফিরে পাই তো মন্দকি। এ হবার জো নেই, যা গেছে তা আর ফেরে না; তার নকল হতে পারে, ছোট ছেলে ঠাকুরদাদার হুবহু নকল দেখিয়ে চললে যেমন হাস্যকর অশোভন ব্যাপার হয় তাই হবে, গোলদীঘির অজন্তা-বিহার হবে, গড়ের মাঠের খেলনা তাজমহল হবে। কুঁড়েঘর আর বদলাল না কেননা সে এমন সুন্দর করে সৃষ্টি করা যে তখনো যেমন এখনো তেমনি তাতে স্বচ্ছন্দে বাস চলল। কিন্তু সেকালের প্রাসাদে একালে আমাদের বাস অসম্ভব, আলো বাতাস বিনা হাঁপিয়ে মারা যাব পাথর চাপা পড়ে। পুরাকালে আমাদের যাঁরা শিল্প ও শিল্পরসিক ছিলেন তাঁরা ক্ষুদ্রচেতা ছিলেন না। তাঁরা নিয়ম করতেন নিয়ম ভাঙতেন তাঁদের মধ্যে শিল্পী ও শিল্প দুই ছিল, কাজেই তাঁদের ভয় ছিল না। এখন আমাদের সেই সেকালের কোনো কিছুতে একটু-আধটুও অদল-বদল করতে ভয় হয় কেননা নিজের বলে আমাদের কিছুই নেই, সেকালের উপরে আগাছার মতো আমরা ঝুলছি মাত্র, সেকালই আমাদের সর্বস্ব! কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এক আফ্রিকার মূর্তিশিল্প যেমন ছিল তেমনি নিষ্ক্রিয় অবস্থাতেই আছে, সেকালকে সে ছাড়াতে একেবারেই পারেনি।
সেকাল ছেড়ে কোনো শিল্প নেই এটা ঠিক, কিন্তু একাল ছেড়েও কোনো শিল্প থাকতে পারে না বেঁচে এটা একেবারেই ঠিক। গাছের আগাছা নতুন মুকুল গাছের গোড়ায় অতীতের অন্ধকারে তার প্রথম বীজটির সঙ্গে যেভাবে যুক্ত রয়েছে সেভাবে থাকাই হল ঠিকভাবে থাকা; আমের নতুন মঞ্জরীর সঙ্গে পুরাতন বীজটার চেহারার সাদৃশ্য মোটেই নেই কিন্তু মঞ্জরীর গর্ভে লুকানো রয়েছে সেই পুরাতন বীজ যার মধ্যে সেই একই ক্রিয়া একই শক্তি ধরা রয়েছে, নতুন আবহাওয়াতেও যেটা ঠিকঠাক আমগাছই প্রসব করবে বর্তমানকালে; এই স্বাভাবিক গতি ধরে চলেছে শিল্প, এর উল্টো-পাল্টা হবার জো নেই।
আমাদের দেশের শিল্পমূর্তিকে যে কারণেই হোক এই স্বাভাবিক গতি থেকে বঞ্চিত করে দেওয়া হল এক সময়ে, দেবমূর্তির বাহুল্যের চাপন পেয়ে কিছুদিন গাছ আমাদের মনোমতো পথ ধরে প্রায় কল্পতরু হবার জোগাড় করলে। কিন্তু কালের নিয়মে হঠাৎ পশ্চিমের হাওয়া বইল চাপন পাথর একটুখানি নড়ে গেল, অমনি গাছ আবার স্বাভাবিক রাস্তা ধরে মন্দিরের ছাদ তুলসীমঞ্চের গাঁথনি ফাটিয়ে নানা দিকে আলো বাতাস চেয়ে গতিবিধি শুরু করলে, পশ্চিমে ঝুঁকল কতক ডাল, পুবে বাড়ল কতক ডাল, এইভাবে আলো বাতাসের গতি ধরে বেড়ে চলল গাছ। শুধু ভারতবর্ষ নয়, সব দেশ এইভাবে শিল্পের দিকে বেড়ে চলেছ। মঞ্চে বাঁধা গাছ দেখতে মন্দ নয় কিন্তু দিকে বিদিকে নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে যে বনস্পতি তার মতো সে শক্তিমানও নয় ছায়াশীলও নয় সুন্দরও নয়। আমাদের প্রাচীন শিল্প ও শাস্ত্র সমস্তই বোধিবৃক্ষের কলমের চারার সঙ্গে সোনার গামলায় নীত হয়েছিল দেশ থেকে বিদেশে, কিন্তু সেইসব যবন দেশের হাওয়া আলো নিয়ে তাদের বেড়ে উঠতে অনেকখানি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, ভিক্ষু শিল্পীদের দ্বারা সহজ গতি ব্যাহত হয়নি; তবেই তো এককালের ভারতীয় উপনিবেশের অভারতীয় অন্তরের মধ্যে চলে গিয়েছিল ভারতীয় ভাব ও রস। ভারত-শিল্প যদি কেবলই টবের গাছ হত তো কোনকালে সেটা মরে যেত ঠিক নেই, খালি টব থাকত আর তাতে সিঁদুর দিয়ে পুজো লাগাত দেখতেম আজও পুত্রকামনায় নিষ্ক্রিয় দেশের শিল্পহীন অপুত্রক হতভাগারা।
সেকালের শাস্ত্রমতো ক্রিয়া করে চললে এখনো আমরা সেকালের মতোই সব দিকে বিস্তার লাভ করতে পারি, কিন্তু একালকে বাদ দিয়ে ক্রিয়া করা চলবে না কেননা বর্তমানকাল এবং বর্তমানের উপযোগী অনুপযোগী ক্রিয়া বলে কতকগুলো পদার্থ রয়েছে যেগুলোকে মেনে চলতেই হবে আমাদের, না হলে সেকালটা ভূতের উপদ্রব ছাড়া আর কিছুই দেবে না আমাদের এবং তাবৎ শিল্পজগতের অধিবাসীকে। দাশরথি রায়ের পাঁচালী আমরা অনেকেই পড়ি কতক কতক ভালও লাগে কিন্তু পাঁচালীর ছাঁদে যদি কবিতা ঢালাই করার কড়া আইন করে দেওয়া যায় হঠাৎ তবে বর্তমানের কোনো কবি তাতে ঘাড় পাতবে না, কিংবা আমি যদি আজ বলি আমার ছাঁদেই বাঙলার চিত্রকর যারা এসেছে ও আসছে তাদের ছবি লিখতে হবে এবং গভর্নমেন্টের সাহায্যে এটা হঠাৎ একটা আইনে পরিণত করে নিই তবে কেউ সাটা মানবে না, উল্টে বরং শিল্পীর স্বাধীনতা বিষম ব্যাঘাত দেওয়া হল বলে আমাকে শুদ্ধ তোপে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবে। আমাদের শিল্পশাস্ত্রকারদের কড়া মাস্টার এবং পাহাড়াওলা হিসেবে দেখলে সত্যই আমাদের সেকালের প্রতি অবিচার করা হবে। পূর্বেকার তাঁরা তখনকার কালে যা উপযোগী বা নিয়ম তারই কথা ভেবে গেছেন, একালের আমাদের কি করা না-করা, শাস্ত্রের কোন আইন মানা না-মানা সমস্তই একালের উপরে ছেড়ে দিয়ে গেছেন তাঁরা, শাস্ত্রকে অস্ত্রের মতো একালের উপরে নিক্ষেপ করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত করে যাননি!
তখনকার তাঁরা নানা শিল্পের রীতিনীতি ক্রিয়াকলাপ সংগ্রহ করে গেছেন নানা শাস্ত্রের আকারে--
“স্বয়ম্ভূর্ভগবান্ লোকহিতার্থং সংগ্রহেণ বৈ,
তৎসারন্তু বশিষ্ঠাদ্যৈরস্মাভির্বৃদ্ধিহেতবে।।” (শুক্রনীতিসার) (৫)
শুক্রাচার্য কেন যে নানা শিল্প নানা সামাজিক রীতিনীতি সংগ্রহ করে শুক্রনীতিসার বলে পুঁথিখানা লিখলেন তা নিজেই বলে গেলেন--
“অল্পায়ুর্ভূভৃদাদ্যর্থং সংক্ষিপ্তং তর্কবিস্তৃতম্
ক্রিয়ৈকদেশবোধিনি শাস্ত্রাণ্যন্যানি সন্তি হি।
সর্ব্বোপজীবকং লোকস্থিতিকৃন্নীতিশাস্ত্রকম্
ধর্ম্মার্থকামমূলং হি স্মৃতং মোক্ষপ্রদং যতঃ।।” (৬)
মুক্তি দেবার জন্য শাস্ত্র, অল্পের মধ্যে অল্পায়ুধকে অনেকখানি বোঝাবার জন্য শাস্ত্র, রক্ষার জন্য শাস্ত্র,— হননের জন্য নয়!
পৃথিবীর সেকালের ভিত্তির উপরে একালের প্রতিষ্ঠা হল স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠা, সেকাল একালের ঘাড় চেপে পড়ল— বাড়ির ভিত উঠে এল ছাতের উপরে, এ বড় বিষম প্রতিষ্ঠা! সেকালের বাস্তুশিল্প হিসেবেও এটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা তার মালমশলার জন্য সম্পূর্ণভাবে সেকালের উপর নির্ভর করে চলতে বাধ্য— নতুন প্রথায় কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব চর্চা চলল। শিল্পও তেমনি সেকাল, একাল ও ভবিষ্যকালের যোগাযোগে বর্ধিত হয়ে চলল, কোনোভএককালের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে তাকে ধরে রাখবার উপায় রইল না। প্রাচীন ভারতের শিল্প শুধু নয়— তখনকার আচার-ব্যবহার সমুদয় কি ছিল কেমন ছিল তা প্রাচীন পুঁথির মধ্যে ধরা রইল বলেই শাস্ত্র পুরাণ ইত্যাদি পড়া। কিন্তু পড়ে জানা হল একরকম শিল্পকে না জানাই। অজন্তা চিত্র কেমন এবং তার বর্ণ দেবার লাইন টানার মাপজোখের হিসেবের ফর্দ পড়ে গেলে ছবিটা দেখার কাজ হয় না। প্রাচীন ভারতের শিল্পের যে দিকটা প্রত্যক্ষ হচ্ছে বর্তমানে— মন্দির মঠ মূর্তি ছবি কাপড়-চোপড় তৈজসপত্র ইত্যাদিতে তা থেকেই বেশি শিক্ষা পায় শিল্পী। এ হিসেবে একটা প্রাচীন মূর্তির ফটোগ্রাফও বেশি কাজের হল শিল্পকে বোঝাতে, আসল মূর্তিটা চোখে দেখলে তো কথাই নেই। ব্রজমন্ডলে কি কি আছে ও ছিল, সেটা ব্রজপরিক্রমা পড়ে গেলেও ব্রজমন্ডল দেখা হল না, জানা হল না— যতক্ষণ না তার ফটো দেখছি বা সেখানে তীর্থ দর্শনে যাচ্ছি। না-দেখা ব্রজভূমি যেটা সম্পূর্ণ কল্পনার জিনিস তার মূল্য বড় কম নয়--
Art-এর দিক দিয়ে। কিন্তু শাস্ত্র মতো ব্রজভূমির একটা বর্ণনা বা symbol দুখানা হরি চরণ যদি হয়, তবে সেটা দেখে কি বুঝব ব্রজের শোভা? নিছক প্রতীক নিয়ে তন্ত্রসাধনা চলে,— শিল্পসাধনা তার চেয়ে বেশি কিছু চায়। সাধকের হিতার্থ শাস্ত্রমতো রূপকল্পনা হল অরূপের, যখন তখন একখন্ড শিলা একটা যন্ত্র হলেই কাজ চলে গেল। কিন্তু শিল্প এমন নিছক প্রতীকমাত্র হয়ে বর্তে থাকতে পারেনা। অনেকখানি চোখের দেখার মধ্যে না ধরলে দেবতাকে দেখানোই সম্ভব হয় না। অথচ দেবতাকে মনুষ্যত্বের কিছু বাহুল্য না দিলেও চলে না। এই কারণে নানা মূর্তির নানা মুদ্রা হাত মাথা ইত্যাদির প্রাচুর্য দরকার হয়ে পড়ল। শিল্পশাস্ত্র নিঁখুত করে তার হিসেব দিলেন। কিন্তু এতেও পাথর দেবতা হয়ে না উঠে মনুষ্যেতর কিছু হবার ভয় গেল না,— তখন শিল্পীর শিল্পজ্ঞান যেটা তাঁর নিজস্ব, তার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় রইল না।
এই যে শিল্পজ্ঞান, এ কোথা থেকে আসে শিল্পীর মধ্যে তা কে জানে? তবে শুধু শাস্ত্রকে মেনে চলে কিংবা শাস্ত্র পড়ে সেটা আসে না এটা ঠিক। এইখানে শিল্পীর প্রতিভাকে স্বীকার করা ছাড়া উপায় রইল না— কেননা দেখা গেল শাস্ত্রমতো মান পরিমাণ নিখুঁত করেও— “সর্ব্বাঙ্গৈঃ সর্ব্বরম্যোহি কশ্চিল্লক্ষে প্রজায়তে”,— লাখে একটা মেলে সর্বাঙ্গসুন্দর। অতএব ধরে নেওয়া গেল “শাস্ত্রমানেন যো রম্যঃ স রম্যো নান্য এব হি”। এতে করে শাস্ত্রের মান বাড়ল বটে, কিন্তু শিল্পক্রিয়া খর্ব হল। তাই এক সময়ে একদল বললে— “তদ্ রম্যং লগ্নং যত্র চ যস্য হৃৎ।” অমনি শাস্ত্রের দিক দিয়ে এর উত্তর এল— “শাস্ত্রমানবিহীনং যদ্ সরম্যং তদ্ বিপশ্চিতাম্।” পন্ডিতের মান বজায় করে শাস্ত্রকার ক্ষান্ত হলেন। কিন্তু এতে করে আমাদের দেশের শিল্পীরা শিল্পক্রিয়াতে প্রায় বারো আনা যে অপন্ডিত থেকে যাবে, সেকথা শাস্ত্রকার না ভাবলেও তখনকার শিল্পীরা যে ভাবেনি তা নয়। প্রতিমা-শিল্প সেই এক ছাঁচ ধরে চলল। কিন্তু অন্যান্য শিল্প সমস্ত নতুন নতুন উদ্ভাবনার পথ ধরে নানা কালের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য ধরে অফুরন্ত সৌন্দর্যধারা বইয়ে চলল দেশে।
চিত্রকলার ইতিহাস এদেশে যেমন বিচিত্র তেমন মূর্তি গড়ার ইতিহাস নয়। বাস্তুবিদ্যা তাও নানা নতুন ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মধু দিয়ে চলে অব্যাহত ধারায় বইল নতুন থেকে নতুনতর সমস্তকে ধরে। কিন্তু ঠাকুরঘরের মধ্যে সেই পুরোনো দেবতা বারবার পুনরাবৃত্ত হতে হতে দেবতার একটা মুখোসমাত্রে পর্যবসিত হতে চলল। শাস্ত্রমতো ক্রিয়া করে দেবমূর্তি গড়া প্রায় উঠেই গেছে এখন। ধ্যানগুলো বাহনগুলো কার কি এই নিয়েই কাজ চলেছে ভাস্করপাড়ায় কত দিন থেকে যে তার ঠিকানা নেই। দেবশিল্প বলে যদি কোনো সামগ্রী হয়ে থাকে এককালে দেশে তো সে বহু যুগ আগে। তারপর থেকে সে শিল্পের অধঃপতনই হয়েছে বেশি বাঁধাবাঁধির ফলে। ঘরে যে শিল্প এই বাঁধনে পড়ে মরতে বসল, বাইরে গিয়ে সেই শিল্প বাঁধন শিথিল পেয়ে দিব্যি বেঁচে গেল দেখতে পাই। নতুন নতুন প্রক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষার স্বাধীনতা শিল্পীর থাকল তবেই শিল্পক্রিয়া চলল, না হলে শিল্পের দুর্দশার সূত্রপাত হল— শাস্ত্রের দ্বারায় সে বিপদ ঠেকানো গেল না।
শিল্পশাস্ত্রে আমাদের দেশে এখানে ওখানে যা ছড়ানো রয়েছে তা থেকে সব শিল্পের তালিকা এবং বাস্তু মন্দির মঠ নির্মাণ, নগরস্থাপন, বিচারপদ্ধতি, নাগরিকের চাল-চোলের সম্বন্ধে নানা কথা এবং এইরকম নানা ব্যাপারের মধ্যে পূজার অঙ্গ হিসেবে প্রতিমানির্মাণ, তার বাহন ব্যবস্থা ইত্যাদিরই খুঁটিনাটি মাপজোখের কথা পাই। চিত্র বিষয়ে দু’-একখানা পুঁথিও পাওয়া যায়। কিন্তু এইসব পুঁথিতে কোনো কোনো শিল্পকে অঙ্গবিদ্যা হিসেবে দেখে আংশিকভাবে সেই সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। Art-এর পাঠ্য পুস্তক হিসেবে এগুলো বেশি কাজের হবে না, এই আমার বিশ্বাস। চিত্র যদি শিখতে চাই তবে চিত্রশালাতে যেতেই হবে আমাদের। প্রাচীন চিত্রে কেমন করে রেখাপাত, কেমন করে বর্ণপ্রলেপ, কেমন করে নানা অলঙ্কার বর্ধনা ইত্যাদি দেওয়া হত— তার প্রতিক্রিয়া ছবি দেখেই আমাদের শিখে নিতে হবে। কোনো শিল্পশাস্ত্রে এসমস্ত প্রক্রিয়া নিখুঁতভাবে ধরা নেই। কেমন কাগজে ছবি লেখা হত, কি কি বর্ণ সংযোগ হত, কোথায় কোথায় কেমন ধারা পালিশ দেওয়া হত ছবিতে, কত রকম তুলির টান, কত রকম রঙের খেলা, কত বিচিত্র ভাবভঙ্গি রেখার ও লেখার— এ সমস্ত এক-একখানি ছবি দেখে শেখা ছাড়া উপায় নেই। শাস্ত্রে কুলোয় না এত বিচিত্র প্রক্রিয়ার রহস্য সমস্ত হয়েছে ছবির মধ্যে ধরা মোগল বাদশাদের আমল পর্যন্ত, তারপর এসেছে ইউরোপ জাপান চীন থেকে নতুন নতুন প্রক্রিয়ায় রচনা করা ছবি। এর চেয়ে প্রকান্ড পরিষ্কার সুন্দর শিল্প ব্যাখ্যানের পুঁথি যার পাতায় পাতায় ছবি পাতায় পাতায় উপদেশ এমন আর কি হতে পারে! এই পুঁথির একখানি পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে চলেছে বিদেশের তারা কত অর্থব্যয়ে নিজেদের শিল্পজ্ঞান জাগিয়ে তুলতে। আর আমরা টাকার অভাবে একটা ছোটোখাটো চিত্রশালাও রাখতে পারছিনা দেশে। পাথরগুলো মন্দিরগুলো ভেঙে নেবার উপায় নেই— না হলে ভাস্কর্যশিল্পের নিদর্শন দেখে আর আমাদের কিছু শেখার উপায় বিদেশীরা রাখত না।
ভাবতে পারো original ছবির মূর্তি নাই হল, reproduction দেখেই আমরা শিল্পকাজে পাকা হয়ে উঠব, পুঁথি পড়ে পাকা হয়ে যাব,— এ মতের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলবার নেই। কেননা আফ্রিকার অধিবাসী যারা, কোথায় তাদের art gallery কোথায় বা তাদের শিল্পশাস্ত্র। ছবির দিক দিয়ে মূর্তির দিক দিয়ে দেশটা উজাড় হলে ক্ষতি এমন কিছু নয়। শুধু মরুভূমিকে চষে আমাদেরই আবার সবুজ করে তুলতে হবে, পূর্বপুরুষদের সঞ্চয় ও ঐশ্বর্য অন্যে ভোগ করে বড় হতে থাকবে? দেশের স্হাপত্যরক্ষার আইন তাড়াতাড়ি না হলেও ও-জিনিস সহজে দেশ থেকে নড়ত না, সময় লাগত। কিন্তু এইসব ছোটখাটো শিল্পসামগ্রী,— চমৎকার কাঁথা, চমৎকার শাড়ি, মনভোলানো খেলনা, চোখ-ঠিকরানো গহনাগাঁটি ঘটিবাটি অস্ত্রশস্ত্র এবং রামধনুকের প্রতিদ্বন্দ্বী চিত্রশালা উড়ে চলেছে বিদেশে। যদি এখন থেকে দেশে এদের রাখার চেষ্টা আইনের দ্বারা হোক পয়সার দারা হোক না করা হয় তবে শীঘ্রই শিল্পক্রিয়া আমাদের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাব। থাকবে শুধু বিদেশ যেটুকু ভিক্ষা দেবে, বিনা রোজগারে বিনা খাটুনির পাওনাটা।
শিল্পী হল ক্রিয়াশীল, শিল্প চাই তো ক্রিয়া করা চাই। তার প্রথম ক্রিয়া দেশেরটাকে দেশে ধরে রাখা, দ্বিতীয় ক্রিয়া বিদেশেরটাকে নিজের করে নেওয়া, তৃতীয় ক্রিয়া শিল্প সম্বন্ধে বক্তৃতা নয়,— করে চলা ছবি মূর্তি নাচ গান অভিনয় এমনি নানা ক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা একেবারেই করা নয় সেইটেই আগে শুরু করতে হল—বক্তৃতা দিতে হল। যেগুলো দরকারি প্রথম শিক্ষার পক্ষে— ছবির মূর্তির একটা যথাসম্ভব সংগ্রহ, তা হল না এ পর্যন্ত। ছবি সম্বন্ধে বই যা শেখাবে বক্তৃতা যা বোঝাবে তার চেয়ে ঢের পরিষ্কার ঢের সহজ করে বোঝাবে সত্যিকার ছবি— এটা করে বোঝাতে পারব লোককে তা জানিনে।
আমাদের ছবি মূর্তি ইত্যাদির একটা মস্ত সংগ্রহ চৌরঙ্গীতে রয়েছে। কিন্তু সেটার নাম আমরা দিয়েছি জাদুঘর। কোন দিন সেটা ফুঁয়ে উড়ে যাবে পুব থেকে পশ্চিমে তার ঠিক নেই। তখন আমাদের ঘর শূন্য। এই ভেবেই ছবি মূর্তি সাধ্যাতীত ব্যয় করেও ধরে রাখলেম, দু-চার জন শিল্পী তা দেখে শিখলে, কাজে এলো দু-চার দিন, তারপর এল দুঃসময়, চলল সব উড়ে বিদেশে— রূপো সোনার কাঠির স্পর্শে। এ আমি দেখতে পাচ্ছি— রইল না, দেশের শিল্প দেশে রইল না। বিদেশী এল, চোখে ধুলো দিয়ে নিয়ে গেল রাতারাতি ভাণ্ডার লুঠ করে। সকালে দেখি আমাদের ঘর শূন্য ভান্ডার খালি শুধু শিল্পী বসে একটা ভুয়ো কৌলীন্য মর্যাদা নিয়ে অথর্ব। আমরা বসে রয়েছি বাইরের দিকে চেয়ে। বাইরেটাও যে কত সুন্দর তার নীল আকাশ সবুজ বন আলো-আঁধার পশু-পক্ষী কীট-পতঙ্গ ফুল-ফল নিয়ে, তাও বুঝতে পারছিনে। মন ভাবছে না, হাত পা চলছে না, নিষ্ক্রিয় অবস্হায় হাত পেতেই বসে আছি। হঠাৎ কোনো একটা সুযোগ যদি এসে পড়ে এই আশায়। এই হল জাতীয় জীবনের সব দিক দিয়ে অতি ভয়ঙ্কর পক্ষাঘাতের প্রথম লক্ষণ— বাইরেটা রইল ঠিক কিন্তু ভিতরটা নিঃসার শিল্পের দিক দিয়ে। এই মানসিক এবং বাইরেও হাত-পায়ের পক্ষাঘাত নিবারণ কেবল শিল্পক্রিয়ার দ্বারা হতে পারে, বহুকাল ধরে হয়েও এসেছে। রাজ্য গেল রাজা গেল এমনকি ধর্মও অনেকখানি গেল যখন, তখন বাঁচবার রাস্তা হল মানুষের পক্ষে শিল্প। আপৎকালে শিল্পের উপর নির্ভর এটা শাস্ত্রের কথা। কেননা শাস্ত্রকাররা জানতেন ক্রিয়াশীলতা এবং ক্রীড়াশীলতা দুটোই শিল্পের এবং জীবনেরও লক্ষণ তাই ক্রিয়াভেদে তাঁরা কলাভেদ নির্ণয় করে গেলেন। “পৃথক পৃথক ক্রিয়াভির্হি কলাভেদস্তু জায়তে।”— (শুক্রনীতিসার)
টীকা
১. ৪/২৬৪ শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
২. ৪/২৬৫ শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
৩. ৪র্থ অধ্যায়, ৪৭২-৭৩ শ্লোক, শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
৪. ৪র্থ অধ্যায়, ৪৮০ শ্লোক, শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
৫. ১/৩ ৪র্থ অধ্যায়, শ্লোক, শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার
৬. ১/৩ ৪র্থ অধ্যায়, শ্লোক, শুক্রাচার্যকৃত শুক্রনীতিসার